7 of 8

গল্পের গতি

গল্পের গতি

শ্ৰীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় একদা এক কাল্পনিক কবির উদ্দেশে ছড়া লিখেছিলেন, —

শ্রীমান সমরেশ সেন,
পড়েছি যা লিখেছেন।
লিখেছেন যা পড়েছেন।

অন্নদাশঙ্কর যাঁর কথা লিখেছিলেন, মনে হচ্ছে তাঁর বোধহয় কিছু লেখাপড়া ছিল। অথবা বলা উচিত পড়ালেখা ছিল যা পড়তেন তাই লিখতেন।

আমার বিদ্যার দৌড় কিন্তু অনেকেরই জানা। খারাপ ডিগ্রি, পড়াশোনা যৎসামান্য। অদ্যাবধি এমন কিছু পড়ে উঠতে পারিনি যা আত্মস্থ করে লিখলে পাঠক-পাঠিকারা আত্মহারা হয়ে হাততালি দিয়ে বাহবা দেবেন। খেলো ও চটুল রচনায় আমার চিরদিনের আসক্তি। তবে যতটা পড়েছি তার চেয়ে শুনেছি অনেক বেশি, এবং এইসব মজার কথা, হাস্যকর গল্প শোনার ব্যাপারে আমার খ্যাতি ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে কেউ কেউ বাড়ি বয়ে আমাকে হাসির গল্প শোনাতে আসে।

উপরের এই ভণিতাটুকু প্রয়োজন পড়ল এই কারণে যে আমার এই সামান্য কলমে কোনও প্রাজ্ঞ পাঠক কিংবা সুচতুরা পাঠিকা যদি কোনও চোরাই কাহিনী কিংবা বহুশ্রুত গল্প ধরে ফেলেন, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। কারণ আমার নিজের কোনও মজার গল্প নেই। সবই শোনা অথবা পড়া। একথা অন্যত্র আগেও বহুবার মাথা নিচু করে স্বীকার করেছি, এবারেও করছি।

তবে এই স্বীকার করাটাই সব কথা নয়। আসল অসুবিধা একেবারে অন্যরকম। অনেক কষ্টের চুরি করা গল্পটিতে হয়তো একটু আপন মনের মাধুরী মেশালাম। পরিশ্রম কিছু কম হল না কিন্তু গল্পটি দু’ লাইন পড়েই কেউ আর এগোলেন না, কারণ সবাই জানেন এ গল্পটা। আমার অজ্ঞাতসারে গল্পটা কবে যে মুখে মুখে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে তা কি আমি আর জানি!

হনলুলু প্রেস ক্লাবের সদর ঘরটিতে সেদিন ছুটির দিনের সন্ধ্যায় বহু লোকের ভিড়। লোকজনের আনাগোনা, আলাপ-পরিহাস। এর মধ্যে দুটি টেলিফোন ঘরের দুই প্রান্তে মাঝে মধ্যে বেজে উঠছে। কেউ গিয়ে ধরছে, কেউ কাউকে ডেকে দিচ্ছে। যেমন হয় আর কী এইরকম আড্ডার আসরে।

এমন সময় একটা ফোন এল, লং ডিসট্যান্স কল, নিউইয়র্ক থেকে। ফোনের নিকটতম ব্যক্তিটি টেলিফোনটি ধরলেন, ‘হ্যালো, হ্যাঁ হনলুল প্রেস ক্লাব। কাকে চাই?’

একটু পরেই যিনি টেলিফোন ধরলেন সেই ভদ্রলোকের কুঞ্চিত হল, ‘কী বলছেন? ও নিউইয়র্ক থেকে? কাকে চাইছেন?… কী বলছেন। কাউকে না, সে কী!’ অতঃপর সামান্য বিরতি ‘ও যে কোনও একজনকে হলেই হবে। ঠিক আছে আমাকেই বলুন।’

ফোন গ্রহণকারী ভদ্রলোক এরপরে ফোনে মন দিয়ে কথা শুনতে শুনতে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লেন, তারপর বললেন, ‘বাঃ চমৎকার! দাঁড়ান, আরেকজনকে ডেকে দিচ্ছি।’ এরপর তিনি পাশের ব্যক্তিকে ফোনটি দিলেন। কিঞ্চিৎ বিস্মিত পাশের ব্যক্তিটি ফোন ধরে তারপর কিছুক্ষণ পরে তিনিও হো হো করে হাসতে লাগলেন। তারপর তৃতীয় চতুর্থ এবং শেষ পর্যন্ত ঘরের শেষ ব্যক্তিটি ফোনে কী সব শুনলেন এবং সবাই যে যার মতো প্রাণ খুলে হাসলেন।

ব্যাপারটি কী? নিউইয়র্ক থেকে ভদ্রলোক ফোন করেছেন, ধরা যাক তাঁর নাম জিম, আগের দিন রাত্রেই এক নৈশভোজের আসরে একটি চমৎকার রসিকতা শুনে এসেছেন জিম সাহেব। শুনে তাঁর এত ভাল লেগেছে যে পরদিন সকালে কাজে গিয়েই তিনি তাঁর সহকর্মীকে গল্পটি আনুপূর্বিক বলেছেন। সহকর্মীটি গম্ভীর ও বিরস মুখে গল্পটি শুনেছেন এবং শেষে জানিয়েছেন যে এ গল্পটি তিনি আগে বেশ কয়েকবার শুনেছেন, তাই এখন শুনলে আর হাসি পায় না বরং রাগ হয়, মাথা গরম হয়ে যায়।

বিফল মনোরথ জিম সাহেব এরপর অন্যান্য কর্মীদের গল্পটি শোনানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই গল্পটি শুনেছে। বিকেলে পাড়ায় ফিরে প্রতিবেশীদের এবং সন্ধ্যায় ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের গল্পটি শোনানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন জিম সাহেব। অনেকে গল্পটি শেষ করতেই দিল না, অনেক আগেই গল্পটি তাদের শোনা।

জিম সাহেবের ভাই কিম সাহেব থাকেন ওয়াশিংটনে, ভায়রাভাই টিম সাহেব থাকেন ফিলাডেলফিয়ায়, কাছাকাছি মধ্যেই বলা চলে। পয়সা খরচ করে এই দু’জায়গায় দুই আত্মীয়কে ফোন করে গল্পটি শোনাতে গেলেন। কিন্তু হতভাগ্য জিম সাহেবের ইচ্ছা এবারেও অপূর্ণ রইল। দু’জনেই ঘুমভাঙা গলায় স্পষ্ট বিরক্তি সহকারে জানালেন এই রদ্দি গল্পটি তাঁদের জানা আছে।

অবশেষে নিতান্ত মরীয়া ও নিরুপায় শ্রীযুক্ত জিম টেলিফোন ডিরেক্টরি খুঁজে খুঁজে সুদূরতম প্রান্তে ওই হনলুলু প্রেস ক্লাবে ফোন করেছেন, হয়তো ওখানে এখনও গল্পটি পৌঁছোয়নি, যদি ওখানে এমন কাউকে পাওয়া যায় যে, এখনও জিম সাহেবের গল্পটা শোনেনি। জিম সাহেবের প্রয়াস সফল হয়েছিল। সারাদিন ব্যর্থতার পরে পরপর একুশজনকে ওই প্রেস ক্লাবের ফোনে গল্পটি শোনাতে পেরে নিশ্চয়ই তিনি আন্তরিক খুশি এবং কৃতার্থ হয়েছিলেন। তবে সে মাসে তাঁর টেলিফোন বিলে ওই দূর মাত্রার একুশে গল্প কতটা ভার বাড়িয়েছিল তা বলতে পারব না। আমি জানি, জিম সাহেবের এই ফোন করার গল্পটা অনেকেই জানেন, কেউ কেউ প্রকারান্তরে অন্যত্র পড়েও ফেলেছেন। সুতরাং এ নিয়ে আমি বাহাদুরি করব না। আমার বাহাদুরি অন্যত্র। জিম সাহেব ফোনে যে গল্পটা বলেছিলেন সে গল্পটা আমিও জানি।

গতকাল রাত্রেই গল্পটি হনলুলু-টোকিও হয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছেছে। হয়তো পাঠক-পাঠিকারা সবাই এখনও গল্পটি শোনেননি। তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য গল্পটি পেশ করছি, অবশ্য প্রয়োজনের খাতিরে কাহিনীটির কিঞ্চিৎ জাতীয়করণ করতে হল। গল্প এক মৃত্যশয্যাশায়ী বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিয়ে। শেষ নিশ্বাসের কাছাকাছি সময়, সাদা বাংলায় বলা যায় টান উঠেছে। ছেলে মেয়ে, আত্মীয় বন্ধু সব বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মারা যাওয়ার পর কীভাবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে হঠাৎ তাই নিয়ে বিবাদ বাধল। বড় ছেলের ইচ্ছে সাবেকি মতে সবাই মিলে কাঁধে করে হরিধ্বনি করে বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যায়। ছোট ছেলে কিঞ্চিৎ আধুনিক, তার ইচ্ছা হিন্দু সৎকার সমিতির ঢাকা কাচের গাড়িতে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া। বৃদ্ধের এক ভাগ্নে ছিল ঘরের মধ্যে, তার ট্রাকের ব্যবসা। সে বলল, ‘আমার নতুন ট্রাকটায় মামাকে নিয়ে যাব। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া যাবে।’

এর মধ্যে মৃত্যুপথযাত্রী চোখ মেলে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছেন মনে হল। ছেলেরা বলল, ‘কী চাইছ বাবা?’ বাবা বললেন, ‘আমার শার্টটা দাও।’ বড় ছেলে বিচলিত হয়ে বলল, ‘সে কী?’ বাবা বললেন, ‘সময় নেই, দেরি কোরো না। শার্টটা দাও, চটিজোড়া দাও। কারওর কিছু করতে হবে না। আমি হেঁটেই শ্মশানে যাচ্ছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *