7 of 8

যাহা পাই, তাহা চাই না

যাহা পাই, তাহা চাই না

সৈকত আর মধুময় একসঙ্গে একই স্কুলে পড়াশুনা করত। দু’জনের মধ্যে যেমন ভাব ছিল, তেমন ঝগড়াঝাঁটিও ছিল। তবে উঁচু ক্লাসে উঠতে দেখা গেল সৈকত মধুময়ের চেয়ে অনেক ভাল ছাত্র। সৈকত তরতর করে উঁচু ক্লাসে উঠে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভালভাবে স্কুল পেরিয়ে গেল। মধুময় কিন্তু সেই স্কুলের গণ্ডিতেই আটকিয়ে রইল।

তদবধি মধুময়ের বাড়ির লোকেরা বিশেষ করে মধুময়ের বাবা শ্যামময় সৈকতকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। তাঁর স্থির ধারণা সৈকত মধুময়ের চেয়ে অনেক মাঠো, সে কোনও চালাকি করে পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে।

এদিকে সৈকত কিন্তু অত্যন্ত ভালভাবে বি এ, এম এ পাশ করে গেল। মধুময় বহু কষ্টে তৃতীয় কি চতুর্থ বারে মাধ্যমিক তৃতীয় শ্রেণীতে পাশ করে আর পড়াশুনো করলে না। করার কথাও নয়। আর কী পড়াশোনা করবে, সে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল।

সৈকত চাকরির চেষ্টা করছে দুয়েকটা পরীক্ষা-টরিক্ষা, ইন্টারভিউ ইত্যাদি দিয়ে সে একটা চাকরি পেয়েও গেল।

একথা মধুময়দের বাসায় পৌঁছতে শ্যামময় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, বললেন, ‘এ আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করব না। ওই গাধা ছেলে সৈকত ও আবার কী চাকরি পাবে?’ তারপর একটু চুপ করে থেকে গজরাতে গজরাতে বললেন, ‘দেখিস, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার-ফেটার আসবে না।’

সত্যিই কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যে কুরিয়রের পিয়ন এসে নিয়োগপত্র দিয়ে গেল। সে খবর শ্যামময়ের কাছে পৌছতে তিনি বললেন, ‘ওসব ভুয়ো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। ওটা নিয়ে বোকা চাকরিতে জয়েন করতে যাবে আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেবে।’

বলাবাহুল্য, সে রকম কিছু কিন্তু হল না। সৈকত চাকরিতে যোগদান করে বহাল তবিয়তে বাস করতে লাগল। এমনকী একদিন মধুময় নিজেও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে তার অফিসে গিয়ে কাজের জায়গা দেখে এল।

এ খবর মধুময় এসে তার বাপকে বলতে তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তারপর শ্যামময় ভবিষ্যৎবাণী করলেন, ‘ওসব বিনি মাইনের কাজ, দেখিস মাইনে-টাইনে পাবে না।’

পরের মাসের পয়লা তারিখে কিন্তু সৈকত অফিসের অন্যদের মতোই মাইনে পেল। মাইনে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা যখন সৈকত বাসায় এল তখন তাদের বাসায় মধুময়ও রয়েছে। মধুময় সরল প্রকৃতির লোক, তাকে আগের দিন সৈকত বলেছিল, কাল সন্ধেবেলা আসিস। কাল মাইনে পাব, দু’জনে মিলে সন্ধ্যাবেলা আমিনিয়ায় গিয়ে পরটা আর মটন রেজালা খাব।’

সন্ধ্যার বেশ পরে পুরনো সুহৃদের পয়সায় মটন রেজালা খেয়ে খড়কে দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে মধুময় বাড়ি ফিরল। শ্যামময় তখন বাইরের ঘরে বসে রয়েছেন। বাপকে দেখে মধুময় বলল, ‘সৈকত কিন্তু আজ মাইনে পেয়েছে।’

শ্যামময় দাঁত খিঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি জানলে কী করে?’

আমিনিয়ায় খাওয়ার কথা না বলে মধুময় বলল, ‘আমি দেখেছি। ও যখন বাড়ি ফিরে মাইনের টাকা ওর মাকে দেয় আমি সেখানে ছিলাম। দেখলাম অনেকগুলো টাকা, তার মধ্যে অন্তত চার-পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট।’

‘পাঁচশো টাকার নোট?’ শ্যামময় এবার যেন আশ্বস্ত হলেন, ‘ওসব জালি, দু’নম্বরি নোট। কাগজে দেখিসনি, পাঁচশো টাকার নোট সব জাল। ওসব নোট ভাঙাতে গেলেই তোমার বোকা বন্ধুটি পুলিশের হাতে পড়বে। জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে, তা কম করেও অন্তত পাঁচ বছর।’

পাঠক, শ্যামময়বাবুকে আপনি ভালই চেনেন। তিনি আপনার পাশের বাড়িতে থাকেন। হয়তো আপনার অফিসেই কাজ করেন। কখন কখন আয়নার মধ্যেও তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে যায়, তখন অবশ্য চিনতে পারেন না।

অতঃপর এই নিবন্ধের দীর্ঘ নামকরণটি একটু খেয়াল করুন।

‘শুনেছি সোনার গাঁ, গিয়ে দেখি শুধুই মাটি’, এই অমূল্য পঙ্‌ক্তিটি আমার রচনা নয়, এটি ঢাকা-ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি প্রাচীন প্রবাদ।

সোনার গাঁ ছিল দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম ঈশা খাঁর রাজধানী, পরবর্তীকালের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্গত। এই নামে অবশ্য আধুনিক ঢাকা শহরে একটি পাঁচতারার হোটেল হয়েছে।

সে যা হোক, আমাদের এই প্রবাদ বাক্যটির অর্থ পরিষ্কার। সোনার গ্রাম শুনে এসেছিলাম, এসে দেখছি সোনা নয় মাটি।

বাঙালির চিরকালীন খুঁত ধরা স্বভাবের সঙ্গে এই প্রবচনটি চমৎকার মানিয়ে গেছে।

সম্প্রতি ইডেন উদ্যানে বিশ্বকাপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পরে এই প্রবচনটি মনে পড়ল। তবে সেই ছোটবেলায় শুনেছিলাম এখনও দেখছি ভুলিনি।

ইডেন উদ্যানে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমরা কী কী আশা করেছিলাম?

(এক) সর্বাপেক্ষা প্রচারধন্যা খ্যাতনাম্নী বঙ্গ দুহিতা শ্রীমতী সুস্মিতা সেন আকাশ থেকে স্বর্গের অপ্সরার মতো আসরে নেমে আসবে হেলিকপ্টারের দড়ির মই বেয়ে।

অতি অবাস্তব বাসনা। সুস্মিতা সেন কেন মুম্বাইয়ের কোনও এক নম্বর মহিলা ডামিও একাজ করতে সাহস পাবে না।

তা ছাড়া অঘটন যদি কিছু ঘটত? সুস্মিতা যদি পড়ে যেতেন। তাঁকে চিকিৎসা করা হত। প্রাণে বেঁচে থাকলে খঞ্জ ও পঙ্গু, থ্যাঁতা ঠোঁট, ফাটা নাক বিশ্বসুন্দরীকে নিয়ে বিশাল ঝামেলা ছিল। সুস্মিতা সেন যে সাহস করেননি তার কারণ তিনি বুদ্ধিমতী।

(দুই) অ্যালিসা চিনয় চারদিকে ঘুরে ঘুরে গাইবেন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া, মেড ইন ইন্ডিয়া।’

না। তিনি আসেননি। সম্ভবত তাঁর আসার কথা ছিল না। তবে ঘুরে ফিরে অ্যালিসা চিনয়ের ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ বেজেছে, যে গান রাস্তার মোড়ে পুজো মণ্ডপে, পানের দোকানে গত মরশুমে বেজে বেজে আমাদের কানের পোকা বার করে দিয়েছে।

(তৃতীয়) আনন্দ শঙ্করের আত্মত্যাগ। উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্করের ছেলে, রবিশঙ্করের ভাইপো এমনকী শ্ৰীমতী মমতাশঙ্করের দাদা যার রক্তে শোম্যানশিপ রয়েছে, সে এমনভাবে নিজেকে জবাই হতে দিল।

এবং শুধু নিজে একা নয়, সস্ত্রীক।

(চার) সৈয়দ জাফরির অতুল কীর্তি। এ সম্পর্কে এই নিবন্ধের শেষে কিছু বলেছি। এখানে সংক্ষেপে বলি, যে ভদ্রলোক অ্যামনেশিয়ায় ভুগছেন, যিনি পানপরাগ নামক সুপুরি মশলার বিজ্ঞাপনে মুখোজ্জ্বল করে দেখা দেন, যাঁর নত্ব-ষত্ব জ্ঞান নেই, তিনি কেন এখানে।

এ কাজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেক ভাল করতে পারতেন। অন্যথায় অপর্ণা সেন। সেটা এই শহরের পক্ষে অনেক বেশি মানানসই, সম্মানজনক হত। এ রকম কেলেঙ্কারিও হত না।

(পাঁচ) চন্দননগর বনাম ইতালি।

এর মধ্যেই ভুলে গেলাম। কী নাম যেন সেই রোম্যানের। ‘লুঠে-নে-দাদা’ কিংবা এইরকম, বিলিতি নাম আবার আমার মনে থাকে না।

ডালমিয়া সাহেব দেশে বা বিদেশে ইংরেজি ইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। বাংলা ইস্কুলে লেখাপড়া করলে তাঁকে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি পড়তে হত, যার আরম্ভই হয়েছিল।

‘বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস’… দিয়ে।

বাংলা ইস্কুলে পড়লে সবসময়ে যে ক্ষতি হয় তা নয়। অন্তত এ ক্ষেত্রে ডালমিয়া সাহেবের উপকার হত, তাঁর জানা থাকত মাঘ মাসে শীতের বাতাস বয়।

‘ফ্রান্সের বাজি’র অবশ্য নিন্দা করা যাচ্ছে না। তবে দু’জনে বলাবলি করছে হাওড়া বালির বুড়িমার বাজির কারখানা উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আগের দুই সপ্তাহ নাকি ওভারটাইম কাজ করেছে।

আর নিন্দা-মন্দ বাড়িয়ে লাভ নেই। থাকলে সেই সোনার গাঁয়ের ব্যাপার।

প্রত্যাশা ছিল সোনার, এসে দেখলাম মাটি। একেবারে প্রকৃত অর্থে মাটি, অনুষ্ঠানটাই মাটি করে গেল।

তবে এ রকম ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়। কলকাতায় এ জাতীয় কেলেঙ্কারি আগেও হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এবং আমরা প্রত্যেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করব কোথায় কী ত্রুটি, কার কতটুকু দোষ। আমাদের মনে হবে আগেকার দিনে এ রকম কিছু হত না।

তখন সবই ঠিকঠাক হত। যা দোষত্রুটি সবই এখনকার সময়ের। এই সূত্রে গল্পটা বলি।

সেদিন এক পার্কের বেঞ্চিতে বসে দুই পরস্পর পরিচিত বৃদ্ধের মধ্যে কথাবার্তা শুনছিলাম।

প্রথম বৃদ্ধ দ্বিতীয় বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খগেনদা, আপনি নরকে বিশ্বাস করেন?’

খগেন নামধারী সেই দ্বিতীয় বৃদ্ধ বললেন, ‘দ্যাখো নগেন, বয়েস বেড়েছে, বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে তুমি আমাকে ওই নরক-ফরক বুজরুকিতে বিশ্বাস করতে বোলো না।’

নগেন বললেন, ‘তা হলে আমাদের অল্প বয়েসে যেসব ভাল জিনিস ছিল, সেসব গেল কোথায়?’

খগেনবাবু একথা শুনে বললেন, ‘খগেন মনে হচ্ছে তোমার কথাটা খুব ফেলনা নয়। সবই তো দেখছি জাহান্নামে গেছে। জাহান্নাম না থাকলে গেল কী করে।’

এর পরে দুই বুড়ো বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছুর নিন্দায় মুখর হলেন। তার মধ্যে ইডেনের অনুষ্ঠান যেমন আছে, তেমনিই হাওয়ার মামলা।

সব সময়ে যে আমরা সবকিছুর নিন্দায় মুখর হই, তা কিন্তু নয়। নিঃশব্দ নিন্দাও আছে, সে খুবই উচ্চবর্ণের আর্ট।

আমার এক খুল্লমাতামহের কাহিনী মনে আছে। তিনি একটি বিলিত সওদাগরি অফিসে কাজ করতেন, সেই অফিসের কাজ শুরু হত সকাল নটায়। তিনিই বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে আগে খেয়ে অফিসে বেরতেন। নিঃশব্দে খেয়ে যেতেন, কোনওদিন রান্না-বান্না নিয়ে কাউকে কিছু বলতেন না।

একদিন তিনি খেয়ে অফিস চলে গেছেন। তারপর অন্যেরা খেতে বসেছে। তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিয়ে একজন বলল, ‘কাকিমা, তরকারিতে নুন দাওনি?’

কাকিমা মানে আমার খুল্লমাতামহী অন্য একজন ভোজনকারীকে দিয়ে যাচাই করে নিলেন এবং তারপর নিশ্চিত হলেন যে সত্যিই ব্যঞ্জনে নুন দেওয়া হয়নি। তারপর স্বগতোক্তি করলেন, ‘শয়তান।’

এই স্বগতোক্তিটি তাঁর স্বামীর সম্পর্কে, যিনি একটু আগে নিঃশব্দে ওই নুন ছাড়া তরকারি অম্লানমুখে খেয়ে গেছেন এবং একবারও নুন না হওয়ার ব্যাপারটা জানান দেননি।

এ ধরনের নীরব সমালোচনা করার যোগ্য প্রতিভা থাকা প্রয়োজন। আমাদের সকলের সেটা নেই বলেই আমরা চেঁচামেচি করে গলা ফাটাই, তিক্ত সমালোচনা করি।

নীরব সমালোচনার পরে নিরপেক্ষ সমালোচনা। এ ব্যাপারটা আরও বেশি গোলমেলে।

সম্প্রতি আমার বাড়িতে আমার এক বহু দিনের পুরনো বন্ধু এসেছিলেন। তাঁর মতো বিশ্বনিন্দুকে আমার এই ষাট বছর বয়সের জীবনে দ্বিতীয়টি আর দেখলাম না। এবার তিনি অনেকদিন পরে এসেছেন। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁর জিবের ধার, তাঁর চিন্তার বক্রতা এখন একটু কমেনি।

বলাবাহুল্য তিনি এবার এসেই ওই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে পড়লেন, ‘সৈয়দ জাফরি একটা অগা।’

বন্ধুকে উসকিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি বললাম, ‘এই সৈয়দ জাফরি লোকটা কে?’

বন্ধুটি এবার কামান দাগবার সুযোগ পেলেন, বললেন, ‘তাও জানিস না, খুব বড় ফুটবলার ছিল। ইন্ডিয়ান অলিম্পিক টিমের হয়ে লন্ডন অলিম্পিকে কানাডার বিরুদ্ধে গোল করেছিল।’

আর নয়, এবার থামাতে হয়। বাধ্য হয়ে আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘আমি শুনেছিলাম সৈয়দ জাফরি হলিউডের ফিল্মস্টার।’

বন্ধু এবার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যদি গভর্নর হতে পারেন, ফিল্মস্টার ফুটবলার হতে পারে না?’

বাজে তর্ক করে লাভ নেই। আমি বন্ধুকে বোঝালাম এ বয়েসে আর অত উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। বরং আমরা ঠান্ডা মাথায়, নিরপেক্ষভাবে যদি সব বিচার করি।

বন্ধু বললেন, ‘নিরপেক্ষ? কিন্তু সকলের আগে ঠিক করতে হবে কীসের পক্ষে নিরপেক্ষ হব আর কীসের বিপক্ষে নিরপেক্ষ হব।’

পক্ষ বিপক্ষ থাকলে আর নিরপেক্ষ হবে কী করে? একথাটা বন্ধুকে বোঝাতে পারলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *