প্রজাপতয়ে
এক সরলমতি যুবককে বিয়ের আগে তার প্রেমিকা বুঝিয়েছিল যে সে গান জানে না বটে তবে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। বিয়ের পরে সেই যুবক আবিষ্কার করে যে তার প্রাক্তন প্রেমিকা। মানে বর্তমান স্ত্রী যেসব বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে সেগুলি হল, রেডিও, গ্রামোফোন, রেকর্ড প্লেয়ার ইত্যাদি। এই প্রবঞ্চিত যুবকটি এর পর কতটা আহত এবং ব্যথিত হয়েছিল, সেই পরিণয় সুখের হয়েছিল কিনা সে তথ্য আমার জানা নেই।
বিয়ের ব্যাপারে লোকেরা বড় উলটোপালটা প্রত্যাশা করে। ছেলেরা যেমন, মেয়েরাও তেমনি। যে কোনও রবিবারের খবরের কাগজে পাত্রপাত্রীর কলম দেখলেই দেখা যাবে শব্দ ও পঙ্ক্তির মধ্যে ফাঁকগুলি অলীক দুরাশায় ভরা। এগুলি শুধুই যে পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকের রচনা তা নয়, পাত্রপাত্রীর মৌন বা স্পষ্ট দাবি অনুসরণ করেই এই সব বিজ্ঞাপন।
শুধু বিজ্ঞাপন বা সম্বন্ধ করে বিয়েতে নয়, ভালবাসার বা পছন্দের বিয়েতে, যাকে এককালে লভ ম্যারেজ বলা হত, তাতেও এ সমস্যা কম নয়। সোনা গয়না, আসবাবপত্র, প্রণামী, ননদ পুঁটলি, তত্ত্ব ইত্যাদির কথায় আসছি না, আইন-আদালতের বধূনির্যাতন কলমে যে কেউ তার বিশদ বিবরণ পাবেন। বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে কিছু বলার নেই, তবু বিবাহের মতো মধূর বিষয়কে বিষণ্ণ করার চেয়ে একটু অন্য কথায় যাই।
শিবরাম চক্রবর্তী একবার তাঁর বিখ্যাত ‘অল্পবিস্তর’ কলমে একটি কাল্পনিক বিয়ের বিজ্ঞাপনের অংশবিশেষ ছেপেছিলেন। হুবহু মনে পড়ছে না, কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের অনেকটা এই রকম, ‘পাত্রীর বাড়ি থাকা প্রয়োজন, বাড়ির ফটো সহ আবেদন করুন।’
বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, সোনা-দানা মোটামুটি দাবির বহর হয়তো কোনও ক্ষেত্রে ভালভাবেই অনুমান করা যায়। আসল বিপদ রক্তমাংসের মানুষ বা মানুষী, আসল যে পাত্রপাত্রী তাদের নিয়ে। সে সম্পর্কে অর্থাৎ ভাবী স্ত্রী বা ভাবী স্বামী সম্পর্কে বহু বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতীও ভুল কল্পনায় ডুবে থাকে।
পরশুরামের দাঁড়কাগ গল্পে কাঞ্চন মজুমদার বলেছিল, ‘বিয়ের জন্য আমি সত্যিই চেষ্টা করছি। কিন্তু যাকে তাকে ত চিরকালের সঙ্গিনী করতে পারি না। হঠাৎ প্রেমে পড়ার লোক আমি নই, আমার একটা আদর্শ, একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড আছে। রূপ অবশ্যই চাই, কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধি কালচারও বাদ দিতে পারি না। … মনের মতন স্ত্রী আবিষ্কার কি সোজা কথা’?
কেবল স্ত্রী আবিষ্কার নয় স্বামী আবিষ্কার করাও যথেষ্ট কঠিন। এক বিদেশি গল্পের নায়িকা বলেছিল, ‘আমি যাকে বিয়ে করব সে হবে সুন্দর, মার্জিত, ঝকঝকে, আধুনিক। সে নাচতে পারবে, গাইতে পারবে। সব সময়ে ঘরে থাকবে, অসময়ে চা চাইবে না, মেঝেতে সিগারেটের ছাই ফেলে নোংরা করবে না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে আড্ডা বসাবে না’। এই কথা শুনে তার প্রেমিকেরা সবাই এই প্রত্যাশা পূরণ করার ক্ষমতা তাদের নেই জেনে চলে গিয়েছিল। শুধ শেষ প্রেমিকটি যাওয়ার সময়ে বলে যায়, ‘হে সুন্দরী, তুমি তোমার মতো একলাই থাক। আসলে তুমি কোনও স্বামী চাইছ না, চাইছ একটা চেলিভিশন সেট। সুন্দর, ঝকঝকে। নাচতে পারে, গাইতে পারে, সব সময় ঘরে থাকে। তুমি যা যা চাও ঠিক তাই।’
অনেকে আবার এত চায়ও না, এমনি এমনিই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। এক সুরাসক্ত যুবক এবং এক সুন্দরী রমণীকে আমি বহু বছর আগে চিনতাম। অনেককাল ধরে তারা পরস্পর প্রণয়াসক্ত ছিল কিংবা বলা উচিত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেছিল, কিন্তু তাদের বিয়ে আর হয় না। মধ্যে অনেকদিন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, কোনও খবরও রাখি না। হঠাৎ একদিন বিয়ের চিঠি এসে হাজির। বিয়ের বাসরে গিয়ে নবদম্পতিকে বললাম, ‘বিয়ের আগে এতকাল প্রেম করা যায় জানতাম না। প্রাক বিবাহ প্রেমের দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে তোমরা রেকর্ড রচনা করছে। গিনেস রেকর্ড। বইতে ঠিকমতো গুছিয়ে লিখে পাঠাতে পারলে ছাপা হবে।’ পাত্রীর নাম সুরমা। সুরমার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হেসে পাত্র বলল, ‘বুঝলেন তারাপদদা, ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। আমার যখন মদ খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে, যখনই নেশা করি, সুরমা আর আমাকে বিয়ে করতে চায় না।’
সুরমা মেয়েটি বুদ্ধিমতী। পরের অংশটুকু সে নিজেই বলল, ‘আর নেশা কেটে গেলে ও আর আমাকে বিয়ে করতে চায় না।’ ব্যাপারটা মারাত্মক—পাত্র নেশা করলে পাত্রী তাকে চায় না আবার নেশা কেটে গেলে পাত্র-পাত্রীকে চায় না। রীতিমতো চৈনিক ধাঁধা, আঠারো বছর লেগেছে এ ক্ষেত্রে সমাধান হতে।
এর চেয়ে অনেক সহজ সমাধানের নীচের দূরভাষ কথোপকথন।
কুমারী মালতীলতার শয়নকক্ষ, রাত বারোটা, সহসা ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোন বেজে উঠল। নিদ্রাজড়িত চোখ কচলিয়ে মালতীলতা টেলিফোন ধরলেন।
মালতীলতা : হ্যালো। হ্যালো।
পুরুষকণ্ঠ : কে, মালতীলতা?
মালতীলতা : হ্যাঁ, আমি মালতী বলছি।
পুরুষকণ্ঠ : মালতী, মালতী, মালতীলতা, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
মালতীলতা : (একটু থেমে) কেন করব না?
পুরুষ কণ্ঠ : সত্যি, কথা দিচ্ছ? বিয়ে করবে?
মালতীলতা : হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। বিয়ে করব।
আচ্ছা তুমি কে কথা বলছ?
এই গল্পের নায়িকা মালতীলতা বিয়ে করতে রাজি আছে, কাকে বিয়ে করবে তা নিয়ে মাথাব্যথা কম। ঠিক এরই একটি বিপরীত ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। আমার আগের পাড়ার এক প্রতিবেশী, রমণীবৎসল জনৈক যুবক মাস দেড়েকের জন্যে কলকাতার বাইরে যান। ফিরে এসে আমাদের পুরানো বাড়ির বাইরের ঘর থেকে তাঁর এক বান্ধবীকে ফোন করছিলেন। আমি সামনের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছি। টেলিফোনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ভদ্রলোকের চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি কথা সাঙ্গ করে টেলিফোন নামিয়ে রেখে বললেন, ‘সর্বনাশ’। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কৌতূহল না দেখানোই ভাল, তবু সর্বনাশটা যখন আমার সামনেই উচ্চারিত হল, আমি সমবেদনা দেখাতে বললাম, ‘কী হল? সর্বনাশ কেন?’ যুবকটি কপাল চাপড়ে বলল, ‘আর সর্বনাশ! আমার বান্ধবীটি বিয়ে করবে ঠিক করেছে। আমি এই ছয় সপ্তাহ ছিলাম না। এরই মধ্যে এ রকম হয়ে গেল। আজকালকার দিনে কাউকে আর বিশ্বাস করা যায় না।’ ভদ্রলোক রীতিমতো হা-হুতাশ শুরু করে দিলেন। আমি শান্ত করার জন্য বললাম, ‘এতে মন খারাপ করবেন না। আপনার তো পরিচিত অনেক মেয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে কাউকে মনস্থ করে বিয়ে করে ফেলুন।’ আমার কথা শুনে ভদ্রলোক প্রমাদ গুনলেন, ‘অন্য কাউকে তো আমি আর বিয়ে করতে পারব না।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সে কী?’ যুবকটি বিপদগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আরে যার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম, ওই বান্ধবীটিই তো আমাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে ফেলেছে।’
পুনশ্চ: একবার আদালতে দেখেছিলাম উকিলবাবু এক বেয়াড়া সাক্ষীকে জেরা করছেন, ‘আপনি বিবাহিত?’ সাক্ষী জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’ উকিলবাবুর আবার প্রশ্ন, ‘আপনি কাকে বিয়ে করেছেন?’ সাক্ষীর উত্তর, ‘একজন মহিলাকে।’ বিরক্ত উকিলবাবুর ফের প্রশ্ন, ‘মহিলা ছাড়া আর কারও সঙ্গে বিয়ে হয়?’ সাক্ষীর উত্তর, ‘হ্যাঁ, হয়।’ উকিলবাবু উত্তেজিত, ‘মানে? সাক্ষীর সরাসরি জবাব, ‘আমার বোনই এমন একজনকে বিয়ে করেছেন যে মহিলা নয়, পুরুষ মানুষ।’