7 of 8

সময়জ্ঞান

সময়জ্ঞান

সময়—প্রায় মধ্যরাত্রি। শুভ-বিবাহের তিথি ছিল। কিছুক্ষণ পরে পরে বিবাহবাসর প্রত্যাগত দু’-একজন পথচারীকে দ্রুতপদে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে।

চৌমাথার কাছাকাছি একটা বেশ বড় গাছের ছায়ায়, প্রায় চার-পাঁচজন যুবক দাঁড়িয়ে। তাদের একজনের হাতে একটা ছোরা, নাপিতেরা যেভাবে কখনও কখনও হাতের তালুতে ক্ষুর অনায়াস বিদ্যুৎগতিতে ঘষে নেয়, সেই রকম ভাবে সে মধ্যে মধ্যেই ছোরাটা তালুতে বুলিয়ে নিচ্ছে। ছোরা বোলানোর সাবলীল অথচ অন্যমনস্ক ভঙ্গি দেখে অনুমান করা কঠিন নয় যে ছোরা ব্যবহারে তার পারদর্শিতার অভাব নেই।

বাকি কয়েকজনকে দেখেও ভালই বোঝা যায় যে এরা সকলেই এর উপযুক্ত সঙ্গী। তাদের পোশাক-চেহারা ইত্যাদি বর্ণনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। শুধু একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে একজনের হাতে একটি দামি হাতঘড়ি, সে ল্যাম্প-পোস্টের আলোর ঠিক নীচে, ফুটবল খেলার শেষদিকে রেফারিরা যেমন চকিত অভিনিবেশে ঘড়ির কাঁটার দিকে লক্ষ রাখেন, সেও সেই কায়দায় বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।

যদিও গভীর রাত্রি, যদিও কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তবুও একে বড় চৌমাথা তার উপরে বিয়ের লগ্ন ছিল, তাই এখনও লোকজন যাতায়াত চলছে।

যখন খূব একটা বড় দল একসঙ্গে আসছে এই যুবকবৃন্দ নিতান্ত নির্লিপ্তভাবে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু যেই দূরে দেখা যাচ্ছে শুধু একজন লোক এগিয়ে আসছে কোনওদিক থেকে, অমনই এদের মধ্যে সেই যার হাতে ছোরা সে পূর্ববর্ণিত বিদ্যুৎগতিতে হাতের তালুতে ছোরা বোলাতে বোলাতে সেই পথচারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সেই ভদ্রলোক, যিনি এতক্ষণ একা একা আসছিলেন, এখন হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার গাছের ছায়ায় একসঙ্গে ওই কয়েকজনকে দেখে এবং তার মধ্যে আবার একজনের হাতে শাণিত অস্ত্র— এই অবস্থায় কী রকম বোধ করলেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে বুঝিয়ে বলা কঠিন।

কিন্তু না, সত্যি মারাত্মক কিছু ঘটল না। ছোরাধারী একটি মাত্র নিরীহ প্রশ্ন করল, ‘দাদা, ক’টা বাজে?’

ভদ্রলোক আঁতকে উঠে, কোনো রকমে দম সামলিয়ে নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘এই সো-সো-সোয়া বারোটা।’

ছোরাধারী ধমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে, ‘সোয়া বারো-টারো চলবে না, মশাই, রাইট টাইম বলুন।’

ভদ্রলোক আরও ঘাবড়িয়ে গেলেন, কিছু বুঝতে পারছিলেন না তিনি। আরও আমতা আমতা করতে লাগলেন। এইবার ছোরাধারীর পিছন থেকে, যার পরনে পাজামার সঙ্গে হাওয়াই শার্ট, সম্ভবত একটু নরম চরিত্রের লোক, সামনে এগিয়ে এল, ঠান্ডা গলায় বলল, ‘দাদা, ক’টা বেজে ক’ মিনিট একটু ভাল করে দেখে বলুন।’

হতভম্ব ভদ্রলোক কিছুই না বুঝতে পেরে তবু গণৎকার জন্মসময় জানতে চাইলে যেমন নিখুঁত ভাবে বলার চেষ্টা করা হয় প্রায় সেই ভাবে বললেন, ‘বারোটা বেজে এগারো মিনিট পঞ্চাশ। সেকেন্ড।’

গাছের থেকে একটু দূরে ল্যাম্প-পোস্টের নীচে সেই যার হাতে দামি ঘড়ি, সে ঘড়ির দিকে এক নজরে তাকিয়ে রয়েছে, ভদ্রলোক সময় বলা মাত্র তাঁর দিকে তাকিয়ে ছোরাধারী উচ্চকণ্ঠে রিলে করে দিল, ‘এই জগা, বারোটা এগারো পঞ্চাশ।’ জগা অর্থাৎ দামি ঘড়িওয়ালা ঘড়ির দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, ‘ছেড়ে দে।’

এই শুনে ছোরাধারী একটু যেন রেগে গেল, চাপা কন্ঠে দাঁত ঘষে বলল, ‘ভাগুন মশায়, খুব হয়েছে।’

সত্যিই এরা তাকে ছেড়ে দিল একথা বিশ্বাস করতে পথচারী ভদ্রলোকের কষ্ট হচ্ছিল, কেন কী হল, কিছুই বুঝতে না পেরে তিনি ইতস্থত করছিলেন, এইবার ছায়ার ভিতর থেকে অন্য আরেকজন গালাগাল দিয়ে উঠল, ‘ভাগ, আর ন্যাকামি করিস নে।’

বল বাহুল্য এর পর ভদ্রলোক দর্শনীয় দৌড় দিলেন, একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে।

ইতিমধ্যে মোড়ের মাথায় দ্বিতীয় একজন পথচারীর আবির্ভাব, আবার সেই একই ছমছমে নাটক, সেই ছোরাধারী, সেই টাইম, বারোটা ষোলো সাতাশ। দূরে আলোর নীচে থেকে ঘড়ি দেখে জগার নির্দেশ এল, ‘ছেড়ে দে।’ কিছু গালাগাল দিয়ে এই ভদ্রলোককেও এরা বিদায় করে দিল। কলকাতার মধ্যরাত্রির অভিজ্ঞতার স্মৃতিমালায় আরেকটি গল্প যোগ হল।

এই ভাবে চলল তিন, চার এবং পাঁচ নম্বর কেস। কিন্তু ষষ্ঠ পথিকের ভাগ্য বোধহয় খুব খারাপ ছিল। তিনি যেই বললেন বারোটা সতেরো মিনিট দশ সেকেন্ড ছোরাধারী রিলে করার আগেই ল্যাম্পপোস্টের নীচ থেকে জগা ঘড়ি দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রেখে দে।’

সঙ্গে সঙ্গে ছোরাধারী তার ছোরাটা ভদ্রলোকের নাকের ডগায় উঁচু করে বলল, ‘সাবাস দাদা, ঘড়িটা খুলে দিন তো।’

এখন ঘটনা হয়েছিল যে ৫ম এবং ৬ষ্ঠ পথিক দু’জনেই একসঙ্গে পান চিবোতে চিবোতে বিয়েবাড়ির লাস্ট ব্যাচ সেরে ফিরছিলেন, ৫ম পথিককে এরা একটু আগেই ভাগিয়ে দিয়েছে, তিনি এখন দূরে দৌড়ে যাচ্ছেন, তাঁর ঘটনাটি ৬ষ্ঠ জনের চোখের সামনেই ঘটেছে সুতরাং ৬ষ্ঠ জন ভেবেছেন এটা কোনও হাসি তামাশা, মাতাল বা পাগলের প্রহসন। তিনি একটু ক্ষীণ প্রতিবাদ করতেই কিন্তু তাঁর হাত থেকে এরা ঘড়িটা টান দিয়ে খুলে নিল। পুরো ঘটনা কিছু বুঝতে না পেরে তিনি বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

বেশ দূরে আরেকজন শিকারকে আসতে দেখে ছোরাধারী তাকে ভাগিয়ে দিতে দিতে বলল ‘বুঝলেন দাদা রাইট টাইম, এক রাতে একশোটা ঘড়ি ছিনতাই করা যায়। কিন্তু বাজে ঘড়ি ছেনতাই করে লাভ কী? কিনতে চায় না, পাঁচ সেকেন্ড টাইম এদিক-ওদিক হলে সে ঘড়ি আমরা ছুঁই না, এত বাজে ঘড়ি বেচবো কোথায়।’ এই বলে ভদ্রলোকের ঘাড়ে একটা জোর ধাক্কা দিয়ে দশ হাত পার করে দিল, সঙ্গে একটা শেষ সান্ত্বনা বাক্য, ‘তবে আপনার ঘড়ি ফাস্ট ক্লাশ পাক্কা টাইম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *