॥ এক ॥
বাঁ হাতখানা মেলে ধরলো কুবের। প্যান্ট শার্ট পরনে লোকটি ইংরাজী একটা নাম বললো কিসের। বার কয়েক শুনলে তবে মনে থাকে। কুবের বুঝতে পারেনি দেখে লোকটি বললো, ‘পেশেন্টকে নির্জলা সত্যি বললে শক্ খেতে পারে—তাই টি.বি হলে প্রথমে আমরা বলি কক্স ইনফেকশান।’
বেশ ভোরের ট্রেন, লোক নেই বলতে একেবারে নেই। ছুটন্ত চৌকো জানালায় সবুজ ধান শুধু। কামরার মেঝেতে আঁসটে গন্ধ, জল। রাত থাকতে মাছ বোঝাই দিয়ে কলকাতা ছুটছিল। এখন ফিরছে।
‘ভয়ের কিছু নয়—ড্রাই একজিমা। ধৈর্য ধরে ট্রিটমেন্ট করতে হবে।’
আরও কঠিন কিছু বললে কুবের অবাক হতো না। কিছুদিন ধরেই ভয়ে ভয়ে আছে। হাতের আঙুলে কালচে এসব দাগ কোন সহজ ব্যাপার নয়। কুষ্ঠ হবে না তো? হলে বোধ হয় আস্তে আস্তে দাগের জায়গায় ব্যথা হয়, চামড়া ফাটে—শেষে ফুলুনি শুরু।
গলিতে খেলুড়ে ছেলেমেয়েদের দু একজনের হাঁটুতে কী আরও নীচে জিনিসটা দেখেছে। মাখন মাখানো পোড়া কালো টোস্ট। ঘা শুকোয়, আবার ক’দিন অন্তর ব্যাগব্যাগ করে পেকে ওঠে। সেও এক রকমের একজিমা। তবে কুবেরেরটা শুকনো।
‘অল্প দিন আগে পড়ছিলাম—‘
কুবের কিছুই শুনতে পেল না এরপর। সব-শুনছি ভাবে তাকিয়ে থাকল। চোখ পোড়াচ্ছে। সকাল হতে না হতে বেরিয়ে এসেছে।
ফাঁকা কামরায় দেশলাই চেয়েছিল লোকটি—তা’থেকে এতদূর গজালি। নাইন্টিন থার্টিফোরের ম্যাট্রিক, ফট্টিটুর এম.বি। সরকারী হেলথ্ সেন্টারের ডাক্তার। মাস পয়লা —নিজের, স্টাফেদের মাইনে আনতে কলকাতা গিয়েছিল।
কুবের এতক্ষণ সবই লোকটির মুখে শুনেছে। আপত্তি করেনি, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেনি। বছর কয়েক হলো, ডাক্তার পেলেই ভেতরটা দেখিয়ে নেওয়ার জোর ইচ্ছে হয় তার। এমনিতে কুবের দুর্বল না, দুপুরে ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে বিকেলে পাঞ্জাবি গায়ে বেরোলে নিদেন পক্ষে মফস্বলের হিরো লাগে তাকে। তবে, এদানিং মুঠো বাগিয়ে আগের সেই জোর আর পায় না ঘুষিতে।
লোকটি তার হাতখানা হাতে নিল, ‘সেদিনই একটা লেখা পড়ছিলাম—গোটা দুই কেসও দেখেছি—‘
একদলা চাপ মত কী একটা বুকের ভেতর থেকে লাফিয়ে মাথায় উঠে এলো কুবেরের। লোকটা এখন যা ইচ্ছে বলতে পারে। বছর চারেক আগেই যদি সাবধান হতো। পাড়ার ডাক্তার একটা প্রেসক্রিপশনও করেছিল। বড় মুসুরির দানা-রঙও সেইরকম—ট্যাবলেটগুলো ক’দিন খেয়েছিল কুবের। কিন্তু এমন ব্যথা শুরু হলো বুকে—শেষে খাওয়াই ছেড়ে দিতে হলো।
‘খুব পুরনো ভি.ডি. থাকলে গাঁটে গাঁটে কালো ছোপ ধরতে শুরু করে—কদমপুরের এক মেছুনিকে দেখেছিলাম—’
পাঞ্জাবির হাতা কনুই পার করে দিয়ে হাতখানা ঘুরিয়ে ধরল কুবের, ‘পাড়ার ডাক্তার বলেছিল এক্সটার্নাল ডারমাটাইটিজ—‘
—‘হতে পারে, সব স্কিন ডিজিজই এক্সটার্নাল। পা দেখি।’
খানিক দেখে লোকটি বললো, ‘বুড়ো আঙুল দুটোই কালো হতে আরম্ভ করেছে।’ কুবের জানে। গরমকালে পায়ের আঙুল কেমন তেলেভাজা বেগুনি হয়ে যায়। শীতকালে ছাল ওঠে। এসপ্ল্যানেডে পায়খানা পেলেও গা এতখানি সিরসির করে না। দুহাতে লোকটার হাত জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হচ্ছিল। ভালো কিছুর শুরু হলেই মাঝামাঝি এসে ফি’বার কুবেরকে আগাগোড়া ভেঙে ফের কাঁচামাটি করতে হয়। অনেক কষ্টে নিজেকে বাগে রাখল কুবের, ‘ধরুন যদি ওয়ার্স্ট কিছুই হয়ে থাকে—’
‘লং ট্রিটমেন্ট লাগবে। কাজকর্ম সেরে আসুন না সেন্টারে এখানকার হাসপাতাল দেখে যাবেন।‘
কুবেরও কদমপুর যাচ্ছে। আজ বছরখানেকই যায়। এই প্রথম আলাপ হলো কদমপুর হেলথ্ সেন্টারের ডাক্তারের সঙ্গে। লোকটা চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে। এরা মরলে কাগজে লেখে অকাল বিয়োগ। মোটা রোজগারের আশায় ডাক্তারি পড়েছিল। সুবিধে হয়নি বলে বাঁধা মাইনের চাকরি নিয়েছে। ডাক্তার যখন কদমপুরে সবাই চেনে। তার সঙ্গে কথাবার্তার পর এবারে লোকটা আপারহ্যান্ড পেয়েছে। পোজের মাথায় শুধু ধেনো মাঠ দেখে যাচ্ছে।
রুদ্রনগরে এক মিনিটও দাঁড়ালো না ট্রেনটা। সরু পিয়াসলে ডবল লাইন বসছে বলে অনেকটা পথ হামা টেনে এগোতে হয়েছে। এদিকে ইলেকট্রিক ট্রেন চলবে আর কিছুদিন বাদে। তারই তোড়জোড়।
সকালের ডাউন লোকালগুলোর মধ্যে এটা মিড ট্রেন। সময়মত স্টেশনে আসতে কুবের দু’টো বাস বদলে রিকশায় এসেছে বাকিটুকু। টিকিট কেনার ভাঙানির ঝামেলা এড়াতে বুলু কাল রাতেই মাপা খুচরো পাঞ্জাবির ইনসাইড পকেটে রেখে দিয়েছিল। আটানব্বই পয়সাতেও কুবরে কদমপুর যাতায়াত করতে পারে—আবার সারাটা পথ ট্যাকসি দাবড়ে শেষ নোটখানাও উড়িয়ে দিতে পারে।
ডাক্তারের কাছে পয়লা আলাপেই এতখানি মন খোলা ঠিক হয়নি। ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। উঃ! চিরটা কাল কুবের প্রথমে করে ফেলে—তারপর ভেবে মরে আর পোড়ে।
কোথায় যাচ্ছে বলার পর লোকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাইল, কেন যাচ্ছে?
কুবের একবারে বলতে পারেনি সবটা। বাড়ি-ঘর বিষয়-আশয় হলে লোকে যেমন যেমন বিনয় করে খানিক ভেঙে খানিক চেপে বলে-তেমন ধারায় বললো, ‘স্টেশনের ধারাধারি একটুখানি জমি রাখবার ইচ্ছে আছে। সামান্য—’
এসব ভাব আগে জানতো না। রাখবার মানে কেনার। ইচ্ছা আছে মানে কেনা কমপ্লিট। রেলে যাতায়াত, পুরনো দলিল পেড়ে দর নিয়ে কোস্তাকুস্তি, সাফ কোবালা লেখানোর জন্যে রেজিস্ট্রি অফিসে মুহুরিদের মাদুর বিছানো খাটে বসে এমন দু’চারখানা কথা কুবেরের রগে বসে গেছে। তবে, ওইটুকু বিনয়ের জন্যে যে পরিমাণ সম্পত্তি থাকা দরকার তার সিকির সিকিও কুবেরের এখনও হয়নি।
মন্দের ভাল, ঠিক কোন্ দাগ কিনেছে—কিংবা আর কোন্ কোন্ দাগ কিনবে সেটুকু আর ভাঙেনি। প্যাকেট এগিয়ে দিতে লোকটা নিজের পকেট থেকে একটা রক্তশূন্য সিগারেট বের করল, ‘দেশলাইটা দিন বরং—’
হাতের সিগারেটের আগুন এগিয়ে দিতে লোকটা বললো, ‘সুবিধে পাইনে, দেশলাইটাই দিন।’
খারাপ অসুখ থাকলে আগুন ছোঁয়াচে হয়ে যাওয়ার কথা কোনদিন শোনেনি কুবের। দেশলাই দিল, ফেরত নিল—পকেটে রাখল।
‘তা আপনি সেই শালকে থেসেক এত দূরে এই কদমপুরে?’
লোকটাকে কুবের অনেক কিছু বলতে পারতো। মুক্ত বায়ু, জায়গাটা নির্জন, ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলে আধ ঘণ্টায় শেয়ালদা। কিন্তু, সব কথাই পেছনে লেজ ফেলে যায়—তা ধরে নতুন নতুন কথা পাততে বসবে লোকটা।
‘চলে এলাম আপনাদের কদমপুরে—’
দু’নম্বর লাইন দিয়ে ট্রেন ইন করল। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে রাস্তায় ওঠার আগে লোকটা তার নাম বললো, বিমল মজুমদার। কুবেরও তার নাম বললো।
তারপর রাস্তায় পড়ে কুবের বিমলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। মানকচু, বুনোসিম ডালায় চাপিয়ে ব্যাপারীরা বাজারে চলেছে। সাইকেল ভ্যানে তাড়ির কলসী—ফুলতলা দিয়ে বাস আসছে ধুলো উড়িয়ে, বিড়ে পাকানো পুঁইশাকে ছাদ ভর্তি।
‘দেখুন ছোটবেলায় খুব একটা ট্র্যাজিক’, একটু থামতেই হলো কুবেরকে, এত ভিড়ে কিছু বলা যায় না, ‘স্যাড এক্সপিরিয়েন্স—ঘটনা বলতে পারেন—
বিমল ডাক্তার রাস্তার লোকের নমস্কারে নমস্কার করলো, ‘আসুন না সময় করে—সকালে বিকেলে ওয়ার্ডে থাকি।
ইরিগেশনে কাটা খালের পাড় ধরে এক মেছুনি রাস্তায় উঠে এল। হাতে একটা পোলো। রাত থাকতে বসিয়েছিল। কলকাতার এতো কাছে জলের মাঠ, মাঠের ধান, ফাঁদপাতা পাখির মিষ্টি মাংস—দাম কম না হলেও জায়গারটা জায়গায় বসে খাওয়ার সুখ, আরাম, স্বাদের কথা ভাবলেই কুবেরের মনে হয় খাঁটি শেকড়ের কায়দায় সরাসরি মাটি থেকে সে নিজে নিজেই রস টেনে নিচ্ছে। অথচ—
সকালের রোদে হাতের চেটো উপুড় করে কালো দাগগুলো আবার দেখলো। ব্যথা নেই, চুলকোয় না—তবে, আগের চেয়ে আরও বেশি জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘ট্রপিকালে দেখাতে পারেন।’
‘একটা সময়-টময় আছে তো—গেলেই কি দেখবে?’
‘বোদহয় সোম আর বুধ’—হাঁটতে হাঁটতেই বিমল বললো, ‘তবে, ওখানে লাইন দিয়ে দেখালে, কতকগুলো ওষুধ একেবারে খাঁটি পাওয়া যাবে—পয়সাও লাগে না—কিন্তু’–ডেলি-প্যাসেঞ্জারের দল সাইকেলে স্টেশনে ছুটেছে। তার ভেতরেও হাঁটা না থামিয়ে বিমলের মুখে তাকিয়ে থাকল কুবের।
‘নার্ভাস ব্রেকডাউন না হয় শেষে। স্কিন ডিজিজের, তাছাড়া অন্য সব অসুখের রুগী এতো আসে-আর এক একখানা যা স্যাম্পেল, বীভৎস। এদের সঙ্গে লাইন দিয়ে কী ওষুধ নিতে পারবেন?’
বিমল ডাক্তার দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে যাবে হেলথ্ সেন্টারে, কুবের যাবে নয়ানদের বাড়ি। চারদিক জলে, মাটিতে, ধানে আগাগোড়া রসস্থ হয়ে আছে। সামনে তেমন কোন বাধা নেই—সবই সহজ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। এসব মাঠ বুলুকে নিয়ে ক’মাস আগেও দেখে গেছে কুবের। কীভাবে কিনবে কী দিয়ে কিনবে—কার জায়গা?—কিছুই জানতো না তখন। রোজ মনে হতো, টানাটানির মধ্যে এভাবে ট্রেন—বাস—ট্রাম করে পয়সাগুলো জলেই যাচ্ছে। যখন সব হয়ে আসছে—ঠিক তখনই—
‘আপনি আছেন তো? নয়ানবাবুর বাড়ি কাজ সেরেই যাচ্ছি—’
বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে বিষম হোঁচট খেলো কুবের। আঙুলটার নীচে অনকদিনের কড়া। মোষের তলপেটের চামড়া হলে কোলাপুরী স্যান্ডেল টেকসই হয়। গর্দানের হলে ছিঁড়বেই। কেনার সময় দোকানদার এরকমই বলেছিল। স্যান্ডেলটা এতো টেকসই যে কিছুতেই ছিঁড়ছে না। ব্যথায় পা চেপে ধরে পড়েছিল কুবের। উঠতে গিয়ে দেখল, দু’ তিনশো ফুট জুড়ে খালপাড় বিকটভাবে তাকিয়ে আছে। আশপাশের লোকেরা ইচ্ছা মত মাটি কেটে নেওয়ায় এই দশা।
এখন সকাল। আটটাও বাজেনি বোধহয়। ভোরের ডিউটিতে সি.এল. মেরে আজ কদমপুরে এসেছে কুবের। প্রায়ই আসে। ট্রেনের সময় এখন মুখস্থ। ফার্স্ট ট্রেন ভোর চারটে পঞ্চান্নয়, সেকেন্ড ছ’টা কুড়িতে, থার্ড আটটা পঁয়ত্রিশ। সরু পিয়াসলে মাঝে মাঝে মোবাইল চেক বসে। রুদ্রনগরে অ্যানাটোন মলমের ফিরিওয়ালা ওঠে I
এই খাল দিয়ে একদিন কলকাতার ময়লা জল আরও তিন চার স্টেশন পরে নদীতে গিয়ে পড়তো। ময়লার পলিতে সে নদীর বুক বুজে গিয়ে খালের এই দশা। নতুন নতুন বিয়েনে ভরাট ধানের গোছে ঢাকা পড়ায় নতুন কাটা খাল হঠাৎ নজরে আসে না। সেগুলো দিয়ে ইরিগেশনের ইঞ্জিনীয়াররা মাঝে মাঝে স্পীডবোটে ছুটে যায় মাঠ দিয়ে রেলের ওভারব্রীজের নীচে অন্ধকারে ঢোকে, ইন্সপেকসন। এই পুরনো খালের জল মাইলখানেক ধরে বহুকাল আটকে আছে। কচুরিপানায় ফেঁপে উঠেছে—মাঝে মাঝে শোলের ঝাঁক পরিষ্কার আলোয় দেখা যায়।
কুবের খোঁড়াতে খোঁড়াতে খালপাড়ে উঠে এলো। উনিশশো সাতাশের জেলা জরিপের নকশায় জায়গাটা দেখেছে। মথুর আমিন দিয়ে মাপানো হয়েছে। চুয়ান্নর রিভাইজড্ সেটেলমেন্টের হিসেবের সঙ্গে মিলে গেছে।
মৌজা মেদনমল্ল, খানা কমলপুর, জেলা চব্বিশ পরগনা। সার্ভেয়ার রায়মশায় খালপাড় বলেন না—বলেন, এনব্যাঙ্কমেন্ট। ফিতে ফেলে দেখছেন, চওড়ায় সত্তর ফুট। আরও দশ ফুট ছিল। সেটুকু সোলগোহালিয়া, নড়িদানার লোকজন কেটে নিয়ে গেছে। কী মাটি। শক্ত লোহা। জল পড়লে দাঁড়ায় না। খালি পায়ে হাঁটলে গোড়ালি ব্যথা করে। বেঁটে বেঁটে বাবলার ঝাড়, সাপের গর্ত, একাদশীর বিকেলে এলে সবে ফেলে-যাওয়া লম্বা লম্বা ফ্যাকাসে খোলস দেখা যায়—হ্যাজাকবাতির ম্যান্টেলের চেয়েও নিভাঁজ, ফটফটে সাদা।
নয়ান বলেছিল এসব জায়গার দাম এত চড়বে জানলে কত জমি আমরা জলের দরে ধরে রাখতে পারতাম। কী ছিল এসব জায়গা। আমাদের বারান্দা থেকে সালতি চড়ে এদিকে আসতাম। করপোরেশন ময়লা ছেড়ে ছেড়ে নিকাশের পথ সব বুজিয়ে ফেললো। নয়ানের বাবা কান্তবাবু বলেন, বাংলা তেত্রিশ সনে বিদ্যেধরী পিয়ালি বুজে গেল। সেই থেকে বিশ বাইশ বছর একনাগাড়ে সারা তল্লাট জুড়ে ছিল বড় বড় হোগলার বন। তবে, মাছের সুখ কিছু গেছে। দলকে দল জাওলা পেতে, ঘুনি বসিয়ে, আলো-পোলোয় শাল-শোল, বান-বোয়াল ধরে শেষ করতে পারেনি। পাম্প বসিয়ে জল টেনে নেওয়ার পর আট দশ বছর চাষ হচ্ছে একটু আধটু—একেবারে নোনামটি।
ট্রেন লাইনের ওপারে ইলেকট্রিক এসেছে। বাজার, ডিমের কারি, হোটেল, গম ভাঙানোর কল-সন্ধ্যেবেলা আলোর জ্বরে ঝাঁ ঝাঁ করে। এদিকটায় পোস্টে চড়ে তার এসেছে—কিন্তু আলো আসেনি। ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলেই আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন দেবে। সকালবেলার রোদে লাইনের দু’ ধারই এক রকম দেখাচ্ছে।
নয়ানদের বাড়ি যেতে বিঘে তিনেকের এক ডোবা। না পুকুর না ডাঙা। শালী জমি—মাস দুই আগে কাদা করে ভাগচাষীরা বীজতলা করেছিল। এখন মোটা মোটা ধানের গোছে জায়গাটা সবুজ হয়ে আছে। কুবের দর করেছিল। পালেদের জায়গা, পয়সার অভাব নেই—দাম আরও চড়লে ছাড়বে।
জলের দর কথাটা শুনলে কুবেরের বড় দুঃখ হয়। ইস তখন যদি বয়স্ক থাকতাম—হাতে টাকা থাকত! এক একদিন ট্রেনে বসে দু’ পাশের মাঠ দেখে মনে হয়, সাইজমত বিরাট একলপ্তে অনেকটা জমি গালগল্পের জলের দরে পাওয়া যেত যদি, এদানী ব্রহ্মোত্তর দেয় না কেউ। তাহলে একেবারে কলবাড়ি করে তুলতো। ভদ্রাসন, পুকুর, ফলের বাগান, সম্বচ্ছরের ধান মলানোর মাঠ সব—সব একসঙ্গে হয়ে যেতো।
কলকাতায় বাসে-ট্রামে ঠাসাঠাসি, ফালি ফালি ঘর, শীতকালে সন্ধ্যে হতেই ময়লা ভর্তি চাপ চাপ ধোঁয়ার দলা অতিকায় বাদুড় হয়ে ট্রামের তারে ঝোলে। তখন চোখ জ্বলে, নিঃশ্বাস টানা যায় না। আত্মঘাতী হওয়ারও ভাল জায়গা নেই। পুরনো আলিপুর, এদিক সেদিক দু’চারজন বাপকেলে সম্পত্তি আগলাচ্ছে। রোজ সকালে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের জিনিসপত্রের আন্ডার গ্রাউন্ড দিয়ে গঙ্গাযাত্রা। এতলোক দিনের মধ্যে কতবার জল সারে। ভাগ্যিস উপরটা রাস্তাঘাট দিয়ে মোড়া–দোকানপসার আলো দিয়ে সাজানো।
বারান্দায় অ্যালসেসিয়ান আজ চেঁচালো না। কুবের পাতা চেয়ারে বসতেই নয়ান বেরিয়ে এল, ‘কতক্ষণ এসেছেন?’
‘এই তো।’ কুবের এর বেশি একবারে বলতে পারলো না। বিমল লোকটা সকালবেলা আঙুল দেখে কী কী বললো তা নয়ানকে বলা যাবে না। বিমল এখানকার ডাক্তার। তার আঙুলে যদি কিছু না হয়েও থাকে—তবু, কিছু হয়েছে—এমন সন্দেহের কথা বিমলকে বলা ঠিক হবে না। ডাক্তারের মুখে রোগের কথা লোকে বিশ্বাস করবেই—তা যদি বানানোও হয়। বিশ্বাসী চাকর, ডাক্তার, ঠিকাদার, রেডিও মেকানিক, প্লাম্বারই খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে কুকুররা এখনও বিশ্বাসী।
নয়ান দালাল না, দারুণ গেরস্থও নয়। মোটা মাইনের অবস্থাপন্ন বাবার বড় ছেলে। প্রায় কলবাড়ির মত বাড়ি। পেছনে ধানী-জমি, ফলের বাগান, পুকুর, বিরাট উঠোন, বসবার বারান্দার সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে নানা ফুলের বাগান। কোমর উঁচু দেয়ালে সবটা ঘেরা।
নয়ান রায় কুবেরকে দাদা ডাকে। এই অল্প বয়সেই অনেকেই তার কাছে সলা—পরামর্শ নিতে আসে। রায়তী স্বত্ব, না-দাবি, হ্যান্ডনোট, মর্টগেজ, বেনামদার সবই নয়ান খানিক খানিক বোঝে। এখানকার খেলাধুলোর পান্ডা, লাইব্রেরির ফাউন্ডার মেম্বর, হুজ্জোৎ হ্যাঁপায় নাইট গার্ড, দুপুরবেলা রেলের অফিসে একটা চাকরীও করে—ছুটিছাটায় পুরী-ঘাটশিলা-যশিডি ছোটে।
বউটি আদর্শ সহধর্মিণী। একদিন জমি জায়গার ব্যাপারে সারাদিন ছুটোছুটি গেল। নয়ান তাকে সন্ধ্যে ট্রেন ধরার আগে খেয়ে যেতে বললো। বউটি ভাত দিল। কী সুন্দর গোছালো—যত্ন করে তাকে ভেতরের বারান্দায় বসে স্বামী-স্ত্রীতে খাওয়ালো।
‘বলরাম এসেছিল। আপনি ছাব্বিশের ওপর কিছুতেই উঠবেন না। চেপে থাকবেন।’
‘থাকতে থাকতে যাতায়াতেই যে গুচ্ছের পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে—’
‘জমি জায়গা করতে গেলে ওটুকু বেরোবেই। আগে বেশ খানিকটা নিয়ে বাড়িঘর করে বসে যান আপনারা—তারপর ধীরে সুস্থে দেখে শুনে কিনবেন। হুটোপাটা করেছেন কী দর চড়বে—’
‘দর কি আমি চড়াই নয়ান! চড়ায় রেল—‘
‘মানে?’
‘আসবার সময় রোজই দেখি রুদ্রনগরে ইলেকট্রিক ট্রেনের ওভারহেড তার টেনে নিয়ে যাচ্ছে—লাইনের দু’ পাশে জরিপ হচ্ছে। সরু পিয়াসলে নতুন ব্রিজের গার্ডার মাথা তুলে দাঁড়ানো। এসব কী আর তোমাদের বলরাম, ভুবন ওদের চোখে পড়েনি?’
‘পড়ুকগে। আপনি চেপে থাকুন। নিজে হেঁটে এসে ও জমি আপনাকে লিখে দিয়ে যাবে। আগ্রহ দেখিয়েছেন তো কী মরেছেন।’
মরবারই কথা। এ তল্লাটে বিঘেটাক জমির যা দর তা দিয়ে কাঠা দূরে থাক—কলকাতার আশেপাশে ছটাকখানেক জায়গাও কেনা যাবে না। সস্তাই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল অন্যদিকে। ডাঙ্গা জমি নয়—শালী জমি সব। এ-বছরও চাষ দিয়েছে শুটকো শুটকো ধান হয় অনেক কষ্টে। জল দাঁড়ায় না। উঁচু করে আল দিয়ে জল বেঁধে রাখতে হয়। ফি বছর আল সরতে সরতে কার জমি যে কোথায় তা আর জেলা জরিপের নকশা দেখে বোঝার উপায় নেই। তার ওপর মনোমত সাইজের জমি পাওয়াও কঠিন। কোনোটা ছিটকানো পায়েস—কোনোটা অষ্টাবক্র। মাপেই বারো কাঠা তেরো ছটাক—তাতে বড়ি শুকোতে দেওয়া যায়। পুকুর কেটে জায়গা ভরাট করে সেখানে আর বাড়িঘর তোলার জায়গা থাকে না। থাকলেও, সামান্য জমি—তাহলে আর ট্রেনে এতখানি আসা কেন? কলকাতায়ই থাকা ভাল। তাই, কুবেরের মুখে জায়গার কথা শুনে আরও চার পাঁচজন তার সঙ্গে এখানে এসেছে। বাঁকাচোরা জায়গাগুলো সবাই মিলে এক লপ্তে কিনে পরে সাইজমত ভাগ করে নেওয়ার কথা হয়েছে।
কিন্তু নেওয়া আর হয়ে উঠছে না। বলরাম, ভুবন ওরা বড় ভোগা দিচ্ছে। আর ওদেরই বা দোষ কী। দালালের কান ভাঙানিতে কার না মনটা দপ্দপ্ করে। দেব দিচ্ছি করেও বলরাম, ভুবন দিচ্ছে না।
‘ওই ছাব্বিশের দরেই দেবেখন। দেখবেন—’
নয়ানের সঙ্গে তর্কে গেল না কুবের। এমন কোন দায় নেই নয়ানের যে, কুবেরকে তার জমি কিনিয়েই দিতে হবে। নয়ান না থাকলে এখানে তার জায়গা কেনা সহজ হতো না।
‘বলরাম দোকান আগলাতে গেছে। ভাইপোটাকে বসিয়েই আসবে। এখন তো ভর সকালবেলা—জোর বাজার
‘আমি বরং ঘুরে আসি—তোমাদের এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হলো।’
‘যেতে বলেছে?’
‘বলছিল—’
‘যান। তবে, দেরি করবেন না। বললাম এসে পড়বে—’
‘রিকশা নিয়ে নিচ্ছি একটা।’
‘কোথায় জায়গা কিনলেন, কোথায় কিনবেন—কাদের জমি—পষ্টাপষ্টি কিছু বলবেন না কিন্তু। ওরাই ঘা দিয়ে দর চড়ায়।’
দর কথাটায় কুবেরের মাথার মধ্যে প্রায়ই বড় বড় গুণ ভাগ হয়ে যায়। নাইন্টিন টোয়েন্টিফোরে বালিগঞ্জ গার্ডেনে কাঠা ছিল চারশো। এখন? ভাবাই যায় না ক’গুণ বেড়েছে। তখন যদি খানিকটা কষ্ট করে ধরে দেওয়া যেতো। কিন্তু তার উপায় ছিল না। চব্বিশ সনের বেশ পরে কুবেরের জন্ম।
‘না না আমি কিছু বলছি নে—’
নয়ান পরিষ্কার বলে দিয়েছে অনেকবার—’কারও সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলবেন না। ভালোমানুষি এখানকার অনেকে বোঝে না। নিজের গ্র্যাভিটি নিয়ে থাকবেন।’
আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও বিপদ। কুবের তা এখন হাড়ে হাড়ে জানে। কী কুক্ষণে যে টিকিট কাটার কাউন্টারের লোকটির সঙ্গে কথা বলেছিল। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক জিনিস কুবেরের মুখ দিয়ে শুনেছে; তখন সে কদমপুরে প্রথম প্রথম আসছে। তারপর দেখা গেল সিগন্যালের লোক, ক্রুম্যান, মায় ঘণ্টিওয়ালা-সবার খোঁজেই সস্তায় জমি আছে—অর্থাৎ দালালির গুড়ে সবারই লোভ।
বাস আসছে দেখে রিকশাওয়ালা মাঠে নামল কুবেরকে নিয়ে। নস্করদের ইঁটের পাঁজায় ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাতিল খোলাগুলো ধানী জমির মাঝে মাঝে বর্ষার জলে এক একটা দিঘি হয়ে আছে। ইজারাদারের লোক ছুটির দিনে ছিপফেলার পাস ছাড়ে। পঞ্চাশ ষাট বছরের সব গর্ত—এবড়োখেবড়ো। তিরিশ সের এক মণের সব মাছ দিঘি তোলপাড় করে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। নয়ানের জ্যাঠাবাবু বড় ভেলার সঙ্গে সাতশো গজ নাইলন কর্ড বেঁধে কামার দিয়ে গড়ানো ম্যাগনাম সাইজ বড়শিতে বেড়াল গেঁথে ছেড়ে দিল চড়কের রাতে। পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা ভেলাটাকে মাঝদিঘিতে টানাটানি করে মাছটা একেবারে মাটিতে গিয়ে শুয়ে থাকল। কর্ড ধরে কিছুতেই তোলা গেল না। শেষে রাগে রাগে জ্যাঠাবাবু নিজেই কেটে দিল।
নয়ান বলেছিল, ‘ওসব মাছ বঁড়শি গেলায় চোস্ত। মুখ একেবারে স্টিল হয়ে গেছে।’
সন্ধ্যেবেলা ইটখোলার গর্তগুলো দেখে কুবেরের বড় কষ্ট হয় আজকাল। খাবলা খাবলা মাটি তুলে নিয়ে যাওয়ার পর খন্দগুলোর আর সদ্গতি হয়নি—পিণ্ডি দেয়নি কেউ। ইটখোলা যে বানিয়েছিল, কাজ ফুরোতে কবে সে কেটে পড়েছে।
একটা বোড়াসাপ রিকশার চাকা বাঁচিয়ে খালে নেমে গেল। বিমল ডাক্তার ওয়ার্ডের বাইরে অর্ধেক বয়সের এক ছোকরার সঙ্গে মাঠে দাঁড়িয়ে। তেল চপচপে ছোলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে গালে দিচ্ছে। কুবেরকে দেখে এগিয়ে এলো ‘ভেতরে বসুন-আসছি।’
সেন্টারে ঢোকার মুখে কুবের একখানা পুরনো মোটর দেখেছে এইমাত্র। সামনের বাঁ চাকাটি পাঞ্চার করে গাড়িটি বিকল। পেছনের সিটে হেলান দিয়ে ঘাড়ে—গর্দানে দুই মক্কেল তাড়ির কলসি ফাঁক করছে। বাইরে দাঁড়ানো একটা লোকের চোখে গগলস্। বোধহয় ড্রাইভার। তারও হাতে একটি পকেট কলসি।
কুবেরকে এক ছোকরা ভেতরে বসাল। বাইরে ডাক্তারের সঙ্গে আড্ডাধারী ছোকরাটিকে চেনা-চেনা লেগেছে কুবেরের। সে-ই ভেতরে এলো, ‘সাবধানে বসবেন। চাদ্দিকে ইনফেকসাস সব রোগ—
কুবের চিনতে পেরেছে। মহা ফোক্কড়। নাম বিকাশ বোস। পেকে একেবারে খয়ের। অল্প বয়সেই বিয়ে থা করে বাপের সম্পত্তি আগলাচ্ছে। স্টেশনে আলাপ হয়েছিল। অতটুকু ছেলের তিন তিনটে পোনা প্ল্যাটফর্মেই বাপের কাছে পয়সা চাইতে এসেছিল। কুবেরের সঙ্গে প্রথম আলাপেই বলেছিল, ‘আপনি শালকের কুবের সাধু খাঁ না? আপনাকে আমি চিনি।’
স্মার্ট কথাবার্তা—জগতের সব বোঝে এমন ঢঙের মুরুব্বিয়ানা হাঁটা চলায়। সংক্রামক রোগের কথা বললো কেন? এমন কাছাখোলা হওয়ার জন্যে নিজেকেই দুবেলা দুষছে কুবের। আপনাকে আমি চিনি বললে কুবেরের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অথচ সে ফেরারী নয়।
ডাক্তার এল খানিক পরে। একেবারে ওয়ার্ডে নিয়ে বসাল। লাইন দিয়ে রুগীর দল। টিকিট দেখতে দেখতেই কথা চালাল। কুবের অনেকটা অবশ হয়ে পড়েছে। তার কী কোন অসুখ হবে। কিংবা হয়েছে। ধরতে দেরি হয়ে গেছে বলে হয়তো আর সারবে না।
ট্রেনের মতো এখানেও আপারহ্যান্ড নিলো ডাক্তারটা। দু’চারবার আঙুল এগিয়ে দিয়ে গুটিয়ে নিতে হলো কুবেরের। কনক্লুশনে পৌঁছে গেছে—এভাবে কিছুই দেখল না। ডাক্তার নিজে থেকেই আবার আসবার কথা বলে কুবের রিকশায় বসলো।
বিকাশ ফোক্কড় গেটেই ছিল, ‘একি উঠলেন?’
‘হ্যাঁ, আজ আসি—’ একেবারে সিনেমার বিদায় নিয়ে ফেলল কুবের। ফেরার মুখে সেই গগলধারী, বিকল মোটর—পিচের লম্বা ফিতে, সাইকেল রিকশার ছায়া সামনে সামনে ছুটেছে।
‘জমিজমা কদ্দুর?’ পাকা খয়ের তার পেছন ছাড়েনি।
‘কোথায় আর হচ্ছে—’ রিকশা থেকেই ছুঁড়ে দিল কুবের।
কী একটা অন্ধকার জ্বর এই সকালবেলার সব কিছু কালো করে দিচ্ছে। ঠিক এইভাবে ধানের কচি পাতায় লক্ষ্মী পোকা উঠে আসে। আগেভাগে কিছু জানা যায় না। বলরাম হয়তো একা বসে আছে। হেলথ সেন্টারে না এলেই ভাল ছিল। কতলোকে অমন ঘুরে যাওয়ার নেমতন্ন করে থাকে। তা’ বলে সব জায়গায় সবাই যায়?
সত্যি বলরাম-ভুবনদের দাগটার পুরো কোবালা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে কুবের আর এসবে জড়াবে না। আসলে দাগ ওদের দুটো। জেলা জরিপে ১৩১৬ আর ১৩৭১। নতুন সেটেলমেন্টে ২০০৮ আর ২০১৯। মোট জমি একশো চব্বিশ শতক। তিন বিঘে পনের কাঠা দশ ছটাক! সার্ভেয়ার রায় মশায়ের হিসেবে আরও আটত্রিশ স্কোয়ার ফুট। মৌজা-মেদনমল্ল। তৌজি নং তিন শো উনিশ। কুবেরের সব মুখস্থ। এখন সে আগাগোড়া ভুলতে চায়।