7 of 8

জোচ্চোর

জোচ্চোর

অভিধানে দেখা যাবে যে জোচ্চোর এবং জুয়াচোর শব্দ দুটি সমার্থক। তবে এর মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেছে। জোচ্চোর মানে আমরা সবাই জানি, এর অর্থ হল প্রবঞ্চক। জুয়াচোর শব্দটির অর্থও তাই কিন্তু সমাস ভাঙলে এর ব্যাসবাক্য ‘জুয়ায় যে চুরি করে’—জুয়াচোর। এ ক্ষেত্রে অর্থটা কিন্তু বেশ একপেশে।

সে যা হোক, আগের দফায় জুয়া নিয়ে লিখেছি, সুতরাং এ দফায় জুয়াচোর স্বভাবতই এসে যাচ্ছে। এবং আপাতত আমরা জুয়াচোর বলতে জোচ্চোরকেই বোঝাচ্ছি।

গত শতকের নৈরাশ্যবাদী জার্মান দার্শনিক শ্যপেনহাওয়ার, যিনি মনীষী হেগেলকে জোচ্চোর (charlatan) বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রবঞ্চনা বিষয়ে তিনি একটি প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন। শ্যপেনহাওয়ারের অন্য অধিকাংশ উক্তির মতোই এই উক্তিটিও চমকপ্রদ। উক্তিটি হল, যখন তুমি প্রবঞ্চিত হলে, তোমার আর্থিক ক্ষতি হল তখন জানবে তোমার টাকা সব চেয়ে ভাল কাজে এবার খরচ হল, কারণ এবার অর্থের বিনিময়ে তুমি কিঞ্চিৎ জ্ঞান সঞ্চয় করলে, অভিজ্ঞতা লাভ করলে। একটি সমজাতীয় কথা বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে বহুকাল ধরেই চালু আছে, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’ ঠিক একই অর্থ প্রতারিত বা প্রবঞ্চিত হলে জ্ঞান বাড়ে। অভিজ্ঞতা বাড়ে। আর মার্ক টোয়েন সাহেবের মতে অভিজ্ঞতা হল সেই পদার্থ যা কোনও ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ঠকবার পরে স্মরণ করিয়ে দেয় আগেও একবার একই ভাবে ঠকেছিলাম।

সামান্য আলোচনা, শুরুতেই খটমট হয়ে গেল। শ্যপেনহাওয়ার এবং মার্ক টোয়েন, গত শতকের এই দুই বাক্যবাগীশ সাহেবের কথা উঠল। জোচ্চুরির নিবন্ধে কী আর করা যাবে, সাহেবদের দেশের দুয়েকটা কথা বলে স্বদেশি জোচ্চুরিতে আসছি।

জোচ্চোর বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা আছে যে, অমুক লোকটা জোচ্চোর, ওর সঙ্গে করমর্দন অর্থাৎ হ্যান্ডশেক করার পর গুনে দেখতে হয় নিজের হাতের আঙুল সব কয়টি যথাযথ আছে কি না। এক বিধবা মেমসাহেবের গল্প জানি। মেমদের তো আর সধবা-বিধবা-কুমারী বোঝা যায় না। জ্যোতিষী তাঁর হাত দেখে বলেছিলেন, ‘আপনার বড় একটা ক্ষতি সামনে আছে।’ মেম বললেন, ‘কী ক্ষতি?’ জ্যোতিষী একটু ভেবে বললেন, ‘আপনার স্বামী মারা যাবেন।’ বিধবা বললেন, ‘কিন্তু আমার তো স্বামী নেই। এবার জ্যোতিষী একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনার ছাতা হারাবে।’

এ হল পুরনো জোচ্চুরি। নতুন জোচ্চুরির কথা বলি। তার আগে আরেকটা গল্প।

অনেকদিন আগে, নিতান্ত অল্প বয়সে। সন্তোষ রাজবাড়ির রথের মেলায় মাত্র আট আনা দিয়ে একটা বই কিনেছিলাম, বইটার নাম ‘সচিত্র গোপাল ভাঁড়’। সেই প্রায় আধ শতক আগে সেই বইতে একটা গল্প পড়েছিলাম।

গোপাল ভাঁড় এক ব্যক্তির কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করেছিল। কিন্তু কিছুতেই শোধ দিচ্ছে না। লোকটি তখন জোর তাগাদা শুরু করে, গোপাল ভাঁড়ও এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। লোকটা আর গোপাল ভাঁড়কে ধরতে পারে না। অবশেষে একদিন সে খুব ভোরের বেলায় গোপাল ভাঁড়ের বাড়িতে এসে হাঁকাহাঁকি-চেঁচামেচি শুরু করল। লোকটির হাঁক-ডাকে গোপাল ঘরের মধ্যে থেকে ঘুম ভেঙে বেরিয়ে এল। তার হাতের মুঠোর মধ্যে যেন কী ধরা রয়েছে। পাওনাদারকে দেখে এগিয়ে এসে গোপাল বলল, ‘এত চেঁচামেচির কিছু নেই। দাঁড়াও আজ এখনই আমি তোমার ঋণশোধের বন্দোবস্ত করছি।’

এই বলে গোপাল ভাঁড় বারান্দা থেকে বাড়ির উঠোনে নেমে উঠোনের একপাশে হাতের মুঠো খুলে কয়েকটি তেঁতুলের বিচি ছড়িয়ে দিল। পাওনাদারকে এর পর কোনও প্রশ্ন করার ফুরসত না দিয়ে গোপাল বুঝিয়ে বলল, ‘এই তেঁতুল বিচি লাগালাম। এইবার বড় বড় গাছ হবে, সেই সব গাছে মণ-মণ তেঁতুল ফলবে। সেই তেঁতুল বেচে তোমার সব ধার শোধ করে দেব। যাও এবার খুশি তো।’ আজ কিছুদিন হল খবরের কাগজে এক ধরনের বিজ্ঞাপন বের হচ্ছে। এই জায়গায় কিংবা সেই জায়গায় ইউক্যালিপটাস বা মেহগনির চাষ হচ্ছে। আপনি যদি সামান্য দেড় বা দু’হাজার টাকা দরে এখন কয়েকটি চারা কিনে রাখেন তবে পনেরো-বিশ বছর পরে আপনি তিন বা পাঁচ লক্ষ টাকা দামের গাছের অধিকারী হবেন। গাছগুলি যেখানে চাষ হবে সেখানকার কাব্যিক বর্ণনা, প্রতিটি গাছের বাজার মূল্য, কৃষিবিমার সুরক্ষা, সেই সঙ্গে ঝলমলে ছবি সহকারে বিজ্ঞাপনগুলি লোভনীয় ও চমকপ্রদ। অঙ্কে কোনও ভুল নেই, গোপাল ভাঁড়ের অঙ্কেও ভুল ছিল না। কিন্তু উলটো দিক থেকে বিবেচনা করে দেখলে পাঁচ-দশটি গাছের চারার দাম বড় জোর একশো-দুশো টাকা, এ ধরনের কিছু গাছ বৃক্ষরোপণ উৎসবে সরকার বিনামূল্যে বিতরণ করেন। আর এই গাছ লাগানোর জন্যে যেটুকু জমি, সেটা যে অঞ্চলে চাষবাসহীন সেই বুনো জায়গায় পতিত জমিটুকুর বাজার দর কিছুতেই দুশো টাকাও নয়। কিন্তু আপনি যদি প্রলুব্ধ হন, মাত্র হাজার পনেরো টাকা গচ্চা দিয়ে ভবিষ্যতে কোটিপতি হওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখেন, তা হলে আপনাকে ঠেকাবে কে? আপনার টাকাটা যাবে।

ভয় এবং লোভ, মানুষের এই দুই প্রবৃত্তি নিয়ে জোচ্চোরদের কারবার। অসহায় বিধবাকে এরা বলে তোমার একমাত্র সন্তানের মৃত্যুযোগ সামনে রয়েছে। সন্ত্রস্তা রমণী তাঁর শেষ সম্বল গলার সোনার হারটি খুলে দেন শান্তি-স্বস্ত্যয়নের জন্যে। কালোবাজারি কিংবা এমনিই সাধারণ ব্যবসায়ীকে গিয়ে বলে, ‘তোমার কাগজপত্র, হিসেব বার কর। আমরা পুলিশ (কিংবা আয়কর দপ্তর) থেকে এসেছি।’ ঝামেলার ভয়ে ব্যবসায়ী কিছু টাকা ছাড়ে। এরা গৃহস্থকে সস্তায় ফ্ল্যাটবাড়ি বা জমির লোভ দেখায়। বেকারকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়। অসুস্থ রোগীকে সুচিকিৎসা। এরাই চোখের সামনে টাকা ডবল করে, সোনা বানায়। হিংটিং ছট মন্ত্র দিয়ে স্বর্গের স্থায়ী ইজারার বন্দোবস্ত করে।

সাধু সাবধান!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *