পাকিস্তান আন্দোলন
তেরই অধ্যায়
১. সুভাষ বাবুর ঐক্যচেষ্টা
১৯৪০ সাল। এপ্রিল মাস। এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাবেক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষ বাবু কলিকাতা কংগ্রেস ও কলিকাতা মুসলিম লীগের মধ্যে এক চুক্তি ঘটান। সেই চুক্তির ভিত্তিতে তাঁরা কলিকাতা কর্পোরেশনের সাধারণ নির্বাচন করেন। প্রায় সবগুলি আসনই তাঁরা দখল করেন। কিছুদিন আগে হক মন্ত্রিসভা কলিকাতা মিউনিসপ্যাল আইন সংশোধন করিয়া কর্পোরেশনের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। মোট ৯৩টি নির্বাচিত সীটের মধ্যে ২২টি মুসলমানের জন্য রিযার্ভ করা হইয়াছিল। মহাত্মাজীর সাথে বিরোধ করিয়া কংগ্রেস ত্যাগ করাতেও সুভাষ বাবুর জনপ্রিয় মোটেই কমেনাই,বরঞ্চ বাড়িয়াছে। বস্তুতঃ এই সময়ে সুভাষ বাবু বাংলার তরুণদের এক রকম চোখের পুতুলি। আর ওদিকে কলিকাতা মুসলিম লীগও মুসলিম ভোটারদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই দুই পক্ষের মৈত্রী ভোটারদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি করিল। নির্বাচনে জয়জয়কার। মুসলিম লীগ নেতা আবদুর রহমান সিদ্দিকী মেয়র হইলেন। স্বয়ং সুভাষ বাবু তাঁর নাম প্রস্তাব করিলেন। মেয়র ছাড়া পাঁচজন অভায়মনের মধ্যে দুইজন হন মুসলিম লীগের। এ ছাড়া শর্ত হইল যে, পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন বছরে মুসলিম মেয়র হইবেন। মুসলিম লীগের জন্য এটা সুস্পষ্ট বিজয়। কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে মুসলিম লীগকে মুসলমানদের প্রতিনিধি-প্রতিষ্ঠান রূপে মানিয়া নেওয়ার এটা প্রথম পদক্ষেপ। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের এটা পরম পরাজয়। কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোস করিলে জাতীয়তার আশা থাকিল কই? কাজেই আমরা জাতীয়তাবাদী মুসলিম লীগ-বিরোধী মুসলমানরা সুষকুর উপর খুব চটিলাম। ডাঃ আর. আহমদ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও আমি সুষ বাবুর এই কার্যের তীব্র নিন্দা করিলাম। খবরের কাগযে এক যুক্ত বিবৃতি দিলাম। সুষ বাবু এ বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে আমাদেরে চায়ের দাওয়াত দিলেন। সূতাবাবুর বাড়িতে চায়ের দাওয়াত রাখা আমাদের জন্য নূতন নয়। অধ্যাপক কবির ‘দৈনিক কৃষকে’র ম্যানেজিং ডিরেকটর, ডাঃ আর. আহমদ ডিরেক্টর ও আমি তার এডিটর। সুষ বাবু কৃষক’র একজন পৃষ্ঠপোষক। কংগ্রেসের মেম্বর না হইয়াও আমরা তিনজনই কংগ্রেসী রাজনীতিতে সুভাষ বাবুর সমর্থক। এ অবস্থায় উক্ত বিবৃতির আলোচনার জন্য আমাদেরে চা খাইতে ডাকিয়া পাঠান সুভাষ বাবুর পক্ষে নূতন কিছু ছিল না। অন্যায় ছিল না। তবু আমার বন্ধুদ্বয় সুভাষবাবুর দাওয়াত রাখিলেন না। এতই গোস্বা হইয়াছিলেন তাঁরা কাজেই আমাকে একাই যাইতে হইল। আমি যথসময়ে সুভাষ বাবুর এলগিন রোডস্থ বাসভবনে গেলাম। বন্ধুদ্বয়ের না আসার বানাওট কৈফিয়ৎ দিলাম। সুভাষ বাবু মুচকি হাসিলেন। তিনি আসল কারণ বুঝিলেন। আমরা দুইজনে আলাপে বসিলাম। সুভাষ বাবু পাক্কা মেহমানদার। আমরা কয়েক তরি মিঠাই ও বহু কাপ চা খাইলাম। আমার জন্য এক টিন সিগারেট আনাইলেন। নিজে তিনি সিগারেট খাইতেন না।
আলাপের গোড়াইতে তিনি দুঃখ করিলেন : তাঁর সাথে আলাপ না করিয়া কাগযে বিবৃতি দিলাম কেন? এটা কি বন্ধুর কাজ হইয়াছে? জবাবে আমি বলিলাম : আমাদেরে ঘুণাক্ষরে না জানাইয়া মুসলিম লীগের সংগে তিনি আপোস করিলেন কেন? এটা কি বন্ধুর কাজ হইয়াছে? ঝগড়ার সুরে আরম্ভ করিলাম বটে, কিন্তু পর মুহূর্তেই উভয়েই উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিলাম। শেয়ানে-শেয়ানে কোলাকুলি। কারণ বিলম্ব এড়াইবার জন্যই উভয়ে পরস্পরকে জানাইয়া যার তার কাজ করিয়াছিলাম। আচ্ছা বেশ। এখন কি করা যায়?
সূভাষবাবু অন্তরের দরদ দিয়া যা বলিলেন, তার মর্ম এই : হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছাড়া ভারতের মুক্তি নাই। মুসলিম লীগ মুসলিম জনগণের মন জয় করিয়াছে। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দ্বারা কোনও আশা নাই। ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা চীনা দেওয়া উঠিয়া পড়িয়াছে। সে দেওয়ালের জানালা নাই। একটা সুরাখও নাই যার মধ্যে দিয়া মুসলমানদের সাথে কথা বলা যায়। এখানে সুভাষ বাবু আবেগপূর্ণ। ভাষায় বলিলেন : ‘আমি মুসলমানদের সাথে কথা বলতে চাই; তাদের সাথে মিশতে চাই; তাদের একজন হতে চাই। বলুন মনসুর সাব, মুসলিম লীগ ছাড়া আর কার মারফত এটা করতে পারি? আর কোনও রাস্তা আছে কি?’
আমি তাঁর সাথে একমত হইলাম। সত্যই আর কোনও রাস্তা নাই। বলিলাম : ‘কিন্তু আপনে যে সুরাখ বার করছেন ওটা বড়ই ছোট। বড় সুরাখ করেন। জানালা, এমনকি দরজা, বার করেন। সিদ্দিকী ইস্পাহানিরে না ধৈরা স্বয়ং জিন্না সাহেবরে ধরেন। মুসলিম লীগই মুসলমানদের প্রতিনিধি-প্রতিষ্ঠান এটা মানলে জিন্ন সাহেবের সাথে কথা বলাই আপনের উচিৎ।‘
সুভাষ বাবু পরম আগ্রহে টেবিলের উপর দিয়া গলা বাড়াইয়া বলিলেন : ‘আমি কিছুদিন থেকে মনে-মনেই তাই ভাবছিলাম। কিন্তু সেদিন লাহোর ঐ যে ধর্মীয় রাষ্ট্রের কি একটা প্রস্তাব পাস করিয়ে ফেলেছেন তিনি। এরপর নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে আপোসের আশা আমি প্রায় ত্যাগ করেছি।‘
২. লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা
আমি প্রতিবাদ করিলাম। বলিলাম : ‘জিন্না সায়েবের সাথে দেখা না করার আপনের একশ’ একটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব তার একটা, একথা বলবেন না। লাহোর প্রস্তাব আপনে পৈড়া দেখছেন?’
সূতাষ বাবু স্বীকার করিলেন তিনি পড়েন নাই, শুধু হেডিং ও রাইটআপ দেখিয়াছেন। পড়িবার কি আছে? পাকিস্তান চাহিয়াছে। পাকিস্তান মানেই থিওক্রাসি। আমি বলিলাম : তাঁর ধারণা ভুল। পাকিস্তান শব্দটাও প্রস্তাবের কোথাও নাই। তিনি বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। আমি যথাসম্ভব প্রস্তাবের ভাষা ‘কোট’ করিয়া লাহোর প্রস্তাবের এইরূপ ব্যাখ্যা দিলাম। প্রথমতঃ ভারতের বর্তমান এগারটি প্রদেশকে রেসিডুয়ারি পাওয়ারসহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ মাত্র তিন-চারটি কেন্দ্রীয় বিষয় দিয়া একটি নিখিল ভারতীয় ফেডারেশন কায়েম করিতে হইবে। তৃতীয়তঃ এগারটির মধ্যে যে পাঁচটি মুসলিম প্রধান প্রদেশ আছে, তাদের মেজরিটি অর্থাৎ তিনটি প্রদেশ যদি দাবি করে তবে মুসলিম প্রধান পাঁচটি প্রদেশকে নিখিল ভারতীয় ফেডারেশন হইতে আলাদা হইয়া স্বতন্ত্র ফেডারেশন করিবার অধিকার দিতে হইবে।
আমার এই ব্যাখ্যা তিনি মানিলেন বলিয়া মনে হইল না। তিনি লাহোর প্রস্তাবের ফুল টেক্সট দেখিতে চাহিলেন। আমি তা দেখাইতে রাযী হইলাম। সোভিয়েট ইউনিয়নের কনস্টিটিউশনের এমন একটা বিধান আছে বলিয়া তিনি এক কপি রুশ শাসনতন্ত্র যোগাড় করিবার দায়িত্ব নিলেন। আলোচনা পরের দিনের জন্য মুলতুবি হইল। পরের দিন তিনি আমাকে তাঁর ফরওয়ার্ড ব্লক অফিসে নিয়া গেলেন। বৌবাজারের ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলের ত্রিতলে তিনি একটি সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন অফিস ইতিমধ্যেই খুলিয়া ফেলিয়াছিলেন। নিজে তিনি রীতিমত নিয়মিতভাবে এই অফিসে হাযিরা দিতেন। তাঁর সুসজ্জিত রুমে প্রবেশ করিয়া তিনি কয়েকখানি বই আনাইলেন। দেখিয়া পুলকিত হইলাম যে শুধু রুশ শাসনতন্ত্র নয়, সুইয়ারল্যান্ড, ইউ. এস, এ, কানডা ইত্যাদি কয়েকটি ফেডারেশনের কনস্টিটিউশনও যোগাড় করিয়াছেন।
রাজনীতি পঞ্চাশবর আমি লাহোর প্রস্তাবের খবরের কাগবে প্রকাশিত ফুলটেক্সট লইয়া গিয়াছিলাম। সেটা উচ্চস্বরে পড়িয়া-পড়িয়া আমার আগের দিনের ব্যাখ্যার সাথে মিল ফেলাইলাম। তিনি সব শুনিয়া বলিলেন : আপনার ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয়, তবে তার সবটুকু আমি মেনে নিলাম। এমন কি আমি আরও বেশি যেতেও রাযী। যদি পাঁচটা মুসলিম প্রদেশের মেজরিটি আলাদা ইউনিয়ন করতে চায় তবে তাতে আমি ত রাযী আছিই এমনকি একটা প্রদেশও যদি সিসিড করতে চায়, আমি তাতেও রাযী।
এই কথা বলিয়া রুশ শাসনতন্ত্রের ঐ ধারাটা আমার সামনে মেলিয়া ধরিলেন যাতে প্রত্যেক ইউনিয়ন রিপাবলিককে সিসিড করিবার অধিকার দেওয়া হইয়াছে।
৩. জিন্না-সুভাষ মোলাকাত
আমরা উভয়ে একমত হওয়ায় স্থির হইল যে সুভাষ বাবু জিন্ন সাহেব দেখা চাহিয়া শীঘ্রই তাঁর নিকট পত্র লিখিলেন। বিপুল আশা-উৎসাহের মধ্যে আমি সুভাষ বাবুর নিকট হইতে বিদায় হইলাম। ভারতীয় রাজনৈতিক সংকটের অবসান ও হিন্দু মুসলিম ঐক্যের একটা গোলাবী স্বপের মধ্যে বিচরণ করিতে-করিতে পরবর্তী কয়েকটা দিন কাটাইলাম। মাঝে মাঝে সুভাষ বাবুকে টেলিফোন করিতে লাগিলাম : ‘জিয়া সাহেবের নিকট চিঠি লেখছেন? সপ্তাহ খানেক বা তারও বেশি একই জবাব পাইলাম : লিখিনি আজো, তবে শীগগিরই লিখব।
আমি বিরক্ত ও নিরাশ হইয়া এ ব্যাপারে খোঁজ করা ছাড়িয়া দিলাম। ভাবিলাম সুভাষ বাবুর নিজেরই মনের পরিবর্তন হইয়াছে। এমন সময় তিনি নিজেই একদিন ফোন করিয়া বলিলেন, তিনি জিন্ন সাহেবের নিকট পত্র লিখিয়াছেন, এবং নিশ্চিত ডেলিভারির আশায় ডাকে না দিয়া মেয়র সিদ্দিকীর হাতে হাতে দিয়াছেন। আমি সেইদিনই সকালের কাগযে পড়িয়াছিলাম, কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র মিঃ আবদুর রহমান সিদ্দিকী বোম্বাই কর্পোরেশনের কর্তৃপক্ষের সংগে কি বিষয়ে আলোচনার জন্য বোম্বাই রওয়ানা হইলেন।
আমি নিরুৎসাহ হইলাম সে কথা সুভাষ বাবুকে বলিলাম। ব্যাপারটা ভণ্ডুল হইয়া গেল। কারণ সিদ্দিকী জিন্ন সাহেবের সূন্যরে নাই। সুভাষ বাবুও একটু আতংকিত হইলেন। আগে জানিলে তিনি এটা করিতেন না। কিন্তু এক্ষণে আর তার কোনও প্রতিকার নাই। দেখা যাক কি হয়। আমিও তার সাথে একমত হইলাম।
পাকিস্তান আন্দোলন কাগযে পড়িলাম, সিদ্দিকী সাহেবের জিন্ন সাহেবের সহিত মোলাকাত করিলেন। পরে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু সুভাষ বাবু জিন্না সাহেবের কোনও পত্র পাইলেন না। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে সুভাষ বাবু জানাইলেন, মিঃ সিদ্দিকীর মতে তিনি যে-কোনও দিন মিঃ জিন্নার পত্র পাইবেন। কিন্তু পনর দিনের বেশি সময় চলিয়া গেল। সুভাষ বাবু জিন্ন সাহেবের পত্র পাইলেন না। ইতিমধ্যে জিন্না সাহেব যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য-সহযোগিতা করা হইতে বিরত থাকার জন্য মুসলিম লীগারদের উপর নির্দেশ জারি করিলেন। সুভাষ বাবু এ কাজের জন্য জিন্না সাহেবকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। সুভাষ বাবুই একরকফানে হাসিয়া বলিলাম : করিয়া খবরের কাগযে বিবৃতি দিলেন। আমি সুভাষ বাবুকে ফোনে হাসিয়া বলিলাম। ‘এবার জিন্না সাহেবের পত্র না আইসা পারে না।’ তিনিও হাসিলেন, বলিলেন : কিন্তু কোন মতলবে তাঁকে কংগ্রেচুলেট করিনি। তাঁর কাজটি সত্যই প্রশংসার যোগ্য।
এরও বোধ হয় সপ্তাহখানেক পরে সুভাষ বাবু জিন্না সাহেবের পত্র পান। আমাকে ডাকিয়া পাঠান। লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যায় যা-যা আগে আলোচনা করিয়াছিলাম, তাই আবার দুহরাইলাম। তিনি এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুত। নির্ধারিত দিনে সুভাষ বাবুকে সি-অফ। করিবার জন্য শত-শত কর্মীর সাথে আমিও হাওড়া স্টেশনে গেলাম। সুভাষ বাবু বোম্বাই যাইতেছেন সত্য, কিন্তু তাঁর আসল উদ্দেশ্যের কথা আমি ছাড়া বোধ হয় আর কেউ জানিত না। গাড়ি ছাড়িবার প্রাক্কালে আমি সুভাষ বাবুর কাছ ঘেষিয়া কানে কানে বলিলাম : ওয়ার্ধায় নাইমা বুড়ার দোওয়া নিয়া যাবেন।
সুভাষ বাবু চমকিয়া উঠিলেন, মুখ বিষণ করিলেন। বোধ হয় বিরক্ত হইলেন। বুড়া মানে মহাত্মাজী। তাঁর সাথে সুভাষ বাবুর সম্পর্ক ভাল নয়। মাত্র সম্প্রতি তাঁর সমর্থক বলিয়া কথিত লোকেরা মহাত্মাজীকে হাওড়া বলে ও লিলুয়া স্টেশনে অপমান করিয়াছে। আমি সুভাষ বাবুর মনের কথা বুঝিলাম। আমার শক্ত হাতে সুভাষ বাবুর নরম হাতটি চাপিয়া ধরিলাম। আমার অনুরোধ রাখবেন। শুধু এই কথাটি বলিলাম। তাঁর হাত ছাড়িলাম না। গাড়ি ছাড়িয়া দেয় দেখিয়া তিনি শুধু বলিলেন : ‘আচ্ছা ভেবে দেখব।’
তাই যথেষ্ট। আমি দৌড়িয়া লাফাইয়া ট্রেন হইতে নামিলাম। অন্যান্যের সাথে হাত নাড়িলাম। তিনিও জানালায় মুখ বাড়াইয়া হাত ও রুমাল নাড়িতে থাকিলেন। যতক্ষণ দেখা গেল চাহিয়া থাকিলাম। তিনি দৃষ্টির বাহিরে গেলে আমার মন বলিল : ভারতের ভবিষ্যৎ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, এ সবেরই ক্ষীণ সূতাটি ঐ ট্রেনে ঝুলিতেছে।
পরদিন খবরের কাগয়ে পড়িলাম বোম্বাই যাওয়ার পথে সুভাষ বাবু ওয়াধায় নামিয়া মহাত্মাজীর সাথে দেখা করিয়াছেন। তাঁদের মধ্যে আধঘন্টা কথা হইয়াছে। তারপর পর-পর কয়েক দিনের কাগযে পড়িলাম। তিনি বোম্বাই পৌঁছিয়া জিন্না সাহেবের সাথে দেখা করিয়াছেন। কয়েক দিন কয়েকবার দেখা হইয়াছে। প্রতিবার দুই-তিন ঘন্টা আলাপ হইয়াছে। এক রাত্রে সুভাষ বাবু জিন্না সাহেবের বাড়িতে ডিনার খাইয়াছেন। ইতিমধ্যে কয়েক বার সুভাষ বাবু সর্দার প্যাটেল ও মিঃ ভুলাভাই দেশাইর সাথে দেখা করিয়াছেন।
সাফল্যের সম্ভাবনায় পুলকে আমার রোমাঞ্চ হইল। শীঘ্রই একটা ঘোষণা শুনিবার জন্য কান খাড়া করিয়া রহিলাম। এতদিনের হিন্দু-মুসলিম সমস্যা আজ চূড়ান্তরূপে মীমাংসা হইয়া যাইতেছে। ভারতের স্বাধীনতা ইংরাজ আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিল না। দেশবাসী জানে না এত বড় একটা শুভ ঘটনার মূলে রহিয়াছে আমার মত একজন নগণ্য ব্যক্তি। আল্লাহ কত ছোট বস্তু দিয়া কত বড় কাজ করাইতে পারেন। সত্যই তিনি কাঁদেরে-কুদরত। অপূর্ব তাঁর মহিমা!
সোনায় আবার সুহাগা! খবরের উপর যবর খবর! গান্ধীজী ও জিন্ন সাহেব উভয়কেই বড়লাট সিমলায় দাওয়াত করিয়াছেন। ব্যস, আর কি? কাম ফতে! সুভাষ বাবুর সাথে আলাপ হওয়ার পরই এ সব ঠিক হইয়াছে নিশ্চয়ই।
কয়দিন হাওয়ায় উড়িয়া বেড়াইলাম। একটা ঘোষণা প্রতিদিন আশা করিতে থাকিলাম। লটারির টিকিট কাটিয়া যেভাবে মানুষ পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়াইয়া থাকে।
গান্ধীজী ও জিন্ন সাহেব সিমলা গেলেন। কোন ঘোষণা বাহির হইল না। সুভাষ বাবুও ফিরিয়া আসিলেন না।
আমি পরম আগ্রহে সুভাষ বাবুর প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিতে থাকিলাম। তিনি এত দেরি করিতেছেন কেন? তবে তিনিও গান্ধীজিন্নার সাথে সিমলায় গেলেন নাকি? শেষ খবরে পড়িয়াছিলাম জিন্না সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া তিনি দিল্লীর পথে বোম্বাই ত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁর সিমলা যাওয়ার খবর বাহির হইল না। তার বদলে খবরের কাগযে পড়িলাম, সুভাষ বাবু এলাহাবাদে জওয়াহের লালের মেহমান হইয়াছে। তারপর বেশ কয়েকদিন আর কোনও খবর নাই। ইতিমধ্যে গান্ধীজী ও জিন্না সাহেব সিমলা হইতে ফিরিয়া আসিলেন, সে খবরও কাগযে পড়িলাম। হায়! ঘোষণাটা হইতে-হইতে হইল না বুঝি। আমি ব্যাকুলভাবে রোয সুভাষ বাবুর বাড়ি টেলিফোন করি। জবাব পাই, কোন খবর নাই। রোয টেলিফোন করায় তার বাড়ির কোনও লোক বোধ হয় ত্যক্ত হইয়াই বলিলেন: ‘আপনি খবরের কাগযের এডিটর। তিনি কোলকাতা ফিরলে আপনি আমাদের আগেই জানতে পারবেন।‘ সত্যই ত! লজ্জায় আর ফোন না করিয়া খবরের কাগযেই পড়িতে লাগিলাম। বেশ কিছুদিন কাটিয়া গেল। বাঞ্ছিত খবর আর বাহির হইল না। ইতিমধ্যে সুভাষ বাবু সম্পাদিত ‘ফরওয়ার্ড’ নামক ইংরাজী সাপ্তাহিকের যামিন তলব হইল। এই দিন জানিতে পারিলাম বেশ কয়েক দিন আগেই তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন। এবার সাহস করিয়া টেলিফোন করিলাম। ফোন ধরিলেন সুভাষ বাবু নিজে। স্বীকার করিলেন দুই দিন আগেই ফিরিয়াছেন। ইচ্ছা করিয়াই খবরের কাগযে খবরটা যাইতে দেন নাই। অন্ততঃ আমাকে খবরটা না-দেওয়ায় অভিমান করিলাম। তিনি হাসিয়া বলিলেন : ‘খবর দেবার মত কিছু নেই বলেই দেইনি। আচ্ছা আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যান।‘
সুভাষ বাবু যতই বলুন দেওয়ার মত খবর নাই। আমি কিন্তু আমার আগ্রহ দমাইতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গেলাম। মুখ-ভাবে কোন নৈরাশ্য ধরিতে পারিলাম না। আগের মতই হাসি মুখ। ও সুন্দর মুখে হাসি ছাড়া আর কিছু বড় একটা দেখি নাই তা
আমাকে চা-মিঠাই খাইতে দিয়া তিনি তাঁর জিন্না-মোলাকাতের বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। জিন্না সাহেব তাঁর সাথে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করিয়াছেন। লাহোর প্রস্তাবের যে ব্যাখ্যা সুতাষ বাবু করিয়াছেন জিন্না সাহেবের ধারণার সাথে তা হুবহু মিলিয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ সুভাষ বাবু জিন্না সাহেবের ধারণা মত লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করিতে পারায় জিন্না সাহেব বিস্মিত হইয়াছিলেন। এইখানে সুভাষ বাবু হাসিয়া বলিলেন : ‘জিন্না সাহেব পুনঃপুনঃ জিগ্গাস করা সত্ত্বেও আমি তাঁকে বলেছি এটা আমার নিজেরই ব্যাখ্যা; অন্য কেউ আমাকে এ ব্যাখ্যা দেননি। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। নিজের বাহাদুরির জন্য একাজ করিনি। অপরের ধার-করা বুদ্ধি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি, এটা স্বীকার করলে জিন্ন সাহেবের কাছে আমার দাম কমে যেত না? কি বলেন আপনি?’
আমি স্বীকার করিলাম। বলিলাম, তিনি ঠিক কাজই করিয়াছেন। তারপর সুভাষ বাবু বলিলেন, লাহোর প্রস্তাবের এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান করিতে জিন্না সাহেব খুবই আগ্রহী। কিন্তু তাঁর দৃঢ় মত এই যে আপোস কোনও ব্যক্তির মধ্যে হইবে না। সে ব্যক্তিরা যতই প্রভাবশালী হউন। আপোস হইতে হইবে কংগ্রেস ও লীগ এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। জিন্না সাহেব সুভাষ বাবুকে স্পষ্টই বছর। বলিয়াছেন, সুভাষ বাবু যতই জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা হউন, কংগ্রেসকে সাথে আনিতে না পারিলে জিন্না সাহেব তাঁর সাথে জাপোস করিতে পারেন না। এমন কি তাঁর ফরওয়ার্ড ব্লকের সাথেও না। তিনি সুভাষ বাবুকে খোলাখুলি উপদেশ দিলেন, সুভাষ বাবু কংগ্রেস ছাড়িয়া বুদ্ধির কাজ করেন নাই। তাঁর আবার কংগ্রেসে ফিরিয়া যাওয়া উচিৎ। এই ব্যাপারে জিন্না সাহেবের মধ্যে এতটা ব্যাকুল আগ্রহ ফুটিয়া উঠিয়াছিল যে শেষ বিদায়ের দিন জিন্ন সাহেব বাড়ির গেট পর্যন্ত সুভাষ বাবুকে আগাইয়া দিয়া এই শেষ কথাটা বলিয়াছিলেন : ‘কলিকাতা ফিরার আগে তুমি এলাহাবাদে জওয়াহের লালের কাছে যাও। তাঁকে তোমার মতে আন। তারপর তোমাদের যুক্ত শক্তিতে তোমার ব্যাখ্যা মত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে কংগ্রেস-লীগে যেদিন আপোস করিতে পারিবে সেটা হইবে ভারতের জন্য ‘লাল হরফের দিন।‘ ‘প্রিয় সুভাষ, আমায় বিশ্বাস কর, আমি পরম আগ্রহে সেদিনের অপেক্ষা করিতে থাকিলাম।‘
জিন্না সাহেবের ইংরাজী কথাগুলি হুবহু উদ্ধৃত করিবার সময় সুভাষ বাবুর মুখে যে আন্তরিকতা ফাটিয়া পড়িতেছিল, তাঁর মধ্যে জিন্না সাহেবের আন্তরিকতাও প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল। উপসংহারে সুভাষ বাবু বলিলেন : ‘জওয়াহের লাল আমার মত গ্রহণ করবেন এ বিশ্বাস আমার আদৌ ছিল না। তবু শুধু জিন্ন সাহেবের অনুরোধ রক্ষার্থে আমি তাঁর কাছে গেলাম। একদিন এক রাত উভয়ে মত বিনিময় করলাম। আমি দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হলাম যে জওয়াহের লাল লাহোর প্রস্তাবের আমার ব্যাখ্যা মেনে নিলেন এবং তাতে কংগ্রেস-লীগে আপোস হতে পারে তাও স্বীকার করলেন। কিন্তু গান্ধীজীর মতের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করতে তিনি রাজি নন। তাই নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম।’
প্রফুল্লতা ও মনোবল নিয়াই কথা শুরু করিয়াছিলেন। কিন্তু স্পষ্ট দেখিলাম, শেষ পর্যন্ত নৈরাশ্য গোপন করিবার চেষ্টায় ব্যর্থ হইলেন। অবশেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন : ‘নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম মিলনবোধ হয় আর সম্ভব হল না। বাংলা-ভিত্তিতে এ আপোস করার চেষ্টা করা যায় নাকি?’
৪. সুভাষ বাবুর অন্তর্ধান
এরপর বাংলা ভিত্তিতে মুসলমানদের সাথে কাজ করিবার বড় রকমের একটা চেষ্টা তিনি সত্য-সত্যই করিয়াছিলেন। সেটা সিরাজুদ্দৌলাকে বাংগালী জাতীয়তার প্রতীকরূপে জীবন্ত করা এবং তার প্রথম পদক্ষেপরূপে হলওয়েল মনুমেন্ট ভাংগার অভিযান চালান। আমার বিবেচনায় এইবার সুভাষ বাবু দেশবন্ধু ও আচার্য রায়ের রাজনীতিক দর্শনে পুনরায় বিশ্বাসী হন।
সিরাজুদ্দৌলার প্রতি আমার মমত্ববোধ ছিল অনেক দিনের। ছেলেবেলা ছিল এটা বাংলার মুসলিম শাসনের শেষ প্রতীক হিসাবে। পরবর্তীকালে কংগ্রেস কর্মী-হিসাবে বাংগালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পর সিরাজুদ্দৌলাকে বাংগালী জাতীয়তার প্রতীকরূপে গ্রহণ করার জন্য অনেক কংগ্রেসী সহকর্মীকে ক্যানভাস করিয়াছি। বাংলার নাট্যগুরু গিরিশ ঘোষ ও খ্যাতনামা ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের সিরাজুদ্দৌলাকে এই হিসাবেই বিচার করিয়াছেন বলিয়াও বহু মনগড়া যুক্তি খাড়া করিয়াছি। কিন্তু হিন্দু কংগ্রেসকর্মীদের কেউ এদিকে মন দেন নাই। কাজেই সূতাষ বাবুর মত জনপ্রিয় তরুণ হিন্দু নেতা এই মতবাদের উদ্যোক্তা হওয়ায় আমার আনন্দ আর ধরে না। ‘দৈনিক কৃষকে’র সম্পাদকীয়তে এই মতবাদের সমর্থনে প্রচুর যুক্তি দিতে লাগিলাম।
সুভাষ বাবু হলওয়েল মনুমেন্ট ভাংগার আন্দোলনে তাঁর পরিচালিত প্রাদেশিক কংগ্রেস ও ফরওয়ার্ড ব্লকের কমিগণসহ যোগ দিলেন। মুসলিম ছাত্র সমাজের তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা মিঃ আবদুল ওয়াসেক, মিঃ নূরুল হুদা ও মিঃ আনওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এই আন্দোলন আগেই শুরু হইয়াছিল। সুভাষ বাবু এতে যোগ দেওয়ায় সত্যাগ্রহের আকারে এই আন্দোলন খুব জোরদার হইল। জনপ্রিয় তরুণ মুসলিম নেতা চৌধুরী মোওয়ায্যম হোসেন (লাল মিয়া) অছাত্র মুসলিম তরুণদেরও এ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিলেন। প্রতি দিন দলে-দলে সত্যাগ্রহী গ্রেফতার হইতে লাগিল। আমার ‘কৃষক’–আফিস ৫নং ম্যাংগো লেন ডালহৌসি স্কোয়ারের খুব কাছে। সময় পাইলেই সত্যাগ্রহ দেখার জন্য হাজার হাজার দর্শকের শামিল হইতাম। সম্পাদকতার দায়িত্ব না থাকিলে হয়ত আন্দোলনে জড়াইয়াই পড়িতাম।
আন্দোলনকে জাতীয় রূপ দিবার জন্য সুভাষ বাবু ৩রা জুলাইকে (১৯৪০) ‘সিরাজ-স্মৃতি দিবস’ রূপে দেশব্যাপী পালন করা স্থির করিলেন। ১লা জুলাই আলবার্ট হলে জন-সভা হইল। লাল মিয়া এতে সভাপতিত্ব করিলেন। ওয়াসেক ও নূরুল হুদা এতে তেজঃদৃপ্ত বক্তৃতা করিলেন। সুভাষ বাবু ঐ সভায় ৩রা জুলাই দেশব্যাপী ‘সিরাজ-স্মৃতি দিবস’ পালনের আবেদন করিলেন। আরও ঘোষণা করিলেন যে ঐ দিন তিনি স্বয়ং কুড়াল,হাতে হলওয়েল মনুমেন্ট ভাংগার সত্যাগ্রহীদের নেতৃত্ব করিবেন। সুভাষ বাবুর এই ঘোষণার জবাবে প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব ঐদিনের আইন পরিষদের সান্ধ্য অধিবেশনে ঘোষণা করেন যে বাংলা সরকার শীঘ্রই হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ করিবেন। অতএব সত্যাগ্রহ বন্ধ হওয়া উচিৎ। পরদিন ২রা জুলাই সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়া সুভাষ বাবু বলেন যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অস্পষ্ট। অতএব এ ঘোষণা সত্ত্বেও সত্যাগ্রহ অব্যাহত থাকিবে এবং তিনি পরদিন (৩রা জুলাই) কুড়াল হতে সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব করিবেন। কিন্তু ২রা জুলাই রাত্রিতেই সুভাষ বাবু ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হইয়া প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী হইলেন।
সুভাষ বাবুর গ্রেফতারেও আন্দোলন দমিল না। মেয়র আবদুর রহমান সিদ্দিকী সুভাষ বাবুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিবৃতি দিলেন। কলিকাতা কর্পোরেশন মুলতবী হইয়া গেল। ইসলামিয়া কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা মিছিল করিতে লাগিল। সত্যাগ্রহ পূর্ণোদ্যমে চলিল। প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব ৮ই জুলাই আবার ঘোষণা করিলেন যে বাংলা সরকার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের সিদ্ধান্তে অটল আছেন। ইউরোপীয় মেম্বাররা হক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন না করিলেও সরকার তাঁদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিবেন না। এর আগের দিন ইউরোপীয় দলের নেতা মিঃ পি. জে. গ্রিফিথ সত্যসত্যই ঘোষণা করিয়াছিলেন যে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ করিলে ইউরোপীয় দল মন্ত্রিসভার প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করিবে।
কিন্তু সপ্তাহ কাল চলিয়া গেল সরকার মনুমেন্ট অপসারণ করিলেন না। কাজেই সত্যাগ্রহ খুব জোরেই চলিতে থাকিল। ওদিকে সরকার ১৭ই জুলাই হইতে সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত সমস্ত খবরের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিলেন। প্রচারের অভাবে সত্যাগ্রহ স্তিমিত হইয়া পড়িল। মিঃ ওয়াসেক ও মিঃ নূরুল হুদা প্রভৃতি ছাত্রনেতা তখন মিছিল বাহির করিলেন। এই মিছিল উপলক্ষে ইসলামিয়া কলেজে পুলিশ-মিলিটারি হামলা হইল। গুৰ্গা সৈন্যরা ছাত্রদের বেদম মারপিট করিয়াছে বলিয়া খবর রটিল। ছাত্রনেতা মিঃ ওয়াসেক ও মিঃ. আনওয়ার হোসেন আহত হইয়া হাসপাতালে গেলেন। মিঃ নূরুল হুদার নেতৃত্বে বহু ছাত্র প্রধানমন্ত্রী হক সাহেবের ঝাউতলার বাড়ি ঘেরাও করিল। হক সাহেব তাঁর স্বাভাবিক মিষ্টি কথায় ভরশা দিয়া ছাত্রদের ফিরাইয়া দিলেন।
সুভাষ বাবুর অবর্তমানে হলওয়েলে মনুমেন্ট সত্যাগ্রহ আস্তে-আস্তে ধিমাইয়া পড়িল। ছাত্র-নেতৃবৃন্দ বুঝিলেন সুভাষ বাবুকে খালাস করাই সত্যাগ্রহ তাজা করিবার একমাত্র উপায়। তখন ছাত্র-তরুণরা ইসলামিয়া কলেজ পুলিশী যুলুমের তদন্তের এবং সুভাষ বাবুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করিল। মুসলিম লীগ নেতারা ও কর্পোরেশনের মেয়র খবরের কাগযে বিবৃতি দিয়া সুভাষ বাবুর মুক্তি দাবি করিলেন। হক সাহেব ইসলামিয়া কলেজে পুলিশী হামলার তদন্তের জন্য হাই কোর্টের বিচারপতি মিঃ তরিক আমির আলির পরিচালনায় একটি তদন্ত কমিশন গঠন করিয়া এবং সুভাষ বাবুর মুক্তির আশ্বাস দিয়া ছাত্রদেরে শান্ত করিলেন। কিন্তু সুভাষ বাবু ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হওয়ায় প্রাদেশিক সরকারের এতে কোন হাত ছিল না। তাই ভারত সরকারের সাথে দরবার করিয়া অবশেষে ডিসেম্বর মাসে সুভাষ বাবুকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু সুভাষ বাবু স্বগৃহে অন্তরীণ থাকিলেন। তাঁর উপর একটি ফৌজদারী মামলাও ঝুলাইয়া রাখা হইল।
অন্তরীণ থাকিলেও সুভাষ বাবুর সাথে দেখা-সাক্ষাতের খুব কড়াকড়ি ছিল না। মুক্তির দুই-তিন-দিন পরেই তাঁর সাথে দেখা করিলাম। দেখিয়া তাজ্জব হইলাম। মনে হইল সপ্তাহ কাল শেভ করেন নাই। সুভাষ বাবুর দাড়ি-গোঁফ ও তাঁর সুন্দর মুখ শীর উপযোগী চাপ দাড়ি শেভ না করার কারণ জিগ্গাসা করিলে তাঁর স্বাভাবিক মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন : শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের সাথেই পলিটিকস্ করব যখন ঠিক করেছি, তখন তাদের একজন হতে দোষ কি? ঐ একবারের বেশি তার দেখা পাই নাই। শুনিলাম তিনি মৌন-ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন।
এটা ছিল বোধ হয় ১৯৪১ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ। পরে জানা গিয়াছিল ১৬ই জানুয়ারি হইতে তিনি নিজেও ঘর হইতে বাহির হইতেন না। কাউকে তাঁর ঘরে ঢুকিতেও দেওয়া হইত না। নির্ধারিত সময়ে তাঁর খানা দরজার সামনে রাখিয়া কপাটে টুকা দিয়া ঠাকুর সরিয়া আসিত। সুভাষ বাবু তীর সুবিধা মত খাবার ভিতরে নিতেন এবং খাওয়া শেষে বুটা বাসনপত্র দরজার বাহিরে নির্ধারিত স্থানে রাখিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিনে। এইভাবে কিছুকাল চলার পর ২৫শে জানুয়ারি দেখা গেল ২৪শে তারিখের-দেওয়া খাবার অছোওয়া অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। ঠাকুরের মূখে এটা জানিয়া বাড়ির সবাই সুষ বাবুর ঘরের সামনে সমবেত হইলেন। দরজা খুলিয়া দেখিলেন ঘর শূন্য। মুহূর্তে সারা কলিকাতা ফাটিয়া পড়িল। যথাসময়ে দেশবাসী জানিতে পারিল তিনি ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করিয়াছেন।
সুভাষ বাবুর অন্তধানে আমি সত্যই খুব দুঃখিত হইয়াছিলাম। কারণ এর পরে হিন্দু নেতৃত্বের অখণ্ড ভারতীয় মনোবৃত্তির বন্যা রোধ করিবার মত শক্তিশালী নেতা হি-বাংলায় আর কেউ থাকিলেন না। একথা শরৎ বাবুর কাছেও আমি বলিয়াছি। তিনি আমার সাথে একমত ছিলেন। কিন্তু তার সাথে অধিকতর ঘনিষ্ঠ হইয়া আমার আশা হইয়াছিল সুভাষ বাবুর রাষ্ট্র-দর্শনের নিশান বহন করিতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমার বিশ্বসও হইয়াছিল। নিষ্ঠাবান সাত্বিক হিন্দু হইয়াও যে রাজনীতিতে উদার। অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী হওয়া যায় শরৎ বাবু ছিলেন তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। তাঁর চরিত্রের এই দিকটা আমাকে এত মুগ্ধ করিয়াছিল যে সুভাষ বাবুর অন্তর্ধানের পর শরৎ বাবুর উডবর্ণ পার্কের বাড়ি আমার প্রায় প্রাত্যহিক আড্ডায় পরিণত হইয়াছিল।
সুভাষ বাবুর উত্তরাধিকারী হিসাবে পরবর্তীকালে শরৎ বাবুই নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বাঙালীর স্বাতন্ত্রের সংগ্রাম চালাইয়া যান জীবনের শেষ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের সাথে মিলিয়া তিনি যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতেও শরৎ বাবুর এই বাংগালীর স্বাতন্ত্রের মনোভাব সুস্পষ্ট ছিল। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কলিকাতা নির্বাচক মণ্ডলীতে কংগ্রেসের সকল শক্তির বিরুদ্ধে একা লড়াই করিয়া তিনি কংগ্রেসকে পরাজিত করিয়াছিলেন। এসব ব্যাপারেই আমার প্রাণ ছিল শরৎ বাবুর সাথে। হিন্দু ভোটারদের উপর কোনও প্রভাব না থাকা সত্ত্বেও আমার সম্পাদিত ‘ইত্তেহাদ’ পুরাপুরি শরৎ বাবুর সমর্থক ছিল।
৫. কমরেড এম, এন, রায়ের প্রভাব
জিন্না-সুভাষ মোলকাত ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও তার একটা ছাপ আমার মনে স্থায়ী হইয়াছিল। আমি নয়া ধারায় চিন্তা করিতে শুরু করি। এই চিন্তায় কমরেড এম এন রায়ের সাহচর্য আমাকে অনেক দূর আগাইয়া নিয়া যায়। ১৯৩৮ সালে দিল্পী কংগ্রেস কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে কমরেড রায়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তার আগে কমরেড রায়ের প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল নিতান্তু রোমান্টিক। বিশ্ব কমিউনিয়মের অন্যতম নেতা স্ট্যালিনের সহকর্মী হিসাবে তিনি ছিলেন আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে এক মনীষী। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর আমার ভক্তির রোমান্টিক দিকটার অবসান হইলেও শ্রদ্ধা-ভক্তি এতটুকু কমে নাই। বরঞ্চ বাড়িয়াছে। বাস্তব রাজনীতিতে অবশ্য তাঁর মতবাদ ও উপদেশ নির্ভরযোগ্য মনে করিতাম না। সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর মত ধৈর্য ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় প্রথম দিকে তিনি আমাকে কৃষক-প্রজা পার্টি ভাংগিয়া সমস্ত কর্মীদের লইয়া সদলবলে কংগ্রেসে যোগ দিবার পরামর্শ দেন। তাঁর উপদেশ অগ্রায় করার পর তিনি নিজেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং আমরা কৃষক-প্রজা কর্মীর কংগ্রেসে যাওয়ায় আমাদের প্রশংসা করেন। কলিকাতার মুসলিম ছাত্রদের উদ্যোগে আহত মুসলিম ইনষ্টিটিউটের এক সভায় তিনি কংগ্রেসকে ‘নিমজ্জমান নৌকা বলেন এবং উহা হইতে সাঁতরাইয়া পার হওয়ার জন্য দেশ-প্রেমিকদের অনুরোধ করেন। কিন্তু আদর্শগত দিক হইতে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত আমাকে বিস্মিত ও মোহিত করিয়াছিল। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক এজা-পার্টির প্রভাবে ভারতের সকল গণ-প্রতিষ্ঠান যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলিতেছিলেন, তখন কমরেড রায় একাই ফ্যাসি-নাযিবাদকে মানবতার শত্রু ও সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে বড় দুশমন প্রমাণ করেন এবং এই যুদ্ধকে গণযুদ্ধ বা পিপলস ওয়ার’ আখ্যা দেন। বিশ্বের একমাত্র সমাজবাদী রাষ্ট্র রাশিয়া হিটলারের সমর্থন করায় আমরা কমরেড রায়ের কথায় তখন বিশ্বাস করি নাই। তাঁর উপদেশ মানি নাই। পরে ১৯৪১ সালের জুন মাসে যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ায়, তখন কমরেড রায়ের কথার সত্যতায় এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় আমার শ্রদ্ধা আকাশচুনী হইয়া গেল।
১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষক-প্রজা সমিতির সেক্রেটারি ও আইন পরিষদে কৃষক-প্রজা পার্টির লীডার বন্ধুবর শামসুদ্দিন পদত্যাগ করার পর হক মন্ত্রিসভার সহিত কৃষক-প্রজা সমিতির সম্পর্ক আগের চেয়েও তিক্ত হইয়া পড়িল। ফলে আমার পক্ষে হক সাহেবের সহিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যাতায়াত রক্ষা করাও আর সম্ভব রহিল না।
১৯৩৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ইউরোপে মহাযুদ্ধ বাধিয়া গেল। ভারতবাসীর বিনা-অনুমতিতে ভারতবর্ষকে ইউরোপীয় যুদ্ধে জড়ানোর প্রতিবাদে সাতটি কংগ্রেসী প্রদেশ হইতেই কংগ্রেসী মন্ত্রীসভারা ২২শে ডিসেম্বর পদত্যাগ করিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৩৮ সালে মুসলিম লীগ পীরপুর রিপোর্ট নামে একটি রিপোর্টে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা সমূহের মুসলমানদের উপর যুলুমের ফিরিস্তি প্রচার করিয়াছিল। কংগ্রেসী মন্ত্রীদের পদত্যাগকে মুসলিম লীগ কংগ্রেসী যুলুম হইতে মুসলমানদের নাজাত ঘোষণা করিয়া ২৩শে ডিসেম্বর সারা ভারতে ‘নাজাত দিবস’ পালন করে। এতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক আরও তিক্ত হইয়া পড়ে। এমন সাম্প্রদায়িক তিক্ততার মধ্যে কৃষক-প্রজা সমিতির অসাম্প্রদায়িক অর্থনীতিক রাজনীতি পরিচালন মুসলমান জনসাধারণ্যে খুবই কঠিন হইয়া পড়িল। তার উপর ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় এবং স্বয়ং হক সাহেবই সেই প্রস্তাব উত্থাপন ও তার সমর্থনে মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করায় বাংলার মুসলমানদের মধ্যেও পাকিস্তান দাবির ও মুসলিম লীগের শক্তি শতগুণে বাড়িয়া গেল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সভা-সমিতি ও প্রচার-প্রচারণা অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়সাধ্য হইয়া পড়ায় কৃষক-প্রজা সমিতির মত গরিব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সভা সম্মিলন করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। ফলে কৃষক-প্রজা সমিতির দাবিদাওয়া এবং হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা কেবল মাত্র সমিতির দৈনিক মুখপত্র ‘কৃষকে’র পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ হইল।
৬. দৈনিক কৃষক
‘কৃষকে’র সম্পাদক গ্রহণ করিয়াছিলাম আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সুতরাং ‘কৃষকের কথাটাও আমার দেখা-রাজনীতির এলাকায় পড়ে। কাজেই এ সম্বন্ধে দুচার কথা বলা এখানে অবান্তর হইবে না।
সমিতির সেক্রেটারি শামসুদ্দিন সাহেবের মন্ত্রিত্বের আমলেই দৈনিক কৃষক বাহির করা স্থির হয়। আমারই উপর উহার সম্পাদকতার ভার চাপান হয়। কোম্পানি রেজিস্টারি করা হয়। মৌঃ শামসুদ্দিন সাহেব, মৌঃ সৈয়দ নওশের আলি, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান ও ডাঃ আর, আহমদ সাহেবান লইয়া বোর্ড-অব-ডিরেক্টর গঠিত হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হন ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক ‘কৃষক’ বাহির হয়। কিন্তু কাগযের বয়স দুইমাস পুরা হইবার আগেই মৌঃ শামসুদ্দিন মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করেন। ফলে মন্ত্রিত্বের জোরে বিজ্ঞাপনাদি জোগাড় করিয়া কাগয চালাইবার আশা দূর হইল। অধ্যাপক কবির অতি কষ্টে বছর খানেক কাগয় চালাইয়া খান বাহাদুর মোহাম্মদ জানের কাঁধে এ ভার চাপাইলেন। খান বাহাদুর দাতা-দয়া কংগ্রেস সমর্থক ব্যবসায়ী পশ্চিমা লোক ছিলেন। বাংলার কৃষক-প্রজার সমস্যা তিনি বুঝিতেন না। কাজেই কংগ্রেসী মুসলমান হিসাবে যতটা পারেন ‘কৃষক’কে সাহায্য করিতেন। তিনিও বেশিদিন কৃষকের বিপুল ঘাটতি সইতে পারিলেন না। ডিরেক্টরদের সমবেত চেষ্টায় বিশেষতঃ অধ্যাপক কবিরের মধ্যস্থতায় কলিকাতার অন্যতম বিখ্যাত ব্যাংকার। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী মিঃ হেমেন্দ্র নাথ দত্ত ‘কৃষকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হইতে রাজি হইলেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার অধিবাসী এবং অধ্যাপক কবিরের বিশেষ বন্ধু। কাজেই তিনি আমাদের দ্বারা অভিনন্দিত হইলেন। তাঁর পরিচালনায় ‘কৃষক’ বেশ সচ্ছন্দে চলিতে লাগিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে কৃষক ছাড়িয়া দিতে আমি বাধ্য হইলাম। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝার সুবিধার জন্য সে কারণটাও এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি।
এই সময় হক মন্ত্রিসভা বেংগল সেকেণ্ডারি এডুকেশন বিল আইন পরিষদে পেশ করেন। এই বিলের মর্ম এই যে মাধ্যমিক শিক্ষা (ম্যাট্রিক পরীক্ষা) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত হইতে নিয়া সরকার গঠিত একটি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের হাতে দেওয়া হইবে। উদ্দেশ্যটি মহৎ এবং তৎকালে সভ্য-জগতের সর্বত্র শিক্ষা-ব্যবস্থায় এই পন্থাই চালু ছিল। স্বাধীনতা লাভের পরে ভারতে ও পাকিস্তানে এই ব্যবস্থাই চালু হইয়াছে। বর্তমানে পশ্চিম বাংলাতেও তথাকার মাধ্যমিক শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নাই। একটি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের হাতেই আছে।
কিন্তু তৎকালে দল-মতনির্বিশেষে সমস্ত হিন্দু হক মন্ত্রিসভার এই বিলের প্রতিবাদ করেন। এমন কি, বিল আসিতেছে শুনিয়াই প্রায় বছর দিন ধরিয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই বিলের আগাম প্রতিবাদ চলিতেছে। কয়েক মাস আগে (২৫শে জানুয়ারি) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করা হইয়াছে এবং সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার হুমকি দিয়াছে।
এমন সময়ে এই বিলের সমর্থনে কৃষকে আমি পরপর কয়েকটা সম্পাদকীয় লিখি। মিঃ দত্তের নযরে পড়ে তা। তিনি আমার সাথে দেখা করিয়া প্রতিবাদ করেন। বলেন : আপনি একটা সাম্প্রদায়িক বিল সমর্থন করিয়া ‘কৃষকের অসাম্প্রদায়িক নীতির’ খেলাফ কাজ করিয়াছেন। আমি জবাবে তাঁকে বুঝাইবার চেষ্টা করি : ‘বিলটা সাম্প্রদায়িক নয়।‘ হিন্দুদের প্রতিবাদটাই সাম্প্রদায়িক সম্পাদকীয় গুলিতে উল্লেখিত বিভিন্ন সভ্য দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার নযিরের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কিন্তু তিনি মানেন না। ঐ বিলের সমর্থনে আর লেখা হইলে তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকিবেন না বলিয়া আমাকে হুশিয়ার করিয়া দিলেন। অন্যান্য ডিরেক্টরদেরও জানাইলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা সবাই আমার সমর্থক ছিলেন। তাঁরা আমাকে কিছু বলিলেন না। আমি এ বিষয়ে আরও দু’একটা সম্পাদকীয় লিখিলাম।
ফলে এ দাঁড়াইল যে আমি নীতি না বদলাইলে অথবা ‘কৃষক’ ত্যাগ না করিলে মিঃ দত্ত আর কৃষক’ চালাইবেন না বলিয়া দিলেন। মিঃ দত্ত সরিয়া পড়িলে কৃষক বন্ধ হইবে, এটা নিশ্চিত। অতএব ‘কৃষক বাঁচাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে আমিই কৃষক ত্যাগ করিলাম। অন্যান্য ডিরেক্টররাও সকলেই পদত্যাগ করিলেন। স্টাফেরই একজন মুসলমানের নাম সম্পাদকরূপে ছাপিয়া ‘কৃষক’ চলিতে লাগিল।
কিন্তু আমি আর্থিক বিপদে পড়িলাম। ময়মনসিংহে ওকালতি গুটাইয়া বাসা ছাড়িয়া টেবিল-চেয়ার বিলি করিয়া সপরিবারে ময়মনসিংহ ছাড়িয়া ছিলাম। যাকে বলে ‘নদী পার হইয়া একেবারে নৌকা পোড়ানো’ আর কি?
এমন অবস্থায় বিপদের বন্ধুরূপে দেখা দিলেন আমার সহোদর-তুল্য ছোট ভাই খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম। তিনি তখন বাংলা সরকারের সহকারী জুডিশিয়াল সেক্রেটারি। তার পরামর্শে আলিপুর কোর্টে এবং কলিকাতা স্মলক কোর্টে প্র্যাকটিস করা সাব্যস্ত করিলাম। তৎকালে উকিল (প্লিডারদের ওকালতি ছাড়া অন্য কাজ করিতে হাইকোর্টে দরখাস্ত দিয়া ওকালতি সসপেণ্ড করিতে হইত। আমি কৃষকের সম্পাদক নিবার সময় তাই করিয়াছিলাম। এবার পুনরায় ওকালতি শুরু করিবার দরখাস্ত দিয়া তার জবাবের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
৭. হক সাহেবের ‘নবযুগে’
এমন সময় হক সাহেব ডাকিয়া পাঠাইলেন। তিনি দৈনিক ‘নবযুগ’ বাহির করা স্থির করিয়াছেন। আমাকে তার সম্পাদনার ভার নিতে হইবে। দুইটা কারণে হক সাহেবের এই প্রস্তাবে আকৃষ্ট হইলাম। এক অর্থনৈতিক, দুই রাজনৈতিক। ‘কৃষকে’ দুইশত টাকা বেতন ও পঞ্চাশ টাকা এলাউন্স একুনে আড়াইশ টাকা পাইতাম। কলিকাতায় ওকালতি শুরু করিয়াই এত টাকা পাওয়ার আশা ছিল না। হক সাহেব আমার আর্থিক অবস্থার সব খবর জানিতেন। তিনি পঞ্চাশ টাকা বেশি করিয়া তিনশত টাকা বেতন-ভাতার কথা বলিলেন। বন্ধুবর সৈয়দ বদরুজা, সৈয়দ আযিযুল হক (নান্না মিয়া) ও ওয়াহিদুযযামান (ঠাণ্ডা মিয়া) সকলেই এই প্রস্তাবে আমাকে রাযি করাইতে চেষ্টা করিলেন। আমার আর্থিক আসন্ন দুরবস্থার একটা প্রতিকার হয় এটা আমি স্পষ্টই বুঝিলাম। রাজনৈতিক কারণটা আরও সুদূরপ্রসারী। উক্ত তিন বন্ধু সেদিকে আরও বেশি জোর দিলেন। জিন্না-নেতৃত্ব মুসলিম বাংলার স্বার্থবিরোধী তা হক সাহেব বুঝিতে পারিয়াছেন। তাই তিনি সসম্মানে মুসলিম লীগ হইতে বাহির হইয়া আসার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন। ‘নবযুগ’ বাহির করা তারই প্রথম পদক্ষেপ। হক সাহেবের কথা-বার্তায় তা বুঝিলাম। উক্ত তিন বন্ধু এ কাজকে অর্থাৎ হক সাহেবকে মুসলিম লীগের কবল হইতে উদ্ধার করাকে মুসলিম-বাংলার স্বার্থে একটা বড় কাজ বলিয়া আমার দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করিলেন। আকৃষ্ট হইবার জন্য আমি এক পায় খাড়াই ছিলাম। অতি সহজেই তাঁদের এই যুক্তি মানিয়া লইলাম। আমার সিদ্ধান্ত দ্রুততর করিলেন বন্ধুবর শামসুদ্দিন। হক সাহেবকে মুসলিম লীগের কবলমুক্ত করিবার চেষ্টা তিনি বেশ কিছুদিন আগে হইতেই করিতেছিলেন। তিনি আমাকে জোর দিয়াই বলিলেন, আমি ‘নবযুগের’ দায়িত্ব না নিলে তাঁর এতদিনের চেষ্টা সাফল্যের তীরে আসিয়া নৌকাডুবি হইবে।
কথাবার্তা অনেক দিন ধরিয়া চলিল। বন্ধুবর সিরাজুল ইসলামের কানে কথাটা গেল। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠান হিসাবে মুসলিম লীগের এবং ব্যক্তিগতভাবে সার নাযিমুদ্দিনের সমর্থক। হক সাহেবের তিনি ছিলেন খুব বিরোধী। তিনি আমাকে হুশিয়ার করিলেন আমার ওকালতি আবার সসপেণ্ড করিলে তাঁর পক্ষে আমাকে সাহায্য করা সম্ভব হইবে না। আমি সে কথাটা হক সাহেবের সাথে পরিষ্কার করিয়া লইলাম। কাগযের সম্পাদক রূপে নাম থাকিবে হক সাহেবের নিজের। কাজেই আমার নামও দিতে হইবে না, ওকালতিও সসপেণ্ড করিতে হইবে না। আমি বুঝিলাম নূতন কাগয প্রতিষ্ঠিত করিতে গিয়া আমি ওকালতির সময় পাইব খুব কমই। কিন্তু সেটা আমার চিন্তার কারণ ছিল না। দরখাস্ত করিয়া ফরম্যালি ওকালতি সসপেণ্ড না করিলেই হইল।
শামসুদ্দিন সাহেব নানা মিয়া, ঠাণ্ডা মিয়া ও ছাত্রনেতা নূরুল হুদা আমাকে সংগে লইয়া দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করিয়া বাড়িভাড়া করা হইতে মেশিন ও টাইপ আদি ছাপাখানার সাজ-সরঞ্জাম কিনার সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া ফেলিলেন। কাগযের ডিক্লারেশন লওয়া হইয়া গেল। তৎকালে ডিক্লারেশন লইতে সম্পাদকের নাম দিতে হইত না। শুধু প্রিন্টার-পাবলিশারের নাম দিতে হইত।
কিন্তু সব ওলট-পালট করিয়া দিলেন একদিন হক সাহেব নিজে। তিনি আমাকে জানাইলেন, সম্পাদকের নাম আমারই দিতে হইবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি পাকিস্তান আন্দেলন কোনও কাগযের সম্পাদক হইতে পারেন না। লাট সাহেব স্বয়ং তাঁকে বারণ করিয়া দিয়াছেন। আমার সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হইয়া যায় দেখিয়া আমি চটিয়া গেলাম। সন্দেহ হইল, এটা হক সাহেবেরই চালাকি। আগে হইতে আমাকে ভাড়াইয়া আনিয়া একাদশ ঘটিকায় লাট সাহেবের দোহাই দিয়া আমাকে নাম দিতে বাধ্য করিবেন, এটা তাঁর আগেরই ঠিক-করা ফন্দি ছিল। আমি তর্ক করিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাগযের সম্পাদক হওয়ায় কোন আইনগত বাধা থাকিতে পারে না। আজকাল গণতন্ত্রের যুগ। পার্টি গবর্নমেন্ট। পার্টি লিডাররাই প্রধানমন্ত্রী। কাজেই পার্টির মুখপত্রের সম্পাদক হওয়ায় লিডারের কোন বাধা থাকিতে পারে না। কথা-বার্তায় বেশ বুঝা গেল এটা হক সাহেবের চালাকি নয়। লাট সাহেব সত্য-সত্যই আপত্তি করিয়াছেন। তবে আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সার নাযিমুদ্দিনই সেক্রেটারিদেরে দিয়া লাট সাহেবের মুখ হইতে ঐ আদেশ বাহির করিয়াছেন। হক সাহেবের ভাব-গতিক হইতে স্বয়ং লীগ মন্ত্রীরা বুঝিয়াছিলেন, হক সাহেব কি উদ্দেশ্যে দৈনিক বাহির করিতেছেন। সম্পাদক হিসাবে। হক সাহেবের নাম থাকিলে উহার ওজন ও জনপ্রিয়তা বাড়িবে, এটাও নিশ্চয়ই তাঁরা
বুঝিয়াছেন। তাই লাট সাহেবকে দিয়া তাঁরা এই কাজ করাইয়াছেন। কিন্তু লাট সাহেবের আদেশে তিনি ভয় পাইয়াছেন এমন মর্যাদাহানিকর ব্যাখ্যা হক সাহেব দিলেন না। তিনি আমার ‘পার্টি লিডার’ ‘পার্টি মুখপত্র’ ‘পার্টি গবর্নমেন্ট’ ইত্যাদি কথার জবাবে মুচকি দুষ্ট হাসি হাসিয়া বলিলেন : ‘ওসব কথা কেন কও? কি উদ্দেশ্যে কাগ্য বাইর হৈতেছে তাত জানই।‘
আমি পরাজিত হইলাম। কিন্তু নিজের নাম দিতে কিছুতেই রাজি হইলাম না। সিরাজুল ইসলামও বলিলেন, আমিও বুঝিলাম, হক সাহেবের মতের স্থিরতা এবং কাগযের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে কোনও ভরশা নাই। কাজেই এই কাজ করিতে গিয়া ওকালতি আবার সসপেণ্ড করিলে সেটা নিতান্তই রিস্কি হইবে। অতএব আমি রাজি হইলাম না। একটা অচল অবস্থার সৃষ্টি হইল। কাগয বাহির না হইলে সকলের চেয়ে বেশি লোকসান আমারই। সুতরাং খুব-তেরেসে ভাবিতে লাগিলাম। একটা ব্রেন ওয়েভ হইল। আমাদের সকলের প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম এই সময়ে দারুণ অর্থ কষ্টে ভুগিতেছিলেন। ডিক্রিদাররা তাঁকে কোর্টে টানাটানি করিতেছিল। অতএব তাঁকে ভাল টাকা বেতন দিয়া তাঁর নামটা সম্পাদক রূপে ছাপিলে আমাদের উদ্দেশ্যও সফল হয়; কবিরও অর্থ-কষ্টের লাঘব হয়। কথাটা বলা মাত্র বন্ধুবর নান্না-ঠাণ্ডা মিয়া ও নূরুল হুদা লুফিয়া লইলেন। আমরা দল বাঁধিয়া তাঁর বাড়ি গেলাম। তিনি সানন্দে রাজি হইলেন। তাঁকে লইয়া আমরা হক সাহেবের নিকট আসিলাম। এক দিনে সব ঠিক হইয়া গেল। কবিকে বেতন দেওয়া হইবে তিনশ’, এলাউন্স পঞ্চাশ, একুনে সাড়ে তিনশ’।
যথাসময়ের একটু আগে-পিছে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে ধুম-ধামের সাথে ‘নবযুগ’ বাহির হইল। জোরদার সম্পাদকীয় লিখিলাম। সোজাসুজি মুসলিম লীগ বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিছু বলিলাম না। মুসলিম বাংলার বাংলা দৈনিকের আধিক্যের প্রয়োজনের উপরেই জোর দিলাম। তোখড় সম্পাদকীয় হইল। অমনি জোরের সম্পাদকীয় চলিতে লাগিল। সবাই বাহ্বাহ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু আমাদের আসল আশা পূর্ণ হওয়ার আশু কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না। আমাদের আসল আশা ছিল হক সাহেবকে মুসলিম লীগ হইতে বাহির করিয়া আনা। আমরা যখন ‘নবযুগের আয়োজন শুরু করি, তখনই হক-জিন্না বিরোধ চরমে উঠিয়াছে। দুই-একদিনের মধ্যেই শুভ কাজটা হইয়া যাইবে, এটাই ছিল আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। বিরোধটা ছিল ভারত সরকার-গঠিত জাতীয় সমর-পরিষদ (ন্যাশন্যাল ওয়ার কাউন্সিল) হইতে হক সাহেবের পদত্যাগ উপলক্ষ করিয়া। ব্যাপারটা অনেকেরই খবরের কাগযে পড়া আছে নিশ্চয়ই। তবু পাঠকদের স্মৃতি ঝালাইবার জন্য সংক্ষেপে ব্যাপারটার পূনরুল্লেখ করিতেছি। ১৯৪১ সালের জুন মাসে ইউরোপীয় যুদ্ধে হিটলারের জয়-জয়কার। অন্যতম প্রধান মিত্রশক্তি ফ্রান্স যুদ্ধে হারিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে হিটলারের স্বস্তিকা’ পতাকা উড়িতেছে। হিটলারের খ্যাতনামা সেনাপতি ফিল্ড মার্শাল রোমেল মিসরের আল-আমিনের যুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীকে পর্যদস্ত করিয়া সুয়েজ খাল ধরে-ধরেন। সমগ্র ইউরোপ জয়ের উল্লাসে উন্মত্ত হইয়া হিটলার এই জুন মাসেই তাঁর এত দিনের মিত্র এবং নিরপেক্ষ সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করিয়াছেন। এক মাসের মধ্যে অর্থাৎ জুলাই পার হইবার আগেই মস্কো দখল করিবেন বলিয়া সদম্ভে ঘোষণা করিয়াছেন।
৮. হক সাহেব ও সমর-পরিষদ
আমরা ভারতবাসীরা ইংরেজের পরাজয় কামনাই করিতেছিলাম। হিটলারের পরিণম জয় সম্পর্কেও আমাদের কোন সন্দেহ ছিল না আগে হইতেই। জুন মাসে দেখা গেল স্বয়ং ইংরাজরা ঘাবড়াইয়া গিয়াছে। তার প্রমাণ স্বরূপ ভারতীয় নেতাদেরে, বিশেষতঃ কংগ্রেস ও লীগকে, খুশী করার জন্য বড়লাট তৎপর হইয়া উঠিলেন। বড় লাটের শাসন-পরিষদকে বড় করিয়া বেশির ভাগ ভারতীয় নিবার প্রস্তাব দিলেন। আর যুদ্ধ-পরিচালনা ব্যাপারেও ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের পন্থা হিসাবে ‘জাতীয় সমর-পরিষদ’ এই গাল-রা নামে এক কাউন্সিল গঠন করিলেন। ঘোষণায় বলা হইল প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীরা পদাধিকারের বলে স্বতঃই কাউন্সিলের মেম্বার হইলেন। সে পদ গ্রহণ করিবার জন্য বড় লাট তাঁদেরে পত্র দিলেন। সকলেই তা গ্রহণ করিলেন। সাতটি প্রদেশ হইতে কংগ্রেসীরা আগেই মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়াছিলেন। সে সব প্রদেশে লাটের শাসন চলিতেছিল। শুধু বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে মন্ত্রিসভা চলিতেছিল। কাজেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শুধু তারাই সমর-পরিষদের মেম্বার হইলেন। এঁরা সবাই মুসলিম লীগের লোক। কাজেই লীগ সভাপতি জিন্না সাহেব এদেরে নির্দেশ দিলেন সমর-পরিষদ হইতে পদত্যাগ করিতে। জিন্না সাহেবের যুক্তি এই যে বৃটিশ সরকার মুসলিম লীগের দাবির ভিত্তিতে আপোস না করা পর্যন্ত মুসলিম লীগ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় কোনও সাহায্য করিবে না। মুসলিম লীগের এই সিদ্ধান্তটা ঠিক কংগ্রেসী সিদ্ধান্তের অনুরূপ। কংগ্রেসও ১৯৪০ সালের মার্চ হইতে বিভিন্ন অধিবেশনে এই দাবি করিয়া আসিতেছিল যে বৃটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তিতে কংগ্রেসের সহিত একটা রফা না করা পর্যন্ত কংগ্রেস যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় কোনও সহযোগিতা করিবে না।
৯. মিঃ জিন্নার যুদ্ধ-প্রচেষ্টার বিরোধিতা
মুসলিম লীগেরও এটা নূতন কথা নয়। মুসলিম লীগের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে জিন্না সাহেব ১৯৪০ সালের ১০ই জুন তারিখে এক বিবৃতিতে সমস্ত মুসলিম লীগারদেরে, বিশেষতঃ মুসলিম মন্ত্রীদেরে, যুদ্ধ প্রচেষ্টায় কোন সহযোগিতা না করিবার নির্দেশ দেন। কেউ এ নির্দেশের কোনও প্রতিবাদ করেন নাই। শুধু পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী সার সেকান্দর হায়াত খাঁ ১৮ই জুন তারিখে এক বিবৃতি দিয়া বলেন যে মুসলিম লীগের এ অসহযোগের সিদ্ধান্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের উপর প্রযোজ্য নহে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব তখন দিল্লি ছিলেন। সম্ভবতঃ তাঁর সাথে পরামর্শ করিয়াই সেকান্দর হায়াত ঐ ব্যাখ্যামূলক বিবৃতি দিয়াছিলেন। যুদ্ধে বাংলা ও পাঞ্জাবের বিশেষ অবস্থা বর্ণনা করিয়াই তিনি ঐ যুক্তিপূর্ণ বিবৃতিটি দিয়াছিলেন। তাতে কংগ্রেস নেতাদের সাথে আপোস আলোচনা চালাইবার জন্য জিন্না সাহেবকে অনুরোধও করিয়াছিলেন। কাজেই আশা করা গিয়াছিল স্বয়ং জিন্না সাহেবের তাতে সম্মতি আছে। কিন্তু পরদিন ২৯শে জুন জিন্ন সাহেব সেকান্দর সাহেবের বিবৃতিকে শিশু-সুলভ ও তার যুক্তিকে হাস্যকর বলিয়া উড়াইয়া দেন এবং সমস্ত মুসলিম লীগারকে যুদ্ধ প্রচেষ্টা হইতে দূরে থাকিতে নির্দেশ দিয়া লীগ সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি করেন।
জিন্না সাহেবের এই কড়া বিবৃতির জবাবে হক সাহেব বা সেকান্দর হায়াত সাহেব কেউ কিছু বলিলেন না। কিন্তু জিন্না সাহেবের আদেশ অমান্য করিয়া তাঁরা উভয়ে দিল্লীতে ৭ই জুলাই তারিখে কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আযাদসহ অন্যান্য কংগ্রেসী নেতাদের সাথে সাম্প্রদায়িক মিটমাটের আলোচনা করিলেন।
কিন্তু এবার জিয়া সাহেব সোজাসুজি মুসলিম লীগ প্রধান মন্ত্রীদেরে ওয়ার কাউন্সিল হইতে পদত্যাগ করিবার নির্দেশ দিলেন। সে নির্দেশ পালনে গড়িমসি করিয়া সময় কাটাইলেন সকলেই। কিন্তু হক সাহেব ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ করিলেন না। এক দুই করিয়া শেষ পর্যন্ত আর সকলেই পদত্যাগ করিলেন। কিন্তু হক সাহেব করিলেন না। ফলে ১৯৪১ সালে ২৫শে আগস্ট তারিখে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি হক সাহেবের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা-সূচক ভাষা প্রয়োগ করিয়া দশ দিনের মধ্যে ‘ওয়ার কাউন্সিল’ হইতে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন। ঠিক এই সময়ে আমরা ‘নবযুগ’ প্রকাশের ব্যবস্থা করিতেছি। সুতরাং আমরা ধরিয়া নিলাম ‘নবযুগ’ বাহির হইবার আগেই হক সাহেবকে মুসলিম লীগ ছাড়িতে হইবে।
কিন্তু নবযুগ বাহির হইয়া বেশ কয়েক দিনের পুরান হইয়া গেল। কিন্তু হক সাহেবের লীগ হইতে বাহির হওয়ার নামটি নাই। হক সাহেব লীগ ওয়ার্কিং কমিটির নির্ধারিত মেয়াদ মধ্যে পদত্যাগ করিলেন না। কোন জবাবও দিলেন না। আমাদের সাথে আলাপে তিনি দৃঢ়তা দেখাইলেন। তাতে আমাদের আশা বাড়িতে লাগিল। ওদিকে কিন্তু লীগ মন্ত্রীরা ও নেতারা হক সাহেবকে খুব চাপ দিতে থাকিলেন ‘ওয়ার কাউন্সিল’ হইতে পদত্যাগ করিয়া জিন্না সাহেবের সাথে একটা আপোস করিয়া ফেলিতে। হক সাহেব শেষ পর্যন্ত কি করিবেন তা বোঝা আমাদের পক্ষে খুব মুশকিল হইল। আমি এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও উভয় কুল ঠিক রাখিয়া সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম।
১০. হক-জিন্না অস্থায়ী আপোস
বহু মুসলিম লীগ নেতার চেষ্টা ও মধ্যস্থতায় হক সাহেব শেষ পর্যন্ত, ১৯৪১ সালের ১৮ই অক্টোবর ‘ওয়ার কাউন্সিল’ হইতে পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগে দ্বিধা ও বিলম্বের কারণ এবং পদত্যাগের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করিয়া তিনি জিন্না সাহেবের নামে লিখিত একটা খোলা চিঠির আকারে সংবাদ পত্রে একটি বিবৃতি দেন। এই পত্রে তিনি জিন্না সাহেবের নেতৃত্বের এবং আন্দোলনের ধারা ও গতির কঠোর ভাষার নিন্দা করেন। প্রথমেই তিনি স্পষ্ট বলিয়া দেন যে জিন্না সাহেবের নির্দেশে বা মুসলিম লীগের ধমকে ভয় পাইয়া তিনি ‘ওয়ার কাউন্সিল’ ছাড়িতেছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থের দিক হইতে ‘ওয়ার কাউন্সিলের’ মেম্বরগিরির কোনও গুরুত্ব ও আবশ্যকতা নাই বলিয়াই তিনি পদত্যাগ করিতেছেন।
জিন্না নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে গিয়া হক সাহেব মুসলিম বাংলার ভবিষ্যৎ বিপদ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ গণকের মতই এমন সব কথা বলিয়াছিলেন, যার প্রায় সবই আজ সত্য হইয়াছে। এই দিক দিয়া এই পত্রখানার ঐতিহাসিক মূল্য অসাধারণ। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশে এর কোনও কপি পাওয়া যায় না। আমার বেশ মনে আছে, ঐ পত্রে তিনি বলিয়াছিলেন, জিয়া সাহেব ও মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির শুধু এই সিদ্ধান্তটাই ভ্রান্ত, তা নয়। তিনি পাকিস্তান প্রস্তাবের যে ব্যাখ্যা ও আন্দোলনের যে ধারা প্রচলন করিয়াছেন, তাও ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক। তাতে মুসলিম ভারতের, বিশেষতঃ মুসলিম বাংলার, ঘোরতর অনিষ্ট হইবে। গোটা বাংলা ও আসাম পূর্ব পাকিস্তানে পড়িবে বলিয়া বাংলার মুসলমানদিগকে ধোকা দেওয়া হইতেছে। মুসলিম লীগে ব্যক্তিবিশেষের ডিটেটরি চলিতে থাকিলে মুসলিম ভারতের রাজনীতিতে মুসলিম বাংলার যে প্রভাব ও মর্যাদা আছে তাও আর থাকিবে না। পশ্চিমা রাজনীতিকদের ইচ্ছামত মুসলিম বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত ও পরিচালিত হইবে। সে অবস্থায় আসাম ত পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হইবেই না, বাংলাও বিভক্ত হইবে।
হক সাহেবের কথিত পত্রের ভাষা এখন এতদিন পরে আমার মনে নাই। পত্রটি যোগাড়ের চেষ্টা সাধ্যমত করিয়াছি। পাই নাই। কিন্তু পত্রখানার মর্ম আমার মনে আছে। পত্রখানি আমাদের সকলের বিবেচনায় অতিশয় মূল্যবান ও দূরদর্শিতামূলক ছিল। সেজন্য ‘নবযুগের’ নিউয ডিপার্টমেন্টকে দিয়া উহার বাংলা তর্জমা করাইয়া আমি নিজে তা দেখিয়া দিয়া ‘নবযুগে’ ছাপাইয়াছিলাম। পত্রটি এত বড় ছিল যে উহা সম্পূর্ণ ছাপিতে কয়েক দিন লাগিয়াছিল।
ফলে ‘ওয়ার কাউন্সিল’ হইতে হক সাহেব পদত্যাগ করিলেই লীগের সাথে, মানে জিন্না সাহেবের সাথে, তাঁর আপোস হইয়া যাইবে বলিয়া আমরা যে আশংকা করিতেছিলাম সে আশংকা সত্যে পরিণত হইল না। আশা আমাদের অটুটই থাকিল। হক-জিন্না বিরোধের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক আদর্শটাই আমাদের সকলের বিবেচ্য ছিল না। ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রশ্নও জড়িত ছিল। আমার স্বার্থটাই ধরা যাক। হক সাহেব লীগ না ছাড়িলে ‘নবযুগের’ দরকার থাকে না। কাজেই আমারও চাকুরি থাকে না। ‘নবযুগ’ বাহির হওয়ায় আমরা সাংবাদিকরা লাভবান হইয়াছি। কিন্তু লীগ মন্ত্রীরা না থাকিলে যাঁরা মন্ত্রী হইবেন, তাদের ত আজও কিছু হইল না। আসল কথা এই যে লীগ মন্ত্রীদেরে তাড়াইয়া যাঁদেরে লইয়া নয়া হক মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে, তাঁদের নাম ঠিক হইয়াই ছিল। কে কোন দফতর পাইবেন, তারও মীমাংসা হইয়া গিয়াছিল। এই সব নিশ্চিত ভাবী মন্ত্রীরা আমাকে অস্থির করিয়া ফেলিলেন। যথেষ্ট জোরে সম্পাদকীয় লেখা হইতেছে না। হক-লীগ-বিরোধের আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে না। তবে আর আগে হইতে ‘নবযুগ’ বাহির করিয়া কি ফল হইল? একমাত্র আমার ছাড়া আর কার কি লাভ হইল? অতএব জিন্না-হক বিরোধটা চরমে আনিবার সাধ্য মত কলমের চেষ্টা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু মুসলিম লীগাররাও হক সাহেবের মত জনপ্রিয় প্রভাবশালী নেতাকে হাতছাড়া করিতে রাজি ছিলেন না। তাঁরাও জিন্না-হক আপোসের জন্য তাঁদের সমস্ত শক্তি ও প্রতিপত্তি খাটাইতে লাগিলেন। আপাততঃ তাঁরাই জয়ী হইলেন। হক সাহেবকে দিয়া তাঁর বিবৃতির ব্যাখ্যা করাইলেন। সেই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ১৬ই নবেম্বর (১৯৪১) মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির দিল্লী বৈঠকে হক সাহেবের সহিত লীগের বিরোধের অবসান ঘটিল। এতে বাংলার লীগ মহল খুব উল্লসিত হইল। কিন্তু আমাদের কলিজা ও মুখ শুকাইয়া গেল। প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন তখন চলিতে ছিল। কাজেই হক সাহেবের দলীয় মেম্বরদের মধ্যে এবং হক সাহেবের সাথে আমাদের দেন-দরবার চলিতে থাকিল। মুসলিম লীগের সাথে তাঁর মিটমাট হইয়া যাওয়ার কথা তুলিলেই তিনি জবাবে মিচকি হাসিয়া আমাদেরে বলিতেন : ‘ওয়েট এণ্ড সী’।
১১. প্রগ্রেসিভ কোয়েলিশন
এর কয়দিন পরেই হক সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং ‘নবযুগে’ প্রচারের নূতন ধারা সম্পর্কে আমাকে নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ দিতে গিয়াই তিনি সর্বপ্রথম আমাকে জানান যে শুধু কৃষক-প্রজা ও কংগ্রেসের সাথেই তিনি আপোস করিতেছেন না। হিন্দু সভানেতা ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের সাথেও তাঁর আপোস হইতেছে। ডাঃ শ্যামা প্রসাদকেও তিনি তাঁর নয়া মন্ত্রিসভায় নিতেছেন। আমি শুধু আকাশ হইতে পড়িলাম না। আস্তা আসমানটাই আমার মাথায় পড়িল। আমি জানিতাম হক সাহেব সময়-সময় খুবই বেপরোয়া হইতে পারেন। কিন্তু এতটা হইতে পারেন, এতকাল তাঁর শাগরেদি করিয়াও আমি তা জানিতাম না। কথাটা শুনিয়া আমি এমন স্তম্ভিত হইলাম যে সে-ভাব কাটিতে বোধ হয় আমার পুরা মিনিট খানেকই লাগিয়াছিল। তিনি আমার মনোভাব বুঝিলেন। গম্ভীর মুখে বলিলেন : ‘শোন আবুল মনসুর, তুমি শ্যামা প্রসাদকে চিন না। আমি চিনি। সে সার আশুতোষের বেটা। করুক সে হিন্দুস। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে তার মত উদার ও মুসলমানদের হিতকামী হিন্দু কংগ্রেসেও একজনও পাবা না। আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি সবদিক ভাইবা-চিন্তাই তারে নিতেছি। আমারে যদি বিশ্বাস কর, তারেও বিশ্বাস করতে হবে।‘
আমি খুবই চিন্তায় পড়িলাম। কিন্তু মনে-মনে হাসিলাম ভাবিলাম, শ্যামাপ্রসাদকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই উঠে না। কারণ স্বয়ং হক সাহেবকেই বিশ্বাস করা যায় না। শ্যামাপ্রসাদকে বিচার করিবার কি অমূল্য মাপকাঠিই না হক সাহেব আমাকে দিয়াছেন। সব অবস্থায়ই হক সাহেব রসিক লোক ছিলেন। হক সাহেবের কথায় বুঝিলাম, পরদিনই মিঃ জে সি গুপ্তের বাড়িতে অপযিশন পার্টি সমূহের নেতাদের সংগে হক সাহেবের বৈঠক বসিতেছে। চাঁদ উঠিলে সবাই দেখিবে। আগামী কালই সবাই জানিয়া ফেলিবে। কাজেই এই অশুভ সংবাদটা আমি কারও কাছে বলিলাম না। কিন্তু বিকালেই দেখিলাম সবাই ব্যাপারটা জানেন। ভাবী মন্ত্রীরাই হাসিমুখে এই খবরটা আমাকে দিলেন।
পরদিন ২৮শে নবেম্বর সত্য-সত্যই মিঃ গুপ্তের বাড়িতে ঐ বৈঠক বসিল। দীর্ঘ আলোচনার পর প্রগেসিত কোয়েলিশন পার্টি নামে নয়া কোয়েলিশন গঠিত হইল। হক সাহেব তার লিডার ও শরৎ বাবু ডিপুটি লিডার নির্বাচিত হইলেন। হাসি-খুশির মধ্যে অনেক রাতে সভা ভংগ হইল। রাত্রেই সারা কলিকাতা, বিশেষতঃ খবরের কাগ আফিসগুলি, গরম হইয়া উঠিল। পরদিন সকালে লীগ সমর্থক মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল। বিকালেই আইন পরিষদের বৈঠকে (২৯শে নবেম্বর) লীগ মেম্বরদের মধ্য হইতে এ ব্যাপারে সোজাসুজি প্রশ্ন উত্থাপিত হইল। হক সাহেব খুব জোরের সাথে সোজাসুজি ও-কথা অস্বীকার করিলেন।
লীগ মন্ত্রী ও মেম্বাররা স্বভাবতঃই হক সাহেবের কথায় আস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন না। তাঁরা হক সাহেবের সহিত দেন-দরবার চালাইলেন। শোনা গেল, ইউরোপীয় দলের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ রক্ষা করিতে লাগিলেন। পর্দার আড়ালে কি হইল, আমরা পথের মানুষেরা তার খবর রাখিলাম না। দেখা গেল, ১লা ডিসেম্বর তারিখে মুসলিম লীগ মন্ত্রীরা সকলে এক সাথে হক মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করিলেন। মুসলিম লীগ পার্টিও আর হক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করে না বলিয়া ঘোষণা করিল। অগত্যা হক সাহেবও পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। পরদিন ৩রা ডিসেম্বর হক সাহেব খবরের কাগয়ে বিবৃতি দিয়া নব-গঠিত প্রগেসিভ কোয়েলিশন পার্টির নেতৃত্ব ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদের সহিত’ গ্রহণ করিলেন।
লীগ মন্ত্রীরা যে সাত তাড়াতাড়িতে হক মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করিয়াছিলেন, তার আসল কারণ এতদিনে বোঝা গেল। তা এই যে ইউরোপীয় দল ও কোন কোন শ্বেতাংগ আই.সি.এস, সেক্রেটারির পরামর্শে লাট সাহেব সার নাযিমুদ্দিনকে ভরসা দিয়াছিলেন, হক মন্ত্রিসভার অবসানে লীগ দলকেই মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হইবে। লাট সাহেবের কাজ-কর্মেও তা বোঝা গেল। হক সাহেব প্রগেসিভ কোয়েলিশন পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া বিবৃতি ও লাট সাহেবকে তা জানাইয়া দেওয়া সত্ত্বেও এবং এই দলের সুস্পষ্ট মেজরিটি থাকা সত্ত্বেও লাট সাহেব হক সাহেবকে নয়া মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব দিতে গড়িমসি করিতে থাকিলেন। মুসলিম মেম্বরদের অধিকাংশের রাজনৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে সকলের তখন এই ধারণা হইয়া গিয়াছে যে, যে-দল মন্ত্রিসভা গঠন করিবে, শেষ পর্যন্ত তাঁদের বেশির ভাগ সেই দলেই যোগ দিবেন। অতএব আপাতঃদৃষ্টিতে মুসলিম লীগ পার্টিতে মুসলমান মেম্বরদের মেজরিটি না থাকা সত্ত্বেও এই পার্টিকে মন্ত্রিসভা গঠনে আহবান করা হইবে, এমন গুজবে কলিকাতা শহর, বিশেষতঃ সংবাদপত্র আফিস, প্রতিমুহূর্তে মুখরিত হইয়া উঠিতে লাগিল। আমাদের বুকও আশংকায় দূর-দূর করিতে থাকিল।
কিন্তু এই অবস্থায় বেশিদিন গেল না। ৭ই ডিসেম্বর জাপান জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অবতরণ করিল এবং ঝটিকা আক্রমণে পার্ল হার্বার নামে বিখ্যাত মার্কিন বন্দর বোমা-বিধ্বস্ত করিল। পরদিন ৮ই ডিসেম্বর বৃটিশ ও মার্কিন সরকার জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ইউরোপীয় যুদ্ধ এতদিনে সত্য-সত্যই বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হইল। বোধহয় বড় লাটের নির্দেশে বাংলার লাটের নীতির পরিবর্তন হইল। তিনি ১০ই ডিসেম্বর হক সাহেবকে নয়া মন্ত্রিসভা গঠনে কমিশন করিলেন। আমাদের মধ্যে বিপুল উল্লাস দেখা দিল। লীগ মহলে বিষাদ! কিন্তু হরিষে-বিষাদ হইল আমাদের। লাট সাহেব ইচ্ছার বিরুদ্ধে হক সাহেবকে মন্ত্রিত্ব দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ডান হাতটি ভাংগিয়া দিলেন। প্রগেসিভ কোয়েলিশনকে সত্য-সত্যই প্রগতিবাদী জাতীয় পার্টি হিসাবে রূপ দিতে পারিতেন যিনি তিনি ছিলেন মিঃ শরৎ চন্দ্র বসু। হক সাহেবের পরেই তাঁর দ্বিতীয় স্থান। নয়া মন্ত্রিসভার তালিকাও সেই ভাবেই করা হইয়াছিল। শরৎ বাবুকে দেওয়া হইয়াছিল স্বরাষ্ট্র দফতর। কিন্তু ১১ই ডিসেম্বর বেলা ১০টায় মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করিবার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে শরৎ বাবুকে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার করিয়া প্রেসিডেন্সী জেলে নেওয়া হইল। আমরা যারা মন্ত্রী হইতেছিলাম না, তারা সবাই রাগে উন্মত্ত হইয়া উঠিলাম এবং হক সাহেবকে এই গ্রেফতারির প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা গঠন করিতে অস্বীকার করিতে উপদেশ দিতে লাগিলাম। কিন্তু যারা মন্ত্রী হইতে যাইতেছিলেন তাঁরা সকলেই আমাদের চেয়ে অনেক বিদ্ধান জ্ঞানী অভিজ্ঞ দূরদশী ধীর চিত্তের লোক ছিলেন। তাঁরা উপদেশ দিলেন যে শরৎ বাবুর পোর্টফলিও খালি রাখিয়া অবশিষ্ট মন্ত্রীদের শপথ নেওয়া হইয়া যাক। শপথ নেওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব লাট সাহেবের সহিত দরবার করিয়া শরৎ বাবুর মুক্তির বন্দোবস্ত করুন। হক সাহেব মন্ত্রিসভা গঠনে অস্বীকার করিলে শীগকেই মন্ত্রিত্ব দেওয়া হইবে, এ বিষয়ে সকলেই একমত হইলেন। তাই হইল। নয়া হক মন্ত্রিসভার শপথ যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হইল। শপথ শেষে প্রধানমন্ত্রী লাট সাহেবের সহিত দেখাও করিলেন। লাট সাহেব বলিয়া দিলেন, ভারত রক্ষা আইনে কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুমেই শরৎ বাবুকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। প্রাদেশিক লাটের বা সরকারের এ ব্যাপারে কিছুই করণীয় নাই। সত্যই তাঁদের কিছু করণীয় থাকিল না। অতএব শরৎ বাবুকে জেলে রাখিয়াই মন্ত্রিসভার কাজ চলিতে থাকিল। শেষ পর্যন্ত শরৎ বাবুকে বাদ দিয়াই এগার জনের পূর্ণ মন্ত্রিসভা গঠিত হইল। হক সাহেব ছাড়া মুসলিম মন্ত্রী থাকিলেন পাঁচ জন। যথা : (১) নবাব হবিবুল্লা (2) মৌঃ শামসুদ্দিন (৩) খান বাহাদুর আবদুল করিম (৪) খান বাহাদুর হাশেম আলী (৫) খান বাহাদুর জালালুদ্দিন। হিন্দু মন্ত্রী থাকিলেন পাঁচ জন। যথা : (১) সন্তোষ কুমার বসু (2) ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (৩) প্রমথ নাথ ব্যানাজী (৪) হেম চন্দ্র লস্কর ও (৫) উপেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ।
১২. মন্ত্রীদের প্রতি অযাচিত উপদেশ
মন্ত্রিসভার সাফল্য-নিষ্ফলতা সম্বন্ধে নিরাসক্ত থাব্বিার যে সিদ্ধান্ত গোড়াতে করিয়াছিলাম, শরৎ বাবুর গ্রেফতারে সে সংকল্প আর ঠিক রাখতে পারিলাম না। মেম্বর-মন্ত্রী না হওয়ায় স্বভাবতঃই আমার পার্লামেন্টারি কোনও দাম ছিল না। কিন্তু হক সাহেবের কাগ ‘নবযুগের সম্পাদকের দায়িত্বের জোরে এবং হক সাহেবের দেওয়া গুরুত্বের বলে মন্ত্রীদিগকে চাওয়া-না-চাওয়া, বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত উপদেশ দিতে লাগিলাম। আমার মনে হইল প্রগেসিত কোয়েলিশনকে সফল করার উপর শুধু হক সাহেবের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভবিষ্যত নয়, সারা বাংলার, বিশেষতঃ মুসলিম বাংলার, ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। এটাকে সফল করার দায়িত্ব শরৎ বাবুর অভাবে যেন আমারই একার ঘাড়ে পড়িয়াছে। একদিকে দিনের পর দিন সম্পাদকীয় লিখিয়া প্রগেসিভ কোয়েলিশনের গুরুত্ব বুঝাইতে লাগিলাম। অপর দিকে তাকে সফল করিবার ফন্দি-ফিকির মন্ত্রীদের সমঝাইতে লাগিলাম। সম্পাদকীয়গুলি যে খুবই যুক্তিপূর্ণ প্রাণস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী হইতেছিল তার প্রমাণ পাইলাম শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নওশের আলী ও বন্ধুবর সৈয়দ বদরুজার মুখে। এরা দুইজনেই প্রগেসিভ কোয়েলিশন গঠনে এবং ‘নবযুগ’ প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ খাঁটিয়েছেন। কিন্তু এঁরা কেউই মন্ত্রী হন নাই। নওশের আলী সাহেবকে পরে আইন পরিষদের স্পিকার করা হইয়াছিল এবং সৈয়দ বদরুজাকে কর্পোরেশনের মেয়র করা হইয়াছিল। এই দুই বন্ধুই আমার সম্পাদকীয়গুলি পড়িয়া পড়িয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুক্তিতে যাঁর-তাঁর ভাষায় প্রায় একই কথা বলিয়াছিলেন : প্রগেসিত কোয়েলিশনটা যে দেশের জন্য এমন প্রয়োজনীয় ছিল, এটার প্রতিষ্ঠা করিয়া আমরা সে সত্যই একটা মহৎ কাজ করিয়াছি, আপনার সম্পাদকীয় পড়িবার আগে আমরা নিজেরাই তা জানিতাম না। আমি এই প্রশংসার জন্য তাঁদেরে ধন্যবাদ দিয়াছিলাম। কিন্তু মনে মনে হাসিয়া বলিয়াছিলাম : ‘লিখিবার আগে আমিই কি জানিতাম?’
কিন্তু মন্ত্রীদের প্রতি আমার উপদেশ কার্যকরী হইল না। হক সাহেব হইতেই শুরু করা যাক। তিনি একটি বিবৃতিতে বলিলেন : শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম বাংলার স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়াছেন। আর আমি নিয়াছি হিন্দু-বাংলার স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব। রাজনৈতিক স্ট্যান্টের রাজা হক সাহেব। তাঁর জন্যও ছিল এটা একটি অসাধারণ স্ট্যান্ট। সত্য সত্যই এটা ঘটাইতে পারিলে বাংলার সার্বিক মুক্তি ছিল অবধারিত। তাতে শুধু বাংলার নয় ভারতের হিন্দু-মুসলিম সমস্যাও সম্পূর্ণ মিটিয়া যাইত। কাজেই ভাব-প্রবণতা হেতু আমি হক সাহেবের এই স্ট্যান্টে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত হইয়া উঠিলাম। হক সাহেব ও শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে মুখে বলিলাম এবং বহু যুক্তি দিয়া ‘নবযুগে’ লম্বা সম্পাদকীয় লিখিলাম। হক সাহেবের পশ্চিম বাংলা ও ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের পূর্ব বাংলা সফরে বাহির হওয়া উচিৎ এবং কালবিলম্ব না করিয়াই এ সফর শুরু করা আবশ্যক। ডাঃ শ্যামাপ্রসাদকে আমি আমার নিজের জিলা ময়মনসিংহ হইতেই সফর শুরু করিবার প্রস্তাব দিলাম। আমি বলিলাম : আমি আগেই সেখানে চলিয়া যাইব এবং সমস্ত জনসভা ও নেতৃ-সম্মিলনীর ব্যবস্থা আমিই করিব। জনসভায় কোনও গণ্ডগোল না হওয়ার দায়িত্ব আমার। কিন্তু মুসলিম-জনতার মনে আস্থা সৃষ্টি করিবার দায়িত্ব ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের।
ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ ইচ্ছা করিলে তা পারেন সে বিশ্বাস আমার হইয়াছিল। প্রথমতঃ তিনি অসাধারণ সুবক্তা ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ আমি তাঁর সাথে কয়েকদিন মিশিয়াই বুঝিয়াছিলাম, তাঁর সম্বন্ধে হক সাহেব যা বলিয়াছেন, তা ঠিক। সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে সত্য-সত্যই তিনি অনেক কংগ্রেসী নেতার চেয়েও উদার। হিন্দু সভার নেতা হইয়াও কোনও হিন্দু নেতার পক্ষে মুসলমানদের প্রতি এমন উদার মনোভাব পোষণ করা সম্ভব, আমার এ অভিজ্ঞতা হইল প্রথমে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদকে দেখিয়া! অবশ্য পরবর্তী কালে তেমন মনোভাবের লোক আরও দেখিয়াছিলাম। আমার নিজের জিলাতেই এমন কয়জন হিন্দু-সভা নেতা দেখিয়াছি, যাঁরা পাকিস্তান হওয়া মাত্র অনেক কংগ্রেস নেতার মত দৌড় মারিয়া সীমান্ত পার হন নাই। বরঞ্চ পাকিস্তানের অনুগত উৎসাহী নাগরিক হিসাবে সকল কাজে মুসলমানদের সহিত সহযোগিতায় ও বন্ধুভাবে পাকিস্তান আন্দোলন সপরিবারে বসবাস করিতেছেন। তবে এটা ঠিক যে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের বেলা কিছুদিন পরেই বুঝিয়াছিলাম তাঁর উদারতা প্রধানতঃ ব্যক্তিগত মহত্ব, রাজনৈতিক সমস্যা ঘটিত দূরদৃষ্টি নয়।
যা হোক, আমার প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত রহিত হইল না। যতদূর বোঝা গেল, তাতে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের চেয়ে হক সাহেবের দোষই এতে বেশি ছিল। এক দিকে হক সাহেব আমাকে বলিলেন : তোমার প্রস্তাব শুনিতে ভাল; কিন্তু ওটা কাজে কতদূর সফল করিতে পারি তা চিন্তা করিয়া দেখ। অপর দিকে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ বলিতে থাকিলেন : আপনার প্রস্তাবে আমি এখনি রাযী। প্রধান মন্ত্রীকে রাযী করান।
শেষ পর্যন্ত হক সাহেব চলিলেন নোয়াখালি। ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ সফরে বাহির হইয়া গেলেন মেদিনীপুর। আমার উৎসাহের জোয়ারে ভাটা পড়িল। শেষ পর্যন্ত প্রবোধ মানিলাম, বোধ হয় হক সাহেবের কথাই ঠিক। কিন্তু হিন্দু সভার সাথে হক সাহেবের মিলনের মত একটা অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় ব্যাপারের ফলো-আপ’ বা সম্পূরক হিসাবে তেমন কোনও অভিনব চমকপ্রদ কর্মপন্থা অথবা সফর-সূচি গৃহীত না হওয়ায় মুসলিম জনগণের মধ্যে কোথাও কোনও অনুকূল প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না। পক্ষান্তরে শহীদ সাহেবের মত মস্তিষ্কবান সংগঠক ও অক্লান্ত পরিশ্রমী নেতা সারা পূর্ব বাংলার দীঘলি-পাথালি সকল শহর-নগরে সভা-সমিতি করিয়া বেড়ানোতে এবং অধিকাংশ মুসলিম ছাত্র মিঃ ওয়াসেকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগকে সক্রিয় সমর্থন দেওয়ায় নয়া হক মন্ত্রিসভা এবং ব্যক্তিগতভাবে হক সাহেব পূর্ব বাংলার মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাইয়া ফেলিলেন। নাটোর ও বালুর ঘাটে পরপর দুইটা উপ নির্বাচনে হক সাহেবের মনোনীত প্রার্থীদ্বয়কে পরাজিত করিয়া মুসলিম লীগ প্রার্থী জয়যুক্ত হইলেন।
১৩. নয়া হক মন্ত্রিসভার স্বরূপ
মুসলিম বাংলার রাজনীতিতে এই পরিবর্তন আসিল এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে। হক সাহেব যখন মুসলিম লীগকে বাদ দিয়া কৃষক-প্রজা পার্টি সুভাষ-পন্থী কংগ্রেস ও হিন্দু-সভার সহিত প্রগেসিভ কোয়েলিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। (১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর) তখন আইন পরিষদের মোট ২৫০ জন ও মুসলিম ১২৩ জন মেম্বরের মধ্যে মাত্র ৩৫ জন ও আইন সভার (লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) মুসলিম সদস্য ৩৭ জনের মধ্যে মাত্র ৮ জন মুসলিম লীগ দলে থাকেন। বাকী সকলেই হক সাহেবের পক্ষে থাকেন। অথচ বছর না ঘুরিতেই অনেক মেম্বর ছাত্র-জনতার চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হক সাহেবের পক্ষ ছাড়িয়া মুসলিম লীগ পক্ষে চলিয়া যান। অবশ্য রাজনীতির পাশবর তাতে হক মন্ত্রিসভার মুসলিম সমর্থকরা কোনদিনই আইন পরিষদে বা উচ্চ পরিষদে কোথাও মাইনরিটি হন নাই।
এই নব পর্যায়ের হক মন্ত্রিসভা ১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর হইতে ১৯৯৩ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত এক বছর চার মাসের অধিক কাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই মুদতে হক সাহেব মুসলিম বাংলার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করিতে না পারিলেও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও অনিষ্টও করেন নাই। তথাপি মুসলিম লীগ তরফের প্রচার ফলে এবং অবস্থাগতিকে মুসলিম গণ-মনে এবং তার চেয়ে বেশি মুখে-মুখে এই মন্ত্রিসভার মুদ্দতটা মুসলিম বাংলার অন্ধকার যুগ ও হক সাহেবের জীবনের কলংকময় অধ্যায়স্বরূপ চিত্রিত হইয়াছে। প্রথমে নামটার কথাই ধরা যাক। মুসলিম লীগাররা এটাকে ‘শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা’ নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন। শাসনতন্ত্রের দিক দিয়া। এই বিশেষণ যেমন অসৌজন্যমূলক ছিল; বাস্তব ব্যাপারেও এটা তেমনই ভিত্তিহীন ছিল। হক সাহেব শ্যামাপ্রসাদ বা হিন্দু সভার সাথে কথায় কি কাজে প্রধান মন্ত্রিত্ব বাটোয়ারা করেন নাই। ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ ছাড়া ঐ মন্ত্রিসভায় হিন্দু সভার আর কোনও মন্ত্রী ছিলেন না। তিনি যদিও অর্থ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন, তবু অন্যান্য মন্ত্রীদের চেয়ে তাঁর কোন বিশেষ অধিকারও ছিল না। হক সাহেবের উপর তাঁর প্রভাবও কংগ্রেসী মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি ছিল না। তথাপি হক সাহেবের রাজনৈতিক দুশমনেরা বিশেষতঃ লীগ নেতারা এই মন্ত্রিসভাকে ‘শ্যামা-হক-মন্ত্রিসভা’ নাম দিয়াছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনসাধারণের চোখে প্রথম দৃষ্টিতেই মন্ত্রিসভাকে অপ্রিয় করা। কিন্তু এ কাজ অমন সোজা হইত না যদি নয়া মন্ত্রিসভা পর-পর কতকগুলি তুল না করিতেন। এই সব ভুল করিবার মূলে রহিয়াছে অবশ্য বাংলার হিন্দু নেতৃবৃন্দের অদূরদশী সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। হক সাহেব জিন্না সাহেবের সাথে ব্যক্তিগতভাবে ও মুসলিম লীগের সাথে প্রতিষ্ঠান হিসাবে যুদ্ধে নামিয়া দুর্জয় সাহসের কাজ করিয়াছিলেন সারা বাংলার বিশেষতঃ মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে। তাঁর গুরু সার প্রফুল্ল চন্দ্রের মত হক সাহেবও মনে করিতেন, পশ্চিমা নেতৃত্ব শুধু বাংলার রাজনীতিতেই অনধিকারচর্চা ও অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে নাই, হিন্দু-মুসলিম মাড়ওয়ারীরা বাংলার অর্থনৈতিক জীবনেও চাপিয়া বসিয়াছে। এই উভয় রাহুর কবল হইতে বাংলাকে মুক্ত করাই ছিল হক সাহেবের প্রগেসিত কোয়েলিশন গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। অবশ্য এ কথা সহজেই বলা যায় যে এত মহৎ উদ্দেশ্যের কথা ভাবিয়া-চিন্তিয়া হক সাহেব ও-কাজ করেন নাই। অমন গঠনমূলক চিন্তা-ধারা হক সাহেবের স্বভাবের মধ্যেই ছিল না। তিনি প্রায় সব কাজই করিতেন ভাব-প্রবণতা বশে এবং সাময়িক প্রয়োজনের তাকিদে। কিন্তু এটা হক-মনীষার বিরাটত্বের নিদর্শন যে তিনি ভাব-প্রবণতা-বশে যা করিতেন বা বলিতেন তার প্রায় সবগুলিই গুরুতর জাতীয় তাৎপর্য বহন কৃরিত। আপাতঃদৃষ্টিতে অনেকগুলি খারাপ লাগিত, আপাতঃশ্রবণে অনেকগুলি অশালীন ও শ্রুতিকটু শুনাইত বটে, কিন্তু পরিণাম বিচারে সেগুলি বাস্তব সত্য বলিয়া বুঝা যাইত। মুসলিম লীগের পাটনা অধিবেশনে তিনি ‘সেতানা’র অর্থাৎ হিন্দু-প্রধান প্রদেশে মুসলিম-পীড়ন হইলে প্রতিশোধ স্বরূপ বাংলায় তিনি হিন্দু-পীড়ন করিবেন বলিয়া যে উক্তি করেন, যতই শ্রুতিকটু হউক, এটা ছিল এই ধরনের উক্তি। এর মধ্যে তাঁর সাধু উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছু ছিল না। ছিল না বলিয়াই এমন বেয়াড়া অশোভন উক্তি তিনি করিয়াছিলেন এমন এক সময়ে যখন তাঁর মন্ত্রিসভার অর্ধেকই হিন্দু এবং তাঁর সমর্থক কোয়েলিশন পার্টির এক-তৃতীয়াংশ মেম্বরও হিন্দু। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে।
১৪. বাংলা-ভিত্তিক সমাধানের শেষ চেষ্টা
প্রগ্রেসিভ কোয়েলিশন গঠনও ছিল এমনি একটা ব্যাপার। আশু কারণ হয়ত ছিল তাঁর সাময়িক প্রয়োজন। কিন্তু ভাব-প্রবণতা-বশে তিনি এমন এক কাজ করিয়াছিলেন, বাংলার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিক হইতে যার সম্ভাবনা ছিল বিপুল। কিন্তু বরাবর যেমন, এবারও তেমনি, হিন্দু-নেতৃত্বের অদূরদশী সংকীর্ণতা সে সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করিয়া দিল। জিন্না-হক দ্বন্দ্বকে তাঁরা নিজেদের অপূর্ব সুযোগ মনে করিলেন। খাদে-পড়া বাংলার সিংহকে দিয়া তাঁরা গাধার বোঝা বওয়াইতে চাহিলেন। হক সাহেবকে দিয়া তাঁরা এমন সব কাজ করাইতে চেষ্টা করিলেন, একটু তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইত, সেগুলি পরিণামে মুসলিম স্বার্থ বিরোধী, সুতরাং সে কাজ মুসলিম সমাজে হক সাহেবের অপ্রিয় হওয়ার কারণ হইতে পারে। এই ধরনের কাজের মধ্যে নিয়ে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করা যাইতেছে,
(১) আইন পরিষদের বিবেচনাধীন মাধ্যমিক শিক্ষা বিলটির আলোচনা স্থায়ীভাবে স্থগিত হইল। ঘটনাচক্রে এই সময়েই আযিযুল হকের ভাইস চ্যান্সেলারির অবসান হয়। প্রথম হক মন্ত্রিসভার আমলে ১৯৪০ সালে তিনি ভাইস চ্যান্সেলার নিযুক্ত হন। লীগ নেতারা এই ঘটনার সদ্ব্যবহার করিলেন।
(২) ১৯৪২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করিবার জন্য জিন্ন সাহেব ১১ই ফেব্রুয়ারি কলিকাতা পৌঁছিলে তাঁর উপর ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যবস্থা হয়। কলিকাতার মুসলমানদের ফাটিয়া-পড়া রোষের মুখে তা পরিত্যক্ত হয়। ফলে জিন্না সাহেব আশাতীত ও কল্পনাতীত অভ্যর্থনা পান এবং নয়া হক মন্ত্রিসভা অনাবশ্যকভাবে একটা অপ্রিয়তা অর্জন করেন।
(৩) জাপানী বোমার আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার জন্য যে এ. আর. পি. প্রতিষ্ঠান আগেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ১৯৪২ সালে ইহাকে সম্প্রসারিত করিয়া সিভিল ডিফেন্স নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগে রূপান্তরিত করা হইল। কলিকাতার অধিবাসীরা শতকরা আশি জনই হিন্দু, এই যুক্তিতে এক-ধারসে বহু হিন্দুকে এই প্রতিষ্ঠানে নূতনভাবে নিযুক্ত করা হইতে লাগিল। মুসলিম লীগ-নেতারা এবং তাঁদের মুখপত্র ‘আজাদ’ এর বিরাট সুযোগ গ্রহণ করিলেন। তাঁরা এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে দস্তুরমত একটি প্রাদেশিক সম্মিলনী করিয়া বসিলেন। হক সাহেবের নয়া মন্ত্রিসভা মুসলিম সমাজে আরও অপ্রিয় হইয়া পড়িলেন।
(৪) ১৯৪২ সালের ২৪শে অক্টোবর ময়মনসিংহ জিলার কিশোরগঞ্জ শহরের জামে মসজিদে পুলিশের গুলিবর্ষণ ও তার ফলে কয়েক জনের মৃত্যু। মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাজনার অধিকার লইয়া যোব বছর আগে ১৯২৬ সালে বরিশালের কুলকাঠি থানার পোনাবালিয়ার পর গুলি বর্ষণের মত ঘোরতর এটাই দ্বিতীয় ঘটনা। কিন্তু সেটা ছিল মসজিদের সামনে; আর এটা হইল মসজিদের ভিতরে। সেটা ছিল দ্বৈত শাসনে ইংরাজ হোম মিনিস্টারের রাজত্বে শ্বেতাঙ্গ জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ র্যাভির আমলে, আর এটা হইল স্বায়ত্তশাসনে হক সাহেবের হোম মিনিস্টারির রাজত্বে হিন্দু জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বানার্জির আমলে। মুসলমানরা স্বভাবতঃই খুবই উত্তেজিত হইল। বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করিল তারা। কিন্তু সরকার হুকুম দিলেন জিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়া বিভাগীয় তদন্ত করিবার। জিলা মেজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ বানাজী। তাঁর উপর নানা কারণে জিলার মুসলমানরা অসন্তুষ্ট ছিল। তার উপর তাদের সন্দেহ ছিল মিঃ বানার্জীর জানামতেই ঐগুলি চলিয়াছিল। সুতরাং প্রতিবাদে সারা জিলার এবং ক্রমে সারা বাংলার মুসলমানরা ক্ষেপিয়া গেল। কিশোরগঞ্জের মুসলমানরা সংগে সংগে মসজিদের নামকরণ করিল শহিদী মসজিদ। ঘটনাচক্রে এর কিছুদিন আগেই ‘নবযুগ’ হইতে আমার চাকুরি গিয়াছিল। সে ব্যাপারেও আমি উপলব্ধি করিয়াছিলাম যে মুসলিম মন্ত্রীরা, এমন কি স্বয়ং হক সাহেবও, ক্রমে অসহায় হইয়া পড়িতেছেন। নয়া কোয়েলিশনের সাফল্যের সম্ভাবনা ক্রমেই তিরোহিত হইতেছে।
এইভাবে হক সাহেবের প্রগ্রেসিভ কোয়েলিশন মুসলিম সমাজে চরম অপ্রিয়তার পাত্র হইয়া উঠিল। ওদিকে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে-সাথে ভারত সরকারের দমন-নীতিও কঠোরতর হইয়া উঠিতে লাগিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের নেতৃত্বে ‘আযাদ হিন্দ ফৌজ’ বর্মা ছাড়াইয়া মনিপুরের কোহিমা শহর ধরে-ধরে। কাজেই বাংলার জনগণ সাধারণভাবে, এবং হিন্দুরা বিশেষভাবে, ইংরেজ-বিরোধী মনোভাবে উদ্দীপ্ত। প্রাদেশিক সরকার ভারত সরকারের হুকুম-বরদার মাত্র। শাসনতন্ত্রে যা কিছু স্বায়ত্তশাসনাধিকারের বিধান ছিল, যুদ্ধের বিশেষ অবস্থায় তার সবই আপাততঃ বাতিল। সুতরাং হক মন্ত্রিসভা কেন, কোনও মন্ত্রিসভার পক্ষেই তখন জনপ্রিয়তা রক্ষা সম্ভব ছিল না। এই সময় মেদিনীপুরে কংগ্রেস আন্দোলনকারীদের উপর অমানুষিক পুলিশী যুলুম হইল। প্রধান মন্ত্রী হক সাহেব গভর্ণর জন হার্বার্টকে দুঃসাহসী কড়া চিঠি লিখিলেন। কিন্তু কিছু হইল না। ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ এই ফাঁকে পদত্যাগ করিয়া হিন্দু সমাজে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করিলেন। কিন্তু কংগ্রেসী মন্ত্রীরা বা আর কেউ পদত্যাগ করিলেন না।
এর পর আরও মাস ছয়েক হক সাহেবের মন্ত্রিত্ব টিকিয়া থাকিল। কিন্তু ওটা শুধু গদিতে টিকিয়া থাকা মাত্র। যুদ্ধাবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটাইবার বিশেষ সুযোগ ছিল না ধরিয়া নিলেও প্রগ্রেসিভ কোয়েলিশনের আসল যে মহৎ উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করিয়া বাংলার হিন্দু-মুসলিমে একটা স্থায়ী ঐক্য বন্ধন সৃষ্টি করা, সে দিকেও নেতারা কিছু করিলেন না। মন্ত্রিত্ব রক্ষার কাজে সবাই এত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে দেশের বৃহত্তর সমস্যার কথা ভাবিবার বোধ হয় তাঁদের সময়ই ছিল না।
১৫. নাযিম-মন্ত্রিসভা
এমনি অবস্থায় ১৯৪৩ সালের ২১শে মার্চ তারিখে দ্বিতীয় হক মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। তিন-চার দিন মধ্যেই ৩রা এপ্রিল নাযিমুদ্দিন সাহেব মন্ত্রিসভা গঠন করেন। হক সাহেবের মত জনপ্রিয় নেতার নেতৃত্বের ও আইন পরিষদে নিশ্চিত মেজরিটির অভাব পূরণের আশায় মুসলিম লীগ নেতারা হক সাহেবের আমলের মন্ত্রিসংখ্যা ১১ হইতে বাড়াইয়া ১২ করিলেন এবং হিন্দু মন্ত্রীর সংখ্যা ৫ হইতে ৬ করিলেন। ইউরোপীয় মেম্বাররা বরাবরের মতই মন্ত্রিসভা সমর্থন করিয়া গেলেন। তবু নাসিম মন্ত্রিসভা আইন পরিষদে কোন কাজ করিতে পারিলেন না। কারণ নাযিম মন্ত্রিসভার আমলেই ১৯৪৩ সালের আগস্ট-সেপ্টম্বরে (বাংলা ১৩৫০ সালের ভাদ্র-আশ্বিনে) বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ধ্বংসকারী দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। অনেকের মতে এই দুর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তুরের মন্বন্তরের’ (১২৭৬ বাংলা সাল) চেয়েও ব্যাপক ও দুর্বিষহ হইয়াছিল। দুর্ভিক্ষের ব্যাপকতার ও যুদ্ধের প্রচণ্ডতার সময় আমরা প্রধানতঃ যান বাহনের অভাবে কলিকাতার বাহিরে যাইতে পারি নাই। কাজেই মফলের দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ চিত্র আমি স্বচক্ষে দেখি নাই। শুধু মফস্বলে যাইতে পারি নাই, তাও নয়। শহরের ভিতরেও আমরা পায় হাঁটিয়াই কাজ-কর্ম করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। তা করিতে গিয়া কলিকাতা শহরের রাস্তা-ঘাটে সেদিন যা দেখিয়াছিলাম তাই এতদিন পরেও বিষম যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্নের মতই স্মৃতি-পথে উদিত হয় এবং গা শিহরিয়া উঠে। অভূক্ত নিরন্ন রুগ্ন অস্থিচর্মসার উলংগ নর-নারীর মিছিল আমরা শুধু এই সময়েই দেখিয়াছি। ডাস্টবিনে খাদ্যের তালাশে মানুষে-কুত্তায় কাড়াকাড়ি করিতে তখনই আমরা প্রথম দেখিয়াছি। অভূক্ত উলংগ কংকালসমূহের এই মিছিলের যেন আর শেষ নাই। কোথা হইতে এত লোক আসিতেছে? খবরের কাগযে পড়িলাম, শস্য-ভাণ্ডার পূর্ব বাংলার পল্লীগ্রাম হইতেই এই মিছিল আসিতেছে বেশি।
১৬. আকাল
বিশ্ব-ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা হৃদয়বিদারী এই দুর্ভিক্ষের দায়িত্ব ও অপরাধ বর্তে গিয়া নাযিম মন্ত্রিসভার ঘাড়ে। পড়িবেই ত। তাঁদের আমলেই এই দুর্ভিক্ষ হইয়াছে। এই দুর্ভিক্ষে অনুমান পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা গিয়াছে। বদনাম তাঁদের সইতেই হইবে।
কিন্তু সত্য কথা এই যে দুর্ভিক্ষের কারণ ঘটিয়াছিল এই মন্ত্রিসভার গদিতে বসার আগেই। এই যুক্তিতে পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা মানে দ্বিতীয় পর্যায়ের হক-মন্ত্রিসভাকেই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করা হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এই দুর্ভিক্ষের দায়িত্ব বন্টনের আপ্রাণ চেষ্টা হয় উভয় পক্ষ হইতে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার-সম্পাদক হিসাবে আমি নিজে ‘আকাল আনিল কারা?’ নামে পুস্তিকা লিখিয়াছিলাম। তাতে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ সাব্যস্ত করিয়া হক-মন্ত্রিসভাকেই অপরাধী, প্রমাণ করিয়াছিলাম। কিন্তু সত্য কথা এই যে এসব ছিল নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্টি প্রপ্যাগো। প্রকৃতপক্ষে ঐ আকালের জন্য এককভাবে দুই মন্ত্রিসভার কেউই দায়ী ছিলেন না। উভয় মন্ত্রিসভাই অংশতঃ দায়ী ছিলেন। আসলে আকালের কারণ ঘটাইয়াছিলেন ভারত-সরকার। যুদ্ধ-প্রচেষ্টার অন্যতম পন্থা হিসাবে তাঁরা বাংলার চাউল যতটা পারিলেন সংগ্রহ করিয়া বাংলার বাইরে সুদূর জবলপুরে গুদামজাত করিলেন। জাপানীদের হাত হইতে দেশী যানবাহন সরাইবার মতলবে ‘ডিনায়েল পলিসি’ হিসাবে নদীমাতৃক পূর্ব-বাংলার সমস্ত নৌকা ধ্বংস করিয়া জনসাধারণের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য অচল করিয়া দিলেন। চরম প্রয়োজনের দিনেও ভারত সরকার বাংলা-হইতে-নেওয়া চাউলগুলিও ফেরত দিলেন না। বাংলা সরকার নোমি-মন্ত্রিসভা) যখন বিহার হইতে উদ্বৃত্ত চাউল খরিদ করিতে চাইলেন, তখন বাংলাসহ অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু-নেতারা চাউল সরবরাহের প্রতিবাদ করিলেন।কেউ কেউ স্পষ্টই বলিলেন, খাদ্যঘাটতির বাংলাদেশ কেমন করিয়া পাকিস্তান দাবি করে তা শিখাইতে হইবে। এগুলি আকালের বাইরের কারণ। এগুলির জন্য হক সরকার বানাযিম-সরকার কাউকে দোষ দেওয়া যায় না।
১৭. আকালের দায়িত্ব
কিন্তু যে জন্য তাঁদেরে দোষ দেওয়া যায়, সেটা ছিল তাঁদের দায়িত্ব-চ্যুতি ও কর্তব্য-ক্রটি। নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার হিসাবে যা তাঁদের কর্তব্য ছিল তা তাঁরা করেন নাই। তাঁরা সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক সরকারের মত কাজ করিয়াছিলেন। প্রথমতঃ তাঁরা অবস্থা জানিয়াও নিজেরা সাবধান হন নাই। দ্বিতীয়তঃ জনসাধারণকে সাবধান করেন নাই। বরঞ্চ প্রকৃত অবস্থা জনসাধারণ হইতে গোপন করিয়াছেন। খাদ্যাভাব অনিবার্য ও আসন্ন, তবু বলিয়াছেন কোনও অভাব নাই। অনাহারে লোক মরিতে শুরু করিয়াছে, তবু বলিয়াছেন কেউ মরে নাই। যারা মরিয়াছে তারা খাদ্যের অভাবে মরে নাই। অতি ভোজনের দরুন পেটের পীড়ায় মরিয়াছে ইত্যাদি।
দায়িত্বহীন আমলাতান্ত্রিক সরকারের এটা চিরন্তন অভ্যাস। দেশবাসী এই সরকারী অভ্যাসের সাথে সুপরিচিত। পাকিস্তানেও আজো চলিতেছে। গণতন্ত্রের অভাবই এর কারণ। এ অবস্থায় জনসাধারণের প্রতি যেমন সরকারের দায়িত্ব-বোধ নাই; সরকারের প্রতিও তেমনি জনসাধারণের কোনও দায়িত্ববোধ নাই। পাঠকগণ সাম্প্রতিক এমন ঘটনার কথা জানেন। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ঘোষণা করিতে গিয়া প্রথমে সরকার পক্ষ যেখানে বলিয়াছেন মাত্র চার জন মারা গিয়াছে, সেখানে জনসাধারণের পক্ষ হইতে বলা হইয়াছে চল্লিশ হাজার মারা গিয়াছে। শেষ পর্যন্ত অনেক হিসাব কিতাব করিয়া সরকার স্বীকার করিয়াছেন চার হাজার মারা গিয়াছে। জনসাধারণও যেন সেই সংখ্যা মানিয়া লইয়াছে। এ যেন আগের দিনের চকবাজারে জিনিস খরিদ করা। দোকানদার হাকিলেন পাঁচ টাকা। খরিদ্দার বলিলেন চার আনা। দামাদামিতে শেষ পর্যন্ত দশ আনায় খরিদ-বিক্রি হইল। গণতন্ত্রহীন আমাদের দেশের জনগণ ও সরকারের সম্বন্ধ আজও তাই। জনগণ যত বেশি ক্ষতি দেখাইয়া যত বেশি চাহিয়া যত বেশি আদায় করিতে পারে তাই লাভ। আর সরকারও ক্ষতি যত কমাইয়া সাহায্য যত কম দিয়া পারেন ততই লাভ। যুদ্ধাবস্থার দরুন তৎকালীন সরকার দুইটি নির্বাচিত মন্ত্রিসভা হইয়াও কার্যতঃ ছিলেন আমলাতান্ত্রিক। মন্ত্রীদের অপরাধ ছিল এই যে জনগণের কোন কাজে লাগেন নাই তবু তাঁরা গদি আঁকড়াইয়া পড়িয়াছিলেন।
কথায় আছে চরম দুর্দিনে মানুষের অজ্ঞাত প্রতিভার সন্ধান হয়। পঞ্চাশ সালের ঐ নবিরহীন আকালে মুসলিম বাংলা নিজের মধ্যে কিছু-কিছু মানব-সেবীর সন্ধান পাইয়াছিল। এঁদের মধ্যে শহীদ সুহরাওয়ার্দীর নাম সকলের আগে নিতে হয়। অত অভাবের মধ্যেও ধৈর্য ও সাহসে বুকে বাঁধিয়া গুয়েল কিচেন ও লংগরখানা খুলিয়া তিনি কিভাবে আর্ত ও ক্ষুধার্তের সেবা করিয়াছিলেন, সেগুলি পরিদর্শনের জন্য আহার-নিদ্রা তুলিয়া দিনরাত চড়কির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেন, সেটা ছিল দেখিবার মত দৃশ্য।
১৮. পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রূপায়ণ
আলীপুরে ওকালতি শুরু করিয়াছি। নূতন জায়গায় ব্যবসা শুরু করিয়াছি। সুতরাং মওক্কেল কম, অবসর প্রচুর। বিকালটা একদম ফ্রি। বাসার কাছেই ‘আজাদ’ আফিস। ‘আজাদের’ সম্পাদকীয় ও ম্যানেজারীয় বিভাগের প্রায় সকলেই আমার বন্ধু-বান্ধব। কাজেই প্রায় সেখানেই আড্ডা। দুনিয়ার সমস্ত সমস্যার আলোচনা এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাধানও হয় সংবাদপত্র-আফিসে। ‘আজাদ’ আফিসেও তাই হইত। আমি ছাড়া আরও লোক জুটিতেন। এইসব বৈঠকে আমি যেমন পারিলাম বন্ধুদের ফ্যাসি-বিরোধী। করিতে। বন্ধুরাও তেমনি পারিলেন আমাকে পাকিস্তানবাদী করিতে। বন্ধুদের যুক্তি-তর্ক ছাড়া ডাঃ আম্বেদকারের ইংরাজী ‘পাকিস্তান’ ও বন্ধুবর মুজিবর রহমানের বাংলা ‘পাকিস্তান’ এই দুইখানা বই আমার মনে বিপুল ভাবান্তর আনয়ন করিল। আমি পাকিস্তান-বাদী হইয়া গেলাম। কিন্তু এ সম্পর্কে দুইটা বিচার্য বিষয় থাকিল। এক, পাকিস্ত’ন দাবিকে দেশ-বিদেশের সকল চিন্তুকের কাছে গ্রহণযোগ্য করিতে হইলে উহাকে একটা ইনটেলেকচুয়াল রূপ দিতে হইবে। ইতিহাস, ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিচারে উহাকে যুক্তিসহ ও এ্যাকটিক্যাল করিতে হইবে। দুই, শুধু ধর্মের ডাকে পাকিস্তান আসিলে মোল্লাদের প্রাধান্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মোল্লাদের প্রভাবে মুসলমানরা কেবল পিছন ফিরিয়া রাস্তা চলে। তাই জীবন-পথে মুসলমানরা এত বেশি হোঁচট খাইতেছে। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের নামে রাষ্ট্র গঠিত হইলে তাকে কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ বিপন্ন হইতে পারে। এই দুইটা সম্ভাবনাকে ঠেকাইতে হইবে। এই আলোচনার ফলে প্রথম উদ্দেশ্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠন করা সাব্যস্ত হইল। দ্বিতীয়টা সম্বন্ধে বন্ধুরা আমাকে আশ্বাস দিলেন যে জিয়া সাহেবের মত বাস্তব-জ্ঞানী মডার্ন নেতার নেতৃত্বে যে রাষ্ট্র গঠিত হইবে, তাতে মোল্লাদের প্রাধান্য থাকিতে পারে না। এই প্রসংগে বন্ধুরা খবরের কাগ্য খুঁজিয়া সাম্প্রতিক একটা ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন। মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা মাহমুদাবাদের তরুণ রাজা সাহেব এক বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন যে পাকিস্তানে কোরআনের আইন অনুসারে শাসন কার্য চলিবে। জিন্না সাহেব পরদিনই তার প্রতিবাদে খবরের কাগযে বিবৃতি দিয়া রাজা সাহেবকে ধমকাইয়া দিয়াছেন এবং বলিয়াছেন, পাকিস্তান একটি প্রগতিবাদী মডার্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হইবে। আর জমিদার-ধনিকদের প্রাধান্য সম্বন্ধে বন্ধুরা বলিলেন যে পাকিস্তান সংগ্রামেই যদি জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে সে সম্ভাবনা একেবারেই অংকুরে বিনষ্ট হইতে পারে। এ অবস্থায় বাংলার কৃষক-প্রজা নেতা কর্মীরা যদি সদলবলে মুসলিম লীগে, সুতরাং পাকিস্তান-সংগ্রামে, শামিল হইয়া যান, তবে এদিককার বিপদ সম্পূর্ণরূপে দূর হইয়া যাইবে।
১৯. সহকর্মীদের সাথে শেষ আলোচনা
কথাটা আমার খুব পছন্দ হইল। কৃষক-প্রজা নেতাদের মধ্যে যাঁদেরে আমি কলিতাকায় উপস্থিত পাইলাম, তাঁদের সকলকে আমি আমার বাসায় দাওয়াত করিলাম। মৌঃ আশরাফুদ্দিন চৌধুরী, মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ, মিঃ আবু হোসেন সরকার, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, নবাবযাদা হাসান আলী, মৌঃ গিয়াসুদ্দিন আহমদ ও চৌধুরী নূরুল ইসলাম প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ আমার বাসায় সমবেত হইলেন। অনেক আলাপ-আলোচনা হইল। কিন্তু আমার মতবাদ ও বিশ্লেষণ তাঁরা গ্রহণ করিলেন না। তবে আলোচনা ভাংগিয়াও দিলেন না। পর-পর কয়েকদিন ধরিয়া আলোচনা চলিল। তৎকালে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন খুবই জোরদার হইয়াছে। ইউরোপে হিটলারের জয়-জয়কার। মিত্র পক্ষসহ ইংরাজরা প্রায় ফতুর। এশিয়ায় জাপান ইংগ মার্কিন শক্তিকে মারের পর মার দিতেছে। সুভাষ বাবুর নেতৃত্বে ‘আযাদ-হিন্দু-ফৌজ’ কোহিমায় পৌঁছিয়াছে। এমন পরিবেশে মুসলিম লীগের সহিত মার্জ করার প্রয়োজনীয়তা সকলের কাছেই খুব ক্ষীণ মনে হইল। আমাদের আলোচনা সভা ভাংগিয়া গেল। আমার এদিককার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আমি খবরের কাগয়ে বিবৃতি দিয়া কৃষক-প্রজা-কর্মীদের কর্তব্য সম্বন্ধে আমার মতামত ব্যক্ত করিলাম। আমার এই সব বিবৃতি মুসলিম লীগের মুখপত্র ‘আজাদ’ ছাড়া আর কেউ ছাপিলেন না। ফলে বন্ধুরা প্রায় সকলেই ধরিয়া নিলেন আমি মুসলিম লীগে যোগদান করিয়া ফেলিয়াছি। অতঃপর কৃষক-প্রজা-কর্মীদের কাছে আমার উপদেশের স্বভাবতঃই কোন মূল্য থাকিল না।
২০. রেনেসাঁ সোসাইটিতে যোগদান
ইতিমধ্যে আজাদ-সম্পাদক মৌঃ আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রভৃতির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রেনেসাঁ সোসাইটির মতবাদে আমি আকৃষ্ট হইলাম। শামসুদ্দিন ও আমি একই ম্যানসনের পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকিতাম। রাতদিন আমাদের মধ্যে রাজনীতিক বিবর্তনের ও যুদ্ধ-পরিস্থিতির আলোচনা হইত। আমাকে বুঝাইবার জন্য শামসুদ্দিন প্রায়ই তাঁর সহকর্মী মুজিবুর রহমান খাঁ ও হবিবুল্লাহ বাহারকে সংগে নিয়া আসিতেন। দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া গরম আলোচনা হইত। ফলে আমি রেনেসাঁ সোসাইটিতে যোগদান করিলাম। এরা আমার প্রাপ্যাধিক মর্যাদা দিলেন। আমাকে মূল সভাপতি নির্বাচন করিয়া পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সম্মিলনীর আয়োজন করিলেন।
১৯৪৪ সালের ৫ই মে তারিখে ইসলামিয়া কলেজের মিলনায়তনে বিপুল উৎসাহ-উদ্যমের মধ্যে এই সম্মিলনী হইল। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্মিলনী উদ্বোধন করিলেন। আমি হইলাম মূল সভাপতি। শামসুদ্দিন হইলেন অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান। অধ্যাপক ডাঃ সুশোভন সরকার, ডাঃ সাদেক, ডাঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, অধ্যাপক আদমুদ্দিন, মৌঃ আবদুল মওদুদ, মৌঃ হবিবুল্লাহ বাহার, শ্রীযুক্ত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রভৃতি বহু মনীষী বিভিন্ন শাখার সভাপতি হইলেন। কলিকাতার বহু লেখক সাহিত্যিক ছাড়াও মুসলিম বাংলার রাজনীতিক নেতাদের প্রায় সকলেই এই সম্মিলনীতে উপস্থিত ছিলেন। নেতাদের মধ্যে জনাব এ কে ফযলুল হক, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দিন, শহীদ সুহরাওয়ার্দী, ডাঃ মেজর সার হাসান সুহরাওয়ার্দী, মৌঃ আবুল হাশিম, মৌঃ তমিসুদ্দিন খাঁ এবং নাযিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার সকল মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র-তরুণরা বিশালাকার হলটি একেবারে জম জমাট করিয়াছিল।
আমার অভিভাষণটা খুবই জনপ্রিয় হইয়াছিল। উহার কয়েক হাজার কপি বিক্রয় হইয়া গিয়াছিল সম্মিলনীতেই। আমার অভিভাষণে দুইটা মূল কথা বলিয়াছিলাম যা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মতের সংগে বেমিল হইয়াছিল। বোধ হয় সেই জন্যই নূতনও লাগিয়াছিল। প্রথমতঃ আমি বলিয়াছিলাম, পাকিস্তান দাবিটা প্রধানতঃ কালচারেল অটনমির দাবি। বলিয়াছিলাম, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়েও কালচারেল অটনমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক হইতে পাকিস্তান দাবি শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক দাবি নয় এটা গোটা ভারতের কালচারেল মাইনরিটির জাতীয় দাবি। দ্বিতীয় কথা আমি বলিয়াছিলাম যে ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দু হইতে আলাদা জাত ত বটেই বাংলার মুসলমানরাও পশ্চিমা মুসলমানদের হইতে পৃথক জাত। বলিয়াছিলাম, শুধুমাত্র ধর্ম জাতীয়তার বুনিয়াদ হইতে পারে না। আমি আরব পারস্য তুরস্কের মুসলমানদের ও ইউরোপীয় খৃষ্টানদের দেশগত জাতীয়তার নযির দিয়াছিলাম। কথাটা মুসলিম লীগের তৎকালীন মতবাদের সংগে বেসুরা শুনাইলেও সমবেত মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের কেউ প্রতিবাদ করেন নাই। কারণ কথাটা ছিল মূলতঃ সত্য।
মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া যে সব মুসলিম ও হিন্দু সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী পাকিস্তান দাবির বিরুদ্ধতা করিতেছিলেন আমার অভিভাষণ তাঁদের অনেকেরই দৃষ্টি ভংগিতে খানিকটা পরিবর্তন আনিতে সক্ষম হইল। আমার অনেক শ্রদ্ধেয় ও প্রবীণ কৃষক-প্রজা ও কংগ্রেস-কর্মীদের মধ্যে যাঁরা নিখিল ভারতীয় জাতীয়তার মোকাবিলায় বাংগালী জাতীয়তার দাবি তোলার পক্ষপাতী ছিলেন, তাঁরা এই মত প্রচারেও উদ্যোগী হইলেন। কমরেড রায় ব্যতীত কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড বংকিম মুখার্জী, কমরেড পি. সি. যোশী প্রভৃতি অনেকেই পাকিস্তান দাবিকে ন্যাশনাল মাইনরিটির আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার বলিয়া মানিয়া নিলেন।
কৃষক-প্রজা নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনায় সুফল পাওয়া না গেলেও আজাদে প্রকাশিত আমার আবেদনের সুফল হইল। বিভিন্ন জিলার কৃষক-প্রজা কর্মীদের অনেকেই আমার মত সমর্থন করিয়া এবং কেহ কেহ আরো কতিপয় প্রশ্ন সম্বন্ধে আলোকপাত করিতে অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিতে লাগিলেন। সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হইলাম সমিতির প্রেসিডেন্ট মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী সাহেবের পত্র পাইয়া। তিনি আমার সাথে সম্পূর্ণ একমত। এমন কি আমার লেখা পড়িবার আগে হইতেই তিনি এই লাইনে চিন্তা করিতেছিলেন। আমাকে এ ব্যাপারে আরও অগ্রসর হইবার জন্য উৎসাহ দিলেন।
২১. শহীদ সাহেবের চেষ্টা
আমি কংগ্রেস-প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যাশনাল প্লাটফর্ম ও কৃষক প্রজা সমিতিকে সে প্লাটফর্মের অন্যতম শ্রেণী প্রতিষ্ঠান বলিতাম। এই কথার সূত্র ধরিয়া শহীদ সাহেব কৃষক-প্রজা সমিতিকে কংগ্রেসের বদলে মুসলিম লীগের শ্রেণী শাখা হইতে উপদেশ প্রদান করেন। কিছুদিন আলোচনার পর তিনি লীগ-কৃষক-প্রজা যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দেন। আমি আনন্দের সাথে এই প্রস্তাব মূলনীতি হিসাবে সমর্থন করি। কৃষক-প্রজা সমিতির অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য মিঃ নির্মল কুমার ঘোষ শহীদ সাহেবের বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। তিনি আমার ও আমার সহকর্মীদেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে শহীদ সাহেবের সহিত কৃষক-প্রজা নেতাদের আলোচনা চলে। শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের প্রস্তাব এইরূপ দাঁড়াইয়াছিল : প্রাদেশিক আইন পরিষদের ও আইনসভার মোট মুসলিম আসনের শতকরা ৪০টি আসনে কৃষক-প্রজা পার্টির মনোনীত প্রার্থীকে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী বলিয়া গণ্য করা হইবে। কৃষক-প্রজা পার্টির এম, এল, এ.-রা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির ভিতরে স্বতন্ত্র গ্রুপ হিসাবে কাজ করিতে পারিবেন; কিন্তু মুসলিম লীগ পার্টির ডিসিপ্লিন মানিয়া চলিতে হইবে।
প্রস্তাবটি আমি গ্রহণ করিলাম এবং আমার পূর্বোক্ত সহকর্মীদের দিয়া ইহা গ্রহণ করাইবার জন্য আবার আলোচনা সভার আয়োজন করিলাম। নির্মল বাবু এ ব্যাপারে যথেষ্ট চেষ্টচরিত্র করিলেন। কৃষক-প্রজার স্বার্থ এতে যথেষ্ট রক্ষিত হইবে বলিয়া নিজেও বুঝিলাম, শহীদ সাহেবও আমাকে বুঝাইলেন। তিনি আমাকে দেখাইলেন, কৃষক-প্রজা পার্টির মনোনীত শতকরা ৪০টি সদস্য ছাড়াও মুসলিম লীগের মনোনীত শতকরা ৬০ জনের মধ্যেও অর্ধেকের বেশি কৃষক-প্রজা শ্রেণীর লোক থাকিবেন। কৃষক-প্রজার স্বার্থের ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চয়ই কৃষক-প্রজা সমিতির কর্মপন্থার সমর্থক হইবেন। ফলে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির মধ্যে কৃষক-প্রজা প্রতিনিধিদের স্বচ্ছন্দ মেজরিটি হইবে। এইভাবে বাংলার আইন পরিষদের এলাকার কার্যকলাপে কৃষক-প্রজার স্বার্থ রক্ষিত ত হইবেই, গোটা পাকিস্তান-আন্দোলনেও কৃষক-প্রজার দাবি প্রতিফলিত হইবে। শহীদ সাহেবের এই প্রতিশ্রুতিতে সন্দেহ করিবার কোনও কারণ ছিল না। বস্তুতঃ মুসলিম লীগকে মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করিবার পদক্ষেপ রূপে জমিদারি উচ্ছেদকে মুসলিম লীগের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হইয়াছিল। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলে এই প্রস্তাব পাস হইয়াছিল আমার উপদেশে এবং বন্ধুবর জনাব নূরুল আমিন ও জনাব গিয়াসুদ্দিন পাঠানের আন্তরিক ও অবিশ্রান্ত চেষ্টায়। প্রধানতঃ ময়মনসিংহ জেলার প্রতিনিধিদের দৃঢ় মনোতাবে ও সমবেত চেষ্টায় এটা সম্ভব হইয়াছিল। বিনা-ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের প্রস্তাবও কাউন্সিলে তুলা হইয়াছিল। এটাও ময়মনসিংহের প্রতিনিধিরাই করিয়াছিলেন। কিন্তু বড়-বড় কতিপয় নেতার প্রবল বিরুদ্ধতার ফলে প্রস্তাবটি পরিত্যক্ত হয়।
২২. মুসলিম লীগে যোগদান
যাহোক শেষ পর্যন্ত আমার সহকর্মী বন্ধুরা এই প্রস্তাবে রাযী হন নাই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে কৃষক-প্রজা সমিতির সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী শহীদ সাহেবের প্রস্তাব মানিয়া লইতে ব্যক্তিগতভাবে সম্মত হইয়াছিলেন। কিন্তু একথাও লিখিয়াছিলেন যে তিনি নিজে আইন সভার মেম্বর না হওয়ায় এ বিষয়ে কোনও নির্দেশ দিবার যোগ্যতা রাখেন না; এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মত দিবার তাঁরাই অধিকারী। কৃষক প্রজা-পার্টির এম. এল. এ. গণ তাঁদের চূড়ান্ত মতে শহীদ সাহেবের প্রস্তাব গ্রাহ্য করিলেন। অথচ কৃষক-প্রজা সমিতির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক দেওয়াও হইল না। অবশেষে অগত্যা আমি মুসলিম লীগে যোগদান করিয়া খবরের কাগযে বিবৃতি দিলাম। সমিতির সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী সাহেব এই সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে মোবারকবাদ দিয়া পত্র লিখিলেন। কয়েকদিন পরে তিনিও মুসলিম লীগে যোগদান করিলেন। কৃষক-প্রজা সমিতির নেতা ও কর্মীদের মধ্যে স্বভাবতঃই বিভ্রান্তি ও বিশৃংখলা দেখা দিল। ব্যক্তিগতভাবে যাঁর যেমন ও যখন সুবিধা হইল, কৃষক-প্রজা নেতারা তেমন ও তখন মুসলিম লীগে যোগদান করিতে লাগিলেন। যাঁরা কংগ্রেসের দিকে হেলিয়াছিলেন, তাঁরা পুরাপুরি ও খোলাখুলি কংগ্রেসে ঢুকিয়া পড়িলেন। অবশেষে নবাবযাদা হাসান আলী এবং আরও পরে সমিতির সেক্রেটারি মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ, এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি মৌঃ নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং মৌঃ গিয়াসুদ্দিন আহমদ এম, এল, এ, ও মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। এক নবাবযাদা হাসান আলী রাজনীতির খবছর ছাড়া আর সকলে আসন্ন নির্বাচনে মুসলিম লীগের টিকিট চাহিয়া এই বদনামের ভাগী হইলেন যে তাঁরা টিকিটের জন্যই মুসলিম লীগে যোগ দিয়াছেন। এক শামসুদ্দিন সাহেব ছাড়া আর কেউ লীগের টিকিট পান নাই। এইরূপে বিচ্ছিন্নভাবে কৃষক-প্রজা নেতারা কেউ কংগ্রেসে এবং বেশিরভাগ মুসলিম লীগে যোগদান করায় কৃষক-প্রজা সমিতি কার্যতঃ লোপ পাইল। অথচ কোন প্রতিষ্ঠানেই তাঁরা নিজেদের অস্তিত্বের কোন স্ট্যাম্প বা ছাপ রাখিতে পারিলেন না।
এই কারণে আজও অনেক সময় আমার মনে হয়, যথাসময়ে সুহরাওয়ার্দী ফরমূলা গ্রহণ করিলে কৃষক-প্রজা সমিতির ভাল ত হইতই, মুসলিম লীগ রাজনীতিতে এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাজনীতিতেও অধিকতর সুস্থতা দেখা যাইত।