কুবেরের বিষয় আশয় – ৩০

॥ ত্ৰিশ ॥

সৃষ্টিধর, কুসুম দেবেন্দ্রলালের সঙ্গে বারান্দায় বসেও কম মজা হচ্ছিল না কুবেরের। নিজের লোকজনের মধ্যে মন কত ফ্রি থাকে। কুবের এখন ভাল পার্টনার পেলে নেট টানিয়ে বিপদ নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে পারে। বাইরে হাওয়া দিচ্ছিল। গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে কুবেরের একবারও মনে পড়ল না, বেশ পরিশ্রম করে একজন মেয়েলোককে তার মাটি চাপা দিয়ে আসতে হয়েছে। ভাল ঘুম, বিশ্রাম হওয়ায় কুবেরের মাথার মধ্যে যেসব দেওয়াল এলোপাথাড়ি পড়ে ছিল—সেগুলো সরানোর চেষ্টাই তার মধ্যে কাজ করেনি। কুসুম কোলে বসল, পাশে সৃষ্টিধর। সামনের সিটে দেবেন্দ্রলাল। গাড়ি স্টার্ট নেবার আগে কুবেরই বেঁকে বসল, সন্ধ্যে হয়ে গেল। এখন আর কোথায় যাব।’

কুসুম কিছুতেই রাজী নয়। দেবেন্দ্রলাল তাকে বোঝালো, ‘বাবার শরীর খারাপ। চল আমরা দিঘির শানে গিয়ে বসি।’

সৃষ্টিধর রাজী হয়ে গেল। পুকুরে সব সময় তার একখানা হাতছিপ ভেজানো থাকে। একবার ছোট একটা মৃগেল আপনা-আপনি ধরা দিয়েছিল।

চারজনে গিয়ে দিঘির ধারে বসল।

.

তখন সেখান থেকে বেশ দূরে, তেলখোঁড়ায় আড্ডাকে অনেক পেছনে ফেলে, লোকালয়ের একেবারে বাইরে একটা মাঠের মধ্যে সাহেব বসে ছিল। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ঝড় উঠে প্রকাণ্ড মাঠের খড়কুটো চুমুক দিয়ে শূন্যে তুলে দিচ্ছে। বুলু দেখল, দূরে হাইওয়ের ওপর দাঁড় করানো গাড়িটা ধুলোর আড়ালে পড়ে গেল।

‘চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ফিরে যাব।’

‘এই কথা বলার জন্যে আমায় এত দূরে নিয়ে আসার কি দরকার ছিল! কোয়ার্টারেই বললে পারতে।’

‘শেষবারের মতো আসতে বলেছিলে। তাই এলাম। আমার সঙ্গে থাকতে পেলে, তুমি নাকি বর্তে যাও। তাই এতটা পথ আগাগোড়া তোমাকে সঙ্গ দিলাম সাহেব। এর পরে আর তোমার কিছু বলার থাকে না—

‘তা সত্যি! তুমি যাও। আমি ঠিক যেতে পারব।’

‘পাগল হয়েছ। এতটা পথ এই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যাবে কি করে?’

‘এতদিন তুমি ছিলে না। একা একা এগোলাম কি করে! তুমি যাও। এতদিন পরে কুবেরবাবু ফিরেছেন—’

কথাগুলো বলতে সাহেবের একটুও কষ্ট হচ্ছিল না। এমন একটা পরিণতির জন্যে সে শুরু থেকেই তৈরী ছিল। সামনে দাঁড়ানো বুলুর দু’পায়ের নখ পরিষ্কার গোল করে কাটা। স্থির, ধবধবে সাদা দাগ পড়েনি কোথাও। ম্যাগাজিনে দেব—দেবীর এরকম ছবি থাকে। বুলু তার মাথায় হাত রাখল।

সাহেব জানে তার এই অঙ্কের কোনও ভাগফল, ভাগশেষ নেই।

বুলুর আঁচল উড়ে উড়ে দু’-একবার তার মুখে, মাথায় পড়ছিল। সাহেব পড়তে দিচ্ছিল। এই শেষ স্পর্শ। বাতাসে সিগারেট ধরানো অসম্ভব। এখন সে খানিকক্ষণ একা থাকতে চায়। মাথার ওপরে আকাশ, নীচে এতবড় একটা প্রান্তর—মাঝখানে শুধু সে একা—এসব জায়গাতেই নিজেকে পরিষ্কার দেখা যায়, চেনা যায়।

বুলু হাইওয়ের দিকে এগোচ্ছে একা একা। সাহেব বসে বসেই দেখল, এই যাওয়াটা কত দীর্ঘ। এতদূর থেকে কোন শব্দ পাওয়া যায় না। একসময় গাড়িটা স্টাট নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল।

প্রতিপদের চাঁদ একটু লাল হয়ে ওঠে। পরে আসল রঙ বেরোয়। ঘাটের ঢালাই বেঞ্চে বসে কুবের সৃষ্টিধর আর কুসুমকে দেখছিল। কুসুমের নানা নালিশ আছে। সৃষ্টিধরের কোন নালিশ নেই। এই মাঠ ঘাট সে নিজের করে নিয়েছে। কদমগাছ দুটো নতুন পাতা ছেড়েছে। এবার বর্ষা পেলে হয়তো ফুল দিতে পারে।

দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘তোদের বাবাকে দু’টি খেয়ে নিতে দে।’

কুবের দেখল, তার বাবা নিজেই খানিক ছানার জল নিয়ে এসেছে। কাটা পেঁপে ছিল ফ্রিজে। প্লেটে ঢেলে তাতে চামচ গুঁজে দিয়ে তাও নিয়ে এসেছে। অনেক দিন পরে ছেলেমানুষ হয়ে গিয়ে কুবেরের কাঁদতে ইচ্ছে হল।

খেয়ে প্লেট নিজেই রাখতে গিয়েছিল কুবের। ফেরার সময় দেখর, তার নামের রাস্তা দিয়ে একটা মোটর হেডলাইট জ্বালিয়ে টলতে টলতে ফিরে আসছে। বেচাল হলেই গাড়িটা খালে গিয়ে পড়তে পারে। ব্রেক কষে গাড়িটা থামাতেই হেডলাইট নিবে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে কুবেরের মনে পড়ল, ‘কালই ‘ডাহুকে’র সার্চলাইটের কার্বন পাল্টে সারেঙ কলকাতা থেকে ফিরবে। তাকে ডাকতে আসবে। মেদনমল্ল দ্বীপে তার যে কত কাজ পড়ে আছে! কামলারা আভাকে দেখতে না পেয়ে খোঁজ শুরু করেনি তো! কুবের ঘাটে যেতে পারল না। সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। সৃষ্টিধর, কুসুম ঘাটে খেলছে। দেবেন্দ্রলাল বাঁধানো বেঞ্চে আরামে ঠেস দিল। গাড়ির দরজা খুলে বুল অনেকটা এগিয়ে এসেছে। গোয়ালে গরুদের পা ঠোকার শব্দ। এই ভরাট সংসারের মাঝে সে কেউ না। সে আসলে দাগী নম্বরী লোক। আবার ক্লাস থ্রি থেকে জীবন শুরু হয় না! কুবের রোডের পাতলা ধুলো-মাখানো জ্যোৎস্নায় জগৎসংসার নতুন হয়ে গেল। শুধু তারই আর পালটাবার কোন রাস্তা নেই। এর চেয়ে দ্বীপে থেকে গেলে ভাল হতো। আভা বলেছিল, আমরা ডাঙায় থেকে যাই না কেন। তখন সেসব কথায় একদম কান দেয়নি কুবের। আজ যদি ভদ্রেশ্বরও কাছে থাকত!

এখন কেউ আভার খোঁজ নিলে কি বলব?

‘সবাই ঘাটে বসে। তুমি এখানে? খেয়েছ?’

খুব খানিক হেসে ফেলল কুবের, ‘তোমার জন্যে বসে আছি—’

বক্স বসানো বারান্দার এই সরু পথে আলো কিছু কম। বুলু সেখানে কুবেরের মুখোমুখি কিছুতেই দাঁড়াতে পারল না।

কুবেরকে নিয়ে একসময় দেবেন্দ্রলালের খুব চিন্তা ছিল। কি করে ছেলেটা শেষ পর্যন্ত। তারপর আস্তে আস্তে নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেছিল। ছেলের চারদিকে ভরভরাটি অবস্থা। এই কথাটা ভেবে বাবা হয়ে দেবেন্দ্রলাল মশগুল ছিল। কিন্তু কদমপুরে এসে ইস্তক কুবেরের জন্যে তার চিন্তাভাবনা ডবল বেড়েছে। সব কিছু এখানে আগোছালো। এত যে ধান উঠবে তার গোলা কোথায়? গরুদের গুড়ের বস্তায় সব সময় পিঁপড়ের সারি। কুবের ফিরে আসতে মন নেচে উঠেছিল। আবার গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেছে দেবেন্দ্রলাল। এত দিন পরে ছেলে ফিরল। বুলু সারা দিন উধাও।

কুবেরের পাশ দিয়ে বুলু ওপরে উঠে গেল। ফিতে-জড়ানো লম্বা বেণীটা হাল্কা করা দরকার।

কুবের জামাকাপড় না ছেড়েই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সারা দিনের ঘুমোনো হাল্কা শরীর নিয়ে জল কেটে বেরিয়ে যেতে গেল। দোতলার ঘরে আয়নায় দাঁড়িয়ে বুলুর বেণী ভাঙা হল না। ঝুলবারান্দায় এসে চুপ করে পুকুরে কুবেরের দাপাদাপি দেখতে লাগল।

পাঞ্জাবির পকেট, পেটে জল নিয়ে কুবের একটা ধাপে বসে গেল। এক পাটি পাম্পশু পা থেকে তলিয়ে গেছে। ধুতির কোঁচা জড়িয়ে এই কাণ্ড।

কুসুম মানুষটি ছোট। কিন্তু কাজ পেলে তাকে থামানো কঠিন। নিঃশব্দে ওপরে এসে বাবার আলনা থেকে তোয়ালে, পাজামা নিয়ে নীচে নেমে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। তখন বুলু দেখতে পেল। আজই এই মেয়েটাকে কোলে পেয়ে বেলুন ফোটানোর কায়দায় কুবের চেপে ধরেছিল। অনেক ভেবেও এসবের কোন মানে পেল না বুলু।

খাবার টেবিলে বুলু একখানা মাজাঘষা কুবেরকে পেল। ঘুমিয়ে চোখ দুটো কিছু ফোলা ফোলা। আর কপালের খানিক জায়গা কালচে দাগে ঢাকা পড়েছে। এসব কোত্থেকে পেল লোকটা?

এত দিন তাড়াতাড়িতে সব কিছু সেরে ফেলার অভ্যেস হয়ে গেছে কুবেরের। তাই দেবেন্দ্রলাল যখন মাঝামাঝি, কুবেরের খাওয়া শেষ। কুসুম অনেক দিন পরে বাবাকে দিয়ে মাছ বেছে নিচ্ছিল। পুরো ব্যাপারটাই ছবি তুলে রাখার মতো।

‘অবেলায় চান করলে? গা ব্যথা হবে না?’

কুবের জবাব দিতে গিয়ে আনাড়ী হয়ে গেল। ঠোঁট ফাঁক হয়ে গিয়ে গাড়লের হাসিতে তার মুখ ভরে গেল। আয়না নেই। তবু এসব দেখতে পায় কুবের, ‘এই পরিষ্কার হয়ে নিলাম। তুমিও চান করতে পারতে—’

‘আমি চান এই বেরিয়েছি।’

‘মাথাটা এমন শুকনো?’

‘বাইরের বাতাসে, ধুলোয়—‘

খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে বসল। এই আসরে একজন আজ অ্যাবসেন্ট—বাঘা। রোজ এই সময়ে সে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়ত। আগাগোড়া একটা কৃতজ্ঞতার ছবি! জিভ বের করে হাঁপাতো।

বাঘার কথায় ছেলে-বউকে ডুবে যেতে দেখে, দেবেন্দ্রলাল উঠল। পেছন পেছন সৃষ্টিধর, কুসুম। ‘বালুচ’ জাহাজের কাকের সমুদ্রযাত্রা শুনতে শুনতে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল দু’জন। দেবেন্দ্রলালকে এখন সেই গল্প শেষ করতে হবে।

খেতে বসার লবি থেকে এই বারান্দাটুকু বেরিয়ে গিয়ে একেবারে আকাশের নীচে ঝুলছে। গ্ল্যানে ছিল না। বাড়ি তৈরির সময় ফালি বারান্দাটুকু বুলুর মাথা দিয়ে বেরোয়। এখানে দাঁড়ালে কুবের বুঝতে পারে সারা বাড়ির জায়গানটিক স্ট্রাকচারের মাঝে এই জায়গাটুকু রিলিফ। কথাটা বোধহয় কোন ইঞ্জিনীয়ার বন্ধুই বলেছিল। কত লোকের কথা আজকাল নিজের বলে মনে হয় কুবেরের।

বহুকাল পরে একেবারে পায়ের কাছে বুলু পানের বাটা নিয়ে বসল। একটু বেশী রাতের জ্যোৎস্নায় কোন ছায়া পাওয়া গেল না। মাথার ওপরের চাঁদকে ঘিরে চন্দ্রসভার লালচে গোল। মাথার ঘোমটা টেনে কুবেরের খুব ফেবারিট পোজে বুলু পান এগিয়ে দিল। পান মুখে দিয়ে কুবের বুলুর হাত চেপে ধরল, ‘মোটা হয়ে গেছ!’

‘তুমিও বদলে যাচ্ছ। কি সব দাগে দাগে একেবারে কালচে হয়ে গেছ।’

‘ও হবেই জানতাম। আমার কোন হাত নেই বুলু। আমি থামাতে পারিনি।’

কুবেরের সব কথার মানে পায় না বুলু। তবু আন্দাজে বললো, ‘তাই বলে এমন দাগে ভরে যাবে?’

কুবের কেঁপে উঠল। ফস্ করে মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আমি দাগী লোক বুলু। নম্বরী মানুষ!’ এইবার কুবের দম নিয়ে বলতে যাচ্ছিল, একটা স্যাড ঘটনায়—এক্সপিরিয়েন্স বলতে পার বুলু-বলা হল না। বুলু খুব কাছে মুখ এনে তারই কাঁধে চিবুক সুদ্ধ মাথার ভার রাখল। একেবারে একটা জ্যান্ত লোক বুকের ওঠানামা সুদ্ধ তার গায়ে লেপটে গেল। কুবের আর নড়তে পারল না।

আমি অত সব বুঝিনে। তোমার কি হয়েছে কুবের?

বিয়ের কত কাল পরে নাম ধরে ডাকল বুলু। কুবের তখন আন্দাজ নিচ্ছিল, কত হিসেব করে মেয়েলোকের শরীরে হাড় মাংস বসানো থাকে। এই হল সময়—এখনই সেই ঘটনা—স্যাড, এক্সপিরিয়েন্সের কথা বলে দেবে।

‘কি হয়েছে তোমার। আমাকে বল ওগো।’

‘আমি নিজেই ধরতে পারিনে বুলু—। ভাল কথা! কি মানত ছিল তোমার?’

‘মানত?’

‘তা-ই হল! মানসিক! ভগবানকে কি বললে আমার জন্যে—

বুলু সাবধান হয়ে গেল। আজই দুপুরে শিবতলায় যাবার নামে বেরিয়েছিল। সব মনে পড়ে গেল একসঙ্গে। তারপর খুব আস্তে বললো, ‘শিব কোথায় যে মানত করব।’

‘কিরকম?’

‘রেলেশ্বর শিব তো অনেক দিন উধাও। বাইরের কেউ জানে না সে কথা। তোমার ব্রজদা একেবারে কেঁচো হয়ে গিয়ে একবার এসেছিল—’

কুবের বসে বসেই জুড়িয়ে গেল। আর কিছু জানতে চাওয়ার ভরসা নেই তার। বুলু তখন নিজে নিজেই বলছে, ‘অথচ দেখ কালই স্বপ্নাদিষ্ট মন্দিরে শিব প্রতিষ্ঠা। দুধ ঢেলে চামরা দুলিয়ে রেলেশ্বরের অভিষেক হবে। কি সাহস ব্রজদার! একটুও ভাঙেনি। তুমি তো এদিককার কোন খবরই রাখ না। আরেকটা খবর শুনবে?’

কুবের মুখ তুলে তাকাতে পারল না। যেমন ছিল বসে থাকল।

‘তোমার আভা বউদি কবে কেটে পড়েছে—’

কুবের অনেক কষ্টে বললো, ‘তাই নাকি?’

‘একবার খোঁজও নিল না মানুষটার। মোহান্ত বনে গিয়ে তোমার ব্রজদা বলে—ফেরার সময় হলেই ফিরবে। লোকটা শিব শিব করেই গেল।’

কাঁধের হাড়ে চিবুকের ছুঁচলো জায়গাটুকু বসে গিয়ে রীতিমত ব্যথা করছিল। তবু কিছু বলতে পারল না কুবের। সামনের নতুন বাড়ি দুটোর চিলেকোঠাতেই আলো জ্বলছে। রেডিও থেমে গেছে কতক্ষণ। দিনের বেলার অর্ডিনারি গাছপালা এখন দিব্যি সেজেগুণে দাঁড়ানো।

বাঁধের ওপরে পাঁচ ঘোড়ার পাম্প কেউ সরাতে পারবে না। ভীষণ ওজন। কামলারা এতক্ষণে অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। তাঁবুর দড়িতে টানানো শাড়িটা কেউ কি আর তোলেনি! হাওয়ায় পেয়ারা পাতার শব্দে বাগান ভরে যাচ্ছে।

বুলু নিজে থেকেই মাথাটা তুললো। নিজের একটা ফিক্সড্ বউ থাকলে কত সুবিধে। মাথার ঘোমটা বুলু বড় একটা পাপড়ি করে খসিয়ে ফেলেছে। মুখখানা প্ৰায় ফুল হয়ে গন্ধ দিচ্ছিল। এই আস্ত মানুষটা তো তার—ভাবতেই কুবেরের সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। এমন করে একজন আরেকজনের মালিকানা চায় কেন? কোন মানে হয়!

‘তুমি কি বলে অমন ফুল ড্রেসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লে! পায়ের পাম্পসু ও খোলোনি—‘

‘এক পটি ডুবে গেল। ড্রেস রিহার্সেল দিচ্ছিলাম—‘

‘কিসের কুবের?’

‘আজ এতদিন পরে ঘন ঘন নাম ধরে ডাকছো যে—

সামনে আর কেউ নেই যে লজ্জা পাবে বুলু। কুবেরের চোখে লালচে রঙের তলানি এক দিকে কাত হয়ে ঠেলে উঠল। নীচে দেবেন্দ্রলালের গল্পের গলা অনেকক্ষণ থেমে গেছে।

‘আপত্তি আছে?’

‘তা কেন!’

‘তবে?’

পানের রসে গলা ভিজে ছিল। তাই খুব সহজেই কুবের বললো, ‘এত দিন ডাকোনি কেন! সে-ই ডাকলে! এত পরে!’

‘তাড়া কিসের? এরই মধ্যে সব ফুরিয়ে গেল!’

‘কোন জিনিস বসে থাকে না বুলু। আমাদের জন্যে কিছুই বসে থাকবে না—’ বুলু শক্ত করে কুবেরকে গোড়া থেকে ধরল, ‘কিসের মহলা দিচ্ছিলে? পায়ে কাপড় জড়িয়ে মাঝ-পুকুরে ডুবে যাবার।

‘যদি মনে কর—তাই। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সব সময় হয়ে ওঠে না বুলু।’

‘তেমন করে ইচ্ছে করোনি বল—’। আজই বিকেলে ঝড়ের মধ্যে মাঠের মধ্যে একটা লোককে ফেলে রেখে এসেছে বুলু। কুবের অবাক হয়ে গেল, একটু আগেও ঘোমটাখসানো বুলুর মাথা, মুখ আস্ত একটা ফুল হয়ে গন্ধ দিচ্ছিল। খুব দেখা যায় না—তেমন একটা সাদা ঘুঘু এসে লনে নেমেছে। ভেবেছে রাত শেষ হয়ে গেল বুঝি।

‘জানো বুলু—আমাদের এই বাড়ি তৈরি হয়েছে কদমপুর মৌজার হাল দু’হাজার তেইশ দাগে। জমি আছে চব্বিশ শতক। বোধহয় চৌদ্দ পনের কাঠা হবে। আজ এখানে এমন নতুন টাউনশিপের চেহারা দেখে আমারই অবাক লাগে। এই জায়গাটুকু ছিল কোটিরাম সরদারের। বুড়ো কাশীবাসী হওয়ার আগে নিজের চাকরের কাছে ষোল টাকায় জায়গাটুকু লিখে দেয়। সেখানে এখন আমরা—’

বুলু কিছু বুঝতে পারেনি। তার কাছে এসবের কোন উনিশ-বিশ নেই।

‘তোমার অবাক লাগে না? লোক কতবার হাতবদল করে এই জায়গায় ঘর বানায়, ধান করে। আবার টাইমের নীচে তলিয়ে যায়—চাপা পড়ে—’

‘ওসব আমার মাথায় আসে না। যা উচিত না—আমি চোখ বুজে তা ছেঁটে ফেলি। একটুও আটকায় না আমার। আমি বুঝি এ জায়গাটা তোমার বানানো তোমার হাতে তৈরী।’

‘তুমিও কম খাটোনি আমার সঙ্গে সঙ্গে। আমরা ক’বছর আগেও কত সিওর অ্যান্ড সিম্পিল ছিলাম। এখন আর সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে ভয় হয়।’

‘আজ তো দিব্যি জলে ঝাঁপ দিলে!’

‘সে তো সোজা।’

‘এবার এত ধান এনে রাখবে কোথায়? আমি বলি কি লঞ্চঘাটায় বেচে দিয়ে হালকা হও। আমাদের আর এত কিসের দরকার? এবার কিছুদিন চুপচাপ থাক। খাও দাও ঘুমোও।’ বুলু মেঝেতে বসে কুবেরের দু’খানা পা কোলে তুলে নিল।

‘অনেক হয়ে গেছে—তাই না।’

‘খাবে কে? তোমার বাড়ি এটা। এখানে এসে পাকাপাকি থাকো তুমি। কুসুম তো তোমাকে চেনেই না প্ৰায়—

‘রোজ কত জিনিস জমে যাচ্ছে দেখ। চোখের সামনে থেকে স্টেডিয়ামের গোল ঢালাই ভিতটা উপড়ে ফেলতে পার? একদিন আমরা যে কোথায় চাপা পড়ে যাব।’

‘ও কি অলক্ষণে কথা। তুমি আর কত জিনিস বানাবে—‘

‘এসব কিছুই যদি আর না থাকে? তুমি তখনও পারবে?’ কুবেরের গলার আওয়াজ কিছু বেশী ভারী হয়ে ওঠার ঘুঘুটা উড়ে গেল। জোৎস্না ফুঁড়ে একটা কালো দলা আবছা জায়গায় চলে গেল।

‘তুমি কি বলছ? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনে—’

‘আমি ডুবেছি বুলু। চাষবাসে ডুবেছি আমি। ভরাডুবি।’

‘এই যে আজই বললে একদম পোকা লাগেনি। আগাগোড়া জল ছিল। তুমি কি বলছ! ঠাট্টা করছ বল!’ আবার বুলুর শুকনো মুখে হাসি ফিরে এল।

এখন আর উপায় নেই। কুবেরের একেবারে নিজের ভেতরসুদ্ধ ভয়ে কেঁপে উঠল। আমি কুবের সাধুখাঁ, আজ চার পাঁচ বছর শুধুই জিতে আসছি। আমার গা বেঁধে টাকা আসে। ভোরবেলা দরজা খুলে শেষরাতে ঝরে-পড়া নোটের গোছা সরিয়ে দিয়ে রাস্তা করে নিতে হয়—তারপর আমি কাজে বেরোই। এই ছবিটাই বুলু জানে। এই ব্যাপারটাই ওর কাছে নরমাল। যা আমি অসুখ বলে জানি-ওর কাছে তা সুখ। আমি সেরে উঠছি সবে। ঠিক তখনই এই ক’বছরের জানা ছবিটা বুলুর চোখের সামনে দুলে উঠল।

কুবের দেখল, আর পিছোনো যায় না, ‘না বুলু। ঠাট্টা নয়। ঝড় উঠে ধানে দুধ আসার মুখে মুখে হাজার বিঘের ওপর মাঠে সব ফুল ঝরে গেছে—’

‘তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে?’

‘কি করব? জল হচ্ছিল। একনাগাড়ে। অন্ধকার। আটকাতে পারিনি বুলু।‘

পা টিপতে টিপতে বুলুর হাত এক জায়গায় এসে থেমে আছে।

‘শুধু এই জন্যে তুমি এত দিন হাড় কালি করে খাটলে?’

‘কি করব? একা একটা দ্বীপে—শুধু আমি—’, তারপরই কুবের বললো, ‘কেন? আগের মত তুমি আবার চালিয়ে নিতে পারবে না? বেশ ছিলাম তখন—’

‘বাড়ি ফিরেই নিজের বউকে আসল কথাটা বলতে পারলে না?’

তুমি কিভাবে নেবে আমি জানতাম না। ভয় ছিল—’

‘নিজের লোককে জান না। বউকে জান না।’ গলা কাটা ঘোমটাটা বুলুর পিঠের ওপর একদম খসে পড়ল। কুবের তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। যে-কোন একরকমের হাওয়ার জন্যে বসে থেকে থেকে গাছপালাগুলো স্থির। একটু পরেই আচমকা দুলে উঠবে, ‘তোমার কি জানি না আমি বুলু? কোনটুকু জানি না? সত্যি করে বল। দেখ আমি হেরে গেছি—’

মাথার ওপর থেকে কোন মূর্তি এইমাত্র কথা বলে উঠল। কেননা, বাইরের জ্যোৎস্না এত দূরে এসে পা বেয়ে বেয়ে কুবেরের বুক ছাড়িয়ে আর উঠতে পারেনি। সেখানকার অন্ধকার থেকে কেউ কথা বললেই বোঝা যায়—কবন্ধ গলার স্বর ফিরে পেল। বুলু তাই মন দিয়ে কুবেরের পায়ের পাতা, হাঁটু দেখছিল। বসে থাকতে থাকতেই ওপরের ছন্ন দেওয়া আবছা মানুষটাকেও দেখল। একদিন কালো স্যান্ডেলে এই ফরসা পা দু’খানা কত ঝকঝকে ছিল। পরিষ্কার দেখা যায়—কালচে সব ছোপ ছোপ দাগ পা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। একেবারে আস্তরণ—চেঁছে তুলে ফেলতে যাওয়াও ভুল হবে।

কুবের দু’হাতে হ্যাঁচকা টানে বুলুকে সিধে দাঁড় করিয়ে দিল, ‘তুমিই বল—আমি কি জানি না তোমার?’

এমন কঠিন করে কেউ টানে! ব্যথা পেলে বুলু চুপ করে কাঁদতে শিখেছে অনেক দিন।

‘আমি কোন দিক তাকাইনি বুলু। আরও কত নিরাপদে রাখা যায় তোমাদের—শুধু তাই দেখে গেছি। বাইরে সময়টা কত খারাপ–তোমাদের একদম জানতে দিইনি। গত ক’বছর শুধু রিস্কের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে জল খেয়ে কোনরকমে পাড়ে এসে উঠেছি। একা একা আড়াল বানাচ্ছিলাম। তার পেছনে তোমাদের, নগেন বীরেন ওদের সবাইকে আনতে চেয়েছি। আসলে এত দিনেও কেউ আসেনি। সত্যি বল—তাই না! আসলে এত করেও, ভালো করে দ্যাখো—আমার মাথার ওপরেও কোন শেড় নেই!’

কান্না কোথায়! এই মানুষটার সামনে বুলুর চোখে জল, মুখে হাসি এক এক সময় এমন শুকিয়ে যায়! চলন্ত ট্রেনের জানালাতেও দূরের পাহাড়কে এতটা আবছা লাগে না তখন।

‘শুধু মা কোনও লুকোচুরি করেনি বুলু। তোমার যদি তাকে কোন দিনও খারাপ লেগে থাকে-অন্তত আজ আর সে কথা তুলো না। মাই আরনেস্ট রিকোয়েস্ট। একেবারে অঙ্ক কষে হিসেব করে টাইম ঠিক করে চলে গেছেন ভদ্রমহিলা। পালং বুনবে বলে এক কাঠা জায়গা চেয়েছিল। আমার কাছে! ড্রিম মারচেন্ট কুবের সাধুখার কাছে!’

তুমি এত খেটে ধান করলে—অথচ ধান পাবে না। এ ক’মাসে কত কালো হয়ে গেলে—

‘একদম কালোয় ঢেকে যাব। কিছু বাকি থাকবে না। আর’, এখানে একদম থেমে গেল কুবের, তারপর বুলুর দু’খানা কাঁধ ধরে ফেলে মুখোমুখি দাঁড়াল, ‘আমার দিকে তাকাও—আমার শুধু একটা কথাই তুমি জানো না। অনেকবার বলতে চেয়েছি—বলা হয়নি—’

বুলু টের পেল সায়ার দড়ির নীচে নাইকুণ্ডলী থেকে শিষ তুলে তার মাথার অবধি এক চুমুকে কে ফাঁকা করে দিল। কুবের তার কোটুকু—কোন্ জায়গাটুকু জানতে চায়। আমি আগাগোড়াই তোমার—সাহেব মিত্তির একটা অজানা লোক ঠিকই—এবং কিন্তু তাকে ভালোই লাগে। কত একাগ্র—শুধু কাছে থাকতে চায়।

‘আমার গায়ের রক্ত ভাল না। দোষে ধরেছে অনেক দিন। রোজ শ্যাওলা পড়ছে—শ্যাওলায় ঢেকে যাচ্ছি। আর বিশেষ বাকি নেই—আর কোন নিস্তার নেই বুলু।

সারাটা সন্ধ্যে ধরেই হাসিটা যেন গলার এক জায়গায় রাখা ছিল। একটু হাঁ করে এই মাঝরাতে বুলু তা শুধু গড়িয়ে দিল। ব্রিজে ট্রেন উঠলেও সারাটা তল্লাট এমন কেঁপে উঠত না। নিজের হাসি—বুলু তবু থামাতেই পারছে না। ঝুলবারান্দা উপচে তা মাঠে পড়ল। তখন তা প্রায় হাত দিয়ে ধরা যায়। হাসির দমকে কাশতে কাশতেই বুলু বললো, ‘ওঃ! এই কথা! ভেবেছিলাম না-জানি কি নতুন কথা বলবে! এ তো আমি কবেই জানি

‘একটা স্যাড ঘটনায়—এক্সপিরিয়েন্স বলতে পার বুলু—কতই বা বয়স আমার তখন—’

‘হয়েছে, হয়েছে—থামো এবার—’

‘আমাকে বলতে দাও বুলু—’, নিজের গলার আওয়াজে সারাটা লবি গমগম করে উঠতেই কুবের মিইয়ে গেল, ‘তুমি জানতে?’

বুলু মাথা নাড়ল।

‘কি জানতে?’

‘সব জানি।’ তারপর থেমে গিয়ে বললো, ‘অ্যাকচুয়াল ফ্যাক্ট কি হয়েছিল জানি না। তবে কোনদিন ওরকম একটা দারুণ বিপদে যে পড়েছিলে—তা আমি কবে জানি!’

কুবের আবার দু’খানা হাতই বুলুর কাঁধে রাখল। বরং বলা ভাল–দু’খানা থাবা। ‘কি হয়েছিল বল তো—’

‘বাঃ! কি করে বলব। তবে মেয়েঘটিত কিছু একটা নিশ্চয়—’ কুবেরের দিকে তাকিয়ে বুলু শেষে সায় পাবার জন্যে বললো, ‘কি? ঠিক বলেছি—?’

এত সুন্দর মুখ, এমন ভরাট জ্যোৎস্না—তার মধ্যে অনেক দিন পরে কুবের বুলুর মুখে একটা অশ্লীল কথা শুনলো—মেয়েঘটিত।

‘শেষ অবধি ট্রিটমেন্ট করিয়েছিলে—’

কুবের একেবারে চুপ করে থাকল। ট্রিটমেন্টের বদলে বুলু ভাগ্যিস ‘চিকিচ্ছে ‘ বলেনি।

‘তুমি এত সব জানলে কোত্থেকে?’ বলতে বলতে কুবের পরিষ্কার দেখল, আগের ঘুঘুটা একটা সঙ্গী জুটিয়ে নিয়ে ফিরল। শুধু ভরদুপুর বেলাই এমন পরিষ্কার আর নির্জন লাগে এখানে।

‘চিলেকোঠার তাকে দেখে এস। তোমার পুরনো কাগজপত্তর গুছিয়ে ওখানে রেখে দিয়েছি। ক্লিনিকে গুচ্ছের ব্লাড রিপোর্ট পড়ে আছে। অন্তত দশখানা পুরনো খামের ওপর তোমার নাম লেখা। আচ্ছা, কত টাকা দিয়েছ ডাক্তারদের শুধু শুধু বল তো? মেয়েমানুষ হয়ে আমি যা বুঝি তা তোমার মাথায় আসে না।’

কুবের এইমাত্র তার নাকের ওপর একটা ঘুষি খেলেও এতটা হকচকিয়ে যেত না। রিপোর্টগুলো বুলুর হাতে পড়েছিল বলে চমকায়নি। এমন কিছু একটা কুবেরের হয়েছিল—অনেক দিন জানে বুলু—জেনে চুপ করে ছিল—তাতেও কিচ্ছু না। কিন্তু এমন একটা অসুখকে আমলেই আনেনি? এ তো ম্যালেরিয়া না।

‘আমার পুঁজ পড়ত—’

‘ভালো কথা। আর তো পড়ে না?’

কুবের ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল, ‘নাঃ!’

‘একটা জিনিস মাথায় আসেনি তোমার! এমন ফুটফুটে দু’টো ছেলেমেয়ে যার-তার বাবার অসুখ কিসের?’

কুবেরের মাথাটা ঘাড়ের কাছে ভাঁজ খুলে গিয়ে বুকের ওপর ঝুলে পড়ল—তখন বিড়বিড় করে যা বললো, তা বুলু ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।

‘আমি রোজ কালচে শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছি।’

‘স্কিন ডিজিজ হয়ে থাকবে। ডাক্তার দেখাও। ট্যাবলেট খাও।’

কুবের আর ঘাঁটালো না বুলুকে। লাভ নেই কোনও। শুধু বললো, ‘অনেক সময় পুরনো অসুখ ব্লাড রিপোর্টেও ধরা পড়ে না।’

আর যা বললো না, তা হল—কদমপুরে গোড়ার দিকে হেলথ সেন্টারের বিমল ডাক্তার বলেছিল—অসুখ পুরনো হলে গাঁটে গাঁটে কালচে ছোপ ধরতে থাকে।

তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে ভালবাস বুলু। তাই থাকো। আমার অসুখের সময় ভাল ওষুধ বেরোয়নি। মফস্বলের এল.এম.এফ্ফ্‌. কোন্ গোঁজামিল দিয়ে রেখেছে সেদিন—কেউ বলতে পারে না। যত দিন বাঁচবো, এই ভযে ভয়েই আমাকে থাকতে হবে। কুবের চীৎকার করে উঠে দাঁড়াল, ‘আমি সব ভুলে যাচ্ছি। কিচ্ছু মনে রাখা যাচ্ছে না।’

বুলু খুব আস্তে বললো, ‘তুমি নীরোগ।’

কুবের ততক্ষণে লবি পেরিয়ে নীচে নামার সিঁড়ি ধরে ফেলেছে।

‘কোথায় যাচ্ছ?’

কুবের ঘুরে দাঁড়াল। কোন্ জন্মে এই মেয়েলোকটির সঙ্গে জানাচেনা ছিল? নিশ্চয়ই কোথাও ছিল। বুলু এগিয়ে আসছে, মাথায় আবার ঘোমটা তুলে নিয়েছে, ‘এই রাতে এমন আনতাবাড়ি ছুটে কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও। কুবের—

তখনই কুবেরের মাথার মধ্যে সবচেয়ে আগে এই ঘোরানো সিঁড়িটাই ভাঁজ খুলে ফেলে এলোপাথাড়ি পড়ে গেল। চোখের সামনের মেয়েলোকটি কাত হয়ে গেল। ভীষণ চেনা মুখ। দারুণ সুখে টলমলে মুখের ওপর ভরাট একখানা হাসি পড়ে আছে। এত ভাঙাচোরা দেওয়ালের এদিক ওদিক ছড়াছড়ি, সাতটা ধাপ সুদ্ধ এক প্যাঁচ সিঁড়ি সিধে আকাশে উঠে গেছে—তার মধ্যে মেয়েলোকটির মোটা ভাঙা বেণীর খাঁজে খাঁজে বুনো লাল ফুল একটাও নষ্ট হয়নি, একটুও থেঁতলে যায়নি—শুধু বেণীটাই ফুলে ফেঁপে বেশ ঢোল হয়ে গেছে।

যতটা নেমেছিল প্রায় ততটা উঠে এসেই কুবের লবির গোড়ায় জ্যোৎস্নার সীমানায় দাঁড়ানো মেয়েলোকটির মুখোমুখি গিয়ে একেবারে রুখে দাঁড়াল, ‘আকন্দর শেকড় খুব কুটকুট করে।

বাইরেটা ফাঁকা চৌবাচ্চার চেয়েও এখন নিঃশব্দ।

‘এসব কি বলছ ওগো! শোনো—‘

‘আমি আর পারব না। সব ভুলে যাচ্ছি।’

বুলু এবার আর কুবেরকে ফেরাতে পারল না। তখন সিঁড়ি শেষ করে ফেলেছে কুবের। নিজের বাড়ি। কিন্তু এখন কোন্ দিক দিয়ে হাওয়া নয়তো জলের ধারায় বয়ে গিয়ে একেবারে সিধে বাইরের মাঠে জ্যোৎস্নার আলোয় গিয়ে পড়া যায়। তখনই দেখল, কুবের এ বাড়ির দেওয়াল, দরজা কিছুই চেনে না। সামনের বড় ঘরের খোলা দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঠের দিকে ঘরের খোলা জানলার বাইরে এক চৌকো জ্যোৎস্না ঝকমক করে জ্বলছে। তার ওপর গ্রিলের তারা-ফোটানো নকশার কয়েকটা কালো লাইন। ঘরের ভেতরে তিন প্রাণী শুয়ে। তার পাশে প্রায় দুধের বোতলের সাইজের মানুষের দু’টো বাচ্চা পর পর শোয়ানো। কাউকে মনে করতে পারল না কুবের।

ততক্ষণে বুলু তাকে ধরে ফেলল, ‘এভাবে কোথায় যাচ্ছ? নাম ডোবাবে সবার! তুমি কুবের সাধুখাঁ। চিনতে পারলে কি বলবে লোকে—’, দেবেন্দ্রলালের ঘুম যাতে না ভাঙ্গে সেজন্যে বুলুর চেপে চেপে বলতে হচ্ছিল। এরকম কুবেরকে সে দেখেনি কোনও দিন। কান্নায় কোনও শব্দ নেই বলে একটুও চাপতে হয়নি, সেই একটা সুবিধে বুলুর।

কুবের ফিনকি দিয়ে মাঠে গিয়ে পড়ল। প্রথম চোটেই আছাড়। অথচ একটুও ব্যথা লাগল না। সারাটা শরীর একেবারে ফুরফুরে হয়ে আছে। বেশী দূর দৌড়তে পারল না। নিশুতি রাতে পাতলা বাতাসে বাতাসে গাছপালা দুলতে শুরু করেছে সব। গয়লাদের একটা মোষ এমন পরিষ্কার আলোয় একেবারে একা মাঠের দিক থেকে মসমস করে ঘাস খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। কুবেরের কাছে পৌঁছতে রাত কাবার হয়ে যাবে।

একেবারে সামনেই তালগাছের সারির মধ্যে দেড়তলা অবধি নেমে পড়ে চাঁদটা ঝুলে আছে। কয়েক পা এগিয়ে চাঁদের ঠিক নীচে গিয়ে দাঁড়াল কুবের। সত্যি, এত দিনকার হলদে চাঁদ আগাগোড়া নীল মাখনে মাখানো। এদিক ওদিক তাকালো কুবের। হাতের কাছে দমকলের একটা মই থাকলে তড়তড় করে বেয়ে ওপরে উঠে যেত। আঙুল বসিয়ে দেখত চাঁদের গায়ে কতটা পুরু করে মাখনের কোটিং। চাঁদ হলদে। কি ভুলই না জানতাম এতদিন।

কুবেরের পায়ের ওপর দিয়ে একটা ভিজে রুপোলী দড়ি খুব আস্তে আস্তে পার হচ্ছিল তখন। নীচে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল।

তারপর সাপটা কয়েক হাত এগিয়ে যেতেই কুবের বুক ফাটিয়ে চীৎকার করে ডাকল, ‘নগেন —আয়।’

এদিকে বিশেষ ঘরবাড়ি নেই। কোথাও কোনও ধাক্কা খেতে না পেরে মাঠের মাঝামাঝি শব্দটা ফুরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *