॥ কুড়ি॥
আমার স্বামীর নামে রাস্তা হয়েছে। তাঁর ধারণা আরও অনেক কিছু হওয়া বাকি—একে একে হবে।’
‘যেমন?’
‘ধরুন রেল স্টেশন, রেডিও স্টেশন—’
সাহেব মিত্তির মজা পাচ্ছিল। বললো, মানে কুবের স্টেশন! রেডিও কুবের! দারুণ আইডিয়া। এভাবে তো কেউ আজকাল ভাবে না—‘
‘ওইরকম আজগুবি মানুষ। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আপনার সঙ্গে আলাপ হলে বুঝতেন।’
‘আলাপ হয়েছে। এই এখানেই। তখনও আপনাদের ব্রজদা রেলেশ্বর শিব বসায়নি। একদিন এসেছিলেন। জায়গা জমির দর কেমন—তাই বোধহয় জানতে। এমনিতে তো দেখে কিছু বোঝা যায় না?’
বুলু রেলেশ্বর শিবের স্বপ্নাদিষ্ট মন্দিরের জন্যে চাঁদা দিতে এসেছিল। কিছুকালই এখানে আসে। ব্রজ দত্ত যত্ন করে বসায়। খাওয়ায়! আভা থাকলে বাড়াবাড়ি রকমের যত্নও হয়েছে তার। সে নাকি এখন বড়লোকের গিন্নী। হপ্তা দুই হল আভা নেই। কোথায় গেছে জানারও উপায় নেই। ব্রজ ফকিরের সমাধির মত একটা কিছু হয়েছে আজ তিন চারদিন। বিশেষ কথাবার্তা বলছে না লোকটা। আশপাশের গাঁয়ের লোক এসে ভিড় করে মানত করে যায়। তার মধ্যে ভাঁটার দৃষ্টি তুলে ব্রজ দু’একবার বুলুকে দেখেছে। সে যে চেনা লোক—তেমন কোন লক্ষণ ব্রজর চোখে ফোটেনি।
‘সাহেববাবু, আপনি তাঁকে দেখে একটুও বুঝতে পারবেন না। নিভাঁজ ভাল মানুষের মুখ। অথচ দেখুন তো আমি এদিকে কি বিপদে পড়ে আছি—’
‘আবার কি হল?’
‘কুবের স্টেডিয়ামের স্টোনচিপ, লোহা, বালি, সিমেন্ট—সব কিছু এসে জমা হচ্ছে। অথচ মানুষটাই নেই এখানে। কে করবে এতসব। কে দেখবে। আমি একলা পারি?’
‘কোথায় আছেন এখন?’
‘সে কি জানি ছাই, শুনেছি চাষবাসে মজে আছে। লঞ্চ দুটোও সেখানে আটক পড়ে আছে। ভদ্রেশ্বর আসছে না কিছুদিন—‘
সাহেব মিত্তির এক মনে বুলুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সে গোলন্দাজ লোক। তীরন্দাজ বলেও নিজের পরিচয় দেয়। সতেরশো আঠারোশো ফুট নীচে পাইপের গায়ে নিরিখ করে সে গুলি করে থাকে। গ্যাস থাকলে গ্যাস—তার পেছন পেছন তেল মাটি ফুঁড়ে পাতাল থেকে এক ঝলকে উঠে আসে। এখন ধক করে খানিক রক্ত তার বুকে এসে দলা পাকিয়ে গেল। বুলুর কোন কথাই তার কানে যায়নি এতক্ষণ। ধীরস্থির একজন চিন্তিত রমণীর মুখে যদি সুন্দর ঠোঁট, সামান্য চাপা নাক আর ঘনপক্ষ ঢাকা চোখ থাকে তাহলে সাহেব মিত্তিরের আর দোষ কি!
বুলুর এতক্ষণে খেয়াল হল। দশ চাকার লরিগুলো অয়েল টাউনের জন্যে মালমসলা বয়ে আনছে। বিরাম নেই। রেলেশ্বর শিবের স্বপ্নাদিষ্ট মন্দিরের অনেকটা উঠেছে। বুলু টের পেল, ব্রজদার বাবার আত্মজীবনী লেখার দিনগুলো এই হোম, যাগযজ্ঞ, মন্দির প্রতিষ্ঠার চাপে কোথায় তলিয়ে গেছে। তাকেও আর কোনদিন কুবের আচমকা সন্ধ্যেবেলা ফিরেই ট্যাক্সিতে কলকাতার রাস্তায় নিয়ে ছুটবে না, সিনেমায় যাবে না। সেদিন বিকেলের ডাকে পাঠানো ব্রজ দত্তর বাবার আত্মজীবনী ‘রজনী দত্তর জীবন ও সময়’ মন দিয়ে পড়ছিল বুলু। সেসব দিন কোথায় গেল। তখন হরিরাম সাধুখাঁর ভদ্রাসন থেকে বেরিয়ে এক সন্ধ্যে সিনেমা দেখাও কত কঠিন ছিল। অথচ এখন-উত্তরের বারান্দায় কৃষ্ণপক্ষের সন্ধ্যেয় প্রায়ই প্রোজেক্টর চালিয়ে পুরনো বাংলা ছবি দেখে বুলু। পুকুরের ওপিঠে সাদা স্ক্রিন টাঙানো হয় তখন। ডলি বলে, বুলুদির ভাগ্যই আলাদা। রেখা বলে, আপনি গুছিয়ে থাকতে জানেন না বুলুদি। কত জিনিস পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।
আরও একটা জিনিস এই মুহূর্তে টের পেল বুলু। সাহেব মিত্তির তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। এই মানুষটাকে আভা বউদিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। দেবার সময় বলেছিল, ‘দেখিস ভাই! তোর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত হলুম!’
তখন কথাটা সাধারণ মেয়েলী রসিকতার চেয়ে বেশি কিছু কানে ঠেকেনি বুলুর। অনেকদিন দাড়ি কামানো ফিটফাট একাগ্র পুরুষ তার চোখে পড়েনি। ইদানীং কুবের সাধুখাঁ নামে তার দখলদার যে পুরুষটিকে সে দেখে আসছে—তার জামাকাপড়ের ঠিক থাকে না, সারাদিন পরে শোয়ার আগে সে জমাখরচের হিসেব খাতায় তুলে রাখে।
দূর শহর থেকে পাকাপাকি ইলেকট্রিকের তার টেনে আনার পর এখন ওয়ার্কসাইট একটা ভব্য চেহারা পেয়েছে। সরকারী মালি এসেছে—অফিস ঘরের সামনে অনেকটা জুড়ে বাগান তৈরি হচ্ছে। সেখানকার নরম ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাহেব মিত্তির আবদার ধরল, ‘এখানে একটু বসতেই হবে আপনাকে। অন্তত এক মিনিটের জন্যেও। তখন আপনার পাশে বসে থাকব। কোনরকম বিরক্ত করব না কথা দিচ্ছি।’
এমন কাতর কথা কোনদিন শোনেনি বুলু। ছেলেমেয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে দূরে বড় রাস্তার ওপর মোটরের মধ্যে বসে। পরিষ্কার আকাশে অনেক রকমের তারা ছিটিয়েছিল। কোনটা লাল কেরোসিনের হারিকেনের চেয়েও ময়লা—কোনোটা খুব কাছের থেকে শুধু তাদেরই দিকে তাকিয়ে জ্বলছে।
‘এইটুকু বসে আপনার লাভ?’
‘আপনি যেমন ইচ্ছে কথা বলবেন—আমি কোন জবাব দেব না—কিছু জানতে চাইব না। আপনার গলার স্বর শুনব চোখ বুজে—’
কড়া আলোর অনেকটা এ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে মানুষজন দেখা যায়—কিন্তু চেনা যায় না। গত পৌষে পঁয়ত্রিশ পার হয়ে গেছে বুলু। মাটিতে বসতে বসতে বুলু বললো, ‘খালি চোখে উড়ন্ত মহাকাশচারীদের দেখা যায় না? ওরা কখন যে ওপরে ওঠে—কখন যে নেমে আসে টের পাওয়ার উপায় নেই।’
‘তার চেয়েও দূরের জিনিস দেখা যায় খালি চোখে।’
বুলু তাকিয়ে আছে দেখে সাহেব মিত্তির ফিরে বললো, ‘তারার কথা বলছি। ওরা মৃত্যুর পরেও অন্তত আমাদের জন্যে টিকে থাকে। মুছে যাবার আগে শেষবারের মত পাঠানো আলো—আমরা হয়তো এই এখন দেখতে পাচ্ছি, তারাটা কিন্তু শেষ হয়ে গেছে কবে।’
‘বাসি ফুলের গন্ধের মত—’
সাহেব মিত্তির চমকে উঠল। পদ্মবীজও এত ঘন, এত স্বাদু, এত সুগন্ধী হয় না। গলার স্বর কি মিষ্টি! দুলসুদ্ধ কানের পাশ, ভারি খোঁপা, নাকের একদিককার ওঠানামা—শুধু এইটুকু সাহেব মিত্তির দেখতে পাচ্ছিল। গয়নার দোকানের ক্যালেন্ডারে এমন মেয়েমানুষের ছবি থাকে।
হেসে বললো, ‘টাটকা তারাও আছে। চিনিয়ে দেব আপনাকে?’
সেই মুহূর্তে বুলুর একবারও মনে পড়ল না, কদমপুরে জমি জায়গার দলিলে শতবার লেখা হয়েছে—গ্রহীতা, বুলু সাধুখাঁ। জওজে কুবের সাধুখাঁ। পেশা গৃহস্থালি। সাকিন কদমপুর। পরগনে মেদনমল্ল। সাবরেজিস্ট্রি অফিস বহরিডাঙ্গা। কুবের সাধুখাঁ এখন ইচ্ছে করলেই হস্তান্তর করতে পারবে না। জোতজমা—সবই তার নামে। দাখিলাও কাটা হয় তারই নামে। এত সবের মাঝখানে কুবের একটা ফালতু মাত্র। ওকালতী বুদ্ধি দিয়ে তাকে নিমেষে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে বুলু।
‘তারাও চেনেন? আমি মনে রাখতে পারি নে। গুলিয়ে যায়—
‘সব চিনি। জ্যান্ত তারা। মরা তারা।’
‘আমায় এক এক সময় মনে হয় সারা ছায়াপথটাই তারাদের কবরখানা—’
সাহেব মিত্তির কান খাড়া করে বুলুর গলার স্বরটুকু মাথার ভেতরে, শরীরের ভেতরে একেবারে শুষে টেনে নিচ্ছিল। শুধু বললো, ‘ওই তারাটা চেনেন?’
গলির মোড়ে স্টেশনারি দোকানও এত অবহেলায় কেউ আঙুল দিয়ে দেখায় না। ‘তারাটার নাম জানেন?’
বুলু মাথা নাড়ল।
‘কুবের।’
ঝুঁকে বসেছিল বুলু। গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল সাহেব। তার মধ্যে পাউডার, তেলখোঁড়ার এই কারখানা গাঁয়ের গন্ধও ছিল। তার কথায় বুলু সরে বসল, ‘জ্যোতিষ্ক বানিয়ে ফেললেন মানুষটাকে! আসলে কিন্তু খুব সিম্পিল।
‘যতটুকু শুনেছি—যা দেখেছি, তিনি একজন কীর্তিমান পুরুষ। জ্বলজ্বল করছেন। পৃথিবীর নাম পালটে এসব লোকের নামে ডাকা যায়। নিদেনপক্ষে মহাসাগর, মহাদেশের নাম কুবের রাখা যায়—’
বুলু মজা পাচ্ছিল, ‘তাহলে তাবৎ ভূগোল বই ফিরে লিখতে হবে যে! ‘
সাহেব বলতে যাচ্ছিল—অ্যাটলাস, ম্যাপ বই, ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি—দরকার হলে সবই কারেক্ট করে নিতে হবে। তার বদলে ফট করে বলে দিল, ‘আমি কোনদিন কিছু করতে পারিনি। অ্যাচিভমেন্ট বানানটাই ভুল হয়ে যায়। শুধু পাতালে গুলি চালাই আজ বিশ বছর। তার আওয়াজটুকুও সেখানেই হারিয়ে যায়—’
মানুষটা যে কেন এতখানি ক্লিষ্ট, কুণ্ঠিত—তার কোন হদিস করতে না পেরে বুকের যেখানটায় মাছ আঁকা লকেটটা পড়ে থাকে—তার দু’ইঞ্চি নীচে হাড় মাংসের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে উঠল বুলুর।
‘আমি কোনদিন কোথাও পৌঁছতে পারিনি।’
বুলু কিছু না হলেও মেয়েমানুষ। সে এটুকু জানে এর নাম একরকমের যন্ত্রণা। বইয়েতে যাকে বলে প্রেম, ভালবাসা। অথচ জিনিসটা ঠিক ঠিক তাও নয় একেবারে। আভা বলেছিল, লোকটার বউ আছে। খানিক মেয়েন্যাংলা মানুষ। স্বভাব ভাল নয়। বুলু বউর কথা তুলতেই বলেছে, টক লাগে। কুবেরদের নতুন গরুগুলোর জন্যে পুরনো খড় কিনতে হয় ফি’বছর। নতুন খড় খেলেই দাঁত টকে যায়।
রাতের সিফটের ওভারঅল পরা কিছু লোক অগোছালো আলোয় লম্বা লম্বা ছায়া ফেলে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। দোতলা ক্রেনের বক্সে বসে একজন পাঁউরুটি কামড়ে খাচ্ছে। অয়েলটাউনের নতুন পাকা রাস্তা বেয়ে লরির পর লরি সারি দিয়ে দাঁড়ানো। একটা গরুর গাড়ি মাঠে নেমে গেল।
‘আপনার বন্ধু কোথায় পৌঁছতে পেরেছে?’
‘তা জানি না। তবে কুবেরবাবু কোথাও একটা এগিয়ে যাচ্ছেন। তালেগোলে গড়িয়ে গড়িয়েও এগিয়ে যাচ্ছেন—’
‘সব সময় ভীষণ কষ্টে ভুগছে। কোন রাস্তাই তার কাছে কঠিন নয় সাহেববাবু। পরিষ্কার বলে—বুলু, আজ আমি ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাই খসে পড়া গাছের পাতার মত একশো টাকার নোটের বান্ডিল দোরগোড়ায় ছড়িয়ে আছে। সেসব ঝাঁটপাট দিয়ে পরিষ্কার করে আমাকে সেদিনকার মত পথ ঠিক করে নিতে হয়। টাকা কোন প্রবলেম নয় আমার। আমার মুশকিল—কোন্ পথে যাব? কোথায় যাব? আমি একদম জানি না। কিছু করার নেই আমার—’
‘কষ্টটা কিসের?’
‘সে বললে হাসবেন আপনি।’
‘বলুন না।’
‘তার মা আসতে পারেনি কদমপুরে। মরে গেলেন। ভাইরাও এল না। ইচ্ছে ছিল, আমার শ্বশুর, শাশুড়ি-দেওররা সবাই আসবে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হবে। দুপুরে দরজা আটকে নাক ডেকে ঘুমোবে সবাই। বিকেলে বেড়াবে। আবার খাবে এবং ঘুমোবে। কোন চিন্তা থাকবে না কারও। কেউ কোনদিন মরে যাবে না। তার মধ্যে সময় সুবিধে মত সবাই মিলে পৃথিবীর উন্নতি করবে। আচ্ছা, বলুন তো আজকের দিনে এসব পাগলামি নয়?’
‘কেন?’
‘সব সংসারে যৌথ পরিবার ধুয়ে মুছে ভেঙে যাচ্ছে। আর তিনি একজন সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে থাকার জন্যে মাথা কুটে মরছেন। আমি তার বউ-ভাল কথা! স্পষ্ট বলে—আছো, থাকো। কিন্তু আমিও নাকি আসলে বাইরের লোক! বুঝুন ব্যাপারটা! অ্যাবসারড নয়?’
আজকের সন্ধ্যেটা খানিক আগেও সাহেব মিত্তির ভেবেছিল, একেবারে তারই। ব্রজ ফকিরের রেলেশ্বর শিবের সামনে থেকে এর আগে অনেককে সে ভাগিয়ে নিয়ে কেটে পড়েছে। কিন্তু কিছুকাল ধরে লম্বা চোয়ালের এই মেয়েমানুষটির ধীর পায়ে এসে দাঁড়ানো ব্রজ ফকিরের সামনে বসে পুজোর যোগাড়যন্ত্র করানো, দূরদেশের স্বামীর কল্যাণে বেল পাতায় চন্দন ছিটানোর কাণ্ডকারখানা—তার শরীরে সবটুকু রক্ত একত্র করে একেবারে মুখোমুখি কে নিশ্ছিদ্র লোহার দরজা তুলে দিয়েছে। সে শুধুই মাথা দিয়ে, ঘুষি মেরে দরজাটা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর আগে কোন মেয়েমানুষকে এত সহজ—এত কঠিন লাগেনি।
সাহেব এইমাত্র টের পেল, এমন রাত্তির একেবারেই তার নয়। সেই গোঁয়ারগোবিন্দ ধরনের লোকটা দূরদেশে বসেও তার চেয়ে কোথায় অনেকখানি উঁচু হয়ে বিরাট একটা ছায়া ফেলেছে। মাসখানেক আগেও নিশুতিরাতে এই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ব্রজ ফকির আর সে—দু’জনে দু’দিক থেকে একটা জিনিস নিয়ে টানাটানি করছে। সে জিনিসের নামও মেয়েমানুষ ওরফে আভা। সাহেব মিত্তির সেদিন নেশার ঝোঁকে চীৎকারে সব কিছু চিরে ফেলছিল। ব্রজ ফকির লাল চোখ করে নিঃশব্দে দাঁত ঘষছিল। আভা সন্ধ্যে থেকেই কাঁদছিল। খালি বলছিল, ‘আমায় ছেড়ে দাও তোমরা—আমায় যেতে দাও—আমি ইচ্ছেমত চলে যাই কোথাও। পায়ে পড়ি তোমাদের—আমায় ছেড়ে দাও। আমার তো আর কিছু নেই, তোমরা তো সব জান।’ তখনও কোন ছায়ার সামনে তার নিজেকে ছোট লাগেনি।
ব্রজ ফকিরের সমাধি বোধহয় ভাঙল। উঁচু ধাপের ওপর দাঁড়িয়ে মালা ঘোরাতে ঘোরাতে বুলুকে ডাকছে। সাহেবের ইচ্ছে ছিল না, বুলু এখন ওদিকে যায়। কি বলে আটকাবে। তাই নিজেও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
কবরখানা গাঁয়ের সব কিছু এক চমকে পালটে যাচ্ছে। শুধু পুরনো ইট আর টালির স্তূপে ভরাট এই জায়গাটুকু বদলাতেই যা সময় নিচ্ছে। স্বপ্নাদিষ্ট মন্দিরের চুড়ো একদিন ড্রিলিং টাওয়ারকে হার মানাবে নাকি। ব্রজ ফকির জেগে জেগে এই স্বপ্ন দেখে। আর স্বপ্নের ভেতরের আদেশ তো এই গ্রাম দেশের দিকে দিকে চাউর হয়ে গেছে। স্বয়ং শিবের আদেশ। সাতাশি ফুট মন্দির চাই। সামনের বছর মাঘী পূর্ণিমায় মন্দির শেষ করতে হবে। স্বপ্নাদেশের কথা ঘরে ঘরে। জ্বরজ্বরি, রোগভোগে সেরে ওঠার পরই সবাই কিছু না কিছু দিয়ে যায়।
একটা ভিজে বেলপাতা বুলুর হাতে দিয়ে ব্রজ বললো, ‘বাড়ির কালো গরুর শিঙে রবিবার রবিবার তেল সিঁদুর মাখিয়ে দিও। আর শনিবার নিজেরা খানিকটা বেগুন পোড়া খাবে—’
বুলুর মুখে ভক্তি শ্রদ্ধার ছায়া পড়তেই সাহেব মিত্তির ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেল। এই নবীন শৈবসাধক ব্রজ ফকিরের সঙ্গে তার এখন অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী শান্তি বজায় আছে। কিন্তু দু’তরফই যে-কোন সময় কেঁপে উঠতে পারে। সেদিন রাত্তিরের পর দু’জনের কেউই খুব খোলাখুলি করে কথা বলতে পারেনি। তার কয়েকদিন পর থেকেই আভা নেই।
‘তোমার স্বামীর ইষ্ট কে?’
বুলু মনে করতে পারল না, কুবের কোন্ দেবতাকে ভক্তি করে। দেবেন্দ্রলাল বংশের শালগ্রাম কুবেরকেই দিয়েছে। দুবেলা পুজো হয়—রাতে শয়ান দেওয়ার আগে আরতি হয়। বৈশাখে শীতল দেওয়া হয়। কিন্তু কুবের কোন্ দেবতাকে ভক্তি করে, ভালবাসে?
শেষে বললো, ‘আমার শাশুড়িকেই ভাবেন খুব—‘
তবে তাঁর ছবি পটে বসিয়ে দাও। সাধুখাঁ গেছেন—ফটোতে ১০৮টা রুদ্রাক্ষের মালা পরিয়ে দিও। দেখে কিনবে—কোন রুদ্রাক্ষে যেন ফুটো না থাকে। নিজে মালাটা গেঁথে নেবে। চান করে উঠে পটের সামনে রোজ খানিকটা সন্দেশ বা ক্ষীর দেবে বাড়ির গরুর দুধের। দেখবে তিনি নিজে এসে খেয়ে যাচ্ছেন—’
সাহেব আর থাকতে পারল না। বললো, ‘দেখা যাবে তিনি আসছেন?’
‘দেখার মত চোখ থাকলে নিশ্চয় দেখতে পাবে—’, একথা বলে ব্রজ ফকির এমন সব কথা বলতে লাগল—যা এমনিতে খুব সোজা, কিন্তু দু’দুটো মানে হয়। তার ভেতর আবার কিছু কথা দেহতত্ত্বের। খুব ভাব দিয়ে যে কেউ বললেই খুব রহস্যজনক লাগে।
সাহেবেরও কিছু অবাক লাগছিল। কদমপুরের সেই ব্রজ দত্ত আর রেলেশ্বর শিবের সেবায়েত ব্রজ ফকির-দেড় দু’বছরের তফাতে একই লোক কেমন ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, কেমন পালটে যাচ্ছে। এর সবটাই বোধহয় ভাল নয়। পাটে বসে বসে ব্রজ ফকিরের রগে কিছু অভ্যেস বসে গেছে। হাসিখানা মোহান্ত প্যাটর্নের হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
‘আমার পিতাঠাকুরের একখানা আত্মজীবনী কিনবে?’
বুলু মনে করিয়ে দিল, ‘আপনার ভাইকে তো একখানা সালকের বাড়িতে ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানাই আমরা এখনও পড়ি।’
‘নতুন ছাপা হচ্ছে। এত চাহিদা হবে কোনদিন ভাবিনি। কয়েক জায়গা পাল্টাতে হল। মন্দিরের টাকা বাদে আর ছ’টা টাকা রেখে যেও—বই বেরোলেই পাবে।’
সাহেব বড় রাস্তা অব্দি এগিয়ে দিতে গেল বুলুকে। সেই অনেক আগে—বিয়েরও আগে পাড়ার ক্লাবে কোরাস গানের পর রাত হয়ে গেলে বিভূতি তাকে এগিয়ে দিয়ে যেত। তখন হাতে হাত লাগলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত 1
সাহেব একটা গর্ত লাফিয়ে টপকে গেল। পেছন থেকে বুলুর মনে হল, লোকটার কাঁধে খুব একটা কিছুর ওজন পড়ে ভীষণ ব্যথা হয়েছে। মাথা তুলতে পারছে না।
‘আর এগোতে হবে না আপনাকে। আমি পারব।’
সাহেব রাজি হল না কিছুতেই, ‘আরেকটু তো পথ। যাই না আপনার সঙ্গে—’
ভীষণ কাকুতির মত শোনাল। পুরুষ লোক এতও পারে। গাড়ির সামনে এসে দুজনেই দেখল, কাচ তুলে দিয়ে ড্রাইভার, ছেলেমেয়েরা—সবাই ঘুমোচ্ছে। বুলুর মন অনুতাপে ভরে গেল। সে এতক্ষণ ওখানে কাটিয়েছে—আর ছেলেমেয়ে বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘এই গাড়িটা কিনলেন?’
‘আমার ইচ্ছে ছিল না। বলেছিলাম লঞ্চের গাদাখানেক ভাড়া টেনে লাভ কি। তার চেয়ে লঞ্চ দু’টো কিনে নাও। তোমার তো সেই লাগবেই। তা শুনবে না—’
‘কেন?’
‘আর কিছু বাড়াতে চায় না আপনাদের বন্ধু। জিনিসপত্র বলে ভীষণ বেড়ে যাচ্ছে—জমে যাচ্ছে। অথছ গুচ্ছের টাকা ভাড়া গুনছে। সবটাতে উলটো বুদ্ধি—’
কথা বলতে বলতে বুলু থেমে গেল। দেখল, সাহেব মিত্তির কিছু শুনছে না। এক মনে তার মুখে তাকিয়ে আছে। নিজে দেবী হয়ে উঠতে কোন্ মেয়ের না ভাল লাগে। বুলু নিজেই সাহেবের হাত দু’খানা নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নিল, ‘মন খারাপ করবেন না। নিজের কাজ করে যান মন দিয়ে—’
তারপর সাহেব মিত্তিরকে একটা কথাও বলার সময় দিল না। হুট করে দরজা খুলেই ভেতরে বসে গেল। কুসুমকে কোলে টেনে নিয়ে ড্রাইভারকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিল, ‘জোরে চালাও—অনেকটা পথ যেতে হবে।’
হকচকানো ড্রাইভার স্টার্ট দিল। কাচের ওপিঠে প্রায় ভূতগ্রস্ত সাহেব দাঁড়ানো। মূর্তিটা মিলিয়ে যেতেও সময় নিল না মোটে। বুলু ইচ্ছে করলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পারত। কিন্তু তিন প্যাঁচের এই হারটায় এমন সব সোনার পুঁতি বসানো মাথা ঘোরালেই গলার চর্বিতে খাঁজ কেটে বসে গিয়ে ব্যথা দেয়।
তবু আন্দাজে শব্দ শুনে বুঝল, ক্রেনের লম্বা শুঁড় প্রায় মাটিতে নেমে ভারী কিছু একটা তুলছে। লোহার চেনগুলো ভারে বড়কড় করে উঠছে। তবু তুলতে হবে।
রাস্তার দু’পাশের জায়গা পালটে যাচ্ছে। টিনের ঘরে ঘরে লেদ মিশিন নিয়ে দুনিয়ার লোকজন বসে গেছে। কত চায়ের দোকান বসেছে। লরি থামিয়ে চাকা পালটাচ্ছে দু’টো লোক! ক’বছর আগে এ-তল্লাটে কুবেরের সঙ্গে প্রথম এসে এসব জায়গা কি ফাঁকা লাগত তার। তখন একটা নেশার ঘোরে ঘুরেছে দু’জন।
তখন কুবেরের চোখের মণি কত উজ্জ্বল ছিল। হাসলে দাঁতের কোণা বেরিয়ে পড়ত। এমন মানুষের বউ হয়ে তার খানিক গর্বও হত। কতবার মনে হয়েছে, কুবের কোনদিন বুড়ো হবে না। চামড়া কি টান টান। চ্যাটালো বুক। অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট খেতে খেতে এমন করে তাকাত। কতকাল ফিরে চায় না সেই মানুষটা। ছোটবেলা থেকে নানান ব্রত করে পাওয়া স্বামী।
অথচ সাহেব কি একাগ্র। হয়তো আজই বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি কামিয়েছিল। খানিক পরেই বড় রাস্তা ছেড়ে গাড়ি কুবের রোডে উঠবে।