7 of 8

হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি

হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি

কোন এক প্রাচীন গ্রন্থে নাকি লেখা আছে, ‘শিল্প হল জীবনের নকল।’ কথাটা কথাটা অবশ্যই খুব। দামি। তারাপদ রায়ের তুচ্ছ রচনায় এত মূল্যবান আলোচনা তরলমতি পাঠক-পাঠিকার পছন্দ নাও হতে পারে। সুতরাং শুরুতেই ব্যাপারটাকে সোজা রাস্তায় নিয়ে আসতে চাই।

কলকাতার এক খ্যাতনামা আধুনিক শিল্পী একদিন সন্ধ্যার অন্তিম পর্বে ওই সোজা রাস্তায় বাড়ি ফিরছিলেন। যেমন হয়, ফাঁকা রাস্তায়, এই মহানগরীর শেষতম ফ্যাশন, ট্যাক্সিবাহী ছিনতাইকারীরা তাঁর পাশে ট্যাক্সিটি দাঁড় করিয়ে তারপর ট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে নামে। চারজন তথাকথিত ডাকাত ছোরা, বোমা, পাইপগান এবং রিভলবার এইরকম চারটি বিভিন্ন অস্ত্র দেখিয়ে নিরীহ শিল্পীর হাতের আঙুল থেকে পলা-বাঁধানো রুপোর আংটি, কনুইয়ের ওপর থেকে অষ্টধাতুর মাদুলি, গলা থেকে গুরুদেবের ছবি লটকানো সোনার হার, এমনকী হাতের অন্য এক আঙুলের সাদা শঙ্খের আংটি সব সার্চ করে কেড়ে নেয়। সাধারণত এত জিনিস একজনের কাছে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই শিল্পী আধুনিক হলেও ভাগ্যচর্চা ও জ্যোতিষে আস্থাবান। তাঁর হাতে কোনও ঘড়ি বা পকেটে একটিও পয়সা ছিল না। সেজন্যে যাওয়ার সময় ট্যাক্সি-ডাকাতেরা টাকাপয়সা না পেলেও মারধর না করে শুধু একটি গলাধাক্কা দিয়ে যায়।

মাদুলি, আংটি ইত্যাদি ভাগ্যদায়ী এবং জীবন-রক্ষাকারী সাজসরঞ্জাম থেকে বঞ্চিত হয়ে তদুপরি গলাধাক্কার অপমানে শিল্পী মহোদয় কিছু হবে না জেনেও থানায় যান। সেখান থেকে পুলিশ সদর গোয়েন্দা দফতর। সেখানে গোয়েন্দারা যখন তাঁর নাম শুনে ধরতে পারে যে তিনি একজন খ্যাতনামা ছবি আঁকিয়ে তখন গোয়েন্দারা তাঁকে অনুরোধ করে যদি তিনি ডাকতদের দু’-একজনের ছবি এঁকে দেন তাহলে হয়তো গ্রেপ্তার করা সহজ হবে। ভদ্রলোক বিমূর্ত শিল্পের সাধক, গোয়েন্দারা সেটা খেয়াল করেননি। ভদ্রলোকের আঁকা ডাকাতদের ছবি থেকে পুলিশেরা মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারে না। এমনকী কোন দিকটা সোজা, কোন দিকটা উলটো তা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। সামনের দিক দিয়ে দেখলে চারটে টিভির অ্যান্টেনা বালির উপর পোঁতা রয়েছে। আবার উলটিয়ে দেখলে দুটো ভাঙা ছাতা। এক সরল প্রকৃতির কনস্টেবল ভুল করে সেটা উত্তর দক্ষিণে না ধরে পূব-পশ্চিমে পাশাপাশি ধরে দেখছিলেন, তিনি উপরওয়ালাকে বললেন, ‘স্যার, এটা মনে হচ্ছে ইনকমপ্লিট সেকেন্ড হাওড়ার পুল। বোধহয় ডাকাতদের ওখানে খুঁজতে হবে।’ টেবিলের ওপার থেকে উপরওয়ালা দারোগা সাহেব পুব-পশ্চিমের বদলে পশ্চিম-পূবে দেখছেন। তিনি বললেন, ‘ইডিয়েট, সত্যরঞ্জন তুমি ইডিয়েট, এটা হল খালাসি-টোলার বন্ধ গেটের ছবি, ডাকাতেরা নিশ্চয়ই ভেতরে বসে বাংলা খাচ্ছে।’

অবশ্য সব ছবি যে এ রকম জটিল হয় তা নয়। শিশুও বুঝতে পারে। এক বাড়িতে যামিনী রায়ের অরিজিন্যাল দেখে একটি বাচ্চা মেয়ে বলেছিল, ‘এটা কি আবার ছবি নাকি এটা তো ক্যালেন্ডার দেখে টুকে করেছে।’ অন্যত্র এক প্রদর্শনীতে দেখেছিলাম একটি বর্ষার ছবি। নদীতে নৌকো, ওপারে সবুজ গ্রাম, আকাশে মেঘ, খুব সম্ভব ইন্দ্র দুগারের আঁকা। সেই বর্ষার ছবির সামনে এক ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর পাশে দণ্ডায়মানা ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, ‘কী গো শরৎকালের জন্যে অপেক্ষা করছ নাকি?’

ছবির বর্ষার আকাশে মেঘ চিরদিনই একরকম থেকে যায় যে সে কোনওদিনই শারদীয়ায় পোঁছবে না। বরং জটিলতার কথা বলি।

পাবলো পিকাসো একদা বলেছিলেন, ‘লোকেরা আজকাল আর শিল্পের মধ্যে সান্ত্বনা বা প্রেরণা খুঁজে পেতে চায় না। অলস, বড়লোক তারাই এখনকার রুচির মালিক, তারা চায় অসাধারণ কিছু অভিনব, উত্তেজক, এলোমেলো। আর আমি এইসব লোকদের তৃপ্তিবিধান করে এসেছি যা কিছু অসংলগ্ন, উলটোপালটা আমার মাথায় এসেছে তাই দিয়ে। আর এরা সেসব যত কম বুঝেছে ততই বেশি প্রশংসা করেছে।’

পিকাসো অকপটে স্বীকার করেছেন যে তিনি এই হাস্যকর খেলায়, এই মনমাতানো পাগলামিতে জড়িয়ে রচনা করেছেন যত সব ধাঁধা আর প্রহেলিকা। ‘ফলে আমি বিখ্যাত হলাম, দ্রুত বিখ্যাত হলাম। আর খ্যাতি, আজকের যুগের একজন শিল্পীর প্রতিষ্ঠা মানেই বিক্রি, লাভ, সম্পদ। তোমরা জান আমি আজ বিখ্যাত এবং বিরাট বড়লোক।’

যদিও কলম একটু ভারী হয়ে যাচ্ছে পিকাসোর এর পরের কথাগুলো না লিখলে অন্যায় হবে। পিকাসো বলেছেন, ‘যখন আমি একা একা নিজের সঙ্গে থাকি তখন আমার ভরসা হয় না নিজেকে শিল্পী বলে বিবেচনা করতে। যে মহৎ অর্থে রেমব্রাঁট বা গয়াকে গিয়োটো বা টিটিয়ানকে শিল্পী ধরা হয়। আমি আসলে সামান্য পাবলিক এন্টারটেনার, যে তার সময়কে বুঝতে পেরেছে।’

এবার একটু নরম জায়গায় ফিরে যাই। প্রথমে একটা ছবির কথা বলি। নীল আকাশের নীচে নীল সমুদ্র, সমুদ্র যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে সেখানে একটি লাল সূর্য। ফিকে নীলের নীচে ঘন নীল, মধ্যে রক্তসূর্য, সূর্যরশ্মির লোহিত তরঙ্গ এবং সমুদ্রের নীল তরঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ছবিটিতে কোনও নাম লেখা নেই, শুধু নম্বর লাগানো আছে। এই রকম কাঁচা ছবি আমাকে খুব টানে। অনেকক্ষণ ছবিটা দেখে আমি ভাবলাম, এটা সূর্যোদয়ের ছবি না সূর্যাস্তের ছবি? প্রদর্শনীতে ছবিটা দেখছিলাম, পাশ দিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। তিনিও ছবিটার পাশে অল্প সময় মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তারপর স্বগতোক্তি করলেন, ‘বাঃ, চমৎকার সূর্যাস্তের ছবি।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোককে ধরে ফেললাম, ‘কী করে বুঝলেন সূর্যাস্ত? সূর্যোদয় নয় কেন? সূর্য উঠছে না ডুবছে কী করে বোঝা যায়?’ ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘যে এঁকেছে তাকে আমি চিনি, সে জীবনে কোনওদিন সকাল সাড়ে নটার আগে ঘুম থেকে ওঠেনি। সূর্যোদয় দেখেছে কবে, আঁকবে যে?’

আমি কিন্তু নিজে বিশ্বাস করি না যে সুর্যোদয়ের ছবি আঁকবার জন্যে সূর্যোদয়ের অভিজ্ঞতা দরকার। এ নিয়ে এখনই প্রচুর বাদবিতণ্ডা করা যেতে পারে। আমি নিজে বাদবিতণ্ডায় যাব না, বরং বিখ্যাত কার্টুনিস্ট লক্ষ্মণ মধ্যে মধ্যে গোলমাল বাঁধান, তাঁকে স্মরণ করছি। লক্ষ্মণের একটা কার্টুনে আছে, শিল্পী দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে কোট-প্যান্ট-টাই পরা এক ভদ্রলোক ইজেলে তুলি বোলাচ্ছেন, আর শিল্পী হাসিমুখে বলছেন, ‘ইনি শিল্পসমালোচক, ইনি আমার ছবি এত ভাল বোঝেন যে এখন থেকে আমার সব ছবি উনিই আঁকবেন।’ জীবনানন্দ দাশের সেই সমালোচক যাঁকে জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘বরং নিজেই তুমি লেখনাকো একটি কবিতা’, লক্ষ্মণ তাঁকেই কার্টুনস্থ করেছেন।

লক্ষ্মণের আরেকটি কার্টুনে আছে, চিত্রপ্রদর্শনীতে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়ে গেল শিল্পীর তুলি মোছার ক্যানভাসটি। হতভম্ব শিল্পী অবাক হয়ে রূপসী ক্রেতার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আর পরিহাস নয়, অবশেষে একটা দুঃখের কথা বলি। এক শিল্পী তাঁর নবপরিচিত বন্ধুকে বলছিলেন, ‘দশ বছর ছবি আঁকার পর আমি ধরতে পারি আমার ছবি আঁকার প্রতিভা নেই, ক্ষমতাই নেই।’ বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তখন কী করলেন, ছবি আঁকা ছেড়ে দিলেন?’ শিল্পী করুণ হেসে বললেন, ‘কী করে ছাড়ব? তখন আমার নাম হয়ে গেছে, প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *