7 of 8

বিপদ

বিপদ

গুরুতর বিপদে পড়েছিলাম এই পুজোর মধ্যে মহাসপ্তমীর দিন।

ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় পার্ক সার্কাসের মোড়ের কাছে আমির আলি অ্যাভিনিউয়ে ডা. মুরলী বিশ্বাসের বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল।

মুরলীবাবু পণ্ডিত ব্যক্তি, বিজ্ঞানের অধ্যাপক, সুরসিক, সদাশয় ভদ্রলোক। তিনি মাঝেমধ্যেই এ রকম নিমন্ত্রণ করে থাকেন।

মহাসপ্তমীর দিন ডা. বিশ্বাসের গৃহে কস্তুরীরও নিমন্ত্রণ ছিল। কস্তুরী আমাদের পুরনো বন্ধু, তার গাড়ি আছে। সে নিজে থেকেই ফোন করে জানাল সে আমাদের সঙ্গে যাবে। কস্তুরীর গাড়ি আছে। সে গাড়ি করে আমাদের বাসায় আসবে, তারপর আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। আমরা মানে, আমি ও আমার স্ত্রী মিনতি এবং কস্তুরী।

কস্তুরী গাড়ি নিয়ে আসবে জেনে আমরা স্বামী-স্ত্রী খুব আশ্বস্ত হলাম, কারণ এই পুজোর বাজারে ট্যাক্সি পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার, তা ছাড়া ফেরার ব্যাপারটাও নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

যথা সময়ে কস্তুরী এল। কস্তুরী একটা পুরনো গাড়ি কিনে ভাল করে সারিয়ে রঙ করে নিয়েছে। দেখলাম গাড়িটা বেশ ঝকঝকে, নতুনের মতোই মনে হয়।

আমরা সবাই মিলে গাড়িতে উঠলাম। পিছনের সিটে কস্তুরী ও মিনতি, সামনের সিটে আমাদের পূর্বপরিচিত ড্রাইভার শিবুর বাঁপাশে আমি। গাড়িটা চলতে শুরু করলে দেখলাম গাড়িটার মতিগতিও ভাল, বেশ স্বচ্ছন্দে যাচ্ছে, বিশেষ ঝাঁকি-টাকি লাগছে না।

আমরা ডা. বিশ্বাসের বাড়ির সামনে এসে গেলাম। মহাপুজোর প্রথম সন্ধ্যা, অদূরেই পার্ক সার্কাসের বিখ্যাত পুজোমণ্ডপ। রাস্তাঘাট আলোয় আলোময়, লোকে লোকারণ্য।

মিনতি ও কস্তুরী গাড়ি থেকে নেমে গেল। কিন্তু আমি আর নামতে পারি না। আমার বাঁ হাতি দরজাটা কিছুতেই খুলল না অনেক টানাটানি, হেঁচকা-হেঁচকি, ধাক্কাধাক্কি করলাম, কিন্তু গাড়ির দরজা এক সেন্টিমিটারও খুলল না।

আমার বন্দিদশা এবং দরজা খুলতে অক্ষমতা দেখে ডানদিকে ড্রাইভারের সিট থেকে শিবু বলল, ‘ও কিছু নয়। আমি দেখছি।’ এই বলে শিবু ড্রাইভারের সিট থেকে দ্রুত নেমে গাড়ির সামনের দিক দিয়ে ঘুরে বাঁদিকে আমার দরজার পাশে এসে হাতল টিপতে লাগল। কিন্তু তাতেও দরজা খুলল না।

ইতিমধ্যে পুজোর দিনের রাস্তায় লোকজনের মধ্যে থেকে একটি ছোটখাটো কৌতুহলী জনতা তৈরি হয়েছে গাড়িটিকে ঘিরে। তারা আমার কার্যকলাপ লক্ষ করছে এবং পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে।

মিনিট পাঁচেক ধরে শিবু বহু মেহনতি করল। ধাক্কাধাক্কি, এমনকী দরজায় লাথি পর্যন্ত মারল, কিন্তু আলিবাবার গুহার দরজার মতো কপাট বন্ধ রইল।

অবশেষে শিবু ঘোষণা করল, ‘গাড়ির দরজা লক হয়ে গেছে।’ পথচারীদের মধ্যে একজন দয়াল ব্যক্তি তাঁর পকেট থেকে এক তোড়া চাবি এগিয়ে দিলেন। শিবু একটার পর একটা চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল, দরজা তো খুললই না, মাঝখান থেকে একটা চাবি বেঁকে গিয়ে দরজার লকের সঙ্গে পুরো চাবির তোড়াটা আটকিয়ে গেল। যার চাবি সে হায় হায় করতে লাগল।

অবশেষে উপস্থিত জনতা একটা সহজ সিদ্ধান্তে এল। বাঁদিক দিয়েই গাড়ি থেকে নামতে এমন কোনও কথা নেই, ডান পাশে ড্রাইভারের দিক দিয়েও তো নামা যায়।

আমি এতক্ষণ এই আশঙ্কাই করছিলাম। স্টিয়ারিং এবং সিটের মধ্যে যে ফাঁকটুকু আছে যার মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার দেহ গলিয়ে দেয়, সেখান দিয়ে আমার মতো ভুড়িওয়ালা লোকের বেরনো সম্ভব নয়।

তথাপি সমবেত জনতার সনির্বন্ধ অনুরোধে আমি প্রাণপণে দম বন্ধ করে ভুঁড়ি চেপে স্টিয়ারিংয়ের নীচ দিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হলাম।

কিন্তু চেষ্টাটাই সার। ঠিক মাঝপথে ভুঁড়ি আটকিয়ে গেল।

শক্ত, মেদবহুল অনেকদিনের লালিত আমার মধ্যদেশ হাজার চাপেও বিন্দুমাত্র সংকুচিত হল, বরং স্টিয়ারিংটা আমার ভুঁড়ির ওপর চেপে বসে গেল, জাঁতাকলে বন্দি হওয়া ইঁদুরের মতো আমি আটকে গেলাম, ইদুরের মতোই ক্ষীণকণ্ঠে চিঁচিঁ করতে লাগলাম।

আমার মারাত্মক অবস্থা দেখে ভিড়ের মধ্যে থেকে জনা দুই বলবান ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, তাঁদের মুখেচোখে পরোপকারের বাসনা ফুটে উঠেছে। আমি হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলাম, ‘দয়া করে, টানা-হাঁচড়া করবেন না। আমি বেশ আছি।’

আমার কথা শুনে জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘বেশ আছেন কী মশায়? দেখছেন না আটকে গেছেন। আপনাকে টেনে বার না করলে বেরবেন কী করে?’ আমি বললাম, ‘কয়েকঘণ্টা এ রকম থাকলে ক্ষিদেয় পেট একটু চুপসোবে, এখন না পারি, তখন পারব।’ কিন্তু আমার অনুরোধ বিফলে গেল। দু’জন পালোয়ান আমার কাঁধ ও কোমর ধরে এক হ্যাঁচকা টানে সত্যিই আমাকে ওই গাড়ি থেকে উদ্ধার করল।

আমার পুজোর নতুন পাঞ্জাবিটা ফেঁসে গেল। ভুঁড়িটায় একটা টনটনে ব্যথা হল, সেই সঙ্গে একটা মোটা কালো দাগ।

এই ঘটনার পর প্রায় একমাস হয়েছে। ব্যথাটা এখন নেই, কিন্তু দাগটা রয়ে গেছে। বোধহয় সারা জীবন থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিপদ