7 of 8

বিদূষক

বিদূষক

বিদূষক মানে ভাঁড়, নানারকম কৌতুক রসিকতা ইত্যাদি করে যিনি রাজার মনোরঞ্জন করেন। যেমন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে ছিলেন গোপাল ভাঁড়।

অবশ্য গোপাল প্রামাণ্য ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে, এটা কোনও আনুমানিক সন্দেহ নয় সুপণ্ডিত সুকুমার সেন মহোদয় পর্যন্ত গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন।

গোপাল ভাঁড়ের প্রসঙ্গে যথা সময়ে আসা যাবে, তার আগে এই প্রাচীন তথ্য উত্থাপনের কারণটা বলি।

আমার তরলমতি সুবিদিত। এবার বিদেশে থাকাকালীন আমার এক পুরনো বন্ধু আমাকে কয়েকটি সরস গ্রন্থ পড়তে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি বই ছিল, জনৈক হুইটমোর গ্রন্থিত ‘দ্য কোর্ট জেস্টারস’ (The Court Jesters)। নামকরণের মধ্যে একটু বাহুল্য আছে, এখানে কোর্ট মানে রাজসভা। বইটির মানে দাঁড়ায় রাজসভার বিদূষক। বিদূষক মানেই রাজার সভাসদ, আলাদা করে রাজসভার বিদূষক বলার প্রয়োজন কী?

সে যা হোক প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সাবলীল ভাষায় লেখা এই বইটি আমার পক্ষে চমৎকার এইজন্যে যে আমার আবাল্য পরিচিত তিনজন বিদূষক, আরও সত্তর-আশিজন ইউরোপীয় এবং এশীয় ভাঁড়ের সঙ্গে আলোচিত হয়েছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মার্কিন লেখক, মার্কিন প্রকাশক কিন্তু কোনও মার্কিন বিদূষকের সন্ধান পেলাম না।

এই বইতে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছেন মহামতি আকবরের সভাসদ বীরবল। ভাঁড়দের জগতে বীরবলের মতো শিক্ষিত, রুচিবান ব্যক্তি বিরল। তিনি শুধু সামান্য বিদূষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন কবি ও দার্শনিক, সভাসদ ও সৈনিক। বুন্দেলখণ্ডের সামান্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান মহেশ চন্দ্র ভারতেশ্বরের রাজদরবারে বীরবল হয়েছিলেন।

পারস্য সম্রাট একদা শুনেছিলেন যে, মোগল সম্রাটের পরশমণি আছে, যা ছোঁয়ালে সব কিছু সোনা হয়। তিনি নাকি পরশমণি সম্পর্কে আকবরের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন। আকবর পারস্যদূতকে বলেছিলেন, ‘এই যে বীরবলকে দেখছেন, ইনি আমার পরশমণি।’

ঠিক এরই আগে একবার আকবর বীরবলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সূর্য উঠলে চারিদিকে আলো হয়ে যায়। সব কিছু দেখা যায়। কিন্তু কী দেখা যায় না বলো তো বীরবল।’

বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বীরবল বলেছিলেন, ‘সূর্য উঠলে অন্ধকার দেখা যায় না।’

বীরবলের বুদ্ধিমত্তার একটি নিদর্শন রয়েছে তাঁর একটি অসামান্য উপদেশে।

মোগল সম্রাটের মা যেদিন পরলোক গমন করেছিলেন, ঠিক সেদিনই তাঁর একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।

সভাসদেরা জানেন না এমন অবস্থায় কী করতে হবে। আকবরের মুখোমুখি হলে হাসবেন না কাঁদবেন।

অনেক ভাবনাচিন্তা করে তাঁরা বীরবলের শরণাপন্ন হলেন।

সব শুনে বীরবল যে পরামর্শ দিলেন, সেটা অদ্যাবধি শিরোধার্য।

বীরবল বলেছিলেন, ‘সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। যদি দেখেন মহামতি হাসছেন, আপনিও হাসবেন। যদি দেখেন সম্রাটের চোখে জল, আপনারাও পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছবেন, চোখে জল থাক বা না থাক।’

আকবর একবার বীরবলকে পরিহাসচ্ছলে আগ্রার কাক গুনতে বলেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে বীরবল কাক গোনা শেষ করে বললেন, ‘আগ্রার কাকের সংখ্যা আশি হাজার তিনশো তিন।’

আকবর অবাক হয়ে বললেন, ‘এ হিসেব বার করলে কী করে?’ বীরবল মাথা চুলকিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ কম-বেশি হতে পারে। যদি কম হয় জানবেন কিছু কাক বাইরে গেছে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে কিংবা তীর্থ করতে। আর যদি বেশি হয় বুঝবেন, বাইরের কাকেরা আগ্রায় বেড়াতে এসেছে।’

পুনশ্চ:

একদা সম্রাট আকবর নাকি বীরবলকে সরাসরি বলেছিলেন, ‘বীরবল তুমি বোকা, তুমি মুর্খ, তুমি গাধা।

বীরবল বিনীতভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হুজুর আগে আমি এমন ছিলাম না, তা হলে আপনি আমাকে কখনওই সভাসদ করতেন না, মন্ত্রী করতেন।’

সম্রাট ভ্রূকুঞ্চন করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তবে?’

একটু এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে একটু হাত কচলিয়ে বীরবল বললেন, ‘সঙ্গদোষে আমার এই পরিণতি।’

হায়! আমরা যদি আমাদের ওপরওয়ালাদের এমন কথা কখনও বলতে পারতাম।

হুইটমোর সাহেবের কোর্ট জেস্টার বইতে বীরবল ছাড়াও, আমার এবং আপনাদের সকলেরই পূর্ব পরিচিত দু’জন বিদুষক আছেন।

গোপাল ভাঁড় এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিন। গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে বেশি তথ্য নেই তবে সবিস্তারে মোল্লা নাসিরউদ্দিন কাহিনী আছে।

আগে গোপাল ভাঁড়ের কথাই বলি। পুরনো গল্প যথাসম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছি।

কয়েকটা আধচেনা গল্প পেলাম। তার একটি হল কুকুর নিয়ে।

গোপাল নিয়মিত মন্দিরে পুজো দিতে যেতেন। একদিন তাঁর পিছু পিছু একটা পথের কুকুর মন্দিরে ঢুকতে যাচ্ছে।

মন্দিরের পুরোহিত কিঞ্চিৎ তফাতে আসছিলেন। তিনি পিছন থেকে এটা দেখে চেঁচিয়ে গোপালকে বললেন, ‘গোপাল, তোমার কুকুরকে আটকাও, কুকুর নিয়ে মন্দিরের উঠোনে ঢুকবে না।’

গোপাল পিছন ফিরে দেখলেন সত্যিই একটা পথের কুকুর তাঁর পিছে আসছে আর আরেকটু পিছনে কুকুরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে মন্দিরের প্রধান পূজারি খুব সন্তর্পণে এগোচ্ছেন।

গোপাল পূজারি ঠাকুরকে বললেন, ‘কিন্তু ঠাকুরমশায়, আপনি কী করে বুঝলেন যে এই কুকুরটা আমার? আমি এই কুকুরের মালিক?

ঠাকুরমশায় বললেন, ‘কুকুরটা যে তোমার পিছনেই রয়েছে গোপাল।’

গোপাল বললেন, ‘কী আর বলব? আপনি কুকুরের পিছনে রয়েছেন। আপনার কথা মানলে বলতে হয় যে, কুকুরটা আপনার মালিক, আপনি এর পিছে পিছে থাকছেন।’

বলাবাহুল্য, সাধারণ বাজার প্রচলিত গোপাল ভাঁড় কাহিনীতে এ গল্পটা ঠিক এভাবে আমি পাইনি।

অন্য একটি গল্প একটু অন্যরকমভাবে রয়েছে।

সাধারণ মানুষ গোপাল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ নিযুক্ত হয়েছেন। সুতরাং তদানুযায়ী চলতে হবে।

নতুন ঘোড়া কিনতে হল গোপালকে। সুন্দর আরবি টাট্টু ঘোড়া। তার সঙ্গে রাজন্যজনোচিত লাগাম, চাবুক থেকে সাজপোশাক সাজসরঞ্জাম।

ঘোড়ার সঙ্গে নতুন সহিস এসেছে। তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গোপাল মনের সাধে ইচ্ছেমতো করে সাজপোশাকে ঘোড়া সাজালেন। নিজেই নিজেকে বাহবা দিতে লাগলেন।

কিন্তু আরবি ঘোড়ার উজবেক দেশীয় সহিস বলল, ‘জাঁহাপনা, আপনার সব গোলমাল হয়ে গেছে, আপনি সামনের দিকের সাজ পিছনে পরিয়েছেন, পিছনের সাজ সামনে। একদম উলটো হয়ে গেছে।’

গোপাল উত্তেজিত হয়ে সহিসকে বললেন, ‘উজবুক কাঁহাকা। তুই জানিস, আমি ঘোড়ার কোনদিকে মুখ করে বসব। আমি ঘোড়ার লেজের দিকে মুখ করে বসব, সেইভাবে সাজিয়েছি।’

হুইটমোর সাহেবের বইতে সভাসদ গোপালের সমাজ জীবনের আর একটা গল্প আছে।

সভাসদ হিসেবে গোপালের ওপরে দায়িত্ব পড়েছিল, রাজধানী কৃষ্ণনগরের অন্ধদের একটি তালিকা প্রণয়নের।

গোপাল লোকজন পাঠিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে অন্ধের তালিকা তৈরি করেছিলেন। সেই তালিকা গোপাল তাঁর নিজের জামার পকেটে রাখতেন, যদি স্বচক্ষে কোনও অন্ধের দেখা পেতেন যার নাম ওই তালিকায় নেই তিনি ওই তালিকায় নামটি লিপিবদ্ধ করতেন।

তা, একদিন সকালে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে একটা গাছতলায় বসে গোপাল একটা পুরনো খাটিয়া মেরামত করছিলেন। সেই পথ দিয়েই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছিলেন, তিনি তাঁর সভাসদের এই কাজ দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘গোপাল, তুমি কী করছ?’

গোপাল বললেন, ‘আজ্ঞে খাটিয়া সারাচ্ছি।’

এরপর তাঁর জোব্বার পকেট থেকে অন্ধের তালিকাটি বের করে তাতে মহারাজের নামটি লিপিবদ্ধ করে আবার পকেটে রাখলেন।

কৌতুহলী মহারাজ বললেন, ‘ওই কাগজটা কীসের?’

গোপাল বললেন, ‘ওটা অন্ধের তালিকা।’

মহারাজ বললেন, ‘ওটায় কী লিখলে?’

গোপাল বললেন, ‘তালিকায় আপনার নাম অন্তর্ভুক্ত করলাম। আপনি পরিষ্কার দেখলেন আমি খাটিয়া সারাচ্ছি, অথচ জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী করছি, আমার হিসেবে আপনি অন্ধ।’

অবশেষে নাসিরউদ্দিন। হুইটমোর সাহেবের ‘কোর্ট জেস্টার’ বইতে যে নাসিরউদ্দিনের কথা বলা আছে, তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় অনেককাল পরে, বলা উচিত, এই সেদিন।

সত্যজিত রায় নাসিরউদ্দিন রসিকতাসমূহ বাঙালি পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করলেন। তারই অনতিকাল পরে ইন্দ্র মিত্র দেশ পত্রিকার পৃষ্ঠায় নাসিরউদ্দিনকে ধারাবাহিক করলেন। অবশ্য ইংরেজিতে নানা সংকলনে এবং আলাদা করেও নাসিরউদ্দিনের রঙ্গরসিকতা বেশ কিছুদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। পেপার-ব্যাকে প্রকাশিত হয়ে সেই বইগুলো বেশ সহজলভ্য হয়েছিল।

হুইটমোর ‘কোর্ট জেস্টার’ গ্রন্থে নাসির সংক্রান্ত অজস্র তথ্য এবং বহু গল্প আছে। গল্পগুলি অধিকাংশই বাঙালি পাঠকের পরিচিত।

আমি স্বল্পপরিচিত দু’-একটি গল্পের কথা উল্লেখ করছি।

নাসির তখন শিশু। যেমন অনেকে জিজ্ঞাসা করে থাকে, তেমনই এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমরা কয় ভাই?’

নাসির বললেন, ‘দুই’।

ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে বড়?’

নাসির বললেন, ‘সমান সমান।’

ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ও তোমরা বুঝি দু’-ভাই যমজ?’

নাসিরের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘না।’

কিছু বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে?’

এবার নাসির বুঝিয়ে বললেন, ‘এক বছর আগে আমার মা বলেছিলেন, যে আমার ভাই আমার চেয়ে এক বছরের বড়। এক বছর তো কেটে গেছে, এখন নিশ্চয়ই আমাদের দুই ভাইয়ের বয়স সমান সমান হয়েছে।’

এই নাসিরই একদা বড় হয়ে প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহকে বলেছিলেন যে, ‘আপনার মূল্য শূন্য।’

দোষটা বাদশাহেরই হয়েছিল, নাসিরের মতো ধুরন্ধর লোককে কেউ কখনও জিজ্ঞাসা করে, ‘বলো দেখি আমি কত মূল্যবান?’

বাদশাহের দিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে তারপর মনে মনে কী হিসেব করে নাসির বললেন, ‘কত আর মূল্য হবে আপনার, এই বড় জোর দশ মুদ্রা।’

বাদশাহ হো হো করে হেসে বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আচ্ছা বোকা হে। আমার গায়ে এই জরির কাজ করা জামাটা দেখেছ, এরই দাম হবে কম-সে-কম দশ মুদ্রা।’

বিনীতভাবে নাসির বললেন, ‘হুজুর, ওই জামাসুদ্ধই আপনার দাম ধরেছি।’

এর মানে হল, বাদশাহের মুল্য শূন্য। প্রগলভ এবং দুঃসাহসী নাসিরের এর পরে কী পরিণতি হয়েছিল হুইটমোর সাহেব সে বিষয়ে কিছু কিন্তু লেখেননি।

পরিণতির ভয় নাসির করতেন না। বীরবল বা গোপাল ভাঁড়ও করেননি। কী বললে কী হবে, একথা ভাবতে গেলে বিদূষকবৃত্তি করা যায় না। মন জুগিয়ে কথা বলে মো-সাহেবরা। তারা বিদূষকদের চেয়ে কয়েক ধাপ নীচের সারির লোক।

একবার বাদশাহ নাসিরের বাসায় হঠাৎ কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন সামনের দরজা বন্ধ, বাড়ির মধ্যে নাসির তো নেই-ই, কেউ-ই নেই।

বাদশাহ পরিহাস করে চকখড়ি দিয়ে নাসিরের কাঠের দরজায় বড় বড় হরফে লিখে দিয়ে এলেন ‘গাধা’। বাড়ি ফিরেই নাসিরের চোখে পড়ল সেটা।

পরদিন পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে স্বয়ং বাদশাহ তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন একথা শুনে নাসির ছুটলেন বাদশাহের প্রাসাদে। গিয়ে বললেন, ‘হুজুর, আপনি আমার বাসায় গিয়েছিলেন, আমি ছিলাম না, আমি খুবই দুঃখিত।’

বাদশাহ মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি বুঝলে কী করে যে আমি গিয়েছিলাম?’

নাসির বললেন, ‘তা বুঝব না কেন হুজুর? আপনি যে আমার বাড়ির দরজায় অতবড় করে আপনার নাম লিখে রেখে এসেছেন।’

বারবার তিনবার গঙ্গারামকে এড়ানো গেছে। এবার আর যাবে না। গঙ্গারামকে ডাকতেই হবে। সে অবশ্যই কোনও রাজরাজড়ার না হোক, মহামহিম শ্রীল শ্রীযুক্ত তারাপদ দেবশর্মনের বিদূষক।

কিন্তু গঙ্গারাম বিলক্ষণ চটে যাচ্ছে। আমি উপেক্ষা করলে আর সে অভিমান করবে না, সে হতেই পারে না।

গঙ্গারামকে খবর পাঠাই, সে জানায়, ‘কেন, আমাকে আবার কেন? গোপালকে ডাকুন।’ কখনও বলে, ‘বীরবল কি ছুটিতে গেছে?’ অথবা, ‘নাসির মোল্লা পালাল কোথায়? স্টক ফুরিয়েছে বুঝি।’

অনেক সাধাসাধি, টেলিফোনে বহু অনুনয়-বিনয় অবশেষে টেলিফোনে বিরিয়ানি এবং চিকেন রেজালার লোভ দেখালেও—কিছুতেই গঙ্গারাম আসে না। শেষে একটি যন্ত্রস্থ রম্যরচনা গ্রন্থ তাকে উৎসর্গ করব এই প্রলোভনে গঙ্গারাম আমার কাছে এল।

আমার ঘরে ঢুকেই সামনের চেয়ারে বসে সে বিনা বাক্যব্যয়ে প্রথমেই একটা গল্প বলল।

গল্পটা সেই গোরু তাড়ানোর কৃষকের। সেই ব্যক্তি সারাদিন ঝোপে-ঝাড়ে, খেতে-মাঠে পলাতক গোরুটির অনুসন্ধান করে গোরুটি না পেয়ে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসা নিজের ছেলেকে বলেছিল, ‘ভাই এক গেলাস জল দাও তো।’

অদুরে রান্নাঘরে রন্ধনরত কৃষক পত্নী স্বামীর এই আচরণ, নিজের পুত্রকে ভাই বলা শুনে রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই। নিজের ছেলেকে ভাই বলছ।’

এইকথা শুনে কৃষক তার স্ত্রীকে মা সম্বোধন করে বলেন, ‘মা, মানুষের গোরু হারালে যে কী অবস্থা হয়, আপনি কী করে বুঝবেন।’

দুঃসাহসী গঙ্গারাম নির্জলা আমার বহু পুরনো গল্প আমাকেই শোনাল। গল্পটা বিস্তারিতভাবে কাণ্ডজ্ঞানের যুগে লিখেছিলাম, গল্পটা শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।

গঙ্গারামকে একথা বলতে, সে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কার কাছে শুনেছিলেন?’

আমি বললাম, ‘সেটা সুনীলকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তবে তার মনে আছে কি না বলতে পারব না।’

গঙ্গারাম তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটি পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া জীর্ণ গ্রন্থ বার করল। বেশ মোটা বই, বছর সত্তর আগে চিৎপুরের বটতলা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির নাম ‘গোপাল ভাঁড় রহস্য লহরী’!

পেজ-মার্ক দেওয়া ছিল। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা খুলে গঙ্গারাম দেখাল সেখানে এই একই গল্প একটু দীর্ঘাকারে, সাধুভাষায় লেখা আছে।

দুই ঠোট কুঞ্চিত করে, পোষা কুকুরকে যেভাবে ডাকে, সেইভাবে চু-চু-চু করতে করতে গঙ্গারাম বলল, ‘কেন যে আপনি ছাই-ভস্ম এইসব হাসির লেখা লেখেন, সবই তো আগে লেখা হয়ে গেছে। আপনি ভাল করে পড়াশুনো করে আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে কিছু লিখুন তো।’

রীতিমতো অপমানিত বোধ করছিলাম। গঙ্গারামকে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। তাকে বললাম, ‘আর কিছু বলার আছে?’

গঙ্গারাম বলল, ‘হ্যাঁ আরেকটা গল্প। একটা সাংঘাতিক মোটা মতন লোক কোনওরকমে গড়াতে গড়াতে বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে গেছে নিজেকে দেখাতে। বিধান রায় অল্প একটু রোগীকে দেখে, অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বললেন, ‘আপনার তো খুব খারাপ অবস্থা। ওষুধ, চিকিৎসায় আর কিছু হবে না। মাস দেড়েকের মধ্যে আপনার মৃত্যু অনিবার্য।’

রোগীটি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে গেল। দেড় মাস পরে আবার সেই রোগীটি ডাক্তার রায়ের কাছে এসেছে, এই দেড়মাস প্রাণান্ত দুশ্চিন্তায় তার ওজন অর্ধেক হয়ে গেছে, ভুঁড়ি অদৃশ্য হয়েছে। চেহারা ছিমছাম হয়েছে, চলনে থলথলে ভাব নেই।’

রোগী এসে বিধান রায়কে বলল, ‘আমার নির্ঘাৎ মৃত্যু, কিন্তু…’, ডাক্তার রায় তাঁকে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুভয় দেখিয়েছিলাম তাতেই তো তুমি রক্ষা পেলে, নতুন জীবন ফিরে পেলে।’

আমি বললাম, ‘এ গল্প তো সবাই জানে, এমনকী আমি নিজেও একবার লিখেছি।’

হাসতে হাসতে ঝোলা থেকে একটা বোর্ড বাউন্ড ইংরেজি বই বার করে গঙ্গারাম বলল, ‘নাসিরুদ্দিনের গল্পের এটা প্রামাণ্য সংকলন। এই গল্পটা এই বইতে রয়েছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *