আমি কবি হয়েছিলাম গায়ের জোরে
একান্ত কলমে এই বয়েসে আর কার কথা লিখব? এতকাল পরে তবে তার কথাই লিখি। আমার সই বাল্যসখী পদ্যরানির কথা।
শক্তি বলত পদ্য। পদ্যরানির ভালবাসা সে খুব পেয়েছিল। অত ভালবাসা তার সইল না।
আমরা, পদ্যরানির ছোটখাটো ভালবাসার লোকেরা সব সময়ে তাকে পদ্য ডাক-নামে ডাকতে সাহস পাই না, কেমন সংকোচ হয়, একটু ভয় ভয় করে। আমরা বলি কবিতা, শ্রীমতী কবিতা। আবার কখনও সম্ভ্রম করে শ্রীলা শ্রীযুক্তেশ্বরী বাক্যসুন্দরী ঠাকুরানি। কখনও বা পদ্যবেগম সাহেবা। সেই কতকাল হয়ে গেল। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। এই সজ্ঞান মর জীবনের প্রায় সব সময়টাই তার সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা।
না। শোয়া হয়নি। অতটা সাহস হয়নি। একটু দূর থেকে পদ্যরানির চরণপদ্মের ভজনা করেছি। তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল।
‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ নয়, পুণ্যশ্লোকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘অজ-আম-ইট’ নয়, সমতল ছায়াচ্ছন্ন মধ্যবঙ্গের এক গঞ্জ শহরের পাঠশালায় আমাদের শৈশব ছন্দের শুরু কর-কর, খর-খর দিয়ে। এবং সেখানেই শেষ নয় তারও পরে গর-গর, ঘর-ঘর।
এইভাবে বছর শেষে একদা রাত্রি শেষ হল। শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ পাঠ শেষ। আমি ওয়ান থেকে টুতে উঠলাম। আমার বয়েস সাকুল্যে ছয়। পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, সেই আমার পদ্যরানির সঙ্গে প্রথম দেখা।
সুন্দর নির্মল প্রভাত কাল, কাননে কুসুম কলি সকলই ফুটেছে। পদ্যরানির সঙ্গে সেই আমার প্রত্যক্ষ পরিচয়।
আভাসে-ইঙ্গিতে আর দশজনেরই মতো তার ছোঁয়া পেয়েছিলাম ঘুমপাড়ানি ছড়ায়, যখন সে ঘুমসুন্দরীর সঙ্গে দত্তপাড়া দিয়ে চলে যেত। তাকে আর পেয়েছিলাম রূপকথায়, দিদিমার মুখে সাত ভাই চম্পা জাগো রে, পারুল বোনের সঙ্গে পদ্যরানিও ভাইদের ডাকত। কে জাগে, লালকমল জাগে, নীলকমল জাগে, লালকমল আর নীলকমল জাগে, রূপকথার সেই প্রাসাদে লালকমল আর নীলকমলের পাশাপাশি পদ্যরানিও জেগে থাকত।
আমার শিশুশিক্ষা দ্বিতীয় ভাগের বছরে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগমন করলেন। সেই ছয়-সাত বৎসর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে একটি শোকগাঁথা লিখেছিলাম, এখনও স্পষ্ট মনে আছে, সেই কবিতায় বাইশে শ্রাবণের সঙ্গে দুঃখের প্লাবনের মিল দেয়া ছিল। শহরগঞ্জের অনেক পত্র-পত্রিকায় অনেক মাস্টারমশায়, বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখনও এ ধরনের কবিতা লিখে থাকেন। সুতরাং পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পরে আজ আর সেই শিশুটিকে দোষ দেয়া উচিত হবে না।
অবশ্য এই আমার প্রথম পদ্যভজনা নয়। মহাকবিদের মতো যথারীতি সন্ধ্যাসংগীত দিয়ে কাব্যচর্চা শুরু করেছিলাম, ভাবা যায়, বিশ্বাস করা যায় সেই অস্ফুট শৈশবে ‘তাই-তাই-তাই, মামার বাড়ি যাই’, নয়; এমনকী ‘আমসত্ত্ব দুধেতে ফেলি’ নয়। আমি লিখেছিলাম
এখন হয়েছে সন্ধ্যা
ফুটেছে রজনীগন্ধা
আর ফুটেছে সন্ধ্যামালতী
আমার শৈশব প্রতিভার কথা আরেকটু বলি। আমাদের আত্মীয় কুটুম্ব আসেজন বসেজন অধ্যুষিত বিশাল দোমহলা বাড়িতে অগুন্তি পুষ্যি ছিল, তার মধ্যে অনেকগুলি ছিল কুকুর ও বেড়াল। এর মধ্যে সাদা বেড়ালদের সাহেবি নাম দেওয়া হত লিঙ্গ নির্বিচারে। শুধু সাহেবি নাম নয়, এই সব বেড়ালদের সাধ্য কবিনামে ভূষিত করা হত। বিভিন্ন বেড়ালের নাম ছিল শেকসপিয়ার, মিলটন, শেলি ইত্যাদি।
বেড়ালেরা অমর নয়। আমার বাল্যকালেই এরা একে একে পরলোক গমন করে। দুয়েকটি পালিয়েও যায়। ওই বয়সেই এই বেড়ালদের উদ্দেশ্য আমি একটি মর্মস্পর্শী পদ্যরচনা করেছিলাম:
‘শেক্সপিয়ার বায়রন,
মিলটন, শেলি (ওরে) তোরা সব কোথায় চলে গেলি।’
বলা বাহুল্য, আমার শৈশবের এই কাব্যসাধনা বিষয়ে আমি ইতিপূর্বে অন্যত্র অনেক কিছু লিখেছি। সুতরাং বিষয়ান্তরে যাওয়া যাক।
পদ্যদেবীর যতই ভজনা করে থাকি কবি হওয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল না। আমি কবি হয়েছিলাম গায়ের জোরে। রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে।
আধুনিক কবিতার কায়দা-টেকনিক কিছুই জানতাম না। শৈশব কৈশোর পেরিয়ে মফস্বল থেকে এই শহর কলকাতায় এসে মাথায় ভূত চাপল কবিতা ছাপাতে হবে। দু’হাতে কবিতা লিখতে লাগলাম।
নিজের কবিতা পড়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যেতাম। সে কী কবিতা লেখার ধূম। রাতদিন বুকে বালিশ চাপা দিয়ে কাব্যরচনা করে যাচ্ছি, সম্বল অকূল উচ্ছ্বাস আর বিপুল আবেগ।
খবরের কাগজের স্টলে যে পত্রিকা দেখছি, উলটে পালটে সেই পত্রিকার ঠিকানা দেখে মনে মনে মুখস্থ করে ফেলছি। বাসায় ফিরে এসে সঙ্গে সঙ্গে একটি একটি করে খামে ঠিকানা লিখে দেদার কবিতা পাঠাচ্ছি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। কখনও নিজে হাতে দিয়ে আসছি, কখনও ডাকে পাঠাচ্ছি।
কোনও বাছ-বিচার নেই। রামকৃষ্ণ মঠের উদ্বোধন থেকে সে যুগের রসালো সিনেমা পত্রিকা সুধাংশু বক্সির রূপাঞ্জলি কিংবা প্রবেশিকা। কিছুই বাদ যায়নি।
সবই পণ্ডশ্রম ছিল। একটি অক্ষরও কোথাও ছাপার অক্ষরে বেরয়নি। মনে আছে, প্রথম যখন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হল তিনি তখন ‘দেশ’ পত্রিকার কবিতা বাছাই করেন। নীরেন্দ্রনাথ আমার নাম শুনে বলেছিলেন, ‘আপনার নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘সেটা অস্বাভাবিক নয়। গত ছয় মাসে আমার অন্তত একশোটা কবিতা আপনি অমনোনীত করেছেন।’
তখন আমি থাকি কালীঘাটে। সন্ধ্যার দিকে মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমার পরনে ডোরাকাটা লুঙ্গি আর কালো হাতকাটা গেঞ্জি। হঠাৎ সুমার্জিত ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সুবেশ এক ভদ্রলোককে দেখিয়ে এক বন্ধু বললেন, ‘মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়।’ মানে পরিচয় পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক কবি মঙ্গলাচরণ।
আমি মঙ্গলাচরণের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে দেখে একটু ভ্রু-কুঞ্চন করলেন। ওই পোশাক, তার ওপরে মারকুটে চেহারা—আমাকে দেখে তিনি বোধহয় উঠতি গুণ্ডা ভেবেছিলেন।
আমি তাঁকে দেখে বলেছিলাম, ‘আমার একটা কবিতা সামনের সংখ্যা পরিচয়ে ছাপা হবে।’ মঙ্গলাচরণ একটু চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করেছিলেন, স্বাভাবিক প্রশ্ন, ‘কী নাম যেন আপনার?’ আমি বলেছিলাম, ‘কবি তারাপদ রায়।’
সামান্য ভেবে নিয়ে মঙ্গলাচরণ তখন বলেছিলেন। ‘কই আপনার কোনও কবিতা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।’
আমি বলেছিলাম, ‘একটু দাঁড়ান, বাসা থেকে ভাল দেখে একটা কবিতা এনে দিচ্ছি।’ মঙ্গলাচরণ অবশ্য আর দাঁড়াননি, তবে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার সময়ে পিছন ফিরে ঘুরে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
পদ্যসুন্দরী বারংবার আমার দিকে তাকিয়ে আমার আচার-আচরণ দেখে মুচকি মুচকি হেসেছেন। আমার অক্ষম কলমে সেই মুচকি হাসি আমি যথাসাধ্য ছড়িয়ে দিয়েছি আমার সারা জীবনের রচনায়। তাঁকে নিয়ে আমি অনেক রঙ্গতামাশা করেছি। যখন যেমন পেরেছি তেমনভাবে তাঁর আহ্বান করেছি। এই সূত্রে এই একান্ত কলমের ইতি টানছি আমার একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি দিয়ে,
কয়েকটি শব্দের পায়ের শব্দ
ক্রমশ এগিয়ে আসছে
বুঝতে পারছি, পদ্যবেগম আসছেন।
সালাম, বেগম সাহেবা, সালাম।