একটি উড়ো কাহিনী
শ্রীলঙ্কায় তামিলদের সঙ্গে সিংহলিদের দাঙ্গাহাঙ্গামা হচ্ছে। অনেক সংবাদপত্রে সেটাই মুখ্য সংবাদ। আমরা ভারতীয়রা স্বভাবতই তামিলদের প্রতি কিঞ্চিৎ সহানুভূতিশীল। কিন্তু এরই মধ্যে একটা কথা উঠল, এবং জোর আলোচনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল যে সিংহলিরাই আমাদের, মানে বাঙালিদের আপনজন। কয়েক হাজার বছর আগে সমুদ্রপথে সিংহল জয় করে বাঙালিরা উপনিবেশ স্থাপন করে। এই তো সেদিন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার নাম ছিল সিংহল, আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ যে হেলায় লঙ্কা জয় করে সিংহল নামে তার শৌর্যের পরিচয় রেখে গেছে এ তো বাঙালি শিশুমাত্রেই ছোটবেলায় কণ্ঠস্থ করেছে। ওই বিজয় সিংহ এবং তার অনুচরদের বংশধররাই নাকি এ যুগের সিংহলি।
সিংহলিদের ইতিহাস, ভাষা, আচার-আচরণ, নাম-গোত্র, সংস্কার-ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি গবেষণা করে বেশ কয়েকজন পণ্ডিত প্রায় প্রমাণ করেই ফেললেন যে বাঙালিরাই সিংহলি। খোদ সিংহলে। সিংহলি বিদ্বানেরা পর্যন্ত কবুল করে বসলেন, আমরা হলাম বাঙালিদের বংশধর।
এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই, একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের গৌরব বোধ করা উচিত, পূর্বপুরুষের এই উজ্জ্বল অভিযানের ঐতিহ্যের অধিকারী হয়ে।।
এদিকে আবার কথা উঠেছে যে যাযাবার রোমারা, যাদের জিপসি বলা হয় তারাও নাকি আদি বাঙালি। তাদের দেবতার নাম কালো বা কালী, তাদের ফরাসি দেশে মানুষ বলে ডাকা হয়। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদির মধ্যে বাংলার ছাপ নাকি স্পষ্ট।
কিছুকাল আগে চন্ডিগড়ে বিশ্ব রোমা উৎসব হয়ে গেল। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে যাযাবার জিপসিরা সেই উৎসবে যোগদান করেছিল। ঠিক তখনই চন্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন যে, রোমারা আসলে বাঙালি। বহুদিন আগে এরা সমুদ্রপথে ইউরোপে যায়। তারপর থেকে যাযাবর জিপসিদের জীবনযাপন করছে। তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে অধ্যাপক মহোদয় যথেষ্ট নজিরও উপস্থাপন করেন।
ইতিহাসের প্রামাণ্য প্রবক্তারা, খাঁটি পণ্ডিতেরা এই সব তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ কতটা পাত্তা দেবেন কিংবা মেনে নেবেন তা আমার মতো সামান্য লোকের পক্ষে বলা কঠিন। বাঙালির এই গৌরবময় ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কিছুকাল আগে শোনা একটি গল্প, একটি উড়ো কাহিনী।
কলকাতা থেকে দিল্লিগামী নৈশ বিমানে ঘটনাটি ঘটেছিল। নিশাকালে বিমানটি ছাড়ে বলেই এটি নৈশ, তা নয়, বহু লোক নেশা করে এই বিমানে ওঠে বলেও এটি প্রকৃত অর্থে নৈশ বিমান। এই বিমানে কলকাতা থেকে একজন বিখ্যাত ভদ্রলোক যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম ধরা যাক ঙ বাবু। তিনি যাচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত দরকারি কাজে। ভদ্রলোকের হাতে দড়ি দিয়ে ঝোলানো একটা বাঁশের চুপড়ি। বাঁশের চুপড়িটা একটা ঢাকনা দিয়ে আটকানো, কিন্তু ভালভাবে আটকানো নয়, বেশ একটু ঢিলে।
ঙ বাবু জানলার পাশের সিটে বসে রাত্রির নক্ষত্রখচিত আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। প্লেন একটু আগে ছেড়েছে। ঙ বাবুর পাশের সিটের বাসিন্দা হলেন এক বুড়ি মেমসাহেব। তোবড়ানো গালে প্রসাধন, শুকনো ঠোঁটে লিপস্টিক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, চোখ দুটি কিন্তু কৌতূহলী। প্লেনের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেমসাহেব সব খুঁটিয়ে দেখছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিব্রাজিকারা যেমন করেন তেমনই আর কী। সব কিছু দেখার পর পাশের সিটে ঙ বাবুর দিকে তাকিয়েই মেমসাহেবের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। সর্বনাশ বাঁশের চুপড়ির ডালাটা একটু আলগা, আর সেই ফাঁকে দুটি বীভৎস কৃষ্ণবর্ণ দাঁড়া আকুলিবিকুলি নড়াচড়া করছে, বেরিয়ে আসার জন্যে বারবার ঠেলে তুলছে চুপড়ির ডালাটা।
মেমসাহেব তাঁর পিঙ্গল চক্ষুতারকাদ্বয় কপালে তুলে, ‘আ আ… আ আ…আ’ করে স্বরগ্রামে সাংঘাতিক আর্তনাদ করে উঠলেন।
সবে সিটবেল্ট খুলে যাত্রীরা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলেন, তাঁরা এই অকল্পিত আর্তনাদে চমকিয়ে উঠলেন। এদিক-ওদিক দুই-একটি শিশু ক্রন্দন জুড়ে দিল, এক পাঞ্জাবি মহিলা হাইজ্যাকিং হচ্ছে ভেবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। দু’-তিনজন যাত্রী দৌড়ে গেটের দিকে ছুটে গেলেন, যেন মহাশূন্যে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলেই আপাতত রক্ষা।
ঘটনার আকস্মিকতা যতই হোক, এরই মধ্যে একজন ঠান্ডা মাথার এয়ার হোস্টেস ঘটনার কারণ আবিষ্কার করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গেলেন ঙ বাবুর রোয়ের দিকে, তারপর ঙ বাবুর হস্তধৃত চুপড়িটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রশ্ন করলেন, ‘ও কী! আপনার হাতে ওটা কী, ওসব কী?’
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার দরকার। শ্রীযুক্ত ঙ বাবুর ওই বিপজ্জনক চুপড়িতে রয়েছে এক ডজন বড় কাঁকড়া। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এঁদো পানাপুকুরের কাদা, কচুরিপানা এবং শ্যাওলার মধ্যে এই সুস্বাদু প্রাণীগুলোর জন্ম ও বসবাস। ঙ বাবুর জামাতা বাবাজীবন দিল্লিতে চাকরি করেন। জামাতাটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লোক এবং কঁকড়াবিলাসী। ঙ বাবু তাই দিল্লি যাওয়ার সময় যদি সম্ভব হয় দু’-একটা কাঁকড়া জামাতার জন্যে নিয়ে যান। এইভাবে বাঁশের চুপড়িতে ভরে নিয়ে যাওয়াই সহজ, কাঁকড়াগুলো মরে না বেশ তরতাজা থাকে। আর তা ছাড়া কয়েকটা জ্যান্ত কাঁকড়া লাগেজের মধ্যে বা অ্যাটাচি কেসের মধ্যে ভরে দেওয়া যায় না।
প্রত্যেক বারই নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেছেন ও বাবু। কেউ খেয়ালই করেনি, এমন কী সিকিউরিটির লোকেরাও কাঁকড়ার ব্যাপারটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আজ এ কী দুর্বিপাক, এ কী অঘটন।
প্লেনসুদ্ধ যাত্রী একসঙ্গে চেঁচামেচি করছে ঙ বাবুর উপর, পাইলট সাহেব কো-পাইলটের হাতে প্লেনের দায়িত্ব দিয়ে নিজেই এগিয়ে এলেন, ‘আপনি কি পাগল না কি মশাই। কঁকড়া বিছে নিয়ে কেউ প্লেনে ওঠে!’ ততক্ষণে পার্শ্ববর্তী বুড়ি মেমসাহেবকে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দূরবর্তী একটা শূন্য সিটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মিলে আঙুল উঁচিয়ে ঙ বাবুর কাছে জানতে চাইছে, ‘ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা কী?’
থতমত ঙ বাবু উঠে দাঁড়ালেন, তারপর একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, ‘বন্ধুগণ আপনারা না জেনে অত উত্তেজিত হবেন না। আমার এই হাতের বাঁশের চুপড়ির মধ্যে বাঘ নয় ভালুক নয়, সাপ, নয়, এমনকী কঁকড়া বিছে নয়, আছে সামান্য কয়েকটি কাঁকড়া। নিতান্তই দিশি, ভেতো বাঙালি কাঁকড়া।’
পাইলট সাহেব নিজে বাঙালি, তিনি প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘কাঁকড়ার বাঙালি-অবাঙালি কী?’ ঙ বাবু বললেন, ‘আরে সেই কথাটাই তো বোঝাতে চাইছি। আরে মশায়রা এই যে দেখছেন এগুলো সব খাঁটি বাঙালি কাঁকড়া। এই যে দেখছেন একটা উঠে আসতে চাইছে বাকিগুলো একে নীচ থেকে দাঁড়া দিয়ে টেনে ধরেছে। কারও বাপের সাধ্যি নেই যে বেরিয়ে আসে, যতবারই উঠতে যাবে বাকিরা সবাই মিলে টেনে নামিয়ে নেবে। দয়া করে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, এই বাঙালি কাঁকড়াদের একজনেরও সাধ্য নেই উঠে আসে, ওরা এই চুপড়ির মধ্যে থাকতে বাধ্য।’
এই কাহিনীর শেষ নেই, বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গেও এর কোনও যোগ নেই। শুধু বাঙালি সম্পর্কে এত কথা লেখার পর বাঙালিনী বিষয়ে তিন পঙ্ক্তি না লিখলে অন্যায় হবে। পঙ্ক্তিত্রয় আমার নয়, পরশুরামের, রাজমহিষী গল্পে আছে :-
‘সোনামুখী বাঙালিনী পাগল করেছে,
যাদু করেছেরে হামায় টোনা করেছে।
ঝমঝেমে ঝঁয় ঝঁয়, ঝমে ঝমে ঝঁয়।’