কুবেরের বিষয় আশয় – ১৬

॥ ষোল ॥

বিরাট বাথান। সারি সারি পুরুষ্টু গাই গরু সারি সারি দাঁড়ানো। ঝকঝকে মাজা পেতলের কেঁড়েতে দুধ দোয়া হচ্ছে। দোকা ভর্তি নানান খাবার। মুগ, অড়হর, ছোলা, গুড়, কচিঘাস টাল দিয়ে সাজানো। গরুগুলো আরামে খাচ্ছে। ফোঁসফাঁস নিঃশ্বাস ফেলছে। বাঁট থেকে দুধের ধারা ক্ষীর হয়ে নামছে। পূর্ণিমার সন্ধ্যে। পালতোলা দু’খানা জাহাজ মাঝনদীতে নোঙর ফেলে ভাসছে। ডিঙি নৌকো ডাঙ্গা থেকে খাবার জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জাহাজে তোলা হবে। এমন সময় পরি বসানো দীঘির ধারের চত্বরে মেদনমল্ল এসে দাঁড়ালো। পেছনেই দুর্গ। দেখেই চেনা গেল। দেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁর সেজো ছেলে কুবের সাধুখাঁ। তবে জুলফি অনেক লম্বা আর মাথায় বাবরি। তখনও দুধ দোয়ানোর ছনছন শব্দ শোনা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নায় সাদা পরিদেহগুলো শুধু ফকফক করছে।

চেনা রাস্তা ধরে কুবের চত্বর থেকে নেমে এল। সবই তার জানাশোনা। শুধু লোকজন নেই কোন। তাতে বিশেষ অসুবিধে হল না। কুবের লম্বা লম্বা পা ফেলে দুর্গের পেছনে এসে দাঁড়াল। সেখানে দুর্গের অতিকায় ছায়ার মধ্যে রাশি রাশি দুধলি ফুটে আছে। একটা দুটোয় সামান্য আলো পড়ে জোনাকির ধারা জ্বলে উঠছে। কুবের গায়ের জাব্বা জোব্বা খুলে ফেলল। একটা গুড়গুড়ি পাখি মনের সুখে গুড়-গুড়—গুড় ড়-ড় করে ডাকছিল। কুবের কোমরের তলোয়ারখানা আলগোছে ঘাসের উপর রাখতেই পাখিটা থেমে গেল। তারপর নদীর মধ্যে নামতে লাগল কুবের। জল সরে যেতে লাগল। বিশাল শুকনো নালার কায়দায় নদীর বুক পেট সব ঠেলে উঠল কতকাল জলের নীচে ছিল। উলটো দিক থেকে দশখানা হাল টেনে কুড়িটা মোষ আসছিল। লাঙলের ফলার দু’ধারে মাটির চাঙড় উলটে উলটে পড়ছে। জল বেটে আসতে হয়েছে বলে মোষের গা ভিজে।

কুবেরও এগোচ্ছিল। কত জমি। কত জায়গা। এ সব আবাদ হয় না। জল সরে যাওয়ায় হুহু শব্দটা সুন্দরী গাছের জঙ্গলের বাঁক পেরোয়নি তখনও—এমন সময় কুবের স্পষ্ট শুনতে পেল, কে ডাকছে, ’সেজদা! সেজদা! সেজদা আছো নাকি?’

সালকে থেকে নতুন বাড়িতে উঠে আসা ইস্তক এমনিতেই কুবেরের ভালো ঘুম হচ্ছিল না। চারদিক খোলামেলা। লোকজন নেই। বড় বড় ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। দেওয়ালে গৃহপ্রবেশের দিনের লাল লাল সিঁদুরের দাগ। খুব অস্বস্তিতে যাচ্ছিল।

আরেক ডাকেই কুবের উঠে বসল। বুলু ঘুমে। কচি মেয়েটা একদিকে ঢলে পড়ে আছে। ছেলেটা আড়মোড়া ভেঙে উঠবে এখনই।

দরজা খুলতেই নগেনের সামনে পড়ল। এত ভোরে। গৃহপ্রবেশের দিন মা আসেনি। আর আসেনি নগেন। ওভারটাইম ছিল অফিসে।

‘বাড়ি চল।’

কুবের তো রাগারাগি করে চলে আসেনি। নিজের বাড়ি করে উঠে এসেছে। তরিতরকারি কুটতে অনেক জায়গা লাগে মার। বুলুর বুদ্ধিতে পুবের দিকে ঢালাও একটা বারান্দা বানিয়েছে। মা সেখানে বসে কুটনো কুটবে ইচ্ছে মত।

মুখ না ধুয়েই, এতক্ষণ নগেনের সঙ্গে কত কথা হয়ে গেছে—এইভাবে কুবের নতুন বাড়ি দেখাতে লাগল নগেনকে। ‘প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড্ বাথ্‌—’

‘জামা কাপড় পরে নাও। তাড়াতাড়ি যেতে হবে—’

ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে কুবের মেদনমল্লর দুর্গ দেখে ফেরবার পর ক’দিনই আবাদে ঢালাও চাষে নামার কথা নিয়ে ভাবছিল। একটু আধটু তৈরিও হচ্ছিল। মাঝরাত থেকেই বাঁ হাতখানা বুকের ওপর। অন্যদিন বুলু নামিয়ে দেয়। বোবায় ধরে এই কাণ্ড।

তখন কুবেরের দুর্গের ঘোর ভালো করে কাটেনি।

নগেন বললো, ‘তাড়াতাড়ি নাও। সবাই বসে আছে। তুমি গেলেই রওনা হবে।’ কুবের তখনও নগেনকে বোঝাচ্ছিল, কদমপুরের এই বাড়িতে থাকার সুবিধে কতখানি। ‘তোরা সবাই থাকবি বলে এ বাড়ি বানিয়েছি। ওই ঘরটায় তুই আর রেখা থাকবি। মা আর বাবা বড় ঘরে। বীরেন আর ডলি দক্ষিণের বারান্দা লাগানো ঘরে—’

‘মা নেই।’

‘আমি না হয়ে রান্নাঘরের কাছে থাকব। কোন অসুবিধে হবে না—’, খচ করে থেমে গেল কুবের, ‘কি বললি?’

‘মা নেই।’

‘মানে?—’

‘কাল রাতে বড়দার ওখানে মারা গেছে। সারা রাত লরি চড়ে আজ শেষরাতে ডেড়বডি এসে পৌঁছেছে—

‘বাবা!’

‘ভেতরে বসে আছে দেখে এসেছি—’

ট্রেনে বসে নগেন প্রথমে কথা বললো, ‘তোমার বাড়ির কথা যে মা কতজনকে বলেছে। অথচ নিজে দেখতে পেল না।’

কুবের কিছু বলতে পারল না। ভোরের ট্রেনের জানলায় বসে ঘনরাম চাটুজ্যের ইটখোলা দেখা যাচ্ছে। ক’বছর আগে প্রথম প্রথম কদমপুরে আসত—তখনই মা শেষরাতে স্টোভে চা করে দিয়েছে। কুবেরকে কতবার। হরলিকসের শিশিতে ঢেঁড়সের বিচি রেখেছিল গুছিয়ে। কুবেরের জায়গা জমি হয়ে গেলে খানিক ক্ষেত করবে ঠিক করেছিল। ঘাটের সিঁড়ির বজ্র গাঁথতে গিয়ে অসময়ে বৃষ্টি নামল। কাজ পিছিয়ে গেল। নইলে কবে গৃহপ্রবেশ হয়ে যেত। মা অনায়াসে এ বাড়ি দেখে যেতে পারত।

বুলু বললো, ‘যদি একটা বছরও এখানে থাকতেন। থেকে, হাঁটা চলা করে বাড়িটা পুরনো করে দিয়ে মরলে আমাদের কোন দুঃখ থাকত না।’

ইটের কামড় বড় কামড়। দালান কোঠা করলে, মাটি পোড়ালে, মাটি খুঁড়লে একজনকে না একজনকে টেনে নেবেই। শেষকালে মায়ের ওপর দিয়েই তা গেল। শেষকালে তুমি সবাইকে হারিয়ে দিলে মা।

ট্রেন সরু পিয়াসলে ছাড়িয়ে গেল। কুবের অনেক কষ্টে মনে করতে লাগল, শেষ কবে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। নগেনের মেয়ের জন্মদিনের দু’দিন আগে? টোয়েন্টিনাইস্থ মে? না তারও আগে। তারিখ মনে নেই ঠিক।

কিছুকালই মা বড়দার ওখানে গিয়ে থাকছিল। সেখানে থাকার সুন্দর ব্যবস্থা। বড়দা বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে দিত। মা বড়দার কোয়ার্টারের সামনে লঙ্কা, বেগুন লাগিয়েছিল। ছাদ ঢালাইর সময় কুবেরের কিছু টান যাচ্ছিল। এদিক সেদিক টাকা আটকানো। কতকাল ধান নিয়ে গেছে—ফেরত দেয়নি। সে সময় একদিন চিৎপুর ইয়ার্ড থেকে লরিতে কদমপুরে সিমেন্ট নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে টাকা নিতে এসেছে। বুলু ঘুমোচ্ছিল। সামনের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ।

পাছে বুলুর ঘুম ভাঙে—কুবের গিয়ে দরজা খুলে দিল। বোঁচকা হাতে মা দাঁড়ালো। রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে। মা বললো, ‘খুচরো পয়সা হবে তোর কাছে? দশ আনা?’

কুবের দিয়ে দিল। তুমি একা! রিকশায় করে হাওড়া স্টেশন থেকে এলে কি করে একা একা? বড়দা?’

‘মফঃস্বলে বেরিয়েছে।’

‘বলে এসেছো?’

‘তোর বড়দা জানতো আমি সালকে চলে আসতে পারি। আমি না থাকলে সালকের এ-বাড়িতে রেশন আসে না ঠিক মত।’

‘ভেতরে এসে বস।’

কুবের জানতো, মা যেখানেই থাক—যত আনন্দেই থাকুক, স্বামীর পিতৃপুরুষের বসতবাড়ির এই আড়াইখানা ভাগের ঘরে তার মন সব সময় পড়ে থাকে।

ডলি বেরিয়েছে। কচি মেয়ে ঘুমোয় না রাতে। রেখা তাই আগাম ঘুমোচ্ছিল। কুবের জল ভরে দিল কুঁজো থেকে।

‘তোর বাড়ির কদ্দূর?’

সময়টা ক’দিন খারাপ যাচ্ছিল তখন। সে সব না বলে কিছু ফাইন চলছে—এমন একটা ছবি তুলে ধরেছিল কুবের দি ড্রিম মারচেন্ট—ড্রিম সেলার। সে সব শুনে মায়ের যে কি তৃপ্তি

লরি পাওয়া গেল না। ঘণ্টা চারেক পরে বাড়ি ফিরে দেখল মা নেই। সন্ধ্যের ট্রেনে বড়দার ওখানে ফিরে গেছে। বউমাদেরই একজন গম্ভীর হয়ে ঘর গুছোচ্ছে। বুলু তখনও বিড়ে পাকিয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। একদম অ্যাডভান্সড্ স্টেজ। কাউকেই তাই ব্যাপারটা কি—জানতে চাইতে পারল না।

নগেনের মেয়ের জন্মদিনের দু’দিন আগে সব কেনাকাটা করতে হল। পয়লা জন্মদিন। কিছু ধুমধাম ছিল। আগাম কাজ সেরে রাখল কুবের। কেননা জন্মদিনের দিন একটা সাত বিঘের জলকর ইজারা নেওয়ার কথা ছিল। সেদিনই সই-সাবুদের দিন ছিল। তাই আগেভাগে কাজ সেরে রাখতে হয়। সেদিন মা ছিল। কুবের যে নগেনের মেয়ের জন্মদিনের ফ্রকট্রক কিনতে গিয়ে সবাইকে সুখী করার জন্যে খাওয়া-দাওয়া হইচই লাগিয়ে দিয়েছিল, তাতেই মা খুশী, খুব খুশী, আনন্দে গায়ের জামা খুলে ফেলল, ফ্যান চালিয়ে দিতে বললো। হরিরাম সাধুখাঁ বাড়ির বউ। একদা যাদের গন্ধেশ্বরীর টাটে সন্ধ্যে হলেই ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হত—সে বাড়ির বউ হয়ে এসে ইস্তক মা পুরনো যা-কিছু, গৌরবের যা-কিছু সবই আঁকড়ে ধরতে চাইতো প্ৰাণপণে।

তারপর আর মার সঙ্গে দেখা হয়নি কুবেরের। গৃহপ্রবেশের দিন মা না আসাতে কুবেরের খুব মন খারাপ হয়েছিল। মাছ কুটতে দেরি, ডাল সেদ্ধ হচ্ছে না, কলাপাতাগুলো শুকনো—এ সব হতেই পারত না মা থাকলে। কেন যে এল না। এমন শরীর খারাপ ছিল—বিছানায় উঠে বসতে পারেনি। উঃ! যদি বুদ্ধি করে একখানা মোটর ভাড়া করে নিজে গিয়ে কুবের মাকে নিয়ে আসত।

সেদিন নতুন বাড়িতে হইচই—সবকিছুর মধ্যে কুবেরের বার বার মনে হয়েছিল, যে থাকলে সব চেয়ে খুশী হত—সেই আসেনি, আসতে পারেনি। মা যা কল্পনাপ্রবণ–হয়ত ফাঁকা কোয়ার্টারের ঘরে বসে বসেই চোখের সামনে এ-সব দেখতে পেয়েছিল। সেদিন কদমপুরে থাকলে মা যা গণ্ডগোল বাধাতো—এটা হয়নি কেন? ওটা ওরকম কেন? কত কি! তবু, তবু ভাল লাগত কুবেরের।

পরদিন কুবের একখানা চিঠি লিখেছিল। হুবহু মনে নেই। তবে মোট কথা, তুমি না থাকাতে সবকিছু ফাঁকা লেগেছে। ওই দিন তোমারই সব চেয়ে ভাল লাগত। মা কি তার চিঠি পায়নি। পেলে একটা জবাব দিত নিশ্চয়।

কুবেররা পৌঁছতেই শ্মশানে রওনা হল সবাই। ইলেকট্রিক চুলো খারাপ হয়ে আছে। বেদি করা উঁচু জায়গায় পোড়াতে দশ টাকা বেশি নিল। গঙ্গামৃত্তিকা মাখিয়ে নাইকুন্ডুলি জলে ফেলতে ফেলতে তিনটে বেজে দশ। আগুনের ভিতর থেকে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে শেষে নাইকুন্ডলি পাওয়া গেল। ছাই, পোড়া পোড়া চর্বির গাদ-তার ভেতরে ভস্ম মেখে পড়ে ছিল।

কুবের কদমপুর থেকে যাতায়াত করে সালকের বাড়িতে হবিষ্যি করল চারদিন। ঠিক হল শ্রাদ্ধের পরই লরিতে করে মালপত্র নিয়ে নগেন, বীরেন, দেবেন্দ্রলাল—সবাইকে পাকাপাকি কদমপুরের বাড়িতে নিয়ে যাবে। সঙ্গে বংশের নারায়ণ শিলাও যাবে। রাস্তা বাড়বে বলে বাড়িভাঙার নোটিসও পড়ে গেছে এদিকে। সালকেও নতুন হচ্ছে।

লরি ঠিক। রোজান দুধ ঠিক হয়ে গেল নগেনের মেয়ের জন্যে। চারদিনের দিন হবিষ্যিতে বসে নগেন বোমাটা ফাটালো, ‘আমরা যাব না সেজদা।’

কুবের আগেই কিছু আশংকা করেছিল।

রেখাকে জিজ্ঞাসা করেছে কুবের, ‘ওখানে থাকতে তোমাদের অসুবিধে হবে?’

‘অসুবিধে কি? আপনার ভাই থাকলেই আমরা থাকব।’

বীরেনকে জিজ্ঞাসা করেছে, ডলিকে জিজ্ঞাসা করেছে কুবের। এমন করুণভাবে জিজ্ঞাসা করতে হবে জানলে কুবের ঢাউস করে বাড়ি বানাতো না। মা গেল না। বাবার শরীর ভাল নয় বলে বড়দা বড় বউদি দেবেন্দ্রলালকে কলকাতার বাইরে যেতে দেবে না। তাহলে বীরেন চলুক, নগেন চলুক অন্তত।

কিন্তু ডলিও যে সেই একই কথা বলে, ‘আপনার ভাই গেলেই আমরা যাব।’

হবিষ্যের সময় কথা বলতে নেই। এ সব জানলে কুবের সাধুখাঁ বস্তা বস্তা সিমেন্ট ঢেলে পেল্লায় বাড়ি ফেঁদে বসত না। দশাসই দিঘি কাটাতো না। একখানা একতলা বাড়ির ইট, সিমেন্ট, বালি খরচা করে ঘাট বানাতো না। শুধু বুলু আর সে—এই ক’জনার জন্যে এত টাকা মাঠের মধ্যে ঢেলে দিত না। এত সবের পর এখন তোমরা এই পায়রার খোপে বসে বকবকম করে কী সুখ পাবে। একটা নিদারুণ কষ্ট—তা হরফে লিখে ফোটানো যায় না—কুবেরের দুই ভ্রুর মাঝখানে এসে নাক চোখ লাল করে দিল। কথা বাড়াল না কুবের।

বউমাদের একজনের বাড়ির জানালায় দাঁড়ালে কচুরিপানা ঢাকা পুকুর দেখা যায়। বর্ষাকালে সে-বাড়ি যেতে জলে কাদায় রাস্তা একসা হয়ে থাকে। আরেকজনের বাড়িও হাঁটু অব্দি কাপড় তুলে এগোতে হয়। ভাড়ার ফালি ফালি ঘর। কী সুখে এরা এখানে পড়ে থাকতে চায়। নগেন বীরেনের কোন অসুবিধেই হত না কদমপুর থেকে অফিস করতে।

পরদিন কুবের একা একাই হবিষ্যি করল কদমপুরের ফাঁকা বাড়িতে। বুলু স্বামীর মনের অবস্থা বুঝে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিল। আজ খুক করে হেসে উঠলে নির্ঘাত দাবড়ি খেত। ছেলেটা শুধু বকবক করে যাচ্ছে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়ছে। দেবেন্দ্রলাল এর নাম রাখতে চেয়েছিল সৃষ্টিধর।

পিয়ন চিঠি দিয়ে গেল। মা জবাব দিয়েছে। নতুন লোক বলে ঠিকানায় চিঠি পৌঁছতে এত দেরি। এর আগে মরা লোকের চিঠি পায়নি কোনদিন কুবের। বাঁধানো ঘাটের চত্বরের কাছেই খামার হয়েছে। আছড়ানো ধানের কিছু ছিটকে এসে পড়েছে। সেগুলো পাখিরা কুবেরের ভয়ে খুব সাবধানে খুঁটে খাচ্ছিল। খামের ওপর চেনা হাতের লেখা। চিঠিখানা খুলে ফেলল—

কল্যাণবর,

বাবা কুবের। আমি এই শনিবার তোমার ওখানে যাইব ঠিক করিয়াছিলাম। কিন্ত ৫/৬ দিন জ্বরে ভুগিয়া দুর্বল হইয়াছি। ডান হাঁটুতে ভীষণ ব্যথা। শরীর বড় দুর্বল হইয়াছে। তোমার বাড়ি দেখার জন্যও আমার মন বড় অস্থির হইয়াছে। এবার সালকিয়ার বাসার থেকে এত মনঃকষ্ট পাইয়া আসিয়াছি। আর সালকিয়া যাইব না। এবার তোমার নতুন বাড়িতে গিয়া লক্ষ্মীপূজা করিব। আমি একটু সুস্থ হইলেই তোমার ওখানে যাইব।

আমার যাইতে ইচ্ছা করে কিন্তু আমার জন্য হয়ত তোমাদের বিব্রত হইতে হইবে। এই জন্য চিন্তা করি। যাক যদি সম্ভব হয় তোমার বাবাকে নিয়া যাইও। তোমাদের বড়দা আমাকে ওষুধ আনিয়া দিয়াছে।

সৃষ্টিধর ও কুসুমসখি কেমন আছে? তাহাদের আমার শত চুমু দিও! বুলু ও তুমি আমার আশীর্বাদ নিও। তোমাদের কুশল প্রার্থনা করি।

আং মা

মহাগুরু নিপাত। গুরুদশার কাছা যে কতকাল কুবেরের গলায় আছে! চিঠিখানা মুড়ে হাতে নিল। বুলু লম্বা চাতালে বসে লোক দিয়ে শ্রাদ্ধের চাল ঝাড়িয়ে নিচ্ছিল। কুঁড়ো তুলে রাখা হচ্ছে। হাঁস খাবে। চিটে ধান নতুন বসানো সুপুরি নারকেল চারার গোড়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মা দেখলে কি যে খুশী হত।

নতুন কাটা পুকুরে মোচাচিংড়ি ফেলা হয়েছে। মাছওয়ালা জানতে এসেছে, বড় সাইজের চারা মাছ ছিল—ফেলে দিয়ে যাবে নাকি। কুবের মাথা নেড়ে দিল। এখন কিছু দরকার নেই। এত কাজের মধ্যেও মা কুবেরের মেয়ের নাম রেখে বসে আছে—কুসুম।

খুব খিদের মাথায় ভাত খেয়ে কুবের আর নড়তে পারে না। হাত পা অবশ হয়ে যায়। আজ ক’বছর দিন নেই, দুপুর নেই, কুবের মাঠে ঘাটে হরদম ঘুরে বেড়িয়েছে। কোথাও বসেনি। এবার কিন্তু, পরিষ্কার দেখতে পেল কুবের, আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারবে না সে। সেরকম দৌড়ানোর আর মানে পাচ্ছে না কুবের। কি দরকার। এখন এই ছাব্বিশ হাজার টাকা ধসানো পুকুর, জলের ধার, বাঁধানো ঘাট ফেলে তাকে যেতেই হবে একদিন।

এতদিনকার ভাবনা চিন্তা, উদয়াস্ত পরিশ্রম সব জলে গেল। কুবের কোনদিন নিজের জন্যে এত সব করতে চায়নি। তার বিশেষ কিছু দরকারও হয় না। দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর এমন একটা সাশ্রয় মেথডে চলবার অভ্যেস হয়ে গেছে—ইচ্ছে করলেই কলের জল খেয়ে তিন দিন কাটিয়ে দিতে পারে। কতরকম স্বপ্ন ছিল! মা আসবে, বাবা আসবে—রেশনে লাইন দেওয়ার চিন্তা থাকবে না। ক্ষেতের ধান, পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, মাঠের সবজি—সব কিছু কুবের গুছিয়ে আনছিল। হরিরাম সাধুখাঁর ভদ্রাসন থেকে বেরিয়ে এলেই সবার হাতের সামনে কুবের এসব এগিয়ে দিত। এখন এতসব দিয়ে কি হবে। কার কাজে লাগবে। ছেলে, মেয়ে, বুলু, কুবের আর বাড়ির লোকজন মিলিয়ে ফেলে-ছড়িয়ে সব শেষ করা যাবে না। অথচ মা থাকলে যে কী সুখী হত—কী খুশী হত। মা হাতে ধরে কাউকে কোন একটা জিনিস তুলে দিলে বাড়ির বউদের কিছুই বলার থাকত না!

ঘাটে এসেই কুবের কেষ্টবাবুর আবাদ, নবীনবাবুর আবাদ মাড়ানো কোম্পানির ভেড়ির উঁচু পিঠ দেখতে পাচ্ছিল। কোথায় আকাশের অনেকখানি ফাঁকা হয়ে গেছে। সেখানে তাকিয়ে কুবেরের বুকের মধ্যে হুহু করে উঠল। এক দমকে সব মনে পড়ে গেল। মা তুমি কত অল্পে সুখী হতে। একবার ছোটবেলায় আমি সস্তায় অনেক মুড়ি কিনে ফেলেছিলাম। তুমি নিজের হাতে টিনে ভরে ইট সাজিয়ে খাটের নীচে গুছিয়ে রেখেছিলে। কত যত্ন। অনেক দিন ধরে আমরা সেই মুড়ি খাই।

বুলুকে আস্তে ডাকল। ক’দিনে বুলুও অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। কদমপুর চলে আসার সময় একটা পুরনো ট্রাঙ্কের সঙ্গে মার কিছু কাঁথা, দুটো বাঁধানো মাসিক—পত্রিকা আর কিছু কাগজপত্র চলে এসেছে। পরশু বুলু তার ভেতরে মার একখানা অগোছালো ডাইরি পেয়েছে। হাতের চিঠিখানা কুবের বুলুকে দিয়ে ডাইরিখানা আনতে বলল। বুলু খোলা চিঠিখানা পড়ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কুবের বললো, ‘আগে ডাইরিটা নিয়ে এস—।’ বুলু ডাইরি আনতে যেতেই কুবেরের কাছে ফট করে একটা সত্যি কথা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুলু—তার ওয়াইফ, তার সঙ্গে কুবেরের লাইফের হাফটাইমের পর থেকে দেখা হয়েছে। মা সেই হাফটাইমের আগের কথা লিখেছে। কুবেরের ওপরে এক ভাই ছিল। সে মরে গেলে বোধ হয় মা কী খেয়াল হতে এসব কথা লিখেছিল। বুলু ডাইরিটা দিল।

শ্রীগোপাল আয়রন ওয়ার্কস্ সন উনিশ শো পঞ্চাশে একখানা প্রেজেন্টশন ডাইরি বাজারে ছেড়েছিল। তারই পাতার পেছনে পেছনে মা লিখেছে—

‘বহুদিন প্রায় সাতাশ বছর পরে ডাইরি লিখতে বসিলাম। দীর্ঘ সাতাশ বছরে বহু পরিবর্তন আসিয়াছে আমার জীবনে। শুধু আমার জীবনে কেন, সমগ্র জাতির জীবনে! সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাসে। স্বাধীনতা আসিয়াছে। কিন্তু উৎসাহ-উদ্দীপনাহীন জীবনে এই মুক্তির স্বাদের উপলব্ধি করিতে পারি না। নিজের দুঃখ যখন অসহ্য হয়—সর্বদা মৃত্যু চিন্তা মনকে অধিকার করে। অধরকে ছাড়িয়ে বাঁচিয়া থাকা নিজের কাছে নিজের আশ্চর্য মনে হয়। এই তো মানুষের জীবন। কত ক্ষণস্থায়ী—তবু এর জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার সীমা নাই। পরস্পরের প্রতি হিংসা দ্বেষের অন্ত নাই। কিন্তু এক মুহূর্তে ইহা শেষ হইয়া গেল। আরও কতকাল বাঁচিয়া থাকিব জানি না। যে জীবন বিদ্যায় বুদ্ধিতে স্বাস্থ্যরূপে এমন উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল—যাহা সর্বদা নিজের কৃতিত্ব মনে করিয়া গর্বিত হইতাম—এই মুহূর্তের ভিতর তাহা ফুরাইয়া গেল। কিছুতেই তাই বিশ্বাস করিতে পারি না। সত্যি ভগবান আছেন কি না—তাহাকে পাওয়া যায় কি না। যদি তিনিই নিয়া থাকেন, কেন নিলেন? কি অপরাধে নিলেন? কিছুই নাকি নষ্ট হয় না। তবে সেই অবিনশ্বর আত্মা কোথায় আছে? যদি এই মহাবায়ুতে মিলাইয়া থাকে তবে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুকের ভিতরে পাই না কেন? যন্ত্রণায় বুক ফাটিয়া যায় কেন? যদি ভগবান ন্যায় বিচারক হইয়া থাকেন তবে এ আঘাত আমার ন্যায্য প্রাপ্যই ছিল—এ বিশ্বাস মনে স্থান পায় না কেন?

কতবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছি। পরমহংসদেবের জীবনে মা কালীর দর্শনপ্রাপ্তি আমার মনে আশ্চর্য বিস্ময় জাগায়। তিনি নাকি বহুবার কালীর দর্শন পাইয়াছেন। তাই দক্ষিণেশ্বর আমার এত ভাল লাগে। পঞ্চবটীর সাধনঘর আমার ছাড়িয়া আসিতে ইচ্ছা হয় না। মনে হয় সব ছাড়িয়া এই পঞ্চবটীর তলায় থাকিতে পারিতাম, তবে হয়ত মনে শান্তি পাইতাম।

মনের ভিতর জলস্রোতের মত চিন্তাস্রোত আমার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। কতদিনের কত কথা। কত ব্যথা দিয়াছি। ভাল জামা কাপড় দিতে পারি নাই।…

কুবের আর পড়তে পারল না। খাতা বন্ধ করে দিল। এ ভাষা মা কোথায় পেল! তার নিজের ছেলে নতুন বসানো বক ফুলের গাছটার গোড়ায় একটা বেড়াল ছানার গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধেছে। বকতে গেল। পারল না। একবার সেই মৃত দাদার কথা মনে করার চেষ্টা করল। তাও পারল না। সব ভুলে যাচ্ছে। পরিষ্কার রোদ্দুরে তার হাতের আঙুলের কালো কালো দাগগুলো শুধু চোখের সামনে ভয়ঙ্করভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *