কুবেরের বিষয় আশয় – ২৮

॥ আঠাশ ॥

ছেঁচে ছেঁচে অনেকটা জল তুলে ফেলা গেল। দু’এক জায়গায় বাঁধ ফাটিয়ে দিতেই বেরিয়ে যাবার আর পথ পায় না। সারাক্ষণ জল সরে যাওয়ার শব্দে কুবেরের রক্ত ঝিম ধরে গেল দু’দিনে। দুধে ভরাট ধানের শিষ যা ছিল, একটু একটু মাথা তুলে লতিয়ে উঠেছে। বুড়ো মত সেই কামলা বললো, ‘ভাববেন না, যেটুকু আছে—আপনাকে চৌগুণ ধান দেবে।’

ভোর থেকে দু’বার তাঁবুর হাতায় দাঁড়িয়ে আভা গলা চিরে ফেলে ডেকেছে। কুবের যায়নি। একবার চা পাঠিয়েছিল। ফ্ল্যাক্সে। বুড়োর কথা বিশেষ কানে নিচ্ছিল না কুবের। দাগের পর দাগ ন্যাড়া-শুধু কয়েক জায়গায় চৌগুণ ধান উঠলেও কুবেরের লোকসান সামলানোর পথ নেই। তবু ধান আছড়ানো অব্দি কুবেরকে সবকিছু বজায় রেখে যেতে হবে।

এতবড় লোকসান ঠেলে আবার মাথা তুলে উঠে দাঁড়ানো বড় কঠিন। আগে শুধ টাকা আসত। কিছুকাল শুধু যায়। মজুরি দিতে হয়, তেল কিনতে হয়। এখন আর টাকা আসে না। অথচ ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে খরচের জাল অনেকদূর বিছিয়ে ফেলেছে। স্টেডিয়ামের ভিত ঢালাইয়ের খবর পেয়েছিল। সে যে টাকা খাওয়ার হাতি।

জায়গা-জমি নাড়াচাড়া, বিক্রিবাটা বেশ কিছুদিন বন্ধ। ফিরে কি আর শুরু করা যাবে। ভাবতেই তার মাথা ঝিমঝিম করে। আগে কত বিশ্বাস ছিল—নিজেই বলেছে, আমার গা বেঁধে টাকা আসে।

নালা কেটে কামলাদের একজন ধানের গোছের ওপরে কোদাল ফেলে রেখে গেছে। সেখানা কাঁধে ফেলে কুবের উঠে এল। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল, নিজেকে কুবের যে-কোন ব্যাঙ্কবাড়ির ভারি গাঁথুনির জাব্দা দেওয়াল বলে ভাবত। কিংবা স্ট্যান্ড রোডের সেইসব বাড়ি। পেল্লায় বিরাট। লিফটের পাশের দেওয়ালে পেতলের পাতে কোম্পানির নাম লেখা থাকে। পৃথিবীর জন্মদিন থেকে এরা আছে—ভাবখানা তাই। দূরে জাহাজে মাল চালাচালি হচ্ছে। ডাঙায় বসে সেইসব কোম্পানি কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করে যাচ্ছে। নিজের ওপর বিশ্বাসটা এতই বেড়ে যাচ্ছিল—এক এক সময় কুবের ভাবত, সে বুঝি একটা কোম্পানি। যারা অফিস সাজিয়ে খরচ-খরচা বাদ দিয়েও লাভ রাখে। স্ট্র্যান্ড রোডে সেইসব বাড়ির পাশ দিয়ে ইট বাঁধানো রাস্তায় কুবের দ্যা ভ্যাগাবন্ড একসময় কতবার হেঁটে গেছে। বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় তার মাথা তখন নুয়ে যেত।

সেই স্বপ্নটা, ছবিটা গোপনে গোপনে কুবেরের ভেতরে এতটা কাজ করেছে—আগে কুবের তা একদম টেরই পায়নি। সেই চালে চলে চলে খরচের হাত দারুণ লম্বা হয়ে পড়েছে। তাঁবুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল, আভা পেছন ফিরে একমনে চুল বাঁধছে—দাঁতে ফিতে কামড়ানো—শরীরেরই কোন ঢিলে টুকরোর কায়দায় ডুমোডুমো কালো পাথরের মালাটা গলায় একদিকে ঝুলে পড়েছে। পরিষ্কার বোঝা গেল, আভার দুই কাঁধের ওপর দু’খানা ভারি পাথর চেপে বসে আছে। তাই নুয়ে পড়েছে। গালের পাশে খানিক অন্ধকার—না ছায়া, চিবুকে চাপা পড়ে আলো অমন কালচে হয়ে যায়।

অনেকদিন পরে আভার জন্যে কিছু মায়া হল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল কুবের। সিঁথি ঘেঁষে ঘন কালো চুল খুব নিয়ম মেনে নেমে গেছে দু’ধারে। চড় মেরে বেণীর ডগা থেঁতলে নিচ্ছে আভা। ওই মাথা, জোরে ভার দিলে দু’টো কাঁধই ভেঙে যাবে—এই নিয়ে একটা মেয়েলোক। অথচ চাষবাসে এই ভরাডুবির মাঝখানে একটুও চলকায়নি আভা। নিজের নতুন সুখে খুব আলতো করে পাখা মেলে দিয়ে বাতাস কাটছে। কোথাও ভার রাখতে চায় না। সে-কথা মনে পড়তেই কুবের আগাগোড়া জ্বলে উঠল। একটু আগে আভাকে বিপদ-আপদে ঘিরে রাখার ইচ্ছে হয়ে যাচ্ছিল। আর এক্ষুণি কুবের ভেতরে ভেতরে ধরে উঠল। বেলা তেমন নয়। বিকেল সেই বিকেলে আসবে। তার আগে নয়। এত আগে আগে চুল বাঁধতে বসেছে।

ইচ্ছে করলেই তুমি পার। দয়া কর আভা।

ওই পর্যন্ত। তারপর কুবের পর পর সাজিয়ে কিছুই মনে করে উঠতে পারল না। ঘচাং করে চেনা-জানা ছবিগুলো মাথার ভেতরে পর পর পড়ে গিয়েই সব গোলমাল। ভিতপুজোর দিন ট্রেনে বাবা বলেছিল, তোমার কত টাকা কুবের। আরেকবার দেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁ কুবেরকে বলেছিল, একদিন যদি টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়—তখন কি করবে?

অবিশ্যি তেমন সময় এখনও আসেনি। কিন্তু কিছু আগেই যদি এসে পড়ে। ব্রজদা সেই কবে থেকে টাকার খোঁজে প্রতিষ্ঠার লোভে নানা ফন্দিফিকির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার অসাক্ষাতে কিছুকাল হল মোহান্ত হয়েছে। অথচ সাধন-ভজনের শিবঠাকুর এখন ওই তাঁবুতে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। বাতাসে বিছানার চাদর গুটিয়ে যায়, কাগজপত্র ওড়ে—তাই হালকা জিনিসপত্তর রেলেশ্বর শিব দিয়ে আভা চাপা দিয়েছে।

আভা উঠে দাঁড়িয়ে জলের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনে তাকালেই কুবেরকে দেখতে পেত। জট-ছাড়ানো মাথার চুল থুথু দিয়ে এখন খাঁড়ির মুখে ফেলে দেবে। ভাসতে ভাসতে তা কতদূর যাবে ভাবাই যায় না। কুবের চত্বরে উঠে এল। চড়া রোদে পরীদের ফাটা ফাটা গাছ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ দুর্গেই শোবে ঠিক করল। কোদালে কাদা ছিল, পায়েও কাদা। কুবের ধাপ করে দিঘিতে নেমে গেল। পুরনো দাম সরানো একটুখানি জলে নিজের ছায়া ফুটে উঠতে কুবের সাবধান হয়ে গেল। ছায়ার আবছা জায়গাগুলো তার গায়ের কালচে শ্যাওলা ছাড়া কিছু নয়। কুবের একেবারে শিওর হয়ে গেল। সেই স্যাঙ্ ঘটনায়—এক্সপিরিয়েন্সে এ তার কি হয়ে গেল। সব ঢেকে যাচ্ছে। শ্যাওলায় ভরে যাচ্ছে কুবের। খুব সাবধানে একেবারে জলের গায়ে চোখ নিয়ে মুখের ছায়া চিনতে চাইল। কিছু দেখা যায় না। সব একাকার। চোখের মণির বাইরের সাদাটে জায়গাটুকু ছায়ায় খুঁজে বের করা কঠিন। জল স্থির করে নিয়ে বার বার দেখতে গিয়ে কুবেরের কোমরের ভেতরে মেরুদণ্ডের শুকনো হাড়ের চাকতিগুলো খচখচ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে এতদিনের জীবনে যা-কিছু জানাচেনা ছিল, কুবের যা—কিছু মনে রাখতে পেরেছিল—সব এক সঙ্গে মুছে গেল।

অথচ এখন তার সাহায্য চাই। কেউ তাকে দিঘির ধাপ থেকে টেনে তুলুক। গায়ে-পায়ে কোথাও কোন জোর নেই। কাকে ডাকবে। আমি কার ছেলে? কে আছে আমার? দিঘির জমাট দামে ফোটা ফুল দেখে একটু একটু করে মাকে মনে পড়ল। সে নেই তাকে ডাকা যাবে না। অনেক কষ্টে আভাকে ডাকল। নিজেই নিজের গলার আওয়াজ পেল না। হাপরের ধারায় শুধু খানিক বাতাস বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। দিঘির গাঢ় গর্ত পেরিয়ে পাড়ের ওপরের পৃথিবীতে কোন শব্দই পায় না। তব চেঁচাতে লাগল কুবের। এক সময় থামতে হল। নগেন কাছে নেই। মা একদম নেই। বড়দা, বড় বউদি, বাবা, বীরেন ওরা একবার কদমপুরে আসেও না। তবে আমি এ—সব কেন করতে গেলাম! কি দরকার ছিল!

রোদ ঘুরে গিয়ে মেঘের আড়ালে পড়ল। কুবের কোদল হাতে সোজা ওপরে উঠে এল। বুঝল, অনেকটা খাটুনির ভেতর দিয়ে একটানা যেতে পারলে কিছুই হারাবে না, সব মনে থাকবে। এই ভুলে যাওয়া যে কতখানি ভয়ের—সে কথা কাকে বলবে? কাছে পিঠে কেউ নেই। আভা! বুঝবে না। বিয়ে করা বউ বুলু? সেও কি বুঝবে! এদানীং মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে সে ভয়টাই সবচেয়ে আগে কুবেরের সামনে বড় হয়ে ওঠে। তখন বিছানায় আসন করে বসে। পর পর মনে করার চেষ্টা করে—কত পুরনো কথা মনে আছে তাই নিজের কাছেই যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করে কুবের। একবার বড়দার রাজা ফাউনন্টেনপেন বেচে দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে কুবের চড়কের মেলায় সাতটা তরমুজ কিনেছিল। বিচিতে-রসে মাখামাখি! তারপর ধরা পড়ে অপমানের একশেষ। সেই ফাইভ-সিক্সে কুবের একটা জিনিস ঠিক করে নিয়েছিল—মন যা চায় তাই কর, জিভ যা চায় তাই খাও—সে জন্যে এনি ডেঞ্জার ফেস করতেই হবে। তখনকার যুক্তি কুবের অনেকটা এভাবে সাজাতো—বাড়ির দরকারী কলম, বইপত্র বেচে দিয়ে কাজ হাসিলের পর মার খেতে হবে, অপমান সইতে হবে ঠিকই—কিন্তু তা কতক্ষণ? বড়জোর দু’তিন ঘণ্টা—বেশি হলে একদিন। তারপর তুমি তো ফ্রি!

ক’দিন আগে দুর্গের ধাপে বসে কুবের এইভাবে একটু একটু করে মাঝরাতে পুরনো দিনের কথা মনে করে ফেলছিল। এইসব হারানো আঙটা ধরে কুবের যে—কোন উপায়ে সব ভুলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে চায়! চেঁচিয়ে গলার আওয়াজ চাল রাখতেই হবে। কথা বলার জন্যে কোন্ ঢঙে টাগরায় জিভ বুলোতে হয়, নিঃশ্বাসের জার্নি আটকে দিতে হয়—তা কিছুতেই ভুললে চলবে না। মনে রাখতেই হবে।

এই এখন—এখনকার লোকজন, টাইম, বিপদ-আপদ, ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে নিজেকে যে-কোন উপায়ে সেফটিপিন দিয়ে গেঁথে রাখতে হবে। তাই এখনকার কোন কাজে মাথা অব্দি ডুবে যেতে হবে, জড়িয়ে পড়তেই হবে। হাতের কাছে সেরকম কিছু না পেয়ে কোদাল কাঁধে মেদনমল্লর দুর্গে ঢুকে গেল। ছাদ নেই বলে ওপর থেকে যা কিছু আলো খসে পড়ছে। নীচে পড়ে তার ধার মোটামোটা দেওয়ালের আড়ালে অনেকটাই ক্ষয়ে গিয়ে যে-কে সেই অন্ধকার।

বেগুনী রঙের ফুল না কুঁড়ি ধরে আজও ঝাঁকড়া আকন্দ গাছটা দাঁড়িয়েছিল। কুবের হোঁচট খেয়ে তার ওপরেই পড়ে গেল। অন্ধকারে অন্ধ রাগে কোদাল হাতে উঠে দাঁড়াল। এখানে একদিন আভা তাকে পেয়েছিল। মেয়েমানুষটার গা ধরে ধরে কুবের সেদিন উঠে দাঁড়িয়েছিল। সেদিনও দুর্গের এত গভীরে তার আগে কোনদিন তারা আসেনি। মেঝের ছালবাকলা উঠে গিয়ে এখানে সেখানে নীচু। ঠিকমত দাঁড়ানোই যায় না।

আবার সেই ভয়টা চেপে বসার মুখে মুখে, চেনা-জানা সবকিছু মুছে যাওয়ার ঠিক আগে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে কুবের আকন্দগাছটায় কোদাল বসিয়ে দিল। যে কোন একটা একটানা খাটুনি দিয়ে এখানকার টাইমের সঙ্গে যে কোন রকমে নিজেকে গেঁথে রাখতে হবে। নইলে সব ভুলে যাব। আর এক কোপ বসাল।

নরম ডালপালা নিয়ে নির্দোষ গাছটা ঢলে পড়ল। আকন্দকে বিশ্বাস নেই। একটুখানি গোড়া থাকলে তা থেকে ফিরে আবার পাতা বেরোয়, ডাল বেরোয়। মাটির কত গভীরে যে এরা শেকড় পাঠায়! এই অন্ধকার থেকে গাছটাকে একেবারে মুছে দিতেই কুবের আর কোদাল থামালো না। এক একবার শেকড়ে আটকে যায়। কোদাল ছাড়িয়ে নিয়ে দ্বিগুণ জোরে বসিয়ে দেয়। কোপাতে কোপাতে খানিকক্ষণের ভেতর বেশ বড় একটা গর্ত করে ফেলল। জায়গাটা ঠাণ্ডা। সদ্য সদ্য মাটি তোলা জায়গার গভীরে দাঁড়িয়ে কুবের বুঝল এ-জায়গা আরও ঠাণ্ডা। তার ভেতর প্রায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা যায়। আগাগোড়া মাটির একখানা শীতল খাট। কোপানো মাটি কি ঠাণ্ডা। কতকাল ওলট-পালট হয়নি।

দূর-জলের জেলেদের বড় নদীর জায়গা ভাগ করে নেওয়া আছে। সীমানা বোঝাতে তেলের বড় বড় ফাঁপা ড্রাম ভাসানো। তার নীচে নীচে জালের সুতো আটকানো। লঞ্চঘাটা পেরিয়ে খানিক দূর অব্দি এসব দেখা যায়। তারপর আর নেই। এদিকে শুধ নদী, জল দেখে দেখে আভার চোখ পচে যাওয়ার দাখিল। তবু আজকে একঠায় বসে এসব দেখতে দেখতে তার সামনেই পৃথিবী হরেক আলোতে ভরে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, এইমাত্র জীবন শুরু হল। কোত্থেকে সারা শরীর যে এত ভরাট হয়ে আছে তা নিজেই জানে আভা।

সামনের জলায় কতক পানা বাতাসের ধাক্কায় একপাশে পুরু হয়ে জমা হয়েছে। তার ওপরে একটা কালো বিরাট সাপকে মাথা তুলে দুলতে দেখল। অন্যদিন হলে চেঁচিয়ে উঠত। আজ চুপ করে গেল। এসব জিনিস, জলের ধারে ধারে কাঁকড়ার গর্ত, ইঁদুরের পথ, কালকেসুন্দির বেঁটে ঝাড়—সবই আজ আভা আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে চায়। এখানে ঝড়-বাতাস, আলো, শব্দ উঠলে-এইসব ছুঁয়েই একেবারে সোজা আকাশে উঠে যায়। এইখানে সে মা হবে।

কালাচ নয়ত ক্ষয়ে গোখরো। বয়স হয়েছে। ফণাটা আরেকটু উঠতেই আভা পরিষ্কার দেখল, একটা বড় ধোঁড়া সাপকে লেজে পেঁচিয়ে মরণ পাক দিচ্ছে। এবার গুঁড়িয়ে ফেলবে। ধোঁড়াটা নেতিয়ে যেতেই তার কোমর কামড়ে ধরল মুখে—মাথাটা তুলে সাঁতরে এসে পাড়ে উঠে মরা সাপটা রাখল—তারপর সেখানে বসে বসেই হাঁপাতে লাগল গোখরোটা।

আভার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—’আহা।’ কার জন্যে বললো, নিজেই বুঝে উঠতে পারল না। মরা ধোঁড়াটা—না, ক্লান্ত গোখরো—কার জন্যে। আজ এমনভাবে সব কিছুর জন্যে তার মন করুণায় ভরে যাচ্ছে। অথচ এই সাক্ষাৎ যম তার তাঁবুর শ’খানেক গজের মধ্যে বাসা বেঁধেছে—একথাটা এখুনি কুবেরকে জানানো দরকার।

ঠিক তখনি তার নাম ধরে ডাক শুনলো—‘আভা।’

দুর্গের চত্বরে মানুষটা দাঁড়ানো। আভা সঙ্গে সঙ্গে উঠলো না। আজ দুপুরে দু’জনের কেউই খায়নি। শোয়নি। ভোর থেকে নানারকমে ডেকেছিল কুবেরকে। ধানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুবের কোন সাড়া দেয়নি। সকাল থেকে রান্না কম করেনি আভা। তারপর দেখল কুবেরের চেয়েও বড় কিছু তার নিজের ভেতর থেকে উঠে তাকে ভারী, গম্ভীর করে দিচ্ছে।

সব ভুলে যাওয়ার ভয়ে কুবের শেকড়সুদ্ধ আকন্দগাছটা উপড়ে ফেলেছে। সেখানে এখন গর্ত! ভেতরে শুয়ে পড়া যায়। তারপর টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে জলার সামনে আভা এক মনে বসে আছে। সব মনে রাখার জেদে আভাকেও ব্যস্ত রাখা চাই।

রোদ নিবে যাবে খানিক পরে। যে ক’গোছ ধান দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের থোড় ফেটে বেরোনো শিষের ডগায় হলদে ছোপ ধরতে শুরু করেছিল। আলোও পালটাচ্ছিল। তার মধ্যে আভা ভীষণ আস্তে বেশ দুলে দুলে এগিয়ে আসছে। সুখে ভাসলে লোক এমন করে।

‘কি বলছ?’

মোটেই তেরিয়া নয়। অন্য কোন কথার ভাবনা আলগা হয়ে ঠোঁটে ঝুলে আছে। হঠাৎ দেখলে পাতলা একটুখানি হাসি বলেই মনে হবে। চোখ অন্যদিকে ফেরানো।

কুবেরের মনে পড়ল, সে দাগী মানুষ—একথাটা নিজেই আভাকে বলে ফেলেছে। আলো সরে যাওয়ার সময় হয়েছিল। পরিষ্কার নীল আকাশে চাঁদের আগাম জলছাপ আবছামত হয়ে ফুটে উঠল। ‘এখানে একটু বসবে?’

কাল পরশু পূর্ণিমা লাগবে। কারও অপেক্ষা না করে কুবের নিজে নিজেই পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। আজ এতখানি আদরেও বিশেষ সাড়া না দিয়ে আভা চুপচাপ কুবেরের পাশে বসে গেল।

আভা দ্বীপে থেকে যাওয়ার কথা বলছে না। কোথাও চলে যাওয়ার কথাও না। কুবের বুঝলো, জীবনে অন্তত একবার-এই প্রথম, সে নিজে নিজেই তার মুখের ওপরকার নিষ্পাপ ছাপটা—মুখোশও বলা যায়-খানিকক্ষণের জন্যে একটানে তুলে ফেলতে পেরেছিল। খুব সত্যি—এই পাপহীন খোলসটা তার মুখের মাংসে ভিখারির গায়ের জামা হয়ে কেটে বসে গিয়েছিল। আলাদা করা যাচ্ছিল না।

ছাল ছাড়ানো আদত কুবেরকে আভা তাই কয়েক মিনিট দেখতে পেয়েছে সেদিন। কুবের বলতে শুরু করলে রেখে ঢেকে বলতে জানে না।

‘রেলেশ্বরকে আনতে গেলে কেন? বেশ ছিল ব্রজদার কাছে—’

‘আর কি আনার ছিল।’

‘লোকটাকে তো পথে বসিয়ে দিয়ে এলে।

‘সে মানুষ নয়! কোন একটা পথ বের করে নেবেই। আমার আগে থেকেই তাকে চেনো তুমি।’

দুর্গের ভেতরে ঢুকে কতক্ষণ কোদাল কুপিয়েছে তার ঠিক নেই। দাঁড়াতে বসতে দম পাচ্ছিল না। এখন হাওয়া দিতে কুবেরের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল।

কুবেরের প্রথমবারের চুমোয় আভার মনে হয়েছিল, বৃষ্টির পর সদ্য ফোটা ফুলে এমন গন্ধ থাকে। তাড়াতাড়িতে কত এলোমেলো করে তার মুখে ঠোঁট লাগিয়েছিল। বেরোবে বলে ব্রজ পুকুরে নেমেছে। সেই ফাঁকে। তখনও কুবেরকে নিয়ে আভা কিছুই ভাবেনি। কিসের থেকে কি হয়ে গেল। এখন এ মানুষকে ফেলে কোথাও যাওয়াও যায় না।

ছায়ায় ছায়ায় কামলারা টান টান হয়ে পড়ে আছে। বেশি বেলায় বেশি খেয়ে সর্বাঙ্গ অবশ।

টাকা-পয়সা হওয়ার পরেও কুবেরের মুখে সেই গন্ধ পেত আভা। দ্বীপে এসেও পেয়েছে প্রথম প্রথম। কিছুদিন এমনভাবে তার মুখে চেয়ে থাকে কুবের-চেনা মানুষকেও তখন চিনে ওঠা যায় না। এখন কোথাও যদি সেই ছাপ খুঁজে নিতে হয় তবে তাঁবুর ভেতরে শোয়ানো পাথরের শিবেই শুধু তা পাওয়া যাবে। আজই সকালে খাবার করে কুবেরকে ডেকে ডেকে তাঁবুতে ফিরে গিয়ে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে আভা।

কারখানা গাঁয়ের শিবতলায় বেলপাতার ডাঁই সরিয়ে রেলেশ্বরকে বিশেষ দেখা হয়নি কোনদিন। তাঁবুর ভেতরে শুয়ে শুয়ে কালো পাথরখানার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলে সিধে একবারে বুকে বিঁধে যায়।

ঘোলাডাঙার কথা। শুনতে শুনতে কুবেরের জন্যে কষ্ট হয়েছিল আভার। কি বা বয়স ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, ‘কুবেরকে এখুনি বলা দরকার একটা বিরাট গোখরো তাঁবুর গাায়েই বাসা বেঁধেছে। শুরুও করে দিল, ‘তাঁবুতে বুঝলে—’

‘আজ আর তাঁবুতে নয়। একটু পরেই জ্যোৎস্না বেরোলেই তোমার বিছানা এই চত্বরে এনে দেব।’ কতকাল পরে আভাকে জোরে চুমু খেল। এমন স্বাদ হয়েছে আভার-জানা ছিল না। আপসোস-আপসোস বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। সময় বুঝে বুনো দুধলি ফুলের গন্ধও উঠেছে। কুবের বললো, ‘আজ আর তোমায় ছাড়ছিনে।’

আভার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কুবেরের দ্বীপে এসে গোড়ায় গোড়ায় গন্ধ ছড়ানো ওই দুধলি ফুল জ্যোৎস্না বেরোতেই বিছানায় ছড়িয়ে দিত। তখন নোঙর-করা লঞ্চের পাটাতনে বিছানা থাকত। এতদিন মনে হয়েছে সেসব দিন কি আর কোনদিন ফিরে আসবে? যা যায় আর আসে না। তাই জানত আভা।

‘আমি তখন বুঝতাম না বিশেষ। বিশ্বাস করবে না তুমি—একদম না বুঝেই আমি শেফালীর ঘরে যাই। তখনকার দিনে ওই বয়সে কি আর বুঝতে পারে একটা ছেলে।’

‘সেই থেকে তোমার মুখের ছাপ পালটে গেল! অন্য একটা মুখোশ এঁটে বসে গেল তোমার মুখে!’

‘আজও আমার মুখের সঙ্গে মিশে আছে। তুলতে পারিনি। কেমন পাপহীন, নিষ্পাপ–কোন ভাব ফোটে না—’

‘তোমার ছোট ভাই নগেন বলেছিল—’

‘গরুর দৃষ্টি আমার চোখে—ভাবলেশ নেই কোন।’

‘কাছে এসো তো—ভালো করে দেখি একটু’, কুবেরকে প্রায় টেনে নিয়ে অনেকক্ষণ একটা চুমো চুপচাপ তার ঠোঁটে চেপে রাখল আভা, ছেড়ে দিতে দিতে বললো, ‘হাসালে তোমরা।’

ততক্ষণে গাঢ় লাল একখানা চাঁদ জায়গামত ঠেলে উঠেছে। প্রায় গোল। সারাটা নদী সাদা কাগজের চেয়েও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

‘একটা কথা বলা হয়নি কুবের। আজ ঠিক তাঁবুর কাছেই বিরাট একটা—’

‘পরে বলবে। তোমার বালিশটা নিয়ে আসি শুধু।’

কুবের ছিটকে তাঁবুতে চলে গেল, বালিশ হাতে বেরিয়েও এল। বিকেল থেকেই আভার ডান চোখ ফলাচ্ছিল। গোখরোটার কথা কিছুতেই বলা হচ্ছে না। এখন ওরা রাতে বাতাস খেতে বেরোয়। আচমকা লেজে না পড়লেই হল। দেখতে হবে না তাহলে। দিঘির পরীরা নিশ্চল। কামলারা খরগোশের মত কোন একটা নরম জীব আগুন ঘিরে বসে পোড়াচ্ছে। সবকিছু দেখে আভার স্থির বিশ্বাস হল, সুখ তাহলে কখনো-সখনো ফিরেও আসে।

এতদিন পরে কুবের যে তাকে নিয়ে কি করবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। কোনদিক দিয়ে এগোবে। আদর করতে করতে বলে ফেলল, ‘তোমার সবটুকুই মধু।

ঘাড়ের ওপরে শক্ত চুমু থেকে নিজেকে অনেক কষ্টে খসিয়ে নিল আভা, ‘তবে যে এতদিন মুখ ফিরিয়ে ছিলে বড়—’

‘কোথায়?’ কুবের কোন তল পাচ্ছিল না। একদম কোথাও থামতে পারছিল না।

‘এমন কঠিন করে তাকাতে। আমিও যে একটা মানুষ তাও ভুলে বসে ছিলে।’ কুবেরের দু’হাতের খিল খুলে কোনরকমে গলা বের করে নিল আভা, এসব বলে সুখ হচ্ছিল তার, ‘কি করে একা একা তাঁবুতে কাটালাম—খোঁজও নাওনি তুমি—’

কুবের আবছা কিছু কথা বললো। আমি নম্বরী লোক আভা। মেয়েলোকটি কিছ শুনতে পায়নি বোঝা গেল। তাহলে কি আমার গলায় কোন কথা ফুটছে না। সে কিরে বাবা। এ রোগের তো নাম জানি না। বয়স, কষ্ট আসলে কোন দাগই ফেলতে পারেনি আভার মুখে। কদমপুরে গোড়ার দিকে আভা বলেছিল, খালপাড়ে সন্ধ্যে সন্ধ্যে একা মাছ কিনতে গিয়ে দেখি—জ্যোৎস্নার মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে—একটা লোকও নেই—পাকুড়তলায় দাঁড়ালাম। এতদিন জানতাম চাঁদ হলদে রঙের। তালগাছের সারির মধ্যে চাঁদ নেমে এসেছে। দেখলাম—প্রায় হাত দিয়ে ধরা যায়। জানো কুবের, এতদিন জানতাম চাঁদ হলদে রঙের। কিন্তু দেখলাম তা নয়। দু’ইঞ্চি পুরু করে নীল মাখনে চাঁদ মাখানো। আঙুল ছোঁয়ালে ডেবে যাবে। এমন একটা কঠিন ভাবনা থেকে বাঁচানোর জন্যে কুবের সেদিনই প্রথম আভাকে শক্ত করে ধরে চুমো খেয়েছিল। ব্ৰজ দত্ত তখন সেপারেট কেলির পুকুরে চান করতে গেছে।

মেয়েলোক একবার ভালো লেগে গেলে পুব-পশ্চিম ঠিক থাকে না। কুবের তাই এদিক থেকে হামলে পড়ে বাঁধানো চত্বরে বেমক্কা গুঁতো খেয়ে কি পালটে আরেক সাইড দিয়ে পিষে ফেলতে চাইল আভাকে। অচেনা সুখে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে আভা একবার হারিয়ে ফেলেছিল। তাই এবার এসবে তার কিছুই হচ্ছিল না। কিছুতেই ভুলতে পারে না আভা, কত সন্ধ্যে—কত বিকেল বিফলে গেছে। কুবের ফিরেও দেখেনি। সেই এক কথা শুধু দয়া কর। তুমি ইচ্ছে করলেই পার।

অথচ এই লোক প্রায় বালক বয়সে মেয়েমানুষের বাড়ি গিয়ে উঠেছিল। আভা বুঝে গেল, ঠিক এখনই পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে—কুবেরের মুখে ভাব ফোটে না কোন—কেননা, মানুষটার মনে কোন ভাব নেই। একটা ভাব ঠিকই ছিল কোনদিন। কিন্তু সেখানে নিজেই বা অন্য কেউ ধাঁই করে একখানা আধলা ইঁট তুলে মেরেছে—তাই ভাবের জায়গায় শুধু একটা থ্যাতলানো ব্যথা চুপ করে পড়ে আছে।

‘আঃ। কি হচ্ছে। এখানে হাটের মধ্যে আমি পারি না—’

আসলে, আভার শরীর বইছিল না। তবু কেউ একজন তাকে আঁকড়ে ধরে উঠে আসতে চাইছে—নিজের শরীরটা ঢেলে দিলেই লোকটা আসতে পারে—এই বা কম কি। এ পাওনা সে কতদিন পায়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুবের তাকে পাঁজাকোলে তুলে নিল।

দুর্গের ভেতরে যেতে যেতে আভা বুঝল, আজও জ্যোৎস্না আছে। লঞ্চের ডগা থেকে কুবের তাকে এমন জ্যোৎস্নার মধ্যেই পাঁজাকোলে তুলে এনেছিল একদিন।

এমন সময় পুরুষ লোক টলতে থাকে। আভার প্রায় কিছুই হচ্ছিল না। একবার বলা দরকার, কুবের আজ আমি দুর্গে তোমার কাছে থাকব। তাঁবুর কাছেই সাপ বাসা করেছে। আজই বিকেলে দেখলাম। ভীষণ একটা দুশ্চিন্তা খরখর করে তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

এখন যদি আমি সব ভুলে যাই—তবে কোথায় যাব। কোন জায়গা দিয়ে শুরু করব। যেসব কথা মুখে আনা যায় না—তাই কিছু আভাকে বলতে বললো। শুনলে বেগ হয়।

আভা বললো ঠিকই—কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না—এসবের কি দরকার? আমিই কি যথেষ্ট না? কুবের আবার বলতে বললো।

দূর থেকে লোকে এইভাবে সবটুকু জোর দিয়ে সদর দরজা আটকাতে যায়। তাতে যদি ব্যথা লাগে লাগুক—তবু খিল সবখানি জোর দিয়ে আটকাতেই হবে। আমার নাম কুবের সাধুখা। এ ছাড়া এখন আমি আর কোন রাস্তা পাচ্ছি না। আমি সব মনে রাখতে চাই।

তখন মেদনমল্লর দুর্গ একচাপ স্তব্ধ স্তূপ হয়ে আভা কুবেরকে ভেতরে নিয়ে স্থির হয়েছিল। কুবের জানে পৃথিবীর নিয়মে এখন তার ফুরোনো চলবে না। আগে আভা ফুরোক। তারপর। কিন্তু শরীরের নিয়মে তার এখনই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। পরে কার কখন শেষ হবে তা দেখার কথা না। সেইজন্য কুবের এসব জায়গায় মনে মনে ফার্নেস ডোরের ফাঁক দিয়ে গলন্ত ইস্পাত দেখে। চোখে নীল চশমা, হাঁ করলে মাড়িতে প্রচণ্ড আগুনের হল্কা লাগে। মনটা ভুলিয়ে রেখে আভার জন্য অপেক্ষা করে। এইভাবে কোন কোনদিন বুলুর জন্যও থেমে থাকতে হয়েছে তার।

কুবের তখনও নামেনি। ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে জ্যোৎস্না-ধোয়া আকাশ এই দুর্গের চত্বরে এসে পড়েছে। মেদনমল্লর ফাঁকা বাথানের গায়ে বাতাস পেয়ে ঝাঁকানো পেয়ারাগাছটা আনতাবাড়ি দুলছে। তার পাতার খস-খসানিতে এই নিঃশব্দ গাঁথুনি ঘেরা শূন্য দুর্গ ভরে যাচ্ছে।

আভা বললো, ‘তুমি কিন্তু বুলুকে খুব ভালবাস—‘

গায়ে গা লেগে যে আত্মীয়তা হয়—তা কত সামান্য। ভুলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে শ্যাওলা পড়া কুবের এ পথে এগোচ্ছিল। থেমে গিয়ে বললো, ‘ও কথা কেন আভা?’

কুবেরের ভারের বাইরে এসেও আভা শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ, শুয়ে শুয়েই বললো, ‘তাতে কি হয়েছে। বুকে হাত দিয়ে বল—তাকে তুমি ভালবাস না?’ এইমাত্র পুরোপুরি ভরে এসেছে। কুবের যে কত রকমেই জানে। এমন ঝাঁ ঝাঁ করে ধরিয়ে দেয়। তাই একটু আগে আভা ফস করে ধরে উঠেছিল।

‘হ্যাঁ বাসি।’ আরও কিছু কথা কুবের বলতে পারত। কিন্তু আভার দিকে তাকিয়ে বুঝল, বলা না-বলা দুই-ই সমান। আমি তো তোমার মত শুধু একজন পুরুষকে স’ল করার জন্যে পৃথিবীতে নামিনি। আমার গায়ে শ্যাওলা ধরেছে ঠিকই। আমি ইনভাইট করিনি। আপনা-আপনি এসে গেছে। আমার কোন হাত ছিল না তাতে। আমি অন্য রুটের লোক। তুমি এলেও যা—না এলেও তাই। আমার বাবা, আমার ভাইরা—এদের নিয়ে আমি দুপুরে ঘর অন্ধকার করে ভরাট ঘুম দিতে চাই। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে সবাই আনন্দে থাকতে চাই, কিছু ভাল কাজ ইচ্ছে হলে করতে চাই। দেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁ নিশ্চিত দীর্ঘজীবন পাক—তাই আমার একমাত্র চেষ্টা। নগেন নির্ভাবনায় আনন্দ করুক—বীরেনের খুশিতে কাটুক—তাই আমার এইম্। সব গুছিয়ে আনছিলাম-তার মধ্যে মাকে রাখা গেল না। এজন্যেই আমি টাকা আয় করতে নামি। এর ভেতরে ভালবাসার জন্যে আমার টাইম কোথায়! বুলুই বোঝে না—আর তুমি তো আভা!

এমন করে শুয়েছে আভা, পেট বোধ হয় অল্প একটু ফুলেছে—তার একদিকে নরম একটা ভঙ্গী করে প্রায় প্রতিমার বুক, গলা, চ্যাটালো কাঁধ-অন্যদিকে আলাদা করা যায় এইভাবে বাতাসে এক জায়গায় শাড়ি কিছু ডেবে গেছে—দু’ধারে দু’খানা পা। প্রায় এমন আলাদা আলাদা করেই কুসুম পুতুল দেখে—বিরক্ত হলে তাদের হাত, পা মুন্ডু হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে।

মেয়েলোক শুয়ে পড়লে তার মধ্যে কুবের কখনো কোন মানে পায় না। এত পলকা লাগে।

‘তুমি তার কতটুকু জান।’

দশ ঘোড়ার সাকসন পাইপ সোঁসোঁ করে জল টেনে নিয়ে বাঁধের বাইরে ক’দিনই একটানা উগলে দিয়েছে। রবার, তারের জাল আর ফাইবার দিয়ে বানানো নামী কোমপানির পাইপ সব সময় ঢেঁটিয়া ভঙ্গীতে জলে নামে। একেবারে অবাধ্য, ঘাড় মোচড়ানো ঢঙ।

‘আমি ছাড়া কে জানবে আভা—’, বলতে বলতে কুবের বুকে বুক রেখে আগাগোড়া জড়িয়ে ফেলল। বেকায়দায় শুয়েছে বলে কুবেরের যাতে চুমো খেতে অসুবিধে না হয়—সেজন্যে আভা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের মুখ খানিক তুলেও ধরেছিল। ঠিক করেছিল, কুবেরের পাগলামি শেষ হলেই বলবে—তুমি কামলাদের দিয়ে কাল ভোরেই সাপটাকে খুঁজে বের করে মারবার ব্যবস্থা করবে।

তার বদলে নিজের ঠিক নাকের ওপরেই কুবেরের মুখখানা, লালচে চোখ একসঙ্গে দেখতে পেল। আভা পুরো ব্যাপারটা হালকা করে দিতে হাসতে যাচ্ছিল। বুকের ওপর লোক নিয়ে হাসাও কঠিন। ভেতরের পাইপগুলো তখন ঠিক ঠিক কাজ করে না।

‘তুমি বুলুর কি জান?’

আভা এবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘ছাড়ো-ও—’

আর কোন চান্স পেল না। তারের জাল, রবার, ফাইবার—কিছুই পেল না কুবের। একটু জোর দিয়ে চেপে ধরতে হল দু’হাতে। শেষদিকে আর একট চাপ—দম ধরে যাওয়ার যোগাড়। সে কিছুই ভুলতে চায় না। কোন একটা জিনিস ধরে তাকে উঠতেই হবে। হাতের আঙুলে মাংসের নীচে কয়েকখানা খুচরো, পাতলা হাড়ের জোড় একটু লাগছিল। ভারী মাল তোলার সময় কুলিরা চেঁচায়—আউর এক দফে, হেঁইয়ো। প্রায় তাই। শেষে একটু একস্ট্রা জোর লাগল। আভার মুখটা ফুলে গিয়ে দু’টো চোখই ঠেলে বেরিয়ে পড়ল। বাঁ হাতখানা কুবেরের পিঠে নখসুদ্ধ বসে গিয়েছে। আলগোছে সেখানা নামিয়ে দিল। কানের একটা দুল রক্তে মাখামাখি। গলায় সেই টেটিয়া ভাবটা আর নেই। খোঁপার ফুল ক’টা বালিশে থেঁতলে গেছে।

কুবের উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই একটা সিগারেট ধরালো। বাইরে বেরিয়ে দেখল ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় পরীগুলো যে-কোন সময় উড়ে যেতে পারে। ওজন বেশি বলেই পারছে না। দিঘির আগাগোড়া পরিষ্কার আলোয় ঝকঝকে হয়ে আছে। আভা শেষ খেয়েছে কাল রাতে। কুবেরও তাই। সারা গা কেমন তেতে আছে।

‘ডাহুকে’র সারেঙ খুব সাবধানে লঞ্চটা ভেড়াবার চেষ্টা করছে। হেড লাইট নেই। খাড়ির ভেতর নোঙর করেও রেহাই পায়নি। ঝড়ের দাপটে সেদিন রাতে হেডলাইটের কারবন ঝরে গেছে কিভাবে। কাল বেলাবেলি লঞ্চঘাটায় পৌঁছতে হবে। তারপর কারবন নিয়ে কলকাতায়।

সিগারেটের প্রায় আগুন অবদি টানল কুবের। আজই জানল, ‘সিগারেট বড় ছোট। না হলে তার এখুনি উঠতে হত না। দুর্গে ঢুকে দেখল আভা সেইভাবেই শুয়ে আছে। একটুও ডিসটার্ব করল না। কুবেরের খুব খাটুনি গেলেও বসতে পারল না।

ছোটবেলায় মোটাসোটা সুপুরি গাছের খসানো ডালের শক্ত চ্যাটালো খোসার ওপর নগেনকে বসিয়ে কত টেনেছে কুবের। চাকা লাগে না—অথচ গাড়ি। যুদ্ধের সময় মফঃস্বল শহরে গিয়ে জিনিসটা খুব পাওয়া যেত। সতরঞ্চি টাইপের শক্ত চালে বসে নগেন মজা পেত—আর কুবের টানত।

একটুও ভাবতে হল না কুবেরের। কামলারা এখন আগুন ঘিরে গোল হয়ে খেতে বসেছে। এখানে যে কত জিনিস পোড়ানোর পায় ওরা। এক এক সময় কুবেরের অবাক লাগে।

চাদর সুদ্ধ আভাকে টানতে টানতে দুর্গের একেবারে ভেতরে নিয়ে এল। পেয়ারা গাছটা তখনও শব্দ থামায়নি। ফাঁকা বাগান সেই আওয়াজে ভরে আছে। আজ এমন জ্যোৎস্নাতেও পাখিরা ডাকছে না। কুবের ফিরে গিয়ে দিঘিল পাড় থেকে কোদালখানা নিয়ে এল।

বেলাবেলি কাটা গর্তের ভেতরে নেমে কুবের খুব যত্ন করে আকন্দের টুকরো টুকরো শেকড় বেছে বেছে বাইরে ফেলে দিল। এখন ভেতরটা আরও ঠাণ্ডা। আভাকে চাদরসুদ্ধ পাঁজাকোলে নিতে হল। এই খানিক আগেও একবার নিয়েছিল। কতকাল এখানকার মাটি ওলটপালট হয় না। আভার মাথা কুবেরের হাতের বাইরে লটপট করে এদিক ওদিক ঝুলে পড়ছিল। টাল সামলে নীচে শুইয়ে দিল। তারপর কোদালে টেনে পুরনো মাটি আবার জায়গা মত চেপে চেপে দিল। শেষে ফুলে ওঠা কাঁচা মাটির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে কিছুটা মাড়াতেও হল।

বেশি সময় লাগেনি। বাইরে এসে দেখল, যেমন রেখে গিয়েছিল—সারাটা তল্লাট ঠিক তাই আছে। শুধু সন্ধ্যের লালচে ভাবটা কেটে গিয়ে চাঁদ এখন খুব স্পষ্ট। জোয়ারের আগে আগে রওনা হওয়ার কথা। ঠিক ছিল, সারেঙ এসে ডাকবে। কতদিন লঞ্চঘাটা, কদমপুর, সালকে যায়নি। কুবের নিজে গিয়েই কাদা ভেঙে লঞ্চে উঠল। তারপর সারেঙকে ডেকে সাবান চাইল।

লোকটা কুবেরকে ভক্তির ভাব দেখায় সব সময়। আজ ওসবে লক্ষ্য ছিল না কুবেরের। সারেঙ বললো, ‘তেল কালি ধোয়ার মেটে সাবান আছে সাহেব—’

‘তাই নিয়ে এস।’

একটা গোল বাংলা সাবানের বল হাতের মধ্যে নিয়ে কুবের লঞ্চের ডগায় দাঁড়াল। এই জায়গাটা লোহার পাতে মোড়া—লোহার খুঁটি বসানো। এখানে নোঙরের শিকল বাঁধা হয়। এখান থেকে ঘুমন্ত আভাকে আরেকদিন পাঁজাকোলে তুলে আনতে হয়েছিল কুবেরের।

মাল্লাদের একজন জল ঢালছে। কুবের কিছুতেই সাবানের বলটা সামলাতে পারছে না। পিছলে যাচ্ছে। এর পর পা ধুতে হবে আবার, ‘কি রাঁধলে আজ?’

সারেঙ, দু’জন মাল্লা চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়ান, ‘আপনি খাবেন—’

‘থাকলে নিয়ে এস। খেয়ে দেখি—’ খিদেয়, খাটুনিতে কুবেরের শরীর অবশ হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ চোখ তুলে দেখল জলার পাশে বাঁধ বরাবর ফাঁকা তাঁবুর গায়ে টানানো দড়িতে শাড়ি শুকোচ্ছে। এই ক’মাসে আভা ওখানে একটা ছোট্ট গেরস্থালি পেতেছিল। জ্যোৎস্নায় জামাকাপড়ের রঙ ধরা যায় না। বাতাস পেয়ে দড়ি আলগা শাড়ির বেশ খানিকটা দিগ্বিদিক হয়ে উড়ছে। লঞ্চে ওঠার আগে কুবের একবার সারাটা তাঁবু হাতড়ে এসেছে। কাঁধের ঝোলা ফেরার পথে কি ভারী লাগছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *