॥ বারো ॥
বড় বৌদির কি আনন্দ। তার বিয়েতে কুবের ছিল নিতবর। সেই কুবেরের আজ ভিত্ পুজো। বড়দা আসতে পারেনি। কদমপুরের জানাশুনোর মধ্যে নয়ানের বাবা কান্তবাবু এসেছেন। কিন্তু ব্রজদা বা আভা বৌদি কাউকেই বলা যায়নি। এখানকার সবাই ব্রজদাকে এমন সন্দেহের চোখে দেখে। আসলে লোকটার কোন মানে করতে না-পেরে এই অবস্থা।
বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক মা সালকের ওই বাড়িতেই একটানা দীর্ঘদিন রয়েছে। কলকাতার বাইরে এসে খাল, খোলা মাঠ, গাছপালা সবকিছু দেখে ভীষণ খুশি। বুলুকে নিয়ে পুজোর গর্তের চারদিকে ঘুরে কুবের একখানা ইট বসিয়েছিল ভেতরে। এখানে কুবেরের বাড়ি হবে। বুলু আস্তে ঘুরছিল। অল্পদিন পরেই বাচ্চা হওয়ার তারিখ। এই ‘হবে’ কথাটায় কতখানি সুখ। ভিত্ পুজোর পর সবাই সালকে ফিরে চলল। বহুকাল পরে দেবেন্দ্রলাল কিছু কথা বলে ফেলল অল্প সময়ে।
যেমন—’ইলেকট্রিক ট্রেনে বেশি সময় তো লাগল না। কদ্দিন চালু হয়েছে এ-লাইনে?’
কুবের বললো, ‘মাস দুই। আগের চেয়ে এখন প্রায় অর্ধেক সময় লাগে।’
‘সালকের ওই বাড়িতে আমার জন্ম। তোমাদের জন্ম। ওপাড়া ছেড়ে আসতে পারবে তো? ভেবে দেখো বাবা। শেষে ঝোঁকের মাথায় ঘরবাড়ি বানিয়ে টাকাগুলো মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে ফিরে এসো না।’
বাবা অল্প বয়স থেকে ভীষণ সামলে চলতে শিখেছে। বাবার তো ভীতু হওয়ার কোন দরকার নেই আর। থাকার একটা পৈতৃক আস্তানা আছে—ছেলেরা চাকরিতে। তবু কুবের এই মানুষটার কাছে নিশ্চিত একটা ছবি তুলে ধরার জন্যে বললো, ‘যায় যাবে—আবার নুতন টাকা আসবে।’
অফিসটাইমের পরের ট্রেন। লোক বলতে নেই। ফার্স্ট ক্লাসের ভেতরটায় মন—ভোলানো রঙ। মাঠে ধান কাটছে। এসব স্লিপ করে ট্রেনটা যেভাবে যাচ্ছে, মনে হবে পাতালের রাস্তা। একটুও আটকাচ্ছে না কোথাও।
দেবেন্দ্রলাল জানতে চাইল, শান্ত গলায়, ‘তোমার কত টাকা?’
‘কত হতে পারে?’
‘আমার কোন আন্দাজ নেই। আমি জীবনে টাকার মুখ বেশি দেখিনি। তোমাদের গর্ভধারিণীর সেজন্য দুঃখ ছিল অনেক দিন—’
কোণের জানলায় মা, বড় বৌদি, বুলু কেউ কারও কথা শুনছে না। সবাই একসঙ্গে বকবকম করে সুখের কথা, স্বপ্নের কথা বলে যাচ্ছে। কুবেরকে দেখেই মা বলে উঠল, ‘এক কাঠা জায়গা দিবি আমাকে। পালম বুনবো—’
মুখে বললো, ‘বেশ তো। তোমার যেখানে ইচ্ছে—যতখানি ইচ্ছে জায়গায় পালম, ঢেঁড়শ যা ইচ্ছে হয় কর।’ মনে মনে খুব হাসি পেল। আমি কুবের সাধুখাঁ। ওয়ানটাইম ভ্যাগান্ড। এখন আমি ড্রিম মারচেন্ট। এবেলা ওবেলা স্বপ্ন বিক্রি করি। স্বপ্ন ছাড়া কি। পাঁচ কাঠায় বিরাট বাড়ি হয়েও অনেকটা খোলামেলা থাকে! একটা ঘেরা বারান্দা করবেন দক্ষিণমুখো। দিনে বসবেন, রাতে শোয়া যাবে। এমন কত কি বলতে হয়। কলকাতার এত কাছে কেউ এই দামে জায়গা দিতে পারবে না। ভেতরে দেখুন ষোল ফুট চওড়া রাস্তা রাখতে গিয়ে কতটা জায়গা ছাড়তে হয়েছে। এখানে একদিন লোকালিটি হলে বেশ ছিমছাম একটা পাড়া গজিয়ে উঠবে।
মা হয়ে তুমি মাত্র এককাঠা জায়গা চাও। হরিরাম সাধুখা বাড়ির বৌ তুমি। এসবই তো তোমার মা। এত অল্পে খুশি হবে জানলে আমি আরও কত কি ব্যবস্থা করতে পারি তা তুমি জান না মা। আমার পাঞ্জাবির ইনসাইড পকেটে এখন আটত্রিশ হাজার টাকার একখানা চেক আছে। জমা দেওয়ার দেরি শুধু। দু’দিনের মধ্যে আমার নামেই টাকাটা ক্যাশ হয়ে যাবে।
কুবের দেবেন্দ্রলালকে বললো, ‘আমারও কোন আন্দাজ ছিল না বাবা। বড়দার পরে তুমি আর কোন ছেলের কুষ্ঠি করাওনি। তাহলে জানতে পারতাম কোন্ রাশি কোন্ নক্ষত্রে আমার জন্ম। যে-গণৎকারকেই হাত দেখাতে চাই—সেই বলে কি রাশি কি নক্ষত্র? কিছুই জানি নে। অথচ দেখ কেমন আন্দাজে টাকা আসে—আসতেই থাকে—আসার কোন মানে বুঝিনে—’
দেবেন্দ্রলালের মনে হল, কুবেরের মনের মধ্যে কোথায় একটা কষ্ট আছে।
‘এক এক সময় এমন বিপদে পড়ি-ঝুঁকি নিয়ে এমন সব জায়গা কিনে ফেলি, বিক্রি না হলে ডুবে গেলাম। ঠিক বিক্রি হয়ে যায় বাবা। যখন চেষ্টা করি—তখন হয় না। যখন হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি তখন সেধে: বাড়ি এসে লোকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়। ভাল জিনিস সেধে দিলে —নেবে না। খারাপ জিনিস নিয়ে গুমোর করে বসে থাক—পড়িমরি করে সবাই কিনতে ছুটে আসবে।’
সরু পিয়াসলে ছাড়তেই দেবেন্দ্রলাল জানতে চাইল, ‘তোমার কিসের দুঃখ কুবের—‘
সোজা বাবার দিকে তাকাল। কুবেরের এই শরীর এই মানুষটার দান। গুরুগম্ভীর শান্ত প্রলেপে মাখানো মুখ নিয়ে দেবেন্দ্রলালও তাকে দেখছে।
দুঃখের কথা অনেক। কটা বলা যায়।
কারখানায় ঢুকেছিল নব্বই টাকায়। ঘষাঘষিতে বাড়তে বাড়তে সেটা প্ৰায় ভদ চেহারা পেতে পেতে কুবেরের অনেক জিনিসে স্বাদ কমে গেছে।
এই যে এখন টাকা আসে, এসে পুরনো হয়ে যায়, আবার নতুন টাকা আসে—বেশ লাগে। কিন্তু কত অল্প টাকাতেই লোক কেমন গরীবের মত করুণ আভা ছড়িয়ে হাসে। তখন এত কষ্ট হয়। দুঃখ হয়। ছাপ মারা এইসব কাগজের টুকরো কতদূর আর দেবে! আমরা তো এসব চাইনি।
‘তুমি কতদিন কারখানায় যাও না। সেখানকার কাজ আছে না গেছে—তা একবার দেখ। থাকলে ভাল। তাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে ঝামেলায় না জড়িয়ে ঝরঝরে জীবন কাটাও। খুব বড়লোক হওয়ার দরকার কি!’
কুবের হাসল। আর পিছোনোর উপায় নেই। প্ল্যান হয়ে গেছে—এবারে গেঁথে তুলতে হবে বাড়িটা। নতুন নতুন জায়গার খবর আসছে। সস্তায় পুকুর। ভদ্রেশ্বর বলেছিল, ‘হোমড়াপলতার ওদিকে জায়গা রাখবেন? বিঘেতে কাহন কাহন ধান হয়। কোন রকমে চষে চারা গুঁজে দিলেই মোটা মোটা গোছ বসে যায়।’ ব্যাপারটা মন্দ না। মাথা গোঁজার জন্যে একেবারে নিজের একটা বাড়ি সম্বচ্ছরের ধান—সে যে প্রায় ষোল আনা নিশ্চিন্তি।
যেসব লোক প্রায়ই দেশপ্রেম, ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে পটাপট কথা বলে যায়—কিংবা টাকা আছে বলে মুখখানা তেলোহাঁড়ি করে বসে থাকে—তাদের সবাইকে কুবেরের একটা প্রশ্নই করতে ইচ্ছে করে, তা হল, ‘মশাইর দাম কত? মানে আপনি, আপনার বক্, টাকা পয়সা, বিদ্যেবুদ্ধি, সম্পত্তি সমেত আপনার বাজার দর কত? আপনি যে দাম বলবেন, তাতেই আমি রাজি। তবে দাম মিটিয়ে দেওয়ার পর জামাকাপড় খুলে সব কিছু রেখে দিয়ে নিঃশব্দে ভবসাগরে মিশে যেতে হবে আপনাকে।’
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে। বাড়িটা হয়ে গেলে তাদের কয়েকজনকে ডেকে এনে দেখাতে হবে।
মা বললো, ‘বড় দুঃখ ছিল—আমাদের কারও একেবারে নিজের একখানা ঘর নেই—একটু যে বসব, একা একা থাকব তার উপায় নেই—তুই একটা ভাল বসার ঘর করিস-’, কি মনে হতে মা বললো, ‘পাঁজা করে ইঁট পোড়ালে বংশ লোপ পায়। আর বাড়ি করে মাটি কামড়ালে মা বসুন্ধরা এক কামড়ে কাউকে না কাউকে তুলে নেয়। সাবধানে থাকিস। আমার বাবার দালান সঞ্চারের সময় নতুন পুকুরে আমাদের এক বোন ডুবে মারা গেল। সে পঞ্চাশ বছর আগের কথা—’
বুলু ইলেকট্রিক ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সাবধানে বসল। এবারের বাচ্চায় কুবেরের খুব ইচ্ছে ছিল না। লক্ষ্মীপুজোর কোজাগরির রাতে ডিউটি থেকে আচমকা এসে পড়েছিল কুবের। নিশুনি রাত। ঘুমন্ত বুলু। ছেলের জন্যে ও একটা খেলুড়ে চায়। সেজন্য পেটে ধরতেও আপত্তি নেই। বরং ভীষণ ঝোঁক। কুবের অনেকবার এড়িয়ে গেছে। সময় মত অঙ্ক কষে সরে এসেছে।
কয়েকদিন বহরিডাঙা রেজিস্ট্রি অফিসে কেটেছে। রাতে ফার্নেসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূর গাঁয়ে লক্ষ্মীপুজোর শঙ্খ শুনছে। কোথাও নিজেকে একেবারে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে মাঝরাতে কুবের এলিয়ে পড়েছিল। সেই সময় এই কাণ্ডটি ঘটে।
‘আমি আর কারখানায় যাব না বাবা।’
‘চাকরি নেই?’
‘তা নয়। খুব আছে। সেজন্যেই যাব না।’ আর বলতে পারল না কুবের। কারখানা জিনিসটা তার বড় কাঁচা লাগে। পাড়ায় স্টেজ বেঁধে থিয়েটারের মত। কিছুকাল পরে উঠে যাবেই। অথচ জায়গা জমি জায়গারটা জায়গায় থাকে। লোকজন আসে যায়—আবার মরে হেজেও যায। অথচ সেই জায়গা আগের মতই ধান দেয়, মাটি দেয়—কত বিশ্বাসী। এখন এক টুকরো বেচলেই কুবেরের এক বছরের মাইনে।
‘এতদিনের কাজ ছেড়ে দেবে?’
দেবেন্দ্রলাল ঝুঁকি নিতে বড় ভয় পায়। কুবেরের বড় ভাই অনেককাল চাকরি করে। সময়ে অফিস যেতে খুব ভালবাসে। ডিসিপ্লিন, পাংচুয়ালিটি—এসব কথা তার কাছে বাংলা হয়ে গেছে।
‘আমার ভাল লাগে না বাবা। আমি আর পারি না।’
‘কি পার না?’
সব বুঝিয়ে বলা যায় না। কত যায়গার জিনিসপত্র একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে ইস্পাত তৈরি হয়, ইস্পাত জল হয়ে ফোটে। অথচ যারা তৈরি করে—তারা শুধু ইনক্রিমেন্ট, অ্যালাউন্স নয়ত বোনাসের হিসেব করে মরে। চাকরিতে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উঠতে কত লোকের বুকের ভেতর আশা-নিরাশার ঢেউ উঠতে দেখেছে কুবের। বৃষ্টি, আলো, মাটির নীচের রাঙালু ইত্যাদি ভগবানের জিনিস—ভগবানের দান। আন্দাজে তাই মনে হয় কুবেরের। কেউ প্রোমোশন পেয়ে ঠিক সেরকম পাওয়ার ভাব করলে কুবেরের ঘেন্না লাগে। সবই তো সেই টাকা। অল্প টাকা, বেশি টাকা, আরও বেশি টাকা।
এই যে লোকটি তার সামনে বসে—নাম দেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁ—একদা ইনি কত সুন্দর ছিলেন। কেমন একটা ভাব মেশানো মুখ। হাতে টাকা থাকলে, বেশি টাকা থাকলে দেবেন্দ্রলালকে স্টিমারঘাটার কাজ নিতে হত না। বিশ্রাম, নিরুদ্বেগ জীবন হলে ওই সব দাগ পড়ত না কপালে।
‘অত অল্প টাকায় আমি আর পারি না বাবা—‘
‘হাত বড় হয়ে গেছে। কিন্তু যেদিন আর টাকা আসবে না কুবের—তখন? তখন তুমি কি করবে?’
‘সেজন্যেই তো লোকে বিষয়-আশয় করে—খারাপ সময়ে বিষয় থাকলে আশ্রয়ের চিন্তা থাকে না। বিষয় মানুষকে দেখে—আশ্রয় দেয়।
‘আমাদের বংশের হরিরাম সুধুখাঁ তো কম করে যাননি। আমাদের বুড়ো ঠাকুরদাদের একজন শেষ বয়সে রাস্তায় মরেন। বিষয় তাঁর বিষ হয়েছিল।’
‘বয়সকালে সাবধান হলে বিপদ নেই।’
‘তুমি তো সাবধান নও কুবের—’
‘এখন কেন সাবধান হব বাবা! সময় হলেই কসাস হয়ে যাব—’
‘তা কেউ হতে পারে না কুবের। কখন যে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে টেরও পাবে না। তখনও তুমি ভাবছো—এই বুঝি আসে, ওই এল। মাথা খুঁড়ে যাচ্ছ—তবু আর আসে না। যা সব করবে বলে ফেলে রেখেছিলে, তার সবটাই তখন বাকি। তখন টাকা না থাকলে মাথা দুলে ওঠে।’
‘তুমি এসব জানলে কোত্থেকে?’
‘তোমাদের বয়সে কাজে ঢুকে এক আরমেনি সাহেব দেখেছিলাম। আজ বাজ কিনছে, কাল লঞ্চ কিনছে, পরশু রিভাররুটে পারমিট বের করছে—সেই সস্তার আমলেও ছোকরার টাকা রাখবার জায়গায় টান পড়ত। মাঠে ঘাটে পয়সা উড়িয়ে বেড়াত। শেষে যেদিন টান পড়ল—অগস্ত্য চুমুকে সমুদ্র শেষ। অনেকদিন বেঁচে ছিল। খুব ঝষ্ট পেয়ে মারা যায় শেষ অব্দি।’
কুবের বুঝিয়ে বলতে পারত। বুলু, মা, বড় বউদি, বীরেন ওদের বউরা কিংবা বাবা—কেউ বোঝে না কি করে কুবেরের টাকা আসে। বড়দা কুবেরের জন্যে চিন্তা করে। পাছে এই সুসময়ে তার কেউ ক্ষতি করে দেয়। নগেন ভাবে, তার দাদা কুবের না কোনদিন বিপদে জড়িয়ে পড়ে। এদের বোঝায় কি করে—ছ’ হাজার ফুট ফ্রনটেজ কিনে তার পেছনে অন্তত তিনশো বিঘে জায়গায় যাওয়ার রাস্তা তার হাতের মুঠোয়। গুপ্তরায় মশায় মাপামাপি করে ম্যাপ বানিয়েছেন। এখন খদ্দের এলেই ম্যাপ মেলে দিয়ে বসে কুবের কথা বলে। এই যে দেখছেন সোজা লাইন গেছে-এটা হল ওই খাল। এই হল খালপাড়। আমাদের মেইন রোড। জিনিসের দাম কমে না, লোক কমে না। যে আসবে তাকেই জায়গা দিতে পারবে কুবের। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে এখন বলতে পারে—কোন্ জায়গাটা চাই আপনার? পুব-দক্ষিণে? ওই শিমুল গাছটার পাশে? ওখানে দর একটু চড়া—আপনার কিছু বেশি পড়বে। তবে সারাজীবন পুবে রোদ দক্ষিণের হাওয়া পাবেন। কেউ আটকাতে পারবে না।
দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘ইদানীং জায়গা জমি বাড়ি ঘর করাও বিপদ। চারদিকে হায় হায় নেই নেই। এর মধ্যে এসবে কেমন অস্বস্তি লাগে—
‘আমারও লাগে বাবা। কিন্তু—‘
খানিক পরেই শেয়ালদা। লাইনের দু’ পাশে কত ঘরবাড়ি উঠছে।
‘কিন্তু কি কুবের?’
‘তাই বলে কি লোকে জায়গা জমি ঘরবাড়ি করবে না?’ নয়ানের বাবা কান্তবাব বলেন—দাপটে না থাকলে বিষয়-আশয় থাকে না। বিষয়-আশয়ের জন্যে আমি? না, আমার জন্যে বিষয়-আশয়? কতরকম ফেরে পড়া যায় রে বাবা! ভবেশ শী তো বিষয়-সম্পত্তির আড়ৎ।
‘নিশ্চয় করবে। একশোবার করবে। তুমি আমার ছেলে কুবের। তোমাকে একটা কথা বলি। খুব বড়লোক আমাদের হওয়ার দরকার কি? এই তো বেশ আছি। যা এমনি এসে যায় তাতেই খুশি থাক।’
কুবের তো তাই থাকতে চেযেছিল। কিন্তু হরিরাম সাধুখাঁর সালকের ভদ্রাসনে ভাগাভাগি করে যেটুকু দেবেন্দ্রলালের ভাগে পড়েছে, তাতে এতজন একসঙ্গে থাকলে চলাফেরা করাই মুশকিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে পিঠ ব্যথা করত। এক কাতে ঠাসাঠাসির মধ্যে সারারাত পড়ে থাকলে গা ব্যথা হবেই। আজ মা কতখানি আনন্দ করে কুবেরের জায়গার ওপর চলেফিরে বেড়াচ্ছিল। মা সবকিছুতে গলা ডুবিয়ে ভাবতে ভালবাসে না। সে জানে ছেলের ব্যবসায় সব হচ্ছে।
শেয়ালদায় নেমে বড় বউদি, মা, বুলু দরদাম করে হরেক জিনিস কিনে ফেলল। দেবেন্দ্রলাল একখানা দা কিনতে বললো কুবেরকে। কয়লা ভাঙতে গিয়ে হাত দা—খানা অনেকদিন ভোঁতা হাতুড়ির চেহারা নিয়েছে। ডাব কাটতে হলে বড় অসুবিধে হয়। অতএব একখানা দা কিনল কুবের।
ট্যাকসিতে ওঠার সময় বুলুকে নানা অঙ্গভঙ্গী করে ভেতরে ঢুকতে হল। আর কিছুদিন পরেই হাসপাতালে যেতে হবে। বড় বউদির সুখ ধরে না। পরিষ্কার জানতে চাইল, ‘এসব করলি কি করে কুবের?
কুবের নিজের কপালে টোকা দিয়ে দেখাল।
বুলু ফোঁস করে উঠল, ‘আমি কিছু নই না? তখন পইপই করে বলেছিলাম বলেই তো তুমি লেগে পড়ে থাকলে। নয়ত কবে সব টাকা ফুটিয়ে বসে থাকতে~~’
বউর জন্যে কুবেরের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কিন্তু ইদানীং বুলুর দিকে তাকালে কুবেরের বার বার মনে হয়—বুলু মূর্তিমতী প্রতিবন্ধক। বড় সাইজের কোন ঝুঁকি নিতে গেলে ভয় হয়। ভরাডুবি হলে এই মেয়েলোকটি ভাসবে। কোথায় তাকে
খানিকটা রিলিফ দিয়ে ইচ্ছে মত কাজ কারবারে এগোতে দেবে—তা নয়, ঠিক এই সময় ফিরে মা হয়ে বসল।
কোম্পানির পুরনো ভেড়ি বরাবর চরভরাটি একশো বিঘে জায়গা এক লপ্তে—বন্দোবস্ত পেয়েছিল। কপাল ঠুকে চাষবাসে নামলে ধানের মত ধান করা যেত। বস্তা যাচ্ছে নব্বই টাকা। এক মরসুমেই তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা উঠে আসতো। বুল সেসবে যেতে দেবে না। চরের জায়গায় ধান যেমন, লাঠালাঠিও তেমন। তার ওপর ধানের লোভ বড় লোভ। কে কোথায় চোরাগোপ্তা মেরে দেবে। বুলুর সবটাতেই ভয়। কুবের আঁচলে থাকার প্রদীপ নয়। এই জিনিসটা বুলু বোঝে না।
‘তোর জন্যে কত চিন্তা ছিল। মা, আপনি তো সবসময় এই ছেলের জন্যে সিন্নি চড়িয়েই বসে থাকতেন। এখন দেখুন।!’
বড় বউদির কথায় মা খুব খানিক হাসল। কুবেরের কোন কিছুই সহজে হয় না। খুব ঘষতে হয়। কদমপুরেই তাকে কতবার আসতে হয়েছে। এখন এ-তল্লাট সব তার জানা হয়ে গেছে। হোমড়াপলতায় ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের ধার দিয়ে বিধবার সম্পত্তি কিছু পাওয়া গেছে। বয়সকালে আবাদে যেন কার বউ ছিল। তখন হোমড়াপলতায় শক্তসমর্থ একজনের রাখনি হয়ে চলে এসেছিল। লোকটা খুব ভালবাসতো। এই ভাগানো আবাদে বউকে মরার আগে সব লিখে দিয়ে গিয়েছিল লোকটা। এখন তার আগের পক্ষের নাতিরা কোর্ট কাছারি করছে। তাদের কথা-এই বিধবা তাদের দাদুর বিয়ে করা বউ নয়। মাগী অন্যের বিধবা। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অতএব হটাও। এ সম্পত্তির হক্ তাদেরই! কিন্তু দলিল তা বলে না। কাগজ বিধবার দিকেই। পরচা, দাখিলা সব এখন কুবেরের কাছে। জায়গাটা জলের দরে হাতে আসবে ঠিকই। কিন্তু দখল নিতে কিছু ঝক্কি পোয়াতে হবে। কুবের সাদুখার চোখে সারা দুনিয়াটা এখন একটা মৌজা মাত্ৰ।
হাতের আঙুল ছাড়িয়ে এখন সেই কালো মরচেগুলো কব্জিতে গেড়ে বসেছে। সারা গায়ের রঙ আগের চেয়ে অনেক কালো হয়ে গেছে। তবু কুবের খুব নিষ্পাপ চোখে, এই মাত্র ফুটে ওঠা ফুলের কায়দায় বুলুর দিকে তাকালো। কদমপুরে শুনেছে, শিষ বেরোনার আগে ধানগাছে থোড় আসে। নয়ান বলছিল, গর্ভ হয়। তখন ঘন সবুজ ধানের মাঠ কালো মেঘ করে আসে। বুলুও তেমন ভরে আছে মাসখানেক। কুবেরের শিরদাঁড়া অব্দি কি এক কাঁপুনিতে শিরশির করে উঠল। সনতের সঙ্গে সেবারে ঘোলাডাঙায় যদি না যেত। শরীরের ভেতরে কোথায় যে কি হয়ে আছে। ভাল করে দেখাতেও ভয় হয়। কি বেরিয়ে পড়বে শেষে কে জানে। হরি ডাক্তারের চিকিৎসার সময় এত ওষুধপত্রই ছিল না। কোথায় গোঁজামিল দিয়ে রেখেছে কে জানে। কিছুদিন হল চলে ফিরে বেড়ানোর সময় কুবেরের শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বাতাস যাতায়াত করে—মজ্জা নেই কোন সেখানে, শুকিয়ে গেছে—দৌড়লে তাই ভেতরকার হাড়ের চাকতিগুলো তেলের অভাবে খটখট্ করে আওয়াজ করে ওঠে। এমন একটা গভীর সন্দেহ কুবেরের মনের মধ্যে অনেককাল ধরে পাক খাচ্ছে।
ঠিক এই সময় আর একটি বাচ্চা। বুলু শুধু খুব নরম গলায় বলল, ‘তুমি কি বলবে বলেছিলে—কি একটা এক্সপিরিয়েন্স-খুব স্যাভ্—’