কুবেরের বিষয় আশয় – ২৪

॥ চব্বিশ ॥

কোনদিন দেখেনি এমন অনেক গাছ, ফুল, লতায় এই দ্বীপ ভরে আছে। ডাঙা থেকে পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে অনেক চেনা গাছপালার বীজও এখানকার মাটিতে এসে পড়েছে। একটা অচেনা গাছই কাটা হচ্ছিল। ফুলগুলো মাদার ফুলের চেয়েও লাল। এসব কুবেরের অচেনা ডাঙার গাছপালা। এতদিন জানত—শুধু উত্তর থেকেই পাখি আসে। তা নয়। দক্ষিণ থেকেও আসে নিশ্চয়। নাহলে এইসব ফুল, এইসব ফল আসবে কোত্থেকে। কামলাদের একজনকে সাপে কেটেছে। কুবের চেয়েছিল—পেট্রোল মাখিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হক। শেষে ওদের ইচ্ছেই থাকল। ডাঙার মত এখানেও দাহ। তাই গাছটা কাটা হচ্ছে। কুবের একটা সাপকে চেনে। কদমপুরে প্রথম জায়গা মাপার দিন সাপটা সারাক্ষণ ছিল। তার গর্তও চেনে। ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে আলাপের দিনেও সাপটা এসেছিল।

শেকড়সুদ্ধ ওপড়াতে বিকেল হয়ে গেল। রসে ঢঢবে হয়ে আছে গাছটা। তাতেই পেট্রোল মাখিয়ে আগুন তৈরি হল। জিনিস চড়িয়ে দিয়ে ওরা গুন গুন করে গাইছে-না, বোধহয় মন্ত্রই পড়ছে কিংবা সুর দিয়ে কান্না—অনেকগুলো লোক উব হয়ে বসে। কুবের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে বুকে খানিক জায়গা লাল আগুনে দাগানো। সে-দাগ বাতাসে গা ঢেলে দিয়ে এদিক-ওদিক অনেকখানি জিভ মেলে দিচ্ছে—আবার গুটিয়েও নিচ্ছে। কোন্ দূর দেশের লোক অচেনা জায়গায় এসে মাটি নিল। মেদনমল্লর দুর্গের গায়ে কত যে লতাপাতা, জানা-অজানা গাছের শেকড়-তাতে আগুনের আলো, কিছু অন্ধকার পড়ে প্রায়ই একটা রাজকীয় চেহারা নিচ্ছে। ওসব গাছ-গাছালিই অলঙ্কার হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে কুবেরের ধানের মাঠও আলো হয়ে যাচ্ছে।

এখন হাজার বিঘের ওপর জায়গা গাভিন ধানচারায় ভরাট হয়ে আছে। একটা হিসেব ছিল কুবেরের। প্রতি গোছে কুড়ি বাইশটা বিয়েন ধরলেও তার মধ্যে অন্তত বারো-চৌদ্দটা শিষ ছাড়লেই যথেস্ট। বইয়ের অঙ্ক বলে—শিষ প্রতি একশো দশটা ধান চাই। গোছ প্রতি অন্তত বারোটা এমন শিষ চাই। বিঘে প্রতি ছেষট্টি হাজার গোছ চাই। তা হলেই ধানে ধানে ছয়লাপ হয়ে যাবে।

ফলন বাড়াতেই হবে। নাহলে ভরাডুবি। মজুর খাটানোর সময় কিছু আলগা দিয়ে কুবের ভুল করেছে। যেখানে জনপ্রতি দশ গন্ডা বিজ ভাঙার কথা—কম করেও সাত গন্ডা রোয়ার কথা—হাতে কলমে কিন্তু তা হয়নি। ফলে পড়তায় পোষাবে না। এক ফলন ভাল হলেই সব পুষিয়ে যাবে।

নিড়েনই আসল। চারা বয়সের গাছের গোড়া খোয়ালি দিয়ে জখম করে দেওয়ার কথা ছিল। যত খেয়ালি ততো বিয়েন। খনা বেঁচে থাকলে তাঁর বচনগুলো এখনকার মতো করে ফিরে লিখতেন। সেই নিড়েন সব জায়গায় সমান পড়েনি।

তারপর অনেক জায়গা হুড়ে গেছে। আনতাবড়ি ইউরিয়া পেয়ে গাছগুলো বেমক্কা বেড়ে গেছে। ঘন কালো হয়ে উঠেছে। তাতে আর শিষ ধরবে না। শুধুই খড়। আবার অনেক জায়গা ডেবে গেছে। সে সব জায়গায় বেঁটে বেঁটে শিষ ধরেছে। ভালো করে লাঙল দেয়নি। মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় ধানচারা শেকড় ছড়াতে পারেনি।

তবে আগাগোড়াই শিষের গায়ে নোলকের স্টাইলে সাদা রেণু রেণু ফুল ঝুলে আছে। এখন সব সময় মন্দ মন্দ বাতাস চাই। শিষগুলো এদিক-ওদিক দুলবে। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভবিষ্যতের ধানের খোল আলগা হয়ে মুখ খুলবে। তার ভেতরে ফুল ঝরে পড়বে। তাই ঝড়-জল এখনকার শত্রু।

দক্ষিণ থেকে বাতাস উঠলে মেদনমল্লর দুর্গ তার বন্ধু। অনেকটা হাওয়া দুর্গ একাই বুক দিয়ে আটকাবে। ধীরে সুস্থে ফুল পড়ে পড়ে ধানের শিষের খোলগুলো ভরে যাক। তারপর যত ইচ্ছে বাতাস ওঠে উঠুক। কোন পরোয়া নেই। কিন্তু এখন।

ধানের কথা ভাবতে গিয়ে কুবেরের মাথার ভেতরে আগুন ধরে গেল। তিরিশ হাজার মণ। লঞ্চঘাটার বাজারে সুবিধে দরে ছেড়ে দিলেও—ওরে বাবা! ভাবা যায় না। অনেক টাকা। ষাট টাকার নীচে নিশ্চয় মণ নামবে না। অতো টাকা একসঙ্গে গঞ্জ জায়গায় নাড়াচাড়া করাও খারাপ। খুব ময়লা জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়াতে হবে। কোনক্রমে টাকাটা একবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে ছড়িয়ে দিলেই হল। তারপর ধীরে সুস্থে নাড়াচাড়া কর। পৃথিবীতে কোথাও কোন মনের মত সিন্দুক পায় না কুবের। ব্যাঙ্কের এত গর্ব। বিজ্ঞাপন লেখা থাকে—নিরাপদ আমানতের জন্য। যদি করকাতায় ভূমিকম্প হয়। তাহলে মাটির নীচের সিন্দুকগুলো কোন্ পাতালে চলে যাবে। ব্যাঙ্ক সারা জীবনেও তা হলে খদ্দেরদের দেনা শুধে উঠতে পারবে না।

এই এতো বড় দ্বীপ সামলানোর লোকবল কুবেরের নেই। দ্বীপে কাঠ ছিল, মধ ছিল, জলে মাছ। দলদলে মাটিতে যা বসাও, তাই ফলবে। আসলে জায়গাটা তোমার নিজের। হেঁটে বেড়াও—নিজের জায়গায় হাঁটছো। হরিরাম সাধুখাঁর সঙ্গে কুবেরের পরিচয় হয়নি। পাঁচ পুরুষের ব্যবধান। দেখা হলে কয়েকটা কথা জেনে নিত কুবের। মশায়, আপনি কতো সব করে গেছেন। একবারও ভেবেছেন, চোখ বুজলে সে-সবের গতি কি হবে। অবিশ্যি ওকথা ভাবলে কিছু হয় না। আজ যদি নগেন, বীরেন তার পাশে থাকত। নিজেদের লঞ্চ। গঞ্জে গিয়ে তিন ভাই মিলে কারবার করত। একা কত দিক দেখবে। তবু ওরা আসবে না। সেই পায়রার খোপ। অফিস থেকে ফিরে চান করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাউডারের পাফ বুলানো। পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা আমোদ—সিনেমার দুখানা অ্যাডভান্স টিকিট পকেটে করে বউ নিয়ে অন্ধকার ঘরে বসে ছবি দেখা। খবরের কাগজে শীত কতটা পড়ল, গরম কতটা বাড়ল, রেল অ্যাকসিডেন্টে কতজন সাবাড় হল—ভোরের চায়ের সঙ্গে তাই পড়তে পড়তে প্রাতঃকৃত্য, দাড়ি কামানো। একেবারে সোপকেস লাইফ! অথচ কুবেরের মাথার মধ্যে সব সময় একটা না একটা ব্যবসার বুদ্ধি ফরফর করে ধরে উঠছে। টাকা কোন প্রবলেম নয়—প্রবলেম লোক। কুবেরের নিজের লোক বলতে একদম নেই।

অবেলায় ঘুমিয়েছিল আভা। ট্রানজিস্টর বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। ইংরাজীতে কিসব বলছে। বাইরে দাঁড়িয়ে কুবেরও শুনতে পেল। ‘ওয়েদার ইন দ্য বে।’ বাকিটা কানে গেল না। ঢঢবে আভা খুব ঢিলে গলায় জানতে চাইল, ‘শেষমেশ আগুনেই দিলে? আমার কথাটা রাখলে পারতে।’

আজ সকালে গাছে কুড়োল বসানোর আগে আভা বাধা দিয়েছিল। ক’দিন আগে গাছটার আধখানা বাজ পড়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাকি আধখানা রসের জোর ছিল। তাই মরতে মরতেও বেঁচে উঠছিল। এই অবস্থায় কুড়োল বসানো আভা চায়নি! তার কথা—সাপে কেটেছে। বেশ তো জলে ভাসিয়ে দাও। আয়ু থাকলে জেগে উঠবে।

‘হাঙর-কুমীরে খাওয়ার চেয়ে আগুনে খাক।’

কুবেরের কথায় আভা চোখ বড় করে তাকিয়েছিল, ‘তোমাদের কোন দয়ামায়া নেই।’

‘দয়ার শরীর তোমার একার।

কোন্ কথায় কুবের এ কথা বলছে-আভা জানে। কুবের অনেকবার বলেছে-’দয়া কর আভা। আমাকে একটু দয়া কর। আচমকা আমার বাচ্চা পেটে ধরার কোন দরকার ছিল না তোমার। ইচ্ছে করলেই কলকাতায় গিয়ে মুক্ত হয়ে আসতে পারতে।’

আভা রাজী হয়নি। এখন তার পা, কোমর ভারি হয়ে এসেছে। বিকেলে অন্ধকার কেমন করে একটু একটু করে আলো গিলে খায়—ছড়িয়ে পড়ে—তা স্পষ্ট দেখতে পায়! গাছগাছালি সবুজ পাতায় ধুলো পড়লে টোকা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সব সময় একটা রসস্থ নেশা তাকে ঘিরে আছে। তার ভেতরে বসে কোন দুশ্চিন্তাকেই আমলে আনবে না আভা।

এই কিছুকাল আগেও সন্ধ্যে রাতে জ্যোৎস্নায় দুর্গের ভাঙা খিলানের নীচে দাঁড়িয়ে কুবের দুই হাতে তাকে টেনে নিয়েছিল—বিশাল ঘুমের সাগর ঠেলে কুবের সাধুখা মাথা তুলে দাঁড়ালো সবে—তারপরেই তাকে নিয়ে লঞ্চের পাটাতনে দুধলি ফুল ছড়ানো বিছানায়—সবই জলছবি হয়ে একের পর এক আভার বুকের ঠিক দ ইঞ্চি গভীরে ছাপা হয়ে পর পর পড়ে আছে। তখন আভা জীবনে প্রথম সুখের দেওয়ালগুলো একে একে পার হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এর পরেও কিছ আছে—আরও আছে। কোন শেষ নেই।

কেন যে সেইসব দিন শেষ হয়ে গেল। কত অল্পদিনের জন্য সেসব দিন এসেছিল! একা দুর্গের চত্বরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আভা মেদনমল্লর প্রায় পৌরাণিক বাথানের গায়ে পেয়ারা গাছটাকে পেয়েছিল। সে গাছে কেউ কোনদিন নাড়া দেয়নি। ফল হয়, পাকে—পাখিরা ঠোকরায়—একদিক থেকে পড়েও যায়। আভাই সেদিন প্রথম ডাঁশা থেকে একটা ফল নিয়েছিল। তাতে কিসের থেকে কত কাণ্ড। আজকাল আর তেমন গা গুলোয় না। ব্যাপারটা তার সয়ে এসেছে।

কুবেরের ভেতরটা কিন্তু সব সময় কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। মুখ দেখেই বুঝতে পারে আভা। অনেক বুঝিয়েছে, ‘তাতে কি কুবের-তোমার তো কোন অসুবিধে নেই। কুকুর বেড়ালের মতো আমিও না হয় একটা বাচ্চা ধরলাম পেটে। কে জানবে কার ছেলে। কাউকে না বললেই হল! এত বড় পৃথিবীর কোথাও থেকে যাব।’ দম নিয়ে ফিরে বলেছে, ‘যতদিন বয়স আছে—সে ক’টা দিন তো এমনিই থাকতে দেবে!’ এখানে আভা খোলা—চোখ কুবেরের দৃষ্টির নীচে গিয়ে মুখ তুলে ধরেছে, ‘আমার একটা চুমো খেয়ে দেখো গা ছুঁয়ে দেখো—আমি এখনও টাটকা। বিকেলে গা ধুয়ে চুল বেঁধে দাঁড়ালে তোমার লুকিয়ে হলেও ফিরে ফিরে দেখতে হবে। চোখ ফেরাতে পারবে না—’, এ সব জায়গায় আভার গলা ফেটে কান্না বেরিয়ে পড়ত।

কিন্তু ও-তরফ থেকে কোন সান্ত্বনা আসেনি। কুবের একটা কথাই ফিরে ফিরে বলেছে, ‘দয়া করো—আভা ইচ্ছে করলেই তুমি পার। দয়া করো।’

