কুবেরের বিষয় আশয় – ৩

॥ তিন ॥

চুটিরামের জমি কিনতে গিয়ে শুধু হেনস্তাই হল। বুড়োর জমি বিক্রি খুবই দরকার। কিন্ত লোভ সামলাবার ক্ষমতা নেই। মোট দু’বিঘের মধ্যে প্রায় সবটাই ভাইপোদের। নিজের অংশে আঠারো শতক-দশ কাঠা চৌদ্দ ছটাক। সাড়ে তিনশো করে কাঠা ঠিক হল।

মাস মাস মাইনে থেকে যদি জমিয়ে আসত কিছু কিছু। কেউ যদি ধার দিত চার হাজার টাকা—কুবের তাকে কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করে দিত। প্রভিডেন্ড ফাণ্ডে খোঁজ নিয়ে জানলো সাত বছর চাকরি না হলে ওখানে হাত দেওয়ার জো নেই। কোথায় পাওয়া যায়। সামান্য হাজার চারেক টাকা হলে স্টেশনের ধারাধারি জায়গাটুকু আটকানো যেত। ক’কামরার বাড়ি হবে কুবের তা ভেবেও ঠিক করতে পারে না। তবে, বাড়ির সামনে খানিক ফাঁকা জায়গা থাকবে। সেখানে গরমের দিনে বিকেলে বেতের চেয়ার পেতে বসে বাসি খবরের কাগজ পড়া যাবে।

আত্মীয়ের ভেতর একজনকে টেলিফোনে বললো সব। মাসে মাসে একশো করে ফেরত দেবে কষ্টেসৃষ্টে। সব শুনে তিনি ফোনেই বললেন, তার আগাগোড়া ওভার ড্রাফটে মোড়া। রাসেল স্ট্রীটের বাড়িখানা নাইন পারসেন্ট লোনে তৈরি। দশ বছর হয়ে গেল আজও আসলের অর্ধেক শোধ হয়নি। এদিকে ডায়েবেটিস—কবে আছেন কবে নেই তার ঠিক কি!

অতএব ধনরাজ শরণং। ওয়েলফেয়ার অফিসার হলেও কোম্পানির নানা কাণ্ডে জড়ানো ধনরাজকে অনেক টাকা নাড়াচাড়া করতে হয়। একদিন সকালবেলা কুবের তার বাড়ি গিয়ে হাজির হল। ধনরাজ নতুন কেনা বাড়ির লনে চীনে ফুলের তোয়াজ করছিল ঝারি হাতে। কুবের বোগেনভেলিয়া না কী একটা জমকালো ফুলের নাম জানতো। জিনিসটা ফুল নাও হতে পারে। কোনদিন চোখে দেখেনি। তাই নিয়েই খানিক কথা চালালো। বেতের চেয়ারে বসতে বসতে ধনরাজ চীনের ভূগোল টেনে আনলো কুবের গভর্নমেন্ট স্কুলের স্টুডেন্ট ছিল। বেতের ডগায় হোয়াং হো, ইয়াং সিকিয়াং করেছে পুরো ক্লাস এইট। চোখ বুজে চীনের প্রদেশগুলো, নদী, এমনকি পাহাড়—শেষে ভাষা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করে দিল।

ধনরাজ তখন চীনের দুর্ভিক্ষ নিয়ে পড়ল। কোন্ পোলিস সাহেব হিটট্রিটমেন্ট ফার্নেসের রিফ্যাক্টরী কারখানা বসানোর ব্যাপারে দিল্লি থেকে এসেছিল ক’দিন আগে। তারই মুখে শোনা, চীনেরা এখন খাবারের অভাবে পুরনো ভারি ভারি ডিকসনারির মলাট জলে ভিজিয়ে সকালে বিকেল টিফিন সারে।

এই জায়গায় খানিক থেমে থেমে কুবের গড় গড় করে বলে গেল, ‘জীবনের সাকসেসের মাঝখানে আপনি আজ দাঁড়িয়ে’, কথাগুলো প্রবন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে মুখটা অনেকখানি ভাবালু করে বললো, ‘খানিকটা জায়গা দেখেছি—বাড়ি করে উঠে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কোথাও অতগুলো টাকা যোগাড় করতে পারলাম না-অথচ পেলে আমি মাসে মাসে শোধ করে দিতাম।’

‘কত?’

‘চার হাজার—’

‘অত তো হবে না। আড়াই হাজার নিয়ে যেও-বাকিটা দেখ আর কেউ দিতে পারে কি না—’

কুবেরের বিশ্বাস হচ্ছিল না।

পরদিন কারখানায় টিফিনে ধনরাজের ঘরের সামনে গিয়ে স্লিপ দিতেই ভেতরে ডেকে পাঠাল কুবেরকে। মেঝে থেকে টেবিল অব্দি থাকে থাকে একশো টাকার নোটের বান্ডিলের সাজানো সিঁড়ি। রেডি করা ছিল। কুবের গুনে দেখল পঁচিশখানা।

‘কিছু সই করতে হবে না?’

‘দরকার নেই, বলে একখানা বাঁধানো খাতা খুলে কুবেরের নামের পাশে টাকার অঙ্কটা লিখে রাখল ধনরাজ, ‘এখন পঞ্চাশ করে কাটাব মাসে মাসে—শেষে কিন্ত বেশি কাটব, আমার কন্টিঞ্জেন্সি ফান্ড থেকে দিলাম। তাড়াতাড়ি ফেরত দিলে অন্যদেরও দরকারে টাকাটা দিতে সুবিধে হয়।

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই—সে তো একশোবার।’ আরও অনেক কিছু বলতে পারত অন্য সময় হলে। এখন ঠিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতার মত কোন কথাই মুখে এল না কুবেরের। তাহলে জায়গা বোধহয় কেনা হবেই।

রাতে বাড়ি ফিরে টাকাটা বুলুর হাতে দিল, ‘আরও দেড় হাজার দরকার।’

বুলু বলল, ‘কদমপুর থেকে তোমার ব্রজদা লোক পাঠিয়েছিল—চটিরাম জমি ছেড়ে দিতে পারে-আজকালের ভেতরে বায়না করতে হবে।’

সেদিন কদমপুর যাওয়ার পর কুবের অন্তত দশবার চটিরামের ওখানে গেছে। যাতায়াত করে দর ঠিক হওয়ার পর টাকার ধান্দায় আজ হপ্তা দুই চৌদিকে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাই আর একটা দিন ওদিক মাড়ানো হয়নি। তা বলে জমি ছেড়ে দেবে চটিরাম।

কিছুকালের ভেতর কুবের খানিকটা খানিকটা করে অন্যরকম হয়ে গেছে। রবিবার সকালের আড্ডা আজকাল জমে না। ফার্নেসে দু’চারজনকে জমি কিনে বাড়ি তৈরির প্ল্যান বলেছে। গুপ্তবাবু বলেছেন, আমরা কলকাতার বনেদী ভাড়াটে—পাঁচ পুরুষ ওপর ভাড়াটে। কদমপুর গিয়ে অ্যাতখানি পথের হ্যাপা পোয়াতে পারব না। দিব্যি মাসের শেষে ভাড়া দিয়ে যাও—কোন ঝামেলা নেই।

‘কালই বায়না করবো—’

‘বাকি টাকা?’

‘যোগাড় করতেই হবে—’

আবছা আবছা শুনেছিল, জমি কেনার আগে সার্চ করাতে হয়। আরও নাকি সব কাগজপত্র লাগে। পরদিন সকালেই কুবের বুলুকে নিয়ে শিবপুরে সারদা চ্যাটার্জি লেনে চলে গেল। সেখানে কুবেরের বন্ধু প্রসূনের শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর নিত্যগুপ্ত রায় বাড়িই ছিলেন। মানুষটি বড়দরের সার্ভেয়ার। বায়নায় কী করতে হয় তাও কুবের জানে না। রায়মশায় আর বুলু কদমপুর চলে গেল মিড্‌ ট্রেনে। পরের ট্রেনে প্রসূনকে নিয়ে কুবের সাবরেজেস্ট্রি অফিসে গেল। দু’খানা ডেমি আর দু’টাকার স্ট্যাম্প নিয়ে ওরা যখন কদমপুরে চটিরামের বাড়ি পৌছাল তখন বেলা প্রায় এগারোটা।

গুপ্তরায় মশায় এতক্ষণ জামাই-এর বন্ধুর জন্য চটিরামকে নরম নরম কথা দিয়ে আটকে রেখেছে। কত লোক নাকি ওই দশ কাঠা চৌদ্দ ছটাক কেনার জন্যে হাঁটাহাঁটি করছে।

শ্রীশ্রীকালী দিয়ে বায়নাপত্রের শুরু হল—

‘বায়নাপত্র গ্রহিতা-শ্রীকুবেরচন্দ্র সাধুখাঁ, পিতা শ্রীদেবন্দ্রলাল সাধুখাঁ, জাতি হিন্দু, পেশা চাকুরী, আদি সাং ১৩। ২, মুন্সী জেলার রহিম লেন, সালকিয়া, হাওড়া, থানা গোলাবাড়ি।

বায়নাপত্র দাতা-শ্রীচটিরাম সরদার, পিতা ময়ূর সরদার, জাতি হিন্দু, পেশা চাষ, সাং কদমপুর, থানা ও সাবরেজিস্ট্রি বহরিডাঙ্গা, জেলা ২৪ পরগনা।

কোথাও দাড়ি কমার বালাই নেই।

তারপর অন্তত পঞ্চাশখানা দলিল করে কুবেরকে খুচখাচ শরিকানি জমি কিনে দাগ ধরে এগোতে হয়েছে। এখন তার এসব প্রায় মুখস্থ—

কস্যরায়ত স্থিতিবাদ স্বত্ত্বের ভাগী বিক্রয়ের বায়না পত্রমিদং কার্যাঞ্চাগে…..নিরাংশে অবিবাদে নির্দায় নির্দোষ নিঃগৌল পরিষ্কার সুস্থ অবস্থায় খাসে ভোগ বাস দখলীকার আছি।

অদ্য তারিখে বায়নার বাবদ আদায় ১০০ একশত টাকা লইয়া অঙ্গীকার করিতেছি যে, অদ্য হইতে ১ মাসের মধ্যে পনের অবশিষ্ট তিন হাজার নয় শত টাকা দিলেই মহাশয়ের খরচে মহাশয়ের নাম বরাবর রীতিমত সাফ কোবালা লিখিত পঠিত সহি সম্পাদন ও রেজিস্টারি করিয়া দিতে বাধ্য থাকিলাম।’

বানানগুলো সব খোদ বিদ্যাসাগরের।

বায়নাপত্র লেখার পর মাঠে নামতে হল। বেলা তিনটে থেকে ফিতে ধরে মাপতে মাপতে সন্ধ্যে হয়ে এল। চটিরাম একখানা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, ভাইপোদের অংশ আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। কিনেছে এখানকার এক বাগ। হরি বাগ-ব্যাংকশাল কোর্টে কী একটা কাজ করে।

মাপামাপির পর গুপ্তরায় মশায় বললেন, ‘বোর্ডে ফেলে দেখতে হবে কতটা জায়গা আছে—’

চটিরাম তখনও দাঁড়িয়েছিল, ‘মেপে কী আর দেখবেন! দলিলের চেয়ে কাঠা দুই বেশিই আছে। দু’কুড়ি বছর চাষ নিজেই দিয়ে আসছি-আল সরে গিয়ে দু’কাঠা জমি বেড়ে গেছে-’

‘যা দখলে আছে—দলিল আছে—তাই কিনব আমরা।’

চটিরাম হাসল, ‘দু’ কাঠা মুফতে পাবেন-তার জন্যে কিছু টাকা আমার হাতে ধরে দিতে হবে।’

‘তা কেন?’

‘যে জমিন আপনার না—তার জন্যে দাম দিতে পারব না—’

‘ও হবে না বাবু।’

কুবের আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। গুপ্ত রায়মশায় তাকে থামাল, ‘বেশ তো, আগে বাড়িতে আঁক কষে দেখি—ঠিক কতটা জমি আছে—কমেও তো যেতে পারে।’

‘বেশ তো কষে দেখুন—’

চটিরাম স্টেশন অব্দি এগিয়ে দিতে আসছিল। লোকাল লোক-যজমানি করে বলে মনে হল, আগ বাড়িয়ে কথা আরম্ভ করল, ‘যা জমি আছে তার দাম দেবেন না?’

সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে সবাই টায়ার্ড। প্রসূনকে যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবে। এমন সময় এ আবার কী ফ্যাকড়া। কুবের নিজেকে সামলাতে পারল না, ‘আপনার জমি?’

‘না।’

‘তবে?’

‘আমাদের এখানকার লোক-আমরা দশজনই তো বলব, দেখবো—ঠিক দর পাচ্ছে কিনা।’

‘বেশ তো বলবেন। কিন্তু, কিন্তু আগে কষে দেখি কতটা জায়গা আছে—’

‘রোজ রোজ আমিনবাবুকে টেনে এনে তাঁর পিছনে দশ-পনের টাকা না ঢেলে একদিন সব মেপে দেখে নিন না—’

কুবেরের মাথায় আগুন চড়ে গেল। পকেট থেকে গুপ্ত রায়মশায়ের কার্ডখানা বের করে দেখালো, ‘দশ পনের নয়—রোজ একশো দেড়শো টাকা ফি ভদ্রলোকের-আমিন নয়, সার্ভেয়ার—’

লোকটা চমকে গেল, মুখের চেহারা নরম হয়ে এল, ‘আমারই ভুল হয়েছে,-আপনারা এসেছেন যখন, একবার আমার বাড়ি ঘুরেই যেতে হবে—’

‘আমাদের সময় নেই মশাই—সন্ধ্যের ট্রেনে ফিরব—

‘সে অনেক দেরি—বাড়ি আমার স্টেশনের উল্টোদিকেই-চলুন, দু’মিনিট বসবেন—‘

দু’মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট বসতে হল। শান বাঁধানো পুকুর। প্রসূন, গুপ্ত রায়মশায়, বুলু আর কুবেরকে চণ্ডী মণ্ডপের বারান্দায় বসিয়ে প্লেট ভর্তি মিষ্টি খাওয়ালো। লোকটির নাম প্রবোধ মণ্ডল। মণ্ডপের কোণে বড় বড় তামার বাসনের ডাঁই—জং ধরে নীল হয়ে গেছে, ওপরে মাকড়সার জাল, এক সময় সেখানে ধুমধামে পুজো হত। তখন ঘাটলা বোধ হয় এমন ভেঙে যায়নি, ধসে যায়নি।

বায়নাপত্রে চটিরাম সই দেবার পর বুলুকে একবার একা পাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল কুবেরের। বুলুর নামেই কেনা হচ্ছে। স্টেশনে কেনা পান খেয়ে বুলুর ঠোঁট এখন শুকিয়ে কালো হয়ে আছে।

ট্রেন যখন কদমপুর ছাড়ল তখন, লালজী আর ঘনরাম চাটুর্য্যের ইটখোলার মাথায় দগদগে লাল আর নিখুঁত গোল হয়ে সূর্য ঝুলছে—যেকোন মুহুর্তে গাছপালার আড়ালে টুপ করে খসে পড়বে।

আলো প্রায় নেই, কামরায় বাতি জ্বলতে জ্বলতে শেয়ালদা এসে যাবে। ছুটন্ত মাঠে মেটে জ্যোৎস্নার কায়দায় সূর্যের ফ্যাকাসে আলো নিভে আসছিল। তার ভেতরেই গুপ্ত রায়মশাই বললেন, ‘কেমন প্লেন জমি দেখেছেন? এক সময় সি বেড ছিল’, একটু থেমে বললেন, ‘দু’চার শো বছর আগে এখানে নদী বইত—‘

তার মানে এসব জায়গার ওপরে জল ছিল। ভাবাই যায় না। এখন তাহলে জলের ভেতর দিয়ে ট্রেন এগোচ্ছে। তার চেয়ে কামরার জানলায় বসে ফুটি ফুটি তারা দেখা ঢের সোজা।

বায়না করে একদিকে কুবেরের যেমন সুখ হচ্ছিল, অন্য দিকে তার মন বেশ খুঁতখুঁত করছিল। মোট দশ-বারো কাঠা। কতটুকুই বা জায়গা। আশা ছিল অন্তত দেড় বিঘে। সামনের দিকে কাঠা পাঁচেক ছেড়ে দিয়ে বসতবাড়ি, পেছনে দশ-বারো কাঠার পুকুর, পাড় ধরে কলাগাছ আর সুপুরির চারা বসিয়ে দেবে—এক কোণে থাকবে জালে ঘেরা পোলট্রি, হাঁসের আস্তানা—কত কী! সেই যে ঠাকুরমশাই মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল পঞ্চাশ টাকার কাঠা! তা বোধহয় বে অব বেঙ্গলের পাড় ঘেঁষে পাওয়া যায়। সেখানে বড্ড ঢেউ।

.

বায়নার বয়ানে ছিল, ‘১ মাহার মধ্যে পনের অবশিষ্ট’ টাকা দিয়ে সাফ কোবালা লেখাতে হবে। কুড়ি দিন পার হয়ে গেল। কুবের বাকি দেড় হাজার কিছুতেই যোগাড় করতে পারল না। পাড়ার কাবুলিদের লিডার গোছের তিন মণ ওজনের এক খাঁ সাহেব তার অনেক দিনের বন্ধু। সে বলতেই রেডি। কিন্তু বুলু পইপই করে বলল, ‘তাহলে ডুববে তুমি—’

এক মাস পুরতে দিন পাঁচেক বাকি থাকতে কুবের কদমপুর গিয়ে দেখে, হরি বাগ তার খুঁটো পোঁতা জমির হাত দশেক ভেতরে পিলার পুঁতে তার লাগোয়া জমির দখল নিয়েছে। চটিরাম বলল, কী করব বাবু? আজ দু’কুড়ি বছর চাষ দিয়ে আসছি ও জায়গা আমার। বাগ মশাই তো মানা না শুনেই পিল্পে বসিয়ে দিলে শনিবার।’

বাগের সঙ্গে দেখা করলে কুবের। লোকটা আইন বোঝে, কোর্টে কাজ করে। চা খাওয়াল কুবেরকে, তারপর বললো, ‘আমি মেপেই পিলার দিয়েছি—ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা কাঠা দুই জায়গা খেয়ে ফেলেছে। সেটুকু সব শরিকের ঘাড়ে ভাগ দিয়ে আমার কেনা অংশটুকু সব পাচ্ছিলাম না। তাই চটিরামের গা থেকে খুঁজে বের করে তবে পিলার দিলাম।’

কুবের বুঝল, হরি বাগের সঙ্গে পারা যাবে না। আর চটিরামের জায়গা অন্য কেউ কিনুক হরি চায় না। কেননা, হরির ওটা পেতেই হবে। এদিকে তারও বাকি টাকা যোগাড় হয়নি। স্টেশনে ফেরার পথে চটিরামকে বলল, ‘আপনি দখল দিতে পারছেন না—আমি কিনব কি করে?’

‘হরেনবাবু উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি মামলা ঠুকে আপনাকে দখল দেব?’

ততদিন আমি বসে থাকব?’ এবারে উল্টো চাপ দিল কুবের, ‘আমি কিনব বলে তৈরি—পাঁচ দিনের ভেতর দখল দিন, আমি কিনছি।’

‘সে আমি কোত্থেকে পারব—শরীরটাও হেলে গেছে ক’দিনের ঠাণ্ডায়

কুবের বলতে যাচ্ছিল, গত বছর জমির বিঘে ছিল আড়াই হাজার। সে জিনিস ক’দিনের তফাতে সাত হাজারে ছাড়ছো—তখন শরীরের কথা মনে ছিল না? কিন্তু এসব কিছুতেই বলতে পারল না! রেলের এই বরো পিট, এই ভিজে কচুবন—এদের পাশাপাশি চটিরাম অনেকদিন এখানকার লোক। কদমপুরের কত কথা লোকে ভুলে গেছে—সেসব মাটি চাপা জিনিস চটিরাম চেষ্টা করলে এখনও মনে করতে পারে হয়ত।

বিকেলবেলা পাশের মৌজা কমলপুরের দিকে সূর্য ঢলে গেছে। থাক থাক আলে ভাগ করা জমির সারা গায়ে সবুজ ঘাস—রোগা রোগা তালের চারা মাথা ধরে উঠেছে-এ সবের মাঝে আদুড় গায়ে চটিরাম দাঁড়ানো—চোখের কোণ ভাল ধোয়া নয় বলে কেমন অস্পষ্ট—মনে মনে ঠিকও করেছে হয়ত, আর পাঁচ দিনের ভেতর সাফ কোবালা হয়ে কুবেরবাবুর হাজার চারেক টাকা কোন দফায় কী রকম লাগাবে।’

‘কিন্তু আমিই বা বসে থাকি কি করে?’

‘তাহলে কাল এসে বায়নার টাকা নিয়ে যাবেন-আর বায়নাপত্রখানা সঙ্গে নিয়ে আসবেন বাবু।’

চটিরামের নীচের ঠোঁটের ওপর মুখের বাকিটুকু দাঁতের অভাবে চেপে বসে গেছে—পাকানো শরীরখানা খুব অবহেলায় তালের আঁটি মাথাটা ধরে আছে। কুবেরের এই বিকেলবেলায় তার জন্যে খুব কষ্ট হল। ষাট সত্তর বয়স হবে। মাথার ওপর বাপ মা নেই, চটিরামের ছেলেবেলার লোকজনও কমে যাচ্ছে তার দিকে। অতগুলো আল ডিঙিয়ে চটিরাম এখন তার বাপকেলে ভিটেয় গিয়ে উঠবে। সন্ধ্যে হতে দেরি নেই। বায়না করার দিন কুবের উঠোনের গোলাটা দেখেছে—একেবারে ফাঁকা, এককালে নাকি চার-পাঁচশো মণ ধান থাকত। মাটির বারান্দা বুক সমান উঁচু, চটিরাম কারও হাত না ধরে উঠতে পারে না নামতেও পারে না।

ঠাকুরমশাই একদিন ভাটিখানার ওদিকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়ে কুবেরকে কী করে দিল। তার কারখানার কলিগরা কেউ এখন ফার্নেসে—কেউ অফডে বলে ঘুমোচ্ছে, নয়ত ঘুরতে বেরিয়েছে। আর কুবের। এমন ফাইন বিকেলে।

কদমপুরে প্রথম আসার পর কিছুদিন কেটে গেছে। কুবের এখন জায়গাটা প্রায় তার মনে ধরেছে বলতে পারে। মাত্র কিছু দিন আগেও কদমপুর সে একদম চিনত না। এত ঘোরাঘুরির পর সব ঠিক হতে হতে হল না। সেদিন বিকেলে মাপামাপির সময় প্রসূন আর বুলু জায়গার পাশে উঁচু কিনারে সারা দিনের ছুটোছুটির পর বসে ছিল। প্রসূন বুলুর মাথার ওপর রোদ বাঁচিয়ে ছাতা খুলে ধরেছিল। গুপ্তরায় মশায়ের সঙ্গে ফিতে ধরার সময় কুবের দেখছিল, বুলু প্রসূনের ছাতা ধরার সময় লজ্জায় আপত্তি করছে-প্রসূন শুনছে না। বন্ধুর স্ত্রীর মাথায় ছাতা ধরতে সবারই ভাল লাগে। বুলুর লজ্জাটাও নর্মাল। কালো শান্তিপুরের পাড় ঘেঁষে লাল সুতোর লতাপাতা তোলা বুলুর শাড়ি মাটিতে ঘাগরা হয়ে ঘুরে ছড়িয়ে আছে। শাড়িটা সবুজ হলে বিকেলে বুলুকে কুবের বনদেবী বলে ডাকতে পারত।

কিন্তু আজ বাড়ি ফিরে বুলুকে কী বলবে। এ যে সেই ভাটিখানার বাড়ি দেখার মত শেষ অব্দি শুধু গাড়িভাড়াতেই গুচ্ছের পয়সা গচ্চা গেল। কদমপুর-শেয়ালদা রেলের টিকিটেই কম করে পঞ্চাশ টাকা গেছে এ ক’দিনে।

বায়নার পর বুলু বলেছিল, ‘একবারেই দোতলা বাড়ি করতে হবে। ঢালাই ছাদ চাই।’ করোগেট ভীষণ অপছন্দ। একতলা তিনখানা ঘরের মোটামুটি বাড়িতে ইট চাই পঁচিশ ত্রিশ হাজার ছাদে, ভিতে, দেওয়ালে—সব নিয়ে সিমেন্টও প্রায় আট ন’ টন। দোতলায় অবশ্য খরচ কিছু কম লাগে। তার ওপর আছে জানলা, দরজা, স্যানিটারি ফিটিং—কত কী। এত জিনিসের কত দাম-তার একটা হিসেব মনে মনে কষতে গিয়ে কুবেরের মাথার ভেতরে নোটের পাহাড় ডাঁই হয়ে উঠেছিল।

এ লাইনই ছেড়ে দেবে কুবের। ধনরাজ মাস মাস মাইনে থেকে যেমন কাটান দিচ্ছে দিক। টাকাটা দিয়ে বুলুকে একজোড়া চূড় বানিয়ে দেবে। বিয়ের আংটিটা সুদ-আসল দিয়ে ছাড়িয়ে আনবে—তারপর ফার্স্ট ক্লাস ট্রেনে চড়ে লটবহরসুদ্ধ চেঞ্জে যাবে—রাজগীর নয়তো নেতারহাট।

শেয়ালদা থেকে একখানা প্যাসেঞ্জার এসে দাঁড়াল। সামনের স্টেশনে কোনদিন যায়নি কুবের। ঢুকতে একটা ব্রীজ আছে। কদমপুর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সেটাই শুধ দেখা যায়।

প্যাসেঞ্জারের লেজে মালগাড়ি থেকে কুলিরা কিম্ভূত সাইজের যন্ত্রপাতি নামাচ্ছে। গায়ে লেখা ও এন জি সি। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কমিশন। গুপ্তরায়মশাই সেদিন মাপামাপির পর ট্রেনে বসে ঠিকই বলেছিলেন, জমি কী প্লেন-এদিকটা সি বেড ছিল। সারা তল্লাট জুড়ে গভর্নমেন্ট গর্ত খুঁড়ছে, তাঁবু গাড়ছে। সকালের দিকে কদমপুর বাজারে নতুন নতুন জিপে চড়ে সরকারী অফিসারদের ঠাকুর চাকর দশ পনের মাইল দূরের

মাঠ থেকে বাজার করতে আসে। লেভেল ক্রসিংয়ে গেট পড়ে গেলে ওদের জিপের জন্যে আবার পথ খুলে যায়।

প্রাগৈতিহাসিক আমলের সমুদ্র যা কিছু গিলেছিল তা সবই এখন মাটির চাপে পড়ে এতদিনে কালো তেল। কোনদিন হয়ত চটিরামের জমিতে টিউবয়েল বসাতে গিয়ে হরি বাগ তেল পেয়ে যাবে।

কুবের উল্টোদিকে তাকালো। দূরের স্টেশনে ঢুকবার মুখে ব্রিজটা এখন একটু দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকে শেয়ালদার আপ গাড়ি আসতে আসতে ডিসট্যান্ট সিগন্যালে আলো দেখা যাবে। একদিন কুবের ওদিকে যাবেই—যেতে যেতে নাকি সমুদ্র পাওয়া যায় শেষে। এক একদিন ফার্নেস বেড়ে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্যে কুবের হাঁপিয়ে ওঠে। ফার্নেসের দরজা তুলে তাকেই বেলচায় করে পোড়াচুন ফুটন্ত ইস্পাতের জলে ছুঁড়ে দিতে হয়। স্লাগের ফেনা সরিয়ে গুঁড়ো চুনের দলা ভেতরে গিয়ে পড়ে। কোন শব্দ নেই—শুধু গলন্ত ইস্পাতের বুক বেয়ে নীলচে আগুন তখন পাক খায়।

‘কখন এসেছিলেন?’

লোকটা কাউন্টারে টিকিট দেয়। ভিড় দেখে কুবেরকে একদিন ভেতর থেকে টিকিট দিয়েছিল। নিজে নিজেই লোকটা আবার বলল, ‘তিনটে কুড়ির?’ একটু থামল, ‘জায়গা পছন্দ হল?’

এখন একে সব বলতে গেলে রামায়ণ হয়ে যাবে। তার চেয়ে অন্য কথাই ভাল। কিন্তু কী নিয়ে এখন কথা বলা যায়। আজ বোধহয় লোকটার ছুটি। কাছেই কোয়ার্টার—পায়চারির পক্ষে এমন বাঁধানো প্ল্যাটফর্মই প্রশস্ত—তাই বোধ হয় এখানে। কথা বলতে বলতে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে ঢুকল দুজনে। অন্যদিন দারোগার টুপি মাথায় যে টিকিট নেয় সে একটি অল্পবয়সী ছোকরার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কুবেরের দিকে আড্ডা ঘুরে গেল। কী করে যেন ওরা জানে, কুবের জমি কেনার জন্যে ঘোরাঘুরি করছে।

ছোকরার কাছে তিনটে বাচ্চা দাঁড়িয়ে-ছোটটা বছর তিনেকের, চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবা—‘

আরও কী যেন বললো। কুবের অবাক, এই ছোকরার তিন তিনটে পোনা! এলেম আছে তো।

‘আমাকে চিনতে পারছেন?’

ছোকরা উঠে কুবেরের দিকে এগিয়ে এল, বাচ্চা তিনটেও পায়ে পায়ে এল। ঠিক মনে করতে পারল না। কোথায় দেখেছে?

‘আমি কিন্তু আপনাকে চিনি—’

ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। কুবের সাবধান হয়ে গেল।

‘শালকের কুবের সাধুখাঁ না আপনি?’

কুবের মাথা নাড়ল। আর কি জানে ছোকরা? সাদা শার্ট, মালকোঁচা ধুতি, কব্জিতে মানানসই ঘড়ি। এই বয়েসে তিন তিনটে বাচ্চা—নিশ্চয়ই পয়সা আছে।

‘আমার নাম বিকাশ বোস—’

কুবেরের কথা কী জানে? কোন্ সময়ে কুবেরকে চিনত? রিজার্ভড্ কুবের? ফ্লিভোলাস কুবের? কুবের দ্য মিন? লিবারাল কুবের? কিংবা, প্রায় ভবঘুরে?

‘আমরা যেবার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম—আপনারা ফোর্থ ইয়ারে—’

কুবের হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কীভাবে চেনে কে জানে। কখন কোথায় দেখেছে। এত কষ্টের পর চটিরামের জমিটা কেনা হল না। কাল আবার ভোরের ট্রেনে এসে বায়নার টাকাটা ফেরত নিয়ে যেতে হবে। তখন না আবার কোন ঝামেলা পাকায়। মনটা খিচড়ে ছিল—খানিকটা ডিস্টার্বড্, বিকাশ তার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে।

ফোর্থ ইয়ারে যখন পড়ত, তখন নেহরু অব্দি তাজা ছিল। সে বছর পনের আগের কথা। প্রায় কিছু মনে নেই। তখনকার এমন কি মনে থাকতে পারে? কী জানে এই ছোকরা? কেউ চেনে বললে কুবেরের সবচেয়ে বেশি ভয় করে। তখনকার একখানা ছবি দেখে বুলু নাক কুঁচকে বলেছিল, ‘এ মা কি রোগা। মাথা অমন হেলিয়ে বসেছ কেন?’ এখনও কুবের কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে ডাইনে কিংবা বাঁয়ে মাথা কাৎ করে ফেলে। ওই অভ্যেস।

অতীত কুবেরের কাছে প্ৰায় ভূত।

বিকাশ তার কথা কী জানে, তা বের করতে না পেরে কুবের মনে মনে কাঁটা হয়ে থাকল। এখনি ট্রেনটা এলে লাফিয়ে উঠে বসতো। অথচ আজই দশ মিনিটের ওপর লেট। কথায় কথায় জানা গেল, বিকাশ বোসের বাবা ননী বোস বছর তিরিশেক আগে কলকাতায় এক কলেজ থেকে ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে রিটায়ার করেন। তখন যা পেয়েছেন, তা দিয়ে এখানে স্টেশনের ধারাধারি তিনি বেয়াল্লিশ বিঘের ঝিল সমেত একশ’ আশি বিঘে জায়গা এক লপ্তে কেনেন। ঝিলে মাছ চাষ, ডাঙ্গায় ইঁট আর টালির ব্যবসা—সবই ননী বোস চুটিয়ে করেছেন। কথায় কথায় মনে হল, বিকাশ তার বাপের আট আনায় কেনা কাঠা এখন বাজার বুঝে হাজার দেড় হাজারেঁ ঝেড়ে যাচ্ছে। কেননা, বিকাশ বার বার জানতে চাইছিল, কি দরের ভেতরে কুবের জমি চায়—মানে, তার রেস্ত কত, সে হদিস পাওয়াই আসল মতলব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *