কুবেরের বিষয় আশয় – ৯

॥ নয় ॥

প্রবোধিনীকে আমি চিরকালই ভালবাসিয়াছি। ঢেঁকি শাক দুই প্রকার। এক প্রকার মাটিতে হয়—অন্য প্রকার বৃক্ষশাখায়। শেষোক্ত শাকের ডগা বড় নরম। এই শাক আমাকে সবিশেষ প্রযত্নে যোগাড় করিতে হইয়াছে। প্রবোধিনীর বড় প্রিয় জিনিস। জীবনটাকে লইয়া কত প্রকারে ছানিয়াছি। ভালবাসিবার এবং ঘৃণা করিবার এতো জিনিস জীবনে আছে আগে জানতাম না। ব্রজ কোলে আসিতে প্রবোধিনী আমার কুরূপ চেহারা যেন সুরূপ হইয়াছে-এই ভঙ্গীতে দেখিতে লাগিল। বালক ব্রজ এখন আমাদের সংসারের প্রধান আকর্ষণ। বড় ইচ্ছা, সে বড় হইয়া যেন একজন মানবদরদী চিকিৎসক হয়। আজ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিপ্লবীরা ঢুকিয়া সাহেবদের গুলি করিয়াছে। কলিকাতা তোলপাড়। এই ডামাডোলে বাজারে অনেক ইলিশ আসিয়াছিল। কিনিবার খরিদ্দার নাই। চওড়া পেটি দেখিয়া আমি একটি কিনিলাম। জীবন কত দ্রুত বদলাইতেছে।’

বুলু আরও পড়তে পারতো। পেছন থেকে কুবের জড়িয়ে ধরতে চমকে উঠল, ‘দিনের বেলা এসব কি?’

ঠোঁট ও চোখ কোঁচকালে বুলুর বয়স দশ বছর বেড়ে যায়। অনেকবার কুবের ভুরু কোঁচকাতে বারণ করেছে বুলুকে। পেঁয়াজ খেতেও নিষেধ। চুমু খাওয়ার সময় মনে হবে এঁটো কলাই বাসনের গন্ধ দিচ্ছে।

‘তোলার জন্যে—’

‘আবার শাড়ি এনেছ? নিজের একটা গরম সুট করাবে করাবে বলছ আজ কতদিন। অথচ করলে না—’

‘হবে’খন। পরে দ্যাখোতো—’

‘এখুনি?’

‘হ্যাঁ এখুনি—‘

‘পাগল।! মা রয়েছেন—সবাই কি বলবে—‘

‘পরে এসো। দেখব।‘

‘না। কত দাম নিল?’

‘বলোতো?’

‘আটান্নো ঊনষাট—‘

‘পঁচাশি—’

‘কি আরম্ভ করেছ? টাকাগুলো নয়ছয় করছ এ ভাবে-আজ অফিসে গিয়েছিলে?’

‘নাঃ! কি হবে গিয়ে।’ কি মনে হতে কুবের বললো, ‘কি বই পড়ছো দেখি।’

‘তোমার ব্রজদার বাবার আত্মজীবনী।’

বইখানা হাতে নিল কুবের। রজনী দত্তর জীবন এ সময়। লেখক ব্রজ দত্ত।

‘আজই ডাকে এসেছে।’

কয়েক লাইনের ভূমিকা।

‘রজনী দত্ত আমার পিতৃদেব ছিলেন। বাঁচিয়া থাকিলে না-হোক নব্বই একানব্বই বছর বয়স হইত। যতখানি দেখিয়াছি জানিয়াছি তিনি সৎ থাকিবার চেষ্টা করিতেন। আমাকে লইয়া তাঁহার অনেক আশা ছিল। কিছুই পূরণ করিতে পারি নাই। নানাভাবে শুধু সৎ হইবার চেষ্টা করিতেছি। পুত্র হিসাবে তাঁহাকে জানাইবার দায়িত্ব আমারই। এই গ্রন্থ পাঠে কাহারও কোন কাজ হইলে বুঝিব আমার পরিশ্রম সার্থক।

‘খাঁটি গ্রন্থকার বনে গেছে ব্ৰজদা! বিয়ালি!’

তাকিয়ে দেখল বুলু উঠে গেছে। ব্ৰজ দত্ত এখন ফকিরের আলখাল্লা পরে। দশ বারো বছর আগেও পুরো দস্তুর সাহেব ছিল। প্রথম আলাপ কলেজে। কলেজ সোস্যালে ম্যাজিসিয়ান ব্রজ দত্ত ম্যাজিক দেখাতে এসেছিল। কালো কোট প্যান্ট পরে স্টেজে নেমেছিল, হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড। পায়রা ওড়ালো সবার সামনে—আবার হাওয়া করে দিল।

সেই প্রথম দেখা। দ্বিতীয় দর্শন বই পাড়ায়। ক্লাস এইটের র‍্যাপিড রিডারের একখানা নোট বই বেরিয়েছে। নোটমেকারের নাম বি দত্ত—ব্রজ দত্ত। খুব অবাক হয়েছিল কুবের, ‘তুমি এতোও জানো ব্ৰজদা—‘

‘জানতে হয় রে। আমাদের একটা ট্র্যাডিশন আছে রে! আমাদের স্কুল থেকে আমাদের ব্যাচেই ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হয়েছিল কুমুদ রায়। তার সঙ্গে সকাল সন্ধ্যে আমার ওঠাবসা ছিল। সেই থেকেই আমি স্কলার—’

‘কোন্ ডিভিশনে বেরিয়েছিলে?’

‘রয়াল অবশ্য। তাতে কি? সঙ্গ গুণ বলে কিছু আছে না?’

কি করে লিখতে হয় জানলে, কুবের একখানা বই লিখত। বইয়ের নাম দিত ব্রজ দত্তর জীবন ও বাণী।

পাঁচটি সন্তান ও একটি বাড়ি সমেত এক বিধবার সঙ্গে ব্রজদার প্রথম বিয়ে। মহিলার গর্ভে ব্রজ দত্তর প্রথম সন্তান জন্মাল। ছেলেটির বছর দুই বয়সের সময় কুবের ব্রজদাকে ফুটপাথ থেকে দর করে পাঁচসিকের মোজা বারো আনায় কিনতে একদা সাহায্য করেছে। তখন ব্রজ দত্তর বড় দুঃসময়। ফিল্ম লাইনে হবু ডিরেক্টর। পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে সারাদিনের শেষে মাল খেয়ে বাড়ি ফিরতো। কুবের আর সেই মহিলা ধরাধরি করে ব্রজ দত্তকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতো।

সে সময় কুবের একবার বড় বিপাকে পড়েছিল। হঠাৎ সিনেমার সর্বভারতীয় চালু সাপ্তাহিকে খবর বেরোলো—মালটি মিলিয়ান রুপিজ কালার ফিল্ম ভেনচার। হিরো নিউ ফাইন্ড কুবের সাধুখাঁ—হিরোইন সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তারকা সুরাইয়া। ডিরেক্টর ব্রজ দত্ত। জানাশোনা মহলে তোলপাড়। মুখ দেখানো যায় না। পুরো ব্যাপারটাই ব্রজ দত্তর একটা বৃহৎ গুল। নিজের ব্যানারে ছবি তোলার জন্য এমন দু’চারটে গুল প্রেস কনফারেন্স করে মারতেই হয়। নাহলে ফাইনানস্ আসবে কোত্থেকে? তখন কুবের কনফার্মড্ বেকার। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে রেডিওর তেলুগু ট্রান্সলেটর—সব চাকুরিতেই এলোপাথাড়ি অ্যাপলিকেশন ছাড়ছে। কোনোটা লাগে না। রোগা হতে হতে ওজন প্রায় একশো পাউন্ড। এক রেসুড়ে বন্ধু তো কুবেরকে পেয়ে যেন স্বর্গ পেয়েছে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল রাস্তায়। তার কি আদর!

‘তুই মাইরি আদর্শ জকি হতে পারবি। চল তোকে একজন ওনারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।’ কুবেরকে নিয়ে প্রায় টানাটানি।

বুলু চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই একটা হর্ণ শোনা গেল। কুবের বললো, ‘ওই যাঃ। ভুলে গেছি—’

‘কি? আবার ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছ নীচে—তুমি যা হয়েছ একখানা!’

‘না হয়ে উপায় কি বুলু? বড় ক্লান্ত শোনাল কুবেরের গলা। এ-মাসে না হোক জনা ছয়েক জমি কিনেছে কুবেরের কাছ থেকে। কত কি বলতে হয় কুবেরের,’জায়গার আমার ত্রুটি অনেক। সুবিধে শুধু নিরিবিলি,আর দক্ষিণের হাওয়া। যে যার বাড়িটুকু করে নিলেই কোন খুঁত থাকে না আর।’

দাম? দাম বলে কিছু আছে নাকি আর। এখন কুবেরের মুখ দিয়ে যা বেরোয়—তাই-ই প্রায় দাম। কত লোক যে জমি চায় তার ইয়ত্তা নেই। ভাবতে গেলে তার মাথা ঘুরে আসে। এক একটা প্লটের দাম তার এক বছরের মাইনের চেয়েও বেশী।

আবার হর্ণ। ‘তাড়াতাড়ি কর। শো আরম্ভ হতে দেরি নেই।’

‘বলা কওয়া নেই—এখন সিনেমায় যাবো কি করে? খোকনও ফেরেনি পাক থেকে।’

‘মা দেখবে। চলো তো। নতুন শাড়ি পরেই চল।’

রাস্তায় বেরিয়ে কুবের স্পষ্ট বুঝলো আরও আগে বেরোলে ভাল হতো। তার জন্যে পৃথিবী প্রায় শেষ হয়ে আসছে। সিগারেটের বিজ্ঞাপনগুলো যা হয়েছে আজকাল শুধু দপদপ করে। কি বাহার! ট্যাক্সিতে বুলু বললো, ‘এভাবে টাকা নষ্ট করো না। কদিন পরে খোকনেরও একজন খেলুড়ে জুটবে তখন অনেক টাকা লাগবে।’

‘আজ একটা সাপ দেখলাম বুলু। আমাকেও দেখছিল।’

‘শেষ রাতে তো। আমিও দেখেছি। সাপের স্বপ্নে বংশবৃদ্ধি!’

‘শেষ রাতে নয়। আজই বিকেলে দেখলাম-–’, হঠাৎ থেমে গিয়ে কুবের বললো, ‘দাঁত পড়ার স্বপ্ন দেখলে কি হয় জান?’

বুলু চুপ করে ছিল। কলকাতা মাড়িয়ে ট্যাক্সি ছুটছে, ‘সন্তানশোক—’

‘চুপ করবে?’ তারপর বুলু বললো,’ তুমি আজকাল আর আভা বউদিদের বাড়ি যাও না?’

‘যাওয়ার উপায় নেই বুলু।’

তাকিয়ে আছে দেখে ফিরে বললো কুবের, ‘আমার যেতে মন্দ লাগে না! কিন্ত কদমপুরের সবাই এমন চোখে দেখে ব্রজদাকে, কি বলব—কেউ ভাবে স্পাই, কেউ বলে লম্পট, নয়ানরা মনে করে ভগবানের নামে জায়গা দখলের তালে আছে-তাই আমি আর মিশতে পারি না। অথচ ব্রজদা খারাপ-এ কথা আমি কিছুতেই বলতে পারি না। ভাল? তাই বা বলি কি করে!

সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে জায়গা খুঁজে নিয়ে বসতে বসতে কুবেরের মনে হল, কোথায় যেন কি করা বাকি রয়েছে—কি যেন ভুল করে ফেলে এসেছে। আজকাল সব সময় মনে হয়, কোথায় যেন ভুল হয়ে যাচ্ছে। একটা বড় গিঁট পড়েছে আন্ডারঅয়ারের দড়িতে। সেটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না।

‘মার জন্যে আমার বড় কষ্ট হয় বুলু।’

‘এখন সিনেমা দেখো তো। পরে শুনব।’

কুবের দেখল, একটা উজ্জ্বল দৃশ্যের আলো পর্দা থেকে ছিটকে দর্শকদের মুখে পড়েছে। সবাইকে দেখা যাচ্ছে। বুলুর মুখ খুবই সুদৃশ্য। টিকলো নাক, টানা চোখ, ছোট কপালের ওপর ঘন বুনোটের দুই থাক কালো চুলের মাঝখান দিয়ে একটা লাল ডগডগে সিঁথে। এই মেয়েলোকটি তো তার বৌ। ইদানীং বুলুর নাক মুখ চোখ কি তৃপ্তিতে ঢলঢল করে। অথচ বুলুর সঙ্গে বিয়ের আগে আলাপের সময় হাত ধরতেই কেমন খিঁচিয়ে উঠেছিল।

.

এই আলোতে নিজের হাত দু’খানা মেলে ধরতেই কেমন পাথরের মত হয়ে উঠল খুব ফরসা দেখাচ্ছে। আমি কুবের সাধুখাঁ। আমাদের চার পুরুষ আগে লবণের গোলা ছিল। আমার মা ঘাড় ফেরালে চিবুকের নীচে আজও নীল নীল শিরা দেখায় যায়। আমার হাতের আঙুলে কালো কালো ছোপ পড়েছে। কনুইতেও কালো ছোপ। কুবের স্পষ্ট বুঝলো এবারে তার গা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাবে। বহরিডাঙ্গা রেজিস্ট্রি অফিসে সারাগায়ে এমন কালচে ছ্যাতলা পড়া একটা লোক পয়সা চেয়ে বেড়ায় সবার কাছে। গায়ে গা লেগে যাবার ভয়ে সবাই তাকে পয়সা দেয়। লোকটাও চাইবার আগে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বিমল ডাক্তারকে আজকাল আর দেখা যায় না। বদলি হয়ে যায়নি তো।

অথচ তার হাত-পায়ের আঙুলের গাঁটে কালো ছোপ পড়ার কথা নয়। সেদিন যদি সনতের সঙ্গে শেফালির ঘরে গিয়ে না বসত! সেইসব কথা মনে পড়লেই একটা ভয়ঙ্কর ওজনের পাথর কিংবা লোহার দরজা তাকে একেবারে মাটিতে চেপে ধরে। নিঃশ্বাস ফেলা যায় না।

শেফালির ঘর থেকে ফেরার পর বেশ কিছুদিন ভয়ে ভয়ে ছিল কুবের। কেউ যদি দেখে থাকে। ক’দিন পরে এমন শরীর খারাপ হল। এমনিতেই মনে মনে কুবের মরে ছিল। বীরেন লস্কর স্যার বদলি হয়ে গেছেন। সারা স্কুল কেমন শুকনো লাগে। রাস্তাঘাট মায়া মমতাহীন। কন্ঠমণি ঠেলে উঠে একটা বেয়াড়া আওয়াজ গলা দিয়ে বের হয়।

শেষে ডাক্তার ডাকতে হল। তখন কুবেরের পুঁজ বেরোতে শুরু করেছে। কি লজ্জা। কোথাও যাওয়া যায় না। কাউকে বলা যায় না। বিষ খাবার পর শেফালিকে বাঁচিয়েছিল হরি ডাক্তার। সেই হরি ডাক্তার এসেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর মার সামনে কুবেরকে সব বলতে হল। ডাক্তার একটা লম্বা লেকচার দিল। কুবেরের কানে কিছু যায়নি। তখন পেনিসিলিন যুদ্ধের সাহেবদের জন্যেই শুধু বিলেত থেকে আসে। ভয়ঙ্কর দাম। অনেক মিকশ্চার, ইনজেকসন, ট্যাবলেট চলল। মার আদেশে কুবের রোজ ঘুম থেকে উঠে গীতার দ্বাদশ অধ্যায় পড়ে। কালীর ফটোর সামনে দম আটকে ব্লেড দিয়ে বুকের ঠিক মাঝখানটায় একটু চিরে কুবের রোজ ভোরে ফটোর ফ্রেমে খানিক রক্ত লাগাতো। লাগানোর পর আটকানো নিঃশ্বাস ছেড়ে দিত। অসুখ থেকে ওঠার পর নিয়মে থাকতে থাকতে কুবেরের গায়ে সবরি কলার ঘিয়ে রং ধরল। সব সময় ভয় হত, তার বয়সী বন্ধুদের সঙ্গে মেশার সময় মা এমনভাবে তাকাতো যেন সব সময় চোখ দিয়ে বলছে, কুবের তুমি ওদের সঙ্গে মিশছো, কিন্তু ওরা তো জানে না তুমি কি করে বসে আছ। মার চোখের সামনে একেবারে মাটিতে মিশে যেত কুবের। কাচের পিচকিরিতে গরম জলের সঙ্গে একটা হলুদ ওষুধ মিশিয়ে মা ধারা করে পুঁজের জায়গায় দিতো। একদিন সন্ধ্যেবেলা জ্যোৎস্নার মধ্যে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে গাদি খেলছিল। মা ডেকে পাতা মোড়ানো একখানা মাসিক পত্রিকা হাতে দিল, এই লেখাটা পড়ো।’

পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে মাকে এত কঠিন লেগেছিল কুবেরের। একটুও পড়েনি সে। পড়ে কি হবে। ভালো হবার জন্যে অসুখ সেরে ইস্তক কত কি করে চলেছে সে। দেওয়ালে রুটিন। পড়ার বই সব বালি কাগজ দিয়ে মোড়া, টেবিলে টাইমপিস, তার পাশেই গীতা চণ্ডী—উপরন্তু ব্রাহ্মমুহূর্তে ব্যায়াম।

মাঝখান থেকে ফল হল, তার চেহারাটা ফিরে গেল। পাড়ার মেয়েরা টালুস টুলুস তাকায়। কলেজের মেয়েদের সঙ্গে আগে ভোররাতে বকুল ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতো। তাদের দু’একজন আড়ালে পেলে আদর করে গাল টেপে। আর দিনকে দিন ভালো হবার জন্যে, নির্দোষ দেখাবার জন্যে, নিষ্পাপ কুসুম হওয়ার লোভে সে অজান্তে নিজের মুখে একটা প্রশান্ত, ভাবলেশহীন ছায়া পাকাপাকি ঝুলিয়ে দিল। বিয়ের পর বুলুই বলেছিল, ‘তোমার চোখ গরুর চেয়েও শান্ত—তাকাও এমনভাবে, যেন কিছুই জানো না। ‘

সিনেমায় এমন সময় নায়িকা দোতলার ঝুলবারান্দায় একটা আবেগের গান জুড়ে দিল। অন্তরায় তাল রাখার জন্যে দুই কলির ফাঁকে নায়িকা দু’বার বড় বড় দুটো দীর্ঘশ্বাস মিউজিক বুঝে ছাড়ল। বুলুও আবেগ দিয়ে কুবেরের দিকে তাকাল। এইসব বুলুর খুব ভাল লাগে, ‘কি ভাবছ?’

‘পোর্টফোলিও ব্যাগটা খাটের ওপর ফেলে এসেছি—’

‘টাকা ছিল?’

‘সাত হাজার।’

‘আমি আন্দাজে তোষকের নীচে গুঁজে রেখে এসেছি।’

‘তার মধ্যে ডায়েরিতে একটা ফোন নম্বার ছিল, মনে পড়ছে না—’

‘নাম মনে আছে?’

‘রেফ্রিজারেটর কোম্পানির ইঞ্জিনীয়ার এস কে বসু। এগারো কাঠা জায়গা নেবেন। হাজারের দর। সিনেমা থেকে বেরিয়ে গাইড দেখে ফোন করতে হবে আবার—’

‘হাজার-টাকা কাঠা! শেষে জানাজানি হলে ‘

‘জানাজানির কি আছে? জায়গার দাম এমনই হয়। এসপ্ল্যানেডে আগে কত দাম ছিল? খুব সস্তা ছিল নিশ্চয়—না হলে মোহনদাসবাবু গরুদের জল খাওয়ার জন্যে তড়াগ কাটাতে পারতেন?’

‘সে তো অনেক আগের দিনের কথা। হয়তো রাস্তা ছিল না, আলো ছিল না, লোক ছিল না—’

‘আমরাও তো আগে কিনেছি। রাস্তা বানাবো, আলো আনাবো—’

‘এখন সিনেমা দেখো। শুধু জায়গাজমির চিন্তা! কি হয়ে যাচ্ছো তুমি—’

আজকাল কলকাতার রাস্তায় ফাঁকা জায়গার দেখা পাওয়া কঠিন। কলকাতার বাইরে বেরোলেই এন্তার ফাঁকা জায়গা। কোথাও কচুরিপানা হয়ে আছে, কোথাও সুপুরি নারকেলের বাগান—একটু ভেবেচিন্তে সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে সেসব জায়গায় দিব্যি বাড়ি হয়, পাড়া হয়, সন্ধ্যে হলে শঙ্খ বাজানো যায়।

হাত দু’খানা মুঠো করে ফেলল কুবের। বিমল ডাক্তারের কথামত ট্রপিকালে গিয়ে দরজা থেকে ফিরে এসেছে। লাইনে হরেক অসুখের মানুষ। বোধহয় তার সেসব অসুখ আর নেই। থাকলে খোকন নিশ্চয় অন্যরকম হতো। অবিশ্যি এসব অসুখে প্রথমটা সব চিহ্ন লোপ পায়। পরে আস্তে আস্তে দেখা দেয়। তখন আর সারানো যায় না। তার মেরুদণ্ডের হাড়ের ভেতর আজকাল, কুবেরের সন্দেহ, সবকিছু বুঝি শুকিয়ে যাচ্ছে। কাৎ হয়ে শুলে মটমট করে ওঠে। খোকনের ঠোঁট খুব লাল। চোখে আলো বেরোয়, হাসলে দাঁতের ঘষাঘষিতে মিছরি চিবোনের মিষ্টি গন্ধ মেশানো মুড়মুড়ে শব্দ হয়।

অথচ সনৎ দিব্যি আজও সেসব জায়গায় যায়। এখন কুবেরের কাছে দিনকে দিন একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বুলু, মা, খোকন, তার এবং আর পাঁচটা মানুষের শরীর কিছু মাংস, হাড়, বাতাস, রক্ত, চর্বি, ঝিল্লি, শ্লেষ্মা এসব জিনিস দিয়ে বানানো। তারই মধ্যে সব জিনিসেরই এক একটা মাত্রা আছে। এর ভেতর একটু এদিক ওদিক হলেই গণ্ডগোল। নয়তো যন্ত্রটা ভালো মেকের। কত সামান্যের জন্যে আজ বিকেলে বেঁচে গেছে কুবের। সাপটা মাথা তুলে দেখছিল তাকে। কি চাই? এখানে কেন বাবু? ভাগ্যিস থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ভদ্রেশ্বর ডাকছে, শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু উত্তর দেবার উপায় নেই। তার গলার আওয়াজে যদি তেড়ে আসে। দৌড়ে কূল পাবে না।

হিরোর চেস্ট চমৎকার। আজ কুড়ি বছর এক চেহারা নিয়ে হাসছে, গাইছে, টাকা কামাচ্ছে। একই লোক দিয়ে টুথপেস্ট আর ব্লেডের বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলে হোসিয়ারি কোম্পানি হিরোর গায়ের ছেলে-মার্কা ছবি দিয়ে গেঞ্জি অ্যাডভারটাইজ করতে পারে। কালো চুল দেখিয়ে তেল কোম্পানি আর স্যুট পরা ছবি দেখিয়ে ভালো পাড়ার দর্জিও খদ্দের টানতে পারে। ভোগ্য পণ্যের এমন মালটিপারপাস জ্যান্ত পুতুল তখন হিরোইনকে জড়িয়ে ধরে বিবেকের রোলে কথাবার্তা বলছে।

বুলু বলল, ‘অমন পারবে?’

‘রোজই তো করি—’

‘উহ! তুমি তখন খারাপ খারাপ কথা বলো শুধু—’

তা কুবেরকে বলতে হয়। শরীরটা এমন বেয়াড়া। ইদানীং না চাবকালে চলতেই চায় না। অথচ সে মোটেই বেতো ঘোড়া নয়। আসলে চাঙ্গা হওয়ার কায়দা রোজ ভুলে যাচ্ছে। গান জানে না, জানলে গাইতো। সেদিন বুলুর অ্যাকাউন্টে একটা লম্বা টাকার চেক জমা দিয়ে ফেরার পথে বার বার মনে হচ্ছিল, ব্যাংক পাড়ার এই এলাহি মনোরম সব রাস্তায়, সারি সারি ঝকঝকে বাড়ির ছায়ায় হঠাৎ মোটর থামিয়ে কুবের খুব ভাবালু একটা গান ধরবে, গাইতে গাইতে স্টিয়ারিং-এ মুখ রাখবে, তন্ময় দুপুরবেলা, গাছের ছায়া নিয়ে হাওয়া নিঃশব্দে যাতায়াত করবে—বুলু শুনতে শুনতে তাতানো পথের শুকনো বকুল তুলতে খুট করে দরজা খুলে নেমে পড়বে।

এসব এত ফানি! এখন আর তাকে মানায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *