॥ সাতাশ ॥
রোদে তাঁবু গরম হয়ে উঠতেই কুবেরের ঘুম ভেঙে গেল। বেলা হয়েছে। আভা নেই। কুবের বাইরে এসে দাঁড়াল। কাল রাতে জল অনেকটা উঠে এসেছিল। কিছু ফিরে গেছে কিছু রয়ে গেছে। দিনের আলোয় কুবের এখন বুঝতে পারল–ঝড়ে জলে যা হয়েছে, তা হল ভরাডুবি। যতদূর দেখা যায় —ধানগাছ শুয়ে পড়েছে—মাঝে-মধ্যে কয়েকগুছি দাঁড়িয়ে। কি বেগে হাওয়া বয়ে গেছে। মাঠের নানান্ জায়গায় এক একদল কামলা বসে।
থোড় ফেটে শিষ বেরিয়েছিল। ফুল ধরেছিল। বুড়ো মত একজন কামলা তার একটা নিবেদন আছে জানিয়ে বললো, ‘এখন খানিকটা জল মেরে দিতে পারলে—মোটা ধানটা ভাল ফলতে পারে। কেন না ধানগাছের সারা গা জলে থাকলেও শিষ যদি একটুখানিও মাথা তুলে থাকতে পারে—তাহলে ধানের আর মার নেই।
গত ক’মাসের সব পরিশ্রম নষ্ট। কম টাকা ঢালেনি। প্যাকেটের পর প্যাকেট ব্লাইটক্স, লিটার লিটার এনড্রিন। সব গেল। বুড়ো কামলার কথা মত দু’দুটো পাম্প চালু হল। শুয়ে পড়া ধানের গোছের পাশ দিয়ে নালা কেটে জলের রেখা সাকসন পাইপের মুখ অব্দি টেনে নিয়ে যাচ্ছে কামলারা। এত বড় মাঠের জল যেদিক থেকে যতটা পারা যায় ছেঁচে ফেলতেই হবে। যদি কিছুটা বাঁচানো যায়।
মেদনমল্লর চত্বরে উঠতে গিয়ে কুবেরের মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ভাঙাদুর্গের এখানে ওখানে পাখিরা বাসা করেছিল। হাওয়ায় গুচ্ছের ডিম বাঁধানো চত্বরে পড়ে ফেটে গেছে। পালক বেরোয়নি—এখন অনেক ছানা জলে, ঠাণ্ডায় সিঁটিয়ে মরে পড়ে আছে। দিঘির পদ্মপাতা ডাঁটিসুদ্ধ জলের ওপর অনেকটা টেনে তুলেছে কে। ঝড়ের কোন বাছবিচার নেই।
কুবের দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। হনহন করে বড় পাম্পটার দিকে ছুটে গেল। উঁচু বাঁধ দেওয়া জলাভূমির পাড়ে আভাকে পেল। মেদনমল্লর দুর্গের উঁচু দেওয়ালে রকমারি বুনোফুল ফুটে থাকত। সেগুলো কাল রাতে ঝড়ে পড়ে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতদূরে ভেসে এসেছে। সকালের ঝকঝকে রোদে দাঁড়িয়ে আভা সেগুলো কুড়িয়ে কোঁচরে নিচ্ছিল, কয়েকটা খোঁপায় গুঁজেছে। কুবের দাঁড়াতে পারল না।
দশঘোড়ার পাম্পটা চালু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। তবে মাঝে মাঝে এয়ারহেডের স্ক্রুটা ঢিলে দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পেট্রোল ঢালতে হয়। তাই হচ্ছিল। কুবের এসে দাঁড়াল। তোড়ে জল টেনে নিয়ে বাইরে ফেলছে। কি মনে হল, সাকসন পাইপের ঝাঁঝরিতে কুচোমাছ নয়ত কাঠকুটো আটকে গিয়ে জলের তোড় কমে যাচ্ছে।
কুবের মাঠে নেমে গেল। তারপর মরীয়া হয়ে সাকসন পাইপের মুখের কাছে দু’হাতে মাটি আঁচড়ে গভীর করে দিতে লাগল। ঘোলা জল পাক খেয়ে সোঁসোঁ করে পাইপে গিয়ে ঢুকছে।
কপাল বেয়ে ঘাম এসে ভ্রুতে আটকে যাচ্ছিল। মাথা তুলে চোখ ডলতে গিয়ে কুবের আভাকে দেখতে পেল। একেবারে সামনা-সামনি রোদ বলে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না। একটা বেগুনি শাড়িতে আভা স্থির হয়ে দাঁড়ানো। মাথায় সেইসব ফুল—কোঁচর হাতে চেপে আছে। মুখে কী একটা সুখ খুব স্থির হয়ে আভার সারা শরীর জুড়ে ভর করে আছে। খুব রাগ হলেও দাঁত চেপে বললো, ‘কি দেখছ?’
‘কিচ্ছু না। এমনি দাঁড়িয়ে আছি।’
কুবের বুঝল, এখন কিছু বলেই আভাকে ছোঁয়া যাবে না। সে এখন এমন কোন জায়গায় আছে, যেখান থেকে সবকিছু সুখের লাগে। অথচ এত কষ্টের চাষবাস—কত বড় বড় অঙ্কের লাভের স্বপ্ন কাল রাতে ঝড়জলে ধুয়ে গেছে।
কয়েক জায়গায় ধানচারা কেটে ফেলে জলের পথ করে দিতে হল। কাটতে মায়া হচ্ছিল। শিষ ভর্তি হয়ে এসেছিল। টিপতেই দুধ বেরিয়ে যায়। সারা ক্ষেত জুড়ে জল নিকাশের নালা তৈরি করছে কামলারা।
আভা নড়েনি। রোদে খালি গায়ে কুবেরকে এই প্রথম অনেকক্ষণ ধরে দেখল। গাঢ় কালচে দাগে সারা গা ভরে গেছে। অমন সুন্দর চকচকে কপালেও ছোপ ছোপ দাগ ধরেছে, চোখ বসে গেছে—টলে টলে কাদার মধ্যে ছপছপ করে এগোচ্ছে মানুষটা—এখন জল কাদা দুইই গরম হয়ে উঠছে। কুবেরের সারাটা গা এক রকমের কালচে শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
থেমে দাঁড়াতেই কুবেরের মাথা দুলে উঠল। সামনের ঢালাও মাঠ চোখের সামনে চলকে গেল। দেখল, তার কিছুই মনে নেই। কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে তাও জানে না। অনেক চেষ্টা করেও কোমর ভেঙে নীচু হতে পারছে না। হতে গেলেই খচখচ করে মেরুদণ্ডের ভেতরের হাড়ের চাকতিগুলো ছুঁচলো একটা ব্যথা তুলে তাকে সিধে করে দিচ্ছে!
পাম্পের আওয়াজের মধ্যেই আভা চেঁচাচ্ছিল, ‘কুবের। কুবের—’
দু’জন কামলা পাশেই কাজ করছিল। ছুটে এসে কুবেরকে ধরে ফেলল। তাদের গায়ে ভর দিয়ে পাড়ে উঠবার মুখে আভাকে দেখেই খিঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি এখানে কেন?’
আভার মুখে সেই সুখ একটুও চিড় খেল না। কাল রাতে ঝড়ের পর ভোর হতেই কেউ এমন করে সাজে। কামলাদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে আভাও কুবেরকে টেনে তুলল। ঝাঁকুনিতে খোঁপা ভেঙে পড়তেই কুবের দেখল বেণীর খাঁজে খাঁজেও আভা লালচে কি একটা ছোটমত বুনো ফুল বসিয়ে নিয়েছে।
‘তুমি এখানে কেন? যাও—’
আভা পেছোলো না। বরং আরও শক্ত করেই কুবেরকে ধরল।
‘চলে যাও আভা। এখান থেকে যাও। তাকিয়ে দেখ—আমার আর কিছু নেই।‘
‘আবার হবে। আবার হবে—’, আভা কুবেরের কোমরে হাত দিয়ে মানুষটার মাথা সুদ্ধ অনেকখানি নিজের শরীরের ওপর নিতে গেল।
‘তুমি যাও—‘
আভা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। সামলে নিল। কামলারা মাঠে নেমে গেছে। কুবের টলতে টলতে তাঁবুর দিকেই এগোচ্ছিল। হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি কে?’
‘আমি? আভা! কেন?’
‘উঁহু। আভা নও।’
‘তবে কে!’
জা’নি না। তোমাকে আমি চিনি না। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না—’, কুবের চিৎকার করে উঠল, ‘আমি সব ভুলে যাচ্ছি আভা—’
একদম না ঘাঁটিয়ে আভা কুবেরের পেছন পেছন তাঁবুতে গেল। বাইরে যেমন হাওয়া তেমন রোদ। এখানে ওখানে নাবি জায়গায় জল দাঁড়িয়ে আছে। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল কুবের। আভা পায়ের গাম বুট খুলে নিল। তারপর তাঁবুর একদিককার ক্যাম্বিশের পর্দা তুলে দিল। হাওয়া আলোয় ভেতরটা ভরে গেল। তার মধ্যে, কুবের দেখল, দিঘির ধারের আস্ত একটা পরী ঠিক তারই সামনে দাঁড়ানো। একেবারে ঠিক আভা।
‘আমাকেও ভুলে গেলে!’
‘দয়া করে চুপ করে থাকো খানিকক্ষণ। তুমি যা পারতে তা তো করলে না—’
‘আমাকে মুক্ত করে তোমার কি লাভ কুবের?’
‘দয়া করে চুপ করে থাকো খানিকক্ষণ। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে আমার—’
‘কিছু খাবে?’ তারপর কোন জবাব না পেয়ে আস্তে আস্তে আভা বললো, ‘যদি চাও-আমি মুক্ত হয়ে যাই—’, কোন কথা নেই তাঁবুর ভেতরে। সাঁ সাঁ করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। শেষে নিজেই বললো আভা, ‘কিন্তু দেরি হয়ে গেছে কুবের। এখন বের করতে হলে ডাক্তাররা ছুরি চালিয়ে মেরে বের করবে—’ নিজের মত করে একটু কেঁদে নিল আভা, ‘সে আমি কিছুতেই পারব না কুবের। জেনেশুনে মেরে ফেলতে দিলে পারব না। সে হয় না–।’
যেমন জবুথবু হয়ে বসে আছে, তাতে দেখেই বোঝা যায়—কুবের কিছুই শুনছে না। পা ছড়ানো, চোখ খোলা, হাত দু’খানা বিছানায় ভেঙে পড়েছে—হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।
‘এখন যেন বড় হয়ে গেছে। ভেতরে নড়াচড়া করে। আগে তো এসব কোন দিন হয়নি আমার—’
তখনও কুবের চুপ করে আছে। তার মাথার ভেতরে তখন বড় দেওয়াল এলোপাথাড়ি ভেঙে পড়ছিল। হাওড়া স্টেশন পার হয়ে গেলাম। চুয়ান্ন নম্বর বাস। হরগঞ্জ বাজার। আস্তাবলে একটা ঘোড়া সারারাত পা ঠুকছে। দুপুরবেলা সালকের বাড়ি দরজা খুলল। মা দাঁড়িয়ে বাইরে। রিকশাওয়ালা ভাড়া গুনে নিচ্ছে। ঘচাং করে এইসব ছবি একটানে ছিঁড়ে তুলে নিল কে ফরফর করে।
আভা তখনও বলছিল, ‘আমায় নাহয় ডাঙায় কোথাও রাখলে–কলকাতায় কোন ফ্ল্যাটে, মাঝে মাঝে যাবে—’
এবারও কোন উত্তর পেল না আভা। দম নিয়ে বললো, ‘তোমার দাদার কাছেই ফিরে যাই। যদি চাও—মাঝে মাঝে দু’জনে বাইরে কোথাও চলে যাব—আবার ফিরেও আসব।’
‘কার সঙ্গে থাকবে তাহলে?’
‘তোমার কাছেও থাকব—মোহান্তের কাছেও।‘
কুবেরের মনে অনেক কিছু এসেছিল একসঙ্গে। শুধু বললো, ‘শেষে যদি ব্রজদাকেই ফিরে আবার ভাল লেগে যায়!’
আভার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কুবের যে কোনদিন আবার এমন হেসে কথা বলবে ভাবাই যায় না। দু’খানা বুক খুলে ফেলে ভেতর থেকে কথা বললো আভা, ‘আর হয় না—’
‘আমার কাছেও থাকবে—ব্রজদার কাছেও, কোন অসুবিধে লাগবে না?’
‘আহা! ন্যাকা! আমি কি ক্ষয়ে যাচ্ছি?’ আভা কুবেরের দ্বীপে এসে ঠিক এই ধারায় গোড়ায় গোড়ায় ফুঁসে উঠত।
‘তবু—’
‘তবু কি? তোমার কথাই ভেবে দেখ কুবের। বুলুর কতদিনকার লোক তুমি—অথচ আমার কাছেও আছ—কোন অসুবিধে লাগছে তোমার?’
কুবের চুপ করে গেল। কথাটা ফেলা যায় না।
‘আমাকে নিয়ে যাও কোথায়’, থেমে গিয়েছিল আভা, পাম্পের আওয়াজ থেমে নেই, ফিরে বললো, ‘নয়ত এখানেই থেকে যাই না কেন আমরা—কি হবে আর ডাঙায় গিয়ে? বল কুবের।’
কুবের চোখ খুলে তাকিয়েছিল। এইমাত্র যেসব জবাব তার মনে আসছিল ভেতরের ভাববার যন্ত্রপাতি কেমন ঢিলে হয়ে যাওয়ায় তা সাজিয়ে উঠতে পারছিল না। শুধুই ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব আস্তে আস্তে বললো, ‘তুমিই হয়ত ঠিক বলছ আভা। আমরা কেউ ক্ষয়ে যাই না। কিন্তু ধরো’ সব হারিয়ে গেল কুবেরের। এইমাত্র দিব্যি একটা ভাল কথা—বেশ জুতসই কথা মনে এসেছিল। শেষে একটু সাবধানে মনে করে করে বললো, ‘ধরো যদি জং পড়ে যায় মনে?’
আভা হাসি ছিটকে দিয়ে বলল, ‘দিচ্ছে কে! পড়লেই হল!’ তারপর একেবারে অন্য জায়গা থেকে আভার গলা উঠে আসতে লাগল, ‘সবারই কুবের দু’জন বউ থাকে—দু’জন বর থাকে। একজনকে নিয়ে ঘর করে—অন্যজন ভাবনায় থাকে—লোকে সত্যি কথা বলতে ভয় পায় বলে এসব বলে না—’
কুবের খুব আস্তে বললো, ‘হবে—’
বাইরে খুব বাতাস। কাল রাতে ঢেউয়ের সঙ্গে অনেক মাছ চিঙড়ি ডাঙায় উঠে এসেছে। আভা গোটা দুই নোনা চিংড়ি তাঁবুর ধারেই ধরে ফেলল। দাড়া ধরে কুবেরের চোখের সামনে তুলে ধরল, ‘দেখেছ—কত বড়।’
কুবের চোখ তুলে তাকাল। দৃষ্টিতে কোন আলো নেই। একেবারে ফাঁকা। ‘এগুলো কি হয়েছে তোমার—এই যে—’, কাঁধে হাত রাখল আভা, কালচে হয়ে গেছে একেবারে।’
কুবের হাসলো, ‘তাই তো ভাবছিলাম। কিসের থেকে কি হয়ে গেল।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছ কোনদিন?’
‘কোন লাভ নেই। আমি জানি কি অসুখ।’
‘সব জেনে বসে আছ।’
‘অনেকদিন জানি। একবার কদমপুরের হেল্থ সেন্টারের রিমল ডাক্তার বলেছিল—কোন্ জার্নালে পড়েছে, এ রোগ পুরনো হলে হাত পায়ের গাঁটে গাঁটে কালচে ছোপ ধরতে শুরু করে—’
‘বলে দিল আর তুমি ধরে নিলে!’
‘আমি যে জানি আভা-’ অল্প একটু থেমে পড়ল কুবের, ‘আর জানত মা। তখন কম বয়স ছিল। কি বা বুঝতাম। আমার জীবনে এটা একটা স্যাড় ঘটনা আভা—বলতে পার এক্সপেরিয়েন্স। সেই অল্প বয়সে এমন ধাক্কা খেলাম মনে মনে কি ভীষণ চাপা গুমোট—যারা জানত তাদের ঘেন্নায় তাদের চোখ তুলে তাকানো আমি সেই বয়সেও সহ্য করতে পারতাম না। আমার ভেতরটা বিলকুল থেঁতলে গেল। অনেকগুলো লোক একসঙ্গে ধরাধরি করে একখানা ভারী পাথর এনে আমার বুকের ওপর চাপিয়ে দিল। সেই থেকে আমি আর নড়তে পারছি না—’
‘কি সব বলছ কুবের। আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে—’
‘সেই থেকে আমি ভীষণ সরল, নিষ্পাপ হয়ে গেলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ আভা—আমি নিজেই জানি—এমন নিষ্পাপ মুখ শুধু শিশু, নয়ত পাগলের হয়—’
‘কুবের—’, আভা থামানোর চেষ্টা করল। বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারছে না। ছেলেটাকে গোড়ায় কেমন দেখেছিল—আর এখন কেমন হয়ে গেছে।
‘আমি সব সময় আমার নিজের মুখ দেখতে পাই। আয়না লাগে না আভা।’
‘চমৎকার! চুল আঁচড়াতে চিরুনি লাগে?’
কুবের রসিকতার ধার দিয়েও গেল না, ‘কখন কখন মোলায়েম—কখন সরল, সাধু, নিষ্পাপ দেখায় আমার মুখ—আমি জানতে পারি আভা। এ-ভাবটা আমার ছিল না। এই মুখোশটা অভ্যেসে অভ্যেসে আমার মুখে একেবারে চেপে বসে মিশে গেছে।’
‘সেই থেকে কি ভুল বোকছো। মাছ ভেজে দেব—খাবে?’
‘দাও। আমার পরের ভাই নগেন বলত—সেঝদা তোমার মুখে সব সময় ভাবলেশহীন একটা বোভাইন লুক্ স্থির হয়ে আছে—’
স্টোভ ধরাতে ধরাতে আভা বললো, ‘আবার ইংরেজী বলছ—জানো আমি বুঝি নে―।’
‘গরুর চোখ দেখেছ? আমার মুখে নাকি কোন ভাবই ফোটে না। শুধুই সরল, শুধুই নিষ্পাপ পাপের কোন ছায়া নেই—’
‘ভালো তো। তুমি খুন করে উঠে দাঁড়ালেও কেউ সন্দেহ করবে না—’
‘শুধু এক মুহূর্তের ভুলে আভা। তখন কিছুই বুঝতাম না।’
স্টোভের দশটা ঘোরানো পলতে একসঙ্গে আগুন পেয়ে শিখা হয়ে উঠল। আভা মুট মুট করে দাড়া ভেঙে ফেলল। মাছ ব্যথা পেলে শব্দ করে না। সেই অবস্থায় বাটিতে রেখে দিয়ে কুবেরের কাছে এল আভা, অনেকদিন পরে একেবারে গা ঘেঁষে পিঠে হাত রাখল, ‘কি হয়েছিল কুবের?’
‘ক্লাস এইটে একদিন শুক্কুরবারের দেড় ঘণ্টার টিফিনে সনতের সঙ্গে ঘোলাডাঙার ফেরিঘাটে গিয়েছিলাম। ওর কাছে পৈতের ব্রতভিক্ষের টাকা ছিল অনেক।’
‘ঘোলাডাঙা?’
‘খারাপ পাড়া বলতে পার—’
‘তুমি গিয়েছিলে?’
‘সেই একবারই–সেই শেষবার—’
‘কত বয়স ছিল?’
‘কত আর-বারো চোদ্দ’
‘মোটে! তখনই!
‘সেই ভুলেই তো আভা—’
‘বল খুব অল্প বয়সেই পেকেছিলে। মেয়েটিকে দেখতে কেমন ছিল?’
‘চেনা মেয়ে। শেফালি—যখন যা পাই তাই ভাল। এখন বুঝি—একেবারে পিওর ফ্যাকাসে একটা মেয়ে। তখন জানতামও না—একবারেই কত কি হয়ে যায়—তারপরেই অসুখ—’
‘বাজে বোকো না। তোমার কোন অসুখ নেই কুবের। তাই ধরে বসে আছে বুঝি। অমন তো লোকে কত যায়। আচ্ছা সেই সন? দেখা হয়েছে পরে?’
‘একবার। অনেকদিন পরে কলকাতায় এসপ্ল্যানেডের মোড়ে—’
‘কিছু বললো?’
‘একদম না। ভুলেই গিয়েছিল আভা। আমি মনে করিয়ে দিতে বললো—’এখনও প্রায়ই যাই’—অথচ আভা আমার যে কি হয়ে গেল! সেই একবারেই—অথচ —’
‘কিচ্ছু হয়নি তোমার—দিব্যি ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছ—আবার কি হবে?’
‘তুমি জানো না আভা।’
‘আমি সব জানি।’
স্টোভের আগুন নীল হয়ে জ্বলছিল। আভা মাছ চাপিয়ে দিল। আলোর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না কুবের, ‘আমার তখন অসুখ হয়—খুব। জানাজানি হয়ে গেল। মা জানলো। মা ওষুধ দিয়ে দিত। সে যে কি কষ্ট আভা—‘
আভা স্টোভের পাশ থেকে নড়তে পারল না। পরিষ্কার দেখল, কুবেরের নাক, চোখ, মুখ পারলে এখুনি আলাদা আলাদা হয়ে ভেঙে পড়ে। কাছে এল। খুব আলগোছে মুখের কাছে মুখ নিল। ঠোঁটে চুমু রাখতে ভরসা হল না। গালে পাতলা করে একটা চুমু বসিয়ে দিল। চুলের ভেতরে আঙুল চালিয়ে হাল্কা করতে চাইল কুবেরকে, ‘ওসব কথা এখন থাক।’
‘পুঁজ পড়তে শুরু করল। সে যে কি বিপদ আভা। কি লজ্জা। নগেন হয়ত পরে বড় হয়ে আবছা আবছা বুঝেছে—’
‘আমি আর শুনতে চাই না’, আভা উঠে গিয়ে খোঁচাখুচি করে মাছ নামাল, প্লেটে এগিয়ে দিল, ‘খেয়ে নাও।’
‘গরম।’
‘চামচ দিচ্ছি—’
তাঁবুর বাইরে তাকিয়ে কুবের বললো, ‘তাই বলছিলাম আভা—আমার রক্ত দোষে ধরেছে—খারাপ। পিঠের ব্রণ খুঁটলে পাতলা ফ্যাকাসে অনেক রক্ত বেরিয়ে আসে। হাঁটতে গেলে মেরুদণ্ডের হাড়ের চাকতিগুলো ছুঁচলো ব্যথায় খচ খচ করে ওঠে। সেখানে একটা সরু রেখা ধরে কি সব মাথার মধ্যে সিধে চলে যাচ্ছে। আভা আমি একে একে সব ভুলে যাচ্ছি। আবার খাপছাড়ান ভাবে অনেকখানি এক সঙ্গে ঘচাং করে মনে পড়ে যায়। গায়ের এই দাগগুলো দ্যাখো কত কম ছিল আগে—এখন রোজ বেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে—রোজ—’
‘চিকিৎসা হয়েছে। সেরেও গেছ তুমি।’
‘ভয়ঙ্কর চিকিৎসা হয়েছিল। বাড়ির মধ্যে আলাদা মশারিতে আলাদা ঘরে জায়গা হল। ডাক্তার চিকিৎসা ছাড়াও দরজা আটকে একা ঘরে দাবড়ি দিয়ে হাজারো কোশ্চেন করত। চিকিৎসার সঙ্গে সোশ্যাল ওয়ার্কও চালাত লোকটা—’
‘সব ভুলে যাও কুবের। এবার বোধ হয় মাছ ঠাণ্ডা হয়েছে। শুধু হাতেই খেতে পারবে।’
কুবের খেতে খেতেই দাপাচ্ছিল, ‘আমি একটু ঘুমাবো।’
‘চান করবে না? আচ্ছা ঘুমোও। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।’ আভা তাড়াতাড়ি স্টোভ নিবিয়ে ফেলল। তাঁবুর বাইরে এসে দেখল, কাল রাতে যতদূর জল উঠেছিল—দ্বীপের ততটা জুড়েই যতদূর চোখ যায় সাদা সাদা কি একটা জিনিস রোদে চিকচিক করে জ্বলছে। জল ফিরে গেছে। এখন নানান মাছ পড়ে আছে। জল নেই আর—রোদ বাড়ছে, এরা আজ সকালেই মরেছে। কামলারা শিল কুড়োবার ধারায় মাথা নীচু করে কুড়োচ্ছে। এতক্ষণ কুবের বাইরে ছিল বলে পারেনি।
শরীরের কথা ভুলে গিয়ে আভা একছুটে তাঁবুর ভেতরে এল। কুবেরকে মাছ কুড়োতে ডাকবে। কয়েক সেকেন্ডে মানুষটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। মুখ হাঁ হয়ে আছে। বুকের ওপর থেকে বাঁ হাতখানা নামিয়ে দিল।
কুবেরের তখন খুব আনন্দে কাটছিল। অনেকদিন পরে নগেনের হাত ধরে একটা কালো পাথরের মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নামছিল। নীচেই রাস্তায় বাস দাঁড়ানো। এমন নিশ্চিন্তে কতকাল কোন জিনিস দেখে বেড়ায় না দু’ভাই। বাস স্টপে দেখল, ‘বোঁচকা নিয়ে মা বসে আছে। কুবেরদের দেখে বললো, ‘পরের বাসে যাবি। এখানে একটু বস।’
দু’ভাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘তুমি বেঁচে আছ মা?’
‘বারে! আমি আবার মরলাম কবে?’
নগেন কুবেরের দিকে তাকাল। সেঝদা কাঁদছে। কুবের ভুলে যেতে যেতে মনে করার চেষ্টা করল, একদিন তবে কাকে আমরা পুড়িয়ে এলাম? কথাটা বলতেই মা বললো, ‘ভুল হচ্ছে তোর। অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিস। তোর গৃহপ্রবেশে যাওয়া হয়নি। চল বাড়ি দেখাবি। ক’টা ঘর?’
কুবেরের মুখ হাঁ হয়ে গিয়ে হাসি বেরিয়ে আসছে গলগল করে। নগেন পুকুরের কথা বলছে, দোতলার ছাদের কথা বলছে। তিনজনে কি জোরে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। মোড় ঘুরে রাস্তাটা সেখানে খানিক জায়গা কালো পাথরের। তার ওপর দিয়ে উঁচ কোন জায়গা থেকে জল আসছে। তিনজনের পা ডুবে গেল সেখানে।
মা বললো, ‘সাবধানে এগোবি। এখানকটা খুব পেছল।’
ছপছপ করে তিনজনে হাঁটছে তো হাঁটছেই। জলের ধারা নেমে আসার একটানা শব্দ। কুবের একবার পেছন ফিরে দেখল, জল কেটে অনেকটা এগিয়েছে দু’ভাই। কিন্তু মা বেশ পেছনে পড়ে গেছে। সেই দূর থেকেই মা বললো, ‘তোরা এগিয়ে যা—আমার জন্য থামিস নে।’
‘মা তোমার কুটনো কুটতে বেশি জায়গা লাগে বলে একটা চওড়া বারান্দা বানিয়েছি। দেখবে চল।‘
এবার ফিরে দেখল, পেছনে মা নেই, পাশে নগেন নেই—শুধু জলের শব্দ—অনেক জল বয়ে যাচ্ছে, মাঝখানে ফেনার রেখা।
কুবের উঠে বসল। তখনও জল পড়ার একটানা শব্দটা শোনা যাচ্ছে। আশ্চর্য! এইমাত্র মা ছিল, আবার চলেও গেল। অথচ জল পড়ছে। আভা নেই। বিছানা থেকে একেবারে তড়াক করে উঠতে পারল না। তাঁবুর জানলা দিয়ে দেখল দশ ঘোড়ার পাম্পটা খুব বেগে জল ছেঁচে বাঁধের ওপারে ফেলে দিচ্ছে। তারই ছ্যাঁচা থ্যাতলানো শব্দটা এখন বাতাস কম বলেই এমন সহজে তার ঘুমের মধ্যে চলে গিয়েছিল।
কুঁজো গড়িয়ে জল খেতে গিয়ে দেখল চন্দনে দাগানো পাথরখানা একপাশে পড়ে আছে। কুবেরের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। ব্রজদার রেলেশ্বর শিব।
এখন কুবের বুঝতে পারল, তার মন এক এক জায়গায় আলাদা সব ঘরে ধরা পড়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মাকে পেল, নগেনকে পেল। আভা তাঁবুতে থাকে। মেদনমল্লর পৌরাণিক তকতকে পরিষ্কার বাথান তার বড় চেনা। কদমপুরে জায়গা মাপার দিন যে-সাপটা আগাগোড়া মাথা তুলে তুলে তাদের দেখেছিল, সে কোথায় থাকে—কুবের জানে।
এই অবেলায় বাইরে আকাশ বোধ হয় অন্ধকার হচ্ছিল। ভেতরেও আলো কমে গেল। তাতে রেলেশ্বর শিব মিশে গেলেও চন্দনের দাগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, একটু আগেও এখানে মা ছিল, নগেন ছিল। বাইরে এসে দাঁড়াল কুবের।
লণ্ডভণ্ড মাঠ দেখে বোঝাই যায়, চাষ-আবাদে আগাগোড়াই কুবেরের ভরাডুবি। তবু ধানকাটা, আছড়ানো অব্দি পর পর সব করে যেতে হবে। পুরোটা গচ্চা জেনেও থামা যাবে না। এর নাম ধান। নেশায় নেশায় জড়ানো। যদি শেষদিকে বাকি শিষের সবটুকু দুধে ভরে যায় তাহলে তো বাজিমাৎ। কিন্তু ফিরে কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ইচ্ছে বা জোর কুবের কিছুতেই পাচ্ছে না।
দু’-চারদিন বাদেই পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার তেজ থাকতে থাকতে ‘ডাহুক’ খোঁড়াতে খোঁড়াতে লঞ্চঘাটায় যাবে। ঝড়ে কি সব ভেঙে বসে আছে। রাতে চললে ইঞ্জিন কম গরম হয়। ঝুঁকিও কম। খুব আস্তে আস্তে লঞ্চটা খাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। মেদনমল্লর দুর্গ বরাবর নোঙর ফেলবে। বেলাবেলি মেঘে ঢাকা পড়ে সূর্য কিছ আলোর রেখা সোজাসুজি কুবেরের মাঠে পাঠিয়েছে। তাতে চারদিক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে আলাদা চেহারা পেয়ে বসে আছে।
ঠিক এই সময় আভাকে দেখা গেল। বড় নদীর মাছমারারা বিদঘুটে মাছ পেলে যেখানটায় ছাল ছাড়িয়ে শুকোতে দিয়ে যায়—সেই দূরের তীর থেকে মেয়েমানুষটা উঠে আসছে। অদ্ভুত এক অভ্যেস। মুখ ফেরানোর জন্যে ভেসে আসা মাছের খোঁজে প্রায়ই দূর দূর জায়গায় চলে যায়। খানিক পরে কুবের দেখল-নদী, দুর্গের অতিকায় কাঠামোটা পেছনে ফেলে একখানা খুব সুখী মুখ নিয়ে আভা এগিয়ে আসছে। হাঁটাচলা, হাসিতে কোন চিন্তা নেই।
অসুখ থেকে উঠলে লোকে ঠিক এমন খিটখিটে মেজাজ, নড়বড়ে পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে—অপেক্ষা করে। রাগবার চেষ্টা করে দেখল, হচ্ছে না। তাই কুবের কোন একটা কিছু ধরে বসবার চেষ্টা করল।