মশা
অনেকদিন আগে একদিন সন্ধ্যাবেলা এক বন্ধুর খোঁজে বেহালায় তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন বেহালায় সাংঘাতিক মশা। ঝোপঝাড়, ডোবা, পানাপুকুর, কাঁচা নর্দমা—এগুলোর জন্যই বেহালায় মশা ছিল। সেসময় মূল কলকাতায় কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত কোনও মশা ছিল না।
কালীঘাটের বাড়িতে আমাদের কোনও মশারি ছিল না। যত মশা ছিল, বেহালা, যাদবপুর, টালিগঞ্জে এমনকী বালিগঞ্জেও।
সে যা হোক, বন্ধুটির বাড়িতে গিয়ে বেল দিয়েছি। একটি অল্পবয়সি কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অমুক বাড়ি আছে?’ মেয়েটি নীরবে ঘাড় নেড়ে জানাল ‘না, নেই।’
অতদূরে কষ্ট করে গিয়ে দেখা হল না, অথচ আমার ধারণা ছিল, বন্ধুটি সন্ধ্যাবেলা বাসায় থাকে।
পরদিন বন্ধুটির সঙ্গে দেখা। সে বলল, ‘তুই কাল বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বেল দিয়ে তারপর চলে এলি। কাজের মেয়েটি বাড়ির মধ্যে গিয়ে বলতে আমি বেরিয়ে এসে দেখি, তুই নেই, চলে গেছিস।’
আমি বললাম, ‘তোদের মেয়েটি যে ঘাড় নেড়ে জানাল যে তুই নেই।’
বন্ধুটি বলল, ‘আরে মশার জন্য ও ওরকম ঘাড় নাড়াচ্ছিল যাতে মশা মুখে না কামড়াতে পারে। আমি বাসায় না থাকলে ও সেকথা মুখে বলত। বাসায় আছি বলেই তোকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে বাড়ির মধ্যে ডাকতে গিয়েছিল।’
শুধু বেহালার দোষ দিয়ে লাভ নেই। একসময়ে সারা বাংলায় মশার অত্যাচারে থরহরি কম্প দেখা দিয়েছিল। প্রকৃত অর্থেই থরহরি কম্প। চল্লিশের দশকে মহাযুদ্ধ-মন্বন্তরের যুগে ম্যালেরিয়ায় ভুগে থরহরি কম্প বাঙালি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। চারদিকের খবর শুনে কেমন যেন একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসছে, বাঙালির ইতিহাসে সেই স্ফীত প্লীহা, অস্থলে-কুস্থলে অসময়ে কম্পমান, শুষ্ক জিহ্বা, কোটরগত চক্ষুর কুইনিনতিক্ত দিনগুলি আবার কি ফিরে এল?
সেই কবে, সেও পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে, অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন,
‘মশায়
দেশান্তরী করলে আমায়
কেশনগরের মশায়।’
এই কেশনগর হল কেষ্টনগর বা কৃষ্ণনগর, যেখানে অন্নদাশঙ্কর চাকরিসূত্রে কিছুদিন ছিলেন। সম্প্রতি কোথায় যেন অন্নদাশঙ্করের স্মৃতিকথায় পড়লাম এই ছড়াটি তিনি লিখেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে চলে আসার পরে।
অন্নদাশঙ্করই পারেন মশক দংশনের বিষাক্ত স্মৃতিকে এমন সরস ও সুললিত ছড়ায় উপহার দিতে, তামরা পারি না।
আমরা তা পারি না। কিন্তু আমি একটা জিনিস পেরেছিলাম, সেও পঁচিশ বছর আগে, ডোডো-তাতাই গল্পমালায় মশার হাত থেকে বাঁচার উপায় বলেছিলাম।
ব্যাপারটা খুবই সোজা। যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
প্রথমে পঞ্চাশ-ষাটটা মশা ধরতে হবে। ভয় পাবেন না, মশা ধরা, মশা মারার চেয়ে অনেক সোজা। ঘরের মধ্যে বিছানার কাছে একটা ফুটো মশারি টাঙিয়ে দেবেন। সেই মশারির মধ্যে কাউকে শুতে হবে না। কিন্তু ভোরবেলা দেখবেন মশারির মধ্যে বেশ কিছু মশা।
একটা কাচের বোতল নিয়ে এর মধ্যে যে ক’টা মশা সম্ভব ধরে ভেতরে পুরবেন। অনেক ধরতে পারবেন না, অনেক মরে যাবে। তাতে কিছু আসে যায় না। পাঁচ-সাতদিনের মধ্যে বোতলে গোটা পঞ্চাশ মশা জমা পড়বে।
এবার বোতলের মধ্যে একফোঁটা আলতা ঢেলে ঝাকাবেন। এই আন্দোলনে কিছু কিছু মশা মরে যাবে। তা যাক।
বাকি যেগুলো জীবিত, জীবন্ত থাকবে, সেগুলো সন্ধ্যাবেলা ঘরে ছেড়ে দিন। এবার জীবনপণ লড়াই শুরু হবে লাল মশাদের সঙ্গে কালো মশাদের। এরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে যাবে। আপনাদের কোনও মশাই কামড়াবে না।
পরদিন সকালে দেখতে পাবেন ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে লাল ও কালো মশাদের অগুনতি মৃতদেহ।