আমাদের কলের গান
আধ মাইল নদীর ওপারে একজন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেছে। সন্ধ্যার উজনি বাতাসে সেই গানের সুর এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। একটু পরে বাদাম গাছের পরের মাঠটা পার হয়ে কাঁচি সিগারেটের মেজাজি গন্ধ আসবে। নৈশভোজন শেষে সবাই বুঝতে পারবে রাত নটা বাজল। এবার বড় তরফের ছোটবাবু ঘুমোতে যাবেন এবং সত্যি কয়েক মিনিটের মধ্যে বাইরের কাছারিঘরে দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজবে তবে কেউ যদি গোনে, দেখবে নটা নয় দশটা বাজল। যারা জানে তারা একটা বাদ দিয়ে গুনবে। ঘড়িটা একটু গোলমেলে। সব সময় একবার বেশি বাজে। শুধু বারোটার সময় তেরোবার না বেজে একবার বাজে এবং এইভাবে দিনের কাজ পুষিয়ে নেয়।
এর পরে একটু করে হ্যারিকেন লণ্ঠনের সলতেগুলো নামিয়ে নিবু-নিবু করে খাটের নীচে রেখে দরজা বন্ধ করে একে একে সবাই শুয়ে পড়বে। কাল সকাল থেকে আবার ব্যস্ততা। বর্ষা এসে যাচ্ছে, বাড়ির সামনে খালটার বাতায় বেশ উঁচু আর শক্তসমর্থ করে মাচা বেঁধে রাখতে হবে। সারা বর্ষা সেখানে বসে যাতে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা যায়। বর্ষার মধ্যে নদী থেকে কত বড় বড় চিতল বোয়াল খালের মধ্যে ঢুকে পড়বে, তার একটাকেও এ-বাড়ির বুড়ো কর্তা রেহাই দিতে রাজি নন, সারা বর্ষা বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ছাতা মাথায় সেই মৎসমঞ্চে পিতামহ অবস্থান করবেন। কিন্তু তাঁর পুত্রদের মাছের প্রতি আসক্তি তেমন নেই, তাঁরা মহাযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। জাপানিরা যদি এসে পড়ে তবে অব্যর্থ অস্ত্র হবে লঙ্কার গুঁড়ো এই থিয়োরিতে দুই পিতৃব্য সকাল সন্ধ্যা ছাদে উঠে হামানদিস্তায় লঙ্কার গুঁড়ো করে যাচ্ছেন, সুগন্ধে চতুর্দিক আমোদিত এক ক্রোশের মধ্যে কাজ-কারবার সমস্ত বন্ধ, হাঁচি আর কাশি ছাড়া কথা নেই। আরেকজন নির্বিকার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এবং উচ্চাভিলাষী; বলিভিয়া না আর্জেন্টিনা কোথায় হেমন্তকালে পাতা কুড়োনোর প্রতিযোগিতা হয়। তিনি গৃহের ও প্রতিবেশীদের জন-পনেরো শিশু জোগাড় করে কার্নিশে বসে এক ধামা শুকনো কাঁঠাল পাতা উড়িয়ে দিচ্ছেন। যে যতগুলো কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে এনে জমা দেবে সে ততগুলো নতুন গিনির মতো ঝকঝকে ছয় নম্বর জর্জের মাথার ছাপ দেওয়া বড় তামার পয়সা পাবে।
এই রকম চমৎকার পরিবেশের মধ্যে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় কী সব কমিশনের ব্যবসা ছিল তাঁর, সেই আমলে প্রতিদিন দাড়ি কামাতেন, কোট-ফুলপ্যান্ট-টাই পরে ঘুরতেন, তিনি একটা কুকুরমার্কা চোঙা গ্রামোফোন নিয়ে উপস্থিত হলেন। তারপর তিন দিন তিন রাত্রি ধরে চলল যন্ত্র বনাম প্রকৃতির লড়াই। সেই আত্মীয় চার বেলা চর্বচোষ্য খান, বাজার ঘুরে দুধের দাম ছ’ পয়সা হয়েছে বলে আর টাকায় সাতটার বেশি ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে ফিরে এসে হাত-পা ছুড়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো একা একাই রাগারাগি করেন। তারপর রাগ ঘুরিয়ে নেন আমাদের পিতামহের দিকে, যুদ্ধের বাজারে এমন জিনিস পাবেন কোথায়? হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছেন, পরে পচবেন। আর বৃদ্ধ ক্ষেপে যান নেমে আসেন তাঁর সুপরিকল্পিত অর্ধ সমাপ্ত বর্ষাকালীন মাচা থেকে (তাঁরই এক পুত্র এটার নাম দিয়েছিল নোয়ার নৌকা) নেমে এসে লম্বা টানা বারান্দায় খড়ম খটখট করতে করতে দৌড়োদৌড়ি করেন, চিৎকার করতে থাকেন, ‘লম্পট বদমায়েস কোথাকার। আমার বাড়িতে কলের গান। খুব সাহস হয়েছে তোমার, বাড়ির বউ-ঝি সব বখে যাবে, ছেলে-পিলে মানুষ হবে না। তুমি অখিল মামার নাতি তাই তোমাকে কিছু বলছি না, আর কেউ হলে সোজা পুলিশের হাতে চালান করে দিতাম।’
সেই অখিল মামার নাতি মহোদয়টি কিন্তু সত্যিই অকুতোভয়। গালাগাল রাগারাগির ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাঝেমধ্যেই যন্ত্রটির ঢাকনাটি একেকবার খুলছেন, নতুন পিন লাগাচ্ছেন, রেকর্ড পালটাচ্ছেন আর চোঙের ভিতর দিয়ে গমগমে গলায় সেই মফস্বলের বৈশাখী বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে সায়গল কিংবা পঙ্কজ মল্লিকের উদাত্ত মধুরতা। অথবা কিঞ্চিৎ আগের আঙুরবালা।
গান শুরু হতেই বাড়ির কাজকর্ম প্রায় সব বন্ধ হয়ে যেত। সে কতটা সুরের মাধুর্যে আর কতটা যন্ত্রের আকর্ষণে বলা কঠিন কিন্তু শুধু বাড়ির লোকেরাই বা কেন আশেপাশের এমন কী বাড়ির উত্তরের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার লোকেরাও কানে গানের আওয়াজ যাওয়া মাত্র ছুটে এসে ভিড় করত। শেষদিন সন্ধ্যায় জুতোর বাক্সের থেকে একটু বড় আকারের বাক্স থেকে বেরুল চোদ্দ রেকর্ডে সম্পূর্ণ নাটক ‘অহল্যা পালা’। সবাই আগেভাগে কী করে জেনে গিয়েছিল বাড়িতে আর তিল ধারণের স্থান নেই, বারান্দা উপচিয়ে উঠোন ছাড়িয়ে রান্নাঘরের পিছনে কামরাঙাতলার ডোবা পর্যন্ত শ্রোতায় ছেয়ে গেল। বড় নাতির অন্নপ্রাশনের পরে বাড়িতে আর ভিড় জমেনি, চোঙা-বাদ্যের (বৃদ্ধ গৃহকর্তা এই নামকরণ করেছিলেন যন্ত্রটির) এই রকম জনপ্রিয়তা ও মাহাত্ম্য দেখে পিতামহ এতদিনে একটু নরম হলেন।
কিন্তু নরম না হলেও বিশেষ কোনও গত্যান্তর ছিল না। এই তিনদিনের মধ্যেই পাড়া ও বেপাড়ার ছেলেরা বাড়িটির নাম দিয়ে বসেছে ‘দি চোঙা প্যালেস।’ বাড়ির ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে পুকুরঘাটে এবং খেলার মাঠে যন্ত্রটির প্রসঙ্গে আমাদের কলের গান বলা আরম্ভ করেছে। বাড়ির বউয়েরা মোটা মোটা খামে পিত্রালয়ে চিঠি লিখে সদ্যলব্ধ যন্ত্রটির গুণাগুণ এবং সুবিধা-অসুবিধা জানিয়ে দিয়েছে। এদের মধ্যে যাদের স্বামীরা কাজে অন্যত্র রয়েছে তারা তাদের প্রবাসী স্বামীদেরও বাড়ির এমন সুদিনে এই সংগীতমুখরিত গ্রীষ্মকালে তাড়াতাড়ি একবার আসার জন্য গোলাপি কাগজে অনুরোধ জানিয়েছে।
এসব কথা এতদিন পরে মনে পড়ার কথা নয়। সেদিন চিৎপুর দিয়ে যেতে যেতে একটা বাদ্যযন্ত্র সারাইয়ের দোকানে একটা চোঙাওয়ালা পুরনো কলের গান দেখে কেমন যেন কৌতূহল হল। জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি এখনও চালু আছে? দোকানদার বলল, আজ্ঞে না এটা বিক্রির জন্যে আনা হয়েছে। এই ভাঙা পুরনো জিনিস কিনবে কে? আমি প্রশ্ন করতেই দোকানদার হেসে উঠলেন, জানেন এটার দাম উঠেছে বিশ হাজার টাকা। সাহেব-মেমরা কিনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাগল!
সাহেব-মেমদের অনেক রকম পাগলামির কথা জানি কিন্তু আমাদের বাল্যস্মৃতি যে এত দামি তা জানতাম না।