কুবেরের বিষয় আশয় – ২৬

॥ ছাব্বিশ ॥

কলকাতায় সেদিন লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে তিন তিনখানা ট্রাম পুড়ছিল। লোকজন ছুটোছুটি করছে। জজ কোর্টের দিকে যাওয়া গেল না। শেয়ালদায় রেল পুলিসের অফিসে পৌঁছে ভদ্রেশ্বর দেখল পুলিস আসছে যাচ্ছে-ছুটছে। তারই ভেতরে কোনরকমে ঢুকে একজন নরমমত লোককে দেখে বললো, ‘আমাদের একটা কুকুর হারিয়েছে। এদিকে দেখেছেন—’

লোকটা ধমকে উঠল। তাকে থামিয়ে দিল পাশের চেয়ারের ঢিলেঢালা মোটা আরেকজন দারোগাবাবু, ‘কি হারিয়েছে বললে? কুকুর? কেমন দেখতে ছিল—’

ভদ্রেশ্বরের বুকে সাহস এল, ‘আজ্ঞে হারাবার কথা নয়। দুধে ভাতে ছিল। কি যে মতি হল—‘

‘পোষা কুকুর বেরিয়ে গেল?’

‘আজ্ঞে মুনিব বাইরে থাকেন। দেখাশুনোর কোন গাফিলতি হয়নি। বাঘা বলে ডাকলেই ছুটে আসত।’

‘দেখল চিনবে?’

‘খুব স্যার। গুটি আষ্টেক গোঁফ ছিল। ডান গালে একটি তিল আছে। কি যে মতি হল—রাত আটটা একের ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে উঠে বাবু ইদিকে এসেছেন।’

একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। সে বললো, ‘খুব বয়স হয়নি—সব সময় চনমন করছে—’

শিশু বলতে পারেন। গত সনের দোলপূর্ণিমেয় জন্ম —সকালবেলা।’

‘বাচ্চামত। আমি ধরেছিলাম। ভাবলুম এত বড়ো শহরে হারিয়ে যাবে। লাস্ট ট্রেনে সরু পিয়াসলে ফিরছিলাম। সঙ্গে ধরে নিয়ে গেলাম! ট্রেন থামতেই লাফিয়ে ছুট—’

মোটা দারোগাবাবু বললেন, ‘কড়েয়া থানায় যাও। পেলে ওখানেই পাবে—’

ভদ্রেশ্বর ভেবে দেখল এত বড় পৃথিবীর কোথায় বাঘাকে পাওয়া যাবে। বলিহারি জীব। ছিলি আরামে —পালাতে গেলি কেন। এখন বোধহয় ধর্ম রাজার সঙ্গী মনস্তাপে অচেনা জায়গায় শুধু ঘেউঘেউ করছে। কোথায় খুঁজবে। যেমন মুনিব তেমন কুকুর। আজ কতদিন সাধুখাঁ মশাইয়ের সঙ্গে দেখাপত্তর নেই। রাস্তায় বেরিয়ে দেখল, ট্রামবাস সব বন্ধ। ফাঁকা ট্রাম লাইন দিয়ে পুলিস-ভ্যান একা একা যাচ্ছে। কলকাতায় যা হয়ে থাকে। লোকজন সব সময় ভীষণ রেগে আছে। স্বাধীনতার মুখে মুখে আর সবার সঙ্গে ভদ্রেশ্বরও ভেবেছিল, আর চিন্তা নেই—এবার সবকিছু ভাল হয়ে যাবে। কোথায়!

ফাঁকা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কড়েয়া থানায় গিয়ে হাজির হল। বেলা দুটো তিনটে হবে। নাল-লাগানো পাম্পশু পায়ে খটখট করে থানার বারান্দায় উঠলো ভদ্রেশ্বর। সেখানেও প্রথমে পাত্তা পেলো না। শেষে বুঝিয়ে বলতে একজন পুলিস তাকে ভেতরের দিকে লোহার জাল লাগানো একটা বড় আটচালার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিলে, ‘দেখুন আছে কিনা—’

ভদ্রেশ্বরকে দেখেই আশি নব্বইটা হারানো কুকুর একসঙ্গে ঘাড় ফেরাল। তারপর একই সঙ্গে তাদের সে কি কান্না। কুঁই কুঁই-কুঁই কুঁই। থামতেই চায় না। কেউ রাস্তা ভুল করে, কেউ রেগেমেগে এখানে এসে পড়েছে। ‘দাঁড়া রে বাবারা—মন খারাপ করিস নে। আজ বাইরে যাবি কিরে কলকাতায় গুলিগোলা চলছে! সময় হলেই বাড়ি যাবি—’, বলতে বলতে ভদ্রেশ্বর ওদের গাল দেখছিল। ডান দিকে তিল আছে, না নেই? কিন্তু এতগুলো মুখ?—তবে বাঘার সারা গা হলদেটে। নাঃ, তেমন কপাল করে আসেনি ভদ্রেশ্বর। ভেবেছিল শেয়ালদায় পেয়ে গেলে গলায় চেন পরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যে-সন্ধ্যে সাধুখাঁ মশাই-এর বাড়ি গিয়ে হাজির হবে। অনেক নুন খেয়েছে। একটুখানি শোধ হয়ে যেত। ঝুলপকেটে আধসেরী লোহার শেকল বিড়ে পাকিয়ে পড়ে আছে। ওজনে ঘাড়ের কাছাকাছি পাঞ্জাবি ছিঁড়ে যায় যায়! তা হলে সরু পিয়াসলেই একবার ঢু মারতে হবে।

ফেরার সময় আর শেয়ালদায় ফেরা যায় না। ঢিল পড়ছে, মোড়ে মোড়ে জটলা, দূরে দুমদাম আওয়াজ। কি রে বাবা! বাঘার খোঁজে বেরিয়ে শেষে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াবে নাকি। যে পথেই এগোয়—লোকে বলে, ‘আর এগোবেন না মশাই।’ সন্ধ্যের সঙ্গে সঙ্গে কারা ঢিল মেরে রাস্তার আলো ফাটায়ে দিল। ফাল্গুন মাস পড়তেই জলের দাঁত ভেঙে গেছে। শীত নেই বলতে নেই। কিন্তু রাস্তাঘাট একেবারে পৌষ মাসের বিকেল হয়ে গেছে। এমন দিনে সাধুখাঁ মশাই একা একা মেদনমল্লর দ্বীপে কি এত ধান করছে। একবার তো এদিক এলেও পারে। শেষে জঙ্গল হাসিলে নেমে পড়েনি তো। যা একখানা লোক!

কোনক্রমে শেয়ালদায় এসে সাতটা বাইশের ট্রেনটা ধরে ফেলল। প্যাসেঞ্জার নেই। আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি ভদ্রেশ্বরের। ইদানীং প্রায়ই হচ্ছে না। ভোর হলে দু’ পালি চাল চাই। এ ছাড়াও অন্য বাজার দোকান তো আছেই। বড় ছেলেটা খালে মাছ ধরে বসে বসে। যেদিন বড়সড় একটা পেল তো বাড়িতে মোচ্ছব। শনিবার একটা পেয়েছিল। মুড়োটা ভদ্রেশ্বরের পাতে দেওয়া হয়। চুষতে চুষতে ষোল বিঘের দাগে বড় দিঘির কথা বারবার মনে পড়ছিল। বারো ভূতে সেখানকার মাছ চিংড়ি লুটেপুটে খাচ্ছে। বহরিডাঙ্গার আদালতে আজ সাত বছর মামলা ঝুলছে। ও তরফ শুধু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিন নিচ্ছে। কাগজ ভদ্রেশ্বরের দিকে। থার্ড মুন্সেফবাবু যদি একট বুঝতেন! রায় যদি তাড়াতাড়ি বেরোতো—তা হলে এ বাজারে এতগুলো পেটের আহার যোগাতে ভদ্রেশ্বর ভোর-রাত থেকে মধ্যিরাত অবদি কাগজ নিয়ে, দলিল নিয়ে, ডেমি নিয়ে পড়ে পড়ে ঘাঁটাঘাঁটি করত না।

ইদানীং লোকজন জমি-জমা কেনাকাটাও ছেড়ে দিয়েছে। আগে ধান উঠলে যাত্রার রিহার্সেলে পাড়া সরগরম হয়ে থাকত। এখন সবাই ভ্রু কুঁচকে আছে। সাধুখাঁ মশাই থাকতে জায়গা-জমি কেনাবেচনার সময় ভদ্রেশ্বরের হাতে কিছু পয়সা আসত। সে পাট বন্ধ। চকদার বনে গিয়ে কুবেরবাবু সবকিছু ভুলে বসে আছে। ধানের নেশা বড় নেশা।

দু’টো লোক এক কোণে বসে কি সব বলাবলি করছে। সরু পিয়াসলে আসতেই ভদ্রেশ্বর নেমে পড়ল। চায়ের স্টলে এক গ্লাস চা আর খান দুই নোনতা বিস্কুট দিয়ে পিত্তি রক্ষা করল প্রথমে। তারপর জিজ্ঞাসা করে একটা আন্দাজী খবর পেল। চিটু দাশ বলে সেখানকার এক বাবু অনেক কুকুর পুষে থাকেন। থানার কাছেই বাড়ি। চা—ওয়ালা দেখেছে—একটা নতুন কুকুর আমদানি হয়েছে।

আর দেরি না করে পকেট থেকে চেন বের করল। তারপর সরু পিয়াসলের সবেধন বাঁধানো পিচ রাস্তা ধরে এগোতে লাগল ভদ্রেশ্বর—হাতে চেন। কোন্ বাড়িটা চিটু দাশের তা ঠিক করতে পারল না। সারাদিন ঘুরে আর পা চলছে না। শরীর খারাপ বলেই যেন জেদ ধরে গেল। প্রথমে খুব আস্তে, তারপর একটা বিদঘুটে গলায়—’বাঘা। বাঘা। বাঘা রে—’ বলে ভদ্রেশ্বর ডেকে উঠল। শরীর বোধ হয় কাঁপছিল। তাই হাতে ঝোলানো ভারী চেনটা ঝনঝন করে উঠল। ডান হাতের একটা অফিস-বাড়িতে ঢং ঢং করে আটটা বাজালো কে। সামনে অন্ধকার তেতলা বাড়িটার ঘরে ঘরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠল। একসঙ্গে অনেকগুলো কুকুরের গলা। ভদ্রেশ্বর আর একবার খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠল ‘বাঘা। বাঘা।’ একজন লোক খুব তাড়াতাড়ি তেতলা থেকে চটি ফটাস করে নীচে নেমে আসছে।

ঠিক তখন কদমপুরে দোতলার দক্ষিণমুখো ঘরে দেওয়াল-জোড়া জানলার পাশে কুবেরের নরম বিছানায় দেবেন্দ্রলালের ঘুম ভেঙে গেল। সৃষ্টিধরের সঙ্গে ঘুরে ফিরে বেড়াতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে এ-ঘরে একটু গড়াতে এসেছিল দেবেন্দ্রলাল। অবেলায় শুয়ে গভীর ঘুমে সন্ধ্যে কাবার করে দিয়ে তবে উঠেছে। বহুকাল এমন নির্জনে, এত খোলামেলায় দেবেন্দ্রলাল ঘুমোয়নি।

সামনের দেওয়ালেই কুবেরের মায়ের একখানা বড় ছবি। তাতে বাড়ির তোলা ফুলের মালা শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে। যেদিক থেকেই তাকায়—দেবেন্দ্রলাল দেখল, তার দীর্ঘ দিনের বিবাহিত স্ত্রী তারই দিকে তাকিয়ে আছে। নীচে বাঁধানো গোয়ালে বড় বড় গরু পা ঠুকছে—ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস নিচ্ছে।

আর ক’টা দিন থাকলে সবই দেখে যেতে পারতো। কপালে নেই। এসব দেখলে ওদের মা আরও দশটা বছর বেশী বাঁচতো। বড় সাধ ছিল, নিজের একখানা ঘর হবে—নিজের একটা আলমারি থাকবে, তাতে পছন্দমত জিনিসপত্তর গুছিয়ে রাখবে, দরকারমত খুলে দেখবে। আর ক’টা দিন থাকলে সবই হতো।

শ্বশুরকে তাঁর ছেলের খাটে শোয়ানোর ব্যবস্থা করে বুলু নীচে নেমে গিয়েছিল। মাঝে দু’ দুবার দেখে গেছে। মানুষটা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন। জাগায়নি। এদিকে কোন রকমের শব্দ হতে দেয়নি। নিজে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। সৃষ্টিধর, কুসুম ধমক খেয়ে সেই যে ঠাকুরদালানের বারান্দায় গিয়ে বসেছে—একবারের জন্যেও এদিকটা মাড়ায়নি।

বুলু ঘরে ঢুকে দেখল দেবেন্দ্রলাল তার শাশুড়ীর ফটোর দিকে তাকিয়ে—চোখে জল। বুলুকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলল, ‘বাচ্চারা কোথায়?’

বুলু বলছিল, ‘নীচে আছে’, এমন সময় দুজনেই খুব ভয়ে ভয়ে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। সৃষ্টিধর বললো, ‘ডাকছিলে?’

দেবেন্দ্রলাল হেসে ফেলল। বুলুর ভেতরটা আগাগোড়া কেঁপে উঠল। বিয়ে-করা বউ মরে গেলে মানুষের এমন হয়।

সৃষ্টিধর বললো, ‘আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবে?’

দেবেন্দ্রলাল কোন উত্তর দিল না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, শেষে হেসে বললো, ‘আমাকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাবে?’

কুসুম অতশত বোঝে না। সে নিজের মত করে বললো, ‘আমি বাবাকে নিয়ে আসব।’

এবারে বুলু আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘কি করে আনবি?’

কুসুম ঘাবড়ালো না, ‘জোরে—খুব জোরে বাবা বলে ডাকব। ঠিক শুনতে পাবে। ছুটে চলে আসবে-’

এত নিশ্চিন্ত আসরে দেবেন্দ্রলাল কোনদিন বসেনি। আজ কুবেরকে দেখলে খুব আনন্দে থাকত। সব জিনিসই একটুর জন্যে খুঁত থেকে যায়—কানায় কানায় ভরে উঠতে পারে না। কোথায় গেল ছেলেটা? বুলুকে বললো, ‘তোমার শাশুড়ী কোনদিন ছেলেদের কোন ব্যাপারে ত্রুটি রাখতেন না। কি বা মাইনে পেতাম! তার ভেতরেই যতদূর সম্ভব করতেন-’

একথা কুবেরের মুখেও শুনেছে বুলু। কুবের প্রায়ই বলত, ‘জানো বুলু আমার মা সারা জীবন শুধু কষ্ট করেই গেল।’

এবারে দেবেন্দ্রলাল যা নিয়ে কথা শুরু করল, বুলু জানে, শ্বশুরমশায়ের তা খুব প্রিয় জিনিস। স্টিমার কোম্পানিতে কাজ করার সময় মালবাবু বলেছিল, ‘দেবেন্দ্রলাল, মুখে রক্ত তুলে কামানো পয়সা ছেলেদের পেছনে ঢালছো ভালো? কিন্তু বুড়ো হলে কি ওরা তোমায় দেখবে?’

দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘বউমা, আমি তখন ছেলেদের দেখিয়ে বলেছি—ওরাই আমার মোবাইল ইনসিওরেন্স পলিসি। লোকে টাকা জমায়—ঘরদোর বানায় আরাম করে—আমি ছেলে বানাই, ছেলে তৈরি করে তুলি।’ এখানে থেমে বুলুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বল ঠকেছি আমি?’

বুলুর কাজ এখন সায় দিয়ে যাওয়া। উজ্জ্বল ঘর, ঝকঝকে ফার্নিচার, কোন গোলমাল নেই চিন্তা নেই—তার ভেতরে সাধুখাঁ পরিবারের এক নম্বরর মানুষটা আনন্দে, সুখে মুখে আর হাসি ধরে রাখতে পারছে না।

মনে আনন্দ থাকতে থাকতে দেবেন্দ্রলালকে বুলু কমলার রস, ছানা খাইয়ে রাতের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে দিল। এমনিতেই রাতে খাবে না বলে দিয়েছিল। তারপর কোন্ কথায় কখন আবার মন ভারী হয়ে উঠবে—তার চেয়ে যা কিছু দিয়ে দেবেন্দ্রলালকে খেতে বসার বাজে ঝামেলা থেকে রেহাই দিল বুলু। এত ফাঁকা বাড়িতে খেতে বসার কাজটাকেও আজকাল তার ফালতু লাগে।

পরদিন খুব ভোরে উঠে অনেক কিছু খেতে হল দেবেন্দ্রলালের। সকালের ঝকঝকে রোদে এই বয়সেও মনে হল, জীবনটা বুঝি এইমাত্র শুরু হয়েছে। ডালপালা ফাটিয়ে লাল ফুল ফুটছে মাদারগাছের সারা গায়ে। প্রথমে তা দেখেই এগোলো খালপাড়ে। একটা অল্পবয়সী ছেলে বসতে না বসতেই বড় একটা রুই বাঁধিয়ে ফেলেছে ছিপে। দেবেন্দ্রলালের মনে পড়ে গেল, এই বয়সে সবচেয়ে ইনপর্টেন্ট কাজ হল, হজম হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখা। হজম না হলে বুকে গ্যাস হয়ে নিশ্বাস আটকে মরতে পারে। আর গুরুপাক চর্বিজাতীয় খাবার-দাবার রক্ত চলাচলের গলিগুলোর ছাদে, গায়ে এমনভাবে জমে থাকবে যে, রক্তই যাতায়াতের পথ না পেয়ে আস্তে আস্তে সারা শরীরে লাল দই হয়ে উঠবে। তখন হরিও রাখতে পারবে না। বুকের ভেতরের রক্তের টিউবওয়েলটা বিকল হয়ে যাবে।

জোর কদমে হেঁটে কদমপুর স্টেশনে চলে এল দেবেন্দ্রলাল। ট্রেন বোঝাই দিয়ে ডাব, টমেটো, ডিম, মাছ, তাড়ি কলকাতায় যাচ্ছে। কত খাবার জিনিস পৃথিবীতে। এখনও দেবেন্দ্রলাল সব কিছু চিবিয়ে খেতে পারে। কয়েকটা দাঁত নেই বলে মুখের ভেতরে কিছু জায়গায় খাওয়ার সময় ঘন ঘন জিভ বোলাতে হয় অবশ্য। তাতে খুব একটা অসুবিধে হয় না।

রেল-লাইনের দু’-ধারে নতুন গজানো বসতি, মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠ, ছায়া ছড়ানো বড় বড় বাবলাগাছের সারি। দেবেন্দ্রলাল হাঁটা ধরে দিল। এদিককার বাতাসে কেমন একটা খুশি ভরে আছে—দেবেন্দ্রলাল ঠিক ধরতে পারল না। হাঁটতে ভালই লাগছিল। তিন চার সনের নারকেলগাছগুলো বসতবাড়ির বেড়া ডিঙিয়ে পাতা মেলে দিয়েছে। ছায়া আছে, আলো আছে, রোদের তাত বড় একটা নেই। কলকাতায় বড় বউমা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছে দেবেন্দ্রলালের নামে। ছেলেরা হাতখরচের টাকা পাঠালে সেখানে রেখে দেয়। দেবেন্দ্রলাল উড়ে চললো।

এক জায়গায় এসে থামতে হল দেবেন্দ্রলালের। সেখানে মজা-পিয়ালির বুকের ওপর রেলপুল দাঁড়িয়ে। নীচেই শুকনো খটখটে মাটিতে রাখালরা গরু ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। ধানকাটার পর মাঠ ভরে খোঁচা খোঁচা খড় নাড়া দাঁড়িয়ে আছে। তারই ভেতরে দেদার আকন্দ চারা। চারদিকে কত পাথর পড়ে আছে। বড় বড়গুলো মাটির মধ্যে গেঁথে বসে আছে। জায়গাটা নির্জন শুধু ট্রেন এলেই গমগম করে ওঠে।

কি খেয়াল হল—দেবেন্দ্রলাল সাবধানে নামতে শুরু করল। স্টিমার কোম্পানির পুরনো লোক। পুলের গোড়ায় জল মাপার রং-চটা গজটা পড়ে থাকতে দেখে বুঝলো, এখান দিয়ে একদিন লঞ্চ চলত—সারেঙরা গজে জলের দাগ বুঝে স্পিড নিত।

‘কে?’

পুলের নীচে ছায়ার আড়ালে এসে পড়েছিল দেবেন্দ্রলাল। খেয়াল করেনি। আলখাল্লা পরা লোকটা আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠায় বুকের ভেতরে অনেকখানি রক্ত একসঙ্গে খড়াস করে চলকে পড়ে গিয়েছে। কোন কথাই বলতে পারল না তাই। গরুগুলো ঘাসের সবুজ মখমলের ওপর দিয়ে পাউডার পাফের চেয়েও আলগোছে মুখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না—বোঝাই যায় না।

‘কি চাই এখানে?’

লাল আলখাল্লা, চোখও লাল, কপালের ঘামে বাবরির লম্বা লম্বা চুল লেপটে গেছে। দু’খানা হাত দিয়ে এইমাত্র লোকটা বোধহয় একখানা পাথর টানাটানি করছিল। পাথরখানা মাটির ভেতরে ফলা হয়ে গেঁথে আছে।

‘আমি দেবেন্দ্রলাল সাধুখা—সালকে থাকি—’

‘কুবেরের বাবা আপনি!’ লোকটার মুখের চোহরা বিলকুল নরম হয়ে গেছে। ‘আপনাকে চিনলুম না তো—’

‘আস্তে আস্তে চিনবেন। এখানে এলেন কি করে?’

‘লাইনের গায়ে পায়চলা পথটা বেয়ে অনেকখানি হেঁটে বসে আছি—’

লোকটা জবাবের জন্যে জানতে চায়নি, ‘কত গেছি আপনাদের বাড়ি—কুবের কলেজে পড়ত তখন, মা খেতে দিয়েছেন কতবার—’

‘আপনার নাম?’

‘আপনিই বলুন! দাড়িগোঁফ না থাকলে ঠিক চিনতেন।’

‘তুমি ব্ৰজ?’

‘আগে ফকির ছিলাম! এখন মোহান্ত!’

‘তার আগে ম্যাজিক দেখাতে—একবার আমাদের বারান্দায় কোটের পকেট থেকে পায়রা বের করে উড়িয়েছিলে।’

ব্রজ কথা না বলে হাঁটছিল। পাশে দেবেন্দ্রলাল। কোন মানে হয় না এমন সব হাওয়ায় এককালের নদীর বুকে বেঁটে বেঁটে গাছপালা হেলছে দুলছে। পাতলা মেঘে চুবোনো রোদ পড়ে পুলকে আলাদা চেহারা পেয়ে যাচ্ছে চারদিক। মাথার ওপরে রেল-লাইন, রেল-পুল। হয়তো এখনই নিঃশব্দে ইলেকট্রিক ট্রেন এসে পড়েই ব্রিজের ওপরে ঝনঝন করে বেজে উঠবে।

দেবেন্দ্রলাল ঘুরে দাঁড়ালো, ‘আমার ছেলে কোথায়?’

ব্রজ হাঁটতে হাঁটতেই বললো, ‘কেন আপনি জানেন না?’

‘তুমিই তাকে এ তল্লাটে টেনে এনেছ। যেখানেই থাক—এখন তোমারই ফিরিয়ে আনতে হবে।’

ব্রজ থামল। বলতে যাচ্ছিল, সময় হলেই ফিরবে। সংসারে লোভের ঘটিটা ফুটো হলে জানা যায়, সময় জলের চেয়েও অস্থির। তার আগে নয়! জীবনে আসলে চটি একখানা পাঁচালি। সেই হিসেবে লোভ গায়ে-গতরে পঞ্জিকা, নয়তো ডিকশনারি। কার কাছে এসব কথা বলবে। দেবেন্দ্রলাল তো চেনে ব্ৰজ দি ম্যাজিসিয়ানকে। এখন এসব কথা তার মুখে শুনলে—নির্ঘাত ভড়ং কি বুজুরকি বলে ধরে নেবে।

‘কুবের তো অবুঝ নয়। যেখানেই যাক—ফিরে আসবে।’

‘তুমি ইচ্ছে করলেই ফিরিয়ে আনতে পার। আমার এই ছেলেটা মহামূর্খ। ভীষণ আনাড়ী। কোন্ বিপদে পড়েছে কে জানে। তিন তিনটে মাস কদমপুর মাড়ায় না। তোমার কথা শোনে খুব। একবার খবর দিয়ে ডেকে পাঠাও না। ক’দিনই আমার বাপের মন ভাল ঠেকছে না—’

দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাঝখানে সাত আট হাত জায়গা। দেবেন্দ্রলালের পেছনে মজা-পিয়ালির শুকনো গভীর খাত মোচড় দিয়ে দক্ষিণের জঙ্গল কেটে ছুটে চলে গেছে।

ব্রজ রাত থাকতে এখানে এসেছে। স্বপ্নাদিষ্ট শিব বসানোর দিন এগিয়ে আসছে। ঘুম ছুটে গেছে তার। রেলেশ্বর শিবকে কোথাও পাওয়া যায়নি। এখানে যদি শিবের দোসর আর একখানা সাইজমত পাথর পাওয়া যায়—তা হলেই মুশকিল আসন। ভোরের আলোয় সব পাথরই সমান লাগছিল। সব পাথরই চোখ ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখানে এই নির্জনে হাওয়ার শব্দের ভেতর কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারেনি—কোনখানে নতুন করে শিব বানাবে। শেষে একখানা গেঁথে বসে যাওয়া পাথর চোখ বুজে টানাটানি করছিল। ঠিক সেই সময় দেবেন্দ্রলাল এসে হাজির।

অবুঝ মানুষটাকে বোঝাবার চেষ্টা করল না ব্রজ। শুধু বললো, ‘আমি সে জায়গা চিনিনে। শুনেছি লঞ্চে যেতে হয়। নদীপথে অজানা দ্বীপে জঙ্গল হাসিল করে চাষ —আবাদ করছে। ভালোই তো। আপনার একটা ছেলে না-হয় একটু অন্যদিকে সাহস করে এগোলোই—’

‘তুমি কোনদিন ছেলে মানুষ করে দেখেছ?’

নদীর শুকনো গাঢ় খাতে দাঁড়িয়ে এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি কোনদিন পড়তে হবে—ব্রজ তা ভাবেনি। তারও ছেলে আছে। সরস্বতী দেখে। কোন খবর জানে না। আগে যাও বা একটু জানার জন্যে মনের ভেতর চিড়িক খেত—এখন আর কিছুই হয় না। রেলেশ্বর শিবের স্নান, ভোগ সজ্জা এসব নিয়েই দেখতে দেখতে দিন কাবার হয়ে যেত। মুখে বললো, ‘না।’

‘তা হলে তুমি বুঝবে না। একটাও যা—পাঁচটাও তাই।’

পাখিরা এখানে নির্ভয়ে দল বেঁধে নামে। আবার উড়ে যায়। ফিরে আসে। এককালে ঢেউয়ের কোমর ভেঙে দিয়ে রেল কোম্পানির সাহেবরা বড় বড় পাথর ফেলেছিল। সেগুলোর গায়ে কোথাও জলের কোন দাগ নেই। তবে জায়গায় জায়গায় স্রোত ঘুরে যাওয়ার মুখে পাথরে পাথরে চিহ্ন ফেলে গেছে। সে জায়গায় মনে হয়, পাথরেরও ছাল উঠে যায়।

দেবেন্দ্রলাল আজ ক’দিন হল কদমপুরে এসেছে। এসে টের পেয়েছে, এখানকার সবকিছু বিরাট একটা বিশৃঙ্খলা। জটপাকানোর সুতোর কোন্ জায়গা থেকে গিট খুলতে হবে কেউ জানে না। পরিষ্কার মনে হল, ঠিক এখুনি একটা হেস্তনেস্ত না করলে এই ঘোলা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। সময় বড় কম। নিজেকে খুব অসহায় লাগল দেবেন্দ্রলালের। অনেককাল একসঙ্গে এতটা হাঁটেনি। বাঁ পায়ের হাঁটুতে রীতিমতো ব্যথা করছে। তবু প্রায় শেষ চেষ্টার মতো বলে দিলো, ‘তুমি কুবেরকে ফিরিয়ে আনো ব্রজ। আমি আর বেশীদিন বাঁচবো না। একটু দেখে যাই ছেলেটাকে–’

কথার ধরতাইটুকু ব্রজর কানে পৌঁছেছিল। বাকিটা আর শোনা গেল না। রেল—পুলের ওপর উঠে এসে একটা আট-বগির ইলেকট্রিক ট্রেন সারাটা তল্লাট একসঙ্গে ঝনঝন করে বাজিয়ে দিলো। গম্ভীর আওয়াজটা লেজে মাড়াতে মাড়াতে ট্রেনটা বেরিয়েও গেল। তখনও ওপরের আকাশে, গাছপালা, পাথরে পাথরে শব্দের শেষটুক ছিটকে পড়ছিল।

দেবেন্দ্রলাল আবার একই কথা বলতে গিয়ে দেখল, মুখে কোন শব্দ ফুটছে না। ছেলেদের মা বেঁচে নেই। দেবেন্দ্রলালকে যারা বুঝতো—তারা অনেকেই আজ নেই। ইদানীং একই কথা তাই ফিরে ফিরে বলতে হয় তার। আবার চেষ্টা করল। হল না।

ব্রজ বললো, ‘রোদ চড়ে যাচ্ছে। এগোই আসুন।’ রেল-লাইনের ওধারে তার এক্কা দাঁড়ানো।

দেবেন্দ্রলাল শুনলো—’চলুন যাই, কি করা যায় দেখি।’ একটু আশা হল তার। ব্যথা ভুলে গিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সেখানে রেল-লাইন। সবকিছু চাকায় পিষে এইমাত্র একটা ট্রেন চলে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *