॥ পনের ॥
নীচু ক্লাসে কুবের বাংলাদেশের ম্যাপ এঁকেছে। অনেকবার। সবচেয়ে সোজা ছিল সমুদ্রের দিকটার রেখাগুলো। পেন্সিল কাঁপালেই দ্বীপ, নদী, সাগর হয়ে যেত। এখন সেই সব জায়গার ভেতর দিয়েই চলেছে কুবের। পাশে ভদ্রেশ্বর গ্রেটকোটের মোড়কের মধ্যে বসে গরম গরম চিংড়িমাছ ভাজা খাচ্ছে। ভাড়া করা লঞ্চ একটার পর একটা শীতের নদী থেঁতলে দিয়ে এগোচ্ছে। সেই কোন্ ভোরে বেরিয়েছে দু’জন। কুবেরের কারখানা আমলের নাইট ডিউটির কোটটার এতখানি সদ্ব্যবহার কোন দিন হয়নি। রাক্কেশখালি, দুর্বাচটি, পাথরপ্রতিমা, চড়াবিদ্যা—মৈসিনির চর। এলোপাথাড়ি নদী আর তার মাঝে মাঝে এমন সব জায়গা।
ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে লাট অঞ্চলের জায়গা দেখতে বেরিয়ে কুবের সকাল থেকে অনেক কিছু দেখেছে। ভাঁটায় নদী শুকিয়ে যেতে লঞ্চ চড়ায় আটকে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল। অনেক কষ্টে ঊর্ধ্বশ্বাসে ফুলস্পীড দিয়ে বড় নদীর বুকে এসে ভেসে পড়তে হয়। এক চুমুকে চারদিককার জল শুষে যাচ্ছিল। তখন একবার কুবের অবাক হয়ে দেখছিল কত জায়গা-জমি জলে ঢাকা পড়ে আছে। ভাঁটায় ফাঁকা নদীর বুক হিসেবে ধরলে কত জায়গা পৃথিবীতে। কথাটা ভদ্রেশ্বরকে বললো কুবের, ‘এসব জায়গা বায়না করা যায় না?’
লঞ্চের বটবট আওয়াজ, কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে, মাঝে মধ্যে চর জেগে আছে। ভদ্রেশ্বর একটু অবাক হল। সে কুবের সাধুখাঁকে একদিককার জঙ্গল হাসিল জায়গা জমি দেখাতে এনেছে। বাবু এখন কোন্ জায়গার কথা বলছে!
‘কোথাকার কথা বলছেন?’
‘নদীর বুক। ভাঁটায় কেমন গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে—’
‘হাসালেন বাবু। এসব জায়গা ভগবান লীলা করে তৈরি করেছেন। এসব দখলে রাখবেন কি করে? জল শুধু জল। জল শুষে নিয়ে আবার ফেরত পাঠাবেন দুনিয়াদার। আপনার আমার কম্ম নয়।’
কুবেরের মন খারাপ হয়ে গেল। মাঠে মাঠে ধান কাটছে দেখে এসেছে কুবের। এদিককার লাট অঞ্চলেও ধান কাটা পড়ছে। বাঁকের দু’দিকে আঁটি বেঁধে দুলতে দুলতে ভেড়ি বরাবর চাষীরা চলেছে। পৃথিবীতে এত জিনিসও আছে। ভাবলে মনে হবে যে-কোন একটা ভাল করে জড়িয়ে ধরলে একেবারে মাটির ভেতরকার রস সুদ্ধ শুষে নেওয়া যাবে। অথচ কত কঠিন।
‘কদমপুরে যেখানে আপনি বাড়ি করলেন—সেখানেও একদিন সাগর ছিল। সে হয়ত কত পুরুষ আগে। আমাদের দেখার কথা নয়। তবে আমি বালক বয়সে নদীর সোতা দেখেছি ওখানে। আমাদের কর্তাবাবাকে ওখান থেকেই বাঘে তুলে নিয়ে গিয়েছিল—‘
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—তারপরেই এই ভদ্রেশ্বর। তার নখদর্পণে পৃথিবীর ওলটপালট, জন্ম বৃত্তান্ত
সস্তায় হাসিল জমি কিনিয়ে দেবে ভদ্রেশ্বর। তা-ই বলে কুবেরকে দিয়ে লঞ্চ ভাড়া করিয়েছে। অথচ কুবেরের আজ এখানে থাকার কথা নয়। দোতলার মেঝেতে পালিশ মিস্ত্রিরা কাজ করছে এখন। জয়পুরের পাথর জোড়ে বসিয়ে নিভাঁজ মেঝে তৈরি হয়েছে—বাথরুমেও পাথর। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ননী বোসের ঝিল, কদমপুর রেল স্টেশন, নয়ানদের দোতলা, খড়িগোদার ধানক্ষেত সব দেখা যায়।
গৃহপ্রবেশের দিন কুবেরের বেশ লাগছিল। বড় বউদি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে কুবের, তার পেছনে বুলু–কাঁকালে এক হাঁড়ি কৈ মাছ। নতুন বাড়ির চারিদিক ঘুরে মাছগুলো বুলু বাড়ির পুকুরেই ছেড়ে দিল। একটা মাছ আর যেতে চায় না। ঠাকুরমশাই বললেন, শুভচিহ্ন। চারদিকেই শুভ ব্যাপারের ছড়াছড়ি। শুধু মা আসেনি। আসতে পারেনি। বড়দার চাকরির জায়গায় গিয়ে জ্বর হয়েছে। পিওনদের ওপর দেখাশুনোর ভার দিয়ে বড়দা চলে এসেছে। কুবের জানত, এখানেই মার মন পড়ে আছে। সারাদিন খাটাখাটুনির পর বড়দা বলছিল, ‘তোদের বাড়ির কথা মা জনে জনে ডেকে বলেছে। শুনছো, আমার ছেলের বাড়ি হয়েছে—পুকুর কেটেছে সে এক পেল্লায় ব্যাপার।’
বটবট আওয়াজ থেমে গেল। ভদ্রেশ্বর সারেঙঘর থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল, ‘এসে গেছি—ওই দেখুন।’
হঠাৎ এমন নদীনালার মাঝখানে গম্ভীরভাবে পুরনো দিনের একটা বিশাল স্ট্রাকচার দাঁড়ানো। আগেকার খিলেন গাঁথুনি। লঞ্চ আর এগোবে না। পাটাতন থেকে মাল্লারা ছোট ডিঙিখানা জলে নামাচ্ছে।
‘ভাল করে তাকিয়ে দেখুন। বুনো পেয়ারার ঝাড়-ফলে নুয়ে পড়েছে—পাতা দেখতে পাবেন না। ছোটবেলা থেকে এ পথে যতবার গেছি—খালি ভাবতুম এমন সরেস জায়গায় আবাদ হয় না কেন? এখানে কোন মতে ধান ছড়িয়ে দিলেই মোটা মোটা গোছা ধান মাথা নিয়ে ঠেসে উঠবে। নদীর পলি পড়ে পড়ে এক্কেবারে দলদলে মাটি। এতদিনে আপনার একটা লোক পেলাম। কিছু টাকা ঢালুন—ধান উঠতেই পাঁচ-ছ’ গুণ হয়ে ফিরে আসবে।’
আইডিয়াটা কুবেরকে গোড়াতেই হিট করেছে। কদমপুরে ক’দিন ধরেই ভদ্রেশ্বর তাকে জপিয়েছে। এখন বাজার হল ধানের। কি মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন? সাহস করে ঝাঁপিয়ে পড়ুন—পয়সা রাখবার জায়গা পাবেন না। কিন্তু একেবারে সামনা—সামনি এসে কুবের ভয় পেয়ে গেল।
আসলে বাংলাদেশের নীচের দিকটায় একটাই নদী—তার মাঝখানে বাংলাদেশ বানানোর সময় ভগবান এলোপাথাড়ি অনেকগুলো ছোট বড় মাঝারি দ্বীপ ছুঁড়ে মেরেছিল। তাই চারিদিকে গাদা গাদা নদীর মায়া। সকাল থেকে একটানা ঝকঝকে জলের দিকে তাকিয়ে কুবেরের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে খানিক সবুজ, খানিক পৃথিবীর মত ঘরবাড়ি দেখতে পেয়ে চোখ একটু ধাতস্থ হয়েছে। কিন্তু এ কি?
পাঁচ-ছ’ মাইল লম্বা হবে বোধহয় —আড়েও কম নয়। ঢাউস হয়ে নদীর মাঝখানে মাটি ঠেলে উঠেছে। তার ওপর পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে কত ফল পাকুড়ের বীজ এসে পড়েছে এই জনমানবহীন চত্বরে। অবাধে গাছপালা জন্মেছে, বেড়েছে—মরেও গেছে হয়ত। তার মাঝখান দিয়ে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে ইটের দেওয়াল, পিলার, খানিক জায়গায় জানালা, দরজার খিলান—ছাদ নেই কোথাও। ছোট্ট ডিঙিখানা দুলে উঠল। পাড়ে ওঠাই দায়। ঢেউ সেখানে ননস্টপ আছাড় খাচ্ছে। ছলবল করে জল প্রায়ই মাটি তুলে নিচ্ছে গালে—সেই সঙ্গে দাঁতন গাছের ঝাড়ও খাবলে নিচ্ছে।
‘এখানে উঠবো কি করে?’
‘ঘাবড়াবেন না। লগি মেরে লাফিয়ে পড়তে হবে। কষ্ট না করলে—’
কিন্তু কেষ্ট লাভ করতে গিয়ে শেষে প্রাণ না দিতে হয়। কুবেরকে জড়োসড়ো অবস্থায় দেখে ভদ্রেশ্বর হেসে উঠল। গ্রেটকোটটা খোলেনি বুড়ো। একেবারে অ্যাডমিরাল গোছের চেহারা হয়েছে। বাতাসে মাথার সাদা চুল উত্তরে কাত হয়ে পড়েছে, ‘এই করে জায়গা জমি করবেন? ভেবেছেন কি? সব আমি করে দেব!’ তারপরই সেই এক ফালি ডিঙির ওপরেই টালমাটাল হয়ে দাঁড়াল, ‘ওই যে দেখছেন—ওটা হল মেদনমল্ল গড়—প্রতাপরাজার সেনাপতি ছিল—এখানে থেকেই ভারি ভারি জাহাজে চড়ে সমুদ্দুর চষে বেড়াত।’
বহুবার দলিলে লিখতে হয়েছে—পরগণে মেদনমল্ল।
এই সেই মেদনমল্লর আখড়া।
তীরভূমি থেকে মাটি আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে দ্বীপের ভেতরে একেবারে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ তুলে দুর্গের সিঁড়িতে এসে থেমেছে। উঠতে কষ্ট হচ্ছিল কুবেরদের। ভদ্রেশ্বর পেছপাও হবার লোক নয়। মাল্লাদের নিয়ে কুবেরকে একরকম হিঁচড়ে ওপরে নিয়ে ঠেলে তুলল। হাঁপ ধরে গেছে। সেখানে বসে পড়ে কুবের সারা তল্লাটের একটা ছবি পেল।
তারিখের নম্বর দেওয়া ঘড়িতে চব্বিশ। আজ চব্বিশে ডিসেম্বর। ঘড়ি না থাকলে বেলা বোঝা যেত না। এখন ঠিক দুটো। কুবেরের পেছনে কত বছরের পুরনো একটা দুর্গের কঙ্কাল হাড়গোড় বের করে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ দিকে মেদনমল্লর দিঘি। দাম জমে তাতে জলের মুখ দেখা যায় না। পদ্ম শালুকের সঙ্গে রকমারি বুনো ফুল ফুটে আছে। সেখানে বিদেশী পাখিরা ঝাঁক বেঁধে আছে। রোদ পোহাচ্ছে।
মাল্লাদের তাড়া ছিল। বেলা চারটের মধ্যে লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে বড় নদীতে পড়তে হবে। জায়গা খারাপ। জীবজন্তু ছাড়াও মানুষের মধ্যে কত জন্তু রয়েছে। সরু নদীতে পেলে রাতারাতি রামদায়ের কোপে টুকরো করে ফেলবে।
‘কোথায়? চলুন এবার—’
এই এতখানি জায়গা—এ তো প্রায় নিজের রাজ্য। এতদিনে কেউ খোঁজ পায়নি কেন? একটু অবাক লাগল কুবেরের। এমন সুন্দর মাটি-জল আটকাবার খাঁড়ি—সবই আছে এখানে। পয়সা ঢেলে মাছ ছাড়াও চলে—আবার আবাদও হতে পারে। পয়সা ছড়ানো রয়েছে—শুধু তুলে নিলেই হয়।
একটা ঢিবি পার হতেই ইট বাঁধানো রাস্তা পড়লো। দেখেই চমকে উঠল কুবের। তারপর সবাইকে পেছনে ফেলে কুবের দৌড়ে চলে গেল। এ তো আমার চেনা জায়গা। ভদ্রেশ্বর, এ তো আমার চেনা জায়গা। কতবার এসেছি এখানে। এই পথ ধরে কতবার ছুটে গেছি। জলের ফেনার ধারায় এরকম কত কথা কুবের সাধুখার বুক তোলপাড় করে এক লহমায় তার ভেতরকার হাড়-পাঁজরের উপর দিয়ে বয়ে গেল। তখন পেছনে গ্রেটকোট গায়ে একটা বুড়ো এলোপাথাড়ি চেঁচাচ্ছে, ‘ধরো ধরো। ধরে ফেল তোমরা-আনাড়ি লোক পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবে। সাধুখাঁ মশাই! ও সাধখাঁ মশাই! কোথায় গেলেন?’
আর সাধুখাঁ! কুবের তখন দু তিন শো বছর আগেকার সেনাপতি মেদনমল্লর বাঁধানো চত্বরে গিয়ে পড়েছে। অনেকগুলো পাখি সেখানে নিশ্চিন্তে ছোঁ মেরে এসে নামছিল আবার উড়েও যাচ্ছিল। কুবের সেখানে এসে দাঁড়াতেই তারা চলে গেল। শুধু একটা মোটা সাপের কিছু সময় লাগল। বয়স হয়েছে। বেচারি নড়েচড়ে মেদনমল্লর খাজাঞ্চিখানার দিকে চলে গেল।
সামনেই সমুদ্র। এদিকটা কুবেররা আগে দেখতে পায়নি। কোণে দিঘির মাঝখানে বাঁধানো জলটুঙি কালের ভারে ধসে পড়েছে। তার ওপর দিয়ে জলকলমির ঝাড় লতিয়ে এগিয়ে গেছে। কুবের আর দাঁড়াতে পারল না। কোন জায়গাতেই স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। এক-একটা ফাটল, এক একটা ভাঙন—সব কুবেরের চেনা জায়গার ওপর দিয়ে ঘটে গেছে। তার ভেতরে যা কিছু জানা চেনা ছিল—সেসব ঠেলে আরও অনেক ভেতর থেকে এই জায়গাটার ছবি আরও জোরে বুড়বুড়ি কেটে ওপরে আসতে চাইছে। কুবের সে-ঢেউ কিছুতেই ঠেলে দাবিয়ে রাখতে পারছে না।
ভদ্রেশ্বর রীতিমত ভাবনায় পড়ে গেল। এই ছিল লোকটা। কোথায় গেল। সব জায়গায় এগোনোও যায় না। চিত্তির করা ফুল মেলে দিয়ে কতরকমের বুনো গাছ এই দুর্গের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মাথার ওপরে ছাদ নেই। সেখান দিয়ে আলো পড়ে ভেতরটা লতায়-পাতায়, ভাঙা ইটে, শ্যাওলায় কারুকাজ করা ভেলভেট হয়ে পড়ে আছে।
সাহস করে এগোতেই কুবের পেয়ে গেল।
‘ভদ্রেশ্বর এই আমার শোবার ঘর—’
বলতে ইচ্ছে করছিল, চমৎকার। নিয়ে এলাম আমি আর আপনি বলে দিলেন কোন্ জিনিসটা কার? কোথাকার? ভাল!
‘এখানে বসে আমি কোটালের বাতাসের দিকে নজর রাখতুম—’
‘হয়েছে। চলুন এবারে।’ মাল্লাদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রেশ্বর চোখ টিপতেই কুবের ছিটকে ভাঙা খিলানের ধাপ ধরে ওপরে উঠে গেল। এসব আমার ছিল। সেখান থেকে সারা তল্লাট কুবেরের চোখের নীচে ঠিকরে এসে দাঁড়াল। শ্যাওলায় পা রাখা যাচ্ছে না। এখনকার তুলনায় একেবারে পকেট সাইজের ইটের গাঁথুনি। তবে খুব চওড়া। দু’ দুটো লোক দৌড়ে যেতে পারে তার ওপর দিয়ে। চরদিকে ইটের শ্রাদ্ধ হয়েছে। ভদ্রেশ্বর নীচে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলছে, ‘আমার ঘাট হয়েছে কুবেরবাবু। আপনি ভালোয় ভালোয় নেমে আসুন। আমরা এবার লঞ্চ ছেড়ে দেব। প্রাণটা খোয়াবেন না দয়া করে। বউমাকে আমি মুখ দেখাতে পারব না। দয়া করে নেমে আসুন—’
কুবের একচোট হেসে উঠল। সারাটা দুর্গ কাঁপিয়ে সেই হাসির আওয়াজ দিঘির চত্বরে গিয়ে আছড়ে পড়তেই পুরনো দামের ওপরের পাখির ঝাঁক একেবারে ছররা খেয়ে আচমকা দিগ্বিদিক হারিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়তে লাগল। কাদার গাঁথুনির পরিগুলো দিঘির দু’ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সব ঢাকা পড়ে গেল। কত পাখি ছিল তাহলে!
‘নেমে আসুন দয়া করে।
‘আমার জায়গায় ওরা কারা?’
‘কোথায়?’
‘ওই যে। দক্ষিণের তীরে গুষ্ঠির নৌকো ভিড়েছে—’
ভদ্রেশ্বর পেছন ফিরে তাকিয়েই বুঝল, দূর দূর নদীর জেলেদের কাণ্ড। ছোটবেলায় এদিকে বিচুলির নৌকোয় চড়ে ঘুরতে এসে দেখেছে, জেলেরা সমুদ্রের অখাদ্য কুখাদ্য কিম্ভুত সব মাছ পেলে ছাল ছাড়িয়ে দ্বীপের মাটিতে ফেলে শুকোতো। কলকাতার ব্যাপারীরা সবরকম জিনিসই কেনে।
মুখে বললো, ‘আপনি নেমে এসে বারণ করুন।’ লোকটা যে এত বড় একটা পাগল কে জানত। অথচ সব সময় কেমন ভদ্রলোক সেজে বসে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার জেলেদের দেখতে গিয়েই ভদ্রেশ্বরের গা ছমছম করে উঠল। দিঘির পাড়ে বাঁধানো চত্বরে বিকেলবেলার রোদ পড়ে ভুল হয়ে যায়—এসব এই বুঝি সেদিনের তৈরি। একটু আগে লোকজন দাসদাসী দিঘিতে জল সরে দুর্গের ভেতর চলে গেছে। এখন সব চুপচাপ। যে কোন মুহূর্তে সেনাপতি মেদনমল্ল এসে পড়তে পারে। আসার সময় হয়ে গেছে।
দিঘিময় পাখির ঝাঁক এখন দুর্গের উঁচু উঁচু দেওয়ালের মাথায় সার দিয়ে বসে পড়েছে। তাদের ছুটোছুটিতে দু’ একটা পালক এখনও শূন্যে। বাতাস ফুঁড়ে কিছুতেই নীচে নামতে পারছে না।
‘ক?’
ভদ্রেশ্বর সামলে নিল নিজেকে। এতক্ষণে লোকটা তাহলে নেমেছে। মাল্লা দুটো কোনদিকে গেল?
‘আমি।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি। কি যে পাগলামি জুড়ে দিয়েছেন—’
কুবেরের দিকে তাকানো যায় না। চোখ লাল। সাত-সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া লেগেও হতে পারে। চুলগুলো খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে। হাঁটুর কাছে ধুতি ছিঁড়ে গেছে।
‘এসব জায়গা আমার চেনা ভদ্রেশ্বর।’
‘কি যে মন খারাপ করা সব কথা বলেন।’
‘না। আমি এখানে ছিলাম। কবে ছিলাম মনে নেই। কিন্তু ছিলাম। সব চেনা।’
একটু শীতও লাগছিল ভদ্রেশ্বরের। লঞ্চে বসে ভালোমন্দ যা কিছু পেটে পড়েছিল—সব হজম হয়ে এখন নাড়িভুঁড়ি সুদ্ধ জ্বলছে।
‘ভালো কথা। চেনা জায়গায় এবারে আবাদ করুন। কিন্তু আমি আর আপনাকে নিয়ে এখানে আসছি নে।’
‘কেন ভদ্রেশ্বর। আমি কি করেছি?’
‘কি করেন নি? অমন করে এই কবরখানায় কেউ দৌড়াদৌড়ি করে?’
‘কবরখানা বলছ কেন? আমি এখানে ছিলাম ভদ্রেশ্বর। ওই যে আমার বৈঠকখানা। ওই ঢালু জায়গায় গরুমোষের বাথান ছিল। এখনও আমি সব চিনে চিনে বের করতে পারি।
‘কাজ নেই। যত্ত গা গুলানো কথা বলেন আপনি। এই করে আবাদ করবেন?’
ভদ্রেশ্বরের কথার ঝাঁঝে কুবের ফিরে এল। ‘জায়গাটার কোনও খাজনা নেই?’
‘তবে বলছি কি! দশ জোড়া মোষের হাল করে কাজে নেমে পড়া শুধু। শীত থাকতে থাকতে লোকজন মালপত্র নিয়ে এখানে এসে নেমে পড়ুন। দখলে রাখুন। তারপর আষাঢ়ের পয়লা হপ্তায় জ্যাঠো রোয়া সেরে দিয়ে ফিরে যান। ধান আর দেখতে হবে না। অমর খন্দ হয় এই মাটিতে। আমি বলছি সাধুখাঁ মশাই—আমি জানি-গাছগাছালির পাতা দেখুন। ঘন, সবুজ—অমর খন্দ—’
আর কোন কথা কুবেরের কানে যাচ্ছিল না। ধানের ভারে সারা তল্লাট নুয়ে পড়েছে। লোকজন দেখা যায় না। কুড়িটা মোষের মাথা ঢাকা পড়ে গেছে। দিঘির ধার দিয়ে পরির সারি আড়ালে চলে গেছে। কুঁজি বেঁধে বেঁধে চাষীরা সংসার করছে। ব্যাপারীদের নৌকোগুলোর গলুইতে আঁকা মাছ, মানুষের চোখ, নোঙরের আঁক—সব কিছু চিকচিক করছে। এক লহমায় কুবের সাধুখাঁ আগামী শীতের চেহারাটা দেখে ফেলল। এখনই বস্তা নব্বই বিরানব্বই টাকা। ধরে রাখতে পারলে—উঃ? ভাবা যায় না!
পাখিগুলো দেখল, খানিকক্ষণের জন্যে যে-চারটে মানুষ তাদের এখানে এসেছিল—এখন তারা হেঁটে হেঁটে নেমে যাচ্ছে। গড়খাই পার হয়ে গেল। এখন আর দিঘিতে বসা যাবে না। দাম ফুঁড়ে ঠাণ্ডা উঠছে। দেখা যায় প্রায়।
ভদ্রেশ্বরের পেছন পেছন কুবের সাধুখাঁ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ফিরছে। মাল্লাদের একজন অল্প জলে বিশ্রী দেখতে একটা মাছ ধরে ফেলেছে।
ভদ্রেশ্বরের মুখ দিয়ে লাল গড়াচ্ছে প্রায়, ‘বাঙাস মাছ এখানে পেলি কোত্থেকে বাবারা? বড় দামি মাছ। রাঁধলে মাংস হয়ে যায়।’
কুবেরের কানে কিছুই গেল না। সারেঙ সিটি মারার দড়িটা ধরে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। আকাশের আধখানা জুড়ে সূর্য এবারে ঢল নেবে! রোদ এলিয়ে পড়েছে। ডিঙিতে পা দিতেই কুবেরের মাথার মধ্যে মেদনমল্লর বাগান, দিঘি, চত্বর, জলটুঙি সুদ্ধ সারাটা দুর্গ চলকে টাল খেয়ে গেল।