কুবেরের বিষয় আশয় – ১১

॥ এগারো ॥

কুবের জানে ওই ফালি বারান্দায় তার জন্ম। হোগলার বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। তখন হাসপাতালের এত চল হয়নি। মিডওয়াইফ শশীবালার হাতে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সাত টাকায়। বুড়ির কেউ নেই। এক ইউনিটের কার্ডে নিজেই রেশন নেয় লাইন দিয়ে। কুবের বড় হয়ে ভাঁড়ার ঘরে একই ধরনের লম্বা লম্বা বোতলে কেরোসিন রাখতে দেখত। সেগুলো মৃত-সঞ্জীবনী সুধার বোতল। কুবের হওয়ার পর শরীর ভেঙে যাওয়ায় মা অনেকগুলো খেয়েছিল।

এগারোই চৈত্র, শনিবার, অমাবস্যার দুপুরে তার জন্ম। ক’দিন পরেই বোধহয় নীলের উপোস ছিল। কুবের জন্মাতেই কলকাতা-হাওড়া-সালকের ওপর দিয়ে গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে বিখ্যাত ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেকেন্ডে হোগলার আড়াল নিশ্চিহ্ন। তখনও ফুল পড়েনি মার।

কাশীবাসী এক পাগলি পিসি ছিল কুবেরের। ভয়ঙ্কর মুখরা বলে বিয়ের পরেই স্বামী তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বড়ঘরের ছেলে। আচমকা মরে যাওয়ায় তার ভাগের সম্পত্তি থেকে টাকা আসত পিসির নামে। সেই টাকায় পিসি কাশীবাসী। ভয়ঙ্কর সুচিবাই।

হোগলার আড়াল সরে যাওয়ায় ঝড়ের মধ্যে কাতরাতে কাতরাতে মা বলেছিল, ‘ঠাকুরঝি ছেলেটাকে একটু ঘরে নিয়ে যাবি?’

‘বউ, তুই কি আমাকে গঙ্গাচান করাবি? ও আমি ছুঁতে পারব না।’

ননদের কথায় মুখ চেপে ঘষটে ঘষটে মা ঘরে এসেছিল। আসবার সময় কয়েক ঘণ্টার কুবেরকে গামলা চাপা দিয়ে বাইরে রেখে এসেছিল। ঝড় থামলে তবে তাকে ঘরে আনা হয়।

কোন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জীবনের ইতিবৃত্ত নয়। জন্মের পর যারা একদিন গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়ের ধারায় মরে যায়—কুবের সাধুখাঁ তাদেরই একজন। মা বড় ভাল কথা। তার মুখেই এসব শোনা। ইতিহাসে যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি, শান্তিস্থাপন, পতন-উত্থান–এক একটা স্তর, সময়ের ধাপ—এই মহিলার জীবনেও তার ছেলেমেয়েদের জন্ম, অসুখ, পরীক্ষা পাস, বিয়ে, চাকরিতে বসা—জীবনের এক একটা মনে রাখার মত সিঁড়ি।

কুবের চেষ্টা করে দেখল, একেবারে পেছনে, কত পেছনে তার কি মনে আছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ‘চা-পান না বিষ পান’ পড়ে অনেকে চা ছাড়লেও বাজারে বাজারে তখন কলেরগানে খরখরে রেকর্ডে ভাটিয়ালি শুনিয়ে বিনি পয়সায় চা খাওয়ানোর বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেছে। গোপি চাকরের কোলে উঠে কতদিন কুবের এইসব গান শনেছে। গোপি ফ্রি চা খেত, মুখের চা কুবেরকে খাওয়াতো। সেই সময় তিন বছরের কুবেরকে অস্টার পরিয়ে দেবেন্দ্রলাল একটা ছবি তুলিয়েছিল। ছবিখানা এখন বুলুর অ্যালবামে। ঘাড় ঠিক ডানদিকে হেলানো। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। ডান কানের কাছে ছবিটা উইয়ে কেটেছে।

দ্বিতীয় যা মনে পড়ে, তা হল, এক জ্ঞাতি দাদুর একটি সাদা ঘোড়া। হরিরাম সাধুখার তৈরি পৈত্রিক এই বাড়ির চারতলার চিলেকোঠায় বুড়ো থাকত। হরিরামের প্রথম পক্ষের দিক দিয়ে প্রপৌত্র। অনেক বয়স। কার ছেলে—কি বৃত্তান্ত, সবাই ভুলে গিয়েছিল। দেখবার কেউ ছিল না বুড়োর। তার বয়সকালের ঘোড়াটা পৈত্রিক আস্তাবলে পা ঠুকে ঠুকে ডাঁশ তাড়াতো মাঝরাতে। মার পাশে শুয়ে রাত জেগে বালক কুবের সেই শব্দ শুনত। একদিন রাতে স্বপ্ন দেখল, ঘোড়াটা সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা সিঁড়ি বেয়ে তাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর কুবেরের বুকে উঠে এক জায়গাতেই পুরো দৌড়ের কসরৎ শুরু করে দিল। কুবের চেঁচিয়েও কূল পায় না। ঘুম ভাঙতে দেখল মশারির মধ্যে সবাই ঘুমোনো। ঘরের বড় আয়নায় জ্যোৎস্না পড়ে উল্টোদিকের দেওয়ালের অয়েলপেন্টিংয়ে হরিরাম আচমকা আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সেদিনই ভোরে কম্প দিয়ে জ্বর এল। টাইফয়েড। ছত্রিশ দিনের দিন রেমিশন। বড়দা চৌরাস্তা থেকে সেদিনই কুবেরের জন্যে বড়দানার চিনিমাখানো একটিন হাংলিপামার বিস্কুট নিয়ে এল। দুধে ভিজিয়ে তাকে একখানা খেতে দেওয়া হয়েছিল।

পাড়ার রায়সাহেব বাড়িতে কাঠের বাক্সে রেডিও থাকত। শীতকালে সন্ধ্যেবেলা রেডিও শুনে সবাই বললো, যুদ্ধ লাগলো। কিছুদিন পরেই বড়দা পট করে চাকরি পেয়ে গেল। মা কালী-বাড়ি পুজো দিয়ে এল।

৮ই জানুয়ারী অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে কুবের সাধুখাঁ ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হল। রোল সেভেন। হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার পর ঢিলেঢালা ক্লাসে ফিফথ পিরিয়ডে সনৎ একদিন কু দিল। ক্লাসটিচার মহতাবউদ্দিন স্যারের ক্লাস। কে করেছে? জানতে চাইতেই সনৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার আমি! অমনি স্যার সনতের সত্যবাদিতার প্রশংসা করে ক্লাসসুদ্ধ সবাইকে বললেন, ফলো সনৎ।

পরের সপ্তাহে ওই পিরিয়ডে কুবের কু দিল। কে করেছে? জানতে চাওয়া মাত্র কুবের উঠে দাঁড়াল। মহতাবউদ্দিন স্যার কাছে ডাকলেন। স্যারের মাথার পেছনে দেওয়ালে হরিণের মাথা লাগানো একটু উঁচুতে। স্যার চক দিয়ে কুবেরের গোঁফ এঁকে উঁচু টুলের ওপর কুবেরকে দাঁড় করিয়ে মাথাটা হরিণের দুই সিংয়ের মধ্যে আটকে দিলেন। তারপর ক্লাসসুদ্ধ সবাইকে বললেন, আমার ক্লাসে গোলমাল হলে এই শাস্তি।

সেদিন থেকে কুবের জীবনে বেতাল হয়ে গেল।

রোজ সে খারাপ হতে থাকল। লোকে যাকে খারাপ বলে—তাই।

শীতকালে হরগঞ্জ বাজারে কমলা ঢেলে বিক্রি হত। একপাল বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যেবেলা চাদর জড়িয়ে কমলা আনতে যেত। দরাদরি করে কেনার সময় কে কটা চাদরের নীচে সরাতে পারতো—তাই ছিল খেলা। মারাত্মক খেলা। ধরা পড়ে একদিন বেদম মার খেল ব্যাপারীদের হাতে। বাড়িতে বলার উপায় নেই। বললে, ডবল ধোলাই হবে।

ব্ল্যাক আউট হয়ে গেলে কুবেররা সনতদের দেশের বাড়ির কাছাকাছি মফস্বল শহরে চলে গেল। সেখানকার স্কুলের গায়ে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি ছিল। একদিন মর্নিং স্কুলের সময় কি ভিড় সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি। কুমির মারা পড়েছে সাহেবের গুলিতে। কুমিরের পেটের ভেতর থেকে চুড়ি, হার, দুল, মানুষের হাতের হাড় পাওয়া গেল একখানা।

এরপর সনতের সঙ্গে ঘোলাডাঙায় শেফালির ঘরে যাওয়া অব্দি কিছু মনে নেই কুবেরের। তারপর সবই ঘোলা। হরি ডাক্তারের ওষুধে ইনজেকসনে কুবেরের পুঁজ পড়া বন্ধ হল। কুবের সৎ হয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগল। কলেজ পার করে দিয়ে চাকরির বাজারে নেমে দেখল, এই নিষ্পাপ ভাবটা কোন কাজেই আসে না। বরং এজন্যে তাকে ঘা খেতে হচ্ছে। চাকরিতে সবাই তুখোড় লোক চায়। ফুলের এগজিবিশনে মানুষের একটা নিষ্পাপ মুখ টবে বসিয়ে রাখা হয়। মিলমিশ হতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু অফিসে কারখানায় অমন মুখের লোককে কেউই ভরসা করে না। বরং বোকা, নয়তো মিনমিনে মনে করে। অথচ মুখে এই ছাপ কুবের সাবান ডলেও ওঠাতে পারবে না। এক শুধু ধার চাওয়ার সময় এই ভাবখানা খুব কাজে এসেছে। ধনরাজের সামনে টাকার কথা তোলার দিন কুবেরের মুখে সব কিছু মিলে একটা করুণ ছায়া ফেলেছিল।

কুবের সিওর—ইরা তাকে ভালবাসত। ভালবাসত তার মুখের পাপহীন অবুঝ, করুণ ভঙ্গীকে। বুকের মধ্যে তার মুখটা ঠেসে ধরে মাথার গন্ধ নিত। পুষ্পঘ্রাণ। মেয়েলোক ভালবাসার এমন এমন সব জিনিস খুঁজে পায়। কুবেরকে মাঝে মধ্যে বানিয়ে বানিয়ে বিপদ আপদের কথা বলতে হত। তখন ইরা টাকা দিতে পেরে আরাম পেত। অথচ কুবের রোগাভোগা নয়। গীতা চণ্ডীপাঠ, কালীর পায়ে দম আটকে রক্তদান, সাঁতরানো, গাছে-ওঠা, ফার্স্ট থেকে ফোর্থ ইয়ার অব্দি কুস্তির সঙ্গে ডন বৈঠক—সব কিছু করে জামাকাপড়ের নীচে সে আর পাঁচজন পুরুষের মতই ছিল। কিন্তু তবু তাকে জ্বর জ্বর ভাব মুখে নিয়ে ইরার পছন্দ মাফিক দুর্বল, করুণ লাভার হতে হয়েছিল। ইরার স্বপ্নে ছিল—তার প্রেমিকের চুল কোঁকড়া হবে। কুবেরের তা ছিল। স্বপ্নে ছিল, চোখে চশমা থাকবে। কুবের নগেনের অল্প পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে ইরার সামনে টলতে টলতে ঘুরত। কেন না চোখে দেওয়ার খানিক পরেই মাথা ঘুরতো। স্বপ্নে ছিল, লাভার গান জানবে। এইটে আর হওয়ার উপায় ছিল না। একদিন নগেনকে আনিয়ে মাঠের মধ্যে বসে ইরার সামনে ‘মনে রেখো, ম-ও-নে রে—এ-এ-খো’—গাইয়ে ছিল। সেঝদার হিরোইন। নগেন তাই গেয়েছিল।

এমন পছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে ভালবাসা হয় না। এ যে শুধু শর্তপূরণ। শেষদিকে পুরো ব্যাপারটাই বোঝা হয়ে দাঁড়াল।

ইরা বলেছিল, ভালো চেহারার লোকজনে তার মার বড় ভয়। ইরার মা ভালো দেখতে নয় বলে ইরার বাবা তার শালীর দিকে ঝুঁকেছিল। অতএব ইরার পক্ষে কুবেরের সুন্দর হওয়ার ব্যাপারটা কিছু অসুবিধের ছিল। তখন কুবের নাইট্রিক এসিড দিয়ে নিজের মুখখানা ইরার পক্ষে জুতসই করে তুলতেও রাজি ছিল। প্ৰেম।

গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে ব্রজদার সঙ্গে দেখা। দেখেই বললো, ‘তোর হবে। আয়।’

তিরিশ মাইল বেগে হাঁটছে ব্ৰজ দত্ত। নিখুঁত সুট—হাঁটার দমকে গলার টাই একবার এদিক আরেকবার ওদিক।

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘গ্র্যান্ডে। ক্যানাডার ফেমাস ম্যাজিসিয়ান সন্ত্রীক এসেছে। কাল ভোরেই কলকাতা ছেড়ে যাবে। আমি ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ম্যাজিকস্-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। আজ আমাকে লাঞ্চে ডেকেছেন। তুই হলি কাগজের রিপোর্টার—’

‘কবে থেকে?’

‘আমিই বা কবে থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট?’ থেমে ব্রজ দত্ত বললো, ‘কাল বিকেলে সাহেব জাদুকরের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় সোসাইটির কথা বলে ফেললাম। মুখে এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকবার এই সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পোসটে নিজেকে নিজে ইলেক্ট করতে হল। একটা রিপোর্টার দরকার ছিল—হ্যাগাড লুকিং-ফাইটিং ফর ফুটিং। ভগবান তোকে মিলিয়ে দিল—’

আর কিছু বলার চান্স পেল না কুবের। একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ৰজদা বোতাম টিপছে। মোটাসোটা বুড়ো সাহেব বেরিয়ে এল। কুবেরের পরিচয় দিয়ে ব্রজ দত্ত তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। টেবিল সাজানো রয়েছে। ভালো ভালো খাবার। ব্রজ দত্ত সাহেবকে বিশেষ কথা বলতে দিল না। কুবেরকে নিয়ে সোজা খাবার টেবিলে। একটু পরে বুড়োর বুড়ি এসে যোগ দিল। খেতে খেতে ব্রজদা একটা চামচ হাওয়া করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সাহেব দু’স্লাইস পাউরুটি, একখানা মাছ ভাজা শূন্যে উড়িয়ে দিল। এইভাবে উড়তে উড়তে টেবিল প্রায় ফাঁকা। দু’জনেই খুব গুণী জাদুকর। দু’জনের উড়িয়ে দেওয়া খাবার, চামচ সব আবার একে একে টেবিলে ফিরে আসতে লাগল। কিন্তু কুবের অনেকক্ষণ ধরে একা একা যেসব জিনিস ওড়াচ্ছিল তা আর ফিরিয়ে আনা গেল না। টেবিলের নীচ থেকে ব্রজদা একটা লাথি দিল, দাঁত চেপে বললো, ‘অত গেলে না—’

সঙ্গে সঙ্গে কুবের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হাউ লং ইউ আর ইন দি প্রফেশন?’

সাহেব নানা শব্দ করে কি বললো। কুবেরের পকেটে একটি আটা কোম্পানির প্রসপেকটাস ছিল। সেইটে মুড়িয়ে নোটবই করে বাংলা লং হ্যান্ডে লিখল, ‘জীবনে এমন বিপদে পড়িনি।’ সাহেবের কথার শেষে ছিল, … লাইফ লং।’

ভাইস-প্রেসিডেন্ট ব্রজ দত্ত সমঝদারের হাসি হাসল। সাহেবের বউ অল্প হেসে খাওয়ার শেষে ছোট কাপের কফি এগিয়ে দিল। কুবের সেই ফাঁকে তার নোটবই ব্রজদার চোখের সামনে তুলে ধরল। ব্রজ দত্ত খুঁটিয়ে দেখে আর একবার হো হো করে হেসে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে কুবের দেখল, টেবিলের ওপর তার কলম নেই। হাওয়া।

ব্রজদার হাত সাফাই। সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ করা প্রসপেক্টাসখানাও অদৃশ্য। সাহেবই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? যাবার আগে সাহেব অবশ্য ফেরত দিল। কেননা কালকে সকালের কাগজেই বেরোবে। সাহেব তখন প্লেনে কোন সমুদ্র পার হচ্ছে। বিজনেস ট্রিপে বেরোয়নি বলে কোন প্রেস এজেন্ট সঙ্গে আনেনি!

গ্র্যান্ড থেকে বেরিয়ে ব্রজদা বললো, ‘কেমন লাঞ্চ খেলি ফ্রি। এবারে এক খিলি পান খাওয়া তোর দাদাকে—’

‘আমি না হয় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে এসেছিলাম। খাওয়া হয়নি। কিন্তু তুমি তো খেয়ে বেরোতে পার। বৌদি নিশ্চয় রেঁধে রাখবেন—’

‘রাখবেন কিরে! ষোড়শোপচারে রেঁধে রাখেন। ওর ওপক্ষের বড় মেয়ে আমি খেতে বসলে হাওয়া করে। কিন্তু যতক্ষণ ঘরের ভেতর থাকি—স্রেফ মনে হয় আমার ডানা কেটে দিয়েছে কে—’

‘ওসব ধানাই পানাই মানায় না তোমাকে। বৌদি এত ভালবাসেন—‘

‘ভালবাসার তুই বুঝিস কিরে! পুটকে পুটকে মেয়ে নিয়ে এদিক ওদিক করে বেড়াস। সব নজরে আসে। ভাল ভাল কথা বলিস গাছতলায় নয়তো রেস্টুরেন্টে বসে। তুই ভালবাসার কি বুঝবি রে?’

‘শুধু তুমি একাই বোঝ। বৌদি বোঝেন না?’

‘খুব বোঝে। একবার স্বামী হারিয়েছে। দোবারা হারাতে চায় না। কিন্তু আমি জানি—আই ফর মাইসেল্ফ—দি ব্রজ দত্ত খোলাখুলি যখন ভাবি, পরিষ্কার বুঝি, পুরুষলোকের কোন মেয়েলোককে ভালবাসা সম্ভব নয়। কাছাকাছি থাকা যায়। বিপদে আপদে দেখা যায়। কিন্তু আমরা সবাই স্ট্রেঞ্জ বেডফেলোজ—’

একটা প্রসেশন যাচ্ছে। দু’জনকেই থামতে হল। ট্রাম, বাস, ট্যাকসি, প্রাইভেট অচল করে দিয়ে কতগুলো লোক চেঁচাতে চেঁচাতে হাঁটছে। আর স্লোগান—‘চালের মণ ষোলটাকায় বেঁধে দাও—বেঁধে দাও—দাম বাড়ানো চলবে না।’

সামনেই ইলেকশন। উল্টোদিকের বড় বাড়িটার দেওয়ালে ছাপানো পোস্টারে নেহরু তাকিয়ে। পাশেই এক দুই তিন করে গত ক’বছরে দেশের উন্নতির খতিয়ান লেখা।

‘বুঝলি। আমার বাবার জীবেনও তাই। মা ভীষণ ডোমিনেটিং লোক। বাবা সুতো ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতো। ছাড়তে ছাড়তে মার কাছ থেকে বাবা এত দূরে সরে গিয়েছিল, শেষদিকে বোধ হয় মাকে চিনতেই পারত না। অথচ চোখ খারাপ নয়—’

কুবেরের বাঁ হাতের কোন আঙুলে খানিক জায়গা কালো হয়ে উঠছে ইদানীং। শীতকাল বলে ঘষতে ঘষতে খানিক ছাল উঠে এল। চাকরি পাওয়া গেল না একটা। অথচ এই সময় আঙুলে এসব কি ফ্যাকড়া।

‘রাতে ডিনারে তোর নেমন্তন্ন—’

‘কোথায়?’

‘আকাডেমি অব মালটিপিল্‌ আর্টস অব ইনডিয়া। স্যার বিপিনের বাড়িতে পার্টি। লেডিও থাকবেন। দু’জন ফরাসী আর্টিস্টের সঙ্গে সবাইকে ইনট্রোডিউস করিয়ে দেব। তুইও থাকিস। দাড়ি কামিয়ে পাউডার মেখে আসবি। গপগপ করে গিলবিনে! একটু আধটু ড্রিংকস্ও থাকবে।—’

‘তুমি সেখানে কি ব্যাপারে?’

‘বাঃ! আমি হলাম ফাউন্ডার সেকরেটারি জেনারেল। লেডি হলেন গিয়ে প্রেসিডেন্ট।’

‘আমি কোন্ সুবাদে যাব?’

‘তুই একজন কনটেমপোরারি আর্টিস্ট। সত্যি কি না বল? তুই এযুগে বাস করছিস-যুগের সঙ্গে জড়িয়ে আছিস তোর এভরি রাইট আছে আর্টিস্ট বলে পরিচয় দেবার। ক’জন তোর আমার মত সাফার করছে বল? ক’জন তোর আমার মত টাইমকে নিঙড়ে নিয়ে সেকেন্ড মিনিট একটুও ফাঁকি না দিয়ে সব সময় ফিল করছে?’

‘সর্দারজীর দোকানে কাচের আলমারিতে আস্ত ছাড়ানো মুরগি কেমন মশলা মাখিয়ে থাক থাক সাজিয়ে রেখেছে—’

‘তোকে খাওয়াব একদিন।’

‘এরল ফ্লিন রবিন হুড আধপোড়া মাংস আখের কায়দায় দু’হাতে ধরে খাচ্ছিল—’

‘আমার বড় দুঃখ হয় কুবের—’, সিনেমার লাইনটা পেছনে বাড়তে বাড়তে কুবেরদের সেখানে দাঁড়াতে দিল না। এত গোলমাল, তার ভেতরে কাশ্মীর সরকারের সূক্ষ্ম হাতের কাজের জিনিসপত্র ঝুলিয়ে ধুলো মাখানো হচ্ছে, ‘আমি যা জানি—শেখাবার মত কাউকে পাচ্ছি না—’

‘ছেলে মেয়েদের শেখাও। সৎ বাপের কাছ থেকে তারা ম্যাজিক শিখুক হাঁটাচলা শিখুক—কত কি শেখার আছে শিখুক—’

‘তুই হাসবি না কুবের?’ ব্রজ দত্ত ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের লোহার বাক্সে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, ‘বিপদে ভেসে বেড়াতে এও ভাল লাগে—আমি জানি, বিপদ কি করে কাটিয়ে উঠতে হয়। আমার কোন নিজের লোককে ব্যাপারটা শিখিয়ে যেতে চাই—’, এখানে একটুও না থেমে ব্রজ দত্ত বলল, ‘তুই আমার ছেলে হবি? অনেকে তো দত্তক নেয়,—বেশ—না হয় মানসপুত্র হ—’,

‘ওয়ান্ডারফুল প্রোপোজাল —একটা সিগারেট ছাড়ো আগে—‘

‘আইডিয়াটা বল? কেমন এসেছে মাথায়। আচ্ছা এবার তোকে দীক্ষা দেব। খুব কিছু কঠিন না। ওই যে বড় মিষ্টির দোকানটা দেখছিস—’,

ঠিক হল ওই দোকানে গিয়ে কুবেরকে একটা কালোজাম খেতে হবে। দাম দেওয়া যাবে না—দোকানীও চটবে না। পুরো ব্যাপারটা দু’ তরফে হাসির ভেতর দিয়ে সারতে হবে।

কুবের এগিয়ে গিয়ে দোকানের শোকেসে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, ‘চুলোয় টেম্পারেচার কনট্রোল করে এসব বানাতে হয়—’, চোখে শ্রদ্ধা ফুটে উঠল কুবেরের। লোকটা গাঁটাগোট্টা, তার ওপর ফরসা—নিশ্চয় খুব নৃশংস। একটা সিলভার লাইন আছে। সময় দিয়ে লোকটা গোঁফ ছাঁটে। তার মানে মনটা একেবারেই পাথর না। আর্ট লাভার।

‘না তেমন কিছু না। বেশির ভাগ মিষ্টির ফিনিশিং টাচ ঢিমে আঁচে দিতে হয়—’

‘তবু বলতে হবে ব্যাপারটা খুবই কঠিন—’, বলতে বলতে কুবের সন্দেশ, রসগোল্লা, কমলাভোগ, কালোজাম, লেডিকেনির থাকগুলো খুব ধীর চোখে দেখে নিয়ে অবাকভাবে বললো, ‘এসব আপনার—

লোকটা হাসতে হাসতে বললো, ‘নিন্ না খান—খেয়ে দেখুন কোনটা দেব?’

‘দেবেন। মানে—‘

‘খান আপনি। কালোজাম দিই?’

কুবের গোটা তিনেক খেল। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পয়সা দিতে গেল। লোকটা হাহা করে উঠে নিষেধ করল। তখন ছানার দর, দুধের চালান এসব নিয়ে মোট তিনটি বাক্য ব্যয় করে কুবের ফিরে এল রাস্তার এপারে।

ব্রজদা হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘ফুলমার্কস! কিন্তু আমার জন্যে একটা আনলে পারতিস।’

‘সিচুয়েশনের সঙ্গে খাপ খেত না। নইলে আনতাম~~’, বলতে বলতে কুবের দেখল, সামনে একটা লোক বিজ্ঞাপনের জন্যে বিখ্যাত ছাতা কোম্পানির একটা ঢাউশ ছাতা মাথায় দিয়ে ফুটপাথ জুড়ে হাঁটছে।

অল্পক্ষণ আগে মানসপুত্র হওয়ার পর থেকেই কুবের খুব হালকা বোধ করছে। বিশেষ বলতে হল না। লোকটা হাঁফিয়ে উঠেছিল। হাতে নিয়ে কুবের প্রথমেই সামনের শোকেসের আয়নায় নিজের চেহারা দেখল। চ্যাপ্‌টা চোয়াল। হাসল। ছায়ায় ভাল দেখাল না। কত লোক হাসলে সুন্দর দেখায়। অথচ তার বেলায় যত গোলমাল। মুখ বুজে থাকলে এত সাধু, এত পবিত্র, এত নিষ্পাপ লাগে। তা আর থাকতে চায় না কুবের। তাই আবার হাসল। এবার আর সাহস করে ছাপ দেখল না। গার্ডেন পার্টির বিরাট ছাতাটার হাতল সাবধানে ধরে হাঁটতে লাগল কুবের। একপাশে ব্রজ দত্ত, অন্য পাশে সেই লোকটা।

‘সারাদিন কতটা হাঁটতে হয়?’

‘মাইল দশেক বাবু।‘

‘কত দেয় রোজ?’

‘পাঁচ টাকা আর জলপানি—’

কুবের হিসেব করে দেখল সে আজ কম করেও সাত মাইল হেঁটেছে। সব মিলিয়ে সারাদিন দশ মাইলে দাঁড়াবে। অথচ তার জন্যে দুপুরের লাঞ্চ আর তিনটে কালোজাম ছাড়া নগদে কিছুই পায়নি, ‘রোজ ক’টা ছাতা এমন বেরোয়?’

‘কোন কোন দিন সাতটা অব্দি—নইলে চারজন লোক রোজ বেরোয়—।’ রাস্তা দিয়ে লোক যাচ্ছে আর কুবেরদের দেখছে। মেট্রোর কাছাকাছি ভিড়ের চাপে ছাতাটা একটু কাৎ হয়ে চিরুনির একজন ফেরিওয়ালাকে প্রায় ঢেকে ফেলল। কাঠের বাক্সের ওপর ঢেলে বিক্রি করছে। মাথায় চুল ঠিক রাখা ব্রজ দত্তের হাতে একখানা চিরুনি উঠে এল। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে কুবেরকে বললো, ‘দেখবি ওখানে?’ তারপর ছাতার বাইরে গিয়ে ঘুরিয়ে ঝালরে লেখা কোম্পানির নাম ঠিকানা জোরে জোরে পড়ে শোনাল। পড়বার সময় কুবেরের হাঁটা থামেনি। ব্রজ দত্ত লেখা পড়তে পড়তে পেছন ফিরে হেঁটেছে।

‘আমরা গেলে ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরতে দেবে?’

‘বাবুরা বিশ্বাসী লোক চায়। আজ বিশ বছর ছাতা মাথায় ঘুরছি। বর্ষাকালে একটা লোক দিলাম বাবুদের। আমার নাম খারাপ হয়ে গেল বাবু। পয়লা দিনেই লোকটা ছাতা নিয়ে পালালো। তারপর অনেক খোঁজ খবরের পর ব্যাটা পূর্ণিয়ায় ধরা পড়েছে—’

কুবের অবাক হয়ে গেল। অত বড় ছাতা মাথায় দিয়ে পূর্ণিয়া অব্দি এত মাইল গেল কি করে লোকটা! কিছুকাল আগে পূর্ণিয়ায় বন্যার ছবি কাগজে ছাপা হত। সব বন্যা, সব শীতকাল এত একঘেয়ে। আলাদা কোন ফ্লেভার নেই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। রাস্তা বাড়বে বলে হরিরাম সাধুখাঁর বাড়ি ভাঙার নোটিশ পড়েছে। অথচ এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। একটি বাড়ি খুঁজে নেওয়া দরকার। পাড়াটা বেশ খোলামেলা হবে। বাড়ির সামনে একটা লন থাকলে সোনায় সোহাগা। সেখানে শীতকালের সকালে বেতের চেয়ার টেবিলে বসে রঙীন ছবির বই দেখবে। মাথার ওপর এই ছাতাটা বসানো থাকলে খুব আরাম হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *