ওগো বধূ সুন্দরী
অল্প বয়সে সর্বাণীর চেহারায় একটা আলগা চটক ছিল। যেটা দেখে সর্বানন্দ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরে সর্বাণীর সেই চটকটা এখন আর তেমন কার্যকরী নেই, যদিও মোটের ওপর দেখতে সর্বাণী খারাপ নন।
রং শ্যামলা হলেও যাকে বলে উজ্জল শ্যামবর্ণ, রীতিমতো ফরসা ঘেঁষা। সেই উজ্জ্বল শ্যামলিমার সঙ্গে মানিয়ে গেছে একটু চাপা নাক, পাতলা ঠোঁট, শালিক পাখির মতো উড়ু উড়ু চোখ।
নবযৌবনের ভালবাসার চোখে সর্বাণীকে সর্বানন্দের একদা যেমন অতুলনীয়া মনে হয়েছিল, এখন আর তেমন হয় না। এটা অবশ্য পুরোপুরি সর্বানন্দের দোষ নয়, সেই মায়া অঞ্জন এখন আর তার চোখে মাখানো নেই।
তাই বলে, একথা বলা উচিত হবে না যে এখন সর্বানন্দ সর্বাণীকে পছন্দ করেন না, কিংবা কুৎসিত মনে করেন।
দাম্পত্যজীবনে যেমন হয়, ধীরে ধীরে মোহ কেটে যায়। কিন্তু তাতে কোনও সর্বনাশ হয় না। ধীরে ধীরে মানিয়েও যায়। দাম্পত্য জীবন মানিয়ে নিয়েই চলে। সর্বানন্দ এবং সর্বাণী, এই দত্ত দম্পত্তির জীবনযাত্রাও মানিয়ে নিয়েই চলছে। একটু আধটু ঝগড়া বা খুনসুটি, অল্পবিস্তর মনোমালিন্য সে তো থাকবেই, তবে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে কিছু নয়।
সে যা হোক, এবার আমরা এবারকার ঘটনার মধ্যে যাই। ঘটনাটি সামান্য হলেও গোলমেলে।
সর্বাণী কোনওদিন সর্বানন্দের অফিসে আসেননি। আসার প্রয়োজন পড়েনি। সর্বানন্দ নিজের মতো অফিসে চলে আসেন, সর্বাণী বাসায় থাকেন।
সর্বানন্দের অফিসের দু’-চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব যারা সর্বানন্দের বাড়িতে আসেন, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেন তাঁদের কারও কারও সঙ্গে অবশ্য সর্বাণীর ভালই পরিচয় আছে। তবুও সর্বানন্দের অফিসে এসে গল্পগুজব, আড্ডার কথা সর্বাণী কখনও ভাবেননি। বরং বলা চলে এ ব্যাপারে তাঁর একটু সংকোচই আছে।
কিন্তু আজ সর্বাণীকে বাধ্য হয়েই তাঁর স্বামীর অফিসে আসতে হয়েছে। সর্বাণীর এক দিদি-জামাইবাবু লন্ডনে থাকেন। তাঁদের দুয়েকদিনের মধ্যে কলকাতায় আসার কথা। কিন্তু আজ দুপুরেই বাসায় ফোন এসেছে, দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে, তাঁরা এই বিকেলেই কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন। এর আগে এ খবর জানিয়ে লন্ডন থেকে তাঁরা একটা চিঠি দিয়েছিলেন, সেটাও আজ দুপুরেই এসেছে। এবং দুটোই সর্বানন্দ অফিসে বেরিয়ে আসার পর।
এর পরে যেমন হয়ে থাকে তাই হয়েছে। প্রথমে বাড়ি থেকে, তারপর পাশের বাড়ি থেকে, তারপর পাড়ার ফোন বুথ থেকে হাজার চেষ্টা করেও সর্বাণী সর্বানন্দের অফিসের লাইন পাননি। অবশেষে মরিয়া হয়ে তাঁকে স্বামীর অফিসে ছুটে আসতে হয়েছে। খবরটা দিতে হবে যাতে সর্বানন্দ সময়মতো এয়ারপোর্টে যেতে পারেন, না হলে বাচ্চা-কাচ্চা, মালপত্র নিয়ে দিদি-জামাইবাবু খুবই বেকায়দায় পড়বেন, তা ছাড়া এটা খুব অভদ্রতাও হবে।
অফিসে এসে কিন্তু সর্বানন্দের সঙ্গে সর্বাণীর দেখা হল না। সর্বানন্দ কোথায় বেরিয়েছেন, একটু পরেই আসবেন।
সর্বানন্দের যে সহকর্মী এই খবরটা দিলেন, তিনি অবশ্য সর্বাণীকে বসতে বলেছিলেন, কিন্তু সর্বাণী বসেননি। ভাগ্য ভাল চেনা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়নি, সর্বাণী অফিস থেকে বেরিয়ে এসে মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পরেই সর্বানন্দকে দেখা গেল রাস্তা পেরিয়ে আসছেন। সর্বাণীকে দেখে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তারপর সর্বাণীর কাছে সব শুনে তাঁকে বললেন ‘তুমি বাড়ি যাও। আমি এয়ারপোর্ট হয়ে দিদি জামাইবাবুদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরব।’
অফিসে ফিরে আসতে তাঁর সেই সহকর্মী বন্ধু জানালেন, ‘আপনার কাছে এক সুন্দরী মহিলা এসেছিলেন।
সর্বানন্দ বললেন, ‘হ্যাঁ দেখা হয়েছে। কিন্তু তিনি যে সুন্দরী এ কথা আপনাকে কে বলল। আপনার সৌন্দর্যবোধকে বলিহারি যাই মশাই।’
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম উনি বোধহয় আপনার স্ত্রী, তাই বলছিলাম।’
সর্বানন্দ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আপনার অনুমান ভুল নয়। উনিই আমার স্ত্রী।’