২১. আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ

আত্মঘাতী ওয়াদা খেলাফ
একইশা অধ্যায়

১. আওয়ামী লীগের বিপর্যয়

৫ই আগস্ট তারিখে পূর্ব-বাংলা আইন পরিষদের স্পিকার-ডিপুটি স্পিকার নির্বাচন হইবে, এটা আগেই ঘোষণা করা হইয়াছিল। আমি আগের দিন ৪ঠা আগস্ট তারিখে ঢাকা পৌঁছিলাম। ঐদিনই খবরের কাগযে পড়িলাম, সুহরাওয়ার্দী সাহেব ১০ই আগস্ট তারিখে করাচিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বিশেষ বৈঠক আহ্বান করিয়াছেন। সুহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্ব সম্বন্ধে অধিকতর নিঃসন্দেহ হইলাম। ধরিয়া লইলাম প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন লাভের জন্যই এই সভা ডাল।

স্পিকার-ডিপুটি-স্পিকার নির্বাচনে আমরা হারিয়া গেলাম। সরকার পক্ষ পাইলেন ১৭০-১৭৭ ভোট, আর আওয়ামী লীগ পাইল ১২-৯৯ ভোট। আমি এতে নিরাশ হইলাম না। কারণ মন্ত্রিত্ব লাভে অসমর্থ হওয়ার পর আইন-পরিষদে মেজরিটি করার আশা সহজ ব্যাপার নয়। শুধুমাত্র মুসলিম-ভোটে গণ-পরিষদের নির্বাচনেই দেখা গিয়াছিল মুসলিম মেম্বারদের মধ্যেও আওয়ামী লীগ মেজরিটি নয়। তার উপর স্পিকার-ডিপুটি স্পিকার নির্বাচনে হিন্দু মেম্বাররা হক সাহেবের দলের পক্ষে ভোট দিবেন, এটা জানাই ছিল। এর একাধিক কারণও ছিল। আমাদের দেশে পার্টি-আনুগত্য এখনও দানা বাঁধে নাই। তাছাড়া সরকারী দলে থাকিলে নিজ-নিজ নির্বাচনী এলাকার জন্য বেশি কাজ করা যায়, এটাও বাস্তব সত্য। কাজেই প্রাদেশিক আইন-পরিষদের এই পরাজয় মানিয়াই লইয়াছিলাম। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের এই পরাজয় কেন্দ্রেও (গণ-পরিষদে) আমাদের পরাজয়ের পূর্বাভাস না হয়, এই প্রার্থনা করিতে-করিতে আমরা দিনই কাটি রওয়ানা হইলাম। কিন্তু কাটি রওয়ানার আগেই আর একটি খবর পাইলাম। সেটি এই যে অসুস্থতা-হেতু বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ দুটি নিয়াছেন; তাঁর জায়গায় ইস্কান্দর মির্যা অস্থায়ী বড়লাট হইয়াছে। সংবাদটিকে আমি শুভ মনে করিলাম না। কারণ আমাদের নেতা সুহরাওয়ার্দীর সাথে যা-কিছু ওয়ালী সওগল ও কিরা-কুরুক করিয়াছেন সবই গোলাম মোহাম্মদ সাহেব; মির্যা সাহেব তেমন কোনও ওয়াদায় বাধ্য নন। নিজের ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি হইতে গলা ফসকাইবার মতলবেই গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থতার অজুহাতে সাময়িকভাবে গা-ঢাকা দিলেন কি না, তাই বা কে জানে?

করাচি গিয়াই পড়িলাম একদম তোপের মুখে। গিয়া দেখিলাম মুসলিম লীগ পার্টির লিডার নির্বাচনে বিষম প্রতিযোগিতা ও তদুপযোগী প্রচারণা চলিতেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মধ্যে। বগুড়া যদি লিডার নির্বাচিত হন, তবে মেজরিটি পার্টি-লিডার হিসাবে তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকিয়া যান। কারণ তিনি বাংগালী। পক্ষান্তরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যদি লিডার নির্বাচিত হন, তবে যেহেতু তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী, সেই হেতু তিনি প্রধানমন্ত্রী হইবেন না, তিনি সুহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করিবার সুপারিশ করিবেন। এ অবস্থায় বগুড়ার বদলে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর লিডার নির্বাচিত হওয়াই আমাদের স্বার্থের অনুকূল। কাজেই আমরা অর্থাৎ জনাব আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আমি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পক্ষে ক্যানভাসে লাগিয়া গেলাম। আসলে ক্যানভাস করিবার কিছুই আমাদের ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তানের কোনও মেম্বরই মুসলিম লীগে ছিলেন না। মুসলিম লীগ পার্টির সব কয়জন মেম্বরই পশ্চিম পাকিস্তানী। তাঁদের কারও উপর আমাদের কোনও প্রভাব ছিল না। কাজেই আমাদের ক্যানভাসের কানাকড়ি মূল্য ছিল না। সেকথা আমরা সরলভাবে স্বীকার করিলাম চৌধুরী মোহাম্মদ আলীসহ মুসলিম লীগ বন্ধুদের কাছে। তবু তাঁরা আমাদেরে রেহাই দিলেন না। যুক্তি দিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলিম লীগারদের উপর আমাদের কোনও প্রভাব না থাকিলেও পশ্চিম পাকিস্তানী আওয়ামী নেতাদের ত আছে। তাঁদের মারফতেই আমাদের কাজ করা উচিত। কতকটা এই যুক্তিতে এবং কতকটা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে খুশী রাখিবার জন্য আমরা ক্যানভাসে নামিয়া পড়িলাম। কে, এস. পি. নেতাদের কেউ কেউ আমাদের এই অবাংগালী-প্রীতির কঠোর নিন্দা করিলেন। বাংগালী বগুড়ার নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব খসাইবার মত অশুভ ও অন্যায় কাজ করিয়া পূর্ব-বাংলার স্বার্থবিরোধী কাজ করিতেছি বলিয়াও শুধু মুসলিম লীগাররা নয়, অনেক কে, এস, পি. নেতাও আমাদের কাজের প্রতিবাদ করিলেন। আমরা তাঁদের বিরূপ সমালোচনা অগ্রাহ্য করিয়া চলিলাম। আমাদের যুক্তি সোজা। মুসলিম লীগ পার্টির নেতা বাংগালী বগুড়া হইলে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হইবেন। আর অবাংগালী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হইলে চুক্তি ও প্রথামত শহীদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হইবেন।

২. বিশ্বাস ভংগ

পরদিন ৭ই আগস্ট। বিকালেই মুসলিম লীগ পার্টির লিডার নির্বাচন। অসহ্য আগ্রহাতিশয্যে ঘরে বসিয়া থাকিতে পারিলাম না। ন্যাশনাল এসেমরি বিডিং–এ গিয়া লাইব্রেরির বই-পুস্তক ঘাটিয়া সময় কাটাইতে লাগিলাম। বস্তুতঃ ন্যাশনাল এসেরির লাইব্রেরিটি দেখিয়া আমি প্রথম দিনেই এত মুগ্ধ হইয়াছিলাম যে পরবর্তীকালে করাচি থাকাকালে অধিকাংশ সময় আমি এই লাইব্রেরিতে কাটাইতাম। যা হউক, লাইব্রেরিতে বসিয়া খবর পাইলাম, মুসলিম লীগ পার্টির সভা হইয়া গিয়াছে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী লিডার নির্বাচিত হইয়াছেন। এর অর্থ শহীদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হইয়া গিয়াছেন। কাজেই আমার আনন্দ আর ধরে না। শহীদ সাহেবকে এই শুভ সংবাদ দিবার জন্য ছুটিয়া লাইব্রেরি হইতে বাহির হইলাম। শহীদ সাহেব তখনও আইনমন্ত্রী। তাঁর বসিবার ঘর আমার জানা। ওটা এসেমরি বিডিং-এর দক্ষিণ অংশে। লাইব্রেরিটা বিডিং-এর উত্তর-পূর্ব অংশে। কাজেই বিডিং-এর পূর্ব দিককার দীর্ঘ বারান্দার সবটুকু মাড়াইয়া আমাকে শহীদ সাহেবের কামরায় যাইতে হইবে। সিঁড়িঘর পার হইয়া খানিকদূর আসিতেই খোদ চৌধুরী মোহাম্মদ আলী সাহেবের সাথে দেখা। হাসিমুখে সালামালেকুম দিয়াই বলিলাম কংগ্রেচুলেশন্স। চৌধুরী সাহেবও হাসিমুখে বলিলেন : ‘ওয়ালেকুম সালাম : মেনি থ্যাংকস’ বলিয়া অতিরিক্ত নুইয়া সালামের জবাব দিলেন ও মুসাফেহা করিলেন। আর কোনও কথা না বলিয়া ব্যস্ততার সংগে সামনের দিকে অগ্রসর হইলেন। আমিও শহীদ সাহেবের তালাশে আগ বাড়িলাম। দেখিলাম, তিনি অপর দিক হইতে আসিতেছেন। মুখ- হাসি লইয়া দূর হইতেই দরা গলায় বলিলাম শুনছেন ত? চৌধুরী মোহাম্মদ আলী লিডার ইলেকটেড হৈয়া গেছেন।

শহীদ সাহেব কোনও ভাবান্তর না দেখাইয়া সহজভাবে বলিলেন : হ্যাঁ শুনেছি।

গতি না থামাইয়া আমার হাত ধরিয়া চলিতে লাগিলেন।

আমি বলিলাম : এইমাত্র চৌধুরী সাহেবের সাথে আমার দেখা হইছে।

শহীদ সাহেব বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন : এরই মধ্যে বেশ তারপর?

আমি : তারপর আমি তাঁকে কংগ্রেচুলেট করলাম।

শহীদ সাহেব : বেশ করেছ। কিন্তু তিনিও কি তোমাকে কংগ্রেচুলেট করলেন?

‘একথার অর্থ কি? তিনি আমাকে কংগ্রেচুলেট করবেন কেন?’–আমি বলিলাম।

শহীদ সাহেব গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। বলিলেন : তবে তিনি তোমাকে। কংগ্রেচুলেট করেন নাই। অশুভ লক্ষণ।

আমি : এতে আপনি অশুভ কি দেখলেন?

শহীদ সাহেব : বোকারাম। কিছুই বুঝতেছ না? তাঁর ওয়াদা রক্ষার ইচ্ছা থাকলে তিনি তোমাকেই কংগ্রেচুলেট করতেন।

এতক্ষণে শহীদ সাহেবের কথার তাৎপর্য বুঝিলাম। কিন্তু তাঁর এই সন্দেহকে আমি অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলাম।

বাসায় ফিরিলাম।

গরমের দিন। লম্বা বিকাল। তবু বিকালের চা খাইতে প্রায় সন্ধ্যা হয়-হয়। এমন সময় খবর পাইলাম: বগুড়া প্রধান মন্ত্রিত্বে পদত্যাগ করিয়াছেন। নয়া মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য শহীদ সাহেব কমিশন পাইয়াছেন। লন্ডনের বি.বি.সি, হইতে এই ঘোষণা করা হইয়াছে। পাকিস্তান রেডিও হইতে না হইয়া বি.বি.সি. হইতে ঘোষণা? হইতে পারে। আমরা এখনও বৃটিশ ডমিনিয়ন ত।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তবে নিজের ওয়াদা রক্ষা করিয়াছেন। শুকর আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ চৌধুরী সাহেবকে। এমন ধার্মিক সত্যবাদী লোকটির প্রতি কি অন্যায় সন্দেহই না করিতেছিলাম। আমরা সবাই ছুটিলাম ক্লিফটনে শহীদ সাহেবের বাড়িতে। গিয়া দেখি এলাহি কারবার। কি ভিড়। সিঁড়িতে পর্যন্ত লোক ভর্তি। হইবেনা ভিড়। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িত।

অতি কষ্টে ভিড় ঠেলিয়া উপরে উঠিলাম। ভিতরে গেলাম। কামরা ভর্তি লোক। সাহেবের সাথে দেখা হইল। দেখা হইল মানে আমরা তাঁকে দেখিলাম। তিনি আমাদেরে দেখিলেন কিনা সেটা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু আমরা ধরিয়া নিলাম তিনি আমাদিগকে দেখিয়াছেন। লিডারের বেলা অধিকাংশ সময়ই অমন ধরিয়াই নিতে হইত। তাই আমরা গুজবের কথা বলিলাম। কমিশন আসিয়াছে কিনা জিগ্‌গাস করিলাম। উপস্থিত সকলেই প্রায় সমস্বরেই বলিলেন : ওটা গুজব নয়, সত্য। অনেকেই নিজ কানেবি.বি.সি, শুনিয়াছেন বলিলেন। কমিশন আসিল বলিয়া। সব ঠিক আছে। স্বয়ং বড়লাটের বাড়ির খবর। টাইপ-টুইপ হইতে একটু সময় কি আর লাগে না? শহীদ সাহেব মৃদু হাসিয়া বুঝাইলেন বক্তাদের কথা সত্য। কম্পিত বুকে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।অনেকে আসিলেন। তার মধ্যে অফিসার চেহারার লোকও ছিলেন অনেক। তাঁরা সবাই আসিলেন শহীদ সাহেবকে কংগ্রেচুলেট করিতে। বড়লাটের কমিশন লইয়া কেউ আসিলেন না। ইতিমধ্যে ঘন-ঘন যরূরী টেলিফোন আসিতে লাগিল। টেলিফোন হাতে নিয়াই কয়েকবারই শহীদ সাহেব আমাদের সবাইকে বাহিরে যাইতে বলিলেন। গোপনীয় কথা। হইবে না গোপনীয়? সম্ভবত বড়লাটের সাথেই প্রধানমন্ত্রীর কথা! প্রতিবারই বেশ অনেক্ষণ কথা বলার পর আমাদের ভিতরে ডাকিলেন। ইতিমধ্যে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীও তাঁর সংগে দেখা করিয়া গেলেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কি কথা হইল আমরা জানিলাম না। সন্ধ্যার পর শহীদ সাহেব, আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আমি এই তিনজনকে তাঁর গাড়িতে লইয়া বাহির হইলেন। সোজা গিয়া হাযির হইলেন অস্থায়ী বড়লাট ইস্কান্দর মির্যার বাড়িতে।

. ষড়যন্ত্র

মির্যা সাহেবড়লাট হইয়াছেন বটে কিন্তু তখনও বড়লাট ভবনে উঠিয়া যান নাই। ভিক্টোরিয়া রোডের অদূরে যে বাড়িতে তিনি আগে হইতে থাকিতেন সেখানেই রহিয়াছেন। বোঝা গেল, টেলিফোনে কথা হইয়াই ছিল। কারণ দেখিলাম মির্যা সাহেব দরজায় দাঁড়াইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। শহীদ সাহেব ভিতরে গেলেন না। আমরা থ্রি মাক্কিটিয়ার্সকে মির্যার হাতে সমর্পণ করিয়া তিনি খানিক পরে আসিতেছেন বলিয়া চলিয়া গেলেন।

মির্যা সাহেব আমাদের লইয়া ড্রইংরুমে ঢুকিলেন। আলোচনা তিনি একতরফা ভাবেই শুরু করিলেন। তিনি যা বলিলেন তার সারমর্ম এই যে শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করার ইচ্ছা তাঁর নিজের এবং পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সকলেরই আছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই শহীদ সাহেবের কেসটা খারাপ করিতেছি কড়া-কড়া শর্ত দাবি করিয়া। আমরা যদি একটু নরম না হই, তবে শহীদ সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্ব বিপন্ন হইতে পারে। আমরা জবাবে বলিলাম যেনূতন কোনও শর্ত-টত ত আমরা দেই নাই; মারিতে যে পাঁচদফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হইয়াছিল তাতেই ত আমরা অটল আছি। মির্যা সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন : মারি চুক্তির চেয়ে বেশি আমরা দাবি করিতেছি। প্রমাণ স্বরূপ তিনি বলিলেন যে তফসিলী হিন্দু নেতারা তার সাথে দেখা করিয়া বলিয়াছেন যে আওয়ামী লীগ নাকি তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কয়েক বছরের জন্যও রিয়াভেশন দিতে রাযী না। এটা নাকি তাঁদের সংগে চুক্তির খেলাফ। বর্ণহিন্দু নেতাদের অনেকে মির্যা সাহেবের সাথে দেখা করিয়া নাকি তফসিলীদের এই দাবি সমর্থন করিয়াছেন। মির্যা সাহেব আরও বলিলেন যে আমরা প্যারিটির ব্যাপার নিয়া বাড়াবাড়ি করিতেছি।

আমরা তিনজনেই মির্যা সাহেবের এইসব কথা অস্বীকার করিলাম। প্রমাণ স্বরূপ মারি-চুক্তি-পত্র দেখিতে তাঁকে অনুরোধ করিলাম। তিনি বলিলেন : ‘হাতে পাঁজি মংগল বারের’ দরকার কি? তাঁর কাছে ঐ চুক্তিনামার এক কপি আছে। এখনই তা দেখা যাইতে পারে। মির্যা সাহেব ঘন্টা বাজাইয়া তাঁর সেক্রেটারিকে মারি-চুক্তিনামা আনিতে বলিলেন। সেক্রেটারি সাহেব অল্পক্ষণেই এক টুকরা টাইপ-করা কাগ হাযির করিলেন।

একটা দস্তখতহীন কাগযের টুকরা। আমাদের মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়াই মির্যা সাহেব বলিলেন : ওটা অবশ্য অরিজিনাল নয়, টু কপি। আমরা তিন বন্ধুতে এক সংগে বুকিয়া পড়িয়া কাগযটি পড়িয়া ফেলিলাম। কাগটিতে পাঁচ-দফা এইভাবে ইংরাজীতে লেখা আছে :

(১) ওয়ান ইউনিট

(২) রিজিওন্যাল অটনমি

(৩) প্যারিটি ইন রিপ্রেয়েন্টেশন

(৪) জয়েন্ট ইলেকটরেট উইথ রির্ভেশন ফর শিডিউলড কাস্ট হিন্দুয ফর টেন ইয়ার্স

(৫) টু স্টেট ল্যাংগুয়েজেয–উর্দু এণ্ড বেংগলি।

আমরা অবাক হইলাম। প্রতিবাদ করিলাম। এটা মারি-চুক্তির ট্রু কপি নয়, বলিলাম। দুই নম্বর দফায় ‘রিজিওন্যাল অটনমির‘ আগে ‘ফুল’ কথা ছিল, সেটা বাদ দেওয়া হইয়াছে। তিন নম্বর দফায় প্যারিটির পরে “ইন অল রেসপেক্টসের” স্থলে “ইন রিপ্রেয়েন্টেশন” লেখা হইয়াছে। চার নম্বর দফায় ‘উইথ রিযার্ভেশন ইত্যাদি’ কথা নূতন যোগ করা হইয়াছে।

এইসব পরিবর্তন কে করিল? কবে করিল? স্বাক্ষরিত চুক্তিনামায় কোনও পরিবর্তন করার অধিকার কারও নাই। আমরা অরিজিনাল চুক্তিনামা দেখিতে এবং দেখাইতে বড়লাটকে অনুরোধ করিলাম। খুব জোরের সংগেই বলিলাম,দুরভিসন্ধিমূলে কেহ বড়লাটকে ঐ বিকৃত নকল দিয়াছেন।

বড়লাট মির্যা সাহেব উক্ত নকলের খাঁটিত্ব লইয়া আমাদের সাথে তর্ক করিলেন না। বরঞ্চ তিনি প্রথমে তফসিলী হিন্দুদের জন্য রিতেশনের প্রয়োজনীয়তার উপর বক্তৃতা করিলেন। দশ বছর নাই হোক, অন্ততঃ পাঁচ বছর দিতে আমাদের আপত্তি করা উচিৎ নয়, এই উপদেশ আমাদেরে দিলেন। আমরা মির্যা সাহেবের মূল্যবান বক্তৃতার সারমর্ম হম করিতে-করিতে বিদায় হইলাম। কারণ ইতিমধ্যে শহীদ সাহেব স্বয়ং আমাদের নিতে আসিলেন। আমরা তিন বন্ধুই মির্যার কথা একই রকম বুঝিলাম। তা এই যে (১) মির্যাসাহেব এবং সম্ভবতঃ মুসলিম লীগ-নেতারা কংগ্রেস ও তফসিলী হিন্দুদের সাথে একটা পৃথক সমঝোতার চেষ্টা করিতেছেন বা করিয়া ফেলিয়াছেন; (২) মুসলিম লীগ নেতারা শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করার ওয়াদা হইতে গলা ফসকাইবার সাধ্যমত চেষ্টা করিতেছেন।

বড়লাটের নিকট হইতে ফিরিবার পথেই গাড়িতে শহীদ সাহেবকে সব কথা বলিলাম এবং আমাদের আশংকার কথাও তাঁকে জানাইলাম। সব শুনিয়া শহীদ সাহেব বলিলেন : কোনও চিন্তার কারণ নাই। সব ঠিক আছে। হয়ত আগামীকালই একটা সুখবর পাইবে।

আমরা আশা-নিরাশার মধ্যে রাত কাটাইলাম বটে, কিন্তু পরদিন ৮ই আগস্ট সত্যই সুখবর পাইলাম। মুসলিম লীগ পার্টির তরফ হইতে একটা ঘোষণা খবরের কাগযে বাহির হইয়াছে। তাতে বলা হইয়াছে, মুসলিম লীগের বৈঠকে মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগ কোয়েলিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। শহীদ সাহেবকে কোয়েলিশনের নেতা হিসাবে গ্রহণ করা হইয়াছে। ঐ সংবাদে আরও বলা হইয়াছে যে শহীদ সাহেব তাঁর মন্ত্রিসভার নামের তালিকাও প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছেন। প্রদিনই শপথগ্রহণ কার্য সম্পন্ন হইবে।

বুঝিলাম আমাদের সন্দেহ অমূলক। শহীদ সাহেবের কথাই ঠিক। যতই হউক, তিনি আমাদের চেয়ে বেশি খবর রাখেন ত। ঐ সংবাদটির সংগে-সংগে আরেকটি খবরও ঐদিনকার কাগযে বাহির হইয়াছে। ভাতে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বলিয়াছেন যে, মুসলিম লীগ পার্টি চৌধুরী সাহেবকেই মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতা দিয়া প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে। আমরা চৌধুরী সাহেবের ঘোষণা ভাল অর্থেই গ্রহণ করিলাম। মুসলিম লীগ পার্টি তাদের লিডারকে মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতা ত দিবেই। সেই ক্ষমতাবলেই ত তিনি শহীদ সাহেবেকে মন্ত্রিসভা গঠনের অনুরোধ করিবেন এবং শহীদ সাহেবকে কমিশন করিবার জন্য বড়লাটকে সুপারিশ তিনিই করিবেন। পার্লামেন্টারি পদ্ধতি অনুসারে বড়লাটের উপর মেজরিটি পার্টির লিডারের সে সুপারিশ বাধ্যকর হইবে।

সেদিন ৮ই আগস্ট ছিল গণ-পরিষদের বৈঠক শুরু হওয়ার কথা। আমরা সে বৈঠকে গেলাম। জনাব গুরমানীর সভাপতিত্বে পরিষদের বৈঠক বসিল। কিন্তু তখনও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়ায় গণ-পরিষদের কাজ হইতে পারিল না। পরবর্তী ১২ই আগস্ট সরিখে স্পিকার-ডিপুটি-স্পিকার নির্বাচন হইবে ঘোষণা করিয়া ঐ তারিখ পর্যন্ত পরিষদের বৈঠক মুলতবি হইল। গণ-পরিষদ মুলতবি হওয়ায় মন্ত্রিসভা লইয়া জল্পনা করা ছাড়া আমাদের আর কাজ থাকিল না। এমন অবসর পাইলে আমি সাধারণতঃ সিনেমা দেখিয়াই সময় কাটাইতাম। কিন্তু আজ ত সিনেমা দেখা যায় না। আজ আমাদের নেতা শহীদ সাহেবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে পাঁচ-দফা চুক্তির সাফল্যে পূর্ব-বাংলার ভাগ্য তথা সারা পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির করিতেছে সরল আন্তরিকতার সংগেই তখন এ কথা বিশ্বাস করিতাম। কাজেই এতবড় গুরুতর দায়িত্ব ফেলিয়া সিনেমা দেখা ত যায় না। দেশের জন্য সিনেমা দেখা স্যাক্রিফাইস করিলাম।

কিন্তু সারাদিনটা অমনি-অমনি গেল। কিছুই ঘটিল না। শহীদ সাহেব কমিশন পাইলেন না। পরদিন ১ই আগস্টও কমিশন আসিল না। লাতের মধ্যে খবর পাইলাম যে মুসলিম লীগ নেতারা কে.এস.পি. ও তফসিলী সহ কতিপয় হিন্দু নেতার সাথে দেন-দরবার চালাইয়াছেন। এমনও খবর পাইলাম যে ১৩ জন কে.এস.পি. ও ৫ জন হিন্দু মেম্বর বিনাশর্তে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রিত্ব মানিয়া লইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। কে.এস.পি-র বন্ধুদের সংগে সাক্ষাৎ করিয়া কথাটার সত্যতা যাচাই করিবার চেষ্টা করিলাম। তাঁরা যদিও এই খবরের সত্যতা অস্বীকার করিলেন, তবু আমরা তাঁদের কাছে আমাদের অভিমত ব্যক্ত করিয়া বলিলাম : যদি শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী মানিতে আপনাদের আপত্তি থাকে, তবে হক সাহেবকেই প্রধানমন্ত্রী করুন, আমরা আওয়ামী লীগ তা মানিয়া লইব। তবু পূর্ব-বাংলার প্রতিনিধিদেরে দুই ভাগ হইতে দিব না। আমাদের কথা দুই-চার জন কে.এস.পি. নেতা উৎসাহের সংগে গ্রহণ করিলেন এবং পার্টিতে আলোচনা করিবেন বলিয়া কথা দিলেন। এঁরা পরে দুঃখের সংগে জানাইলেন যে ব্যাপার অনেক দূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছে, এখন আর পিছাইবার উপায় নাই।

সারাদিনই শহীদ সাহেবের বাসায় যাতায়াত করিয়া কাটাইলাম। জানিতে পারিলাম, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ঐদিন একাধিকবার শহীদ সাহেবের সহিত মোলাকাত করিয়া তাঁকে ডিপুটি-প্রধানমন্ত্রিত্ব অফার করিয়াছেন। নামে মাত্র চৌধুরী সাহেব প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন। আসলে ডিপুটি-প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবই প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন। এই ধরনের কথা চৌধুরী সাহেব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিষ্ট ও বিনয়-নম্র ভাষায় বলিয়া প্রস্তাবটিকে লোভনীয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। শহীদ সাহেব নিজে এবং আমরা সকলে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিলাম।

সন্ধ্যার দিকে শহীদ সাহেব তাঁর ‘থ্রি মাস্কটিয়ার্স’ আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আমাকে এক কোণে ডাকিয়া নিয়া বলিলেন : ‘তোমরা এক্ষুণি পাঞ্জাব হাউসে গুরমানী সাহেবের সংগে দেখা কর।’

আমরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের প্রতি আস্থা হারাইয়াছি। কাজেই বলিলাম : ‘রমানী সাহেবের সাথে দেখা করিয়া কোনও লাভ আছে?’

শহীদ সাহেব বলিলেন : ‘লাভ-লোকসানের কথা নয়। গুরমানী সাহেব তোমাদের তিন জনের নাম করিয়াই তাঁর সাথে দেখা করিতে অনুরোধ করিয়াছেন। তোমাদেরে পাঠাইব বলিয়া আমি ওয়াদা করিয়াছি।‘

৪. আশা কুহকিনী

নেতার ওয়াদা রক্ষার জন্য কতকটা, আর মানুষের আশার শেষ নাই বলিয়াও কতকটা, আমরা গুরমানী সাহেবের সাথে দেখা করিতে পাঞ্জাব হাউসে গেলাম। শহীদ সাহেবের গাড়িতেই গেলাম। লোকজন আমাদের জন্য সিঁড়িতেই দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। বোঝা গেল, আমাদের পাঠাইয়া শহীদ সাহেব গুরমানী সাহেবকে ফোন করিয়া দিয়াছেন। লোকজনের মধ্যে অফিসার-গোছের একজন আমাদের পথ দেখাইয়া গুরমানী সাহেবের ড্রইংরুমে নিয়া গেলেন। ঢুকিয়াই দেখিলাম একদম ‘হাউস ফুল’। এক চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের নেতারা সেখানে জমায়েত হইয়াছেন। জনাব গুরমানী ছাড়া দওলতানা, চুন্দ্রিগড়, দস্তী, খুরো, রাশদী, তালপুর ও হারুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সকলে উঠিয়া অতিরিক্ত তাযিমের সাথে আমাদেরে অভ্যর্থনা করিলেন। আমরা না বসা পর্যন্ত কেউ বসিলেন না। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। আমরা তিন বন্ধুতে চাওয়া-চাওয়ি করিলাম। সব ফতেহ কোনও আশা নাই।

গুরমানী সাহেবই প্রথমে কথা বলিলেন। তিনি প্রথমে আমাদেরে জানাইলেন যে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী একটা যরুরী কাজে আটকিয়া যাওয়ায় তাঁর আসিতে একটু দেরি হইবে। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনা চলিতে থাকুক। আলোচনার বিষয় কি আমরা জানিতাম না বলিয়া আমরা চুপ করিয়া রহিলাম। গুরমানী সাহেব তাঁর স্বভাব সিদ্ধ মিঠা যবানে ডিপ্লম্যাটিক ল্যাংগুয়েজে অনেক আকাশ-পাতাল ভ্রমণ করিয়া যা বলিলেন তার সারমর্ম এই : শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিবার পথে বিপুল বাধা সৃষ্টি হইয়াছে। সেসব বাধার মধ্যে মাত্র দুইটির কথাই তিনি বলিতেছেন। প্রথমতঃ আওয়ামী লীগ পূর্ব-পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি নয়। তবু তাঁরা প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং তার সাথে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও সর্ব-বিষয়ে প্যারিটি দাবি করিতেছেন। নিরঙ্কুশ যুক্ত-নির্বাচন দাবি করার দরুন হিন্দু সদস্যরাও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করিতেছেন না। পক্ষান্তরে হক সাহেবের যুক্তফ্রন্ট পার্টি পূর্ব-পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি হইয়াও প্রধানমন্ত্রিত্ব দাবি করিতেছে না। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকেই তাঁরা প্রধানমন্ত্রী করিতে রাযী আছেন। প্যারিটি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে তাঁদের কোন দাবি নাই। এর উপর হিন্দু মেম্বররাও হক সাহেবের পার্টিকেই সমর্থন করিতেছেন। এ অবস্থায় শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিতে মুসলিম লীগ পার্টিকে আর কিছুতেই রাযী করান যাইতেছে না। দ্বিতীয়তঃ শহীদ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম বিশিষ্ট ও সম্মানিত মুসলিম লীগ নেতা জনাব খুরোর বিরুদ্ধে বিষোদগার করিয়া অবস্থা এমন তিক্ত করিয়া ফেলিয়াছেন যে গুরমানী সাহেব সহ উপস্থিত সকল নেতার সমবেত চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ পার্টি মেম্বরগণকে শহীদ সাহেবের প্রতি নরম করা যাইতেছে না। সেজন্য গুরমানী সাহেব সহ উপস্থিত সকল লীগ-নেতাই খুব দুঃখিত। শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিবার যে ওয়াদা তাঁরা করিয়াছিলেন, সে ওয়াদা রক্ষা করিতে পারিলেন না বলিয়া তাঁরা নিরতিশয় লজ্জিত।

বলিলেন বটে লজ্জিত কিন্তু কারও মুখে লজ্জার কোনও লক্ষণ দেখিলাম না। তাছাড়া নবাব গুরমানী সাহেবের মেহমানদারিও নবাবের মতই। তাঁর একতরফা মিষ্টি বক্তৃতার সাথে-সাথে আমাদের মধ্যে প্রচুর মিষ্টিকেক-পেটিস ও চা-কফি বিতরণ করা হইতেছিল। উপস্থিত সকলে সে সব গলাধঃকরণে ব্যস্ত থাকায় তাঁদের চোখে মুখে লজ্জার ভার থাকিলেও তা ধরা সম্ভব ছিল না। পক্ষান্তরে গুরমানী সাহেবের মিঠা বক্তৃতায় আমরা এমন আসুদা হইয়া গিয়াছিলাম যে তাঁর চা-বিস্কুটের মিষ্টতা আমাদের তেমন মুখরোচক হইল না। আমরা গুরমানী সাহেবের এই ভদ্রতার জন্য তাঁকে হাজার হাজার ধন্যবাদ দিয়া বিদায় হইলাম।

৫. চৌধুরী মন্ত্রিসভা

পরদিন ১০ই আগস্ট চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করিলেন। যুক্তফ্রন্ট নামে কৃষক-শ্রমিক পার্টি, কংগ্রেস ও তফসিলী সকলেই মন্ত্রিত্ব লইয়া সে মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। স্বয়ং হক সাহেব চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর অধীনে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হইলেন। আওয়ামী লীগার ও কে.এস.পি-রা একই সোমারসেট হাউসে অথবা নিকটবতী বেলুচ মেসে থাকিতাম বলিয়া আগের রাত্রেও কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে পাঁচ-দফা চুক্তি আদায়ে আমাদের সহযোগিতা অফার করিয়াছিলাম। কিন্তু তাঁরা তখন মন্ত্রিত্ব লইয়াই ব্যস্ত। আমাদের কথাকে তাঁরা বোধ হয় ভাংগানির মতলব মনে করিলেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র হামিদুল হক চৌধুরী ও মোহন মিয়া সাহেবই আমাদের প্রস্তাবের আন্তরিকতায় বিশ্বাস করিলেন বলিয়া মনে হইল। কিন্তু তাঁদের উপদেশও অগ্রাহ্য করিয়া হক সাহেব যখন পরদিন বিনাশর্তে নিজের মর্যাদা হানিকর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন তখন মোহন মিয়া দুঃখিত হইলেন এবং হামিদুল হক মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করিলেন।

পরদিন ১১ই আগস্ট আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আমি এক যুক্ত বিবৃতি দিলাম। তাতে পাঁচ-দফা-চুক্তির উল্লেখ করিলাম। যুক্ত ফ্রন্ট একটু শক্ত হইলে যে আমরা ঐ সব শর্ত আদায় করিতে পারিতাম, সে কথাও বলিলাম। আমাদের অন্তবিরোধের ফলে ১৯৫৪ সালের অতবড় জয়টা এমনি করিয়া ব্যর্থ হইয়া গেল।

এরপর আমাদের অপযিশনের পালা শুরু। প্রথমেই আসিল সাবেক গবর্নর জেনারেল কর্তৃক রচিত ৩৯টি বেআইনী অর্ডিন্যান্স দুরস্ত করার বিল। ফেডারেল কোর্টের রায়ে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল যে ঐ আইনগুলি নয়া গণ-পরিষদকে দিয়া ভ্যালিডেট করিতে হইবে। এইগুলি হইয়া যাইবার পর আসিল পশ্চিম-পাকিস্তান একত্রীকরণ বিল। অর্ডিন্যান্সরূপে এ ব্যবস্থা ইতিপূর্বেই প্রযুক্ত হইয়া গিয়াছিল। ব্যাপারটাকে আইন-সম্মত করা মাত্র। তবু আমরা ইহার জোর বিরোধিতা করিলাম। তিন কারণে : (১) পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রীকরণের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত পূর্ব-বাংলার স্বার্থ-সম্পর্কিত পাঁচ-দফা-চুক্তির অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়া একতরফাভাবে এই বিল আনা হইয়াছে। (২) পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসমূরে গণভোট ব্যতিরেকে শুধু মুসলিম লীগ পার্টির দলীয় চাপে প্রদেশগুলি ভাংগিয়া দেওয়া হইতেছে। (৩) প্রদেশগুলির অস্তিত্ব বজায় রাখিয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসিত যোনাল ফেডারেশনরূপে চারটি প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি একত্র করার বদলে উহাদের অস্তিত্ব বিলোপ করিয়া গোটা পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি প্রদেশ করা হইয়াছে। বিরোধী দলের পক্ষ হইতে আমিই প্রথম বক্তৃতা করিলাম। আমার সুদীর্ঘ বক্তৃতার মূলকথা ছিল দুইটি : (১) পূর্ব-বাংলার দাবি মত পাঁচ-দফা-চুক্তি কার্যকরী করা (২) পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখিয়া পূর্ব বাংলায় সমান-ক্ষমতাভোগী একটি যোনাল সাবফেডারেশন করা। লাহোরের ‘পাকিস্তান টাইমস’ আমার এই প্রস্তাবকে ‘মনসুর প্ল্যান’ নামে যথেষ্ট পাবলিসিটি দিয়াছিলেন।

মুসলিম লীগের দলীয় শৃংখলার খাতিরে বিভিন্ন প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দ সকলেই সরকারী বিল সমর্থন করিলেও তলে-তলে অনেকেই এবং গণ-পরিষদের বাইরের প্রায় নেতৃবৃন্দই এই প্ল্যান সমর্থন করিয়াছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ পার্টি যুক্তফ্রন্টের সমর্থনে মেজরিটির স্টিমরোলার চালাইয়া এক ইউনিট আইন পাস করাইয়া ফেলিলেন। এটা ১৯৫৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বরের ঘটনা। দুইদিন পরেই ৩রা অক্টোবর গবর্নর-জেনারেলের অনুমোদন সহ উক্ত আইন গেযেট হইয়া গেল। ৬ই অক্টোবর নয়া প্রদেশের গবর্নর হইলেন নবাব মুশতাক আহমদ গুরমানী। অর্ডিন্যান্সের-বলে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের গবর্নর তিনি আগে হইতেই ছিলেন। এবার ডাঃ খান সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্বে নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়া গেল। সবই রেডিই ছিল। ১৪ই অক্টোবর জাবেতা তাবে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হইল।

৬. শাসনতন্ত্র রচনা

অতঃপর ১৯৫৬ সালের ১২ জানুয়ারি হইতে শাসনতন্ত্র রচনায় হাত দেওয়া হইল। সর্ব-সম্মত শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সকল প্রকার চেষ্টা করিলাম। পাকিস্তানের বয়স আট বছর হইয়া যাওয়ার পরেও শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া একটা পরম লজ্জার ও দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল। এ সম্বন্ধে পযিশন দল ও অপযিশন দলের সবাই একমত হইলাম। সেজন্য শাসনতন্ত্র রচনার কাজে সহযোগিতা করিতে আমরা সর্বদাই প্রস্তুত ও আগ্রহশীল ছিলাম। অপযিশন বলিতে তখন কার্যতঃ এক আওয়ামী লীগ। গোড়াতে কিছুদিন অপযিশনে বসিয়া অবশেষে হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবও মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ব্যতীত আর যাঁরা অপযিশনে রহিলেন, তাঁদের মধ্যে জনাব ফিরোয় খা নুন ও নবাব মোযাফফর আলী কিযিলবাস ও আযাদ পাকিস্তান পার্টির একমাত্র প্রতিনিধি মিয়া ইফতিখারুদ্দিন এবং স্বাধীন মুসলিম লীগ-মেম্বর জনাব ফযলুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে এঁরা কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থন না করায় শাসনতন্ত্রকে গণমুখী করিবার ব্যাপারে এঁরা কোনও কাজে লাগিলেন না। ফলে পাঁচ দফা মারি-চুক্তি কার্যকরী করিবার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইলাম। যুক্ত-নির্বাচন প্রথাও গ্রহণ করা হইল না। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ত দূরেই থাকিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে অধিকতর সংকুচিত করা হইল। আমাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা ‘জীবন-মরণ সংগ্রামের পথ’ বাছিয়া লইলাম।

এবারও আমি অপযিশনের ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যান’ হইলাম। এর আগেই আমি ১৬৭টি সংশোধনী দাখিল করিয়া রাখিয়াছিলাম। সাধারণ আলোচনার বিতর্কে প্রথম বক্তা হিসাবে আমি একনাগাড়ে দুই দিনে সাত ঘন্টা সময় লইয়াছিলাম। অবশ্য এই সাত ঘন্টার মধ্যে ডিপুটি-স্পিকারের বাধা দানে অনেক সময় নষ্ট হইয়াছিল। তবু আমার বক্তৃতায় (১) পূর্ব-বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আবশ্যকতা; (২) ভৌগোলিক অবস্থার হেতু অর্থনৈতিক বিভিন্নতা; (৩) ঐতিহ্যিক ও কৃষ্টিক পার্থক্য; {4) পূর্ব-বাংলার প্রতি ক্রিমিন্যাল ঔদাসীন্য; (৫) রাষ্ট্রের আয়ের প্রায় সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়ের ভয়াবহ পরিণাম; (৬) অর্থনেতিক অসাম্য; (৭) চাকরিতে পূর্ব বাংগালীর শোচনীয় অবস্থা; (৮) তিন সাবজেক্টের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করিতে পারিয়াছিলাম। ১৯৫৬ সালের ১৬ই ও ১৭ই জানুয়ারির গণ-পরিষদের ‘ডিবেট’ বা প্রসিডিং-এর সরকার প্রকাশিত বিবরণী হইতে দেখা যাইবে যে বিনা বাধায় আমি অগ্রসর হইতে পারি নাই। কিন্তু অত বাধা দিয়াও ডিঃ স্পিকার মিঃ গিবন আমাকে ক্লান্ত, বিরক্ত ও রাগান্বিত করিতে পারেন নাই। আমি অসিমুখে তাঁর বাধা ঠেলিয়া অগ্রসর হইতেছিলাম। আমার ধৈর্য দেখিয়া আমার নেতা অপযিশন লিডার মিঃ সুহরাওয়ার্দী পর্যন্ত তার হইয়াছিলেন। মিঃ গিবনের পুনঃপুনঃ বাধা দানে আপত্তি করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন : মিঃ ডিপুটি স্পিকার, বক্তাই অপযিশন দলের প্রথম বক্তা; তাঁকে বিনা বাধায় বক্তৃতা করিতে দিন। আপনি তাঁর বক্তৃতার ধারা পছন্দ নাও করিতে পারেন কিন্তু এটা তাঁর নিজস্বধারা।

ডিপুটি স্পিকার মিঃ গিবন মিঃ সুহরাওয়ার্দীকে বাধা দিয়া বলেন : ‘কে বলিয়াছে আমি তাঁর বক্তৃতার ধারা পসন্দ করি না? আমি তাঁর ধারা খুবই পসন্দ করি। আপনি এঁর বক্তৃতার গোড়ার দিকে এখানে ছিলেন না বলিয়াই আপনি শুনেন নাই, আমি এর সম্পর্কে কি বলিয়াছি। আমি বলিয়াছি : মিঃ আবুল মনসুর একজন ‘লাভেবল লইয়ার (প্রিয়ভাষী উকিল)’।

জনাব সুহরাওয়ার্দী : ‘সে কথা সত্য। কিন্তু তবু আমি বলিতেছি যে আপনি যখন এর বক্তৃতায় ঘনঘন বাধা দিতেছিলেন তখন আমি তাঁর পাশে বসিয়া এই কথাটাই ভাবিতেছিলাম : আমি নিজে অত বাধা পাইলে একবিন্দু অগ্রসর হইতে পারিতাম না এবং বক্তৃতার খেই হারাইয়া ফেলিতাম।‘

৭. শাসনতন্ত্রের বাঞ্ছিত মূলনীতি

আমি নামকরা বাগ্মী নই। কিন্তু দেওয়ানী উকিল। এতক্ষণ ধরিয়া বক্তৃতা করিতে পারিয়াছিলাম আমার কাছে বিষয়-বস্তু তথ্য-পরিসংখ্যা প্রচুর ছিল বলিয়া। আমি অনেক বই-পুস্তক পড়িয়া ঐ বক্তৃতার জন্য তৈয়ার হইয়াছিলাম। আমি জানিতাম, আমি মাঠে-ময়দানে জনসভায় বক্তৃতা করিতে যাইতেছি না, গণ-পরিষদে শাসনতন্ত্রের কাঠামোর উপরে বক্তৃতা করিতে যাইতেছি। আমার বক্তৃতায় শাসন সম্পর্কে এই কয়টি মূলনীতির অপরিহার্যতা উল্লেখ করিয়াছিলাম : (১) পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত হইতে হইবে। কারণ (ক) লাহোর প্রস্তাব একটি নির্বাচনী ওয়াদা। উহারই ভিত্তিতে ভারতের মুসলমান ভোটাররা ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়াছিল। (খ) লাহোর প্রস্তাব তদানীন্তন ভারতের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসমূহের মধ্যে একটা পবিত্র চুক্তি। এই চুক্তির পক্ষগণের সকলের সম্মতি ব্যতীত কোনও এক পক্ষের ইচ্ছায় এই চুক্তির রদ-বদল হইতে পারে না। (গ) লাহোর প্রস্তাব একটি দূরদশী, বাস্তবধর্মী, সুচিন্তিত পরিকল্পনা। পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান, দুই অঞ্চলের ভাষিক, কৃষ্টিক ও ঐতিহ্যিক পার্থক্যের উপর ভিত্তি করিয়াই উহা রচিত হইয়াছে; (ঘ) মুসলিম লীগের পরবর্তী অধিবেশনের কোনও প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব সংশোধিত বারিবর্তিত হয় নাই; ইবার কোনও কারণ ও অধিকার ছিল না; (ঙ) পূর্ব-পাকিস্তানের ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ওয়াদা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত। পূর্ব-পাকিস্তানের উহা জাতীয় দাবি এবং পূর্ব পাকিস্তানী প্রতিনিধিদের উহা পবিত্র ওয়াদা। (চ) উক্ত ২১ দফা ওয়াদার ১৯ দফায় যে তিন বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের কথা বলা হইয়াছে, উহা অবাস্তব-অসাধ্য দাবি নয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বৃটিশ সরকারের কেবিনেট মিশন যে গ্রুপিং সিস্টেম ও ফেডারেল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়াছিল তাতেও তিন-বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থা ছিল। (ছ) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত না হইলে তা পরিণামে যে টিকিবেও না, দেশবাসী তা গ্রহণ করিবে না, সে কথা লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই সুস্পষ্ট হুশিয়ারি স্বরূপ উচ্চারিত হইয়াছে।

লাহোর প্রস্তাব ব্যতীত অন্য কোনও বুনিয়াদে যে পাকিস্তানের শাসনত্ম রচিত হইতে পারে না, তা দেখাইতে গিয়া আমি বলিয়াছিলাম। (২) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আসলে দুইটি দেশ, (৩) উহাদের বাশেন্দারা আসলে দুইটি জাতি; (৪) দুই পাকিস্তানের আসল সমস্যা রাজনৈতিকের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক; কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ দুই-এর এক ও অজি নয়; (৫) সরকারী আয় জনগণের ব্যয়, সরকারী ব্যয় জনগণের আয়, এই নীতিতে সরকারী ব্যয় হইতে পূর্ব-বাংলার কোনও লাভ হয় নাই; (৬) পূর্ব-বাংলা হইতে যে টাকা পশ্চিমে আসে, তা আর ফিরিয়া যায় না। এটা কার্যতঃ একরোখা অর্থনীতি; (৭) এই একরোখা অর্থনীতির বিষময় পরিণাম কিভাবে দেশের অনিষ্ট সাধন করিতেছে তা দেখাইতে গিয়া আমি সরকারী স্টেটিসটিকস্ হইতে বিস্তারিতভাবে ‘ফ্যাট এও ফিগার্স কোট’ করিয়া দেখাইয়াছিলাম।

(ক) দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় এবং দুই অঞ্চলের মধ্যে মবিলিটি অব লেবার ও ক্যাপিটেল না থাকায় সরকারী সমস্ত ব্যয়ের, সরকারী গৃহনির্মাণাদি সাকুল্য খরচের, সবটুকু সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তান পাইতেছে। পূর্ব ঋকিস্তান এর একবিন্দুসুবিধা পাইতেছেনা।

(খ) শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সব প্রতিষ্ঠান পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত ও এখান হইতে পরিচালিত হওয়ায় এই সবের সকল সুবিধাই আঞ্চলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতি সাধন করিতেছে।

(গ) দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ায় ব্যাংকিং ইনশিওরেন্স ইত্যাদি সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস এবং বিদেশী মিশনসমূহের অফিস ও ক্রিয়া কলাপ পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকিতেছে। এ সবের আর্থিক সুবিধা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানপাইতেছে।

(ঘ) সরকারী চাকুরিতে দেশের মোট রাজস্বের শতকরা পঁচিশ টাকার বেশি (তৎকালে একশ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে সাড়ে বত্রিশ কোটি) ব্যয় হইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরের চাকুরির শতকরা একশটি এবং মধ্য নিম্ন-মধ্য চাকুরির শতকরা আশি-নব্বইটি পশ্চিম পাকিস্তানীরা অধিকার করিয়া থাকায় এই হইতে যে বিপুল আয় হয় তার সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পায়। ব্যয়ও হয় পশ্চিম পাকিস্তানেই। প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তান এই হারে ধনী ও পূর্ব পাকিস্তান এই হারে গরিব। হইতেছে।

(ঙ) দেশরক্ষা বাহিনীর পিছনে দেশের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ ভাগ (ভকালে একশ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে একশ দশ কোটি) ব্যয় হয়। দেশরক্ষা বাহিনীর কোনও বিভাগে পূর্ব-পাকিস্তানী অফিসার একরূপ না থাকায় এই বিপুল আয় হইতে তারা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। চাকুরি-বাকুরি ছাড়াও সরবরাহ বা নির্মাণকার্যের ক্যাকটারি হইতেও তারা বঞ্চিত। ইহার ফল স্বরূপ প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানকে ধনী ও তুলনায় পূর্ব-পাকিস্তানকে গরিব করিতেছে।

এই ব্যাপারটাই পরিষ্কার হইয়াছিল নবাব গুরমানীর সাথে আমার কথা কাটাকাটিতে। আমি আমার বক্তৃতায় যখন উভয় পাকিস্তানের সমান অধিকার দাবি করিতেছিলাম, তখন আমার বক্তৃতায় বাধা দিয়া নবাব গুরমানী বলিলেন বন্ধুর ভুলিয়া যাইতেছেন যে পাকিস্তান সরকারের রাজত্বে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আসে শতকরা চৌরাশি টাকা; পূর্ব-পাকিস্তান দেয় মাত্র শতকরা ষোল টাকা।

জবাবে সরকারী হিসাবের খাতা দেখাইয়া আমি বলিয়াছিলাম : নবাব সাহেব একটু ভুল করিয়াছেন। পূর্ব-পাকিস্তানের দান শতকরা ষোল নয়। আরও কম। মাত্র চৌদ্দ টাকা।

নিজের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতেছি দেখিয়া নবাব গুরমানী সহ পশ্চিমা নেতারা কৌতূহলে আমার দিকে চাহিয়াছিলেন। আমি তাঁদের আরও বিখিত করিয়া বলিয়াছিলাম? বর্তমানে পূর্ব-পাকিস্তান দেয় শতকরা চৌদ্দ। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার বছর দিয়াছিল শতকরা ত্রিশ। আট বছরে শতকরা ষোল কমিয়া হইয়াছে চৌদ্দ। বছরে দুই কমিয়াছে। বাকী চৌদ্দ কমিয়া শূন্যে আসিতে লাগিবে আর মাত্র সাত বছর। ১৯৬৩ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের জমার খাতায় যখন শূন্য হইবে, তখন আপনারা ন্যায়ই বলিতে পারিবেন : পূর্ব-পাকিস্তান লোকসানের কারবার। ওটা লিকুইডেট করা যাইতে। পারে।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ব্যাংকিং ইনশিওরেন্সসহ সমস্ত শিল্প-বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস করাচিতে হওয়ায় পূর্ব-পাকিস্তানে অর্জিত সকল আয় পশ্চিম পাকিস্তানের হিসাবে জমা করার সুবিধা ছিল।

আমি বক্তৃতার উপসংহারে বলিয়াছিলাম : আপনারা ভূগোলকে অগ্রাহ্য করিবেন। মনে রাখিবেন ভূগোল ও ইতিহাস যমজ সহোদর। যদি ভূগোলকে আপনারা অস্বীকার করেন, তবে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করিবে না। মনে রাখবেন ইতিহাসের পুনরাবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

গবর্নমেন্ট পার্টি আমার এইসব আর্তনাদে কর্ণপাত করিলেন না। মাঝে হইতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষতঃ করাচির উর্দু কাগযসমূহ আমার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহ, দেশদ্রোরে বিক্ষোভ তুলিলেন। আমার বিচারের দাবি করিলেন। কেউ কেউ কিনা বিচারে চৌদ্দ বছর জেলের বা সংগেসার করিয়া গর্দান লইবার ফরমায়েশ দিলেন। গণ-পরিষদে ‘প্রিভিলেজ মোশন’ আসিল। যথারীতি প্রিভিলেজ কমিটিও বসিল এবং সম্পাদকদের তলবের ব্যবস্থাও হইল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হইল না। কারণ সরকারী-দল তাদের পক্ষে।

পশ্চিম পাকিস্তান হইতে এই ধরনের প্রায় সার্বজনীন নিন্দা ও কঠোর-ক প্রতিবাদের ঝড়-তুফানের মধ্যেও আমার বুকে বল, অন্তরে সান্ত্বনা ও মনে আত্মবিশ্বাস জাগরুক রাখিয়াছিল ঢাকা ও চাটগাঁও হইতে প্রায় একই সংগে অজানা বন্ধুদের কয়েকখানা মোবারকবারে টেলিগ্রাম। ঐ সবগুলিতে বিভিন্ন উপাধিতে আমাকে তাঁরা ইতিহাস বিখ্যাত অমর বাগ্মী এড়মও বার্কের সাথে এবং আমার বক্তৃতাকে বার্কের বৃটিশ পার্লামেন্টের বক্তৃতার সাথে তুলনা করিয়া প্রাপ্যাধিক গৌরব ও সম্মান দান করিয়াছিলেন। তার কোনটাতে আমাকে বাক-অব বেংগল, কোনটাতে বাক-অব-ইস্ট বেঙ্গল, আর কোন কোনটাতে বার্ক অব-পাকিস্তান বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছিল। স্বতঃস্ফূর্ত গণ-মনের উল্লাসের প্রতীক হিসাবে এ সবের স্মৃতি আজও আমাকে আনন্দ দেয় বলিয়াই ওদের উল্লেখ করিলাম।

সরকারপক্ষ স্টিম রোলার চালাইলেন। আমরাও দস্তুর মত ‘ফিলিবাস্টারিং’ শুরু করিলাম : ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। সংশোধনী, মুলতবি ও অধিকার প্রস্তাব এবং ধারাবাহিকতার মুক্তা’ (পয়েন্টস-অব-অর্ডার) ইত্যাদিতে সরকার পক্ষকে ব্যতিব্যস্ত রাখিলাম। আমরা আওয়ামী লীগের মেম্বররা বেশির ভাগই ছিলাম আমাদের পার্লামেন্টারি কর্তব্য সম্বন্ধে সদা-সচেতন নিরলস কঠোর পরিশ্রমী ও কর্মব্যস্ত। দিনরাত অধ্যয়ন মুসাবিদা ও রামর্শ করিয়া শত শত সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করিলাম এবং পাহারা কুত্তার মত সর্বদা হাযির থাকিয়া চব্বিশ ঘন্টা ঘেউঘেউ করিতে থাকিলাম। আমি একাই আগেই ১৬৭টি সংশোধনী দিয়া রাখিয়াছিলাম। তারপর আরও বাড়াইয়া দুইশর উপর সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করিলাম। একটিও বাদ না দিয়া প্রতি সংশোধনী পেশ ও তার সমর্থনে দুই-তিন বার পাঁচ-সাত মিনিট করিয়া বক্তৃতা করিয়া যাইতে লাগিলাম। সরকার পক্ষও নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে কম বুদ্ধি রাখিতেন না। কর্মোদ্যমও তাঁদের আমাদের চেয়ে কম ছিল না। আমাদের কৌশলের জবাবে তাঁরা ঠিক করিলেন দিন-রাত ননস্টপ এসেমব্লির অধিবেশন চালাইবেন। এইখানে আমরা চালে হারিয়া গেলাম। আমরা প্রতিবাদে ওয়াকআউট করিলাম। আমার একারই সংশোধনী মারা গেল একশ তেতাল্লিশটা।

এই বয়কটটা নিশ্চিতই আমাদের বোকামি হইয়াছিল। কারণ আমরা যে প্রতিপদে সরকার পক্ষকে বাধা দিয়া সময় নষ্ট করিতেছিলাম সেটা শুধু বিরোধিতায় সময় নষ্ট করিবার জন্য নয়। আমাদের আন্তরিক আশা ছিল ইতিমধ্যে পূর্ব-বাংলার সবকে না। হউক মেজরিটিকে আমরা ঐক্যমতে আনিতে পারি। পূর্ব-বাংলার দুই-একজন বাদে সবাই যুক্তফ্রন্টের লোক। এরা যাদের ভোটে নির্বাচিত হইয়া আসিয়াছেন তাঁরা সবাই যুক্তফ্রন্টের এম, এল, এ.। পূর্ব-বাংলা-আইন-পরিষদে যুক্তফ্রন্ট পার্টিই সরকারী, দল। তাঁরা পার্টি মিটিং-এ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কেন্দ্রীয় মেম্বারদের ম্যানডেট দিয়াছেন। এই ম্যানডেট অনুসারে কাজ করাইবার জন্য একদল প্রতিনিধিও করাচি আসিয়াছেন। তাঁদের সাথে একযোগে আমরা অনেক লবিওয়ার্ক করিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। বাংলাকে অন্যতর রাষ্ট্রভাষা করিয়া নির্বাচন প্রথা স্থগিত রাখিয়াম ‘শক্তিশালী কেন্দ্রে’র নামে ফেডারেশনের পোশাকে একটি ছদ্ম-ইউনিটরি শাসন রচনা হইয়া গেল। নাম হইল তার ‘ইসলামিক রিপাবলিক’। হক সাহেবের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের পূর্ব-বাংলায় মুসলিম মেম্বাররা একুশ দফার নির্বাচনী ওয়াদা খেলাফ করিয়া এই শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে ভোট দিলেন। ১৯৫৪ সালের বিপ্লবী নির্বাচন বিজয়টা এইভাবে সমাধিস্থ হইয়া গেল। আমরা আওয়ামী লীগাররা আর কি করিব? ঐ শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে পূর্ব-বাংলার জনমত যাচাই করিবার চ্যালেঞ্জ দিয়া। আমরা শাসনতন্ত্র দস্তখস্ত দিতে অস্বীকার করিলাম।

তবুও একটা শাসনন্ত্র হইয়া গেল। ভালই হোক আর মন্দই হোক। এই ঘটনায় এই সত্য প্রমাণিত হইল যে দেশের শাসনতন্ত্র রচনা এমন অসাধারণ ব্যাপার নয়, যা রচনার জন্য নয়টি বছর লাগিতে পারে। বস্তুতঃ বর্তমান গণ-পরিষদ কিছু বেশি দেড় মাসের মধ্যে এই শাসন রচনার কাজ শেষ করিয়াছে। এটা অনেকেরই সান্ত্বনার কথা। শুভবুদ্ধির কথা। শান্তিপ্রিয় নাগরিকের কথা। শান্তিপূর্ণ পথে গণতন্ত্র বিকাশের কথা। আমরা নিজেরাও অনেকে শেষ পর্যন্ত এই কথাই বলিলাম। এইভাবে বর্তমানকে গ্রহণ করিলাম। কিন্তু শুভ বুদ্ধিই শেষ কথা নয়। শান্তিপ্রিয়তাই সমস্যা সমাধানের অস্ত্র নয়। এই শাসনতন্ত্রের বলে কেন্দ্রে সর্বশক্তি কেন্দ্রীভূত হইল এবং পূর্ব-বাংলা প্রবঞ্চিত হইল। এটাই যদি শেষ কথা হইত, তবে ব্যাপারটা তেমন জটিল হইত না। আসল কথা এই যে, এই শাসনতন্ত্র সমস্যার সমাধান করে নাই, আরও সমস্যা সৃষ্টি করিয়াছে। যতই ইসলামী বিশেষণ দেওয়া হউক, যে শাসনন্ত্র দুই পাকিস্তানের ভৌগোলিক পৃথক সত্ত্বা ও আর্থিক বিভিন্নতার স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হইবে, তা পাকিস্তানের সত্যিকার বাস্তবানুগ শাসনতন্ত্র হইতে পারে না। সে শাসনতন্ত্র স্থায়ী হইতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক অবিচার ও অসাম্যকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রলেপ দিয়া চাপা দিবার চেষ্টা করিলে তাতে ইসলামেরই অপমান করা হয়। যতদিন আমরা এই অসাধু চেষ্টা চালাইব, ততদিন আমাদের জাতীয় জীবনে ঝড়-ঝা চলিতেই থাকিবে।

এই শাসনতন্ত্র দুইটা বড় রকমের সংস্কার প্রবর্তন করিল। পূর্ব-বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হইল; আর পশ্চিম অঞ্চলের চার-চারটা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নিজ নিজ অস্তিত্ব লোপ করিয়া এক পশ্চিম পাকিস্তান হইল। নামে কিছু আসে যায় না যদি পরিবর্তনের সাথে স্বকীয়তার বিলোপ না হয়। বৈচিত্রহীন ইউনিফরমিটির চেয়ে জাতির শতদল রূপ অনেক বেশি কাম্য দেশের ক্ষমতাশীল নেতারা, শুধু ক্ষমতাহীন চিন্তুকরা নয়, যত তাড়াতাড়ি এই সত্য বুঝিবেন, ততই মংগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *