বেংগল প্যাক্ট
তেসরা অধ্যায়
১. খিলাফত্রে অবসান
১৯২২ সালের মাঝামাঝি প্রাদেশিক খিলাফত কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠক উপলক্ষে কলিকাতা গেলাম তদানিন্তন প্রাদেশিক সেক্রেটারি সৈয়দ মাজেদ বখশ সাহেবের বিশেষ অনুরোধে, কলিকাতায়ও আমার এই প্রথম পদার্পণ। খিলাফত কমিটির মিটিংএও আমার এই প্রথম উপস্থিতি। আমি অনেক আগে হইতেই প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার থাকা সত্ত্বেও এর আগে কখনও তার মিটিং-এ যোগ দেই নাই। অল-ইন্ডিয়া-খিলাফত নেতা মওলানা শওকত আলী সাহেব ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত সদস্যের সাথে বিশেষতঃ জিলা-নেতৃবৃন্দের সাথে খিলাফতের বিশেষ পরিস্থিতি আলোচনা করিতে চান। সেক্রেটারি মাজেদ বখশ সাহেবের এই মর্মের পত্র পাইয়াই আমি এই সভায় অংশ গ্রহণ করিতে আসি। কলিকাতা খিলাফত কমিটির আর্থিক অবস্থা তখনও স্বচ্ছল। মফস্বলের নেতাদের হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তখনও করা হয়। সেক্রেটারি সৈয়দ মাজেদ বখশ সাহেব আমারও বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু আমি হোটেলের বদলে শামসুদ্দিনের সাথে থাকাই মনস্থ করিলাম। তাই ১নং আন্তণী বাগানস্থ ‘মোসলেম জগত’ আফিসে উঠিলাম। খিলাফত কমিটির সভায় যোগ দেওয়া ছাড়াও আমার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। খিলাফত উদ্ধারের বদলে নিজেকে উদ্ধার করা আমার আশু প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছিল। শামসুদ্দিনের মধ্যস্থতায় কোনও খবরের কাগজে একটা চাকরি যোগাড়ের সম্ভাবনা বিচারও আমার সে যাত্রায় উদ্দেশ্য ছিল। খিলাফত কমিটির কাজ সারিতে আমার দুইদিন লাগিল। মওলানা শওকত আলী সাহেবকে এতদিন শুধু দূর হইতে দেখিয়াছি, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা শুনিয়াছি। এবারই প্রথম সামনা-সামনি কথা বলিবার গৌরব অর্জন করিলাম। মওলানা সাহেবের আশাবাদ দেখিলাম। বিস্মিত হইলাম। তখন মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে নয়াতুকী বাহিনী গ্রীক বাহিনীর কবল হইতে স্মর্না উদ্ধার করিয়াছে; গ্রীক বাহিনীকে তাড়া করিয়া নিতেছে। এই ঘটনায় সব মুসলমানেরই আনন্দ করিবার কথা। আমরাও করিয়াছি। কিন্তু মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কীরা রাজনৈতিক সেকিউলারিষম গ্রহণ করিতেছে; পোশাক-পাতিতে ইউরোপীয় সাজিবার চেষ্টা করিতেছে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠান উঠাইয়া দিতে পারে বলিয়া গুজব রটিতেছে। স্বয়ং তুর্কীরা খিলাফত উঠাইয়া দিলে আমরা ভারতীয়রা কিরূপে আন্দোলন চালাইব, প্রধানতঃ এই কথাটার আলোচনার জন্যই মওলানা সাহেব কলিকাতা আসিয়াছেন। তাঁর মতে কামাল খিলাফত উচ্ছেদ করিতে পারেন না। আইনতঃ সে অধিকারও তাঁর নাই। খিলাফত কোন দেশ-রাষ্ট্রের অনুষ্ঠান নয়; এটা বিশ্ব-মুসলিমের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। অতএব কামাল পাশা ওটা উঠাইয়া দিলেও আমরা তা মানিব না। মওলানা সাহেবের এই বিস্ময়কর আশাবাদে পুরাপুরি শরিক হইতে না পারিলেও আমরা খিলাফত-কর্মীরা নৈরাশ্যের মধ্যে আলোর ছটা দেখিতে পাইলাম। পরম উৎসাহের মধ্যেই খিলাফত কমিটির কাজ শেষ হইল।
খিলাফতের কাজ শেষ হওয়ায় আমার কাজ শুরু হইল। শামসুদ্দিনের কাছে মনের কথা বলিলাম। তিনি আমাকে কিছু ‘কোদাল কাম’ করিবার পরামর্শ দিলেন। আমি ‘কোদাল কাম’ শুরু করিলাম। শামসুদ্দিনের কাগযে কিছু কিছু লেখা দিতে লাগিলাম। বংগীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কলেজ স্ট্রিট আফিসে যাতায়াত করিলাম। সমিতির সভাপতি ডাঃ শহীদুল্লাহ, সেক্রেটারি ভোলার কবি মোযাম্মেল হক, সমিতির সহকারী সম্পাদক মোযাফফর আহমদ (পরে কমরেড) ও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচিত হইলাম। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামানের সাথে খিলাফত কমিটিতেই পরিচিত হইয়াছিলাম। মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব এই সময় কলিকাতায় থাকিয়া ‘ছোলতান’ নামক সাপ্তাহিক কাগজ চালাইতেন। আমি শামসুদ্দিনের পরামর্শে ‘মোহাম্মদী’ ও ‘ছোলতান’ অফিসে যাতায়াত করিয়া আমার ‘কোদাল কামের’ পরিধি বাড়াইতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে ‘সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামক আমার এক অতিদীর্ঘ দার্শনিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধ শামসুদ্দিনের কাগযে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতে লাগিল। প্রাথমিক ‘কোদাল কাম’, যথেষ্ট হইয়াছে মনে করিয়া সেবারের মত ময়মনসিংহ ফিরিয়া আসিলাম। পরে আরও কয়েকবার যাতায়াত করিলাম।
একবার ময়মনসিংহে ফিরিবার অন্য কারণ ঘটিয়াছিল। শুধু আমার নন সারা জিলার নেতা মৌঃ তৈয়বুদ্দিন আহমদ সাহেব সেবার আইন সভায় প্রার্থী হইয়াছিলেন। বেংগল প্যাক্ট। তাঁর পক্ষে ক্যানভাস করা আমার কর্তব্য ছিল। ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রশ্নও এতে জড়িত ছিল। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়া কংগ্রেসের সভাপতিরূপে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কাউন্সিল এন্ট্রি প্রোগ্রাম পেশ করেন। কংগ্রেস তাঁর মত গ্রহণ না করায় ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতেই তিনি স্বরাজ্য দল গঠন করেন। ডাঃ আনসারী হাকিম, আজমল খী, বিঠলভাই প্যাটেল, পভিত মতিলাল নেহেরু, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুযযামান ইসলামাবাদী, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রভৃতি অনেক নেতা দেশবন্ধুকে সমর্থন করেন। আমি নিজে দেশবন্ধুর এই মত পরিবর্তনকে মডারেট নীতি মনে করিয়া গোড়ার দিকে এই নীতির বিরোধী ছিলাম। কিন্তু দেশবন্ধুর সাম্প্রদায়িক উদার নীতির জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাহেতু এবং আমার জিলার নেতা তৈয়বুদ্দিন সাহেব দেশবন্ধুর সমর্থক হওয়ায় আমিও মোটামুটি এই নীতির সমর্থক হইলাম। তারপর মার্চ মাসেই আইন সভার নির্বাচনে তৈয়বুদ্দিন সাহেব স্বরাজ্য দলের টিকিটে নির্বাচন প্রার্থী হওয়ায় আমার পক্ষে চিন্তা-ভাবনার আর কোনও পথ রইল না। নির্বাচনে তাঁকে সাহায্য করিবার জন্য আমি কলিকাতা ত্যাগ করিলাম।
দেশে ফিরিয়াই নির্বাচন যুদ্ধে আমি মাতিয়া উঠিলাম। কারণ তৈয়বুদ্দিন সাহেবের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নন, স্বয়ং ধনবাড়িয়ার বিখ্যাত জমিদার নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী সাহেব। জমিদারের প্রতি আমার চিরকালের বিদ্বেষ।তার উপর ধনবাড়ির নবাব সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশেষ কারণ ছিল। তাঁর প্রজাপীড়নের নিত্য নতুন কাহিনী আমাদের কানে আসিত। উহাদের সত্যাসত্য বিচারের আমাদের সময় ছিল না। জমিদারের যুলুমের কাহিনী বিশ্বাস করিবার জন্য আমরা উন্মুখ হইয়াই থাকিতাম। এইবার তাঁকে নির্বাচনে হারাইয়া শোধ নিবার জন্য কাজে লাগিয়া গেলাম। আমার নিজের জন্মস্থান এই নির্বাচনী এলাকায় পড়ায় আমার কাজ বাড়িয়া গেল, সহজও হইল। নবাব বাহাদুরের বাহাদুরি’ এই শিরোনামায় জীবনের সর্বপ্রথম নির্বাচনী ইশতাহার লিখিলাম। সকলেই এক বাক্যে তারিফ করিলেন। নবাব বাহাদুরের আর রক্ষা নাই।
নির্বাচনে সত্য-সত্যই নবাব বাহাদুর হারিয়া গেলেন। বিপুল বিত্তশালী সরকার সমর্থিত বড় লোকের গরিব জননেতার কাছে পরাজয় এতদঞ্চলে এই প্রথম। অতএব আমার কলমের ঐ এক খোঁচাতেই এত বড় নবাব ভুলুণ্ঠিত হইলেন, একথা আমার বন্ধু-বান্ধবসবাই বলিলেন। আমি বিশ্বাসকরিলাম।
নির্বাচনে জিতিয়াই শামসুদ্দিনের নির্দেশমত কালিকাতায় ফিরিয়া গেলাম। আইন সভার বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে তৈয়বুদ্দিন সাহেবও গেলেন। বলা আবশ্যক আমার ভাড়াটাও তিনিই দিলেন। শামসুদ্দিন আগেই আলাপ করিয়া রাখিয়াছিলেন। এবার যাওয়া মাত্রই ‘ছোলতানে’ ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি হইয়া গেল। পরে এই বেতন চল্লিশ টাকায় বর্ধিত হইয়াছিল। ছোলতানে যোগ দেওয়ায় আমি দেশবন্ধুর স্বরাজ্য দলের আরও সক্রিয় সমর্থক হইতে বাধ্য হইলাম। কারণ ‘ছোলতানের’ মালিক মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব দেশবন্ধুর অনুরক্ত ও স্বরাজ্য দলের সমর্থক ছিলেন। আমাকেও কাজেই ঐ দলের সমর্থনে লিখিতে হইত।
২. দেশবন্ধুর বেংগল প্যাক্ট
এই সময় স্বরাজ্যদলের মোট বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ জন সদস্য ছিলেন। হিন্দু মুসলিম মেম্বর প্রায় সমান-সমান। নির্বাচিত মেম্বরদের মধ্যে এরাই ছিলেন মেজরিটি। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থায় সরকারী দফতরসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলির বেশির ভাগই ছিল ‘রিযার্ভ’। তারা আইন সভার বিচার্য বিষয় ছিল না। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়গুলি ছিল ট্রান্সফার্ড। অর্থাৎ ওদের উপর ভোটাভুটি করা যাইত। দেশবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি স্ট্রাটেজি ও টেকটিকসের দ্বারা এবং অসাধারণ বাগ্মীতার বলে স্বরাজ্য দল এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করিয়া সরকারী দলকে অনেক নাকানি-চুবানি খাওয়াইলেন।
সার আব্দুর রহিম, মৌলভী আব্দুল করিম, মৌলভী মুজিবুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুযযামান ইসলামাবাদী প্রভৃতি মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং মিঃ জে. এম. সেনগুপ্ত, মিঃ শরৎ চন্দ্র বসু, মিঃ জে, এম, দাশ গুপ্ত ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রভৃতি হিন্দু নেতার সহযোগিতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এই সময় (১৯২৩ এপ্রিল) ঐতিহাসিক ‘বেংগল প্যাক্ট’ নামক হিন্দু-মুসলিম চুক্তিনামা রচনা করেন। তিনি স্বরাজ্য পার্টি ও বংগীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিকে দিয়া ঐ প্যাক্ট মনযুর করাইলেন। এই প্যাটে ব্যবস্থা করা হয় যে, সরকারী চাকুরিতে মুসলমানরা জন সংখ্যানুপাতে চাকুরি পাইবে এবং যতদিন ঐ সংখ্যানুপাতে (তৎকালে শতকরা ৫৪) না পৌঁছিবে ততদিন নূতন নিয়োগের শতকরা ৮০টি মুসলমানদেরে দেওয়া হইবে। সরকারী চাকুরি ছাড়াও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, যথা কলিকাতা কর্পোরেশন সমস্ত মিউনিসিপ্যালিটি এবং ডিস্ট্রিক্ট ও লোকাল বোর্ডসমূহে, মুসলমানরা ঐ হারে চাকুরি পাইবে। প্যাক্টের বিরোধী হিন্দু নেতারা বলিতে লাগিলেন যে, দেশবন্ধু স্বরাজ্য দলে এবং কংগ্রেস কমিটিতে প্যাক্ট পাস করাইতে পারিলেও কংগ্রেসের প্রকাশ্য সম্মিলনীতে পারিবেন না। তাই প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রকাশ্য সম্মিলনীতে এই প্যাক্ট গ্রহণ করাইবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জ এই সম্মিলনীর অধিবেশন আহবান করিলেন। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব এই প্রকাশ্য অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। এইসব কারণে দেশবন্ধু মুসলমানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। আমি নীতিগতভাবে কংগ্রেসের ‘নোচেঞ্জার’ দলের সমর্থক হইয়াও শুধু এই কারণে দেশবন্ধুর একজন ভক্ত অনুরক্ত।
মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের ‘ছোলতানে’ সাব-এডিটরি নেওয়ার পর জানিতে পারি যে, মৌঃ ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহেবও ছোলতানের অংশীদার। মওলানা সাহেবই কলিকাতায় থাকিয়া ‘ছোলতান’ সম্পাদনা করিতেন। সিরাজী সাহেব সময় সময় কলিকাতা আসিয়া ইসলামাবাদী সাহেবের মেহমান হইতেন। উভয়েই পুরামাত্রায় স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষপাতী হইলেও সিরাজী সাহেব সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর ব্যাপারে কংগ্রেসের বিরুদ্ধতা করিতেছেন বলিয়া কলিকাতায় খবর আসে। সাম্প্রদায়িক হিন্দু কংগ্রেস নেতারা ঐ প্যাক্টের দরুন দেশবন্ধুর বিরোধী। সিরাজগঞ্জের আঞ্জুমনী মুসলিম-নেতারা ঐতিহ্যগতভাবেই কংগ্রেস-বিরোধী। এই দুই দল মিলিয়া সিরাজগঞ্জ কংগ্রেস সম্মিলনী ভন্ডুল করিবার চেষ্টা করিতেছেন। সিরাজী সাহেব এদের দলে যোগ দিয়াছেন। অথচ মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব দেশবন্ধুর ও সম্মিলনীর পুরা সমর্থক। তাঁরই নির্দেশ ও উৎসাহে আমি দেশবন্ধুর বেংগল প্যাকটের সমর্থক এবং দেশবন্ধু বিরোধী কংগ্রেস নেতাদের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার নিন্দায় অনেকগুলি সম্পাদকীয় লিখিয়াছি। শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর মত ত্যাগী আজীবন-নির্যাতিত বাগ্মী নেতার তীব্র রসনা, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শক্তিশালী লেখকের চাঁছাল কলম, ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকার মত বিপুল প্রচারিত দৈনিকের পৃষ্ঠা দিনরাত দেশবন্ধুর বিরুদ্ধ প্রচারণায় নিয়োজিত। তাঁদের মূলকথা এই যে, দেশবন্ধু বাংলাদেশ মুসলমানদের কাছে বেচিয়া দিয়াছেন। এদের সংঘবদ্ধ বিরুদ্ধতা ঠেলিয়া দেশবন্ধু কর্পোরেশনের সাধারণ নির্বাচনে (১৯২৪ এপ্রিল) জয়ী হইয়াছেন। নিজে মেয়র নির্বাচিত হইয়াছেন। জনপ্রিয় তরুণ মুসলিম নেতা শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে ডিপুটি মেয়র করিয়াছেন। সুভাষ বাবুকে চীফ একযিকিউটিভ অফিসার ও হাজী আবদুর রশিদ সাহেবকে ডিপুটি একযিকিউটিভ অফিসার করিয়াছেন এবং অনেক মুসলমান গ্র্যাজুয়েট এম. এ.-কে রাতারাতি কর্পোরেশনের মোটা বেতনের দায়িত্বপূর্ণ চাকুরি দিয়াছেন। কলিকাতা কর্পোরেশনের মত হিন্দু-প্রধান প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের পক্ষে রাতারাতি অত ভাল চাকুরি পাওয়া কল্পনারও অগোচর ছিল। কাজেই সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা দেশবন্ধু আয়োজিত সিরাজগঞ্জ কনফারেন্স পন্ড করিবার চেষ্টা করিবে এটা স্বাভাবিক। আঞ্জুমনওয়ালারাও যা কিছু কংগ্রেসী সবটার অন্ধ বিরুদ্ধতা করিবে এটাও আশ্চর্য নয়। কিন্তু সিরাজী সাহেবের মত স্বাধীনতাকামী কংগ্রেস সমর্থক সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা একাজ করিতেছেন কেন ইহা কলিকাতাস্থ নেতৃবৃন্দের কাছে এরূপ দুর্বোধ্য ছিল।
৩. সিরাজগঞ্জ কনফারেন্স
তাই দেশবন্ধু ও মওলানা আকরম খাঁর কথামত মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব আমাকে সিরাজী সাহেবের নিকট পাঠান। কংগ্রেস সম্মিলনীর এক সপ্তাহ আগে এঁদের-দেওয়া রাহা খরচ লইয়া আমি সিরাজগঞ্জ গেলাম। বেংগল প্যাকটের মুদ্রিত শর্তাবলী, দেশবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতার অসংখ্য কপি, প্যাকটের সমর্থনে আমি ‘ছোলতানে’ যে সব সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম সেই সব সংখ্যার যত কপি পাওয়া
গেল তার সব এবং ‘ছোলতানের’ সর্বশেষ সংখ্যার হাজার খানি কপির এক বিরাট বস্তা সংগে নিলাম। গিয়া উঠিলাম সিরাজী সাহেবের বাড়ি বাণীকুঞ্জে। সিরাজী সাহেব গরিব হইলেও মেহমানদারিতে তাঁর মোজ-মর্যি ছিল একদম বাদশাহী। তাছাড়া আমাকে খুবই স্নেহ করিতেন। আমাকে তিনি সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন এবং থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু চা-নাশতা খাওয়ার সময়েই বুঝিয়া ফেলিলাম, ‘ছোলতানের’ সাম্প্রতিক লেখাসমূহের জন্য তিনি আমার উপর বেশ খাপ্পা হইয়াছেন। গত দুই-তিন মাস তিনি কলিকাতা যান নাই। কাজেই তাঁর সর্বশেষ রাজনৈতিক মতামত আমার জানা ছিল না। কথাবার্তায় বুঝিলাম, তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অনেক দূর আগাই গিয়াছেন। স্থানীয় ‘নোচেঞ্জার’ কংগ্রেসী ও আঞ্জুমনী নেতাদের সহায়তায় তিনি প্রকাশ্যভাবে অনেক কাজ করিয়া ফেলিয়াছেন।
স্বভাবতঃই আমি খুব সাবধানে কথা বলিতে শুরু করিলাম। মেহমানদারিতে সিরাজী সাহেব পয়গম্বর সাহেবের অনুসরণ করিতেন। আমাকে ছাড়া তিনি খানা-পিনা ও নাশতা-পানি কিছুই খাইতেন না। তিনি অনেক সকালে উঠিলেও নাশতা খাইতে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেন। সকালে নাশতা খাইয়া আমি শহরে বাহির হইতাম। ফিরিয়া আসিয়া দেখিতাম, তিনি আমার জন্য ক্ষুধার্ত মুখে অপেক্ষা করিতেছেন। তিনি হাসি-মুখে বলিতেন আমারে উপাস রাইখা আমি খাঁটি সৈয়দ কিনা তাই পরীক্ষা করতেছ বুঝি?
বড় বেশি অন্যায় হইয়া গিয়াছে বলিয়া তাঁর কাছে মাফ চাহিলাম। আমার মাফ চাওয়া অগ্রাহ্য করিয়া তিনি বলিলেন : আমি সৈয়দ কিনা শুধুমাত্র আমারে উপাস রাইখা তার পরীক্ষা হবে না। সৈয়দের হাত আগুনে পুড়ে না। পরীক্ষা করতে চাও আমি চুলা থনে জ্বলন্ত আংগার আইনা দিতেছি। তাই তুমি আমার হাতের তালুতে রাখ। যদি আমার হাতের তালুতে একটা ফোঁসকাও পড়ে তবে বুঝবা আমি সৈয়দের বাচ্চা নই। আমার দাবি ঝুটা।
এই কথাটা সিরাজী সাহেব আমাকে কতদিন বলিয়াছেন তার হিসাব নাই। আমাকে ছাড়া আরও অনেকের নিকট বলিয়াছেন শুনিয়াছি। তাঁরা কেউ এই ভাবে সিরাজী সাহেবের সৈয়দি পরীক্ষা করিয়াছেন কি না জানি না। কিন্তু আমি করি নাই। আমি অন্যান্য বার হাসিয়া চুপ করিতাম। কিন্তু এবার যে কঠোর দায়িত্বের মিশন লইয়া আসিয়াছি তাতে চুপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বলিলাম? পরীক্ষায় আমার দরকার নাই। আপনার চেহারাই সাক্ষী দেয় আপনি খাঁটি সৈয়দ।
সিরাজী সাহেব তোষামোদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করিতেন। তোষামোদীদিগকে দস্তুরমত ঘৃণা করিতেন। কিন্তু খোদাকে ধন্যবাদ। আমার এই কথাটাকে তিনি তোষামোদ মনে করিলেন না।
এই ভাবে সিরাজী সাহেবের মন জয় করিয়া অবশেষে এক সময়ে কায়দা বুঝিয়া আমার কথাটা পাড়িলাম। কংগ্রেস সমর্থন-অসমর্থনের ঊর্ধ্বে বেংগল প্যাক্টটাকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের আক্রমণ হইতে বাঁচানো যে সকল দল ও সকল মতের মুসলমানের কর্তব্য এই দিক হইতে আমি কথা চালাইলাম। মনে করিলাম সিরাজী সাহেবের কাছে এইটাই হইবে নির্ঘাত অমোঘ অব্যর্থ যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ। সিরাজী সাহেব যা বলিলেন তার অর্থ এই যে, দুইদিন বাদে যখন ভারতবর্ষে মুসলিম রাজ্যই কায়েম হইয়া যাইতেছে, তখন ঐ ধরনের প্যাকটে মুসলমানদের কোনও লাভ ত নাই-ই বরঞ্চ লোকসান আছে। তিনি খুব আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে বলিলেন। তিনি খাবে দেখিয়াছেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাবুলের আমির ভারতবর্ষ দখল করিতেছেন। তিনি আবার স্মরণ করাইয়া দিলেন সৈয়দের স্বপ্ন মিথ্যা হইতে পারে না।
এই দিককার চেষ্টা আপাততঃ ত্যাগ করিয়া দেশবন্ধুর ব্যক্তিগত কথা তুলিলাম। হিন্দু সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা যেভাবে চারদিকে হইতে দেশবন্ধুকে আক্রমণ করিতেছে তাতে তাঁকে রক্ষা করা মুসলমানদেরই কর্তব্য। কারণ মুসলমানদের জন্যই তিনি এই ভাবে অভিমন্যু সাজিয়াছেন। এই কথায় সিরাজী সাহেবকে খানিকটা নরম মনে হইল। কিন্তু যা বলিলেন তাতে নিরাশ হইলাম। তিনি বলিলেন : দাশ সাহেব (তিনি কিছুতেই দেশবন্ধু বলিলেন না) তাঁর সাথে ওয়াদা খেলাফ করিয়াছেন। তাঁরই পরামর্শ মতে কাবুলে কংগ্রেসের শাখা খুলিতে দাশ সাহেব রাযী হইয়াছিলেন। কিন্তু লালা লাজপত রায়ের ধমকে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করিয়া দাশ সাহেব সিরাজী সাহেবের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন। এর পর দাশ সাহেবের উপর সিরাজী সাহেবের কোনও আস্থা থাকিতে পারে না।
আমার মনে পড়িল কিছুদিন আগে লালা লাজপত রায় কংগ্রেসের সহিত সমস্ত সম্পর্কচ্ছেদ করিয়া খবরের কাগযে এক বিবৃতি দিয়াছিলেন। তাতে লালাজী বলিয়াছেন যে, কংগ্রেস কাবুলের আমিরের দ্বারা ভারতবর্ষ দখল করাইয়া ভারতে মুসিলম রাজত্ব কায়েম করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছে। সিরাজী সাহেবের এই অভিযোগের মধ্যে আমি অকুলে কুল পাইলাম। আমি সিরাজী সাহেবকে বুঝাইলাম যে কাবুলে কংগ্রেস স্থাপন করায় বিলম্ব হইয়াছে বটে কিন্তু সে পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় নাই। যদি হইত তবে লালা লাজপত রায় কংগ্রেস বর্জন করিতেন না। বরঞ্চ লালাজীর কংগ্রেস ত্যাগে এটাই প্রমাণিত হয় যে কংগ্রেস স্বমতে দৃঢ় আছে, দেশবন্ধুর প্রভাবেই এটা সম্ভব হইয়াছে। সুতরাং তিনি সিরাজী সাহেবের কাছে-দেওয়া ওয়াদা খেলাফ করেন নাই। তবু যদি সিরাজী সাহেবের সন্দেহ হইয়া থাকে, তবে কলিকাতা গিয়া অথবা অন্ততঃ দেশবন্ধুর সিরাজগঞ্জ আগমনের সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করিয়া ব্যাপারটা পরিষ্কার করা উচিৎ। তার আগে সম্মিলনীতে বাধা দেওয়া সিরাজী সাহেবের তাল দেখায় না। যে সিরাজী সাহেবের পরামর্শ গ্রহণ করিতে গিয়া দেশবন্ধু সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু নেতাদের চক্ষুশূল হইয়াছেন তাঁকে এ ভাবে পরাজিত হইতে দিতে সিরাজী সাহেব পারেন না। আমার এই যুক্তি সিরাজী সাহেবের অন্তরে দাগ কাটিল।
সিরাজগঞ্জ সম্মিলনে দেশবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করিতে তিনি সম্মত হইলেন। ইতিমধ্যে সলিনের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকিতেও রাযী হইলেন। উহাতে আমি সন্তুষ্ট হইলাম। কারণ আমি জানিতে পারিয়াছিলাম সিরাজী সাহেবের প্রকাশ্য ও সক্রিয় সহযোগিতা না পাইলে সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাও আজুমনী মুসলমানরা কিছুই করিতে পারিবেন না। আমি এই মর্মে মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবকে পত্ৰ দিলাম। তিনি সন্তুষ্ট হইয়া জবাব দিলেন এবং চার দিকে ন্যর রাখিবার জন্য আমাকে সম্মিলনী পর্যন্ত সিরাজগঞ্জে থাকিতে উপদেশ দিলেন।
শুধু আমার কথাতেই সিরাজী সাহেব মত পরিবর্তন করিয়াছেন এমন দাবি আমি করি না। কারণ ইতিমধ্যে বহু বড় বড় কংগ্রেস নেতা সিরাজী সাহেবের সহিত দেখা করেন। অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান পাবনার জমিদার বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ও করটিয়ার জমিদার জনাব ওয়াজেদ আলী খানপন্নী (চান মিয়া সাহেব) সিরাজী সাহেবের সহিত যোগাযোগ করিয়াছিলেন।
একদিন আগে হইতে দলে দলে ডেলিগেটরা আসিতে শুরু করিলেন। চান মিয়া সাহেব একদিন আগে হইতেই সিরাজগঞ্জে আসিয়া অভ্যর্থনা কমিটির আয়োজনের তদারক শুরু করিলেন। সিরাজী সাহেব নিরপেক্ষ হইয়া যাওয়ায় সম্মিলন-বিরোধী চক্রান্ত হাওয়ায় মিলাইয়া গেল।
নির্দিষ্ট দিনে বিপুল-উৎসাহ উদ্যমের মধ্যে বিরাট সাফল্যের সংগে সম্মিলনের অধিবেশন হইল। ডেলিগেটের সংখ্যাই ছিল পনর হাজারের মত। দর্শকের সংখ্যা ছিল তার অনেক গুণ। এত বড় জন-সমাবেশে অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যানের ভাষণ, দেশবন্ধুর প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা, মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের সুলিখিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ অভিভাষণ ও অন্যান্য বক্তাদের বক্তৃতায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বাণী এমন সজীবতা লাভ করিয়াছিল যে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে দেশবন্ধুর বেংগল প্যাক্ট গৃহীত হইয়া গেল।
দেশবন্ধুর অত সাধের বেংগল প্যাক্ট আজ ভাংগিয়া গিয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি হইয়াছে। দেশ আজ ভাগ হইয়াছে। দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দেশবন্ধুর প্রাণপ্রিয় পরাধীন দেশবাসী আজ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক হইয়াছে। সিরাজগঞ্জের বগল বাহিয়া যমুনা নদীর অনেক পানি গড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু দেশবন্ধুর সেদিনকার মর্মস্পর্শী উদাত্ত আবাহন আমার কানে, এবং বোধ হয় আমার মত অনেক বাংগালীর কানে, আজো রনিয়া-রবিয়া ধ্বনিয়া উঠিতেছে : “হিন্দুরা যদি উদারতার দ্বারা মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করিতে না পারে, তবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য আসিবে না। হিন্দু-মুসলিম-ঐক্য ব্যতীত আমাদের স্বরাজের দাবি চিরকাল কল্পনার বস্তুই থাকিয়া যাইবে।” দেশবন্ধুর কল্পিত হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের বাস্তব রূপ সম্পর্কে তিনি তাঁর সিরাজগঞ্জ-বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন : ‘হিন্দু ও মুসলমান তাদের সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র সত্তা বিলোপ করিয়া একই সম্প্রদায়ে পরিণত হউক, আমার হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের রূপ তা নয়। ওরূপ সত্তা বিসর্জন করনাতীত।” এই বাস্তব বুদ্ধির অভাবেই আজ দেশ ভাগ হইয়াছে। ইহারই অভাবে দেশভাগ হইয়াও শান্তি আসে নাই।