7 of 8

বোকার মা

বোকার মা

রেল-ক্রসিংয়ের একটু দূরে রাস্তার মোড়ে দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে।

প্রথম বন্ধু—রেলে একটা লোক কাটা পড়েছে দেখেছ?

দ্বিতীয় বন্ধু—না তো, আমি একটু আগে ওদিকের থেকে এলাম, তখন কিছু দেখলাম না। একটা গাড়ি আসছিল বটে সেই সময়।

প্রথম বন্ধু—সেই সময়েই কাটা পড়েছে, তাড়াতাড়ি করে আসতে গিয়ে মারা গেল লোকটা।

দ্বিতীয় বন্ধু—আমিও তো তাড়াতাড়ি করেই একেবারে ছুটে এলাম। লোকটা কেমন দেখতে?

প্রথম বন্ধু—তোমার মতোই দোহারা চেহারা, লম্বাও তোমার মতোই হবে।

দ্বিতীয় বন্ধু—(উত্তেজিত ভাবে) সর্বনাশ! গায়ের রং কী রকম?

প্রথম বন্ধু—ভাল করে খেয়াল করিনি, তবে মনে হয় খুব ফরসা নয়, অনেকটা তোমার মতোই হবে।

দ্বিতীয় বন্ধু— (আরও উত্তেজিত) লোকটার পরনে কী দেখলে?

প্রথম বন্ধু—তোমার মতোই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি।

দ্বিতীয় বন্ধু— (গলার স্বর প্রায় জড়িয়ে গেছে) তা হলে?

প্রথম বন্ধু—তা হলে আর কী? লোকটা তুমি নও, তার পায়ে রয়েছে স্যান্ডেল আর তোমার পায়ে দেখছি কাবুলি চপ্পল।

দ্বিতীয় বন্ধু—(পকেটের রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে) বাঁচালে, এই কথাটা আগে বলতে হয়। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!

উপরের এই কাহিনীটি অবশ্যই বাজে এবং সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কিন্তু আমরা কি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এই রকম অনাবশ্যক উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হই না? অনেক দিন আগে কোথায় যেন এক বোকার মায়ের গল্প পড়েছিলাম। বোকার মা সন্তানহীনা। কিন্তু তার সবসময়েই দুশ্চিন্তা যদি তার ছেলে থাকত, যদি সেই ছেলে বোকা হত তা হলে কী সব সাংঘাতিক বিপদ হতে পারত। চূড়ান্ত বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল এক চাঁদনি সন্ধ্যাবেলায় যখন বোকার মা তার বাড়ির দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিল, কাঁদার কারণ ছিল অনেকটা এই রকম। যদি সত্যি সত্যি বোকা থাকত, যদি বোকা বিকেলে ফুটবল খেলতে যেত, যদি সন্ধেবেলা সেই সময়ে খেলে ফিরত আর যদি কালবৈশাখীর ঝড় উঠত, যদি দাওয়ায় একটা বড় আমগাছ থাকত, যদি ঝড়ে সেই আমগাছ উলটে পড়ে যেত আর বোকা যদি সেই গাছে চাপা পড়ত তা হলে কী সর্বনাশ হত! কোথায় বা আমগাছ কোথায় বা ঝড়, কোথায় বা বোকা! বোকা জননীর করুণ ক্রন্দনে সেই জ্যোৎস্নাময় সন্ধ্যাবেলা প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা যারা বুদ্ধি করে এই সন্তানহীনাকে বোকার মা নামকরণ করেছিল তারা সেই সন্ধ্যায় প্রথমে হতভম্ব পরে কৌতুকান্বিত এবং সর্বশেষে অতি বিরক্ত হয়েছিল।

আমাদের সমস্ত বা অধিকাংশ দুশ্চিন্তাই এত অমূলক এমন কথা বলা চলবে না। কিন্তু যাঁরা রাত দুপুরে সাইকেলের ঘণ্টি শুনলেই ভাবেন কোনও অনিবার্য দুঃসংবাদ নিয়ে টেলিগ্রাম এসেছে কিংবা বাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে কোনও অচেনা লোক দাঁড়িয়ে থাকলেই আশঙ্কিত বোধ করেন যে লোকটা তাঁকে খুন করার জন্যেই অপেক্ষা করছে তাঁদের অবস্থাও আমাদের প্রথম কাহিনীর দ্বিতীয় বন্ধু এবং দ্বিতীয় কাহিনীর বোকার মা’র চেয়ে কোনও অংশে ভাল নয়।

এমন লোকের সংখ্যা কম নয় যাঁদের দৈনিক সকালে একবার ক্যান্সার হয়, বিকেলে হার্ট অ্যাটাক। বুকে হাত চেপে পা টিপে টিপে বাড়ি ফিরে আসেন, এই যায় কি সেই যায়। পরের দিন সকালেই দু’বার কাশবার পর তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে তাঁর টি বি হয়েছে এবং আবার রাত দুপুরে আলো জ্বালিয়ে বলে কম্পিত বক্ষে নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কবজি ধরে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা গুণে নিজের নাড়ির গতি দেখেন। যে কোনও খাবারেই তাঁর ফুড পয়জন হতে পারে, যে কোনও যানবাহনে দুর্ঘটনা। প্রত্যেকটি লাশের বর্ণনার সঙ্গে তিনি নিজেকে মিলিয়ে দেখবেন সত্যি সত্যি বেঁচে আছেন কি না। কে তাঁকে প্রশ্ন করবে এত উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনে বেঁচে থাকা আর না থাকায় বিশেষ কোনও তফাত আছে কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *