॥ দশ ॥
বাবু হরিরাম সাধুখাঁ কুবেরের পাঁচ পুরুষ আগে বংশের সবচেয়ে কৃতী মানুষ। তিনি ঠগী দমনের সময় কোত্থেকে যেন বহু কাঁচা পয়সা পান। সেই সুবাদে গঙ্গার ঘাটে লবণের গোলার অংশ কিনে ব্যবসা শুরু করেন। দুই বিয়ের দরুন বিপুল সংসার হয় তাঁর। অনেক বাড়িও বানাতে হয়েছিল ফলে। দোল দুর্গোৎসব ছাড়াও দিয়তাং ভুজ্যতাং তাঁর রক্তে ছিল।
কুবেরের বাবার আমলে এসে ভাগের ভাগ তস্য ভাগ হয়ে তাদের অংশে পড়েছিল আড়াইখানা ঘর আর তিন দেয়াল ভর্তি অয়েল পেন্টিং। তার বাবাই প্রথম চাকুরে। অবস্থা বুঝে দেবেন্দ্রলাল ছেলেদেরও পড়িয়েছিল। অল্প বয়স থেকে কুবেরের বড় ভাই বাপের সংসার টানতে গিয়ে চল্লিশেই বুড়িয়ে যায়। দেবেন্দ্রলাল যুদ্ধের আগে অব্দি মন্দ চালায়নি সংসার। তারপর বাজার পালটে গেল, স্টিমার কোম্পানীর চাকরি দেশ ভাগাভাগিতে নষ্ট হয়ে গেল। ভাগ্য ভাল, মেয়েদের তার অনেক আগেই পার করে দিতে পেরেছিল। বড় ছেলের পর দেবেন্দ্রলালের তিন মেয়ে—তারপরেই কুবের। তার পরেও আরও দুই ছেলে হয় দেবেন্দ্রলালের।
কুবের জানে উনিশ শো ঊনচল্লিশ পর্যন্ত দীর্ঘ এক শো দেড় শো বছর চাকুরেদের সোনার সময় গেছে। খাবার-দাবার, বাড়িভাড়া কাপড়চোপড় সবই সস্তা। সেই সোনার যুগে কুবেরের মা বউ হয়ে আসেন। তিনি ফেলে ছড়িয়ে সংসার করেছেন। সাধুখাঁ পরিবারের পুরনো কালের রবরবা দিদি-শাশুড়ির মুখে শুনতে শুনতে তিনি অন্য জায়গায় চলে যেতেন। তখনকার নফরমহল এখন ভাড়াটেতে বোঝাই। তখনকার আস্তাবল এখন বিড়ির কারখানা। কুবেরের মা পরের বাড়ির মেয়ে হয়েও এই বাড়ির ঐতিহাসিক গৌরব তিনি নিজের পাওনা বলে আঁকড়ে ধরেছেন। তাই জীবনে কোথাও তিনি অর্ডিনারি হতে রাজি নন। সব সময় উত্তমে তাঁর আগ্রহ। তাই ব্যথাও পান বড় বেশি।
দেবেন্দ্রলাল ঘরে এসে বসতেই একে একে তার সব ছেলেই চাকরিতে বসেছে। সবাই মিলে সংসারটিও মন্দ চালায় না। কিন্তু কুবেরের মা আগেকার ঢিলেঢোলা মেজাজে চলতে না পেরে সব সময় দুঃখ পান।
হরেকেষ্টর জায়গা কেনার পর সে জায়গা হাত-ফের হয়ে কুবেরের হাজার চারেক টাকা এল। মার জন্যে লালপেড়ে শাড়ি, বাবার শীতকালের শাল, বড়দার জন্যে আশি সুতোর ধুতি কিনে বাড়ি ঢুকতেই দেবেন্দ্রলাল কুবেরকে বললো, ‘টাকাটা এমন হেনস্তা করতে নেই। আসছে বলেই দুড়দাড় খরচ করতে হবে?’
মা থামিয়ে দিল, ‘তুমি থামো তো। ছেলে এনেছে—কোথায় আদর করে নেবে—’
‘আমার জীবনে বাবার হাতে সাতবার টাকা আসতে দেখেছি। লক্ষ্মী চঞ্চলা! বাবা যত্ন নেননি। আটবারের বার লক্ষ্মী আর এলেন না। হরি সাধুখাঁর বংশধর আমি—অবৈতনিক ইস্কুলে আমার পড়াশুনো —
কুবেরের হিপ পকেটে তখনও সাঁইত্রিশখানা একশো টাকার নোট। মুখ তার ইদানীং গোল হয়ে এসেছে, তাতে হাসি ধরে বললো, ‘আমার গা বেয়ে বাবা টাকা আসবেই।’
কুবেরের ছোট ভাইরাও বিয়ে করেছে। তার পিঠোপিঠি ভাই নগেন সরকারী প্রেসে ভালো মাইনের কাজ করে। একেবারে ছোটজন বীরেন পঁচিশ পেরোয়নি। স্টেটবাসে জোনাল ইন্সপেক্টর। তার বউ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর গল্প করতে বসে বলে, ‘আপনার ভাই যে উপায় করে না।’ কথাটা প্রায়ই খচ করে লাগে কুবেরের। পুরুষমানুষ এই বয়সে আর কত উপায় করবে। প্রায়ই ভাবে, একবার বলবে, ছোট বউমা, বীরেনের বয়েসে তো আমি বেকার। তুমি একটু ট্যাক ট্যাক করা ছাড়বে। পুরুষমানুষের কানের কাছে সদাসর্বদা ওই অমুঙ্গলে কথাগুলো বন্ধ কর। কার যে কখন কি হয়, কে বলতে পারে। দেখবে বীরেন একদিন কলকাতা কিনে দিল্লির কাছে বেচে দিচ্ছে, মাদরাজ ইজারা নিচ্ছে। শীতকালে নোটের লেপ বানিয়ে তোমাকে নিয়ে শুয়ে থাকবে। ভাশুর হওয়ার পর থেকে ভাইদের আর খোলাখুলি কথা বলা যায় না। নইলে পুরুষমানুষের কাজে যে-বউ নাক গলায়, তার স্বামীর রোজগারের হাত পায় আড় ভাঙে না কোনদিন।
বীরেন আর নগেনের জন্যে রেডিমেড শার্টও এনেছে কুবের। ছোট দু ভাই ছোঁ মেরে নিয়েই গায়ে দিয়ে ফেলল। আয়নার সামনে ঘুরে দেখতে দেখতে নগেন বললো, ‘চল আজ সবাই সিনেমা দেখবো। তুমি তো বড়লোক—’
মা নগেনকে থামালো, ওর মাথাটা খারাপ—তার ওপর তুই আবার উসকে দিচ্ছিস। এখুনি গুচ্ছের টাকা নষ্ট করে দিয়ে আসবে—’
কুবের লাফ দিয়ে উঠল, ‘চল সবাই। আজ রান্না বন্ধ। হোটেলেই খাব সবাই—তারপর এসপ্ল্যানেডে যেকোন হলে ঢুকে পড়ব—’
‘এখন কি টিকিট পাবেন?’
নগেনের বউ রেখা হিসেবি। মাসকাবারি বাজারের কাপড় কাচা সাবান মেপে নিয়ে কলতলায় দেয়। ঘরে সিগােেটর ছাই ফেললে পোস্টকার্ড দিয়ে তুলে নিয়ে ছাইদানিতে রাখে। বিয়ের আগে নগেন জুতো পায়ে দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরতো। আঁচিয়ে গামছার অভাবে পর্দায় মুখ মুছতো। সবার এক টুকরো, নগেনের তিন টুকরো মাছ না হলে ভাতই উঠতো না মুখে। রোজ পাটভাঙা জামা গায়ে না-দিলে বেরোতে পারত না, রাস্তায়। সেই নগেন এখন বাড়ির বাইরে জুতো রেখে ঘরে ঢোকে। ভাবখানা, যেন শয়ন মন্দিরে ঢুকছে। মা এক টুকরোর বেশি মাছ দিলে পাতে ফেলে রেখে যায়। বিয়ের পর থেকে নগেনকে আর পায় না কুবের। মুখে হাসি নেই। বেহিসেবি হয়ে ট্যাক্সি দাবড়াতে পারে না। বুলুর অ্যাডভানসড স্টেজ। রাতে শুয়ে শুয়ে দুঃখ করে বলেছে কুবের, ‘কি হয়ে গেল ভাইটা। আর কাছে আসে না’
খুক করে হেসে উঠেছে বুলু, ‘তা চিরকাল তোমারই থাকবে? বিয়ে করেছে, আপনজন হয়েছে—এখন তো বদলাবেই—‘
তাই বলে পর হয়ে যাবে? আমার সঙ্গে একখাটে শুয়ে গল্প করবে না? রেখা যেন ওর দু’খানা ডানাই কেটে দিয়েছে—
‘ওমা! মেয়ে হয়েছে, বউ হয়েছে—চিরদিন তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে? সে কখনো হয়?’
‘আমি তো বদলায়নি।’
‘তোমার কথা আলাদা।’ তারপর থেমে থেকে বলেছে, ‘তুমি যত ভাইকে ভালবাস, ভাই তোমায় তত ভালবাসে না—‘
এইখানে কুবেরের ইচ্ছে হয়েছে, চেঁচিয়ে বলে ওঠে—তুই থাম মাগী। কতখানি জানিস আমার ভাইকে? বিষম খেলে নগেনের বুক লাল হয়ে ওঠে, জামার ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পাই, তুই জানিস এসব? কিন্তু বলতে পারেনি কুবের। বিয়ে করা বউ, ছেলের মা বুলু, আরও একটা পেটে এসেছে। জীবনের মাঝখানে শেষ অব্দি এই অন্য আরেকজনের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকতে হবে। কড়ি খেলার সময় মনেও আসেনি এসব কথা। এখন অবলীলায় বিবেকবাণী ঝাড়ে। নগেন, বীরেন, মা, বড়দা, বাবা, বড় বউদি—এসব মেলায় কেনা মাটির পাখি নয়। রঙ চটে গেলেও তা কুবেরের নিজের জিনিস।
মন সেকেন্ডে গ্রহতারায় চলে যায়। পলকে এসব মনে এসে মনেই ডুবে গেল কুবেরের। রেখাকে বললো, ‘যত টাকার টিকিটই লাগুক না কেন—সবাই যাব—’
মা বললো, ‘টাকাগুলো নষ্ট করিস নে। বুলু আট মাস পোয়াতি। সামনে তোর অনেক পয়সার দরকার হবে। কুড়িটা টাকা দে। দশ টাকার বাজার করাই—দশ টাকার একখানা পাটি আনাবো হরগঞ্জ বাজার থেকে। রাতে তোষকে পা কুটকুট করে।’
‘সিলি! যত আর্থলি ব্যাপারে সারাদিন জড়িয়ে আছো! এখন তোমার গীতা চণ্ডী আওড়ানোর সময়—’
মা’র শেষকালের ছেলেগুলো বেশি ছাড়া ভাবে মানুষ হওয়ায় যা ইচ্ছে বলে মাকে। তবে হাসতে হাসতেই বলে।
বীরেন, বললো, ‘সেঝদা এখন রিচম্যান—’ দেবেন্দ্রলালের বড় ছেলের পর এক ছেলে ছিল। সে আর নেই। তাকে হিসেব ধরেই কুবেরকে ছোটরা সেঝদা ডাকে। বীরেন ডিউটিতে বেরোচ্ছিল, হেসে বললো, ‘সেঝদার কাছে এখন একশো টাকার নোট ইকোয়াল টু এক পয়সা। ভালো কথা, তোমরা তো সিনেমায় যাচ্ছ—আমাকে ফাইভ রুপিস দেবে?’
একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরতে ছোট বউমা ডলি ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘ওকে দেবেন না সেঝদা, সব উড়িয়ে আসবে-আমাকে কিছু দেবে না—‘
‘তাই তো চাই! ওড়ালেই আসে। যত ওড়াবে তত একশো টাকার নোট তোমার ছাদে উড়ে এসে পড়বে সারা রাত ধরে। সকালে শুধু কুড়িয়ে নিতে হবে ডালায় করে—’, বলতে বলতে কুবের মার হাতে বুক পকেট থেকে দু’খানা দশ টাকার নোট বের করে দিল।
দেবেন্দ্রলাল ছেলেদের গোলমাল থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে খবরের কাগজে সুর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় দেখছিল। আর থাকতে পারল না, মূর্খ! আমার এই ছেলেটা মহা মূৰ্খ। টাকা রাখতে শেখ। জীবনেও কষ্ট পাবি না।’
‘রিকোয়ার মানি?’
দেবেন্দ্রলালের গম্ভীর মুখের ওপর একখানা একশো টাকার নোট ভাঁজ করে উঁচ করে ধরল কুবের, ‘এনি অ্যামাউন্ট ইউ লাইক?’
কানে শুনতে পায় না দেবেন্দ্রলাল। আন্দাজে হাসল, তারপর ‘দেখি’ বলে নোটখানা টেনে নিল, ‘বাড়ির ট্যাক্স বাকি সাতাশি টাকা—’
নগেন এগিয়ে এল, ‘তেরো টাকা ফেরত দাও সোদাকে—’
‘রাখ! বাজারে আমার লাগে না—’
তা লাগে। কোথায় কোন্ জিনিসটা ভাল, জন্ম ইস্তক ছেলেদের খাইয়ে আসছে দেবেন্দ্রলাল। কুঠিঘাটার ইলিশ, সাঁত্রাগাছির ওল, অনেক আগে সাতক্ষীরের গজাও নিয়ে এসেছে ছেলেদের জন্যে। তখন নাভারোন থেকে বাসে যাওয়া যেত। একবার ভেতরে জায়গা পেল না দেবেন্দ্রলাল। একজন মৌলবী সাহেবের সঙ্গে বাসের ছাদে বসে ধুলো খেতে খেতে একাশি মাইল এসেছিল দেবেন্দ্রলাল। সঙ্গে গজার হাঁড়ি। সাবধানে আঁকড়ে বসেছিল।
নগেন ক্ল্যাপ দিয়ে উঠল, ‘লর্ড সেঝদা। জবাব নেই! লা-জবাব!
কথাটা একসঙ্গে দু’ভাই হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে শিখেছিল। কত কাল একসঙ্গে সিনেমা দেখে না। বুলু বলে, বিয়ের পর ভাই ভাই আলাদা হয়ে যায়। জীবন অন্য রকম হয়ে যায়। সেটাই নাকি স্বাভাবিক। শুধু কুবেরই নাকি অস্বাভাবিক।
বিয়ে হয়ে গেলে কচু হয়। আমি, নগেন, বীরেন, মা, ছোড়দি—সবাই কেরোসিনের কাঠের দু’খানা খাট জোড়া দিয়ে শুতাম। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে সবে। বাবার চাকরি নেই। বড়দা শুধু রোজগেরে। আশিজন পাওনাদার ছোঁক ছোঁক করছে। স্কুল কলেজে মাইনে বাকি, রেশনের টাকা থাকত না–ভোরে ঘুম থেকে উঠলে পিঠ ব্যথা করত। সারা রাত এক কাতে শুয়ে না ঘুমোলে জায়গাই হত না। তবু তখন কত শান্তি ছিল।
‘রেখা তুমি তো কিছু চাইলে না?’
‘বাঃ! আমি আবার কি চাইব! সব সময় তো দিচ্ছেন—’
সব সময় কুবের দিচ্ছে না—একথা কুবেরের চেয়ে ভালো আর কে জানে। সবাইকে দিতে ইচ্ছে করে ঠিকই। কিন্তু আগের চেয়ে প্রয়োজনগুলোও এখন বেড়ে গেছে জীবনে। কুবেরকে লোকে আজকাল চালাক, ধুরন্ধর, চতুর, ঘুঘু কত কি ভাবে। কেউ জানে না কুবের সাধুখাঁর মত বোকা আর কেউ নেই। টাকা আসছে ঠিকই—কিন্তু তা ষোল আনা ধরে রেখে নতুন নতুন জায়গার লাগানোর মত ব্যবসায়ী বুদ্ধি বা ধৈর্য তার নেই। হরিরাম সাধুখাঁর অয়েল পেন্টিংখানা আজও দরদালানে টাঙানো আছে। তীক্ষ্ণ চোখ, সিংহ নাসা, চ্যাটালো বুক—এই মানুষটি সাধুখাঁ বংশে প্রতিষ্ঠা এনেছিল। বাড়ির লাগোয়া নফর মহল তৈরি করেছিল—আস্তাবলের ঘোড়া বছর বছর পালটাতো।
রেখার সঙ্গে ভাশুর হয়ে তর্ক করা যায় না। হয়তো মিতব্যয়ী। হয়তো অবস্থা বুঝে আবেগ চেপে চলতে অভ্যস্ত।
এখন কুবেরের সামনে সারাটা জগৎ নানান রঙে ভর্তি হয়ে উঠেছে। কে জানতো তাকে একদিন টাকার হিসেব রাখতে ডাইরি করতে হবে—লিখে রাখতে হবে। সাতটা ব্যাংকে বুলু আর তার নামে সাত দু’গুণে চৌদ্দটা অ্যাকাউন্ট। কোনটায় চেক জমা পড়ে—কোনটায় নগদ। মাসের ছ’ তারিখ অব্দি টাকা থাকলে সুদ হয়। সুদের তোয়াক্কা না রেখে কুবেরকে মাঝে মাঝে ছ’ তারিখের আগেই টাকা তুলতে হয়। জমি কেনার সময় সুদের কথা ভেবে টাকা ফেলে রাখা যায় না। হাজরার মোড়ের ব্যাংকে চেক জমা দেওয়ার কাউন্টারের ছেলেটি কয়েকবারই বলেছে, এভাবে টাকা তোলেন আপনি,—প্রায়ই সুদ হারাচ্ছেন শুধু শুধু। বুঝিয়ে বলা যায় না। দশ কিংবা কুড়ি বছরে ব্যাংক যা সুদ দেবে তার চেয়ে অনেক বেশি বহরিডাঙায় গিয়ে একটা জমি কোবালা করে দিলেই হাতে আসবে।
‘আপনি খুব বড়লোক হয়ে গেছেন সেঝদা—‘
রেখার কথায় হাসল কুবের। বড়লোক হয়নি। বড়লোকের কোন মাপ নেই। সাইজ নেই। একদা সে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত। গম্ভীর গলায় ‘স্টাফ’ বলে ট্রামে কন্ডাক্টরকে এড়িয়েছে। আচমকা তার আন্দাজে কেনা জায়গা হাত বদলের যোগাযোগে প্রায়ই তাকে টাকা দিচ্ছে। নগেন জানে না কুবের কত টাকা নাচাচাড়া করে ইদানীং। এখন তার পকেটে কত টাকা আছে বীরেন জানে না। গত কিছুকালে দশ-বারোটা প্লট কোবালা করে দিয়ে কত টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখেছে বুলুও জানে না। লোকে অভাবের কথা বলে, দেশের কথা বলে, আকাশের বৃষ্টি দেখে ফলনের কথা বলে—এসব কদমপুরেও শুনেছে কুবের। কিন্তু মাথায় কিছুই ঢোকে না তার। চোখের সামনে খালপাড় দোলে শুধু। ফ্রনটেজ দু’ হাজার ফুট কেনার পর এখন পেছনের জায়গাগুলো কুবের ছাড়া আর কেউ কিনতে পারবে না।
‘এবার বাড়ি শুরু করব রেখা। সেখানে আমরা সবাই আরামে থাকব।’
হেলতে দুলতে বুলু ঘরে ঢুকল, হাতে খোকন, ‘পরে বাড়ি কোরো। এখনকার মত একটা পাখা ভাড়া কর। নইলে ওই ঘরে আর শোয়া যায় না। ফালি বারান্দায় মা শুয়ে থাকেন রাতে—গরমে শুধু এপাশ-ওপাশ করেন, চোখে দেখা যায় না।’
রেখা বললো, ‘ইনস্টলমেন্টে পাখা পাওয়া যায়—’
সিগারেট কিনতে দেওয়ার মত হিপ পকেট থেকে আটখানা একশো টাকার নোট বের করে নগেনকে দিয়ে কুবের বললো, ‘তিনটে পাখা আনবি—আটচল্লিশ ব্লেড—‘
‘লর্ড!’ তোমার কমপ্যারিজন হয় না সেঝদা। এত টাকা পাচ্ছ কোত্থেকে—’
‘আমার গায়ে বেঁধে আসে রে!’
বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেল। বীরেনের বেরোনো হল না। দেবেন্দ্রলাল হাতে টাকা পেয়ে বাজারে চলে গেছে। নগেন পাড়া ছাড়িয়ে বড় রাস্তার দোকানে পাখা কিনতে বেরোনোর আগে জানতে চাইল, ‘সত্যি বাড়ি করবে সেঝদা? সেতো অনেক টাকা। তোমার আছে?’
‘সব নেই। আবার আসবে—–’
মা বীরেনকে মোড়ের দোকান থেকে টাকা দিয়ে সন্দেশ আনাতে পাঠালো। বাড়ির বিগ্রহে মিষ্টি দেবে। প্রথমবার মাইনে হবার পর এক টাকার সন্দেশ চড়িয়েছিল মা। তখন নগেন বীরেন পড়ে। বড়দার ওপর পুরো সংসার। সেই সময় কুবের মাস মাইনের টাকা হাতে পড়তেই খুব কাজে দিয়েছিল। বদলির চাকরিতে বড়দা এখন বাইরে বাইরে থাকে। আগের মত আর চাপ নেই। মাসখানেক হল চুলে কলপ দিচ্ছে রবিবার রবিবার।
বুলুর হাতে বাকি টাকা রাখতে দিয়ে নোট বইটা চাইল।
‘আজ কে টাকা দিল?’
নামের পাশে টাকার অঙ্ক .লিখতে লিখতে বলল, ‘রেফ্রিজারেটর কোম্পানির সেই মিস্টার বোস অ্যাডভান্সড করল—সামনের হপ্তায় রেজিস্ট্রি।’
‘এই শরীরে আমি বহরিডাঙা যেতে পারব না—’
‘কষ্ট করে যেতে হবে বুলু। নাহলে লোকে আমাদের টাকা দেবে কেন?’
‘তুমি আমার শরীরের দিকে একটুও তাকাও না। ছেলেটার স্বভাব কেমন হল বাপ হয়ে একবার ফিরেও দেখলে পার। আক্যুটে—দামি দামি জামা পরছে, ছিঁড়ছে—কোন কিছুর মূল্য বোঝে না—’
‘এক গ্লাস জল দেবে।’
‘তা দিচ্ছি। তুমি যে কি হয়ে যাচ্ছ দিনকে দিন—‘
‘খারাপ হয়ে গেছি?’ তারপর কি ভেবে কুবের বললো, ‘বিয়ের সময় কত মাইনে পেতাম আমি—’
‘নব্বই টাকা প্লাস ডি এ কত যেন—ঠিক মনে নেই।’
‘আরও অনেক জিনিস ভুলে যাবে বুলু। আমি কিন্তু সব মনে রাখি। তুমি আসবার আগে আমি ষাট টাকার একটা কাজ পেয়েছিলাম। বড়দার একার আয়ে আর সংসার চলে না। সেই চাকরি পাওয়ার খবর শুনে মা কেঁদে ফেলেছিল। টাকা জিনিসটা কুলটা! কখন যে কার ঘরে থাকবে তার ঠিক নেই। এমনভাবে আসছে—আমারই এক এক সময় ভয় করে। ফাঁকা লাগে—
‘তাই বলে ছেলেকে দেখবে না? বউকে দেখবে না? মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াবে? বহরিডাঙা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে মুহুরিদের সঙ্গে কাটাবে? অফিসেও যাচ্ছ না—
‘আর যেয়ে কি হবে?’
‘মাস গেলে মাইনে দেয়। পুজোয় বোনাস দেয়—’
‘আমার আর ভাল লাগে না। প্রোডাকসন বোনাস একশো সাঁইত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ—তাই নিয়ে চুলচেরা গজালি ঘণ্টার পর ঘন্টা, হিট অ্যালাউন্স বাহান্ন টাকা পঁচাশি পয়সা হবে, না তিরাশি পয়সা হবে—তার কুটকচালি-বোরিং—’।
‘এক সময় তো এ-ই কত লোভেল ছিল! তাই না?’
‘লোভ একটু একটু করে মরে বুলু—’, নিজের বৌর মুখে ঢলঢল ভাব দেখে শান্তি পেল কুবের। তারপর খচ করে বলে দিল, ‘খোকনকে ভাল জিনিস নষ্ট করতে দিয়ে যাও—তাহলে দামি জামা, ভালো খেলনা, ছবির বইতে আর লোভ থাকবে না—’
‘ও কি কথার ছিরি! তোমার কি কেউ নেই। এমন করে বল কেন?’ কুবেরের হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিতে নিতে বুলু বললো, ‘আমার অত বৈরিগিপনা নেই বাপু—খাবো, থাকব, সুখ করব, বয়স হলে মরে যাবো —’
‘আমার কত লোভ মরে গেছে বুলু। এখন কত টাকা আসে—সব তুমিও জানো না। আমার মনে হয় ঘুড়ি লুটছি—হইহই করে ট্রাম রাস্তা ধরে ভোকাটা ঘুড়ির পেছনে ছুটছি। মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় হাত কেটে যাচ্ছে—তবু ছুটছি। আজকাল একশো টাকার নোটের গোছা ব্যাংকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে জমা দেওয়ার আগে লোটা ঘুড়ির মত পর পর সাজিয়ে নিই। জানি এগুলো আমার নয়।’
‘ছোটবেলায় ঘুড়ি ধরেছ?’
‘কোনদিন পারিনি। আঁকশি ছিল না। প্যান্টে বোতাম থাকত না, গায়ে জামা না। নগেনকে পেছনে নিয়ে কোমর ধরে ছুটতাম। শুধু একবার একখানা পেয়েছিলাম—’
বুলু হাসি ঢেলে তাকিয়ে আছে দেখে কুবের উৎসাহ পেল, ‘একখানা কাটা ঘুড়ি দুলতে দুলতে গিয়ে পুকুরে পড়ল। সবাই ছুটে এসে পুকুর পাড়ে থমকে দাঁড়াল। নগেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কোন কম্পিটিটর নেই। ঘুড়িখানার কেনিফট্রাশ দশা। কাগজ জলে গলে গেছে—’
‘কি করলে?’
‘তাই নিয়ে পাড়ে উঠলাম বীরদর্পে। সুতো গুটিয়ে নগেনের হাতে দিলাম। আমার জীবনে অন্তত একবার ঘুড়ি লোটার দরকার ছিল বুলু। একবার আমাকে টাকার শেষ দেখতেই হবে। ঘটির তলায় কি আছে আমি জানবোই।’
আড়াইখানা ঘরের এককোণে নারায়ণ। ঠাকুরমশাই পুজোর পর আরতি দিয়ে নৈবেদ্যের থালা কখন নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। রেখা মেয়ের দুধ জ্বাল দিচ্ছে ফালি বারান্দায়। স্টোভটায় পলতে নেই বলতে নেই। ডলি বি টি পড়েছিল। স্কুলে কাজ পায় না। চাইল্ড এডুকেশন পড়েছিল। বাচ্চা চায়। ডাক্তার দেখানো দরকার। বীরেন সময় পায় না। ডলি তার পার্টিশন করা ঘরে জানলা দরজায় যবনিকার স্টাইলে খালি খালি পর্দা টানাচ্ছে। পাশেই শরিকানি একখানা ঘর চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে সেখানে নগেন আর রেখা থাকে। রাতে ফালি বারান্দায় মা আর বাবা থাকে। তালপাতার পাখা নাড়ার আওয়াজ বড় ঘরখানাতে শুয়ে শুয়েই রোজ রাতে শুনতে পায় কুবের।
‘এখন তোমাকে দেখলে ইরা নিশ্চয় বিয়েতে বসত—’
মেয়েলোকের চপল হওয়ার বিষয় ওই একটাই। বিয়ের আগেকার কিছু স্মৃতি, কিছু কাহিনী। ছাড়াছাড়ির সময় অল্প বয়সে মনে হয়, ওঃ! এসব কথা কোনদিন ভোলা যাবে না। তারপর এমন অবস্থা হয়, হাজার চেষ্টা করেও ইরার মুখখানা অব্দি মনে পড়ে না। অথচ আগে কত খুঁটিনাটি মনে থাকত। মনে হত, কোনদিন ভুলবো না। এখন ব্যাপারটা প্রায় শীতকালের বাতের কামড়ের মতো। গরমকালের কোন চিহ্ন নেই। ঠাণ্ডার দিনে হঠাৎ এক-একদিন টনটন করে ওঠে শুধু।
‘বিভূতিও তোমাকে দেখলে নিশ্চয় হিংসে করত—
‘তা করতে যাবে কেন? বেশ আছে বৌ নিয়ে বেহালায়—’
‘তাতো আছেই। তিনটি মেয়ে। এই বাজারে আড়াইশো টাকা মাইনে। মেলিং ক্লার্ক। অফিসের পরেও বড়তলা থানার পাশে এক কোম্পানির খাতা লিখে দিতে যায়—’
তুমি এসব জানলে কোত্থেকে? খোঁজখবর কর বুঝি—
‘দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। লাল আলোতে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল। দেখি সামনে দিয়ে যাচ্ছে। বাসে প্যাসেঞ্জার বোঝাই। উঠতে পারছে না। ডেকে পৌঁছে দিলাম। তখন সব বলছিল—
‘আর কি বললো?’
‘ভয় নেই। তোমার কথা তোলেনি।’ মজার ঘোরে কুবের বললো, ‘আচ্ছা তোমাকে তিন বছর গান শিখিয়েছিল?’
‘বিয়ে হয়নি, বয়স বেড়ে যাচ্ছিল। মন খারাপ থাকতো। তখন পাড়ার ক্লাবের কোরাস গাইতে গিয়ে একসঙ্গে গান ধরেছি। একদিন বৃষ্টির রাতে জল ভেঙে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল—গলির মধ্যে হাত টেনে নিয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল, আলো নেই, আমি হাত টেনে নিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেছি। অন্ধকার বারান্দা। উঠে পেছন ফিরে দেখি আমাদের খোলা দরজার সামনে ভূতে পাওয়ার মত বিভূতি দাঁড়ানো—’
‘কোঁকড়া চুল বিভুতির—তোমার ভাল লাগতো—‘
খুক করে হেসে ফেলল বুলু, ‘তা লাগত। যারাই মেয়ে দেখতে আসে তারাই এটা চায় ওটা চায়। দাদা কোত্থেকে দেবে? বাবা থাকলে না হয় হত। কে তা বুঝবে। তখন যে কোন একজন হলেই ভালো লাগত। আমি টিউশুনি করে হারমোনিয়াম কিনেছিলাম। বিভূতি স্বরলিপি তুলতে জানত—’
‘শুধুই স্বরলিপি তুলে দিত।’
‘আবার কি! তুমি তো কতজনের সঙ্গে কত কি করেছ। আমি খোঁজ নিতে গেছি—‘
‘আমি খুব কিছু করিনি বুলু। মিশেছি অনেকের সঙ্গে। দু’চারজনের সঙ্গে ঢলাঢলির যোগাড় হয়েছিল। কিন্তু তখন আমি কনফার্মড্ বেকার। কারও সঙ্গে জমত না। নেশার মত জড়িয়ে পড়েই কেটে গেছি—’, হঠাৎ কুবের বলে দিল, ‘বুলু—বিভূতি চুমু খেয়েছিল—‘
চুমুর মত করেছিল—মুখ কাছে এনে সেরকম করতে চেয়েছিল—’
‘তুমি ঠোঁট বুজেছিলে—তাই না—’
‘কেন খুঁচিয়ে পাগল করছো। আমি তো কিছুই লুকোইনি তোমাকে। আমার এসবে কিছুই হত না। এক-একদিন অনেকক্ষণ বসে থাকত। হারিকেনের আলো—চিমনি কালো হয়ে এসেছে হলদে কেরোসিনে। দাদা বাজার করে ফেরেনি! বৌদির বাচ্চাগুলো না খেয়ে ঘুমোচ্ছে। বিভূতি কখন উঠবে বলে বসে আছি। উঠলেই ছাতু আর গুড় মেখে খেতে বসব! এক দানাও চাল থাকত না কোন কোন দিন। তিন টাকা, সাত টাকা সব টিউশুনির রেট—পাঁচ বাড়ি ঘুরে যা পেতাম তাই জমিয়ে জমিয়ে লাল পাথরের ডুমো বসানো একটা হার গড়িয়েছিলাম দেড় বছরে—’, হঠাৎ থেমে দম নিল বুলু। বিকেলের ট্রামে একরকমের শব্দ হয়। তার মাঝখানে ফিরে বললো, ‘তখন চাকরি পেলে ইরার সঙ্গে নিশ্চয় বিয়ে হয়ে যেত তোমার।’
‘তা হত। ডিপ লাভের পিরিয়ড যাচ্ছিল তখন। দু’শো টাকার চাকরি পেলে অন্য রকম হয়ে যেত। শেষদিকে আর পাঁচটা হিসেবি মেয়ের মত বলতে শুরু করল-আমার সঙ্গে তোমার খাপ খাবে না। আমি একভাবে মানুষ—তুমি একভাবে মানুষ! বুঝতে পেরেছিল, আমি শীগগির কোন চাকরি পাচ্ছি না।’
‘কষ্ট হত তোমার?’
‘তা হত বুলু। কিন্তু কিছু করার ছিল না। অবশ্য এমন কষ্ট আমার ভুলতে দেরিও লাগত না। ইরার বাবা পাকিস্তানে ওষুধ ব্ল্যাক করে অনেক টাকা করেছিল। কলকাতায় দু’খানা বেনামা বাড়ি। তারপর নিউ আলিপুরে নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল—‘
‘কষ্ট ভুলে যেতে? আমার কিন্তু খুব মন খারাপ থাকত। বিভূতিটা ভীষণ ভীত ছিল। অল্প মাইনের চাকরিতে তখন আমাকে বিয়ে করতে ভয় পেয়েছিল! মানে মানে করে কেটে পড়ল। আমার তো শরীর খারাপ হয়ে গেল—’
তখন আমি গিয়ে হাজির। তোমাদের ছাদে প্রথম আলাপেই হাত চেপে ধরলাম তোমার। তুমি দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছিলে। আমি ওরকমই করতাম বুলু। অন্ধের মত একজনের পর একজনের সঙ্গে মিশতাম। সবাই যে যার জীবনের জায়গায় বসে আছে। শুধু আমিই সিট পাইনি। হাউস ফুল। তখন ইনসালটেড হতে এত ভাল লাগত—’
‘ইরার হাত চেপে ধরতে?’
হোহো করে হেসে উঠল কুবের, হাত কি! জড়াজড়ি করেছি কত। তখন তো কলকাতায় এমন খালি বাড়ির সন্ধান জানতাম না। ইংরাজি মাসের গোড়ার দিকে ওর ছিল পিরিয়ডের সময়। লাল নয়ত খয়েরি শাড়ি পরে আসত। তখন কি পাগলামিই করত। গলার স্বর বড় মিষ্টি ছিল। ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’—এমন গাইত—গলার ভেতর দিয়ে বুকের সুধা বল, অমৃত বল—সব উঠে আসত। দোষের মধ্যে ওর নাকটা কিছু মোটা ছিল, কিন্তু ভয়ঙ্কর গাঢ় গম্ভীর চোখ দিয়ে সে-খুঁত পুষিয়ে নিয়েছিল। চুমু খাওয়ার সময় বুঝেছিলাম, এ মেয়েকে আমি ভালবাসব নিশ্চয়—পরে হয়ত সব গুবলেট হয়ে যাবে—কিন্তু ভালবাসা হবেই। চুমু খেয়েই বুঝেছিলাম—’
‘কেমন করে?’
‘যেমন করে তোমাকে বুঝেছিলাম। তিনদিনের মধ্যে জোর করে চুমু খেয়েই বুঝলাম তোমার সঙ্গে ভালবাসা হবে। তবে সময় লাগবে। আসলে বিয়ের পর আস্তে আস্তে তোমাকে ভালবেসেছি বোধ হয়—অথচ লোকে বলত আমাদের লাভ ম্যারেজ—’
‘বুঝলে কি করে—’
‘চুমু খেয়ে সুগন্ধি লাগলেই জানতাম। তোমার আগে শুধু ইরাকে তেমন লেগেছিল। এক-একজনকে এমন বিচ্ছিরি লেগেছে চুমু খাওয়ার পর–কি বলব—কিন্তু সেই মোমেন্টে তো পিছোনো যায় না। আমাকে তখন গাড়ি ভাড়া দিয়ে করুণা করে মেয়েরা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে প্রেম করাতো, প্রেমের ডায়লগ শুনতো। আমারও কোন চাকরি ছিল না, কাজ ছিল না—জগৎটাই শুকনো—আমি তখন প্রায় মেয়েমানুষের নাঙ্ হয়ে উঠেছি।’
‘মানে?’
‘ও তুমি বুঝবে না—’
‘বলোই না—’
‘কেষ্ট বোঝ? পুরুষলোক পয়সা হলে রক্ষিতা রাখে। আমি তখন মেয়েদের রাখিত—সস্তার নাঙ্! লাভমেশিন বলতে পার—ঘোরে থাকতাম—সামনে সব কিছুই ধু ধু করছে—’
‘ভালোই ছিলে বলতে হবে!’
‘চমৎকার! শুধু মন খারাপ লাগত—এ আমি কি করছি। সকালে কৃষ্ণা! বিকেলে তৃষ্ণা! সন্ধ্যেয় আরতি—এরকম কত কি!’
‘বিবেক কামড়াতো তাহলে!’
‘আফটার অল হিউম্যান বিইং! কামড়াবেই। আর বয়স বা কি ছিল! তখনকার কুবের সাধুখাঁকে এখন দেখতে পেলে আমি নিজেই টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতাম। দেখলে মায়া হত। বলতাম-ব্রাভো ইয়ংম্যান! খুব হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করেছ। এই নাও দশ হাজার টাকা। এবার খেয়েদেয়ে দরজা আটকে ঘুমোও গিয়ে। কেউ ডিসটার্ব করবে না। তোমার সব চিন্তা আমার—’
‘খুব পরিশ্রম হত বল!‘
‘হবে না? বৃষ্টির দিন। একটা গেঞ্জিও শুকোয়নি। মার সাদা ব্লাউজ পাঞ্জাবির নীচে। পুলিশ অফিসারদের সাততলা ফ্ল্যাটবাড়ির পেছনে আলিপুরের দিকে গাছপালা ঘেরা একটা মাঠ ছিল। ইরার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ভালো ভালো কথা বলছি—মাথা নীচু করে ইরার তিন তিনটে চুমু খাওয়া হয়ে গেছে—আমি তখন নন্দনকাননের পুকুরে চিৎ সাঁতার দিচ্ছি প্রায়—এমন সময় ইরা আমার বুকে ভালবাসার হাত বোলাতে গিয়ে গায়ে গেঞ্জির বদলে মার ব্লাউজ আবিষ্কার করে গলগল করে মাটিতে ভেঙে পড়ে, হাসতে লাগল। হঠাৎ এক সঙ্গে অনেক হাসির শব্দ—কথা—তড়াক করে দু’জনেই উঠে দাঁড়ালাম। পুলিশ অফিসারদের সেই ফ্ল্যাটবাড়ির সব ফ্লোরেই পেছনের ঝুল-বারান্দায় মেয়েপুরুষ দাঁড়ানো। এতক্ষণ তারা বিনে পয়সায় সিনেমা দেখছিল। এবার একটা হাসির সিনে সবাই হেসে উঠেছে।’
‘কি করলে?’
‘আমরা দু’জন মাথা নীচু করে সবার চোখের সামনে দিয়ে মাঠ পেরোলাম। মাঠ যেন আর শেষ হয় না। রাস্তায় উঠে ইরাকে চাঙা করার অনেক চেস্টা করলাম। ততক্ষণে আমার কেস হোপলেস্। পৃথিবীতে আমাদের আড়াল করার একটা শেড নেই। বিশেষ করে আমার নেই। ইরা বললো,—‘একটা কাজ জোটাতে পার না—কতলোক চাকরি করে।’ এত স্যাভ্—করুণ হয়ে গেল বিকেলটা। তারপরেই মেয়েটা এক ডাক্তার জুটিয়ে বিয়ে করে ফেললো। বিলিভ মি, আমার কোন কষ্ট হয়নি। অথচ মজা দেখ সেই ডাক্তারকে নিউ আলিপুরের বাড়িতে ঘরজামাই রেখে নারসিং হোম করেছিল ইরার বাবা। অনেক টাকা আসবে। কিন্তু ওপাড়ার বাসিন্দারা কচি ধন্বন্তরিতে বিশ্বাস করে না। তারা ছোটে ঘাঘু ডাক্তারের খোঁজে। বেচারার নতুন সারসিং হোমে ওষুধ নিতে আসে তারাতলার লেবার ক্লাসের লোকজন। তারা ওষুধের দামই বাকি রাখতে চায়। অতএব ইরাকে স্কুলে চাকরি নিতে হল—’
‘তুমি এত খোঁজ পেলে কোত্থেকে—’
‘কঠিন না। আমাদের কারখানার গুপ্তর বউয়ের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ায় ইরা। তার কাছে বলেছে—বর যতদিন নিজের পায়ে না দাঁড়াচ্ছে—ততদিন কোন বাচ্চা আনবে না। বরকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে স্কুলে কাজ নিয়েছি।’
‘মিসেস গুপ্ত জানলেন কি করে—ইরা তোমাকে চেনে?’
রীতিমত জেরার ভঙ্গী দেখে হাসি পেল কুবেরের, ‘ন্যাশনাল মেটালস্ নাম শুনে ইরাই আমার কথা জানতে চেয়েছিল গুপ্ত বৌদির কাছে। তিনিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব কথা বলেছেন। ভাল কথা—বিভূতি বেহালায় আছে জানলে কি করে?’
‘বাঃ! তোমার সামনেই তো বললো।’
তা ঠিক। বিয়ের বছর দুই পরে কুবের একদিন কারখানার টাইম অফিসে শুনল বিভূতি নামে কে এক ভদ্রলোক তার জন্যে দু’ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে গেছে। বলে গেছে পরদিন আসবে। রাতে বাড়ি ফিরে বুলুকে নামটা বলতেই, বুলু বলেছিল, ‘ওঃ! আমাদের পাড়ার ছেলে ছিল—’ পরদিন অফিসে বিভূতির সঙ্গে দেখা হল। প্রথম আলাপেই জানালো, বুলুদির বরের সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছে। বুলুকে দিদি বলতেই কুবের বুঝল, এই পাতলা আড়ালটুকুর দরকার ছিল না কোন। বরং ছেলেটাই ধরা পড়ল নিজের কথায়। বুলুর চেয়ে কোনমতেই ছোট না। সেন্ট্রাল আর নথ ক্যালকাটার বাইরে বছর দশ পনের আগেও পাড়ার মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা করতে এসে নরম নরম ছেলেরা প্রথমেই দিদি পাতাতো। হঠাৎ ধরা পড়লে পাড়ার ছেলেদের হাতে আড়ং ধোলাই হওয়ার মুখে ওই ডাকটুকুই লাভারদের কাছে বিপদের মাঝে লাইফ বয়া হয়ে দেখা দিত।
ছোকরার ইচ্ছে ছিল বুলুদির বরকে দেখে। ছোকরার ইচ্ছে ছিল বুলুকে একবার দেখে। অনেকদিন দেখেনি। নানান জনের ভালবাসার নাঙ্ কুবের সাধুখাঁ বিশেষ মজা পেয়েছিল। কিছুই মনে করেনি সে। কিছু না জানিয়ে বিভূতিকে একেবারে বসবার ঘরে এনে বসিয়ে তবে বুলুকে ডেকেছিল কুবের, ‘দেখবে এসো–কে এসেছে—’
খোকন হওয়ার পর তখন সূতিকার মত হয়েছিল বুলুর। আস্তে হেঁটে ঘরে ঢুকেই বুলু প্রথমে বোবা হয়ে গিয়েছিল, তারপর অনেক কষ্টে বলেছিল, ‘কি ব্যাপার —’
ছেলেটাও ঘাবড়ে গিয়েছিল। কুবের মিষ্টি আনার নাম করে পাড়ার দোকানে গিয়েছিল। কোন সন্দেহবাই তার মনে নেই। একটা মজা শুধু। তবে কঠিন মজা। রসগোল্লা খেতে গিয়ে গলায় আটকে গিয়ে প্রচণ্ড বিষম লাগল বিভূতির। বুলু উঠল না। কাঠ হয়ে বসে থাকল চেয়ারে। বেচারা! বড় সৎ! এসব কেউ আর গায়ে মাখে নাকি আজকাল। পৃথিবীটা কত বদলে গেছে বাইরে—তার কোন খবরই রাখে না বুলু। পুরনো কথা ভেবে কাঁটা হয়ে বসে ছিল। শেষে কুবের উঠে জল এনে দিয়েছিল। আর আসেনি ছেলেটা। বিয়ে করার ভয়ে বুলুর কাছ থেকে কেটে পড়েছিল। কুবের কত জায়গায় কেটে পড়েছে। পরে সেইসব মেয়েকে বরসুদ্ধ ফুটপাথে হাঁটতে দেখে বুকের মধ্যে খচ করে উঠত তার। আহা এসব আমার সম্পত্তি ছিল! এক—একটি পুরাতনী শিখা!
খোকন জুতো পায়ে লাফাতে লাফাতে কাছে এল। কাকীমাদের ঘরে সব সময় ঘুর ঘুর করে। ছেলেটার ভাল নাম অমিতাভ সাধুখাঁ। দেবেন্দ্রলাল নাম দিতে চেয়েছিল সৃষ্টিধর। কাছে টেনে এনে একটা চুমো খেল কুবের। কতদিন যেন দেখা হয় না। নদীর ওপারের ছেলে একেবারে। মুখখানা তুলে ধরে ভাল করে চোখ দেখল কুবের। তার নিজের শরীরে ঘোলাডাঙার পাপ কিছু থেকে থাকলে এই নরম ছেলেটার গায়ে একদিন না একদিন ফুটে বেরোবেই। কুবের দেখল তারই মত নিষ্পাপ, নির্দোষ মুখশ্রী—নখ বসালে আপেলের ওপর যেমন বসে তেমন বসে যাবে—এখন একেবারে নিটোল। এই ইননোসেন্ট মুখোশটা অনেকদিন না-খোলায় একেবারে মাংসের মধ্যে বসে গেছে কুবেরের।
‘ছেলেটাকে ওভাবে ধরেছ কেন? ওর হাড় ভেঙে যাবে তো—’, খোকনকে বুলু সরিয়ে নিল, ‘নাও জুতো জামা ছাড়ো। ঠাকুরপো কুলির মাথায় দিয়ে পাখাগুলো আনছে—এখন বড় রাস্তায়—’
কুবেরদের জানলা দিয়ে ট্রাম লাইন অব্দি দেখা যায়। হঠাৎ বললো, ‘বিভূতি তোমাকে চুমু খেয়েছে মনে পড়লেই আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে—’
‘খেতে দিইনি তো। মুখ সরিয়ে নিয়েছি—’, তার চেয়ে বুলু বলতে পারত—বড়ি শুকোতে দিয়েছিলাম, কাক বসতে দিইনি।
‘ওই হল। আমার ভাবলেই কষ্ট হয়।’
‘আমার কষ্ট হয় না তোমার সব কথা শুনে—’
‘বাঃ! আমি যাই করি আমার মনে তো কোন দাগ কাটেনি কোনদিন—’
‘আমিও দাগ ফেলতে দিইনি।’
কুবের দেখল বুলুর হাত জানলার পর্দা টানতে টানতে জবাবের জন্যে থেমে আছে। হেসে বললো, ‘কি জানি! কিন্তু বিভূতির সঙ্গে তোমার ওসব মনে হতেই আমার বুকের মধ্যের দেওয়ালগুলোয় গরম হাওয়া ঘুরে ঘুরে পুড়িয়ে বেড়ায়—
এবারেও খুক্ করে হাসল বুলু, ‘ন্যাকামি!’
‘আমি একটা কথা বলব বুলু তোমাকে?—আমার জীবনের একটা স্যাভ্ ঘটনা—খুব স্যাড্।’