কুবেরের বিষয় আশয় – ৭

॥ সাত ॥

পরদিন খুব ভোরে, বুলু তখনও ঘুমে, চারটে পঞ্চান্নর ট্রেনে কুবের চেপে বসলো। সরু পিয়াসলে ট্রেনটা থেমে থাকলো, পেট্রোলের খোঁজে ভারি ভারি ড্রিলিং পাইপ, বোঝাই হয়ে একটা গুডস্ ট্রেন গেল। ইলেকট্রিফিকেশনের ওভারহেড তার পোষ্টে টেনে টেনে লাগানো হচ্ছে। যে কোন উপায়ে ইলেকট্রিক ট্রেন চলবার আগেই এদিকে জমি কিনতে হবে কুবেরকে।

ব্রজদা বাড়ি ছিল। ঘুম চোখে চা খেয়ে কুবেরকে বললো, ‘চল্ তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। গোটা সাউথ বেঙ্গল—মায় বে অব বেঙ্গলের খানিকটা ভবেন শী বন্ধকী কারবারে কিনে রেখেছে।’

কদমপুর বাজারে ঢুকতে ভবেন শী’র দোকান। আদ্দির ফুতয়া টেবিল ফ্যানের হাওয়ায় ঘাড়ে গর্দানে কাঁপছে। সামনে বড় ঘরের এক ফর্সা বুড়ো করজোড়ে বসে। আলাপ করিয়ে দিতে ভবেন বললো, ‘কি দরকার আপনার? বাড়ি না জমি?’

কুবেরকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো, ‘রাস্তা নেই এমন জমি সরু পিয়াসলে দিতে পারি—ধান হয় এখনও, সাত হাজার টাকা বিঘে। এ-বছর পুকুর কেটে সামনের বছর ভিত বানাতে পারবেন। তৈরি বাড়ি যদি কেনেন তাও পারেন। এই তো বাজারের মোড়ে আছে—দোতলা, টিউবওয়েল পুকুর দুই-ই আছে—একতলায় তিনখানা ঘর, দোতলায় ভাল চিলেকোঠা—চব্বিশ হাজার পড়বে, রেজিস্ট্রি খরচ আলাদা।’

‘অত টাকাই নেই আমার!’

‘তাতে কি? এগ্রিমেন্ট করে নেব। দশ বছরের কিস্তিতে শোধ দেবেন—সাড়ে বারো পারসেন্ট সুদে পড়বে, দলিলখানা মর্টগেজ থাকবে আমার কাছে—শোধ হয়ে গেলে ফেরত পাবেন।’

কুবের বোমকে যাওয়ার দাখিল। এমনও হয় নাকি। মুখে বললো, ‘তার চেয়ে স্টেশনের ধারাধারি আমায় একটু জায়গা দিন। ছোট্ট বাড়ি করে নেব সুবিধে মতো। অফিস ফেরত ট্রেন থেকে নেমেই যেন বাড়ির উঠোন চোখে পড়ে—’

‘তাই বলুন। যেমন চাইবেন তেমন পাবেন। কাল সকাল সাড়ে ন’টায় আসুন—সঙ্গে লোক দেব-সরু পিয়াসলেই কুড়ি শতক—ধরুন গিয়ে বারো কাঠা দু’ছটাক জমি আছে। চরণদার লোকটিকে গাড়ি ভাড়া দেবেন দুটি টাকা। একবেলা আটকে থাকবে বেচারা।’

বাইরে বেরিয়ে দেখল রুপোর একগাদা গহনা গায়ে এক ঘুঁটেওয়ালি দাঁড়ানো। কোলে একটা সাদা-হাঁস। ভবেন শী ভেতর থেকে ডাকলো, ‘কইগো—কি এনেছো?’

ব্রজদা কুবেরকে ভেতরে পাঠিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিল। কুবেরকে দেখে এগিয়ে এল, সব শুনে বললো, ‘ততক্ষণ আমার ওখানে বসবি চল—’

আভা বৌদি একটা বেঁটে ছাতা মাথায় দিয়ে কোত্থেকে ফিরছে। বাঁ হাতে একটা ব্যাগ, ‘খালপাড় থেকে মাছ নিয়ে এলাম—মেছুনিরা রাতে পোলো বসিয়ে রাখে, ভোর ভোর তুলে পাড়ে বসেই যা ধরা পড়ে বেচে দেয়—’

ভোরে ব্রজদার বাড়িতে কুবের খেয়াল করেনি, আভা বৌদি ঘরে নেই। ফ্রিলের ঝালর দেওয়া ব্লাউজের হাতা কনুই ছাড়িয়ে নেমে এসেছে—তারপর লাল রঙের দু’গাছা ভারি কাচের চুড়ি-বালা বলতেও দোষ নেই। সুরমা টানা চোখে মণি দুটো হলদে হয়ে ঠেলে উঠেছে—কাল রাতে বেমক্কা খোঁচা খায়নি তো?

‘বসবেন চলুন—টাটকা পুঁটি মাছ ভেজে দেব—’

ঘরে বসে ব্রজদা যা বললো, তার মর্মার্থ : ভবেন শী সস্তার বাজারে বন্ধকী কারবারে নামমাত্র পয়সায় বিরাট বিরাট সম্পত্তির একেবারে ফালতু মালিক হয়ে বসেছে। বন্ধকী সোনার গয়না মেয়াদ ফুরোতেই গালিয়ে বেচে দিয়েছে। এখন এতো টাকা-পয়সা, জমি-জায়গা, পুকুর, খামারবাড়ি, যেনতেন না ওগরালে বিপদ। বয়েস বাড়ছে—বড় ছেলেটাও নেশাভাঙ ধরেছে, ঘরে গিন্নিরও রোজ নাকি এক পাঁট না হলে সন্ধ্যেই মাটি হয়ে যায়—এই অবস্থায় পুলিস, ইনকাম ট্যাক্সের লোক সবাই ছোঁকছোঁক করছে। টাকা দিয়ে কতদিন আর সামলাবে? তবে, লোক ভাল—গরীব হলেও ব্রজ ফকিরকে বিপদে-আপদে দেখে।

‘যা-ই বলো, তোমার এতো পিরীতের ভবেন কিন্তু সুবিধের নয়।’ বারান্দায় তোলা উনুনে চাপানো কড়ার মাছগুলো এপিঠ-ওপিঠ ভাজতে ভাজতেই আভা বৌদি বললো।

মেঘ করে আসা সকালে টালির ছাদের নীচে এই চিলতে বারান্দায় আলোই আসেনি। কাঠের আঁচে এক-একটা আগুন শিখা হয়ে উঠছে—তাতে আভার মুখ, মুখে বসানো হলদে কালো চোখের মণি—সবই অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কাল শেষ রাতে বুলু ঘুমিয়ে পড়েছিল। এতক্ষণে নিশ্চয় ঘুম ভেঙেছে। ব্রজদা এক খাবলা তেল মাথায় চাপড়ে গামছা কাঁধে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল। নিশ্চয় সেই সেপাই-এর কেলির পুকুরে।

‘দেখুন তো—এত জ্যান্ত! অনেকক্ষণ ভাজলেও ভেতরে দগদগে রক্ত থাকে—’ আভার একটা বেণী ঝপাং করে কুবেরের পিঠে পড়ল, বাসি তেলের গন্ধ মাখানো মাথাটা তার ঠিক কপালের ওপরেই। অনেকটা ঝুঁকে পড়ে কথা বলছিল।

আভা হঠাৎ টান টান দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘কাল সন্ধ্যে আমি নিজেই খালপাড়ে গিয়েছিলাম—আপনার দাদা ফিরতে সেই রাত দশটা, জ্যোৎস্নার মধ্যে ছিটছিটে এমন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, শেষে একটা পাকুড় গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম—‘

অন্ধকার হয়ে আসা ঘরে বুক চিতানো বোকা পাখির কায়দায় আভা দাঁড়িয়ে। কাল সন্ধ্যেবেলা হাতায় তিন থাক ঢেউ তোলা এই ব্লাউজটা গায়েই হয়ত খালপাড়ে গিয়েছিল।

মেছুনিদের পোলো বসাবার সময়—হাতে পয়সা নিয়ে গিয়েছিল, তখন হাতে পেলে ওদের সুবিধে—হাটবাজার করে ফেরে

বড় একটা ধান্য পুঁটির পিঠ তুলে কুবের মুখে দিল।

‘বৃষ্টি থামতেই পাকুড়তলা থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়েছি—বাঁ হাতেই ইটখোলার মাঠ জ্যোৎস্না পড়ে খাঁ-খাঁ করছে, আমার যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে অনেকক্ষণ—ভীষণ জল খাওয়ার ইচ্ছে হল, কোথায় যাই—একবার মনে হল মেছুনিরা পোলো বসিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ, ভুল সময়ে এসে পড়েছি, একেবারে এক-একা, এই মাঠে—কোথায় যাই, আচমকা নস্করদের পোড়ো বাগানে তাকিয়েছি—কী বলব আপনাকে, ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা দুই সারি তালগাছের ফাঁকে আকাশের সরু মত গলিটা ধরে চাঁদ একেবারে কদমপুরের মাথার ওপর নেমে এসেছে—’

একবার ইচ্ছে হল থামায় আভাকে। মোড়ায় বসে এক গ্লাস জল খেয়ে একটু জিরোক্। থামানো গেল না। মিড ট্রেনটা হাঁপাতে হাঁপাতে প্লাটফর্ম ছাড়বে। দু’হাত মেলে ধরল আভা, ‘এই এত বড় চাঁদ, ঠিক এত বড়’, বলতে বলতে আভার হাত দুখানা প্রায় বাতাস কাটতে শুরু করে দিল, ‘কদমপুরের সবাইকে দেখতে নেমে এসেছে অনেকখানি—এত কাছে বলে স্পষ্ট দেখলাম চাঁদখানার ওপর অন্তত দু’ইঞ্চি পুরু করে নরম নীল মাখন মাখানো—’এখানে সামান্য থামল আভা, ‘অথচ চিরকাল জেনে এসেছি চাঁদ হলুদ রঙের—’

পাখির মধ্যে ধনেশ নামটা কুবেরের অনেকদিনের পছন্দ। অথচ আজও দেখা হয়নি পাখিটাকে। নামটা এত সজল। নিশ্চয়ই খুব খোলামেলা বড় দুই ডানা থাকে। আভাকে কোনদিন এরকম জানত না কুবের। চাঁদের এতদিনকার রঙ নিয়ে ভাবনায় পড়ে দাঁড়ানো। মেলে ধরা হাত দু’খানা প্রায় বুজিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু আবজে দিল কুবের, তারপর পিঠসুদ্ধ মাথাটা একেবারে তার মুখের নীচে—শেষে ঝটকানো ঠোঁট একটা চুমোতে চেপে ধরল। কতক্ষণ এভাবে ছিল তা বোঝার আগেই আভা তার দুই হাতের ভেতর থেকে গলে গিয়ে বারান্দায় চলে গেছে—একেবারে কড়ার কাছে, হাতে খুন্তি, ‘ডিম হয়ে গেছে বুঝলে—‘

প্রথমে কিছু কানে গেল না কুবেরের। তারপর বুঝলে কথাটা মনে পড়তেই সামনে তাকিয়ে দেখে একখানা মস্ত পিঠ, জলে ভিজে—তার দু’পাশ দিয়ে দু’খানা হাত উঠছে নামছে। ব্রজ ফকির গা মুছে ভিজে গামছা মেলে দিয়েছে।

‘দিন—প্লেটটা এগিয়ে দিন’, শেষের এই মাছগুলো ভাল ভাজা হয়েছে, কুবেরকে দিতে দিতেই আভা বলল, ‘তুমি সন্ধ্যে করে পিঁড়েটা টেনে বস—আমার রান্না নেমে যাবে ততখোনে। ‘

রান্না মানে ঐ ভাজা মাছের ঝোলের জন্যে জল বাটনা নামিয়ে দিয়ে কয়েক মিনিটে আভা ফুটিয়ে ফেলল। ব্রজদাকে ভাত বেড়ে দেওয়ার আগে মাথায় ঘোমটা তুলে নিল।

পৌষ মাসে জমি জায়গা বিক্রি হয় না। অঘ্রাণের শেষাশেষি বলরাম-ভুবনদের জায়গাটুকু হয়ে গেল। মোট এক একর চব্বিশ শতক—তিন বিঘে পনর কাঠা দশ ছটাক জায়গা বলরাম-ভুবনদের বাবা-কাকা-জ্যাঠাবাবুদের খরিদা সম্পত্তি। খাজনা সাত টাকা পাঁচ আনা তিন পাই। বাপকেলে জায়গাটুকুর দাম দলিলে দেখল নব্বই টাকায় কেনা। কুবের দলিল পড়ে অবাক। ইংরেজি সন উনিশশো বিয়াল্লিশের পাঁচই মে কোন ভূতনাথ সরদারদের কাছ থেকে মাত্র ওই টাকায় কেনা সম্পত্তির ভেতর জমির দাম সত্তর আর ‘মাঠের ধান্য’ কুড়ি টাকা। ভূতনাথরা আবার উনিশশো দুই সালে জমিদার হরি বাঁড়ুজ্যের খাস জমি থেকে তিন টাকায় ওই লপ্তটুকু কিনেছিল। সবটুকু নিতে কুবেরের মোটমাট বারো হাজার পড়ে গেল। বারো হাজার টাকা যোগাড় করতে কুবেরকে দল বাঁধতে হল। ভূতনাথরা বেঁচে আছে কি না জানা জায়নি। হয়ত কবে মরে হেজে গেছে। বেঁচে থাকলে না হোক্ আশি পঁচাশি বছর বয়স হতো। তাদের এক জীবনের জায়গার দর চার হাজার গুণ বেড়েছে। অথচ সেই লাইন দিয়ে রেলই চলে, একই মাঠগুলো ধানই দিচ্ছে শুধু।

সারদা চ্যাটার্জি লেন থেকে প্রসূনের শ্বশুর রায়মশায়কে আনতে হল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে দেখে তিনি গামবুট পরেই বাসে উঠলেন। অঘ্রাণের ঠাণ্ডার সঙ্গে ছিচকে বৃষ্টি মিশে একেবারে হাড় অব্দি কালিয়ে দেবার যোগাড়।

জল পড়ে পড়ে সাপের গর্ত বরফ হয়ে উঠেছে। জায়গা মাপার সময় আগাগোড়া একটা সাপ আল বদলে বদলে কুবেরদের দেখল মাথা তুলে। রায়মশায় বললেন, জন্যেই সব জায়গায় আমি একখানা লোহার গজ কাঠি নিয়ে যাই। লাঠির কাজ হয়ে যায়। আজই আনিনি।’

ভুবন সঙ্গে সঙ্গে সাপটাকে তেড়ে গেল, ‘একদম বিষ নেই—এই দেখুন ধরে আনছি।’ সত্যিই গেল। সাপটাও ভুবনকে দেখে মাথা একটু উঁচু করেই ছুট। তিন—চার হাত লম্বা তো হবেই। শুধু হাতে ফিরে হাঁপাতে লাগল ভুবন, বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘ঢ্যামনা!’

বহরিডাঙ্গা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দুর্গা মুহুরির খাটে বসে দলিল লেখা হল। জে.এল.আর. অফিসে নোটিশ পাঠানোর জন্যে দুর্গার শাগরেদ জয়কেষ্ট খাম পোস্টকার্ড সব রেডি করে দিল। বেলাবেলি রেজিস্ট্রি হয়ে যেতে ভুবনদের সঙ্গে বুলুকে নিয়ে কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বড় বড় রাজভোগের মধ্যে ঢাকাই পরটা ঠেসে ভেঙে খেয়ে ফেলল কুবের। তাহলে এতদিনে জায়গা কেনা হল।

বারো হাজার টাকা যোগাড় করতে বুলুর জামাইবাবু বলাই মহাপাত্র, তার বন্ধু রঙ কোম্পানীর ধীরেন দাস আর মারোয়াড়ি হাসপাতালের স্টাফ নার্স ঊষাদিকে একত্র করে কুবের জায়গা কিনতে নেমেছিল।

পৌষ মাস কেটে গেল বণ্টননামা তৈরি করতে। হাজারো তকলিফ। ছ’ কাঠার কমন প্যাসেজ সুদ্ধ নকশা তৈরি করে দিলেন রায়মশাই। তা ছাপাতে গিয়ে কিলবার্নের অফিসে ঢুকে কুবের অবাক। কত যন্ত্রপাতি, কত ম্যাপ, কত স্কেল। সবই তো জমি-জায়গা, ঘরবাড়ি, সেতু-খালের জন্যে। আজকাল ম্যাপ বুঝতে আটকায় না কুবেরের। স্কুলবাড়ি, রাস্তা, ডাঙা জমি, ভদ্রাসন —সব কিছু চিহ্ন দেখে দেখে ম্যাপ থেকে খুঁজে বের করতে পারে।

এক এক মৌজায় কত জমি। এখন সরকার বাহাদুরের খাজনা জমে পড়ে। কিছুকাল আগেও জমিদার-কাছারিতে গিয়ে দিয়ে আসতে হতো। তখন নীলামে কত লাট হাত বদলাতো। জয়কেষ্ট বলছিল, ‘এখন আর কি মামলা দেখছেন! বহরিডাঙ্গা রেজিস্টারি অফিস তো আজকাল শ্মশান। জমিদারি থাকতে চোত মাসে এই আমাদের সেরেস্তাতেই লোকে লোকারণ্য।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *