॥ তেইশ ॥
লোহার চেন ক্রেনের মুখ থেকে মাটির নীচে নেমে যাচ্ছিল। ড্রাইভার একটা ভাঙা পাইপ এবার চেন টাইট করে ওপরে তুলবে। তেল খোঁজার পাইপ প্রায়ই এমন ভেঙে গিয়ে ভেতরে পড়ে থাকে। সেটা তোলা এক ঝামেলা। তখন লোকগুলোর দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। আজ আর কিছুতেই পাইপ উঠছে না! চেন কড়কড় করে আপত্তি জানালো। তারপর অনেকখানি মাটি ফেটে গিয়ে যা বেরোলো—তা দেখে ব্রজর চক্ষুস্থির। চেনের শেষে তার শিব। তবে আগের চেয়ে অনেক গায়ে গতরে লেগে গেছে। মাটির নীচে পাথর ফুলে যায়? হবেও বা। ব্রজ নতুন বাঁধানো মন্দিরের চত্বর থেকে নীচে নেমে গেলো এক দৌড়ে, ‘আমার—মশাই শুনছেন—ও আমার শিব।’
ধড়মড় করে উঠে বসল ব্রজ। সন্ধ্যে রাতে হাওয়া দিচ্ছিল। তাই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। ঘেমে জল। কোথায় শিব। বেলপাতার পাহাড় হয়ে আছে। ওর মধ্যে শিব নেই তা জানে ব্রজ। এ তল্লাটের লোকজনই শুধু জানে না।
জীবনে কোনদিন ব্রজ খুব কাছাকাছি গিয়ে ঠাকুর দেবতা এর আগে কখনো নাড়াচাড়া করেনি। ব্যাপারটায় যে এত মজা আগে জানা ছিল না। পাথরের গায়ে চন্দনের দাগ দিতে দিতে ব্রজ কতদিন একমনা হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। আভা ফোড়ন কেটে বলত, ‘ভালোরে ভাল। মায়া পড়ে গেল?’
ব্রজ প্রথম প্রথম কিছু বলতে পারত না। তার এই নতুন ভালবাসার কথা লোকজনের সামনে বলতে তার কেমন লজ্জা হত। এসব কি জোরে বলা যায়! একদিন বলেছিল, ‘এ তুমি বুঝবে না আভা—’
‘খুব বুঝি।’ শেষে গুমোরে গুমোরে পা ফেলে ভাঙা চিমনিটির ওপরে গিয়ে বসেছিল আভা, তখন বোধহয় সকালবেলা ছিল, ফট করে ব্রজকে বলে ফেলল, ‘ছেলেপুলে যে পেটে ধরিনি খুব ভাগ্যি। না হলে কপালে শতেক হেনস্তা ছিল।’
‘একথা বলছ কেন আভা? যে জিনিস আমার আর ভাল লাগে না—যাতে আর স্বাদ নেই তা কেমন করে করি। তুমিই বল?
খুব তীক্ষ্ণ গলায় আভা ফুঁসে উঠেছিল, ‘ওরে আমার কচি গোঁসাইরে!’
মেয়েলোকটা গেল কোথায়? এখন মাঝরাত। বাতিল চিমনির ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শব্দ তুলে। বন ধোঁধলের জঙ্গলের আর কিছুই নেই। লোক চলাচলে এককালের নুনের কারখানার কবরখানায় হাঁটাপথের একটা আবছা ছাপ পড়েছে। এই মেটে জ্যোৎস্নাতেও তা চোখ এড়ায় না।
ব্রজর ভেতরটা হুহু করে উঠল। বাইরে বেরিয়ে এসে তেল খোঁড়ার বাতিঘরের কড়া আলোর মধ্যে পড়ে গেল। একেবারে খরখর করে চোখে লাগে। সামনেই স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির। প্রায় শেষ। শিব আমদানি থেকে মন্দির তৈরির জন্যে স্বপ্নে আদেশ পাওয়া—সারা ব্যাপারটাই কেমন গুজব আর মিথ্যের মিলে দিয়ে পর পর খাড়া করে ফেলেছিল ব্ৰজ-কোথাও আটকায়নি। অথচ শেষে রেল লাইনে কুড়িয়ে পাওয়া সেই পাথরখানা নিয়ে এত টান ভালবাসায় পড়ে যাবে আগে কোনদিন ভাবতে পেরেছে! রেলেশ্বর শিব নামটা দিয়ে নিজেই খুব একচোটে হেসে নিয়েছিল মনে মনে। তারপর স্বপ্নে মন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ! আসলে নিজের জন্যে এই পৃথিবীর মাটিতে একটা পাকাপাকির দাগ টেনে দিতে চেয়েছিল বলেই এত কাণ্ড। না হলে আর এসবে তার আর কি দরকার ছিল।
রজনী দত্ত চেয়েছিল তার ছেলে থিতু হোক কোথাও। ব্রজ থিতু হয়েছে। কাঁহাতক আর ঘুরে ঘুরে বেড়ানো যায়।
‘দু’ জায়গায় সংসার পেতে আমার বেলায় ফুরিয়ে গেলে কচি গোঁসাই?
এসব আভার শুধুই ঠাট্টার কথা নয়। কখনো খ্যাপা মোহান্ত বলেও ডাকত। ওই নামেই সে ইদানীং পরিচিত। আভা ফুট কেটে বলত, ‘যে যাই বলুক—যে নামেই লোকে ডাকুক—আমি তো তোমায় সেই দুপুরবেলা থেকেই জানি। আমি ওসবে ভুলছি নে। সংসারে নামিয়েছ তুমি—এবেলায় সরে পড়লে চলবে কেন?’
ব্রজ দত্ত জবাব দিত না বড় একটা। কি হবে দিয়ে। আভা, তুমি আমার ভেতরে ভেতরে বদলানোর কতটুকু জান। আমি বদলাচ্ছি আভা। রোজ পালটে যাচ্ছি। পুরনো কথা তুলে আমাকে পোড়াও। আমি আর গায়ে গা লাগিয়ে মাংসে, ঘামে একাকার হয়ে স্বাদ পাই না, সুখ পাই না। আগে আগে যা হয়েছে সব ভুলে যাচ্ছি।
‘ব্যাঙাচির লেজ খসলে ব্যাঙ হয়—মোহান্ত হয় না গো বুঝলে!’
এমন তরল করেও হাসতে জানে মেয়েমানুষ। যা বলবে, ঠিক ওই চিমনিটির ওপর উবু হয়ে বসে বলা চাই। কেন? আর কি কোন জায়গা নেই। তুমি শিব সেবায়েতের বউ। রেলেশ্বর শিবের সাধিকা। সে কথা ভুলে যাও কি করে।
‘আমি আভা। শুধু আভা। আগেকার সেই আভাই আছি। তোমার ওষুধ ছিল সরস্বতীদি।’
‘গত জন্মের কথা তুলো না গো। পায়ে পড়ি গো। কি হবে ওসব কথায়। তোমার তো কোন লাভ নেই। আমি নানান সংস্কারে জড়িয়ে ছিলাম। এক একটা গেরো আলগা হয়ে যাচ্ছে। কষি আলগা পড়তেই গায়ের ওপরে আগেকার সব দাগ হাতে ঠেকছে বটে—তবু ভুলেও যাচ্ছি, মিলিয়েও যাচ্ছে—’
‘তবে আমাকে গোড়া থেকে এভাবে বানালে কেন?’
কেটে পড়ার আগে আভা এই ধারায় কথা চালাচালি করত খুব। নিশুতি রাতে বেপট জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্রজ দত্ত মনের ভেতরে একা একাই চাপান উতোর কাটছিল। কিন্তু একা কতক্ষণ পারা যায়। আগেকার বউগুলো একে একে হারিয়ে গেল। এককালে ম্যাজিক দেখাতাম আমি। এসব সময়ের হাত সাফাই। টাইম দি মাস্টার ব্রেইন। মাস্টার ম্যাজিসিয়ান।
একবার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্যে ইংরাজিতে উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলাম। সে বছর নোবেল প্রাইজের ছড়াছড়ি। রোজ সকালে কুবের ডিকটেশন নিতে আসত। মুখে মুখে বলে যেতাম। তখন চোখে ফলস চশমা থাকত সব সময়—ভারি ফ্রেম, পুরু কাচ। তখন আমি প্রফেসর দত্ত। ‘জ্ঞানাঞ্জনী’ নাম দিয়ে টিউটোরিয়াল খুলেছি মির্জাপুরে। এগারোখানা ঘরের পুরো বাড়ি। তিন সিফটে ক্লাস চলে। ঢালাও টাকা আসে। খরচাও দু’হাতে। সকালে ঘুম ভাঙবে ভালো কোন বাজনা শুনে। তাই একজন দুঃস্থ সেতারি অ্যাপয়েন্ট হয়ে গেল। আমার কোর্ট মিউজিসিয়ান। তার বাজনায় ঘুম ভাঙতো। সেতার থামিয়ে ছেলেটা গাঁজা টিপে দিত। তখন ঘোরে থাকতাম। মাস্টারদের মাইনে বাকি—বাড়ি ভাড়াও সাতমাস বাকি। এরকমই এক রাতে লেটারহেড, সিল, চাবি নিয়ে কেটে পড়লাম। কুবের জানে।
তখনই সরস্বতী আছে। তারপর থেকেই কত গেরো যে আলগা করে বেরিয়ে আসছি।
কিন্তু এখন এই একখণ্ড পাথরের টানে পড়ে এখানে হড়কে বসে আছি। অথচ টুকরোটা উধাও। মন্দিরের অয়ারিং শেষ। কানেকশন দিলেই ইলেকট্রিক আলোয় বেলপাতার পাহাড় ঠেলে রেলেশ্বর শিব উঁকি দেবে। ব্রজ তার ইট সাজানো ঘরের খোপে ঢুকে গেল। নিবু হারিকেন কিছুতেই নেবাতে পারল না। কল ঘোরে না। তখন রাগে রাগে উলটো দিকে ঘুরিয়ে আলো করে ফেলল ঘরখানা। মেঝে থেকে প্রায় এক মানুষ সমান বইয়ের থাক। নতুন বাঁধাই হয়ে এসেছে। বাবার আত্মজীবনী। রজনী দত্তর জীবন ও সময়।
হাঁটকাতেই বাইশের পাতা খুলে গেল—‘জীবন জিনিসটি জীবনে একবারই ভাঙানো যায়। বারে বারে ভাঙাইলে তাহা খুচরার আন্ডিলে পরিণত হয়। তখন হাতে অর্থ থাকিবার নিশ্চিন্ত মনোভাব হারাইয়া যায়। বরং অর্থ বোঝা হইয়া দাঁড়ায়। চতুর্দিকে মন আছড়াইয়া ফেরে। তাই আমাদের নিজের নিজের মনকে একশো টাকার একখানি নোটের কায়দায় সযত্নে চারভাঁজ করিয়া রাখিতে হইবে। ঠিক করিব, সহজে এই ভাঁজ খুলিব না। খুলিলে ভাঙাইতে হইবে–ভাঙাইলেই ফুরাইবে। আমি মন ছড়াইয়া পড়িবার বিপদের কথা বলিতেছি। একটি মনকে বণ্টন করিলে তাহা শক্তি হারাইবে। বরং তাহাকে একত্র রাখিয়া এক জায়গায় নিয়োজিত করিলে শতগুণ কাজ দিবে। ব্রজর গর্ভধারিণী এই দিকটি বুঝিলেন না। জীবনে একটি রঙই প্রবল। সেই রঙটিকে দীর্ণ করিয়া একটি আলোক প্রজ্বলিত করাই শ্রেয়ঃ। তাঁহার মাথায় কিছুতেই এই সত্যটি আসিল না। আমি চাহিয়াছিলাম, সারাটা শীতকাল ঘানির সরিষা তেলে ব্রজকে ভোলা ভোলা করিয়া মাখাইয়া ছাদে উপুড় করিয়া ফেলিয়া রাখি। তাহাতে শিশুর মাংসপেশি শক্তি অর্জন করে। স্বাস্থ্যই সর্বাগ্রে। তিনি বুঝিলেন না। বেবিসোপ নামে একটি খারাপ জিনিসেই তাঁহার গভীর আস্থা।’
সেইসব কাল কবে কেটে গেল। বাবা বলতেন, দেশবন্ধু গেলেন—আশুতোষ গেলেন—রবীন্দ্রনাথের বয়স হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খাঁ খাঁ করছে। কোন্দিকে এগোবো জানি না। এমন সময় সুভাষচন্দ্র এলেন। ব্রজ নিজেও সুভাষচন্দ্রকে দেখেছে। কি গায়ের রঙ! কি তেজ! এঁরা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন—কলকাতার এত কাছে কদমপুরের কয়েক মাইলের মধ্যে দিশী সরকার একদিন পেট্রোলের খোঁজে মাটি খুঁড়তে লোক পাঠাবে। তাঁদের কাল আর এখনকার কাল—মাঝখানে অনেকগুলো বছর পড়ে আছে।
নতুন অয়েলটাউনের চেহারা এখান থেকেই খানিক বোঝা যায়। রাস্তা তৈরির বড় বড় রোলারগুলো জায়গায় জায়গায় জমাট অন্ধকার হয়ে পড়ে আছে। রাতে ও লরি থেমে নেই। ঠিকেদারদের লোহা আসছে, বালি আসছে, পাথর আসছে। তবে সবই কুয়াশায় আবছা।
সাইটে হঠাৎ দপ করে আগুন ধরে উঠল, গ্যাস বেরোচ্ছে। আগুনের মাথা আট দশ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে। উল্টোদিক থেকে লোহার চেনে বেঁধে ঢালাই সিমেন্টের একখানা ভারি প্লেট টেনে এনে আগুনের মুখ চাপা দেওয়া হল। ব্রজ দেখতে পেল সাহেব দাঁড়িয়ে। অনেকদিন কোন কথা নেই দুজনে। সেদিন রাতে ব্রজ এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছিল সাহেবকে। আভাকে কি সব খাইয়ে একেবারে ঢিলে করে ফেলেছিল। তার পরে পরেই মেয়েমানুষটা যে কোথায় গেল। শিবও নেই।
সকালেই সাহেবকে পেয়ে গেল। পুজোর দুর্বো, বেলপাতা আনতে গিয়ে সাইটের সামনে পোড়ো মাঠে দেখা। সাহেব চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।
‘একা ক’টা জীবন নষ্ট করবে সাহেব?’
নাইট ডিউটির পর চা খেয়েই কাগজ আনতে গিয়েছিল। এখানে শহর ভালভাবে গজালে বাড়িতেই কাগজ পাওয়া যাবে।
লাল চোখ তুলে ব্রজকে দেখল। ভারি একখানা মুখ। চিবুকে, চোখের নীচে ভরাট গাম্ভীর্য দানা বেঁধে আছে। এইসব লোককে কালেদিনে লোকে সফল বলে। এই মানুষটিকে সাহেব নানান বর্ণে দেখেছে। এখনকার চেহারাটাই তার ভীষণ রকমের ভড়ং বলে মনে হয়, ‘সকালবেলা ফ্রেস মাইন্ডে এখন আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই—’
ব্রজ এগিয়ে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল, পায়ে খড়ম, হাতে ফুলতোলার সাজি, ‘কদমপুরে যাওয়া আসা কতদিনের?’
সাহেব রুখে দাঁড়াল, হাতে হাতুড়ি থাকলে ব্রজর মাথা বরাবর সিধে বসিয়ে দিত। কিছুকাল সে নিজে দারুণ একটা স্নিগ্ধ নেশায় বিবিন্ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার নিজের পাখনা পাতলা একটা সুখে প্রায়ই আজকাল ছড়িয়ে যায়, বুকের মধ্যে সব সময় কি হবে কি হবে ভাব। আগে কোনকালে এমন হয়নি সাহেবের, ‘কেন? তোমায় জবাবদিহি করতে হবে?’
‘তোর হাত ধরে বলছি সাহেব—কুবেরকে আমি অনেককাল জানি। মানুষটা ভয়ঙ্কর একা। বাইরের জিনিসপত্র অনেক কিছু বোঝে না। বড় সরল। জেনেশুনে তার কোন সর্বনাশ করিসনে। ছেলেটা আমাদের মত নয়রে। কোন ধাক্কাই সামলাতে পারবে না।’
সাহেবের কাছে কুবের এখন একটি দূরের পাহাড়। আবছা দেখা যায়, কাছে যেতে হলে হাঁটতে হবে অনেক। সেই পাহাড়ের একটি জলধারায় এখন সে আছে, ‘এসব আমাকে বলার অর্থ?’
‘সবই তুমি জান বাছা। আমার আর তোমার মত পোড়া গরু ত্রিসংসারে তৃতীয়টি নেই!’
‘আমাকে তোমার দলে টানছো কেন?’
‘একই গোয়ালের বলে। আপত্তি আছে?’
সাহেব মিত্তির পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে গেল!
ব্রজ ছাড়লো না। সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে গেল, ‘আরও একটি কথা আছে ভাই।’
‘পথ ছাড় বলছি।’
‘ছাড়বো, নিশ্চয় ছাড়বো। তার আগে কথা সেরে ফেলি। আমাদের কতদিনের আলাপ পরিচয়। সে কি আজকের! তা ভাই যা বলব তা কাউকে বলতে পারবে না—’
সাহেব খুব রেগে উঠেছিল। এবারে তেরিয়া হয়ে একটা কাণ্ড করে ফেলত। কিন্তু ব্রজ ফকিরের ঠাণ্ডা মোলায়েম গলায় অবাক হলো। কি কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে। আভা যে এখানে নেই সে তো অনেকেই জানে।
‘আমার স্ত্রীরত্বের কথা বলছি না। যেখানেই থাক একদিন ফিরে আসবেই। আমি অন্য কথা বলছি—’
সাহেব ভেতরে ভেতরে অধীর হয়ে উঠেছিল। বুলুর কথা আর কি জানতে চাইতে পারে। যে তারায় আমি কোনদিন যেতে পারব না—যে আলোয় আমি জেনেশুনে নেশাভরে তাকিয়ে থাকব শুধু—তার কথা আমি কি জানি।
‘আমার রেলেশ্বর শিব উধাও হয়েছেন।‘
‘মানে?’
‘পাওয়া যাচ্ছে না। সাহেব এ আমার বউ নয় যে থানার ডাইরি করে খোঁজাখুঁজি শুরু করব।’ ব্রজর চোখে জল এসে যাচ্ছিল বোধহয়, চোখ মুছে নিল, শেষ বল, শুরু বল জীবনে আমার এখন এই একটাই নেশা সাহেব। ভগবান নিয়ে আগে তো কোনদিন নাড়াচাড়া করিনি। ব্যাপারটা কি জানতামও না—’
‘সব জেনে ফেলেছ?’
‘তা আর বলি কি করে! মুখ্যু মানুষ। শাস্ত্র কি জানি না। নিজের মত করে চন্দনে দাগাতাম। বেলপাতা চড়াতে চড়াতে কি যে হয়ে গেল সাহেব—’
সাহেব এক ধাতানিতে অন্যমনস্ক ব্রজকে ধাতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, ‘তোমাদের শিব শিবানীর কাণ্ডে আমাকে জড়াচ্ছ কেন? আমায় যেতে দাও।’
ব্রজ এবার আটকালো না। কিন্তু এমন কথা বললো—সাহেব আর এগোতে পারল না, ‘দু’পা গিয়েই মাটিতে গেঁথে গেল। ‘সাহেব আমি আগে না জেনেশুনে অনেক ভালো জিনিস নষ্ট করেছি—শুধু সখের বশে, নেশার ঝোঁকে—কিন্তু কোনদিন জেনেশুনে কারও ক্ষতি করিনি। আর তুই?’
সাহেব ফিরে দাঁড়াল।
‘সাহেব তুমি একটি আস্ত শয়তান। নিজের খেয়াল মেটাতে শুশুনিয়ার পাহাড়ি গাঁয়ে বিয়ে করে বসলে। সাহস নেই যে বাপকে বলবে। সে বউও ঘরে তুললে না কোনদিন। তারপর থেকেই জেনেশুনে কত মেয়েকে যে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাছে টেনে এনেছ—ফেলে দিয়েছ, তার ঠিক নেই।‘
‘এই ভোরবেলা এসব বলার মানে? সেয়ানা ভাম কোথাকার!’
‘যত গালাগালিই দাও সাহেব—আমি তোমার মতো জেনে-বুঝে এতো শয়তানি কোনদিন করিনি।’
ব্রজ ফকির উঁচু ঢিবির ওপর দাঁড়ানো। লাল আলখাল্লায় মহাপুরুষের পোজে খাড়া হয়ে আছে। এই সব লোক সব সময় সাহেবের পাশে পুরনো ক্যালেন্ডার হাতে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুরনো তারিখগুলো এরা দাগিয়ে দাগিয়ে রাখে। কবে পূর্ণগ্রাস ছিল, কবে সাহেবের জীবনে রাহমুক্তির প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ল—সবই এদের মুখস্থ আমি যে এখন কি করি।
‘আমিই বা জেনেশুনে কবে কি করলাম ফকির সাহেব! আভাকে তো তুমি জেনেশুনেই—’
‘শুধু ওই একটা কথাই ধরে বসে আছিস।’
‘আর কোনটা ধরব বল? সব কি আর জেনেশুনেই করেছি! আমিও এক ঘোরে থাকতাম। ফলস ব্রাভাডো বলতে পার। কি দেমাক! ডাক দিচ্ছি—আসছে। নাচতে বলছি—নাচছে। কম মজা! বলো? তুমিও একজন পুরুষমানুষ—না হয় এখন মোহান্ত হয়েছ। বুকে হাত দিয়ে বলো তো তুমি হলে কি করতে?’
‘মানুষ বদলায় সাহেব। ভগবানও বদলায়।’ বলতে বলতে ব্রজ ফকির একটা কাণ্ড করে বসল। ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে রাতজাগা লালচোখে আঙুল দেখিয়ে বসে বসল, ‘উঠে এস। উঠে এস বলছি।’
সাহেব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ‘কোথায়?’
‘এই এখানে। আমার লেভেলে উঠে আসতে পারবে?’
ঢিবির ওপরে লাফিয়ে সহজেই উঠতে পারতো সাহেব। কিন্তু ‘লেভেল’?
ব্রজ তখনও কথা বলে যাচ্ছে, ক্রেনের টঙে তোলা শুঁড় বরাবর চোখ ‘মনের এখানে দাঁড়িয়ে তুমি খোসা ছড়ানো আলো অবধি দেখতে পাবে। আলোর গায়ে ছাল উঠে গেলে তা কত সুন্দর। ছাল ছাড়ানো আলো পর পর পুবে, দক্ষিণে, উত্তরে, পশ্চিমে টানানো—’
‘নাটক হচ্ছে! রেলেশ্বর শিবের কাছে আমি তো মানত করতে আসিনি—’
‘এসব দেখতে মানত লাগে না সাহেব। এসব দেখার চোখ আস্তে আস্তে তৈরি হয়। ভেতরে ভেতরে বদলে গিয়ে সেই চোখ ফোটে—’
বদলের কথা ব্রজ কতটুকু জানে। সাহেব তা নিয়ে আর টানাটানি করল না। তবে একথা ঠিকই, একটা লোক পালটায়। ওলট-পালট হচ্ছেই! সূর্যের আঙটায় ঝোলানো এই দুনিয়াও প্রদক্ষিণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ঘুরে নিচ্ছে। সেসব কথা ভূগোলেই আছে। কাঁটা বেছে মাছটুকু তুলে নেওয়ার মত প্রায় মানুষকেই সাহেব আলাদা করে ফেলতে পারে। আড়াই শো গ্রাম অভিমান, তিরিশ কেজি মাংস, হাড়—বারো কেজি আটশো। কিন্তু বুলু প্রায় সবটাই কোন গভীর কিছুর নির্যাসেই ষোল আনা তৈরি। তা বেছে বেছে আলাদা করা যায় না।
সেই উঁচু ‘লেভেলে’ ব্রজকে ফেলে সাহেব এগিয়ে গিয়েছিল খানিকটা। নিজে নিজেই ফিরে এল। ‘বউদির কোন খোঁজই করনি? বেঘোরে কোথাও—
‘কপালে থাকলে হবে। আমার কি এখানে এসে শিবতলা বানানোর কথা ছিল?’
তাও তো শিব উধাও। সত্যি কার এতো বুকের পাটা? শেষে শিব লোপাট।’
অনেক দিন পর সাহেব ব্রজ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছিল। মোহান্তর সমস্যা অনেক। বউ বেপাত্তা—শিব নিখোঁজ। এরই মধ্যে ব্রজ খুব আত্মীয়ের গলায় বললো, ‘আমি বলি কি সাহেব—তুমি না হয় কদমপুর যাওয়া বিলকুল ছেড়ে দিলে! কি হয় না গেলে। মেয়েমানুষ কম তো ঘাঁটোনি।’
সাহেবের গায়ে ফোসকা পড়ে গেল। ফের এক কথা। কিছুই হয়নি—এইভাবে সাহেব চলে গেল। ব্রজ বাইরে ঢিবির ওপর সাত সকালে পড়ে থাকল। কিছু একটা যদি বলতো সাহেব।
মেয়েদের কত সুবিধে। হাঁটতে শিখেই ব্রত, উপোস। পুণ্যের নামে কষ্ট করতে করতে অচলা ভক্তির আবহাওয়ায় গিয়ে পড়ে। তখন ভগবান দাও, ছেলে দাও, স্বামী দাও—সবকিছুর মধ্যেই একটা মানে খুঁজে পায়। পুরুষলোক হয়ে ব্রজ দত্ত শুধু অবিশ্বাস করতেই অভ্যস্ত ছিল। কতবার কত ঢঙে কত রঙে নিজে নিজেই সাজলো—অন্যদের বিশ্বাস করাতে চাইল, অথচ নিজে তখন আদৌ বিশ্বাস করে না। ম্যাজিসিয়ান ব্রজ, ব্রজ দি সেলসম্যান, নোটমেকার ব্রজ, প্রফেসর ব্রজ, ডিরেক্টর ব্রজ। কত কি! শেষে নিজেরই একটা মনগড়া সাজানো ব্যাপারে জড়িয়ে গেল। এমন হবে আগে ভাবতেও পারেনি। কবে যে রেল লাইনে পাথরখানা কুড়িয়ে পেয়েছিল তা আর মনে নেই। এখন শিব সেবায়েৎ ব্রজ মোহান্তর নামে মানিঅর্ডারের টাকা আসে। লোকে লাউটা মুলোটা দেয়। গরুর দুধও আসে। এক্কায় চড়ে মাঝে মধ্যে এদিক—ওদিক যেতেও হয় ব্ৰজকে।
শিবসাধিকা আভা তো এই চেয়েছিল। নিশ্চিন্তি আর নিয়ম। না হয় কপালময় চন্দন মেখে সারাটা দিন এলোচুলেই বসে থাকতে হতো। আগের মতো তো দুশ্চিন্তার আর কিছু ছিল না আভার। সরকারী লোকজনও আর ধর্মস্থানে ঘা দেবে না। যতদিন আয়ু শিবই সব যোগাবেন।
ব্রজ দেখতে পাচ্ছে, সাহেব তার নতুন কেয়ারটেকারের বারান্দায় বেরিয়ে এল। এতদূরে হাওয়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সাহেবের গলার এক কলি গান এখানেও উড়ে এসে পড়েছে। কি যে হলো ছোকরার।
সিঁড়ির নীচের র্যাক থেকে শু বের করে নিল সাহেব। কালি, তারপর বুরুশ। অবাক হয়ে গেল, জুতোয় বুরুশ বুলোনোর তালের সঙ্গে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতই গায়—সব মিলে যায়। ক’টাই বা জানে। বাঁ পায়ের জুতোতে কালি দিয়ে বুরুশ হাতে নিয়েই গলা ছেড়ে দিল—’মনে রবে কি না রবে আমারে-সে আমার মনে নাই মনে নাই।’ কথা গুলিয়ে গেল কিনা বুঝতে পারল না। কতকালের গান। বাঁকুড়ায় ক্রিশ্চিয়ান কলেজের হসটেলে গরম কালে সন্ধ্যেবেলা এসব গান গাইত। তখন চাপা গরম চিরে একরকমের হাওয়া বেরিয়ে পড়ত। গানেরও বয়স হল। একথা মনে হতেই সাহেবের শরীরের ভেতর দিয়ে সুর উঠে এলো। তাতে এইমাত্র ভাবা কথা ক’টি বসিয়ে নিল সাহেব-আমার গানেরও বয়স হল। মরি মরি এ যে কতদিনের-আমার গানেরও বয়স হল। বুরুশ থেমে নেই। চলন্ত ট্রেনের চাকায় যেমন সুর থাকে—একেবারেই তাই এসে গেছে বুরুশে। সেই সুরে যে গান ইচ্ছে বসিয়ে নাও। দু’পাটি জুতোর নাকই চকচক করছে। ঘরে ঢোকার একপাশে বারান্দায় আলগোছে জুতোজোড়া রাখল সাহেব। বেশ পূজনীয় দূরত্ব দিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার জুতোর দিকে তাকাল। একবার কুবের রোডে পা দেওয়া মাত্র ধুলোয় ভরে যাবে। কিছু করার নেই।