7 of 8

বাসাবাড়ি

বাসাবাড়ি

বাসা এবং বাড়ি এই শব্দ দুটির মানে, সরলভাবে বলা যায় প্রায় একই। কিন্তু শব্দ দুটির ব্যবহারিক প্রয়োগজনিত অর্থ যথেষ্ট আলাদা।

বাসা শব্দটির মধ্যে একটা সাময়িক, ক্ষণিক ব্যাপার আছে, কিন্তু বাড়ি একটা ধারাবাহিক ব্যাপার। বহু ক্ষেত্রেই বাড়ি বলতে মাতৃভূমি বা জন্মস্থান বোঝায়। যেমন আমাদের বাড়ি বাংলাদেশে কিংবা ময়মনসিংহ জেলায় অথবা এলাসিন গ্রামে। বাসা শব্দের ব্যবহার অন্যরকম, কলকাতার বাসায় এখন অনেক লোক, এখানকার বাসা এবার উঠল। আবার কখনও চোরের বাসা, বাঘের বাসা। এ রকম ক্ষেত্রে চোরের বাড়ি বা বাঘের বাড়ি বললে কোনও অর্থ হবে না।

আমাদের কবির মনে একটা এতটুকু বাসার স্বপ্ন ছিল, রহিব আপনমনে ধরণীর এক কোণে, ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা। একা কবি নন সব মানুষই স্বপ্ন দেখে একটা স্বপ্ননীড়ের, সারা জীবন মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়ায়। এই বাসা খোঁজার ব্যাপারে অতি সাম্প্রতিক একটা গল্প বলি। বলা বাহুল্য, গল্পটা মোটেই আমার নিজের নয় কিন্তু সে জন্যে বলতে বাধা কোথায়?

বেশি গৌরচন্দ্রিকা করার অবকাশ নেই। মজার গল্পটা সরাসরি বলি।

অজিত ফুকন বলে একটি গুয়াহাটির ঝলমলে তরুণ একটি সর্বভারতীয় ব্যাঙ্কে স্টাফ অফিসার। সম্প্রতি কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। তাতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি একটি বিয়ে করেছেন, উমা নামে একটি পরমাসুন্দরী মেয়েকে। দুঃখের কথা মধুযামিনী শেষ হতে না হতে বদলির নির্দেশ পেয়ে তাঁকে গুয়াহাটি থেকে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছে। অজিত আপাতত টালিগঞ্জের দিকে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে বাইরের ঘরে পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকছেন, সেই সঙ্গে অফিসে যাচ্ছেন আর অবসর মতো প্রাণপণে ফ্ল্যাট খুঁজছেন। একটা ফ্ল্যাট না পেলে উমাকে নিয়ে আসা যাচ্ছে না। কত দালাল, বিজ্ঞাপন, কতরকম চেষ্টা করছেন অজিত, কিন্তু কোথাও একটা ভদ্রমতো বাসস্থান, ছোট একটা এক বা দু’ ঘরের ফ্ল্যাট জোগাড় করতে পারছেন না।

এরই মধ্যে একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে উমাকে একটা সুদীর্ঘ প্রণয়পত্র লিখে অজিত সেই চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে রবীন্দ্র সরোবরে লেকের পাশে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে বিরহ বিলাসে বিজড়িত হলেন।

একটু পরেই তাঁর ঝিমুনি এল, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ অনেক রাতে ঘুম ভেঙে অজিতবাবু দেখলেন, চারদিক শুনশান, কোথাও কেউ নেই। ঘুম ঘোরে হাতঘড়ি দেখে তিনি। দেখলেন ঘড়িতে রাত দুটো বাজে।

তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিলেন অজিত, হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল রবীন্দ্র সরোবরের সীমাবদ্ধ পুষ্করিণী সমুদ্রের মতো ফুঁসছে। বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়িয়ে পড়ছে রবীন্দ্র সরোবরের তটে।

ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও কোনও গোলমাল আছে অনুমান করে অজিতবাবু তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দেখলেন একটা বেশ মোটা কাচের রঙিন বোতল ঢেউয়ের ধাক্কায় পারে উঠে এসেছে। বোতলটার গড়ন একটু অন্য রকমের, সচরাচর এমন দেখা যায় না। কৌতূহলবশত অজিতবাবু বোতলটি কুড়িয়ে নিলেন।

বোতলটির মুখে একটি সুদৃশ্য কাচের ছিপি, বোতলের মধ্যেও যেন কী একটা আছে, নড়াচড়া করছে মনে হল। কী ভেবে অজিতবাবু ছিপিটা খুলে ফেললেন, সঙ্গে সঙ্গে বোতলের গলা দিয়ে ধোঁয়া বেরতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী একটা দৈত্যে রূপান্তরিত হল। যাকে বলে একেবারে খাঁটি আরব্য উপন্যাসের জিন। এবং এর পরে হুবহু সেই একই প্রাচীন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। দৈত্যটি আভূমি কুর্নিশ করে অজিতবাবুকে বলল, ‘হুজুর, হুকুম করুন, আপনার কী চাই। যা চাই আজ্ঞা করুন, এখনই এনে দিচ্ছি।’

ঘটনার আকস্মিকতায় অজিতবাবু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, এই আধুনিক যুগে খাস কলকাতার বুকে এ রকম একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে এরকম একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে এতো সুদূর কল্পনাতেও আসে না। ধাতস্থ হতে কিঞ্চিৎ সময় লাগল, তারপর তিনি মনে মনে ভাবলেন, দেখাই যাক না, দৈত্যটার কতখানি ক্ষমতা। আমার যা দরকার, যা হন্যে হয়ে রাতদিন খুঁজছি, একটা ছোট বাসা, ফ্ল্যাট বাড়ি দৈত্যটার কাছে চাই।

এইরকম ভেবে অজিতবাবু দৈত্যটাকে বললেন, ‘দ্যাখো আমি নতুন বিয়ে করেছি। থাকার জায়গা নেই বলে বউকে নিজের কাছে আনতে পারছি না। তুমি একটা ছোট ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে পার কলকাতার মধ্যে কোথাও।’

অজিতবাবুর প্রার্থনা শুনে সেই বিশালকায় দৈত্য কেমন যেন কুঁকড়িয়ে গেল, হাত জোড় করে বলল, ‘হুজুর মাফ করবেন। ওই একটা জিনিসই পারব না। ফ্ল্যাট জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আর ভেবে দেখুন হুজুর, আমি যদি ফ্ল্যাটই জোগাড় করতে পারতাম তাহলে কি আমি নিজে এত বড় শরীর নিয়ে এত কষ্ট করে একটা বোতলের মধ্যে থাকতাম।’

পুনশ্চ: একটি কথোপকথন:—

বাড়িওয়ালা—ঘনশ্যামবাবু, আজ দেড় বছর আপনি বাড়িভাড়া দেননি। আর নয়, আপনি আমার ঘর ছেড়ে দিন।

ঘনশ্যামবাবু—বলছেন কী মশায়? আপনার ভাড়া না মিটিয়ে বাড়ি ছেড়ে দেব? জোচ্চোর পেয়েছেন?

বাড়ির কথা কখনওই সহজে শেষ হবার নয়। বিশেষ করে আগের বাসাবাড়িতে একটা আরব্য উপন্যাসের জিন মাথা গলিয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পগুলোকে হটিয়ে দিয়েছিল। ভাল ভাল কয়েকটা গল্প লেখাই হয়নি, স্বল্প পরিসরে বাদ পড়ে গেছে।

যেমন, এই গল্পটা। এক ভদ্রলোক দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন। ভ্রমণকালে তিনি এক প্রাচীন, পরিত্যক্ত, জীর্ণ প্রাসাদ দেখতে গিয়েছেন। সঙ্গে গাইড রয়েছে, সে প্রাসাদ দেখিয়ে বুঝিয়ে বলছে, ‘এই যে প্রাসাদ দেখছেন স্যার, সাতমহলা প্রাসাদ ছিল এটা। পাঁচশো বছর ধরে এইরকম দাঁড়িয়ে আছে। খানখানান্‌ আহাম্মক জং এই প্রাসাদ বানিয়ে ছিলেন। তারপর এই পাঁচশো বছরে একটু মেরামত করা হয়নি। একটু রঙ করা হয়নি, একটা পাথর বদলানো হয়নি। কোনও কিছু টাচ করা হয়নি।’

ভদ্রলোক এতক্ষণ নিবিষ্টমনে ভগ্ন-প্রাসাদটি নিরীক্ষণ করছিলেন, অতঃপর মন্তব্য করলেন, ‘বুঝলেন গাইড-সাহেব আমাদের বাড়িওয়ালাও ঠিক এইরকম। কিছু সারায় না, মেরামত করে না, রঙ করে না। একই বাড়িওয়ালা নাকি কে জানে?’

আমরা অনেকেই ভুক্তভোগী। এ-জাতীয় বাড়িওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় আমাদের অনেকেরই আছে। তিক্ত অভিজ্ঞতাও কিছু কম নেই।

সেই যে এক বাড়িওয়ালা বলেছিলেন, ‘বাড়িতে জলের প্রচুর ব্যবস্থা আছে।’

বাড়িতে উঠে যাওয়ার কয়েকদিন পরে একদিন মাঝারি বৃষ্টিতে শোওয়ার ঘরের, বসার ঘরের, রান্নাঘরের ছাদ দিয়ে প্রথমে ঝরঝর করে, তারপর হুড়হুড় করে বৃষ্টির জল পড়তে লাগল। এরপর বাড়িওয়ালার কাছে এ ব্যাপারে নালিশ জানাতে তিনি নাকি ফেঁপে-হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘বলেছিলাম না, জলের প্রচুর ব্যবস্থা।’ এ ব্যাপারে আরও একটা পুরনো গল্প আছে, সেটা আরও নিষ্ঠুর। এইরকমই এক ভাড়াটে বাড়িতে ফাটা ছাদ দিয়ে বৃষ্টির সময় অঝোরে জল পড়ত। ভাড়াটে ভদ্রলোক বাড়ির মালিককে সেকথা জানাতে তিনি বলেছিলেন, তিনশো টাকা ভাড়ায় ছাদ দিয়ে জল পড়বে না তো লেমনেড পড়বে!

বাড়িওয়ালাদের নিন্দেমন্দ বেশি করা উচিত হবে না। তার আগে এক সরল বাড়িওয়ালার কথা বলি।

আর্ট কলেজের পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, যে-কোনও একটা বিষয় বেছে নিয়ে ছবি আঁকে, স্কেচ করে। এইরকম একদল ছেলেমেয়ে একটা রাস্তার মোড়ে একটা পুরনো দিনের থাম-লাগানো, বারান্দা-ঘেরা বাড়ির ছবি আঁকছিল। সকাল থেকে আঁকার পর্ব চলছে। বাড়ির বারান্দায় বসে বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা দেখলেন সারাদিন ধরে। দিনের শেষে যখন ছেলেমেয়েরা ক্যানভাস গুটিয়ে তুলি মুছে বাড়ির দিকে রওনা হবে, বুড়ো এসে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বাড়ির ছবি দিয়ে কী করবে বাবা তোমরা?’ ছেলেমেয়েরা জানাল, ‘আমাদের মধ্যে যার যার ছবি ভাল হবে সেগুলো আমাদের বাৎসরিক চিত্র-প্রদর্শনীতে স্থান পাবে। কত লোক দেখবে আপনার বাড়ির ছবি।’

একথা শুনে বৃদ্ধ বললেন, এ তো ভাল কথা। খুব ভাল কথা। কিন্তু বাবারা, তোমরা যদি আমার বাড়িটার ছবির গায়ে লিখে দাও যে, ‘ভাড়া দেওয়া হইবে’, তা হলে আরও ভাল হয়।’

কথায় কথায় ভাড়াবাড়ির প্রসঙ্গেই যখন রয়ে গেলাম, যে কয়েকটি প্রচলিত গল্প এ সম্পর্কে রয়েছে তার দু’-একটি মনে করা যাক।

নতুন বাড়ি ভাড়া করেছেন এক দম্পতি। বাড়িটি শহরতলিতে, ছিমছাম, চমৎকার। তবে, একটি দোষ রয়েছে, বাড়ির পাশেই রেললাইন, সেই লাইনে সারারাত ধরে ট্রেন আসে যায়।

বাড়ি দেখে ফেরার পথে স্বামী-স্ত্রী আলোচনা করছিলেন, যেমন হয় আর কী, বাড়িটার সুবিধে-অসুবিধের কথা। অনেক কথার পর স্বামী স্ত্রীকে বললেন, ‘দ্যাখো, সবই ভাল। আলো-হাওয়া, বাথরুম, রান্নাঘর বেশ চমৎকার। কিন্তু ওই একটাই অসুবিধে। সারারাত বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন যাবে আসবে। প্রথম দু’-চারদিন রাতে ভাল করে ঘুম হবে না।’

স্ত্রী বেচারিনীর কিন্তু বাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনি স্বামীর কথা শুনে বললেন, ‘তার জন্য। কী হয়েছে? প্রথম দু’-চারদিন না হয় হোটেলে থাকব।’ স্বামী ভদ্রলোক এ রকম প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত বোধ করায় স্ত্রী বললেন, ‘ইচ্ছে করলে আমরা দু’জনায় কিন্তু বড়দির বাড়িতেও থাকতে পারি, তখন দু’-চারদিন।’

আমার জানা নেই, এই দু’-চারদিনের সমস্যা এত সহজে স্বামী ভদ্রলোক সমাধান করেছিলেন কি না।

পরের গল্পটির প্রেক্ষাপট একইরকম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে আলাদা আলাদাভাসে বাড়ি দেখেছেন। অবশ্য একই বাড়ি। স্ত্রী আগে দেখে গেছেন, বিকেলে স্বামী দেখতে এসেছেন।

এর পরের ঘটনা কথাবার্তার মাধ্যমে বোঝানো সহজ। সুতরাং কথাবার্তাই হোক:

ভাবী ভাড়াটে: ফ্ল্যাটটা আমার বেশ লাগছে। সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকে আসতে চাই।

ভাবী বাড়িওয়ালা: আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার আজ দুপুরে দেখা হয়েছে?

ভাবী ভাড়াটে: কেন?

ভাবী বাড়িওয়ালা: আপনার স্ত্রী আজ দুপুরে বাড়ি দেখতে এসেছিলেন। তাঁর একদম ভাল লাগেনি। আমার বাড়ির প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে তিনি বড় যাচ্ছেতাই করলেন।

ভাবী ভাড়াটে; তাতে কী হয়েছে? আজ পঁচিশ বছর ধরে তিনি আমার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ব্যাপার যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছেন। তবুও তো আমাকে ত্যাগ করেননি। আপনি ভাববেন না। আমরা আপনার বাড়িতে আসছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *