7 of 8

পাকিস্তান

পাকিস্তান

পাকিস্তান বিষয়ে আমি লেখার কথা ভেবেছি খুশবন্ত সিংয়ের একটি মন্তব্য পাঠ করে। আমি পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু উদ্বাস্তু, পাকিস্তান শব্দটি আমার সমাজের সকলের কাছেই অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনাবহ—ছিন্নমূল এবং স্মৃতিবিদারক। বলাবাহুল্য পাকিস্তান সম্পর্কে আমার নিজের কোনও রসিকতা নেই।

সর্দার খুশবন্ত সিং কতবিদ্য ব্যক্তি। যে কোনও গোলমেলে অথবা সাধারণ ঘটনা নিয়ে চমকপ্রদ উক্তি করায় অথবা সেটাকে একটি সর্দারি গল্পে দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় তাঁর জুড়ি বিরল। আর, পাকিস্তান সম্পর্কে বলতে গেলে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু হিন্দুর মতো তিনিও জাতিগতভাবে উদ্বাস্তু শিখ, ওই দেশটি সম্পর্কে দু’-চারটি হক কথা বলার বা খাঁটি গল্প বলার অধিকার তাঁর অবশ্যই আছে। খুশবন্ত সিংয়ের শেষতম মন্তব্যটি অবশ্য শুধু পাকিস্তানীদের গায়েই লাগেনি। আমাদের মোটা চামড়াতেও তার উত্তাপ একটু লেগেছে। খুশবন্ত বলেছেন যে ভারত এবং পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য একটাই। সেই পার্থক্যটা হল পাকিস্তানী কুকুরগুলো ভাল খেতে পরতে পায় কিন্তু তাদের ঘেউ ঘেউ করতে দেওয়া হয় না, আর ভারতীয় কুকুরগুলো ঠিকমতো খেতে পায় না বটে কিন্তু তাদের ঘেউ ঘেউ করার স্বাধীনতা রয়েছে।

উক্তিটি অন্যান্য এ জাতীয় উক্তির মতোই অবশ্য খুশবন্ত সিংয়ের নিজস্ব নয়। পশ্চিমি দেশগুলি ভিজাভি (vis-a-vis) কমিউনিস্ট দেশগুলি সংক্রান্ত অজস্র রসিকতা ইউরোপে গত পঞ্চাশ বছর চালু রয়েছে। তার মধ্যে এই রসিকতাটিও আছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে সেই কথিকায় মোটা নির্বাক কুকুরটি লাল এবং রোগা ঘেউ ঘেউ বিলাসী কুকুরটি সাদা।

পাকিস্তান সম্পর্কে দ্বিতীয় গল্পটিতে যাই। এই দ্বিতীয় গল্পটিও খুশবন্ত সিংয়ের। এবং পড়লেই বুঝতে পারবেন অসামান্য গল্প এটি। শুধু লিখবার আগে একটা ছোট খটকা আছে, জিষ্ণু উপাধ্যায় অথবা বাহারউদ্দিন এটা ইতিমধ্যে লিখে ফেলেননি তো? কিংবা মদন মিত্র তাঁর পাকিস্তান পরিক্রমায়?

সে যা হোক, খুশবন্ত সিংয়ের জবানিতে গল্পটি বেরিয়েছিল বছর দেড়েক আগে হিন্দুস্তান টাইমস কাগজে। নাপিত এবং রাজা নিয়ে অনেক গল্প আছে নানা উপকথায়, খুশবন্ত সিংয়ের গল্পটিও সেই লাইনের।

কাহিনীর নায়ক পাকিস্তানের প্রবল প্রতাপান্বিত প্রেসিডেন্ট। প্রধানত তাঁদের নিরাপত্তার কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোনও কারণে, রাষ্ট্রপ্রধানেরা আর দশজনের মতো চুল কাটতে বা দাড়ি কামাতে রাস্তাঘাটের দোকানে বা সেলুনে যেতে পারেন না। সরকারি বা তাঁদের স্ব-নির্বাচিত নাপিত দিয়েই কাজটি সমাধা করতে হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়ারও নিজের নাপিত রয়েছে। বহুকালের পুরনো বশংবদ নাপিত। বহুদিনের পরিচয়ে নাপিত মহোদয়ের সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ হৃদ্যতাও স্থাপিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট সাহেবের। দাড়ি কামাতে কামাতে দু’জনের মধ্যে নানারকম সুখ-দুঃখের গল্প হয়।

কিন্তু আজ কিছুদিন হল জিয়া লক্ষ করছেন যে তাঁর নাপিতটি দু’-একটা গোলমেলে কথা বলছে। আগে লোকটি বৃষ্টি কম হচ্ছে, পেশোয়ারি চালে এখন আর সেরকম গন্ধ নেই, কিংবা এখানকার ছেলেরা খুব বেশি গাঁজা খাচ্ছে এই সব নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু আজকাল হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই দুম করে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘তা হলে কর্তা, নির্বাচনটা কবে করছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে জিয়ার মাথায় রক্ত উঠে যায়, কোনওক্রমে ক্রোধ দমন করে চুপ করে থাকেন। কিন্তু লোকটি বে-আক্কেলে, আবারও ওই একই প্রশ্ন, ‘তা হলে নির্বাচনটা..?’ জিয়ার ইচ্ছা হয়, ‘লোকটাকে এখনি ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে দিই, অথবা বড় রাস্তার মোড়ে পঞ্চাশ ঘা বেত লাগাই।’

কিন্তু পুরনো লোক, আর লোকটার এই বাজে প্রশ্ন করা ছাড়া আর কোনও দোষই নেই, চমৎকার মোলায়েম হাতে দাড়ি কামায়, ঝরঝরে চুল কাটে।

পরের দিন দাড়ি কামাতে কামাতে নাপিতের আবার একই প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, নির্বাচনটা…?’

জিয়া ফের উত্তেজিত। জিয়া এবারও ক্রোধ দমন করে ঠান্ডা হন, পরে ধীর ভাবে ভাবতে লাগেন, এই বোকা লোকটা কি কোনও বিরোধী দলে নাকি কোনও গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থায় যোগদান করেছে? নাপিত হয়ে নির্বাচন নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? নাকি কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের কাফেরদের বা কমিউনিস্টদের গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেছে এই নাপিতটা।

অবশেষে একদিন ওই নির্বাচনের প্রশ্নটা করতেই জিয়া সাহেব চেপে ধরলেন নাপিতকে, ‘কেন তুমি বার বার এই প্রশ্ন করছ? নির্বাচন কবে হবে বা না হবে তাতে তোমার কী?’

প্রেসিডেন্টের এই অগ্নিমূর্তি দেখে নাপিতটি ঘাবড়িয়ে গেল, তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললে, ‘সাহেব ব্যাপারটা হল…’

জিয়া ধমকে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার?’ নাপিত বলল, ‘আপনার দাড়ি তো খুব কড়া, কাটা খুব কঠিন। কিন্তু আমি দেখেছি যে ভোটের কথা বললেই আপনার দাড়িগুলো একেবারে খাড়াখাড়া টানটান হয়ে ওঠে। আমারও কামানোর সুবিধে হয়, আপনারও গালে লাগে না। তাই দাড়ি কামাতে কামাতে আমি ওই ভোটের কথাটা তুলি, আর সঙ্গে সঙ্গে আপনার দাড়ি খাড়া হয়ে যায়’

এ গল্প একালের পাকিস্তানের। আমার শেষ গল্প সেকালের পাকিস্তানের মানে সাঁইত্রিশ বছর আগের, সেই যখন পাকিস্তান হয়েছিল, গল্পটি খুব সম্ভব সৈয়দ মুজতবা আলির। বহু চেষ্টা করেও, বহু পাতা উলটিয়ে আমি সেই গল্পটি খুঁজে পেলাম না। তবু গল্পটি এত মর্মান্তিক যে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে আমার নিজের অক্ষম ভাষায় উপস্থাপন করছি।

দেশবিভাগের পর দলে দলে হিন্দুরা সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসছিলেন। এঁরা যে সবাই দাঙ্গাহাঙ্গামায় অথবা উৎপীড়নে চলে আসেন তা নয়, অনেকেই আসেন কিছুটা নিরাপত্তাবোধের অভাবে আর কিছুটা সামাজিক কারণে। সেই সময় কিন্তু বহু শুভবুদ্ধি সুহৃদ মুসলমান অনেক হিন্দু পরিবারকে চলে না আসতে অনুরোধ করেছেন।

এই রকম একটি ঘটনার কথা লিখেছিলেন মুজতবা আলি। নদীর ঘাটে নৌকোয় বাক্স-বিছানা তোলা হচ্ছে, একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার চিরদিনের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় এক মুসলমান ভদ্রলোক তখনও সেই পরিবারকে বোঝাচ্ছেন, ‘যাবেন না। পাকিস্তান হয়েছে তো কী হয়েছে। এই তো ফ্ল্যাগটা দেখুন। এর মধ্যেও হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। এই যে তিনভাগ সবুজ মুসলমানের জন্যে, আর এই একভাগ সাদা হিন্দুর জন্যে।’ (পাঠক, পাকিস্তানের পতাকা স্মরণ করুন।)

হিন্দু পরিবারটি এই শেষ মুহূর্তেও একটু দোমনা হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের সম্বিৎ ফিরল, যে কুট্টি গাড়োয়ানের ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মালপত্র নিয়ে এসেছেন নদীর ঘাটে, তার কথায়, সে বলল, ‘কর্তা আর থাকবেন না। পালাইয়া যান। দেখছেন না, নিশানের বাঁশটা দিছে ওই সাদারই মধ্যে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *