॥ ছয় ॥
‘কী হলো—’, পারলে বুলু জোরে কেঁদে উঠতো। এক একদিন মনে হয় এত চাপে বুকের পলকা হাড়গুলো মুড়মুড় করে ভেঙে যাবে। অথচ তখন খেয়াল থাকে না।
‘ঠিক করেছি—’, খোকনের পা বুলুর পেটের ওপর পড়ল।
নাকে অনেকটা বাতাস ভরে বুলু অন্ধকারে শুয়ে শুয়েই হাসল। খুকখুকের বদলে একটা বড় উঁ ধরনের আওয়াজ হল। বুলুর কুবেরের ওপর খুব রাগ। বউ কষ্ট পাবে—চাই কি কাটা ছেঁড়া করতে গিয়ে মরেও যেতে পারে—সেজন্য এমন পুতুপুত হয়ে চলবে?
‘মনে নেই? খোকনের বেলায় মর মর হয়েছিল—’
‘তা বলে রোজ ফেলে দেবে?’ বুলুর মাথায় আগুন ধরে যাওয়ার যোগাড়। হিসেব মত আজ বোধহয় জোড় দিন ছিল। তারও প্রায় হয়ে এসেছিল—অথচ এমন সময়—
অন্ধকার। আয়না থাকলেও মুখ দেখা যাবে না। মশারিতে কে আর আয়না রাখে। একটু আগে বুলুর শেকড়-বাকড় সুদ্ধ কুবের মোটা ভারি শাবল দিয়ে খুঁড়েছিল। এক এক খোঁচায় বুলু ডালপালা সমেত ওপরে ওঠে যাচ্ছিল—আবার নীচেও পড়ছিল। এসব সময় কুবেরকে তার এত নিজের—এত জোরালো, ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মত লাগে। পিঠ, পিঠের হাড়, হাত দু’খানা ছুঁতে সবচেয়ে আরাম। এক একদিন কিন্তু সে আগে ফুরিয়ে যায়—কুবের খুঁড়ে চলে। সেসব সময় নিজেকে একটা কাঠামো মনে হয়, একেবারে কাঠের—কুবের আরও বড় কাঠামো—তখন খুঁড়লেও শরীরের ভেতরের শক্ত জিনিসপত্রে শুধু গুঁতো।
কুবের মুখ খুললো না। এসব কথার জবাব আসে না তার। কত কাজ বাকি। ধনরাজের টাকাটা নিয়ে চটিরামের জমি বায়নার কথাই বুলু জানে। বায়নার টাকা ফেরত নেওয়ার কথা জানে না। কীভাবে বলবে। সেদিন সারা দিনের ওই টানাপোড়ানের পর এখন কিভাবে বলবে বুলুকে।
বুলু কুবেরকে খোঁচালো না।
কুবের মনে মনে পুজো প্যান্ডেলের ধারায় বাঁশের কাঠামোর মত পর পর তার প্ল্যান সাজিয়ে দেখল—এখনও অনেক কাজ বাকি। ন্যাড়া করণীয়গুলো মাথা ঠেলে শুধু বাইরে বেরিয়ে আছে।
সস্তায় খানিকটা জায়গা ধরতে হবে। তারপর সে-জমিতে মাটি ফেলে উঁচু করার ব্যাপার আছে। মাটি বসতে বছর দুই—তারপর ভিত্ খোঁড়ার পালা! ভিতের আগে অবশ্য প্ল্যান—ক’তলা বাড়ি হবে তাও ভেবে-চিন্তে ঠিক করতে হবে। ধনরাজ তো বারবার দেবে না। এই অবস্থায় আবার যদি বুলুর পেট ফুলে ওঠে—সে এক দুশ্চিন্তা।
‘তোমার তো কোন চিন্তা নেই—হলেই হল।
বুলু ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রায় ফোঁস করে উঠলো, ‘তোমার জমি-জমা কবে শেষ হবে বলতে পার?
‘হয়ে এসেছে—’
‘চটিরামের জায়গাটুকু কিনে স্থির হয়ে জিরোও কিছু দিন—এই যে সারাদিন চরকির মত ঘুরে বেড়াচ্ছ—কোন্ দিন আবার রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে না পড়ে যাও।’
একবার জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল কুবের। বছরখানেক আগে। সকালবেলা খিদের মুখে পাঁচখানা আটার রুটি গিলে বেরিয়েছিল। হজম না হয়ে শেষে কি যন্ত্রণা বুকের ভেতর। প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল। ট্রামবাস বোঝাই, ট্যাক্সিগুলো হাত তুললে থামে না—বড় রাস্তার মোড়ে ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।
অজান্তে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের গাঁট গায়ে ঘষে দেখলো কুবের। জায়গাটা শুধু কালোই হয়নি—কেমন খসখসে হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখাতে হবে।
‘চটিরামের জায়গা কেনা হবে না।’ অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। এই সময় কঠিন কাজ খুব সোজা হয়ে যায়।
‘কেন?’
কুবের সব বললো। খানিকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারল না বুলু। সারাদিন শুধু রোদে পোড়ার ব্যাপারটা ঘুরে-ফিরে মনে পড়তে থাকলো। ঠিকই করে ফেলেছিল, রাস্তার দিকে ফুলবাগান করবে। দোতলার ছাদে জ্যোৎস্না উঠলে খোকনকে তোলা বিছানায় উপুড় করে ঘুম পাড়াবে।
কোন সাড়া না পেয়ে কুবের বললো, ‘অন্য কয়েক জায়গা দেখেছি। দর অনেক কম—তবে স্টেশন থেকে খানিকটা দূরও বটে। দেখো, ঠিক কিনে ফেলব।’
‘কেনাকাটা বন্ধ করে চলো কোথাও ঘুরে আসি।’
‘বাঃ! এতদিন পরে একথা বলছ কেন?’ কুবের আরও জানতে চাইতে পারে। যেমন, আমিই তো সে কথা বলেছিলাম গোড়ায়। কিন্তু তুমি বলেছিলে, না, আগে জায়গা কেনো—তারপর ঠিক বাড়ি হয়ে যাবে।’
বিয়ের পর কোথাও আমরা যাইনি কিন্তু—’
কুবের কিছু বলতে পারল না। কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওদের। টাইম অফিসের রামকৃষ্ণভক্ত সাধু প্যাটার্নের অমৃতদের বাড়ি ত্রিবেণীতে একবার গিয়েছিল দু’জনে। দারুণ যত্ন-আদর হয়েছিল। তখনও খোকন হয়নি। আর একবার কেষ্টনগরে মামাশ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। সারাটা দুপুর ট্রেনে গরমে কাটলো। মামাশ্বশুর টাকার অভাবে কলি ফেরাতে পারেননি। ভাঙা ছাদের বিপদ জানান দেবার জন্যে কার্নিশের কোলে একটা তিন পা চেয়ার উলটে রাখা রয়েছে। খুব যত্ন পেয়েছিল কুবের—উঠোনের ইঁদারার জল খেয়ে অম্বলভাবটা কেটে গিয়েছিল কয়েক ঘণ্টায়।
কিন্তু এসব তো কাছে পিঠের জার্নি। বুলু কতদিন বলেছে, ‘চলো না যশিডি ঘুরে আসি।’
মধুপুরে কুবের একটা বিনে ভাড়ার বাড়িও পেয়েছিল। অথচ শেষ অব্দি যাওয়া হল না।
ফার্স্ট ক্লাসে কতকগুলো টাকা শুধু শুধু গচ্চা। থার্ড ক্লাসে স্লিপিং বার্থ রিজার্ভ করে জানলায় পর পর দুটো সিটে বিছানা পেতে দু’জনে নাগপুর নয়তো দিল্লী যাবে—বাইরে বৃষ্টি হবে, খোকন অবেলায় ঘুমিয়ে ফুলো ফুলো মুখে উঠে বসে জানলা দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে—তখন কুবেরদের মেলট্রেন ফুলস্পীডে একটা স্টেশন মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে, অনেক কষ্টে স্টেশনের নামটা পড়া যাবে—রাজনন্দ গাঁও।
কিন্তু এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। চার-পাঁচ জায়গায় কুবের চার ফেলেছে। চিনের মোড়ে কাটাখালের মুখোমুখি একটা প্লট দেখেছে। সব ভাল—শুধ স্টেশনে পৌঁছতে হাঁটতে হবে অনেকটা।
‘রাজগীর যাবে? হট্ স্প্রিংয়ে চান করবে—’
‘কেন? আমার কি বাত হয়েছে?’
হুঁ। হয়েছে—মাথায় হয়েছে—’, বলে কুবের অন্ধকারেই বুলুর মাথাটা ধরে ঘোরাতে গেল। রেডিওর নব নয়। ফলে ঘোরানো গেল না।
‘উঃ! লাগে না? ছাড়ো বলছি—’
বুলুর গলা চিরে গেল। আজকাল কুবের রোজ এত মোটা হয়ে যাচ্ছে—ঘাড় ঘামে, হয়ত সেখানে কিছু দিন পরে খানিকটা থলথলে মাংস গজাবে।
চলন্ত মোটর, চলন্ত ট্রেন, চলন্ত রিকশায় বুলুর পাশে বসে হাওয়া কেটে এগোতে এত ভাল লাগে।
বুলু মাথা ঘুরিয়ে মশারি ফেলে ঘুমোনো শুরু করে এবার।
আঙুলের খসখসে জায়গাটা অজান্তে আর একটা আঙুলে একটু ছুঁয়েই থেমে গেল কুবের। সেদিন কতদিন পরে দেখা হল সনতের সঙ্গে। এই সনতের সঙ্গে একদিন দুপুরে ক্লাস এইটে রিকশা চড়ে ঘোলাডাঙায় গিয়েছিল।
সেদিন তখন দুপুর ছিল। লরি লরি সোলজার কুকুর-মানুষ সব চাপা দিয়ে হু হু করে চলে যেতো। ফৌজদারি উকিল জ্ঞান ঘোষ খারাপ মেয়েমানুষ পাড়ার পেছনে আমবাগানে একখানা বাড়ি ভাড়া করে থাকত। তার মেয়ে সেবার সন্ধ্যেবেলা একদিন বিষ খেল। হরি ডাক্তার শেফালিকে বমি করানোর জন্যে সেদিন রাত আটটা নাগাদ তাদের বাড়ি ডিম চাইতে এসেছিল—কাঁচা ডিম খাইয়ে দিলে এই অবস্থায় নাকি হরহর করে বমি হয়ে যায়। পরে শুনেছিল শেফালি লজ্জা ঢাকার জন্যে মরতে গিয়েছিল। জ্ঞান ঘোষের বড় ছেলে ধীরেন নাকি প্রায়ই দুপুরে শেফালিদের বাড়ি যেত। এর সামান্য কিছু জেনে আর অনেক বেশি শুনে কুবের তখন টুকরো ব্যাপারগুলো জায়গা মত সাজিয়ে গরম হয়ে উঠত। তখন সবে তার গলা ভাঙতে আরম্ভ হয়েছে। কণ্ঠমণি দিনকে-দিন চামড়ার চাদর ঠেলে জেগে উঠছিল।
একদিন তো মফঃস্বল শহরের একেবারে দুপুরে দুই আমেরিকান সোলজার স্রেফ জাঙিয়া পরে জলে নেমে গেল। সঙ্গে ঘোলাডাঙার দুই মেয়েলোক। তাদেরও সাঁতার কাটতে হচ্ছে। পুকুরের চারপাশে শহরের ভিড় ভেঙে পড়েছে। বোমার ভয়ে সালকে ছেড়ে কুবেররা তখন ওই শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকে।
.
একদিন দুপুরে শুক্রবারের দেড় ঘণ্টার টিফিনে সনতের সঙ্গে সাইকেল রিকশায় উঠে বসল। সনৎ নেড়া—সদ্য সদ্য পৈতে হয়েছে, পকেটে ব্রতভিক্ষার টাকা। কুবেরের বুক পকেটে খুচরো নোট মিলিয়ে প্রায় টাকা কুড়ি। লস্কর স্যারের ফেয়ারওয়েলের চাঁদা। ডাকবাংলোর মোড়ে স্টেশনারি দোকান থেকে ফাউন্টেনপেন কিনবে। স্যারকে দেওয়া হবে।
ডাকবাংলোয় দোকান বন্ধ। রিকশায় বসে ফুর্তি লাগছিল। রেলের মাঠে হিন্দুস্থানী বৌ মত একজন নীচু হয়ে ছাগলের খুঁটো পুঁতছে। সনৎ রিকশাওয়ালাকে বললো, ‘স্টেশনের দিকে চল।’
‘ফিফথ্ পিরিয়ডে ফিরবি নে?’
‘অনেক দেরি—খানিকটা ঘুরে নেই চল—’
স্টেশনে যেতে হাতকাটা রিটায়ার্ড দারোগার ‘গাঁজা ও আফিমের দোকান। তারপরই ঘোলাডাঙার ফেরিঘাট। সনৎ হঠাৎ পয়সা মিটিয়ে দিয়ে কুবেরের হাত ধরে রিকশা থেকে টেনে নামালো, ‘যাবি?’
‘কেউ যদি দেখে ফেলে—
‘এখন কেউ আসে না। চল—
।বেলা দেড়টা হবে। ঘরে ঘরে জানলা বন্ধ। সন্ধ্যেবেলা এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে কুবের। তখন হারমনিয়াম বাজে, গান হয়, পেঁয়াজি আর হিঙের গন্ধে গোটা পাড়া ম ম করে।
মোটাসোটা একজন ঘোমটা খুলে ওদের দেখছিল। সবে ভাত খাওয়ার পর পানমুখে জিভটা অনেকখানি বের করে বোঁটা থেকে একদলা চুন মুখে টেনে নিল। টেনে, কুবেরদের দিকে ফিক্ করে হেসে ডাকল।
সনতের সঙ্গে খানিক এগিয়ে যেতেই ঘোমটা ফেলে দিয়ে মেয়েলোকটা আবার ডাকল ‘এসোগো। এই দুপুরে?’
এমন সহজ কথা বলছে দেখে কুবেরের হাত-পা আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওরা দুজনে খিড়কি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল-আগে আগে সনৎ।
ঘোমটা একদম ফেলে দিয়ে মেয়েলোকটা পিচ কাটল। বেশি জলে খুব অল্প খুনখারাবি রঙ গুললে ফ্যাকাসে লাল হয়। একটা লাল শাড়ি পরা মেয়েকে বারান্দায় বসিয়ে ক’জনে মাথায় জল ঢালছে।
সনৎ থেমে দাঁড়াল, ‘কি কুচ্ছিৎ মাইরি—’
কুবেরের কানের ভেতর দিয়ে তখন ভিমরুল উড়ে যাচ্ছে। কেবল ‘কুচ্ছিৎ’ কথাটা শুনতে পেয়ে বললো, ‘এই মেয়েটাকে দেখ না—’
সনৎ তাকে আঙুল দিয়ে দেখাতেই বারান্দায় দাঁড়ানো সেই মেয়েলোকটা বললো, ‘কেন? খারাপ হয়ে গেছি দাদাবাবু?’ তারপর হেসেই বললো, ‘ওর তো কাল রাত থেকেই চার ডিগ্রি জ্বর—’
সনৎ কুবেরের হাত ধরে খিড়কিতে বেরিয়ে এসে বললো, ‘তবে আমরা চললাম।’
ওরা তখনও পথে পড়েনি। ভেতরে বারান্দা থেকে জল ঢালার আওয়াজ—আর তার সঙ্গে অনেকজনের হাসি একসঙ্গে ওদের পেছনে ছুটে এল।
গনগনে রোদ—বুড়ি বেশ্যারা গরম পিচের রাস্তায় সেদ্ধ ধান মেলে দিয়ে শুকোচ্ছে, মুড়ি হবে, পাড়ায় পাড়ায় ক’দিন পরেই বিকোতে বেরোবে। লম্বা লাঠি দিয়ে পায়রা তাড়াচ্ছে। টিনের খাপরার চালের ভাপানো ছায়ায় পোষা বেড়াল কোলে একজন কুবেরের চোখে তাকিয়ে গেয়ে উঠলো। গানটার এক চিলতে আজও ভোলেনি কুবের—
‘ওরে কে কে যাবি আয়-য়-রে
বাঁশি বাজে-এ-এ বিপিনে-এ’
হাসতে হাসতে গানটা থামিয়েছিল বুড়ি। পরনে বিধবার থান, একটা প্রমাণ সাইজের তোবড়ানো বুনো নারকেল মুখে আঠা লাগানো পাটের কায়দায় কয়েকগাছি পাকা চুল ঝুলে।
সে-ই আঙুল দিয়ে একটা ঝুলবারান্দা দেখিয়ে দিয়েছিল, ‘নোতন এসেছে—জেগে আছে।’
ফিরেই যাবে ঠিক করে ফেলেছিল। দু’এক বাড়ি উঁকি দিতে এতক্ষণে যা চোখে পড়েছে তা হলঃ কেউ সায়া পরে হুমহাম করে ঘর মুছছে।—কেউ বা ভেতরের চাতালে রক্ষেকালী হয়ে কাপড় আছড়াচ্ছে—আর, সব জায়গাতেই প্রায় একই গন্ধ—দারুণ পেঁয়াজ-রসুনে বোধ হয় খুবই পচা কোন মাছ জম্পেস করে কড়ায় চাপানো হয়েছে।
এমন সময় সাইকেলে কাকামিঞার উদয়। উঃ! ভাবলেও এখন জ্বর আসে কুবেরের। দেখতে পেলে ঠিক বাবাকে গিয়ে লাগাতো। সনৎকে হ্যাঁচকা টানে সেই ঝুলবারান্দার নীচে নিয়ে এল কুবের। তারপর দু’জনে মরা ড্রেনের ওপর সরু সিঁড়ি ধরে দেড়তলায় উঠে এল।
কড়া নাড়তে হল না। দরজা খোলা ছিল। উঁকি দিতেই যে উঠে এলো সে ফৌজদারি উকিল জ্ঞান ঘোষের খারাপ মেয়েমানুষের মেয়ে শেফালি—কিছুদিন আগে এরই জন্যে ডাক্তার কুবেরদের বাড়ি থেকে কাঁচা ডিম চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
‘তুই?’
কুবের বললো, ‘কাউকে বলবি নে—মেরে ফেলব তাহলে—’
শেফালি ভয় না পেয়ে হাসল, হেসে পেছন ফিরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সনৎকে বললো, ‘কিছু খাবেন?’
সনতের পেছন পেছন কুবেরও ঢুকল। শেফালি ঘরের ভেতর বড় আলোটা জ্বেলে দিয়ে আপনি আপনি করে কথা বলতে থাকল। যেমন—
‘দোরটা বন্ধ করে দিন—
‘একসঙ্গে দুজনের তো একঘরে থাকার নিয়ম নয়—পুলিস ধরবে—’
‘আচ্ছা উঠবেন না—এক কাজ করছি—’
জ্যালজেলে ছাপা শাড়িটা অনেকখানি তুলে নিজেই পালঙ্কে উঠে টানানো নেটের মশারি ফেলে দিল, ফ্যাকাসে মুলোর চেয়েও ফক্ককে সাদা দু’খানা পা, বেশ রোগা, ‘আপনাদের একজন ততক্ষণ ঐ চেয়ারটায় বসুন—কেমন ঘরের ভেতর ঘর হয়ে গেল!’
ড্রেসিং টেবিলের পাশে হাতল লাগানো সিংহাসন মার্কা চেয়ারটায় বসে কুবেরের পরিষ্কার মনে হয়েছিল, শেফালি মোটা হয়ে গেছে—ফর্সা। ফ্যানের হাওয়ায় কুবেরের শীত ধরেছিল। ঝুলবারান্দাটা দেখাতে গিয়ে বুড়ির হাত ঠিকই এই দেড়তলার ঘরের দিকে উঠেছিল, কিন্তু ঘোলা দুই চোখ তাকেই দেখছিল। অন্য সময় হলে কুবের দাঁড়িয়ে যেত—ভাব জমিয়ে বুড়ির সঙ্গে কথা বলত। বলতে বলতে বুড়ির চোখের ঘোর ভাল করে দেখে নিত। কিন্তু আর দাঁড়ালে ঠিক কাকামিঞার চোখে পড়ে যেত। পড়ে যায়নি তো?
পুলিসের লোক কাকামিঞা। দিন নেই দুপুর নেই সাইকেলে ঘুরছে কাকামিঞা। কি খেয়াল হতে কুবের আয়না টেবিলের দেরাজ খুললো। দু’খানা ভাঁজ করা পাঁচ টাকার নোট—কিছু ছোট ছোট ছবি, দেখতেই কুবেরের চোখ ঠেলে উঠল, মুখ হাঁ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। মশারির ঘরের দিকে পেছন ফিরে কুবের ফটোগুলো পকেটে পুরলো, নোট দু’খানাও পকেটে ভরে নিল। একটু আগে সনৎ টাকাটা শেফালিকে দিয়েছিল।
সনৎ বেরিয়ে আসতে কুবের মশারিতে ঢুকল। ভেতরে শেফালি, বুনো চুলের গন্ধ ঝুলছে। পা-দু’খানা খানিক দূর অব্দি দেখা যায়। তারপর-ঘরের নীল আলোয় সবই প্রায় অন্ধকার। বর্ষাকালের ভিজে সুকতলার গন্ধের ভেতর নামতে গিয়ে আগেকার সেই আবিষ্কার, গরম-ভাব সব কোথায় মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। এখন পর পর সাজিয়ে ভাবতে গিয়ে কুবের একটা জিনিস বুঝতে পেরে ভীষণ ভয় পায়। লোকের পাশে লোক থাকে—অথচ কি ভয়ঙ্কর সব জিনিসপত্র নিয়ে মেয়েলোক কেমন চুপচাপ থাকে সর্বদা। বেশিক্ষণ এগোতে হয়নি তাকে—প্রথমটা জ্বলে গিয়েছিল, তারপর মাথার ভেতরের ঘিলুর খানিকটা কে সুড়ৎ করে চুষে নিল—সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে শব্দ করে হাওয়া পাস করছে আজও।