টাকাপয়সা
সবাই তো জানেন সেই পুরনো ধাঁধাটা, ‘পৃথিবীটা কার বশ?’
এর উত্তর ওই ধাঁধা প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উত্তরটা হল পৃথিবী টাকার বশ। ব্যাপারটা বোধগম্য হবে যদি এর প্রতিবেশী ধাঁধাটিকে স্মরণ্ করি। সূর্যমুখীর বাপের বাড়ি কোন্নগর?’ যার সরাসরি সাদা উত্তর হল, ‘কোন্ননগর।’
পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা।’ উনিশ শতকের সেই মহাপুরুষ যা বলতেন তাই আপ্তবাক্য। সব ফলেছে। সব সত্য হয়েছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাশে এক বিঘে জমির দাম ছিল তখন আশি টাকা। এখন সেই জমির দাম আশি লক্ষ টাকা।
পৃথিবীর সব ভাষাতেই টাকাপয়সা নিয়ে শ্লোকের, প্রবাদ বাক্যের ছড়াছড়ি।
অর্থই অনর্থ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনও শেষ নেই। পাতার পর পাতা ভরে যাবে সব লিখতে।
বরং দুয়েকটি মূল্যবান মহাজন বাক্য স্মরণ করি টাকা নিয়ে।
এক মহাপুরুষ বলেছিলেন যে যখন তুমি বুঝতে পারবে টাকা গাছে ফলে না তুমি দেখবে যে তুমি গাছের ডালে উঠে বসে আছ, আর নেমে আসার সুযোগ নেই।
একটা খুবই দামি কথা বলেছিলেন আঠারো শতকের মার্কিন দার্শনিক বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন। কথাটা হল, ‘যে মনে করে যে টাকা দিয়ে সব কিছু করানো যায়, আর কেউ না হোক সে টাকার জন্য সব কিছু করতে পারে।’
অনেকদিন আগে একবার এক অর্থনীতিবিদের বক্তৃতায় একটা অতি প্যাঁচালো কথা শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি টাকাই সব নয়। টাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের অভাব নেই এই পৃথিবীতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেগুলো পাওয়ার জন্য টাকা লাগে।’
যতদূর মনে আছে, এই খ্যাতনামা ইংরেজ অধ্যাপক সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘এই জগতের অর্ধেক পাপকার্যের মূলে রয়েছে অর্থের লালসা।’ তারপর একটু থেমে থেকে যোগ করেছিলেন, ‘বাকি অর্ধেক পাপকার্যের মূলে রয়েছে অর্থের অভাব।’
অধ্যাপক মহোদয়দের কচকচির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি গল্পের মধ্যে চলে যাওয়া বোধহয় ভাল হবে।
আমার নিজের একটা ব্যক্তিগত দুঃখের গল্প বলি। গল্পটা আমার পক্ষে অপমানজনক, তবু অনেক কাল আগের কথা বলে এখন আর বলতে দ্বিধা নেই।
সেই আমার কপর্দকহীন, ছেঁড়াতালি চপ্পল, ময়লা জামা, প্রথম যৌবন। দৈনিক হলুদ প্যাকেটের কড়া তামাকের পাঁচ প্যাকেট মানে পঞ্চাশটা সিগারেট খাই। নয়া পয়সার নয়া যুগ। পাঁচ প্যাকেটের পাইকারি দাম পঞ্চাশ নয়া পয়সা। একেকটা একপয়সা। এর কিছু ওপরে ছিল দশ নম্বর সিগারেট, খাঁটি টিনের কৌটোয় এক কৌটো পঞ্চাশটা নরম সিগারেট, এক টাকা দাম।
হাতে পয়সা কম থাকলে বা বেশি থাকলে, যখন যেমন, ওই পঞ্চাশ পয়সার কিংবা এক টাকার পঞ্চাশটা সিগারেট কিনতাম। সিগারেটের দোকানটা ছিল আমাদের বাড়ির রাস্তার মোড়ে, একটা ব্যাঙ্কের পাশে।
একদিন হাতে একদম টাকা ছিল না। সেই সিগারেটের দোকানে গিয়ে পঞ্চাশ পয়সার পাঁচ প্যাকেট সিগারেট ধার চেয়েছিলাম। ব্যাঙ্কের সাইনবোর্ডের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সেই পানওয়ালা বলেছিল, ‘ধার দিতে পারব না, ব্যাঙ্কের বারণ আছে।’
আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, এর মধ্যে ব্যাঙ্কের বারণ করার কী আছে? দোকানদার জানাল, ‘ব্যাঙ্কের সঙ্গে চুক্তি আছে।’
আমি আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাঙ্কের সঙ্গে তোমার আবার কী চুক্তি?’ দোকানদার বলল, খুবই সোজা চুক্তি, ‘আমি ধারের কারবার করব না। ব্যাঙ্কও পান সিগারেটের কারবার করবে না।’
পুনশ্চ:
টাকা পয়সার ব্যাপারে নিজের একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা বলি।
শহরতলিতে একটা বাড়ি ছিল আমাদের। বাড়ির পাশে এক চিলতে জমি। তখন খুব টানাটানি যাচ্ছে। ঠিক করলাম এখানে তরকারির চাষ করব। তাতে সংসারের কিছু সাশ্রয় হবে।
যেমন ভাবা তেমনই কাজ। প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা কোদাল চেয়ে এক শুভ প্রভাতে বাগান কোপানোর কাজে লেগে গেলাম। তখন বয়েস কম ছিল। মোটামুটি কায়িক পরিশ্রম করতে পারতাম।
অনেকটা জমি ভাল করে কোপানোর পরে দেখি কোপানো মাটির ওপরে আমার পায়ের কাছে একটা সিকি পড়ে রয়েছে। সিকিটা কুড়িয়ে নিয়ে জামার পকেটে রাখলাম।
একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার কোপানো শুরু করলাম। আরেকটু কোপাতেই দেখি পায়ের কাছে একটা আধুলি পড়ে রয়েছে।
মাটি কোপাতে কোপাতে চটপট পয়সা পেয়ে যাচ্ছি, খুশি মনে আধুলিটাও তুলে নিয়ে পকেটে রাখলাম। তারপর আবার একটা সিকি পেলাম। আবার একটা আধুলি। কিছুক্ষণ পরে আমার মনে একটু খটকা লাগল। এই পোড়ো জমিতে এত খুচরো পয়সা আসছে কোথা থেকে? তা ছাড়া পকেটে এত পয়সা রাখছি পকেট যে ভারী হচ্ছে না।
একটু পরেই আবিষ্কার করলাম যে আমার জামার পকেটটা ফুটো। সেই ফুটো গলিয়ে পয়সাগুলো পড়ে যাচ্ছে। আর আমি কুড়িয়ে যাচ্ছি। কুড়িয়ে পকেটে রাখছি, আবার পড়ে যাচ্ছে। আবার কুড়োচ্ছি।