7 of 8

দুই বাঘের গল্প

দুই বাঘের গল্প

কেউ জানেন না।

জানার কথাও নয়। আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে এক জোড়া বাঘ, চিতা বাঘ বা বনবেড়াল নয়, একেবারে আসল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার উধাও হয়েছিল, এই মাত্র মাস দেড়েক আগে।

চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার পাহারাদারের শৈথিল্য ও অনবধানতাবশত ব্যাপারটা ঘটেছিল। সে অনেক সময়েই খাঁচার দরজা ভেজিয়ে রাখত। তালা না দিয়ে। অবশ্য কোনওদিন কোনও বাঘ দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি, তারা বীরদর্পে নিজেদের খাঁচার মধ্যে পায়চারি করেছে। ইচ্ছে হলে নিরীহ দর্শক সাধারণকে ভয় দেখানোর জন্যে, শিশুদের আমোদ দেওয়া জন্যে হালুম হুলুম করেছে।

কিন্তু এই বাঘ দুটো ঠিক সে জাতের নয়। এরা দু’জনে এক খাঁচায় ছিল। এক সঙ্গে সাঁট করেছিল, চিড়িয়াখানা থেকে পালাতে হবে।

গল্পের সুবিধের জন্য আমাদের আলোচ্য বাঘ দুটির নাম বলে দেওয়া ভাল। দুটিই প্রায় একইরকম দেখতে। পুরুষ বাঘ। শুধু একজনের নাকের ওপরে একটা কাটা দাগ; শিশুকালে কুমিরে আঁচড়ে দিয়েছিল। এই বাঘটার নাম আচরণ। অন্য বাঘটার কোনও ‘ভিজিবল ডিস্টিংগুইশিং মার্ক’ নেই, সে দেখতে অন্যান্য আর দশটা বাঘের মতো। তার নাম বিলক্ষণ।

একদিন কেলেঙ্কারি হল। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও, দর্শকরা চিড়িয়াখানা থেকে চলে যাওয়ার পরেও বাঘের খাঁচার দরজায় তালা লাগানো হল না। খাঁচার পাহারাদারের সেটা খেয়ালই ছিল না। সে তখন চিড়িয়াখানার মাঠে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসে ‘বিনোদন বিচিত্রা’ পত্রিকা পড়ছিল।

চিড়িয়াখানার বড় বড় প্রাগৈতিহাসিক গাছপালার মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে আসার পর বিলক্ষণ খুব সাবধানে তার ডান পায়ের থাবা দিয়ে খাঁচার দরজাটা ঠেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে হাঁ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ খাঁচার ভিতরে বসে চারদিক লক্ষ করে তারপর একে একে বিলক্ষণ ও আচরণ খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে দেওয়াল ঘেঁষে এগোতে লাগল।

বাঘ দুটোকে দেখে এবং তাদের গন্ধ পেয়ে হরিণেরা ত্রস্ত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। পাখিরা চেঁচামেচি আরম্ভ করল। চিড়িয়াখানায় রাতের দিকে হঠাৎ হঠাৎ এ রকম ছুটোছুটি চেঁচামেচি হয়— ব্যাপারটা কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না।

আজকেও তাই হল। কেউ কিছু খেয়াল করল না। আচরণ আর বিলক্ষণ চুপিসারে দেওয়াল আর কাঁটা মনসার ঝাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। রাত গভীর হলে, যখন ওপাশের খিদিরপুরের খালধারে রাস্তায় গাড়িঘোড়া, মানুষজনের শব্দ একেবারে থেমে এল, বাঘ দু’জনে এক লাফে পাঁচিল পেরিয়ে চিড়িয়াখানার বাইরে চলে এল। সেখান থেকে আচরণ রওনা হল দক্ষিণমুখী, সরাসরি সুন্দরবনের দিকে। আর বিলক্ষণ রওনা হল উত্তরমুখী গড়ের মাঠের ময়দান ধরে, ওদিকে যদি কোনও জঙ্গল থাকে এই আশায়।

দেড়মাস পরে গতকালকেই আচরণ আর বিলক্ষণ ধরা পড়েছে। আজ তাদের আবার সেই পুরনো খাঁচায় পোরা হয়েছে।

এই দেড়মাস বিলক্ষণ বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, তার গায়ে গত্তি লেগেছে। কিন্তু আচরণের অবস্থা অতি শোচনীয়। হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছে তার, সে খুব রুগ্ন, কথায় কথায় হাঁপাচ্ছে।

আচরণের অবস্থা দেখে বিলক্ষণ জিজ্ঞাসা করল, ‘একী তোমার এ রকম হাল হল কী করে?’

আচরণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ভাই, তুমি তো জানো সুন্দরবন যাব বলে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু পথের মধ্যে পড়লাম ঘোর বিপদে।’

বিলক্ষণ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বিপদ?’

আচরণ বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম খরার মরশুম, খটখটে বোশেখ মাস। খাল-বিল-নালা লাফিয়ে লাফিয়ে একরাতে সুন্দরবনে চলে যাব। কিন্তু তোমার কি মনে আছে আমরা যেদিন পালালাম সেদিন রাতে কী ভয়ংকর ঝড়বৃষ্টি এল। তারপর এক নাগাড়ে অকাল বর্ষা, দিনের পর দিন।’

বিলক্ষণ বলল, ‘ঝড় বাদলায় আমিও খুব বেকায়দায় পড়েছিলাম।’

আচরণ বলল, ‘তোমার কথা পরে শুনব। আগে আমার কথা শেষ করি।’

বিলক্ষণ দেখল এই দেড় মাসে আচরণের প্রকৃতি একটু খিটখিটে হয়েছে, সে আর বাধা না দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। বলো।’

আচরণ আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করে বলল, ‘কী বিপদে যে পড়েছিলাম, বৃষ্টিতে নদীর বাঁধ ভেঙে গেল। গ্রামকে গ্রাম পথঘাট জলে ডুবে একাকার। একটা উঁচু ঢিবি মতন জায়গা দেখে সেখানে একটা তালগাছের নীচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। হঠাৎ পরের দিন সকালে মানুষের চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি চারপাশ থেকে দলে দলে মানুষেরা মাথায় বোঁচকা নিয়ে জলে সাঁতরিয়ে সেই ঢিবির দিকে আসছে। আমি এক লাফে তালগাছের মাথায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে পাক্কা পনেরো দিন। এর মধ্যে প্রথম কয়েকদিন বাবুইয়ের বাসা থেকে দু’-চারটে করে ডিম খেয়েছি। তারপরে সেও ফুরিয়ে গেল। পনেরো দিনের মাথায় মাথা ঘুরে নীচে পড়ে গেলাম।’

বিলক্ষণ অবাক হয়ে বন্ধুর কথা শুনছিল, এবার বলল, ‘তারপর।’

আচরণ বলল, ‘তারপর আবার কী?’ বোধহয় তালগাছ থেকে নীচে পড়ার পরে, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, ঘুমপাড়ানি গুলি-টুলি মেরেছিল। এতদিন পরে দেখছি এই খাঁচার মধ্যে ফিরে এসেছি। সে যাক, এবার তোমার খবর বলো।’

বিলক্ষণ বলল, ‘আমার খবর তো ভালই ছিল গত পরশু পর্যন্ত। খেয়ে-দেয়ে ভালই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজের দোষে মারা পড়লাম।

আচরণ বলল, ‘তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।’

বিলক্ষণ বলল, ‘বলছি। সংক্ষেপ করে বলছি। সেই ঝড়ের রাতে চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আমি তো উত্তর দিকে রওনা হলাম। তুমুল ঝড় বাদলে আটকে গেলাম ময়দানে। এদিকে ভোর হয়ে এল। তাড়াতাড়ি লাট সাহেবের বাড়ির মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করে তারপর লালদিঘি পেরিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংসে ঢুকে গেলাম। পুরনো বিশাল বাড়ি, পেল্লায় কাঠের সিঁড়ি। তারই একটার পিছনে লুকিয়ে রইলাম। সন্ধ্যাবেলায় যখন লোকজন কাজ করে ফিরে যাচ্ছে একেবারে শেষের লোকটাকে ধরে খেলাম। কেউ কিছু টের পেল না। এত হাজার হাজার লোক, কেউ কিছু টের পেল না। এইভাবে মাস দেড়েক ভালই চলছিল। নির্বিবাদে একটা একটা করে লোক খেয়ে যাচ্ছিলাম। ভুলটা করলাম পরশু দিন। ভুল করে যে লোকটা চা দেয় তাকে খেয়ে ফেলি। সকালবেলায় বাবুরা এসে চা খান। যখন চায়ের লোকটাকে খুঁজে পাওয়া গেল না, তাঁরা খেপে গেলেন। খোঁজ শুরু হয়ে গেল। সিঁড়ির পিছন থেকে আমাকে ধরে ফেলল। তারপর চালান হয়ে আবার এখানে ফিরে এলাম।’

বিলক্ষণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আচরণ বলল, ‘সত্যি, বড় দুঃখের কথা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *