॥ ঊনিশ॥
সারেঙ মেদনমল্ল দ্বীপের তীর ঘেঁষে লঞ্চ নোঙর করল। তবু ডাঙা থেকে বেশ দূরে। বলা যায় না, এই নিশুতি রাতে বেপট জায়গায় কোন কিছু ডেকে উঠে আসে যদি।
বোরো চাষের কামলারা ছোট ছোট কুজির ভেতর এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। জঙ্গল হাসিল বুনো গাছের ডালপালা জড়ো করে কারা আগুন দিয়েছিল। তার নিবু আগুনে মেদনমল্লর পোড়ো দুর্গটা ঠায় দাঁড়ানো। কেবিনে গুমন্ত কুবের এক ঝটকায় জেগে গেল। ক্লা ক্লা শব্দ তুলে একটা মাছখেগো পাখি এই ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় বেরিয়ে পড়েছে। বুঝতে পারেনি, রাত শেষ হয়নি। অন্ধকার ঘরে কুবেরের খুব ভয় ধরে গেল। আনপড় মেয়েমানুষটা জ্যোৎস্নার গোরে পাটাতন থেকে পড়ে যায়নি তো। শীত চলে গিয়ে হপ্তাখানেক খুব হাওয়া দিচ্ছে। কপালে লেগে হাওয়াতেই প্রায় নেশা ধরে হাওয়ার যোগাড় হয় এক সময়।
ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এসে ডেকে দাঁড়াল। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে ‘বড়বিল’ নোঙর করে পড়ে আছে। ‘ডাহুকের’ সামনেই চাঁদ আকাশের কোণ বেছে নিয়ে ঝুলে পড়েছে। লঞ্চের ডগায় খানিক অন্ধকার স্তূপ হয়ে আছে। কুবর এগিয়ে গেল। তারপর সাবধানে পাঁজাকোলে তুলে ফেলল।
কেবিনে ঢোকার মুখে আভার ঘুম ভেঙে গেল, ‘আমি কোথায়? তুলে আনলে কেন?’
‘না আনলে ঢুলতে ঢুলতে জলে পড়ে যেতে কোন সময়!’
‘গেলে যেতাম!’ তারপর বিছানায় বসে বলল, ‘দু’বার ঘুরে গেলাম—তুমি ভোঁসভোস করে ঘুমোচ্ছিলে। জাগাইনি আর। লঞ্চের গলুইতে বসে মনে হচ্ছিল—আমি বুঝি সবার আগে, তোমাকেও পেছনে ফেলে নদীর পর নদী পার হয়ে যাচ্ছি।’
কুবের গায়ে কাঁথা টেনে দিল, ‘পা ঢেকে বস।’ কী মনে হতে বলল, ‘গলুই কখনো আগে যেতে পারে না আভা। নৌকো, লঞ্চ-কাঠকুটো, হাল, পাল, মাস্তুল সবই একদিন হারায়—ধসে যায়, পড়ে যায়, ডুবে যায়—পড়ে থাকে শুধু গলুই।’
‘কি রকম?’
‘ঝড়ঝাপটার কথা ভেবে মিস্ত্রিরা এই জায়গাটুকু লোহা দিয়ে মুড়ে দেয় একেবারে। বছর বছর রং হয়। আমাদের ওখানে পুকুর কাটতে গিয়ে সাত হাত মাটির নীচে মাছ আঁকা রুপোর পাতে মোড়া একখানা গলুই উঠেছিল। আগে নদী ছিলওখানে। দেড় দু’শো বছর আগে কারও নৌকাডুবি হয়েছিল। সব ধুয়ে মুছে গিয়ে গলুইটা পড়ে ছিল—’
‘ওটা কি কুবের?’ বলতে বলতে কুবেরের বুকের মধ্যে চলে এল। কুবের চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল, ‘কই? কোথায়?’
‘ওই যে—’
‘ওটা তো মেদনমল্লর দুর্গ। পেল্লায় দিঘি আছে সামনে। দামে ঢাকা বলে এমন জ্যোৎস্নাতেও রঙ ফোটেনি। নইলে—’
‘চিকচিক করত?’
কুবের নিজেকে সামলাতে পারল না। এমন পোড় খাওয়া মেয়েমানুষটা কি করে জলের সামনে, আলোর সামনে খুকিটি হয়ে যায়। আর পাঁচজন পুরুষে যা করে, কুবের তাই করল। আলিঙ্গন ওরফে জাপটানেয়, তারপর বিছানায়। প্রথম রাতটা ঘুমিয়ে কুবেরের নাক মুখ চোখে নেশাভাঙা একটা আরাম লেগেই ছিল। ভোররাতেই ফুরফুরে হাওয়ায় সবকিছু সহজ হয়ে গেল তার কাছে। আভা আজ আর বললো না, ‘শেষে এ তুমি কি করলে—‘
বরং আভা ফরফর করে উঠল, ‘নইলে চিকচিক করত? নদীর মতন? দিঘির সামনেই দুর্গ?’
‘ভোর হলে দেখতে পাবে—’
‘আমায় যেতে দেবে ওখানে? দিঘির সামনে? নেমে দেখব?
‘এত ভয় কর আমায়?’
‘তোমার দাদা নিজে কোনদিন কিছু দেখায় নি। শুধু বলত, বিকেলের আকাশে তাকিয়ে দেখো—যা ভাববে, তেমন ছবি হয়ে মেঘ ভাসছে। বল কুবের, রোজ আকাশ দেখা যায়? শেষে আমায় সাহেব মিত্তিরের সঙ্গে জুতে দিয়েছিল। লোকটা আমার গন্ধে গন্ধে ফিরত।’
‘বল, ভাল লাগত। লুকোচ্ছ কেন!’
‘না কুবের—আমি কিছু লুকোবো না। আমার যা বয়স তাতে কোন কিছু আর লুকোনোর মানে হয় না। আমার বিচ্ছিরি লাগত। আমায় নিয়ে শ্যাল কুকুরের মত টানাটানি লেগে গেল একদিন। আমিও একটা মানুষ—আমারও ঘোর লাগত, নেশা ধরে যেত এসব দেখে, কিন্তু কুবের—’
‘থামলে কেন?’
‘শুধু আমার জন্যে কেউ বসে আছে—এটা ভাবলেই ঘোর লেগে যেত। হাজার হোক আমি মেয়েমানুষ। ‘
চাঁদ যাওয়ার আগে খুব আলো দিচ্ছিল। কুজি থেকে লোকজন বেরিয়ে পড়েছে। মাল্লাদের একজন চা নিয়ে এল। লেপে পা ঢেকে গরম চা মুখে দিতেই কুবেরের পরিষ্কার মনে হল, আভার সঙ্গে তার পরিচয় অনেকদিনের, মানুষটা বড় আপন তার।
রোদে বেরোতেই ‘ডাহুক’ থেকে কাঠের পাতলা স্লিপার ফেলে দিল পাড়ে। তার ওপর দুলতে দুলতে টাল সামলে কুবের আর আভা মাটিতে গিয়ে পৌঁছল। সামনেই মেদনমল্লর দুর্গ। আভা মাটিতে আটকে গেল। এতবড় একটা জিনিস এই নদীপথে কতকাল দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কুবেরকে পেছনে ফেলে ছুটে গেল। সেই দিঘি, পরীর সারি, দামভরা পুরু আস্তরণের ওপর পাখিরা বসে। আভাকে দেখে তারা একটও নড়ল না।
কুবের পেছনে পড়ে গিয়েছিল। চত্বরে এসে দাঁড়াতেই আভা বললো, ‘এত পরিষ্কার—কাল বিকেলেও এখানে লোক ছিল মনে হয়।’
কথাটা কুবেরের কানে গেল না। নদী থেকে পাইপ বসিয়ে দশ ঘোড়ার পাম্পের সঙ্গে লাগানো হয়েছে। চার ইঞ্চি মোটা নল দিয়ে জল এসে পড়বে মাটিতে ভিনদেশী কামলারা হালে মোষ জুতে ফেলেছে। জমি তৈরি হচ্ছে। আবাদ হবে।
মাথার ওপর বিনবিন আওয়াজ শুনে ওপরে তাকাল কুবের। তার সঙ্গে সঙ্গে আভাও তাকাল। উঁচু খিলান থেকে একটা বুনো গাছের শেকড় ঝুলে পড়েছে। তার আষ্টেপৃষ্ঠে বড় সাইজের একটা মৌচাক ঝুলে আছে। খানিক জায়গা তার পোড়া পোড়া। চাকের আশেপাশে মৌমাছিরা দল বেঁধে পাক খাচ্ছে।
‘কাল পূর্ণিমা ছিল। কামলারা হয়ত আগুন দিয়ে মধু বের করে নিয়েছে—‘বারণ করনি কেন কুবের? মৌচাক সুলক্ষণ। ভরভরাটি করে তোলে সবকিছু।’ এখনও সংসারের নেশা লেগে আছে মেয়েটার চোখে। কুবের পরিষ্কার কিছু বললো না। শুকনো চাকের চারদিকে মাছিগুলো ঘুরে মরছে। কুবের আভাকে সেখানে দাঁড়াতে দিল না, মিথ্যে মিথ্যে বললো, ‘মধু নেই—এখন দেউলে মাছিগুলো যাকে পাবে কামড়াবে―চলে এস।’
ক্যাম্প খাটানো তাঁবুর ঘরে ঢোকার আগে আভাকে সামলানো দায় হল। ফাঁকা বিরাট চত্বর থেকে নড়তে চায় না। দুর্গের সামনের দিঘির দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকল। বোধহয় কুবেরকে লুকিয়ে দু’বার চোখ মুছল। কুবের যতবার উঠে আসতে বলে ততবারই আস্তে আস্তে বলে, ‘এমন জায়গাও ছিল কুবের। এমন জায়গাও আছে—‘
জায়গার কথা শুনতেই কুবের খচ করে স্টার্ট নিল। ‘জান আভা, পৃথিবীটা জায়গায় জায়গায় ভর্তি। তুমি যত চাইতে পার তার চেয়েও বেশি জায়গা আছে—’
আভা চত্বরে দাঁড়ানো কুবের সাধুখাঁর মুখের দিকে তাকাল। চোখ লাল হয়ে উঠেছে। চুল উড়ুউড়ু। মুখটা ফুলে উঠেছে। এ কার কাছে সে বসে আছে? মুখে বললো, ‘আমাদের পোড়াতে কতটুকু জায়গা লাগে কুবের?’
কুবের তার নিজের কথার তোড়ে বলতে যাচ্ছিল, ‘জায়গা থাকলে কি হবে? আসল হল দখলে রাখা।’
আভার কথায় ঘাবড়ে গেল। প্রথম কোন জবাবই দিতে পারল না। শেষে বললো, ‘ভোরবেলা কিসব আজেবাজে বকছো। তাঁবুতে যাবে তো চল—’
‘তুমি এগোও। যাচ্ছি। আরেকটু দেখে যাই—’
দুপুরের মধ্যে সারা তল্লাট জমজমাট হয়ে উঠল। সত্তর আশিজন কামলা চুচকো ঘাস তুলে তুলে পাহাড় করে ফেলল। জমির মধ্যেই তা আস্তে আস্তে পচে সার হয়ে যাবে। দু’ দুটো পাম্প মেশিন নদীর অফুরন্ত জল তুলে জমির উপর উগরে দিচ্ছে। খাঁড়িতে কারা লাফা বসিয়েছিল। তাতে হরেক মাছ ধরা পড়েছে। কুবের কিছুটা নজর পেল।
ভাত খেয়ে উঠে আভা হরিতকী তলায় গিয়ে পাখিদের ঠোকরানো একটা হরিতকী পেল। ধুয়ে মুখে দিতেই মুখের ভেতরটা আজব কষে খুব সুস্বাদু লাগতে লাগল। চারদিক খোলা, জোয়ারের জল মাটির ওপর অনেকটা উঠে এসেছে, কুবের রোদে পিঠ দিয়ে একমনে মৌজা ম্যাপ দেখছিল।
‘চল কোথাও ঘুরে আসি—বেশ অজানা জায়গা দিয়ে—যে পথে কেউ কোনদিন যায়নি।’
কুবেরের ওঠার ইচ্ছা ছিল না। জে.এল আর ও. অফিসে মেদনমল্ল দ্বীপের একটা সরকারী বিলি ব্যবস্থার চিঠি আদায় করতে কুবেরের কম ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে না। কাগজপত্র নিয়ে বসেছিল। এতবড় জায়গা কম্পাউন্ড ওয়াল দেওয়ার কথাও ওঠে না। কিন্তু একখানা সরকারী কাগজ হাতে থাকা দরকার। মালিকানার একটুখানি চিহ্ন অন্তত।
‘তুমি ঘুরে এস। দুর্গের ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পার—’
‘একা আমার ভয় করে। হঠাৎ যদি ভয়ঙ্কর চেনা বলে ঠেকে যায়!’
কথাটায় কুবেরের ভেতর-অব্দি একেবারে গুড়গুড় করে ডেকে উঠল। অবাক হল। আভা জানল কি করে? এইসব জেনে ফেলে বলে পরের বউ হলেও আভা ফট করে তার নিজের মেয়েমানুষ হয়ে গেছে।
কুবের প্রথমে উঠল না। উঠতে পারল না। মৌজা ম্যাপের ভেতর দিয়ে নদীর দিকচিহ্ন ধরে ধরে তার চোখ এই মেদনমল্ল দ্বীপ খুঁজে ফিরছিল। কোমরের নীচে, পেছনে হাড়ের ভেতর আজকাল ওঠা-বসার সময় মড়মড় করে আওয়াজ হয়। গালে, কপালে কালো কালো ছোপ ছড়িয়ে পড়েছে। ভদ্রেশ্বর বলে, ‘ওসব কিছু নয় সাধুখা মশাই। নোনা মাটির দাগ বসে যাচ্ছে গায়ে গতরে। পয়সা হলে কিছু খেসারত মা লক্ষ্মী নেবেনই।’
কুবেরও নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে—আমার গায়ে কোথায় কিসের দাগ-দাগালি হল, তা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর বয়স নেই। আমার তো আর ফিরে বিয়ে হচ্ছে না। পুরুষমানুষের ওতে কি আসে যায়। তাছাড়া এই দেহটা এখন তো পাবলিকের গালাগালি, হিংসে, শীত-গ্রীষ্ম—সবই এর ওপর দিয়ে এতদিন বয়ে গেছে—আরও যাবে।
হঠাৎ তার নিজের নাম অনেক উঁচু থেকে ভেসে আসছে শুনতে পেয়ে কুবের উঠে দাঁড়াল।
আভা দুর্গের চওড়া দেওয়াল ধরে অনেক উঁচুতে উঠেছে। সেখান থেকে নামতে পারছে না। হাওয়ায় শাড়ির আঁচল পতপত করে অনেকখানি উড়ছে। একটা দৃশ্য বটে। কুবের স্পষ্ট দেখল দিঘির ধারের একটা পরী প্রাণ পেয়ে উঁচুতে উঠেছে I
এইসব ছেলেমানুষি আজকাল একদম বরদাস্ত হয় না কুবেরের। কিসব ছেলেমানুষি।
‘নেমে এস।’
‘ভয় করছে।’
‘খুব পারবে।’
‘একা ভয় করছে। তুমি এস—’
কুবের টের পেল, এখন আভা পড়ে গেলে তার খুব কিছু যাবে আসবে না। আভা যে ভোররাতে ‘ডাহুকে’ উঠে এসেছে—সেকথা কেউ জানে না। এত বড় দ্বীপের যে কোন জায়গায় মাটি চাপা দিলেও কেউ জানতে পারবে না। শুধু কুবেরের কদমপুরে গিয়ে চুপ মেরে থাকতে হবে।
দুর্গের ভেতরে ঢুকে কুবের অনেক কষ্টে আভাকে নামালো। নেমে ফেরার পথে সেই খিলানের ভাঙাপথ, শূন্য বাগান, দিঘির দাম ফুঁড়ে সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে। সেই প্রাচীন শূন্যতার মধ্যে কুবের আভাকে প্রাণভরে একটু চুমো খেল, ‘বাঃ! বেশ মিষ্টি গন্ধ তো।’
‘হরিতকী খেয়েছিলাম একটু আগে—তোমার দ্বীপের গাছের—’
‘গরম জামা আনোনি কেন?’
কুবেরের কোলের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় আঁটোসাঁটো গড়নের মেয়েমানুষটি খুব রস করে বললো, ‘নাগো। এইতো বেশ নরমে গরমে আছি—’
কুবের ধপ করে নামিয়ে দিল। দক্ষিণ থেকে হাওয়া উঠে এই ফাঁকা ডাঙাগাঁথুনির বিশাল কাঠামোর মধ্যে পড়ে লতাপাতা, গাছগাছালির কচি ডাল ধরে সরসর করে বয়ে গেল। তখন কুবের ভীষণ জোরে আভাকে আগের চেয়েও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বুকের মধ্যে যত দূর পারে ঠেসে ধরে কুবের বললো, ‘বিশ্বাস কর—এসব জায়গা আমার ভীষণ চেনা আভা। আমি বোধহয় এখানে ছিলাম কোনদিন। আমি সব বুঝতে পারি—’
‘উঃ লাগে না? ছাড়ো বলছি।’
আভার কুঁচকে ওঠা নাক মুখ চোখ দেখে ঠিক এই সময়ে কুবের একেবারে সিধে তার নিজের নাকের ওপর একটা ধাক্কা খেল। কি বিশ্রী দেখতে হয়ে গিয়েছিল আভার মুখ।
নিমেষে দু’জনের কাটান-ছাড়ান হয়ে গেল। বাইরে দিঘির ধার দিয়ে আভা তাঁবুতে চলে গেল, একা একা কুবের সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল। তার ঘাড়ে গলায় এখন অনেক মাংস। চোত-বোশেখে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি জড়িয়ে এখনও সে সন্ধ্যের ফুরফুরে হাওয়ায় কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে পারে, প্রেম করতে পারে, এসব ভালোভাবে করার রেস্তও তার হয়েছে। অথচ কিসের মায়ায় জমি জায়গা চাষ —আবাদের পিছনে ছুটোছুটি করছে নাগাড়ে কয়েক বছর।
হাল থেকে ছাড়া পেয়ে গোটা চারেক মোষ দিঘির ধারে নেমে এসেছে। এত ঘাস, এত পাতা এর আগে পায়নি বোধহয়। দূরে জেলেদের নৌকা ভিড়ছে। এবারে বড় বড় ছুরি দিয়ে কিম্ভূত সব সামুদ্রিক মাছের গা চিরে চিরে রোদে শুকোনোর জন্যে টানিয়ে রেখে যাবে। এদেরই দেখতে পেয়ে কুবের প্রথমদিন দুর্গের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে চটে উঠেছিল।
পাখিরা আর ক’দিন পরেই উড়ে যাবে। কিছু চলে গেছে। তাদের ভাঙা বাসায় নতুন নতুন পাখি এসে বসছে। এরা ওপর দিয়ে যাবার সময় কোথাকার কি জিনিস—ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, চিনতে পারে।
পৃথিবীর এক জায়গায় শহর, এক জায়গায় কারখানা, খানিক জুড়ে নদী, গাছপালা, জঙ্গল। আমরা যে কোন একটার ভেতরে বসে থাকি বলে অন্যগুলো ঠিক ঠিক চিনতে পারি না। ভদ্রেশ্বরের ফেলে যাওয়া সিগারেটের একটা ফাঁকা প্যাকেট মেদনমল্লর চত্বরে পড়ে আছে। এমন জায়গায় এ জিনিসটা একদম মেলে না। বুড়ো দিনের বেলায় দিঘির ধারেই কাটাত। রোজ পাখির মাংস না হলে চলত না।
কামলাদের ঠিকেদার বলে গেল, নতুন ধানের খানিক বীজ ফেলা বাকি ছিল। ভাল অঙ্কুর বেরিয়েছে। এবারে ভিজে ধান, বস্তা বোঝাই দিয়ে মুখবন্ধ হাঁড়ির ভেতরে রাখা ছিল চারদিন। রাতে শিশির, দিনে রোদ খাইয়ে সুন্দর কলা বেরিয়েছে। কুবের তার সঙ্গে সঙ্গে গেল।
বিঘে দেড়েক জায়গা জুড়ে পচা গোবর, নানান্ সার ফেলে মাটির হরেক কারকিত করা হয়েছে। চারদিকে জল বের করার নালা। একজন সমান তালে ধান ফেলতে লাগল। হাতের মুঠোর ভেতর থেকে ছররা হয়ে ধান ছিটিয়ে বেরিয়ে আসছে—আর নরম কাদায় পড়ে গেঁথে যাচ্ছে। লোকটার পেছন দিয়ে শুধু চষা মাটির মাঠ—যতদূর দেখা যায়—শুধু তাই—তার পরেই জল, নদী—দূরে দূরে আর অন্য কোন দ্বীপের জঙ্গল, গাছপালা।
আভা অনেকক্ষণ কুবেরের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে সস্তার একটা আধা—গরম কাপড়ের ব্লাউজ। কাঁধে চাদরের মত একটুখানি মোটা কাপড় পড়ে আছে।
‘এসব ধান হবে একদিন।’
‘রীতিমত ধান। একটা চারা থেকে দশ বারোটা বিয়েন বেরোবে আভা—’
‘বুলু জানে এসব?’
‘কানে নেয়নি কোনদিন। ও বলে, এসব নাকি আমার নেশা।’
‘মেয়েটা কিন্তু ভাল।’
‘তা আমার চেয়ে আর কে বেশি জানে!’
‘আমিই জানি! তুমি তার কতটুকু বোঝ?’
কথায় কথা যে কোন্ দিকে যাবে, তা বলা যায় না। আভা সাবধান হয়ে গেল। কারখানা গাঁয়ে তেল খোঁজার আড্ডায় বুলুকে দেখে আভা প্রথমদিন চমকে উঠেছিল। রেলেশ্বর শিবের কাছে মানত করতে এসেছিল বুলু। রেলেশ্বর শিব নাকি ভয়ঙ্কর রকমে জাগ্রত। সেখানকার দু’টি জাগ্রত সেবক আভার নিদারুণ পরিচিত—একজন ব্রজ দত্ত, অন্যজন সাহেব মিত্তির। সেই সাহেব বুলুকে এনেছিল।
‘তুমি কি জান বুলুর? সত্যি করে বল। আমি সব জানতে চাই।’
‘রহস্যও বোঝ না। নিজের বউকে চোখে চোখে হারাও! অথচ পলকে পরের বউ কবজা করে বসে আছ!’
আভা ফিরে যাচ্ছিল। পেছনে কুবেরকে দেখে তাঁবুর পাশ কাটিয়ে উত্তরের নীচ জলাভূমির উঁচু পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে হাওয়া কিছু বেশি ঠাণ্ডা। এখন তাকে কেউ আবার কোলে তুলে নিক। আচ্ছাসে জাপটে ধরুক। এই নিশ্চিত ভাবনাহীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কতকালের স্বপ্নের আনন্দ, ভালবাসা, চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কোথাকার বিশাল পৃথিবীর ঝুলকালি দিয়ে এটুকু সে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। তবু পরিষ্কার বুঝতে পারল, তার মাথার ভেতর দিয়ে ড্রিলিংয়ের পাইপ নেমে যাচ্ছে। লোহার চেন কড়কড় করে ওপরে উঠে আসছে। আর দুর্গের চাতালে দাঁড়িয়ে সাহেব মিত্তির একটা কিম্ভূত বন্দুক বাগিয়ে ঠিক তার বুকের মাঝখানে টিপ করে নিরিখ করছে। হয়তো গুলীতে বুকটা ফেটে গেলেই সেখান থেকে গলগল করে তেল বেরিয়ে পড়বে। সেই তেলের জন্য কতলোক কতকাল মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে। তাই আভাকে সেদিন ব্রজ প্রায় নীলামে তুলেছিল।
‘আমি জানি আভা—তুমি রহস্য করনি। তুমি এমন কিছু জান—যা আমাকে বলতে চাইছ না। একথা বুঝতে পেরেই আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে—হাত দিয়ে দেখ।’
আভা হাত রাখল, ‘শার্টের বোতাম লাগাও না কতদিন?’
‘যতদিন এই জমি-জায়গা চাষ-আবাদের পেছনে ঘুরছি—’
‘পড়ে যাবে। সাবধানে দাঁড়াও—‘
টাল সামলে নিল কুবের। বড় বড় জলের পোকা শ্যাওলা মেখে এক একবার ভেসে উঠছে—আবার ডুবে যাচ্ছে, ‘পড়ব না। তুমি বল আভা—আমি সব জানতে চাই। বিশ্বাস কর আমি ভীষণ একা। আমার কেউ নেই। আমার যা আছে সবই জঞ্জাল। তা শুধু জমে যায়। জায়গা আটকে রাখে। অথচ ভেতরে তাকাও, আমার চোখে তাকাও, সেখানে হলহল করছে—একদম ফাঁকা—’
‘আমায় ফেলে দেবে নাকি? পাগলের মত কোথায় উঠে এসেছ দেখ একবার! দু’জনেই নীচে পড়ে যাব একসঙ্গে—
কুবের নেমে এল। আভাও এল।
তখনও সেই লোকটা সমান মাত্রায় ধান ফেলছে। অঙ্কুরের জট খুলে ধানগুলো ছিটকে গিয়ে নতুন মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে।