7 of 8

ভুল, ভূল

ভুল, ভূল

না। ‘ভূল’ লেখা উচিত হবে না। কোনও অজুহাতেই ভুলকে ভূল লেখা চলবে না। সেটা ডাহা ভুল হবে। পূজা এবং পুজো চলবে, বধূ যখন বউ হবে হ্রস্ব উ হতে বাধা নেই।

আমাদের ছোটবেলায় ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট পেপারে বাংলা ব্যাকরণের সাজেশনের অধ্যায়ে বহু প্রচলিত বানান ভুলগুলোর একটা তালিকা ছিল। সেই তালিকার নীচে একটি অসামান্য পঙ্ক্তি বোল্ড পয়েন্টে ছাপা ছিল, যে পঙ্ক্তিটি আমি এই এতকাল পরেও ভুলিনি। পঙ্ক্তিটি হল,

‘ভুল বানান কিন্তু ভূল করিয়ো না।’

ভুলে যাওয়া আর ভুল করা এক ব্যাপার নয়। আমরা চিঠিতে ঠিকানা লেখার সময় ভুল করি, তারপর সেই ভুল-ঠিকানার চিঠি ডাকে ফেলতে ভুলে যাই।

বোধহয় এইচ জি ওয়েলসই বলেছিলেন যে দৃষ্টি আকর্ষণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল ভাল মতন একটা ভুল করা। এবং এই বুদ্ধিতেই অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের বিজ্ঞাপনে, সাইনবোর্ডে একটা ভুল রেখে দেন, এতে লোকের নজর কাড়ে, গ্রাহক ভুলটা মনে রাখে না কিন্তু দোকান বা দ্রব্যের কথা মনে রাখে। কোনও ঘৃত ব্যবসায়ী যদি দোকানের সাইনবোর্ডে লেখেন, ‘এখানে বিষুদ্ধ ঘৃত পাওয়া যায়।’ এতে সত্যিই ব্যবসাবৃদ্ধি হয় কি না তা অবশ্য বলা কঠিন।

একদা ভুল নিয়ে রসসাগর শিবরাম চক্রবর্তী একটা মজার গল্প লিখেছিলেন। একজনের পায়ে একজোড়া মোজার একটা লাল রঙের, অন্যটা কালো রঙের। তাঁর এক বন্ধু এ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘এ এক মোজার ব্যাপার হয়েছে মোশায়। আমার বাসায় আরো এক জোড়া মোজা আছে, সে জোড়ারও একটা লাল, একটা কালো।’ সে ভদ্রলোককে বোঝানো অসম্ভব হয়েছিল যে তিনি দু’জোড়া মোজা ঘুলিয়ে ফেলে এই অসামান্য ভুলটি করেছেন।

ছাপাখানার ভুত বলে একটা অদৃশ্য জীব আছে। কেউ কখনও তাকে চোখে দেখেনি বটে কিন্তু ছাপার ব্যাপারের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জানেন সে আছে, যথেষ্টই আছে, সব রকম মুদ্রণ প্রমাদের জন্যে সে দায়ি। বাংলায় তাকে ভূত বলা হয় বটে কিন্তু সাহেবদের কাছে সে সাক্ষাৎ শয়তান, যাকে বলে ডেভিল, প্রিন্টারস ডেভিল।

এক উকিল সাহেবের কথা বলি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের এই বিখ্যাত আইনজ্ঞ একটা বড় মামলার কাগজপত্র নিজের হাতে রচনা করে ছাপতে দিয়েছিলেন আদালতে পেশ করার আগে। অত্যন্ত বনেদি ও বিখ্যাত ছাপাখানা থেকে চূড়ান্ত প্রুফ এল তাঁর কাছে প্রিন্ট অর্ডার মানে ছাপবার অনুমতির জন্যে।

উকিলসাহেব তাঁর অমূল্য সময় ব্যয় করে সেই পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠার ম্যাটার অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, গোটা চল্লিশেক ভুল রয়েছে। সংশোধন করে তিনি আবার প্রুফ পাঠাতে বললেন। পরেরবার প্রুফ এলে তিনি নিজে না দেখে তাঁর সেরেস্তার লোকজনকে দেখতে বললেন। সঙ্গে লোভ দেখালেন, কেউ যদি ভুল বার করতে পারে প্রত্যেকটি ভুলের জন্যে তিনি এক ডলার করে পারিশ্রমিক দেবেন।

ব্যাপার দাঁড়াল গুরুতর। তাঁকে প্রায় একশো ডলার দিতে হল। এবারেও তিনি প্রিন্ট অর্ডার না দিয়ে বললেন আবার প্রুফ পাঠাতে। পরেরবার প্রুফ এল। এবার আর নিজের অফিসের কর্মচারী নয়, উকিল সাহেব অফিসের দরজায় বিল বোর্ডে পুরো ম্যাটার ঝুলিয়ে দিলেন। সঙ্গে নোটিশ দিলেন, ‘প্রতিটি ভুল সংশোধনের জন্যে দশ ডলার করে দেওয়া হবে।’

দুঃখের বিষয়, এবারও আইনজীবী ভদ্রলোকের একশো দশ ডলার ক্ষতি হল, অর্থাৎ তখনও এগারোটা ভুল ছিল।

ভুক্তভোগীরা জানেন, ছাপাখানায় এ রকম এবং এর থেকে ঢের বেশি ভুল হয়ে থাকে। সুখের বিষয়, পাঠকেরাও জানেন। তাঁরা ক্ষমাঘেন্না করে এসব মেনে নেন। তার প্রমাণ ভূরিভূরি ভুলে ভরা কত বই বেস্টসেলার হয়। এ বিষয়ে আমি নিজেও হলফ করে বলতে পারি।

এই মুহূর্তে দুটি মারাত্মক মুদ্রণ প্রমাদের কথা মনে পড়ছে।

সেই বিখ্যাত সবুজপত্র, সেই অবিস্মরণীয় প্রমথ চৌধুরী, নিরঙ্কুশ, ঝকঝকে, ত্রুটিহীন। তাঁর কাগজেই তাঁর নাম ছাপা হয়েছিল প্রথম চৌধুরী।

আর, বিলেতের টাইম কাগজ মহামান্যবর্তী ইংলন্ডেশ্বরীর সন্তানজন্মের সংবাদে বাকিংহাম প্যালেস লিখতে লিখেছিল ফাকিংহাম প্যালেস (Fuckingham Palace)।

ভুলের গল্প এত সহজে শেষ হবে না।

বিলিতি প্রবাদ আছে, ভুল করার জন্যেই এই মানবজন্ম। আর আমাদের বাবু মোহনদাস, মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমাদের ভুল আর ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই আমরা সব জানতে পারি।’

আপনারা জীবনে কী কী ভুল করেছেন?

এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল পাঁচ হাজার জন লোকের কাছে। বলা বাহুল্য আমাদের দেশে নয় আমেরিকায়। প্রশ্নটির উত্তরে এক বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘শুধু শুধু এতদিন ধরে এতসব বই পড়েছি, এত না পড়লেও চলত। রাত জেগে, চোখ নষ্ট করে দরকারি কাজ ফেলে বই পড়েছি, বই আর বই। এত জেনে কী লাভ?’

বিপরীত দিকে এক মধ্যবয়সি ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘স্কুলজীবনে ভাল করে পড়াশুনা নাক বড় ভুল করেছি। এখন আর শোধরাবার কোনও উপায় নেই।’

কেউ বলেছিলেন, ‘অল্প বয়েসে বিয়ে করে খুব ভুল করেছিলাম।’ আবার অন্য কেউ বলেছেন, ‘বেশি বয়েসে বিয়ে করে খুবই ভুল করেছি।’

বলা বাহুল্য, ভুলের আরও অনেক নমুনা ছিল এই সব জবাবে। কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে।।

(এক) বাবার কথা না শুনে বড় ভুল করেছি।

(দুই) টাকাপয়সা ভাল করে উপার্জন করার চেষ্টা করিনি।

(তিন) টাকাপয়সা হিসেব করে খরচ করিনি।

(চার) গির্জায় যাইনি।

(পাঁচ) নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ভুল করেছিলাম।

এই তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। যে কেউ এই তালিকায় তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি যোগ করতে পারেন। তার মধ্যে, ‘আমার পক্ষে চাকরি করা ভুল হয়েছে’, ‘ব্যবসা করা ভুল হয়েছে’, ‘সাহিত্য করতে যাওয়া ভুল হয়েছে’, ‘মোটা হয়ে যাওয়া ভুল হয়েছে’, ‘সময়মতো সল্টলেকে জমির জন্যে চেষ্টা না করা ভুল হয়েছে’—এ রকম অবশ্যই থাকতে পারে।

আবার এ রকম থাকতে পারে যে ‘গত সপ্তাহে নগেন ডেন্টিস্টকে দিয়ে দাঁত তুলতে যাওয়া আমার সবচেয়ে বড় ভুল বড় আহাম্মকি হয়েছে’। এমনকী কারাগারবাসী কেউ হয়তো কবুল করতে পারেন, ‘থানার সামনে ছিনতাই করতে যাওয়া, তাও আবার বুঝতে না পেরে বড়বাবুর শালির গলার হার, খুবই ভুল করেছিলাম।’

এসব স্বীকারোক্তির প্রসঙ্গ বাড়িয়ে লাভ নেই, বরং ভুলের গল্পে, মজার ভুলের গল্পে যাই। এক ভদ্রমহিলা স্বামীর সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে গেছেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিল চুকিয়ে রাস্তায় এসে মহিলার খেয়াল হল খাওয়ার টেবিলে তাঁর হাতের রুমালটা ফেলে এসেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি রেস্তোরাঁর মধ্যে ফিরে গেলেন। তখন বেয়ারা তাদের টেবিল পরিষ্কার করছিল। মহিলা দেখলেন রুমালটা বেয়ারার ট্রেতে কিংবা টেবিলের ওপরে কোথাও নেই। তখন তিনি উবু হয়ে টেবিলের নীচে উঁকি দিয়ে দেখলেন, তাঁকে এই ভাবে দেখে বেয়ারা একটু বাইরের দরজার দিকে তাকাল, কাচ লাগানো প্রশস্ত দরজা, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মহিলার স্বামী সেখানে অধীর, অস্থিরভাবে দণ্ডায়মান।

অতঃপর বেয়ারাটি যথাসাধ্য নম্র কণ্ঠে বলল, ‘মেমসাহেব আপনি ভুল করেছেন। আপনার স্বামী এখানে নয়, ওই দেখুন দরজার বাইরে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে, তিনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’

ভুলের পর ভুলভুলাইয়ার কথা বলা যেতে পারে। রাজা বাদশাদের শখ ছিল ভুলভুলাইয়ার। প্রাসাদের মধ্যে বা অন্যত্র ভুলভুলাইয়ার মহল বানাতেন। সেই মহলে একবার প্রবেশ করলে বেরনো কঠিন, অথবা বলা চলে প্রায় অসম্ভব। বাতায়নহীন আধো-অন্ধকার গলিঘুঁজিতে সব পথ (প্যাসেজ), সব দরজা এক রকম। বারবার ভুল হয় এই বুঝি ঠিক রাস্তা, অবরুদ্ধ দেওয়ালে ব্যাহত হয়ে আবার ভুলভুলাইয়ার গলি ধরে বেরিয়ে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা। আমি যদি পোড়খাওয়া মানুষ না হয়ে হাফ কবি কিংবা অসফল দার্শনিক হতাম, অনায়াসে কম্প্রকণ্ঠে নিবেদন করতে পারতাম, ‘জীবনটাও বুঝলেন কিনা, একটা ভুলভুলাইয়ার গলি।’

কিন্তু আপনারা জানেন এ ধরনের ছেঁদো কথা বলা আমার স্বভাব নয়। আমি ভালবাসি ছেঁদোগল্প বলতে। এবং অবশেষে তাই হোক।

শীতের দিনে দূরপাল্লার ট্রেনে দু’জন যাত্রী পাশাপাশি বার্থে দু’দিন দু’রাত্রি কাটিয়েছিলেন। প্রথমজন শিক্ষিত অধ্যাপক, দ্বিতীয়জন সরকারি অফিসের সামান্য একজন কর্মচারী, পিয়নগোছের চাকরি, ভ্রমণভাতা পেয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন।

গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নামার সময় খেয়াল করলেন এ দু’দিন রেলগাড়িতে যে বালাপোশটা তিনি শীত নিবারণের জন্যে ব্যবহার করেছেন সেটা নেই। কাল রাতেও গায়ে দিয়েছেন, আজ সকালে নেই। ইতিমধ্যে এই এক্সপ্রেস ট্রেনে একজন নতুন যাত্রী ওঠেনি। সুতরাং অধ্যাপক সাহেবের সন্দেহ গেল গরিব পিওন সহযাত্রীটির প্রতি। তিনি তাঁকে জেরা করলেন, নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধা শতরঞ্চি মোড়ানো তাঁর বিছানা খোলালেন এবং অবশেষে দেখা গেল বালাপোশটি এসব জায়গায় নেই। তারপর দেখা গেল সেটা লোয়ার বার্থের নীচে ট্রেনের মেঝেতে অন্ধকারে পড়ে আছে।।

বালাপোশটা ফেরত পেয়ে অধ্যাপক খুশি মনে সেটা লাগেজে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি ভুল করেছিলাম।’

পিওনটি বললেন, ‘আমিও ভুল করেছিলাম।’

অধ্যাপক বললেন, ‘আপনি আবার কী ভুল করলেন?’

পিওন বললেন, ‘আপনি ভুল করেছিলেন আমাকে চোর ভেবে। আমি ভুল করেছিলাম আপনাকে ভদ্রলোক ভেবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *