7 of 8

ইঁদুর

ইঁদুর

প্রাতঃস্মরণীয় বাক্যবাগীশ র‍্যালফ ওয়ালডো এমার্সন সাহেব তাঁর এক বিখ্যাত বক্তৃতায় ভাল বই লেখা, সুধর্ম প্রচার করা ইত্যাদি মহৎ কাজের সমগোত্রীয় হিসেবে উল্লেখ করছিলেন ইঁদুর ধরার খাঁচা তৈরির কুশলতাকে।

এই সর্বজ্ঞানী কেন যে সামান্য ইঁদুরের কল বানানোর যোগ্যতাকে সাহিত্য রচনা বা ধর্মপ্রচারের সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেটা আমি কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার আগে ইঁদুর সম্পর্কে দু’-একটা জ্ঞানের কথা বলে নিই। ইঁদুর দেবতার বাহন। যে কোনও দুর্গা প্রতিমার পাশে গণেশ ঠাকুরের পায়ের নীচে একটি ছোট মাটির ইঁদুর থাকবেই। সব মূর্তিতেই যে ইঁদুর ছোট তা অবশ্য নয়। আধুনিক দুর্গা প্রতিমায় দেখেছি দুর্গা যেমন সিংহের পিঠে দাঁড়িয়ে আছেন তেমনিই লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ যে যার বাহনে আসীন। সেখানে বিশালকায় ইঁদুরের পিঠে ক্ষুদ্র উপবীত, উন্নত ভুঁড়ি, সুঠাম শুঁড়সহ গজানন দণ্ডায়মান। সেই ইঁদুর প্রায় সিংহের সমান।

র‍্যাট, রোডেন্ড, মাউস ইত্যাদি আকৃতি-প্রকৃতিগত নানা নাম ইঁদুরের ইংরেজিতে। কিন্তু বাংলায় শুধুই ইঁদুর। বিশেষণ যোগ করে নেংটি ইঁদুর, ধেড়ে ইঁদুর, ধানী ইঁদুর, মেঠো ইঁদুর পার্থক্য বোঝানো হয়। বাংলায় পাড়াগাঁয়ের মাঠের ইঁদুর, ধানী ইঁদুর; যে ‘ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ’, কিংবা যে ‘মেঠো ইঁদুরের চোখ ধানের নরম শিষে নক্ষত্রের দিকে আজো চায়’ জীবনানন্দ তাকে কবিতায় অমর করে গেছেন।

আপাতত, কাব্য বা অমরত্ব থাকে। গণেশ আমাদের কুকুরের নাম। কোনও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির মনে আঘাত দেবার জন্যে বা ওই নামের কোনও পরিচিত ব্যক্তিকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে আমাদের কুকুরের এই নামকরণ নয়। আসলে গণেশের মা, সেও আমাদের বাড়িতেই ছিল। তার এক সঙ্গে চারটি বাচ্চা হয়েছিল দুর্গা পূজার ষষ্ঠীর দিনে সকালে। চারটি বাচ্চার দুটি ছেলে, দুটি মেয়ে। পণ্ডিতিয়া সন্ধ্যা সঙেঘর বারোয়ারি পুজোর ব্যান্ডেল ছিল আমাদের বাড়ির সামনেই, সেখানে তখন জগজ্জননী পুত্রকন্যা নিয়ে এসে গেছেন। মাইকে মাতৃস্তোত্র বাজছে, আমরা বিনা পরিশ্রমে বিনা বাক্যবায়ে কুকুর শিশুদের নামকরণ করলাম, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী।

এর মধ্যে বাকিরা অন্য বাড়িতে গেল। গণেশ রইল আমাদের বাড়িতে। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবিষ্কার করি গণেশের এই নামকরণ ঠিক হয়নি।

গণেশ নামটি যতটা শাস্ত্রবিরুদ্ধ, গণেশ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যকলাপ ততোধিক অশাস্ত্রীয় হয়ে উঠল। অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের মনে সংশয় দেখা দিল গণেশ কুকুর না বিড়াল? সে নির্বিচারে, নির্মমভাবে তার বাহনদের অর্থাৎ ইঁদুর মারতে শুরু করল। অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে, খাওয়া-দাওয়া ঘুম বন্ধ করে ঘণ্টায় পর ঘণ্টা সে ইঁদুরের প্রতীক্ষায় দরজার আড়ালে বা আলমারির নীচে নাক গলিয়ে অতিবাহিত করতে লাগল। পণ্ডিতিয়ার বাড়িতে তত ইঁদুর ছিল না। তার খুব সুবিধে হয়েছে আমাদের বাসা বদলের পর। বর্তমানে যে জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নাবশেষে আমি বসবাস করার চেষ্টা করি সেটা বোধহয় কলকাতায় ইঁদুর সাম্রাজ্যের রাজধানী। কৃষ্ণ, শুভ্র, ধূসর, পিঙ্গল, রক্তাভ, নীলাভ ইত্যাদি সহস্রবর্ণের এবং পিপীলিকা থেকে সামান্য বৃহৎ ও মার্জার থেকে সামান্য ক্ষুদ্র আয়তনের সহস্র ইঁদুরের লীলাভূমি এই গৃহ। বাড়িতে কোনও বিড়াল নেই, সব জানলায় জাল দেওয়া, বাইরে থেকে আসবার কোনও সম্ভাবনাই নেই, ইঁদুরেরা এ-বাড়িতে প্রাণের সুখে পান-ভোজন, নৃত্য-গীত, ক্রীড়াকৌতুক এবং বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। তদুপরি তারা অকুতোভয়। আলনা বেয়ে উঠে যাচ্ছে, সকলের চোখের সামনে রান্নাঘরের তরকারির ঝুড়ি থেকে একটা নিটোল গোল আলু নিয়ে কয়েকজন মিলে ফুটবল কাম ভলিবল খেলছে। পোষা বেড়ালছানার মতো খাবারের থালার সামনে চুপচাপ অপেক্ষা করছে। অনেক সময় যে খাচ্ছে তার উঠে যাওয়ার আগেই থালায় উঠে পড়ছে। রাত্রে বিছানায় উঠে দল বেঁধে কুচকাওয়াজ করছে। জামার পকেটে, জুতোর গহ্বরে বাচ্চা পাড়ছে—এই রকম চলছিল ইঁদুরদের দিনকাল। পন্ডিতিয়া থেকে গণেশ এসে এ সমস্ত ভেস্তে দিয়েছে। ইঁদুরেরা অনেকেই এখনও আছে কিন্তু তাদের জীবন ও স্বাধীনতা বিপন্ন। অসংখ্য ইঁদুর শহিদ হয়েছে; গণেশ আবার ইঁদুর খায় না, মূষিক নিধনেই তার আনন্দ আর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর নিহত জীবটিকে মুখে করে এনে বাড়ির যে কারওর পদপ্রান্তে উপঢৌকন দেয়, বোধহয় আমাদের আর্থিক অবস্থা অনুমান করে সে এই ভাবে পরিবারের খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করতে চায়। প্রসঙ্গত এই কাহিনীর একটি উপকাহিনী এখানে লিখে না রাখলে অন্যায় হবে। গণেশকে নিয়ে সকালে ময়দানে বেড়াতে যাই। শিকল খুলে দিলে সে মাঠের মধ্যে অনেকদূরে চলে যায়। তখন ‘গণেশ, গণেশ’ করে তাকে ডাকাডাকি করে ফিরিয়ে আনতে হয়। ময়দানের .ভ্রমণকারীদের মধ্যে অধিকাংশ বড়বাজারি ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী। হঠাৎ একদিন এই রকম এক ভদ্রলোক আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবুজি, গণেশ নামটা ভাল নয়, আমি ওর জন্যে নাম ঠিক করেছি, টমি।’ আমি বাধা দিলাম না, শুধু মুখে বললাম, ‘টমি চমৎকার নাম।’

দিন সাতেক পরে গণেশ অন্য একটা কুকুরকে শুঁকতে শুঁকতে বহুদুর চলে যায়; আমি ‘গণেশ-গণেশ’ করে ডেকে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করছি, এমন সময় আবার সেই ভদ্রলোক, ‘কী হল বাবুজি, ওকে টমি নামে ডাকছেন না?’ আমি কী আর বলব, তাড়াতাড়ি পাশ কাটাতে কাটাতে বললাম, ‘আমি তো ডাকতেই চাই। কিন্তু গণেশ কিছুতেই নাম বদলাতে রাজি নয়।’ (প্রসঙ্গত, আতি সম্প্রতি এক শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনে দেখলাম বসিরহাটের এক ভদ্রলোক সপরিবারে নাম বদল করে তারাপদ রায় নাম গ্রহণ করেছেন। আজকাল, ৫.৭.৮৪)

আবার ইঁদুরে ফিরছি। বাংলাদেশে যাদের মারোয়াড়ি বলা হয় তাদের এক গরিষ্ঠ অংশ এসেছেন রাজস্থানের দেশনক অঞ্চল থেকে। থর মরুভূমির এক প্রান্তে দেশনকে রয়েছে কাণিমাতার মিন্দর। কাণিমাতার মন্দিরে যত ইঁদুর আছে কলকাতার কার্জনপার্কে তার এক শতাংশ ছুঁচো নেই। গণেশের মতোই কার্ণিমাতার বাহন ইঁদুর। একটা দুটো নয়, লক্ষ লক্ষ ইঁদুর। গাদাগাদি ঘুরছে, ফিরছে। ঘুমোচ্ছ তীর্থযাত্রীরা পা টিপে টিপে আলতো করে ইঁদুরদের সরিয়ে মন্দিরের মধ্যে ঢুকছে।

কোনও কারণে একটি ইঁদুর যদি মারা যায় পায়ের চাপে তবে ওই ওজনের সোনার ইঁদুর গড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অভয়ারণ্য নয়, ইঁদুরের অভয় মন্দির।

এরই সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবস্থা ওয়ালট ডিসনির স্টুডিওতে। ঈশপের গল্পের মতো ডিসনির মিকি মাউস এই শতাব্দীতে জীবজন্তুকে মনুষ্যধর্ম দিয়েছে। এই তো সেদিন ডিসনির কার্টুন ইঁদুর মিকি মাউসের রজতজয়ন্তী মহা ধূমধামে প্রতিপালিত হল।

রোজার মিলার নামক এক খ্যাতনামা গায়ক গিয়েছিলেন ডিসনি স্টুডিওতে। চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। হঠাৎ এক জায়গায় দেখলেন দরজার আড়ালে কয়েকটা অদ্ভুত আকারের জিনিস, গর্ত কাটা বাক্সের মতো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এগুলো কী?’ যে গাইড ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, তিনি বললেন, ‘দারুণ ইঁদুরের উৎপাত তাই ইঁদুরের খাচা করানো হয়েছে। এগুলো ইদুরের খাঁচা।’ ‘সর্বনাশ, মিকি মাউসের জন্মভূমিতে ইঁদুর ধরার খাঁচা? ডিসনি স্টুডিওতে ইঁদুর মারা হয়?’ চমকে উঠলেন গায়ক।

আমরা অবশ্য চমকাব না। কারণ আমরা আবাল্য মূষিকবিরোধী। আমরা পাঠশালায় পড়ে এসেছি, ‘উই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার’।

পুনশ্চ—ইঁদুরের কথা অনেক হল। অবশেষে ছুঁচো মেরে একটু হাত গন্ধ করি। এক ব্যক্তি ছুঁচো দেখে একদা বলেছিলেন, ‘বাবা, কত বড় ইঁদুর!’ ভদ্রলোক বন্ধুর সঙ্গে কার্জনপার্কে গাছের আড়ালে বসে লুকিয়ে মদ খাচ্ছিলেন। তখন রাত বেশ হয়েছে। ভদ্রলোকের বন্ধু বললেন, ‘আরে, এগুলো ইঁদুর নয়। প্রথম ব্যক্তি জানতে চাইলেন, তা হলে এগুলো কী?’ বন্ধুবর বললেন, ‘এখন তুমি বাড়ি ফিরলে তোমার স্ত্রী তোমাকে যে নামে সম্বোধন করবেন এগুলো সেই জন্তু। প্রথম ব্যক্তি ঢোঁক গিলে বললেন, ‘ও, ছুঁচো’ ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *