7 of 8

স্থূল ও অস্থূল

স্থূল ও অস্থূল

শেক্সপিয়ার নামে এক মধ্যযুগীয় নাট্যকার তার এক বহুপঠিত, বহু অভিনীত নাটকের নায়ককে দিয়ে স্থূলতার সপক্ষে একটি উক্তি করিয়েছিলেন, দুর্দিনে সেই নায়ক চেয়েছিলেন তাঁর চারপাশে মোটা লোকদের, Let me have men about me that are fat. জুলিয়াস সিজার নামক সেই বিখ্যাত নায়ক একথাও পরিষ্কার করে ঘোষণা করেছিলেন যে রোগা লোকেরা বিপজ্জনক, রোগাদের দৃষ্টি শীর্ণ, ক্ষুধার্ত; তাদের চিন্তাধারা জটিল।

সভ্যতার ইতিহাসে বেদ-বাইবেলের মতোই শেক্সপিয়ার। তিনি যা বলেছেন তার আর এদিক-ওদিক নেই। মানুষ সম্পর্কে সেটাই শেষ কথা।

কিন্তু রোগা লোকেরা কেন খারাপ আর মোটা লোকেরা কেন ভাল? একজন রোগা লোক মোটা হয়ে গেলে যে আগে খারাপ বা ধূর্ত বা বিপজ্জনক ছিল মোটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কি সরল, ভালমানুষ হয়ে যাবে? নাকি একজন স্থূলাঙ্গিনী তন্বী হওয়া মাত্র হয়ে উঠবে হিংস্র ও কুচুটে।

এক সুরসিক রম্যরচনাকার বলেছিলেন, ‘মোটারা ভাল তার একমাত্র কারণ তারা মোটা। তাদের ভাল না হয়ে কোনও উপায় নেই। তারা মোটা বলেই অন্যের সঙ্গে মারামারি করতে অক্ষম, আবার মারামারি করলেও প্রয়োজন অনুসারে দৌড়ে পালাতে পারে না। তাই তারা ভাল।’

কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, মোটা মানুষেরা ভাল মানুষ হোক আর যাই হোক, সব মোটা লোকেরই চিন্তা কী করে রোগা হওয়া যায়। মানুষের এই আধুনিক দুর্বলতার উপর নির্ভর করে আজকাল শহরের পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠছে শীর্ণনিকেতন, স্লিম হওয়ার ক্লিনিক। কেউ বলছে স্টিম বাথ, কেউ বলছে যোগ ব্যায়াম। আবার কেউ বা বিলিতি তুকতাক, ডায়েটিং, উপোস ইত্যাদি সম্ভার নিয়ে স্থূল দেহীদের শরীরের ভার কমানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

রোগা হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বাতলে দিয়েছিলেন এক বিলিতি ডাক্তার। তাঁর প্রেসক্রিপশন ছিল, যদি রোগা হতে চাও তবে খুব বেশি খাও, যত পারো খেয়ে যাও। খেতে খেতে তুমি একেবারে মোটা হয়ে যাবে। মোটা হয়ে গেলে তুমি অলস হয়ে যাবে, তখন তুমি আর কাজ করতে চাইবে না। পারবেও না। তখন তোমার কাজ চলে যাবে, তোমার আয় বন্ধ হয়ে যাবে, তুমি আর খাবার কিনতে পারবে না। খাবার কিনতে না পারার জন্যে তোমার খাওয়া হবে না। আর যখন তুমি খেতে পাবে না তখন তুমি ঠিক রোগা হয়ে যাবে।

এই সমাধানটি জটিল এবং মর্মান্তিক। আসলে খাওয়া কমালে রোগা হবে, ওজন কমবে আবার খাওয়া বাড়ালে মোটা হবে, ভুঁড়ি হবে, ওজন বাড়বে, একথা হাজারে নশো নিরানব্বুই জন সম্পর্কে সত্যি।

শারীরিক স্থূলতা একদা ঐশ্বর্য ও সচ্ছলতার প্রতীক ছিল। সেটাই স্বাভাবিক, একটি চিরক্ষুধার্ত জীর্ণ সমাজে লক্ষ রোগা লোকের মাঝে দু’-চারটি মোটা লোক অন্তত সচ্ছল বা ধনী ব্যক্তি হিসাবে কিছুটা খাতির পেতেই পারে।

কিন্তু কোনও এক সময়ে মোটা হওয়ার ব্যাপারটা পরিহাসের বস্তু হয়ে গেছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে এবং ভারতচন্দ্রে মোটাত্ব নিয়ে উপহাস আছে। আমাদের প্রিয়বন্ধু কবি উৎপলকুমার বসুর সুযোগ্য সন্তান শ্রীযুক্ত ফিরোজ বসু, যাঁকে আমরা কেউ কেউ পূর্বপরিচয়ের সুযোগে কাটু বলেও ডাকি, তিনি আমাদের বন্ধুবান্ধবের কোনও কোনও ঘরোয়া আসরে অসামান্য সংগীতসুধা পরিবেশন করে তৃপ্ত করেন। ফিরোজবাবুর একটি প্রিয় গান, ‘যিসকা বিবি মোটি।‘ অর্থাৎ যার স্ত্রী মোটা। অমিতাভ বচ্চনের এই হিন্দি গানটি শুধু ফিরোজবাবুর মুখে নয়, রেকর্ডে, রেডিয়োতে, বাজারে, গঞ্জে, প্যান্ডেলে, বিয়েবাড়িতে, বিচিত্র স্থানে, বিচিত্র অবস্থায় শুনেছি। গানটি অশালীন এবং নারী জাতির প্রতি অপমানকর, গানটিকে বন্ধ করা হোক—এই দাবি নিয়ে দিল্লি এবং বেনারসে মহিলারা নাকি প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত বের করেছিলেন। কিন্তু গোপনে বলি, আমাদের স্কুল রুচির জন্যেই হোক অথবা ফিরোজবাবুর প্রসাদগুণেই হোক কিংবা আমাদের স্ত্রীরা তন্বী বলেই হোক আমাদের কিন্তু গানটা ভালই লেগেছে। তা ছাড়া মজার গানে নারীমুক্তি বা স্ত্রী-স্বাধীনতার কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি, মান-অপমান হতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

এসব নিতান্তই অন্য কথা বরং মোটা মানুষের কথা বলি। নিউ ইয়র্কার পত্রিকার কার্টুনে দেখেছি এক লোদর স্লিমিং ক্লিনিকে রোগা হতে গেছেন। প্রথম সপ্তাহে তিনি হারিয়েছেন এগারো পাউন্ড ওজন, দ্বিতীয় সপ্তাহে আরও ন পাউন্ড ওজন আর তৃতীয় সপ্তাহে ভুঁড়ি তখন এত চুপসে গেছে ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে রাস্তার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন নিজের পরনের ফুলপ্যান্টটি।

অন্য এক স্থুলোদর ব্যক্তি ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আর কিছু না হোক শরীরের যেখানটা সবচেয়ে বেশি চর্বি, বেশি মোটা সেখানটায় কমিয়ে দিন।’ সরল প্রকৃতির রোগীটি হয়তো তাঁর ভুঁড়ির কথাই বলেছিলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু কী বুঝলেন কে জানে, মৃদু হেসে বললেন, ‘কবন্ধ হলে আপনাকে মোটেই ভাল দেখাবে না।’ ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, আপনার মাথাটাই সবচেয়ে মোটা। কমাতে হলে মাথাটাই কমাতে হয়।

এই গল্পের শেষ অংশ বলতে পারি না, বোধহয় মানহানির মামলা ছিল কাহিনীর শেষে।

ডাক্তারের কথা, ডাক্তারের নির্দেশ অনেকেই ভাল করে বুঝতে পারে না। এক অসম্ভব স্থূলদেহী ভদ্রলোক যথারীতি মেদ কমানোর জন্যে ডাক্তারের নিকটে পরামর্শ নিয়েছিলেন। ডাক্তার তাঁকে দেখেশুনে বলেছিলেন, ‘কোনও ওষুধ দরকার নেই। একটা ডায়েট চার্ট করে দিচ্ছি। সেই ভাবে এক মাস খান তারপরে আসবেন।’ পরের মাসে ভদ্রলোকের ওজন আরও বেড়েছে। ডাক্তারবাবু বিস্মিত, ‘সে কী আপনি আমার ডায়েট মেনে চলেননি?’ স্থুলদেহী জবাব দিলেন, ‘কেন মানব না? অক্ষরে অক্ষরে মেনেছি।’ ডাক্তারবাবু ভ্রূকুঞ্চন করলেন, ‘ডায়েটে যা ছিল তাই খেয়েছেন?’ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, ‘খেয়েছি। কিন্তু খেতে খুব কষ্ট হয়েছে। এমনিতেই তো জানেন আমি বেশি খাই। আবার সেই খাওয়ার উপরে আপনার এই ডায়েট খাওয়া প্রথম কয়েকদিন রীতিমতো আইঢাই লাগত।’

অন্যদিকে এক রোগা ভদ্রলোকের স্ত্রীকে ডাক্তারবাবু একটি লোভনীয় এবং পুষ্টিকর খাদ্যতালিকা করে দিয়েছিলেন যেটা খেলে ভদ্রমহিলার স্বামীর স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হবে। কিন্তু স্বামীর স্বাস্থ্য আর ভাল হয় না। অবশেষে ডাক্তারবাবু ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার স্বামীর জন্যে যেসব খাবারের কথা বলেছিলাম সেগুলো করেন না?’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই তো নারকেল ভাজা কিসমিস দিয়ে ছোলার ডাল, ডিমের বড়া, আলু-কড়াইশুঁটি দিয়ে মাংস—সবই করি।’ এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তবে?’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তবে আর কী? খাবারগুলো এত ভাল হয় যে লোভে পড়ে আমি নিজেই খেয়ে ফেলি। কর্তাকে আর কিছু দেয়া হয় না।’ নিজের বিপুল দেহভারের উপর একবার লজ্জিতভাবে চোখ বুলিয়ে ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে জানালেন, ‘মধ্যে থেকে আমার ওজন সাংঘাতিক বেড়ে গেছে।’ উদ্ভ্রান্ত ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত কেজি?’ ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে বললেন, ‘আরও বারো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *