কুবেরের বিষয় আশয় – ২২

॥ বাইশ॥

সৃষ্টিধর তখন বুলুর কোলে। কুবের লোহার কারখানায় কাজ করে। একদিন নাইট ডিউটির পর সকালে ফিরে বুলুর শাশুড়ির সঙ্গে পাশাপাশি বসে কুবের ছবি তুলেছিল। সে-সব দিনগুলো কোথায় গেলো। বুলু পরিষ্কার বুঝতে পারে, বেশ ভালো ছিল তখন।

সেদিন ছবি তোলার কথা না। দোতলায় শোবার বড় ঘরের দেয়ালে মায়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কুবেরের ফটো টানানো। সালকের বাড়ি থেকে কয়েক মাইল পুবে এগোলেই গাঁয়ে চলে যাওয়া যায়। কোনো মেলা ভাঙার পর ছবিওয়ালা ঢাকনা দেওয়ার কালো কাপড়খানা কাঁধে ফেলে মালপত্র মাথায় নিয়ে ভোর ভোর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কারখানা ফেরত কুবের লোকটাকে ডেকে বারোয়ারি উঠোনে এনেছিল। অনেক ছবি তোলার পর মায়ের সঙ্গে বসে ওই ছবিখানা তোলে। কে জানতো! পরে এই ফটোই বুলুর শাশুড়ির শেষ ছবি হবে।

তখন কুবেরের মাথায় চুলের ঢাল কি ছিল! কালো। অনেকখানি। মরালোকের পাশে জলজ্যান্ত মানুষটা বসে আছে।

বেশি ভাবার সময় নেই বুলুর। লোকটা সেই যে ঘাপটি মেরে আছে—আর এদিকে আসার নাম নেই। ইদানীং কেমন হয়ে গেছে। হিসেব আর হিসেব। অথচ আগে কতো মেলামেশা ছিলো। একটু যে বসে দু’দণ্ড পেছনে ফিরে যাবে—ভেবে ভেবে পুরনো দিনগুলো তুলে এনে দেখবে—তার ফুরসৎ নেই।

শীতকালে মাছের গায়ে এক রকমের শ্যাওলা হয়। জাল ফেলে সেই শ্যাওলা ভেঙে না দিলে মাছ বাড়ে না—মরে যায় শেষে। বেড় জাল ফেলে জেলেরা শ্যাওলা ভাঙছে মাছের। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালেই এসব চোখে পড়বে।

লালচে মুলতানি গাইটা ক’দিন মুখে কিছু দিচ্ছে না। নতুন একজন দোহাল এসেছে। নাম গণেশ। গরু মোষ নাড়াচাড়া করে থাকে। খালের ওপারে নিজের খাটাল ছিল। ছেলেমেয়ে বৌ নিয়ে খড়ে-গোবরে বেশ জড়িয়ে-মড়িয়ে ছিল। বাচ্চা হতে গিয়ে বউ কাবার। কুবেরের কাছে পাঁচশো টাকা চেয়েছিল। মোষ আনবে। সংসার চলছে না। রোজান দুধ গাহিকদের দিতে পারছে না। বলছে, ‘বাবু টাকা দিবেন বলেছিলেন। দেখা করতে পারলাম না। আমি লোকটা কেমন শুধোবেন পাঁচজনের কাছে। গণেশ কারও চুংলি চাপটি করে না।’

অর্থাৎ কারও নিন্দে করে না। চুলি খায় না। অতএব সবাই তাকে ভালো বলবে।

ভালোরে জগৎ! বুলু কথা বাড়াতে দিল না। দেরাজ থেকে পাঁচখানা একশো টাকার নোট এনে দিলো। গণেশ গলে যায় প্রায়। নুয়ে নুয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো। কিভাবে টাকাটা ফেরত দেবে—কতরকম কিস্তি—সব বললো। বুলুর কানে কিছ গেলো না। সে শুধু বললো, ‘আমাদের এই নতুন গাইটা কিছু খাচ্ছে না গণেশ—’

‘ও ঠিক পানহাবে—এখুন বাঁট শুকিয়ে আছে। একটা শরবত করে খাওয়ান।’

শরবতের ফিরিস্তি দিল। আধসের ঘি, আধসের জিরে, আধসের গুড়—পাঁচ পোয়া জলের সঙ্গে ফুটিয়ে ভোরের বেলা খাইয়ে দিতে হবে। বাঁট দুধে সুল সুলাবে।

আজই ভোরে কুবেরকে বার বার মন থেকে তাড়াতে হচ্ছে বুলুর। এতদিনে সে, কুবের, সৃষ্টিধর, কুসুম মিলে কদমপুরে প্রায় একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। কাগজে ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে-আপনার আমানতের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। হরিরাম সাধুখাঁর বংশ পরম্পরায় কদমপুরে ছিটকে আসা সাধুখাঁদের এই টুকরোটুক একটা প্রতিষ্ঠানই বটে!

কুবের একদিক থেকে ছড়িয়ে রেখে গেছে। বুলু অন্যদিকে থেকে গুটিয়ে তুলতে পারছে না। গত বর্ষায় জানলার গ্রিলের এনামেল উঠে গেছে। জং ধরছে দু’চার জায়গায়। দিঘির ঘাটে ঘোরানো সিমেন্টের বেঞ্চ সারা দিন ফাঁকা পড়ে থাকে। চড়চড়ে রোদে কয়েক জায়গা ফেটেছে। দু’টো কদম চারা বসানো হয়েছিল। ডালপালা মেলে ছায়া দিলে সখের ঘাটকে রোদের হাত থেকে বাঁচানো যাবে। একটা গাছ বাঁচানো যাবে না বোধহয়। শুকিয়ে যাচ্ছে। কে বলছিল, নীচে ধেড়ে ইঁদুর বাসা বেঁধেছে—সেগুলো তাড়াতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে বুলু কুবের স্টেডিয়ামের চত্বরে গিয়ে পড়ল। বিরাট কাণ্ড। অথচ লোকটা আজ ক’মাস বেমালুম গায়েব। গোড়ায় রাগ হত। কিছুদিন কান্নার মতো একটা জিনিস ন্যাবড়ার দলা হয়ে গলায় পাকিয়ে যেতো। এখন কিছু হয় না। বিয়ে হয়ে ইস্তক দেখে আসছে—বাই উঠলে হলো—তখন ফেরানো যাবে না কিছুতেই—কুবের তখন একটানা ঘোরে থাকে।

স্টেডিয়ামের কাজ বন্ধ হয়ে আছে হপ্তা দুই। সিমেন্টের ওয়াগন আসেনি। রাজগঞ্জপুরে নাকি স্ট্রাইক যাচ্ছে। ভালোই হয়েছে বুলুর পক্ষে। শুধু ভিত কাটানোর পর ঢালাইর ওপর থেকে চার রদ্দা ইট গেঁথে তুলে ঠিকেদারমশাই থেমে আছেন। গাঁথুনির সেই গোল চক্করের মাঝে ইটচাপা ঘাস মুক্তি পেয়েই ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে রোদে ভাজা ভাজা হচ্ছে। ভিত্‌ না উঠতেই বিরাশি লরি ইট শেষ। চালানে যে কতোবার সই করতে হয়েছে বুলুর। কাল রাতেও সাহেব অনেকক্ষণ ছিলো—ঠিক ওই জায়গাতে।

বুলু অনেকবার বলেছে, ‘এখান থেকে ওঠো। সাপ খোপ থাকতে পারে।’

আগে লোকটাকে বুলু সাহেববাবু ডাকতো! কিছুদিন মিত্তিরদাও বলেছে। এখন কিছুই বলে না। সাহেব কখনো তাকে আপনি বলে, কখনো তুমি।

‘সাপ আমাকে কামড়াবে না। তারা চেনে—’

‘কিরকম?’

সাহেব একটুও থামলো না। গড়গড় করে বলে দিলো, ‘এতো ছাইপাশ কাজ করেছি সারাজীবন—বিষে আমার সারা গা ভর্তি।’

‘এবার তুমি আবোল তাবোল বলতে শুরু করবে জানি। আমি বরং উঠি—তুমি বসে থাক।’

বলেও উঠতে পারল না বুলু।

হেসে ফেলল সাহেব, ‘প্রায়ই পৃথিবীর বুকে গুলি করি আমি। পৃথিবীর গায়ে নানান জায়গায় গুলি করেছি—আঙ্কেলেশ্বেরে, নাহারকাটিয়ায়—তেল উঠেছে গ্যাসের পেছন পেছন। রাস্তা দিয়ে মোটর গেলে ভাবি আমারই গুলি করা মরা-তেলের জোরে গাড়িটা ছুটছে! অথচ জানো—আমি মার্কসম্যান সাহেব মিত্তির জীবনের এক সন্ধ্যেয় বাঁকুড়ার গাঁয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে এমন গুলি খেলাম—আজও মরছি না, শুধুই এদিক ওদিক যন্ত্রণায় আছাড় খেয়ে বেড়াচ্ছি—প্রাণটুকু বেরোয় না।’

‘তখন তোমার বয়স কত ছিল—’

‘কি আর এমন! সতেরো—জোর আঠারো। বাঁকুড়া শহরের কলেজে পড়ি, হসটেলে থাকি। ইয়ারকির মাথায় ফট করে প্রায় বাল্য বিবাহে বসে গেলাম। উপায়ও ছিল না। শুশুনিয়া পাহাড়ে গরম পড়তেই খরগোশ মারতে যেতাম ফি বছর। সন্ধ্যেরাত। টর্চের আলো পড়তেই সাদা, নধর জিনিসটা থমকে দাঁড়াল। গুলি করলাম। পড়ে গেল। গেমের পেছনে ছুটতে ছুটতে কতটা এসেছি খেয়াল নেই। কারও পোষা খরগোশ যে এমন বেরিয়ে পড়ে ধাঁধায় ফেলতে পারে জানবো কি করে। কাছেরই গাঁ থেকে পনেরো ষোল বছরের একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। অসাবধানে তাকেও গুলি করে বসতাম। আমি তখন শিকারের আনন্দে শিকার করে বেড়াই। কমলার অভাবে পাকা টমেটো মুখে গুঁজে কতদিন সারাটা দুপুর দারুকেশ্বরের তীরে তীরে পাখির পেছনে ছুটেছি। ঝলসানো ঘুঘু বটপাতা দিয়ে ঘসে পোড়া লোম তুলে ফেলতাম—একা ঠিক দুপুরে বটতলাতেই কাগজ পেতে খেতে বসতাম—’

‘তোমার বাবা মা—‘

‘আমার মাকে দেখিনি। বাবা ফিরে বিয়ে করে অকারণে অপরাধী হয়েছিলেন সারাটা জীবন। আমার দু’নম্বর মা কোনদিন অযত্ন করেনি। আর আমি তো স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ হসটেলেই হসটেলেই কাটিয়ে দিলাম। কতটুকু আর তার কাছে ছিলাম। বাবাও থানায় থানায়—শেষ বয়সে এস আই থেকে ও সি হয়েছিলেন—রিটায়ারের বছর দুই আগে ডাকাতির তদন্তে গিয়ে আর ফেরেননি। সরকারের কতো কাজ—একজন দারোগা কোথায় গেল, তার খোঁজ নেয় কে!’

‘আর ফেরেননি?’

‘অনেক ঘুরে আমি পেয়েছিলাম। তখন আর চেনা যায় না। ভাগ্যিস কোমরের বেল্টটা ছিল। নইলে চিনতে পারতাম না। শ্রাদ্ধ শান্তি করে সেই যে ফিরে এসেছি—আর যাইনি। এমন মূর্খ ছিলাম জানেন—বাবাকে টাকা পাঠিয়ে মেসের ঘরের জানলায় মানি অর্ডারের রসিদ একটা পেরেকে লটকে রাখতাম। আমি তার একমাত্র সন্তান—কীর্তিমান ছেলে রিসিট রেখে ডাকযোগে ভালবাসা পাঠাতো!’

‘তোমার মা?’

‘নিঃসন্তান বিধবা স্বামীর পেনশন পাওয়ার আগেই ভাইয়ের সংসারে মারা গেলেন। খবর পেয়ে কালিঘাটে নেড়া হলুম। ছুটি ছিল না বলে যেতে পারিনি। এখন শুধু এক জায়গাতেই টাকা পাঠাই। রসিদ রাখি না।’

বুলু তাকিয়ে আছে দেখে বললে, ‘কমলা মিত্তিরকে—আসলে কমলা বীরসা। ওর পৈতৃক পদবীতেই মানি অর্ডার করি। আগে গাঁয়ের লোক ধরে ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লেখাত। একবার শ্বশুর মশাই আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল। পুকুর আছে, ঘোড়া আছে, গরু আছে, মুরগি আছে—কি নেই তার সংসারে। জমিজিরীতেও খারাপ না। অনেক লোভ দেখিয়েছিল।’ একটু থামল সাহেব, সিগারেট ধরালো, বাইশ তেইশ বছর হয়ে গেছে। কমলার ছেলেপিলেও হয়েছে এতদিনে–’

বুলু ঝাঁকুনি খেল, ‘কার বললে?’

‘কমলার! ওদের ঘরে মেয়েমানুষ এতদিন পুরুষ ছাড়া থাকে না। ছেলে বয়সে আমি একটা ভুল করে বসেছিলাম বলে ও তার বোঝা বইবে কেন? বয়স থাকতে থাকতে অন্যজনের ঘরে উঠেছে—অবিশ্যি বলতে পারেন লিগালি কমলা এখনও হানড্রেড পারসেন্ট আমারই ওয়াইফ।’

‘টাকা নেয়?’

‘নেবেন না কেন? আর বাজার যা পড়েছে। ওর ছেলেপিলের বাপকে দিয়ে একখানা চিঠিও দিয়েছিল। লোকটা বোধ হয় শহরগঞ্জে চাকরি-বাকরি করে থাকবে। লিখেছিল—গমের কে জি এক টাকা তিরিশ। বাবুমশাই আপনি যদি বুঝসমঝ করে দশটা টাকা বাড়াই না দেন এ বাজারে পাঁচটি ছানাপোনা নিয়া শুখা পেটে মরিব। আমার পরিবারের ওপক্ষ খুব বিবেচক! তাই না?’

‘আমার ওপক্ষটি কিন্তু মোটেই বিবেচক নন। এ অবস্থায় দেখলে তোমাকে আগে তারপর আমাকেও বলি দেবে!’

‘কোথায়। আমি তো এমন কিছু করিনি। আজ মোটে আপনার কোলে মাথা রেখে শুয়েছি—’

‘মোটে?’

‘তা ঘাসে শাড়ি অমন একটু আধটু নষ্ট হয়ই। আর আমি যে সাইট থেকে এতখানি ছুটে এসে গায়ের সবটাই ঘাসে রেখে মাথাটুকু তোমার কোলে রেখেছি বুলু—’

মাথা আবার এর চেয়ে বড় হয় নাকি সাহেব? সব মাথাই এতটুকু।’

সাহেব তড়াক করে উঠে বসল, ‘বুকে রেখে দেখো—অনেক বড় লাগবে।’

বুলু বাধা দিতে পারল না। সাহেব বাইরে বাইরে অনেকদিন ঘুরছিল। ভেতরে যাওয়ার পথ্ কোন্‌দিকে জানে না। দেখলেও চিনতে পারে না। তাই সামনা-সামনি যতটুকু ছোঁয়া যায়, ধরা যায়—তার ওপরেই নিজেকে সবটা ঢেলে দিল। নিষ্ঠুর, স্থির, নিখুঁত লাগত বুলুকে। সেই শান্ত মুখের ওপরে ঠোঁট খুঁজে নিয়ে সাহেব শেষ হয় না এইভাবে নিজের ঠোঁট অনেকক্ষণ চেপে রাখল।

‘হয়েছে। এবার তো শান্তি!’

সাহেব ঘাসের ওপর আধো বসা অবস্থায় বুঝতে পারল না বুলু চটে গেল—না, মেয়েলোক যেমন করে—ইন্টারভ্যালের জন্যে সময় দিয়ে রঙ্গ করে উঠে গেল।

‘ওখানেই বসে থাকবে। খবরদার উঠবে না। আমি বাড়ি পৌঁছলে তবে সোজা তোমার কাজে যাবে—’, বলতে বলতে বুলু প্রায় ছুটে চলে গেল। সাহেব দেখতে দেখতেই বললো, ‘আমি সারারাত এই এখানে বসে থাকবো। আলো নিবিয়ে তুমি শুয়ে পড়লে তবে যাবো।’

বেশ অনেকটা দূরে ঢালাইর মশলার মিকশ্চার মেশিনটার পাশে বুলু দাঁড়িয়ে পড়লো—পাশেই কুবের রোড, তারই ছায়া সেখানেও লম্বা হয়ে পড়েছে, জোরে কথা বলা যাবে না, এই কুবের নগরের অধীশ্বরী তাই দাঁতে চেপে বললো, ‘আমি এই দাঁড়িয়ে আছি—চোখ ভরে দেখে নাও। দয়া করে ঠাণ্ডায় পড়ে থেকে কষ্ট পেয়ো না সাহেব—আমার শুতে শুতে অনেক রাত হবে। যত ইচ্ছে দেখে নাও আমাকে―: কান্নার কাছাকাছি একটা জিনিস আবার অনেকদিন পরে গলা বেয়ে উঠে আসছে, পরিষ্কার টের পেলো বুলু।

এই সামান্য ব্যাপারে এত কান্নাকাটির কি আছে সাহেব একদম আন্দাজ পেল না। কিছু একটা গুরুতর হয়ে থাকবে। বুলুকে দেখা যাচ্ছে। ঘাসে আলো পড়ে সারা ব্যাপারটা কিন্তু একরকমের মনোহারি হয়ে উঠেছিল। পুরনো অভ্যেস। চুমোটুমো না খেলে তেমন জুৎ হয় না। বুলুকে চোখে রেখে সাহেব লম্বা লম্বা পা ফেলে কুবের স্টেডিয়ামের ঢালাও চত্বর পার হয়ে গেল।

আগে যা ইচ্ছে করা যেত। এখন আঙুলটুকু নাড়তে হলেও ভাবতে হয়। নয়ানের বউ বুলুদি বলে মাঝে মধ্যে আসত। কিছুকাল হলো সেও আসে না। মাঝখানে কয়েকটা টাকা হয়ে চেনা মানুষজনের মাঝখানে একটা করে দাগ টেনে দিয়েছে। ইচ্ছে মতো চেঁচানোও যায় না।

স্টেডিয়ামের বাইরে মাটির উঁচু টিবিটা পার হতেই ভোরের রোদে কুবের ভবনের সামনে দু’টো জিনিস এক সঙ্গে দেখতে পেল বুলু। সৃষ্টিধর বুড়ো বকসার কুকুরটার পিঠে স্কুলের ব্যাগ চাপিয়ে গুরুজ্ঞানে হেট হেট করছে—আর একখানা এক্কাগাড়ি এসে থামল।

গাড়িতে ব্রজ ফকির। চোখে গগলস। মোটা বেতের লাঠিতে ভর দিয়ে নেমে পড়ল। ইদানীং এদিক সেদিক যাওয়ার জন্যে গাড়ি দরকার হয়। তেপুকুরের বাছাড় বাড়ির বুড়ো তরফ ব্রজ ফকিরের একজন এক নম্বর ভক্ত। গাড়িটি সম্ভবত তারই দান। রেলেশ্বর শিব আর তার সেবায়েতের শ্রীবৃদ্ধির খবরাখবর কদমপুর অব্দি এসে পৌঁছায় আজকাল।

বুলু তার স্বামীর এককালের ব্রজদাকে ঘরে নিয়ে বসাল। লোকটার সেই উড়োনচণ্ডী চেহারা আর নেই। পরতে পরতে চর্বি। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কাঁধের ঝোলা থেকে ভেলভেট বাঁধাই একখানা বই বের করে টেবিলে রাখল, টোকা দিয়ে এসেছিলে—তাই নিয়ে এলাম। তুলে রাখ।’ বুলু বইয়ের নতুন চেহারা দেখে অবাক হলো। আগে এর তুলনায় অনেক সাদামাটা চেহারা নিয়ে বইখানা বেরিয়েছিল। রজনী দত্তর জীবন ও সময়।

‘কুবের ফেরেনি?’

বুলু চুপ করে থাকল।

‘আর তোমাদের দরকার কি! অনেক তো হলো। এবারে ঘরে ফিরে জিরোতে বলো।’

‘দেখা হলে আপনি বলবেন।’

‘আমার কথা কুবের আগে কিন্তু খুব শুনত। একবারে ওঠবস করতো।’ থেমে গেল ব্রজ ফকির, তারপর ফিরে বললো, ‘সেই যে কদমপুরে বেড়িয়ে যেতে বললাম—আর এখন! আমিই কদমপুরের বাইরে চলে গেছি। কুবেরও বিষয়-আশয়ের ঘোরে পড়ে কদমপুরের বাইরে বাইরেই কাটায়। আমরা যে যার ছড়িয়ে পড়লাম।’

‘আপনি তবু শিব নিয়ে আছেন—’

‘সেজন্যেই এলাম। মন্দির হয়ে এলো প্রায়। মাসেককাল পরে নবগৃহে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা। অথচ আমার সাধিকা আজও বেপাত্তা—’

‘কোন খোঁজ পাননি বৌদির ‘

‘একদম না। কোথায় যে গেলো। ভাবলুম ঘুরে যাই—তোমার এখানে এসে যদি উঠে থাকে।’

বুলু জানে তার স্বামী দ্বীপে চাষ-আবাদে গেছে। সময় হলেই ফিরবে। কিন্তু নিজের বউ কোথায় গেছে জানে না—অথচ এতোদিন চুপচাপ বসে আছে। কেমন ধারার লোক। আগের দু’দুটোপক্ষের ছেলেমেয়ে দু’জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

‘পুলিসে খবর দিলেন না কেন?’

‘লাভ নেই বুলু। আভা নিজে না ফিরলে কেউ তাকে ফেলতে পারবে না। ভাল কথা—কুবেরের লোকজনও এদিকে আসেনি?’

‘পেট্রোল আর পোকা মারার ওষুধ কিনতে লোক এসেছিলো।’

ঘরে বসে কথা বলা যাচ্ছিল না। রেফ্রিজারেটর কোম্পানীর এস কে বোস জায়গা কিনেছিল কুবেরদের কাছ থেকে। এখন সেখানে ভিতের কলম ঢালাই হচ্ছে। লোকটা ক’তলা বাড়ি করবে কে জানে। জায়গার চেহারা এতো তাড়াতাড়ি পালটে যাচ্ছে। মিকশ্চার মেশিনে সিমেন্ট, বালি, স্টোন, চিপ জল দিয়ে মাখানো হচ্ছে। তার আওয়াজ সর্বত্র।

ব্রজ ফকির ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখতে লাগল। কুবেরের ছবির সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল। শেষে বললো, ‘কলেজে পড়ার সময় আরও অন্যরকম ছিলো। তবে ওর চোখ চিরকালই এমন—স্বপ্নে ভেসে আছে সব সময়—কোন কিছুর ছায়া পড়ে না—’

‘বলুন মুক্ত পুরুষ!’

খচ করে ঘুরে দাঁড়াল ব্রজ, ‘তোমার এতো অভিমান কেন বুলু? পুরুষমানুষ আগের দিনে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে কখনো আদৌ ফিরতো না। রাজার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে কতো বীর বেঘোরে মারা পড়তো। আর তুমি তো ধান উঠলেই খবর পাবে—‘

বুলু কোন কথা বললো না। ব্রজ কুসুমকে দেখে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ‘সুলক্ষণা।’

তারপর বললো, ‘কাল সাহেব এসেছিলো?’

কোন জবাব না পেয়ে ফিরে বললো, ‘কখন গেলো?’

এবার একটা যাহোক বলতে হয়। তাই বুলু বললো, ‘যেমন যায়—’

‘প্রায়ই আসে তাহলে—‘

বুলু চুপ করে থাকল। এই মানুষই সাধ করে কুবেরদের কদমপুরে একদিন জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তারই সামনে কুবের সাধুখাঁ একে একে পাল্টাতে পাল্টাতে .এখন এই আধখানা নগরের পত্তনদার। একেবারে ময়দানবের কাণ্ড। জেলেরা জাল তুলে তুলে পোনামাছের শ্যাওলা ভেঙে দিচ্ছে। সারি সারি দোকায় মুখ নামিয়ে দুধেল গাইগরুগুলো তৃপ্তিতে চুনিভুষি মাখানো কুচো খড় খাচ্ছে। আলু ক্ষেতে নেমে সৃষ্টিধর মাটি সরিয়ে আলু তুলে আনছে। এই মানুষটাই জানে কুবের কোথায় ছিলো আগে—এখন কোথায় পৌঁছে গেছে।

‘মেসোমশায় আসেন না?’

‘মাঝে মাঝে। শ্বশুরমশায় বিগ্রহের সোনার বেড় পরাতে আসবেন শনিবার। রবিবার অভিষেক ঠাকুরের।‘

হঠাৎ দু’খানা হাত চেপে ধরলো ব্রজ, ‘বিপদে পড়ে এসেছি বুলু। তোমরা আমার পুরনো বন্ধু। তোমাদেরই সব বলা যায়।’

বুলু হাত ছাড়িয়ে বসতে বললো।

‘বাইরে থেকে আমায় বোঝার উপায় নেই। অথচ ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় ভুগছি কিছুকাল। কি হবে—কি করব, কিছুই ঠিক করতে পারছিনে।’

‘খুলে বলুন না।’

‘বলছি। কাউকে বলবে না—এই আমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো।’

বুলু ব্রজ ফকিরের গা ছুঁয়েই হাত সরিয়ে নিলো। চন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে ভুরভুর করে। আতরও থাকতে পারে। জটা মাথায়—কিন্তু আগাগোড়া পরিষ্কার। ঠাকুরতলা বানানোর পর থেকে ব্রজ দত্ত ধীরে ধীরে অনেক গোছালো হয়ে উঠেছে।

‘বড়ো বিপদে পড়েই এসেছি আজ। কেউ জানে না—আমাদের রেলেশ্বর শিব উধাও—’

‘কি বলছেন?’

‘যা বলছি সত্যি। মন্দির তৈরি প্রায় শেষ। নতুন করে শিব বসবেন। অথচ কোথায় শিব! আভা চলে যাওয়ার পর দু’তিনদিন কোনদিকে তাকাতে পারিনি। একটু সামলে নিয়ে পুজোয় বসতে গিয়ে দেখি রেলেশ্বর শিব উধাও! ‘

‘সর্বনাশ!’

‘শুধু সর্বনাশ! কোথায় খুঁজবো। রোজ ভেবেছি-ঠাকুর গেছেন—নিজে নিজেই ফিরে আসবেন। বসে থেকেছি। ধ্যানে—ঘোরে বাবা বাবা বলে কতো ডেকেছি—তারপর ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্যে ফুল, বেলপাতা, চন্দনে জায়গাটা পাহাড় করে রেখেছি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় রাখিনি। কে আর ঘেঁটে দেখতে যাচ্ছে।’

‘কিন্তু শিব প্রতিষ্ঠার দিন কি হবে?’

‘তাই ভেবেই তো মরে যাচ্ছি।’

‘যেখান থেকে পেয়েছিলেন-সেই কোন্ বাবার আশ্রম থেকে-তারা যদি এসে ফেরত চায়?’

এবার ব্রজ দত্ত সাবধান হয়ে গেলো। ভগবান ঘেঁটে ঘেঁটে সে এখন অনেক সাংসারিক হয়ে পড়েছে। রেল লাইনের পাথরের মধ্যে ওই বেঢপ খণ্ডখানা পেয়ে নিজেই নাম দিয়েছিল, রেলেশ্বর শিব। ঠিক মজা-পিয়ালির বুকের ওপর রেলব্রিজে উঠতে লক্ষ লক্ষ পাথরের মধ্যে টুকরোটা মাথা উঁচু করে পড়ে ছিলো। পাগলা পিয়ালির ঢেউয়ের মাজা ভেঙে দিয়ে আগে কতবার রেলপুল বাঁচানো হয়েছে। সেজন্যে এককালে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই ফেলতে হয়েছে অনেক। নদী শুকিয়ে গিয়ে তার বুকে চাষ হচ্ছে। সেইসব পাথর টেনে টেনে পাড়ে তুলে ফেলা হয়েছে। তারই কোন টুকরো হবে। নিজেই রটিয়ে দিয়েছিল শ্রীশ্রী ১১০ বাবার আশ্রম থেকে তার ওপর শিবসেবার ভার পড়েছে। সেই পাথরের টুকরোটাই তাকে এতো দিয়েছে—দিচ্ছে।

‘দানের বিগ্রহ ফেরৎ হয় না বুলু।‘

তখন ব্রজকে কে আবার বিগ্রহ দেবে। নিজের নেই চালচুলো। এখন হলেও হতে পারতো। তাই সেদিন নিজেই নাম দিয়েছিল, রেলেশ্বর শিব। ব্যাপারটা জানতো আভা—আর খানিকটা সাহেব। দু’জনের কে সরাতে পারে। শিব সরিয়ে কার লাভ—এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ব্রজ।

পষ্টাপষ্টি বলাও যায় না বুলুকে। ব্ৰজ দত্ত এখন দূর দূর তল্লাটের শিব সেবায়েৎ—তার ঘোর হয়, সমাধি হয়—লোকে বলে খ্যাপা মোহান্ত। অথচ শিবই নেই। সাধিকাও উধাও। কি বিপদ।

‘সাহেব কিছু বলেছে তোমায়?’

‘না তো।’

‘অবিশ্যি একেও আমি বলিনি কিছু।’ তারপর বুলুর দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বললো, একদমকে, ‘আমার জীবনে যে কি হয়ে যাচ্ছে—অথচ কি ছিল। এখন আর আগের মতো দৌড়ঝাঁপ পারি না। শতেক ঝামেলা। কেউ একজন পাশে থাকলে যে কতো সুবিধে ছিলো।’

‘আগে বোঝেননি কেন! ঘরের মুড়ো ঝ্যাটারও দাম আছে। ফেলে দিলে, হারালে কদর বোঝা যায়—

যা ইচ্ছে বলতে পারো বুলু। আপত্তি করবো না। কিন্তু এখনকার মতো একটা পথ বলে যাও—কোথায় যাবো? কি করবো? কিছু ঠিক করতে পারছিনে—‘

‘আমি সামান্য মেয়েমানুষ। আমি কি করে বলবো। ঠাকুর যেমন এসেছিলেন তেমন গেছেন। বুঝলে আবার ফিরে আসবেন।’

খুব ভয় ধরে গেল ব্রজর। আগে কোনদিন ঠাকুর দেবতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেনি। কিছুকালের অভ্যেস একদম পালটে গেছে। শেষদিকে রেলেশ্বর শিব স্বয়ং পাথরের ওপর তিন তিনটে চোখ জ্বালিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। চন্দন মাখানোর সময় খরখরে গা মোলায়েম লাগতো ব্রজর। গরম পড়লে বেলপাতার পাহাড় সরিয়ে হাওয়া যাতায়াতের পথ করে দিয়েছে কতদিন। ভোগ সাজিয়ে দিয়ে দূরে বসে থাকত চুপচাপ। এই ঠাকুর এলেন-এই পিঁড়ে পেড়ে নিয়ে বসলেন, মুখে দিলেন। স্পষ্ট বুঝতে পারত—ব্রজ নিজেও অনেককাল শিবঠাকুরের চেলা। গাঁজা টিপে টিপে তার আঙুলের ডগা আসল রঙ হারিয়ে বসে আছে অনেকদিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *