কুবেরের বিষয় আশয় – ৫

॥ পাঁচ ॥

চটিরাম বায়নার টাকাটা ফেরত দেওয়ার পর কথাটা বুলুকে জানানো গেল না। কদমপুরে এবারে ভালো ধান হবে। সময়মত ফাইন বৃষ্টি হচ্ছে। সকালেই কিন্তু কুবেরের গায়ে ফোস্কা পড়ার যোগাড়। ফার্নেস বেড়ে দাঁড়িয়ে তিরিশ টন গলন্ত ইস্পাতের মুখোমুখি দূরের মাঠে বৃষ্টি পড়া দেখতে ভালোই লাগে। তবে বাতাসের সঙ্গে উড়তি চুন জলো ভাবটা শুষে নিয়ে গায়ে বসছে—আর গা চুলকোচ্ছে।

এবারও অনেকগুলো টাকা গচ্চা গেল তাহলে। বুলু কেন, বাড়ির সবাই জানে কদমপুরে এবার বাড়ি-ঘর বানানোর মত একটুখানি জায়গা হচ্ছে। অথচ হচ্ছে না আসলে। মন্দের ভালো, বুড়ো সৎলোক। বায়নার টাকাটা পুরোই ফেরত দিয়েছে।

কেন যে এই ভজকট ব্যাপারে জড়াতে গেল! এই টাকার পুরী কি দেওঘর দিব্যি ঘুরে আসা যায়। তাও ঘুরবে না বুলু। জমি কিনতেই হবে—সেখানে থাকবার মত একখানা বাড়িও একদিন করতে হবে।

হাতের মরচে-ধরা আঙুলগুলো দেখে একবার ইচ্ছে হল কারখানার ডাক্তারকে গিয়ে দেখায়। কিন্তু এখানকার ডাক্তার পোড়া, কাটা আর থ্যাতলানোর ড্রেস শুধু জানে। ড্রাম বোঝাই কালি বানানো আছে। হাত পুড়তে তাতে ডুবিয়ে রাখলে ঠাণ্ডা লাগে। সরল চিকিৎসা। ভদ্রলোক ভালো ফ্ল্যাশ খেলে।

দেড়টা নাগাদ তিরিশ টন ইস্পাত ভালরকম ফুটে উঠল। গরম গরম মাল ক্রেনে ঝোলানো বিরাট বালতিতে নামিয়ে দিয়ে কুবেরের কাজ শেষ হল। একটু আগে বেরিয়ে একটা-পঞ্চাশের ট্রেনটা ছুটতে ছুটতে ধরলো। জানলার ধারে বসতে চিরকাল ভালবাসে। সাদা-শার্ট গায়ে একটা লোক সেখানে বসে। আর তিনটে জানালা তিনটে বাচ্চা আগেভাগেই দখল করে আছে।

সাদা শার্টের গায়েই বসল। লোকটার ঠোঁট, হাতের আঙুল ও গলায় শ্বেতী। কতবার শুনেছে-এসব জিনিস ইনফেকসাস নয়। তবু একটু ফাঁক রেখে বসলো। লোকটা গল্পবাজ। নিজেই আলাপ করলো। কী মনে হতে জানতে চাইল, ‘রোগটা কি?’

শ্বেতীওয়ালা যা বলল তা এই—

ঠিকাদারের সঙ্গে মাঠে মাঠে কাজ মাপত। রোদের আলো নাকি এইসব রোগে চামড়ার শত্রু। আগেকার শভার চিনির বড় বড় দানার মতো আমাদের গায়ে কালো রঙের দানা আছে। রোদে সেসব দানা জ্বলে গিয়ে তার ঠোঁটে, গলায়, হাতে এই অবস্থা।

শেষে বলল, ‘গোড়াতেই যদি ডাক্তার দেখাতাম—’

‘কি হতো?’

‘প্রথম তো সামান্য ছিল। ছড়াবার আগে স্পটে অ্যারেস্ট করতে পারতাম।’

কুবের তার আঙুলগুলো উলটে লোকটাকে দেখালো, ‘খুব দেরি হয়ে গেছে?’

‘কতদিনের?’

বিমল ডাক্তারকে যা বলেছিল তা সবই কুবের ফিরে বললো।

‘রোদ বাঁচিয়ে চলবেন—আমাদের মত লোকের বড় শত্রু সূর্য।’

তাকে ঐ লোকটার দলে টানায় কুবের শিউরে উঠলো। তার মানে কিছুদিনের মধ্যে কুবেরের হাত-পা’র আঙুল, গলা ঠোঁট সবই আস্তে আস্তে রঙ হারাবে-আর ফিরবে না।

ট্রেনের জানালা দিয়ে এদিকে শুধু কারখানার চিমনি, ছোট ছোট ঢালাই ঘরের কিউপোলা ফার্নেসের টোপর আর ইয়ার্ড দেখা যায়। কদমপুরের দিকে এখনও কারখানা যায়নি বিশেষ। মাঝে মাঝে কুয়ো খুঁড়ে পেট্রল বের করার সরকারী যন্ত্রপাতি যায় মালগাড়িতে।

বুলু, ব্রজদা ইত্যাদি পরিচিত ইউজুয়াল এলাকা থেকে তাকে একদিন না একদিন সরে আসতে হয়। আঙুলের মরচেগুলোর বয়েস এখন প্রায় চার বছর। আরও বছর চারেক পরে হয়ত তার গায়ের রঙের দানাগুলো রোদে-জলে জ্বলে ফ্যাকাসে হয়ে আসবে। তখন আর বুলুর সঙ্গে মেশা যাবে না। সব সময় ফুলহাতার শার্ট পরে থাকতে হবে। অথচ জমি দেখতে গিয়ে আজ কিছু দিন ভীষণ রোদে পুড়তে হচ্ছে। তাও চটিরামের জায়গাটা হল না।

এসপ্লানেডে এসে বাস থেকে নেমে রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকানের শোকেসে একটা নীল রঙের শার্ট দেখে কুবেরের পা আটকে গেল। দারুণ জামাটা পরলে তাকে রয়াল দেখাবে। কতকাল ফাইন জামাকাপড় পরে না। এভরি আধুলি এতো সাবধানে খরচ করে আজকাল। শুধু মনে হয় : যেদিন থেকে টাকা পয়সা আয় করে আসছে—তখন থেকেই বাজে খরচ না করে সব যদি জমাতে পারতো তাহলে আজ অন্ততঃ চার-পাঁচ বিঘে জমি ক্যাজুয়ালি কিনতে পারতো।

শার্টটা দেখে তার খুব ইচ্ছে হল, কিনে ফেলে। সেই সঙ্গে একটা লাগদার ট্রাউজার। আর একটা চকচকে কালো শু—মাথার চুল ছোট, ডিস্ট্রিঙ্গুইন্‌ড হবে, মেট্রোর সামনে থেকে জওহরলাল নেহারু রোড ধরে সে স্কেট করে এগোবে হাত দুখানা চলতি দুলুনির সঙ্গে ব্যালেন্স বিশাল পাখিল ডানার ধারায় দুলবে —বাস্ট্রাম সব বন্ধ—ফুটপাতে লোক ধরে না, তখন কুবের সাধুখাঁর মুখে একটাসির চূড়ান্ত হাসি 1 ছেলেছোকরারা বলবে কী ফিগার। কুবের জানে তার ফিগার ভালো নয়। দর্জীর মাপে চল্লিশ—কিন্তু ঢোলা প্যান্ট পরলেই তার নীচের দিকটা র‍্যাশন ব্যাগ হয়ে যায়।

কিংবা—

ফার্নেস বেডে ভিলাইর স্টিল উইজার্ড সুকু সেন, দুর্গাপুরের পি কে পাল, বার্নপুরের ভাড়াটে এক্সপার্ট মাফেট দাঁড়ানো। সালকের কুবের সাধুখাঁ ফার্নেস ডোর উঁচু করে স্যাম্পেল স্পুনে আধ বাটি গলন্ত ইস্পাত বের করে সিলিকা প্লেটে ঢেলে দিল। মাইল্ড স্টিল। ম্যারিয়েবল অ্যান্ড ডাকটাইল।

গলন্ত ইস্পাতটুকু প্লেটে পড়ে আস্তে ঠাণ্ডা হলে কুবের সেটাকে চৌদ্দ পাউন্ড ওজনের হাতুড়ির তিন বাড়িতে দু’খণ্ড করল। তারপর ভাঙ্গা জায়গাটায় ইস্পাতের দানার ফরমেশন সেন-পল-মাফেটকে দেখিয়ে বলল, ‘পারফেক্ট।’

ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দেখা গেল অ্যানালিসিসে কুবেরই ঠিক।

তখন ফুটন্ত ইস্পাতের বুকটা নীলচে আগুন চেটে চেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুবের, সুকু সেন, পি কে পাল আর মাফেট ফাইভ লেগেড় রেসের কায়দায় ভেতর দিকের পাগুলো জোড় মিলিয়ে নাচতে শুরু করল—গলায় কোরাস—‘পারফেক্ট! পারফেক্ট! মাইল্ড ম্যালিয়েবল্ অ্যান্ড ডাকটাইল।’

‘কী রে!’

আচমকা চড় খেয়ে ফিরে তাকালো কুবের। এসপ্ল্যানেড ভর্তি লোক। তার বুক—পকেটে ঘামে ভেজা সুতোয় পেঁচানো ফার্নেস গ্লাসের মাথা উঁকি দিচ্ছে। চুলে বোধ হয় ফার্নেসের চুন লেগে আছে। সামনে একখানা হাসি মাখানো মুখ, ‘খুব রেসপেকটেবল্ হয়ে গেছিস—চেনাই যায় না। সেই হ্যাগাড লুক কোথায়!

কুবের একটুও চিনতে পারল না। কোথায় আলাপ করেছিল। কলেজে? রেলে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে? স্কুলে নিশ্চয় নয়। প্ল্যাটফর্মে?

কুবেরের গা টিপে বলল, ‘মোটাও হয়েছিস। ভালো কথা, তুই নাকি জমিজমা কিনছিস খুব—কোথায় আছিস—দারুণ টু পাইস হয়!’

স্কুলেরই। সনৎ। চিনতে পেরেছে—খালিশমারির নাগেদের বড় ছেলে সনৎ। খেয়া পার হয়ে স্কুলে আসতো। কী চেহারা হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে বললো, চল-শরবত খাবি র‍্যালি সিং-এ।’

‘হসপিট্যালিটি? চলো।’

শরবত ছাড়াও আরও কিছু খেলে ভালো হতো। কিন্তু, সনৎ সুদ্ধ বিল চড়ে যাবে।

‘কত মাইনে পাস?’

‘শ’ দুই’, তিন শ’ টাকার ওপর কমিয়ে বলল কুবের। সনতের যা চেহারা হয়েছে, তাতে সত্যি বললে ওর গায়ে লাগতো।

‘অনেক! আমায় একটা কাজ দেখে দে না—শ’ দেড়েক হলেও চলবে।’

‘কতদূর পড়লি?’ দেখা হয়নি বহুকাল। কুবের আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে থাকল। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, লাল টকটকে গায়ের রঙ, হেড স্যার বলতেন—‘ফলো সনৎ-সনৎকে ফলো করো সবাই।’

সেই সনৎ! হাতের আঙুল উপুড় করে আর একবার দেখলো কুবের। আজই ট্রেনের লোকটা বলেছে, সূর্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। দোকানের ভেতরটা ছায়া।

‘আই এস-সিতে গিয়ে এমন আটকে গেলাম—ছ’টা ভাইস চ্যান্সেলার হজম হয়ে গেল—আমি কিন্তু এক জায়গাতেই।’

‘জমিজমা কিনেছি কে বললো?’

‘খবর পৌঁছয়। আমাদের বাড়ি বিজন মুহুরি ছিল মনে আছে—সে তো এখন তোদের সেই জায়গার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বসে। তোকে দেখেছে কাগজপত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে।’

‘আচ্ছা সনৎ—একদিন দুপুরের কথা তোর মনে পড়ে?’

‘কবে?’

‘ফট্টিফোরের সামারে-বীরেন লস্কর স্যারের ফেয়ারওয়েলের আগের দিন, ক্লাস এইটে, আমি আর তুই দু’জনে সাইকেল রিকশায় ফেরিঘাট চলে গেলাম—‘

‘আমার হাতে বাবার সাদা তামাক কেনার টাকা, তোর কাছে র‍্যাশন আনার ব্যাগ, টাকা-’

‘ফেয়ারওয়েলের প্রাইজ কেনার টাকাও ছিল—’

‘লরি লরি সৈন্য যাচ্ছিল—’

‘টিফিনে বেরিয়ে সেভেনথ পিরিয়ডে ফিরে এলাম আমরা।’

সনৎ হাসতে হাসতে বলল, ‘ফেয়ারওয়েলের ধুমধারে কেউ আর কিছু বলল না সেদিন। নয়তো হেড স্যার লম্বা করে দিতো।’

তারপর তো তুই দেশের বাড়ি চলে গেলি। বম্বিং-এর ভয়ে সেখানে ভর্তি হয়ে গেলি—আমরাও বছর দেড়েকের ভেতর কলকাতায়–’

‘একবার দেখা হয়েছিল—তোরা যেদিন প্ল্যাটফর্মে ট্রেনে উঠতে এসেছিস—’

‘কোথায়? আমি তো দেখিনি তোকে সন

‘সামনেই যাইনি। আমরা সেদিন দেশের বাড়ি থেকে শহরে ফিরে আসছি—তোর চেহারা কী খারাপ হয়ে গেছে—ন্যাড়া, এমনিতেই হ্যাগার্ড দেখতে ছিলি, আরও বিচ্ছিরি হয়ে গেছিস—’

‘কেন জানিস?

সনৎ অবাক হয়ে তাকাল, ‘বাঃ! এতকাল পরে কি করে জানব?’

কুবের অনেক কিছু মনে করার চেষ্টা করল। কিছুই মনে করতে পারল না। শেষে বললো, ‘আচ্ছা, সেদিন প্ল্যাটফর্মে দেখেও এলি নে কেন?

সনৎ হাসতে হাসতেই বললো, ‘এখন এতো ছেলেমানুষি মনে হবে বলেই হাসি পাচ্ছে। কেননা, এখনো তো আমি প্রায়ই যাই—ত লোক যায়, কেউ কেয়ারও করে না—’

কুবের চুপ করে তাকিয়ে আছে, আয়নার কালো শার্টটা দেখা যাচ্ছে না! সনৎ অ্যাট ইজ বললো, ‘দেশে ফিরেই হপ্তা দুই বাদে তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম-বারান্দা থেকেই তোর দাদা হাঁকিয়ে দিল—রীতিমত থ্রেটেনিং—আমি তো ভড়কে গেলাম। কী হল! শেষে ভয় হল, তুই কি এতই কাঁচা-সব বলে ফেলেছিস?’

‘আচ্ছা তারপর তোর কিছু হয়নি?’

‘কি হবে? কতবার গেলাম—’

কুবেরর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! একদিন দুপুরের কাণ্ড তার কতো কি গণ্ডগোল করে দিল।

‘যাঃ। গ্রেভ করে দিচ্ছিস চারদিক। বিয়ে করেছিস?’

কুবের মাথা নাড়ল।

‘ছেলেপিলে?’

‘একটা ছেলে—তোর? মানে, বিয়ে করেছিস?’

‘কবে! কিন্তু, মাইরি বউটাই আঁটকুড়ো—’ একটু থেমে নিজেই বললো সনৎ, ‘এক দিক দিয়ে ভালো—নো রিস্ক ফুল গেইন!‘

কুবের চুপ করেই ছিল। খালি পেটে শরবত নড়ে গা ঘোলাচ্ছে। কথা না বলে বাড়ি চলে গেলে ভালো হতো। পাহাড়ী দেশে এক রকম জন্তু আছে—তার খানিকটা কেটে খেলেও আবার গজায়—আবার খাওয়া যায়। আয়নার দিকে পিঠ ফিরিয়ে সনৎ বসে। কথা বলছে, মুখের ভেতরটা অনেক দূর দেখা যাচ্ছে—কালচে, কেমন খাওয়া খাওয়া পোকায় কাটা।

‘তবে অন্য জায়গায় যাস কেন?’

‘এক গ্লাস শরবতে এত কথা হয় না। কি খাবি বল?’

‘পকোঁড়া নে।’

টমেটোর সস্ মাখিয়ে একটা বড়া অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ভাল লাগে। হবিষ্যির পর মুখ ফেরায় না কে?’ সনৎ নিজেই বলে গেল, বিয়ে দিয়ে বাবা স্বর্গে রওনা হলেন। মা গিয়ে মামাবাড়ি উঠল। এক বউ নিয়ে কতকাল কলকাতার ভাড়াটে খোপে নতুন লাগে তুই বল?’

‘ডাক্তার দেখালে পারিস—অনেক বেশী বয়সে কনসিভ করে।‘

‘মানে?’

‘বেশী বয়সে গর্ভ হয়। কতরকম চিকিৎসা হয়েছে আজকাল—‘

সনৎ থামিয়ে দিল, ‘বেশ আছি। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি হবে—’, এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে সনৎ বললো, ‘দে না মাইরি একটা চাকরি, শ’ দেড়েক হলেই চলবে—এক কেয়ারটেকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে আছি—দো বেলা ফ্রক পরা বুড়ি—ধুড়ি মড়া বাক্সে ভরছি, পার ক্রস টাকায় তিন পয়সা কমিশন—’

‘মাইনে নেই?’

‘সে বেলায় টাইট! অ্যালউন্স-মানে জলখাবার, আর ট্রামের একখানা অল সেকশন মান্থলি। তুই বল কুবের, টাকায় তিন পয়সা হলে কত লোক মরলে তবে মাস গেলে এক শ’ টাকা হয়! আগে তবু সবাই বেলেপাথরের ক্রস দিত, আট দশ টাকার ভেতর হয়ে যায়। তারপরও কম্পিটিশন। নতুন নতুন লোক ব্যবসায় এসে স্রেফ কাঠের ক্রস পাঁচ টাকার ভেতর ছাড়ছে-নিজেদের পায়েই কুড়ুল মারছে—’

কুবের পুরো ব্যাপারটা শর্টকাট করার জন্যে বললো, ‘তবু প্রিয়জন মরলে লোকে একটা স্থায়ী জিনিসই বানায়। দেখবি কাঠের জায়গা পাথর আবার দখল করে ফেলবে। পাথরের মত আবার জিনিস আছে নাকি। কেটে কেটে নাম লিখে রাখো-শ্যাওলা পড়লেও জেগে থাকবে—’

সনৎ এসব কিছুই শুনতে পায়নি। ভোঁতা নাক দিয়ে গরম জল ছেটাতে ছেটাতে একটা ডবল ডেকার এসে শব্দ করে ব্রেক কষলো। প্যানিকি প্যাসেঞ্জারেরা পড়িমরি করে নামছে।

সেই গণ্ডগোলের ভেতরেও সনৎ শুরু করে ছিল, ‘গত চোতের আগের চোতে স্মল—চিকেন মিলিয়ে তালতলা, কিড স্ট্রীটে বেশ ব্যবসা হয়েছিল! সব মিলিয়ে পুরো সিজিনটা দেড় শ’ দু’শো টাকা মাস গেলে পেয়েছি। অবিশ্যি ফুর্তির চোটে পয়সাও ধরে রাখতে পারিনি। এসেছে-গেছে। সরকারী টিকেদারদের এমন আঠা কাজে—গত বছর অ্যায়সান টিকে দিয়ে গেল যে, সারা চোত-বোশেখ লবডঙ্কা। মেটে সাহেবদের পাড়া-বেপাড়া মিলিয়ে শতখানেক ক্রসও বিকলো না।’ কুবের শুনছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। কিছ বোঝা গেল না। তার দিকে মুখ, চোখ রাস্তা পার হয়ে মুনমেন্টে দেখছে।

মাসান্তে দেড় শ’ টাকা দেয় এমন একটা পাকা চাকরি সনতের খুবই দরকার।

‘এখন তো বর্ষার সময়—লাস্ট টেন ইয়ার্সে ফি বছর কত বড় বড় সাহেববাড়ি কলেরায় বিলকুল ফৌত হয়ে গেছে, শুধু পাথরের অর্ডার! এবার দ্যাখ কি ফাইন বর্ষা, এক একদিন কলকাতা ভেসে যাচ্ছে—তাও সিজিন জমছে না—’

‘থামবি?’

থামতে গিয়ে কুবের প্রায় চীৎকার করে উঠেছে। কাউন্টারে ম্যানেজার গোল করে তাকালো। সনৎ চমকে উঠেছে। সামলে নিতে গিয়ে মুখ বেঁকে গেল, ‘কেন?’

‘সে তুই বুঝবি নে—’

ওঃ! হিউম্যানিটি! তা তুই হিউম্যানিটি চোষ গে—’

‘হিউম্যানিটি? এসব কথা তুই জানলি কি করে?’

‘লোকে বলে। শুনি’, সনৎ থামল না, তবে—আস্তে গুনগুন করে বললো, ‘না, তুই কিনা বললি প্রিয়জন! আজকাল আবার প্রিয়জন কে রে? যে যার কাছে প্রিয়—যে যার কাছে—’

‘কেন? তোর বউ? প্রিয় না?’

‘বুঝি নে। তবু, একসঙ্গে থাকি। শেষ রাতে ঠাণ্ডায় কুকুরকুণ্ডলা মেরে ঘুমোতে দেখলে নিশ্চয় উঠে গিয়ে পায়ের দিকের জানালা আটকে দিই—ওই আর কি? বললাম না একসঙ্গে থাকি।’

‘কষ্ট হয় না কখনো?’

সনৎ মনে করতে পারলো না। শেষে অনেক মাথা খাটিয়ে বললো, ‘ফুর্তির দিনে চোলাই পেটে গেলে দেখেছি অম্বল হয়ে আমার বুক ব্যথা করে দম আটকে আসে, ভেতরের সব বাতাস বোধ হয় একসঙ্গে ওপর দিকে উঠতে চায়—

‘কিংবা কুবের—তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি নে, ছ’ আউন্স রামের পর তিন আনার গাঁজা টেনে বিকেলের দিকে গড়ের মাঠে চিত হয়ে শুয়ে থাক—দেখবি তুই খালি পিছলে পড়ছিস, পৃথিবীটা লাটিমের মত পাক খাচ্ছে, আর তুই কোনক্রমে ব্যালান্স করে শুয়ে আছিস, টাল খাচ্ছিস, পৃথিবী ঘোরার সাঁইসাঁই শব্দও শুনতে পাচ্ছিস—

‘তখন মাইরি কুবের, আমি নাকি সঙ্গের লোকজনকে বলি-আমাকে কাইন্ডলি বউয়ের কাছে পৌঁছে দিবি—একেবারে বিছানায়—তখন যদি কেউ আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে—’

‘ধ্যাত শালা-বউ, বউ—তুই!’ বলতে বলতে কুবের উঠে দাঁড়াল, ‘কথায় কথায় বিকেল কাবার করে দিলি—

‘ঠিকানাটা দে।’

অফিস ছুটির ভিড় শুরু হয়ে যাচ্ছে। এমন ট্যাঙ ট্যাঙ করে শালকে ছুটতে হবে। সেই পিলখানার ধারে। সনৎ বাড়ি চিনে চিনে গেলে বিপদ। কি বলতে কি বলবে। বাবা ঠিক চিনে ফেলবে।

রোজ ট্রামে নতুন গজানো এক স্নো কোম্পানির ভয়ঙ্কর সব বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে যায়। কত নম্বর ক্যানাল ওয়েস্ট রোড যেন লেখা থাকে। রাস্তার নামটা দিয়ে বললে, ‘লিখে নে, সতের দুই—দোতলায় উঠে বাঁদিকের ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়বি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *