7 of 8

ওয়ার্ক কালচার

ওয়ার্ক কালচার

কোনও অফিসের বড়কর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনার অফিসে কতজন লোক কাজ করে?’

প্রশ্নটা সরল প্রকৃতির, নিতান্তই সংখ্যানৈতিক। বললেই চুকে যেত, ‘আশি, একশো কী দেড়শো লোক কাজ করে।’

বড়কর্তা কিন্তু এমন সোজা উত্তর দেননি। সাধে কি আর তিনি বড়কর্তা। তিনি বলেছিলেন, ‘তা প্রায় শতকরা পঞ্চাশজন কাজ করে।’ মানে দাঁড়াল, তাঁর অফিসে যতজন লোক আছেন, তার অর্দ্ধেক কাজ করেন আর বাকি অর্ধেক কোনও কাজ করেন না।

একথা জানার পরে কেউ হয়তো বলতে পারেন, ‘এই বড়কর্তা অতি ভাগ্যবান ব্যক্তি এমন অনেক অফিস আছে যেখানে শতকরা পঁচিশজন লোকও মানে এক-চতুর্থাংশ লোক কোনও কাজ করেন না।’

অবশ্য এরও ব্যতিক্রম আছে। এমন অনেক অফিস আছে যেখানে একজনও কোনও কাজ করেন না। কিন্তু সেটা তাঁদের দোষ তা বলা যাবে না, কার্যকারণবশত সেখানে কোনও কাজ নেই। কলকাতায় প্লেগের অফিসে তিরিশ বছর কোনও কাজ ছিল না। ম্যালেরিয়া অফিস বেকার ছিল প্রায় কুড়ি বছর। কিন্তু অফিস, পদ, মাস শেষের বেতনাদি সবই ছিল, এমনকী ভাল কাজের জন্য এইসব কাজহীন অফিসে প্রমোশনও হয়েছে।

হঠাৎ বহুকাল বাদে প্লেগভীতি এবং তারপরে ম্যালেরিয়া আতঙ্ক এসে এইসব অফিসে হুলুস্থূল পড়ে গেছে। সবাই অবাক হয়ে জেনেছে, এইসব অফিস এতকাল ধরে দেশে ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, এঁরা এইসব অফিসের কর্মচারীরা এতদিন কী করতেন।

অনেক জেলায় এখনও আছে কি না জানি না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাংকি অফিসার (Monkey Officer) কিংবা ওই জাতীয় নামের একটা পদ ছিল। পদের একজন রীতিমতো গাদাবন্ধুকধারী অধিকারীও ছিলেন।

মাংকি অফিসার কোনও প্রতীকী পদার্থ নয়, সত্যিই বানরের অফিসার। না, বানরের দেখাশোনা, দেখভাল, পরিবার-পরিকল্পনা, পুনর্বাসন এসব এই অধিকারীর কাজ নয়, এই ব্যক্তি বানর সংহার অফিসার। শস্যখেতে বা জনপদে কোথাও অতিরিক্ত বানরের উৎপাত দেখা দিলে এঁর কাজ হল সেই বানরকে গুলি করে হত্যা করে বিনাশ করা। বলা বাহুল্য, কাজ করার সুযোগ এঁদের জীবনে কদাচিৎ আসে। আমি একবার এক বানর অধিকারীর দেখা পেয়েছিলাম, যাঁর গাদাবন্দুকের চওড়া নলে বোলতা বাসা বেঁধেছিল।

তাই বলে কি এই ভদ্রলোকের কোনও কাজ ছিল না। না, তা নয়। প্রত্যেক সপ্তাহে ওপরওয়ালা মারফত হেড অফিসে রিটার্ন পাঠাতে হত। আগের সপ্তাহ, আগের মাস পর্যন্ত কতগুলো বানর নিধন করা হয়েছে। এ সপ্তাহে বানরের অত্যাচারের খবর কতগুলো এসেছে। এ সপ্তাহে ঠিক কতগুলো বানর মারা গেছে কি না এবং সেক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এইরকম চতুর্দশপদী রিটার্ন।

স্বাভাবিক কারণেই ভদ্রলোক জিরো রিটার্ন পাঠাতেন, মানে সবই শূন্য, শূন্য। ভদ্রলোকের ওপরওয়ালারা চোখবুজে আরও পঞ্চাশটা সাপ্তাহিক রিটার্নের সঙ্গে সেটার নীচেও একটা সই করে দিতেন।

সেই রিটার্ন হেড অফিসে যেত। কোনওটার রিটার্ন পাঠাতে গাফিলতি হলে, কখনও কখনও মাস তিনেকের মাথায় রিমাইন্ডার আসত। কালেভদ্রে গুরুতর গাফিলতি হলে অর্থাৎ একাধিকবার রিটার্ন না গেলে হেড অফিসের বড় সাহেব ডেমি-অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে হুমকি দিতেন, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের গাফিলতি আর বরদাস্ত করা হবে না।’

দুঃখের বিষয়, কেউ কখনও খতিয়ে দেখতেন না ব্যাপারটা কী, কীসেরই বা রিটার্ন? দায়সারা গড্ডালিকাপ্রবাহ চলছে তো চলছেই।

টাক্কাভি ঋণ নামে এক প্রাগৈতিহাসিক কৃষিঋণ ছিল, বহুকাল হল সে আপদ চুকেছে। কিন্তু দশ বছর আগেও একটা অফিসে দেখেছি, সেই ঋণদানের ও আদায়ের পৌনঃপুনিক অতি জটিল মাসিক রিটার্ন অফিস ছুটির পর বড়বাবুর সঙ্গে বসে কেরানিবাবু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই রিটার্ন মেলাচ্ছেন। মেলাচ্ছেন মানে বহু পুরনো বাতিল হিসেবের সঙ্গে সাম্প্রতিক একগাদা শূন্য যোগ দিয়ে একটা বেশ বড় গোল্লা।

এই উদাহরণগুলো এই জন্যে এসে গেল যে, আসলে কাজ করাটাই সব কথা নয়, কাজটা সঠিক কাজ কি না সেটাও কাউকে দেখতে হবে। ডিসেম্বর মাসে কেউ জীবিত থাকলে সে নভেম্বর বা অক্টোবরেও জীবিত ছিল এর প্রমাণ চাওয়ার সমস্যা শুধু পেনশন অফিসেরই নয়, সব অফিসেরই অল্পবিস্তর রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থাক। এবার ওয়ার্ক কালচার বিষয়ক কয়েকটি উড়ো কাহিনী বলি।

এসব গল্প শুনে কেউ কেউ হয়তো বলবেন সম্পূর্ণ গাঁজাখুরি কথাবার্তা। আমি তাঁদের জানাতে চাই, এসব গল্প আমি রচনা করিনি, আমি শুধু নতুন পরিবেশন করছি।

প্রথম গল্পটা সত্যিই খুব পুরনো। আমি নিজের নামে এটা একাধিকবার চালিয়েছি। এবারেও তাই করি।

আগেরদিন রাত্রিতে গভীর ও দীর্ঘ আড্ডা দিয়ে অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠেছি। সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় তিরিশ বছর হবে। আমি তখন কিনু গোয়ালার গলি কবিতার সেই দুখিসুখী নায়ক হরিপদর মতো সরকারি অফিসের কনিষ্ঠ কেরানি।

সেই সময়ে আমার এক অতি বিপজ্জনক ওপরওয়ালা ছিলেন। তাঁর মতো গোলমেলে লোক বিশ্বসংসারে বিরল।

সে যাক হোক, সেদিন বেশি বেলায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে অফিস যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলাম। কিন্তু আগের রাত্রির অনিদ্রা এবং ক্লান্তির জন্যে খাওয়া-দাওয়ার পরে বিছানায় একটু শরীর এলিয়ে দিতেই চোখ বুজে এল এবং ক্রমশ ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙে উঠে দেখি বেলা প্রায় দুপুর। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে অফিস অভিমুখে রওনা হলাম। অফিসে পৌঁছে ঢোকার মুখে দেখি আমার সেই গোলমেলে ওপরওয়ালা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মুখোমুখি হতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী এত দেরি?’

আমি আর কী বলব, সত্যি কথাই বললাম, ‘স্যার, বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঠিক অফিস আসার মুখে।’

এই কথা শুনে আমার সেই ওপরওলা যৎপরোনাস্তি অবাক হয়ে গেলেন, ‘সে কী মশায়, আপনি বাড়িতেও ঘুমোন নাকি?’

ইঙ্গিতটি অবশ্যই স্পষ্ট। আমি অফিসেই যথেষ্ট ঘুমোই, আমার আবার বাড়িতে ঘুমোনোর প্রয়োজন কি?

এই কাহিনীর সূত্রে অন্য একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে।

সেও অনেকদিন আগের কথা। তখন আমি মহাকরণে একটি দপ্তরে উপসচিব। আমার এক সহকর্মী, তিনিও উপসচিব, আমার সঙ্গে একই ঘরে বসেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই জনৈক সহায়কের বিষয়ে গজগজ করতেন, আমার কাছে অনুযোগও করতেন।

ওই সহায়কটিকে আমিও হাড়েচড়ে চিনতাম। অমন অকর্মণ্য, সময় অচেতন, মিথ্যাবাদী সরকারি কর্মচারী সহজলভ্য নয়। আমার ভাগ্য ভাল, সে আমার শাখায় কাজ করত না।

আমার সহকর্মীর ভাগ্যও ভাল। কারণ এর মধ্যেই জানা গেল, ওই কর্মচারীটি অন্যত্র কাজ পেয়ে চলে যাচ্ছে। চলে যাওয়ার আগে সহায়কটি যথারীতি তার অফিসার, মানে আমার উপসচিব বন্ধুটিকে একটা ভাল ক্যারেক্টর সার্টিফিকেটের জন্যে অনুরোধ জানাল। অগত্যা রাজি না হওয়া ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না।

কিন্তু কী সার্টিফিকেট তিনি দেবেন। কাজকর্ম, উপস্থিতি, আচারব্যবহার কোনওটাই জ্ঞানত, ধৰ্মত ভাল বলা যায় না। শেষ পর্যন্ত অনেক কাটাকুটি করে মাত্র আড়াই পঙ্‌ক্তির একটা সার্টিফিকেট হয়েছিল, তার মধ্যে কাজকর্ম ইত্যাদি বিষয়ে কথা নেই। তবে ভাল বলা হয়েছে, ‘ভাল ঘুমোতে পারে।’

অবশেষে একটা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিই। সদা তৎপর হলেই ওয়ার্ক কালচার উন্নত করা যায় না।

এটা এক পোস্ট অফিসের ঘটনা। যেমন হয়, কাউন্টারে এক ভদ্রলোক কিছু বলেছেন। তার জবাবে কাউন্টারে কর্মরত কেরানিবাবু বললেন, ‘না নেই। প্রায় মাসখানেক নেই।’

এই কথা তৎপর নতুন পোস্টমাস্টার মশায়ের কানে যেতে তিনি ছুটে সেই ভদ্রলোককে বললেন, ‘না, নেই কেন? আপনি ওই নয় নম্বর কাউন্টারে যান, ওখানে পাবেন।’

মাস্টারমশাই ভেবেছিলেন বেশ কিছুদিন পোস্টকার্ডের অভাব যাচ্ছে, এই ভদ্রলোক বোধহয় পোস্টকার্ডের খোঁজ করছেন।

আসলে তিনি অন্য জায়গার লোক। পোস্টঅফিসে টিকিট কিনতে এসে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এখানে বৃষ্টি হচ্ছে কি না। তারই জবাবে কেরানিবাবুটি জানান, না, চার সপ্তাহ নেই।

সুতরাং এবার যখন মাস্টারমশায়ের কাছে জানতে পারলেন, নয় নম্বর কাউন্টারে বৃষ্টি আছে, তিনি একটু অবাক হলে কারও কিছু করার নেই।

ইংরেজি সরস সাহিত্যের গুরুদেব, অবিস্মরণীয় জেরোম কে জেরোম তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘থ্রি মেন ইন এ বোট’ বইতে লিখেছিলেন,

‘আমি কাজ ভালবাসি। কাজ আমাকে আকর্ষণ করে। আমি কাজের কাছে বসে থাকি এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি ভালবাসি কাজটাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে। কাজ ছাড়া হতে আমার হৃদয় ভেঙে যায়।’

রসিকতাটি খুবই উচ্চমানের এবং সে জন্যেই স্পষ্ট। কাজ করতে না চাওয়া লোকের পক্ষেই শুধু এ রকম যুক্তির অবতারণা করা সম্ভব। কাজ করি না কারণ কাজকে ভালবাসি আর তাই কাজ ধরে রাখি।

যে কোনও কাজ ফাঁকি দেওয়া লোক, তিনি যাই হোন না কেন, এ রকম একটি সরস যুক্তির আড়ালে অনায়াসেই আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু তা তিনি নেন না। সাধারণত কাজ পড়ে থাকার জন্যে যে কারণগুলি দেখানো হয়, তা হল,

(এক) স্ত্রীর শরীর খারাপ। স্ত্রী নাম্নী ভদ্রমহিলা এসব ব্যাপারে খুব কাজে আসেন। তিনি হয়তো জানেন না কী সব দুরারোগ্য অসুখে তিনি ভুগছেন, যার জন্যে তাঁর স্বামী অফিসের কাজ ঠিক সময়ে তুলতে পারছেন না।

(আজকাল অবশ্য অফিসের মহিলা কর্মীরা স্বামীর অসুখের সুবাদে একই পদ্ধতিতে কাজ এড়িয়ে যাচ্ছেন।)।

(দুই) রাস্তায় যানবাহনের অভাব। সেইজন্য অফিস আসতে দেরি হয়ে যায়। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরতে হয়।

(এই যুক্তিটা অবশ্য আপাতগ্রাহ্য। কিন্তু তাঁকে যদি বলা হয়, আপনি সকাল-সকাল এলে এবং দেরি করে অফিস থেকে বেরলে ভিড় এড়াতে পারেন, তিনি যা যা বলতে পারেন সেটা অকল্পনীয়।)

(তিন) ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষা চলছে। সুতরাং তাঁকে হলে ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে অফিসে আসতে হয়। এসেই বেরিয়ে যান পরীক্ষার্থীর টিফিন দিতে। দ্বিতীয় বেলার পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার পর অফিসে এসে মিনিট পনেরো থেকে আবার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাত্রা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছেলে বা মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে।

অবশ্য এসবের বিপরীতে আমি অন্য একটি গল্প জানি, সেটি খুবই মর্মান্তিক।

কোনও এক অফিসে এক দায়িত্ব সচেতন ব্যক্তি গত পনেরো বছর ধরে কাজ করছেন। কখনও অনিয়মিতভাবে অফিসে আসেননি। বিনা অনুমতিতে কামাই করেননি। ঠিকঠাক দশটার মধ্যে অফিসে এসেছেন। সারাদিন ঘাড় গুঁজে কাজ করেছেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অফিস ছুটির পরে বাড়ি রওনা হয়েছেন।

একদিন সেই ভদ্রলোক বেলা সাড়ে বারোটায় এসে অফিসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু একী চেহারা তাঁর। মাথা ফাটা, কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা। চুল উসকোখুসকো। হেঁড়া জামাকাপড় ধুলো মাখামাখি। হাত ছড়ে গিয়েছে। কোনওরকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনি এসে অফিস পৌঁছালেন।

তাঁকে দেখে ওপরওয়ালা খেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার, এত বেলায় সং সেজে কোথা থেকে এলেন?’

ভদ্রলোক কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার কোনও দোষ নেই স্যার।’

ওপরওলা আবার খেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তা হলে আমার দোষ?’

ভদ্রলোক অনুনয় করে বললেন, ‘স্যার, আমার কথাটা একবার শুনুন।’

অতঃপর ওপরওলা গম্ভীর হয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। সেই জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে থেকে চোখটা নামিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘স্যার অফিসে আসার জন্যে দৌড়ে মিনিবাসে উঠতে গেছি এমন সময় পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিল। অনেক দূরে ছিটকে গিয়ে ফুটপাথের ওপরে পড়ে গিয়েছিলাম, মাথাটা ফেটে গেল, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলাম।’

ওপরওলা এতক্ষণে অস্থির হয়ে পড়েছেন, তিনি হুমকি দিলেন, ‘কথা সংক্ষিপ্ত করুন।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘বলছি স্যার, আর একটু। রাস্তা থেকে লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানে ব্যান্ডেজ করল, ইঞ্জেকশন দিল। বুঝতেই পারছেন স্যার।’

অবশেষে ওপরওলা বললেন, ‘তাই বলে এত দেরি!’

অনেকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। কী যেন একটা চাকরির জন্যে অফিসে একটি ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছিল। খুব দুঃখজনক কাজ, যতজনের ইন্টারভিউ নেয়া হবে তার মধ্যে শতকরা দশজনও কাজ পাবে কি না বলা কঠিন। আবার যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে, তাদের অধিকাংশরই যোগ্যতা সন্দেহজনক।

এরই মধ্যে এক চাকরি প্রার্থীকে পেলাম যার আবেদনপত্রে দেখা গেল, সে লিখেছে এর আগে সে আরও তিন জায়গায় কাজ করেছে।

স্বভাবতই তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘এই যে তিন জায়গায় তুমি এর আগে কাজ করেছ লিখেছ দরখাস্তে, তা সেসব জায়গা থেকে তোমাকে কোনও সার্টিফিকেট দেয়নি?’

উত্তরে চাকরি প্রার্থী জানান, ‘হ্যাঁ, দিয়েছিল।’

তখন তাকে বলা হল, ‘দেখি সার্টিফিকেটগুলো দাও তো।’

সে এবার জানাল, সার্টিফিকেটগুলো নেই, সে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

একথা শুনে আমরা যারা সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম সবাই অবাক হয়ে গেলাম। সে কী কথা!

এরপরে সে যা বলল সে খুবই মর্মান্তিক। তার বক্তব্য হল, সেই সার্টিফিকেটগুলোয় তার সম্পর্কে যা লেখা ছিল তা দেখলে তাকে আর কেউ চাকরি দিত না।

বলাবাহুল্য, আমাদের ওখানেও তার চাকরি হয়নি।

পরিহাসের কথা থাক। এবার একটু কঠিন বাস্তবে আশা যাক।

অফিসগুলোতে অনেকেই কাজ করে না। ঠিকমতো অফিসে আসে না। ধুমধাড়াক্কা ছুটি নেয়। দরকারি কাগজপত্র, নথি ফেলে রাখে। কাজ ফেলে আড্ডা দেয়। খেলার মাঠে, সিনেমায় যায়। প্রেম করে।

মাঝে মধ্যেই খবরের কাগজে দেখা যায়, লোকমুখে আলোচনাও শোনা যায়। অমুক অফিসে একজন ডিরেক্টর বা কমিশনার এসেছেন। নাম বজ্ৰপানি চক্রবর্তী কিংবা কৃতান্ত বাগ। তিনি এসেই অফিসে হুলুস্থূল বাধিয়ে দিয়েছেন। সাংঘাতিক কড়াকড়ি শুরু করেছেন। সবাইকে নির্দিষ্ট সময়ে আসতে হবে, সিটে থাকতে হবে, টিফিনের সময় কোনও কারণেই আধঘণ্টার বেশি অফিসের বাইরে বা টেবিল ছেড়ে চলে যাওয়া যাবে না।

বেশ একটা কাজ-কাজ হইচই পড়ে যায়। কিছু পুরনো নথির ওঠানামা শুরু হয়। ধুলোময়লা, মাকড়শার জালের নীচ থেকে অনেক পুরনো কাগজ বেরিয়ে আসে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় ব্যাপারটা কেমন যেন অল্পদিন পরেই থিতিয়ে যায়। আবার ঢিলেমি, কাজে ফাঁকি শুরু হয়। সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ বড় কর্তাও ইতিমধ্যে যথা নিয়মে বদলি হয়ে যান। আবার যে কে সেই। সেই ভূতাবস্থা।

আসলে কোনও একক অফিসে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু করা যায় না। দু’-চার দিন বিধি নিয়ম প্রয়োগ করে ভয় দেখিয়ে কিছুটা কাজ হয়তো হয়, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না।

কোথাও কোনও অফিসে ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। তার মধ্যে একটি অফিস যথাযথ চলবে এ রকম হতে পারে না।

ওয়ার্ক কালচার অনেক বড় ব্যাপার। যে কাজ করবে তার যদি কাজ করার মনোভাব না থাকে, সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধ না থাকে, তা হলে ভয় দেখিয়ে, জোর করে কাজ করানো কঠিন।

কলু তার ঘানির বলদের গলায় ঘন্টা বেঁধে দেয়, যাতে তার অসাক্ষাতে বলদ যদি ঘানিতে পাক না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে, ঘণ্টা বাজা থেমে যেতেই সে বুঝতে পারবে। এক পণ্ডিতমশায় এই দেখে কলুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কিন্তু তোমার বলদ যদি ঘানিতে পাক না নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গলা দুলিয়ে ঘণ্টা নাড়ে, তা হলে তুমি তো বুঝতে পারবে না যে সে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে।’

এ কথা শুনে কলু রেগে গিয়ে পণ্ডিতমশায়কে বলেছিল, ‘আমার বলদের অত বুদ্ধি নেই। সে তো আর আপনার পাঠশালায় পড়েনি।’

ওয়ার্ক কালচারের সমস্যা যাদের নিয়ে তারা সবাই কিন্তু ওই পণ্ডিতমশায়ের পাঠশালার ছাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *