ঘুম (২)
ঘুমের মতো এমন বেদনাহর, শান্তিদায়ক আর কিছুই নয়। রোগী-ভোগী, শিশু-বৃদ্ধ, সুখী-দুঃখী সকলেই ঘুম চায়। গাঢ়, গভীর ঘুম মনকে প্রশান্ত করে, শরীরকে ঝরঝরে করে তোলে।
কম হোক, বেশি হোক সবাই ঘুমোয়। না ঘুমোলে চলে না। কেউ বেশি ঘুমোয়। আট-দশ ঘন্টা এমনকী তারও বেশি। সদ্যোজাত শিশুরা প্রায় সারাক্ষণই ঘুমোয়। তারা ঘুমোতে ঘুমোতে বড় হয়। ঘুমের ব্যাপারে এমন বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তির কথাও শোনা যায়, যিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য, প্রাতরাশ সেরে আবার স্লিপিং পিল খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন।
আবার অনেকে খুব কম ঘুমোন। বেশি ঘুম তাঁদের দরকার পড়ে না। ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী এঁরা নাকি রাতে তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেন না।
ঘুমের ব্যাপারে নেপোলিয়ন ছিলেন অদ্বিতীয়। শোনা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ফাঁক ফুরসত পেলে তিনি ঘোড়ার পিঠেই পাঁচ-দশ মিনিট ঘুমিয়ে নিতেন।
জীবনের সব দুঃখ, লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু মানুষকে চিরতরে পরিত্রাণ দেয়, তাই মৃত্যুর আরেক নাম চিরনিদ্রা। ঘুমও সাময়িকভাবে মানুষকে দুশ্চিন্তা, দুঃখ-ক্লেশ থেকে রেহাই দেয়।
ঘুম নিয়ে যুগে যুগে কবি ও দার্শনিকেরা ভূরি ভূরি কথা লিখেছেন। তার সামান্য অংশও উদ্ধৃত করতে গেলে সে এক মহাভারত হবে।
মনোবিদ্যা এবং ডাক্তারি শাস্ত্রও ঘুম নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামিয়েছে, এখনও ঘামাচ্ছে। অনিদ্রা রোগের রোগী পৃথিবীতে অসংখ্য।
এক অনিদ্রা রোগী চিকিৎসককে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু রাতে ঘুমোতে পারি না। পাশের বাড়ির হুলো বেড়ালটা আমাদের বারান্দায় এসে এমন ম্যাঁও-ম্যাঁও করে প্রত্যেক রাতে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ঢিল মেরে কিংবা লাঠি দেখিয়ে বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দিলেই পারেন।’
রোগী বললেন, ‘তাড়াই তো, তারপর ঘুম যে চটে যায়, সারা রাত আর ঘুম আসতে চায় না।’
ডাক্তারবাবু তখন বললেন, ‘ঠিক আছে ওষুধ দিচ্ছি।’ এই বলে কয়েকটা ট্যাবলেট রোগীর হাতে দিতে রোগী বললেন, ‘কখন খাব? রাতে শোয়ার আগে?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আরে না, না। আপনার জন্য নয়, আপনি খাবেন না। সন্ধ্যাবেলা এক বাটি দুধে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বারান্দায় রেখে দেবেন। বেড়ালটা খেলেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বে। সারা রাত জ্বালাতে পারবে না।’
ঠিক এর বিপরীত সমস্যা নিয়ে এক মহিলা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘আমার স্বামী ঘুমের মধ্যে অনর্গল কথা বলেন।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘এর খুবই ভাল ওষুধ আছে। আমি এখনই দিচ্ছি। আপনার স্বামীর ঘুম পাতলা, ওষুধটা খাইয়ে দিলে গভীর হবে, ঘুমের মধ্যে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘না ডাক্তারবাবু, আপনি ভুল করবেন। আমি আমার স্বামীর কথা বলা বন্ধ করতে চাইছি না। ঘুমের মধ্যে ও অনেক রকম ইন্টারেস্টিং কথা বলে। আমার শুনতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমার নিজের ঘুম এসে যায়, সব শুনতে পারি না। আপনি আমাকে এমন একটা ওষুধ দিন, যাতে আমার ঘুম না আসে।’
এই গল্পেরই আরও একটা দিক আছে। সকালবেলা চায়ের টেবিলে স্ত্রী স্বামীকে বললেন, ‘তুমি কালকে ঘুমের মধ্যে আমাকে যাচ্ছেতাই সব খারাপ কথা বলেছ।’ স্বামী বললেন, ‘তুমি ঠিক বলছ না।’ স্ত্রী বললেন, ‘সে কী? আমি স্বজ্ঞানে শুনেছি।’ ‘ঠিকই শুনেছ’, স্বামী বললেন, ‘কিন্তু কথাগুলো আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলিনি। চোখ বুজে ছিলাম বটে, কিন্তু সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় বলেছি।’
অনিদ্রা রোগের বহু রকম চিকিৎসা আছে। ঝাড়ফুঁক, তুকতাক থেকে ওষুধ, ডাক্তার, মনস্তত্ত্ববিদ থেরাপি। নিদ্রাকাতর ব্যক্তি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে ভেড়া গোনে, হাজার হাজার ভেড়া গোনা শেষ হয়ে যায়, তবু চোখে ঘুম আসে না। মুঠো মুঠো ট্যাবলেট, মিক্সচার, গেলাস গেলাস ঘুমের ওষুধ খায় কিছুতেই কিছু হয় না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুম আসবে না, এই ভয়ে এই দুশ্চিন্তাতেই ঘুম আসে না। এইরকম এক ভদ্রলোক দীর্ঘদিন অনিদ্রা রোগে ভুগেছিলেন, ডাক্তার ওষুধ অনেক কিছু করেও কিছু হয়নি। অবশেষে তাঁর ছেলেরা অনেক খুঁজেপেতে একজন লোককে নিয়ে আসে, সে নাকি জাদুবলে, হিপনোটিক মতে ঘুম পাড়াতে পারে।
সেই লোকটি এসে বৃদ্ধের চারপাশ ঘুরে চামর দিয়ে বাতাস করে, গালবাদ্য করে, প্রচুর অং-বং হিং-টিং-ছট এবং অঙ্গভঙ্গি করে ঘণ্টাখানেক ব্যয় করল। বৃদ্ধ চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলেন। সবাই বুঝতে পারল অনেকদিন পরে তার ঘুম এসেছে।
ভেলকিওয়ালা প্রচুর বকশিশ নিয়ে চলে গেল। কিন্তু সে যেই ঘরের বাইরে বেরিয়েছে, বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসে বললেন, ‘খ্যাপাটা বিদায় হয়েছে? আচ্ছা পাগলার পাল্লায় পড়েছিলাম বাবা।’
পুনশ্চ: অনিদ্রা বিষয়ে আমার নিজস্ব একটি সুচিকিৎসা আছে। ঘুম না এলে খাটের মাঝামাঝি থেকে সরে এসে একেবারে একপ্রান্তে এসে চোখ বুজে শুয়ে পড়ুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাবেন এবং ছ’ মিনিটের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যাবেন। মেঝেতে একটা তোশক রাখবেন, না হলে আঘাত গুরুতর হতে পারে।