‘ভয় নেই। তোমাকে বাবা ডাকবে না।’

‘তোমাকে তো মা ডাকবে—’

একটা তেকোণা পাথরের সবখানি তীর হয়ে শরীরের ভেতরে গেঁথে গেলেও আভা এতটা ব্যথা—এতখানি সুখ একই সঙ্গে পেত না। ‘তোমার তো আরও ছেলেমেয়ে আছে। আমি এ জিনিস আগে কোনদিন পাইনি। থাকলই বা আমার।’ তারপর না থেমেই কুবেরকে সোজাসুজি বলেছে, ‘পুরুষমানুষ আমি চিনি কুবের। কখন আমাকে নিয়ে নাচে–তাও জানি। বয়স হলে তাড়িয়ে দিও। তখন একটা জায়গা ঠিক করে নিতে পারব।’ মুখে আর কিছুতেই বলতে পারল না—সেদিনও নিশুতি রাতে চলন্ত লঞ্চের ডগা থেকে আমায় ঘুমন্ত অবস্থায় পাঁজাকোলে তুলে এনেছিলে।

‘তুমি নিজেই তো তোমাকে রাখতে বলেছিলে। কদমপুরের বাড়িতে। মনে নেই? সেই একদিন দুপুরবেলা—সাহেব মিত্তিরের কি ছুটোছুটি-’

‘সব মনে করে রেখেছ!’

‘ভুলিনে বলেই তো যত মুশকিল। আমার সৃষ্টিধর আছে—কুসুম আছে। আমি নেহাত জাল অনেক ছড়িয়ে ফেলেছি—গুটিয়ে তুলতে পারছিনে বলেই তাদের কাছে যেতে পারছি নে।’ এর পর কুবের নিজের মনের মধ্যেই নিজেকে বার বার ছিঃ! ছিঃ! বলল। এইমাত্র মনে হচ্ছিল—যা বিষয় আশয় হয়েছে—সৃষ্টিধর, কুসুমকে দিলে দু’ভাগ হবে। তারপরেও নতুন কেউ এলে তেভাগ। তখন সৃষ্টিধর বঞ্চিত হবে কিছুটা, কুসুমও হবে

বাতাসে গা ভাসিয়ে পেট্রোল মাখানো আগুন এদিক ওদিক লাফাচ্ছিল। তাই কখনো ছায়ায়—কখনো আলোয় কামলাদের গুনগুনানো কান্না —দলবেঁধে বসার জন্যে দলপাকানো এক স্তূপ মানুষ—সব কিছুই শোনা যাচ্ছিল, দেখাও যাচ্ছিল। আজ সারাটা দিন কুবের আলে আলে ঘুরছে। কোথায় জল বেশী, কোথায় একদম নেই—নিজেই দেখে ফিরেছে। মাইনে করা লোকের ওপর—দিনমজুরির কামলাদের ওপর সব কিছু ভার দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকা যায় না। এই লোকগুলো কত সস্তা। আসলে মানুষ কত সস্তা। দিনমজুরির টানে কোন্ সেই শালবনী, চন্দ্রকোণা আরও ওপাশের লোক একটানা চার মাসের কাজের লোভে এতদূরে ছুটে এসেছে। তবুও পৃথিবীতে রোজ লোক হচ্ছে, জন্মাচ্ছে। এই অবস্থায় সে আর একবার বাবা হয় কি করে। সব ব্যাপারটাই গণ্ডগোলে। নিজের ছেলে বলতে কুবের বোঝে সৃষ্টিধর। তার একটা ভালো নাম একদা দিয়েছিল। সে নাম আজ তার নিজেরই মনে নেই। নিজের মেয়ে বলতে কুবের বোঝে কুসুম। বউ বলতে বোঝে বুলু। কতদিন এদের দেখিনি। আমি কি করতে এসেছিলাম এ তল্লাটে। সবাইকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব। আজ কেউ আমার জন্যে বসে নেই। আমার মতো করে ভাবারও কেউ নেই।

আভা দেখল, কুবের নয়—তার পাশে কালো রঙের একখানা পোড়া কাঠ দাঁড়ানো। রোদে রোদে কুবেরের আর কিছু নেই। আগুনের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মানুষটার গায়ে কালচে শ্যাওলা ধরেছে আগাগোড়া। মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, চোখ লাল—বড়সড় একটা প্রাণীর মতো লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ফেলছে। ইদানীং এত কাছের মানুষকেও আভা ঠিক চিনে উঠতে পারে না।

‘আজও তুমি দুর্গে থাকবে? বিকেল থেকেই কেমন হাওয়া দিচ্ছে দেখেছ।’ আভা বাকিটুকু বলতে পারল না। জোর বাতাসে তাঁবুর ছাদ শব্দ করে ওপরে ওঠে আর নামে। জলের চেহারা ভাল নয় বলে দুপুর বেলাই ‘ডাহুক’ আর ‘বড়বিল’ বাঁকের মুখে খাঁড়ি দেখে কিছু ভেতরে গিয়ে নোঙর ফেলছে। আর আজই সাপেকাটা মানুষটাকে এই তাঁবুর সামনেই পোড়ানো হল। হাজার হোক আমি মেয়েমানুষ।

কুবের যেদিন জানল, আভার ভেতরে আরেকজন মানুষ আসছে—সেদিন থেকেই আভা বুঝতে পেরেছে, কুবের তাকে রাস্তার মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে স্টেশনে ফিরে যাচ্ছে। সে আর যাবে না। গোড়ায় বিশ্বাস হয়নি আভার। আগাগোড়া এমন সুখে ভেসে ছিল। ক’দিন পর সুতোয় টান দিয়ে দেখে ছিঁড়ে গেছে কোথায়। রাতে কামলাদের ক’জনের তাঁবুর সামনে শোয়ার ব্যবস্থা করে সেই যে কুবের দুর্গের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে—মাঠে নামার সময় বেরোয় শুধু। আভা বলে যে কেউ এখানে আছে কুবেরের মুখ দেখে তা বোঝারও উপায় নেই।

‘আজও তুমি দুর্গে থাকবে? রাতে ভীষণ ভয় করে আমার—’

কুবের বিড়বিড় করে কি বললো। হাওয়ার দাপটে কিছু শোনার উপায় নেই। ঠিক এখুনি আবার কুবেরকে ঘাঁটাতে ভরসা হল না। সেদিন ভরদুপুরে আভার মুখে তার নিজের সুখের খবরটা শুনে এমন দড়িছেঁড়া বেগে মেদনমল্লর দুর্গের ভেতরে ছুটে গেল। খানিক পরে ভাঙা খিলান, থাম, তিন দিক ফাঁকা একাকী দাঁড়ানো একখানা বড় দেওয়ালের পেছনের অন্ধকার ঠেলে কুবেরের থ্যাতলানো গলা ভেসে এসেছিল। ভয় ধরে গেলেও আভা বসে থাকতে পারেনি। আন্দাজে গলার আওয়াজের পথ ধরে গিয়ে কুবেরকে পেয়েছিল।

মেঝেয় ফাটল দিয়ে একটা বড়সড় আকন্দ গাছ ঠেলে উঠেছে। অল্পস্বল্প আলোয় বেগুণী রঙের ফুল না ফল—কিসের পাতলা গুঁড়ো মাখানো নিথর পুরু পাতাগুলোর মধ্যে একটু একটু জ্বলছিল।

সেই ভাঙাচোরা মেঝের ওপর কুবের হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। আভার হাঁটুতে কুবেরের গা লেগে গেল। তবুও লোকটা চমকালো না। আন্দাজে কুবেরের মাথায় হাত রাখল। বাড়ির পুকুরে ভাসানের পর লক্ষ্মী-সরস্বতীর পরচুলাও এতো সহজে খুলে আসে না। কুবেরের মাথা থেকে আভার হাতে পটাপট কয়েক গুছি উঠে এল, ‘কি হচ্ছে এখানে বসে বসে—’

আভা কোন জীবন্ত প্রাণী নয়। দিঘির ধারে সারি দিয়ে পরীরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কুবের কোন স্তব্ধ জিনিস ধরে ধরে উঠে দাঁড়াল। আভা তার চোখ চিনতে পারল। এতো তাড়াতাড়ি দৃষ্টি কি করে ঘোলা করে ফেলে। অন্য সময় আভা তার সব কিছু নিয়ে কুবেরের হাতে পড়লে ব্যাপারটাকে ভালবাসার ঘাঁটাঘাঁটি বলে ধরে নিত। লোকে তাই নেয়। তাতে সুখ থাকে। এখন যেভাবে কুবের তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে ওপরে উঠে এলো—তাতে শুধু ভয়ই ধরে।

‘আমার জীবনে একটা স্যাঙ্ ঘটনা-স্যান্ড্ এক্সপিরিয়েন্স বলতে পার তখন বয়স কম ছিল, কিছুই বুঝতাম না। আমি গোড়া থেকে বলছি আভা—‘

‘হয়েছে। এখন বাইরে চলো তো—’

‘আমাকে বলতে দাও।’

‘পরে বলবে। এখানে অন্ধকারে বসে বসে চেঁচাচ্ছিলে কেন?

‘আমি পথ হারাতে চাচ্ছিলাম আভা। আসলে পথ পাচ্ছিলাম না। যেদিকে যেতে চাইনি—সেদিকেই চলেছি। এখনও ধানে দুধ আসেনি। কত কাজ পড়ে আছে। অথচ তুমি কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছ আমাকে। বাঁচাও আমাকে আভা। ইচ্ছে করলেই দয়া করতে পারো—’

আর কোন কথা বলতে না দিয়ে আভা ভূতগ্রস্ত কুবেরকে একরকম টানতে টানতে খোলা চত্বরে এনে ফেলেছিল। সামনেই দিঘি। আলো ফেটে গিয়ে সেখানে সব কিছু জ্বলজ্বল করছিল।

কুবের পরিষ্কার আলোয় আভার গলায় হাত রাখল। দশ ঘোড়ার পাম্পের সাকসন পাইপ। টেটিয়ার মতো সিধে হয়ে সেই পাইপ মাথাটা তুলে ধরে আছে। সেই মাথায় নাক, মুখ, চোখ, কান লাগানো। আভার কানের দুল, মাথার বেণী দুর্গের ভেতরকার পড়ন্ত আলোর সঙ্গে ঝুলে পড়েছে। ভাঙা খোঁপার ভেতরে এই বেণীটাই ছিল। সব সময় দেখা যায় না।

‘কি করছো? লাগে না গলায়?’ মাথা বাঁকিয়ে আভা তার গলা কুবেরের থাবার ভেতর থেকে বের করে নিল, ‘কি হয়েছে তোমার। অমন পাগলের মতো তাকাচ্ছ কেন?’

‘তুমি বুলুর কি জান?’

‘কিচ্ছু না! অমন কথার পিঠে কত কথা বলে লোকে। তাই তুমি ধরে বসে আছ এখনো। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। শরীর ভাল নেই।’

অন্য দিনের মতো আভা সহজেই যেতে পারেনি। দু’জনে অনেকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়েছিল। কুবেরের সাজানো খেতখামার, অনেক আশার চাষাবাদ—কয়েক সেকেন্ডে একটা আস্ত ব্যর্থ কাণ্ডকারখানার চেহারা নিয়ে ফেলেছে।

সেই থেকে কুবের দুর্গের চত্বরে থাকে। মাথার ওপরে তাঁবু—তিন দিকে দেওয়াল—সামনেই দিঘি।

রেডিওতে বেশ বলে—ফেয়ার ওয়েদার। স্লাইট রাইজ ইন নাইট টেম্পারেচার এখানে খ্যাপা হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রানজিস্টর সারাক্ষণ চেঁচায়। তাতে গান থাকে, বাজনা থাকে, খবরও বাদ যায় না—মাঝে মাঝে আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি। কুবের লক্ষ্য করেছে, কিছুকাল একজন মাত্রাতিরিক্ত চন্দ্রবিন্দুর মিশেল দিয়ে খবরাখবর বলে। সেদিন বলছিলো—মাদৃভাষা, আদ্‌মো-জিগ্‌মাবা। একের নম্বরে বেতার কৌমুদি!

আভা তখনও দাঁড়িয়ে। কুবের এই বাতাসে দুর্গের পুরু দেওয়ালের আড়ালে থাকবে, না বাতাসে তোলপাড় তাঁবুর ভেতরে গিয়ে আভার সঙ্গে রাত কাটাবে। এই জিনিসটি পরের বউ। দশ ঘোড়ার পাম্প–যেমন আছে, যে জায়গায় আছে—সেখান থেকে বারো চোদ্দ মণের জিনিসটা বাতাস উপরে তুলতে পারবে না। ধানচারাগুলো নুয়ে নুয়ে পড়বে ঠিকই—কিন্তু শেকড় উপরে তুলে বাতাস তাদের ছন্নছাড়া করতে পারবে না।

‘আমি দুৰ্গেই থাকবো আভা। সামনেই আছি—ভয় কিসের?’

‘তাই বলে আমি এ ঝোড়ো রাতে একা একা তাঁবুতে কাটাবো?’

‘শেষ রাতে সেদিন লঞ্চঘাটায় স্লিপার বেয়ে বেয়ে ডাহুকে উঠে আসতে তো আটকায়নি?’

‘তুমি মানুষ!’

‘কে বললো! আমরা কেউ কি আর মানুষ আছি! কোনদিন ছিলাম হয়তো!’ তারপর আগুনের দিকে আঙুল তুলে কুবের বললো, ‘লোকটার ঘরবাড়ি বউ ছেলেমেয়ে আছে নিশ্চয়ই। দিনমজুরি খাটতে এসে কাবার হয়ে গেল।’

আভার মুখে একসঙ্গে অনেক কথা এসেছিল। বাতাসের দাপটে দাঁড়ানো যায় না। তাঁবুর ভেতরে চলে গেল। সবই তো বোঝ বাছা। তোমার আয়ু সাত মাস। মাথায় কাজ নিয়েছ সতের বছরের। আশার শেষ নেই। লোভের শেষ নেই। তাঁবুর ভেতরে একটুও হাওয়া ঢোকে না বলে বাতির শিখা যাকে বলে একেবারে নিষ্কম্প। ঢাকা দেওয়া খাবার গরম করে নেয় রোজ। আজ আর উঠতেই ইচ্ছে হলো না আভার।

মেদনমল্ল অনেক ইট দিয়ে দুর্গটা গেঁথেছিল। কাদায় মশল্লায় এখানকার চেয়ে অনেক খুদে খুদে ইট অনেক বর্ষার জল খেয়ে পাথর হয়ে আছে। বাইরের বাতাস সেখানে আমল পায় না। কুবের শুয়ে শুয়ে তাঁবুর ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আকাশে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে তারা খসে পড়ছিল। কোথায় কে মারা গেল। বাবা কেমন আছে কে জানে। জনকপুরী খয়ের আর সাদা তামাক দিয়ে পান খায় দেবেন্দ্রলাল। কুবেরের কাছে একটা ভাল হামানদিস্তে চেয়েছিল। দাঁত প্রায় নেই। পান আজকাল ছেঁচে খায়। পাতলা ঠোঁট লাল হয়ে থাকে।

কিছু বেশি রাতে কুবেরের ঘুম ভেঙে গেল। বাতাসের দাপাদাপি সুবিধের ঠেকছে না। সাত ব্যাটারির বন্দুক মার্কা টর্চ জ্বেলে দেখলো, সদ্য সদ্য সাদা ফুল-ধরা ধানের শিষ ক্ষেতময় পাগলা বাতাসের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে। কুবেরের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। সর্বনাশ। সব গেল।

কামলারা ঘুমোচ্ছে। এখন ডাকলেও সাড়া দেবে না। কি একটা সন্দেহ হল। টচ নিবিয়ে একা একাই ক্ষেতের গা ধরে ধরে নদীর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। যা সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই। বহু দূর ধরে জল ক্ষেপে উঠে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। আর হাত দুই উঠলেই বাঁধ ফেটে গিয়ে জল ঢুকে পড়বে মাঠময়। কষের চেয়েও অন্ধকার বেশি ঘন। হাওয়ার মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানো যায় না। অন্যদিনের মতো আজও রাতে পাম্প দুটো চলছিল। রাতে চললে ইঞ্জিন কম গরম হয়। জোরে হাঁটলে পা হড়কে যেতে পারে। পেট্রোল ট্রাঙ্কে কাঠি ঢুকিয়ে দেখলো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না। তবু মনে হল, তেল বড়ো বেশি পুড়ছে। স্পার্কে টিনপ্লেট চেপে ধরতেই বটবট করে পাম্প থেমে গেল। হাওয়ার গতি ভাল নয়। বৃষ্টির ফোঁটা বড়ো বড়ো হয়ে পড়তে পারে। তখন গরম ইঞ্জিনে জল পড়ে যে কোন কাণ্ড ঘটতে পারে। দুটো পাম্প বন্ধ করে দিয়ে ত্রেপল চাপিয়ে দিয়ে ফিরে আসছিল কুবের, ‘তুমি এখানে?’

‘টর্চের আলোর ঝলক দেখেই বুঝেছি—তুমি উঠেছ—‘

‘তাই বলে অন্ধকারে এতোটা এসে ঠিক করোনি।’

‘ভেবেছিলাম অতবড় গাছটা চিতায় জ্বলছে—সহজে নিববে না, আলো পাবো। যা হাওয়া কিছুই টিকছে না—’

কুবের এখন একটা বিরাট সর্বনাশের নিরুপায় দর্শক। ভোরের রোদে যেসব ফুল ধানের খোলে পড়ে ক’দিনেই দুধ হয়ে যেতো, গাছ শুকিয়ে হলুদ হলে পাকা ধান হতো—তার সবই বোধহয় আজ রাতে খ্যাপা হাওয়ায় ঝরে যাবে। এতো কাঠখড় শুধু শুধুই পোড়ানো হল।

‘কিছুই আর থাকবে না আভা। শেষ অব্দি বিঘে পিছু হাঁড়িমাপা ধান হয় কিনা সন্দেহ।’

‘কিছুই থাকবে না? বলেছিলে, হাওয়ায় হাওয়ায়, পাখি নয়তো ফড়িংয়ের ঠোঁটে, নোখে, পায়ে ফুল গিয়ে ধানের ভেতরে পড়ে—ধান হয়।’

‘এতো হাওয়া নয়। এ যে ঝড়। কিছু থাকবে না আভা, সব ঝরে যাবে। ধানে দুধই ধরবে না—’

কুবেরের চোখ দেখতে পাচ্ছিল না আভা। তবু বুঝতে পারলো, কুবেরের ভেতরে কি হয়ে যাচ্ছে। আগে বালি নষ্ট হলে, একখানা ইট অসাবধানে ভেঙে গেলে কুবের মনে মনে কিউবিক, হাজারের দর নিয়ে অঙ্ক কষে দেখতো—কতো পয়সা গেল। তারপর আস্তে আস্তে কুবেরের একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। চুপচাপ গচ্চা খেতে পারে। নিঃশব্দে সর্বনাশ বুক পেতে নিতে পারে। কারবারে ওঠাপড়া আছেই। এতোকাল এই কথাটাই নিজেকে বুঝিয়ে এসেছে কুবের, কিন্তু আজ—

এই নিশুতি রাতে অচেনা দ্বীপের বুকে দাঁড়িয়ে কুবের বারবার বুঝতে পারছে—এই নদী, এই মাটি—বাতাসের দাপাদাপি, ভগবানের

মাটি—বাতাসের পোকামাকড়-সবকিছুর হাতে সে শুধুই একটা পুতুল। তার শুধু কাজ করে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কোন রাস্তা নেই।

যা ভেবেছিল—সেই বৃষ্টিই এলো। দূরে এক সঙ্গে কোথায় নদীর বুকে কোটি কোটি জলের দানা, শীলের কুচি পড়ে খই হয়ে ফুটছে। অন্ধকারেই কুবের দাঁড়িয়ে পড়লো। ছবিটা তার চেনা। কদমপুরের বাড়িতে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কতোবার দেখেছে।

আভা দাঁড়াতে দিল না, ‘ছুটে এসো। ভিজবে নাকি এখানে দাঁড়িয়ে—’

‘তুমি যাও।’

‘পাগল নাকি! তোমায় ফেলে যাবো আমি? চলো বলছি। এই শরীরে দাঁড়ানো যায় না কুবের।’

সেদিন দুপুরের পর থেকে কুবের আভাকে খানিক ঘেন্না দিয়েই দেখতে শুরু করেছিল। আসলে হয়তো ঘেন্না নয়। তার সব কাজের মাঝখানে মূর্তিমতী বাধা একেবারে। একরকমের আক্রোশ তৈরি হচ্ছিল আভাকে নিয়ে। ভেতরে ভেতরে সে সব সময় ফুঁসছিলো।

আভার পেছনে কুবের তাঁবুতে এলো। বাইরে এতো দাপাদাপিতেও আলোটা ঠায় জ্বলছে। তাঁবুর ওপরে এখন অকালের বৃষ্টি ধারা হয়ে ভেঙে পড়ছে। বাইরে ছুটে গিয়েও কুবের এখন দ্বীপজোড়া সর্বনাশের এতোটুকুও আটকাতে পারবে না। দামে ভরাট দিঘির মাঝখানে পদ্মপাতাগুলো নিশ্চয় বাতাসে উলটে পালটে যাচ্ছে। মেদনমলুর দুর্গ ধোয়া জল আগাগোড়াই বাথানোর ঢালু গা বেয়ে তোড়ে নাবাল জমিতে গিয়ে পড়ছে। এই সর্বনাশটুকু তার জন্যে এতোদিন ওঁৎ পেতে বসেছিল। ক’দিন আগেও আকাশের গায়ে এতোটুকু মেঘের চিহ্নও দেখা যায়নি।

বাইরে তাকাতে পারলো না কুবের। এখন তার সাধের চাষ-আবাদের ষোল আনা বাতাসের পায়ের নীচে, জলের দয়ায় পড়ে আছে। কতো জায়গায় বিঘের পর বিঘে ধানের কোমর ভেঙে শুয়ে পড়েছে। ঝরা ফুলগুলো এবার ফড়িং খুঁটে খুঁটে খাবে। জল শুকোলে পোকা-মাকড় উঠে আসবে। কামলারা এতক্ষণে উঠে বসেছে। আপাতত খানিক ছাদের জন্যে তারা মোটা খিলানের গায়ে একমাত্র দাঁড়ানো বিরাট দেওয়ালটার আড়ালে গিয়ে মাথা তুলে তুলে আকাশের ভাবগতির আন্দাজ নিচ্ছে।

ভিজে সপসপে জামাটা কতোকাল গায়ে আছে কুবের জানে না। অনেক দিন পরে আভা আজ আবার এই নিশুতি রাতে দিব্যি তড়তড় করে চলাফেরা করছে। এতদিন পরে কুবের যে আবার তাঁবুতে আসবে—তাও প্রায় এক ডাকেই—আভার একদম বিশ্বাস হচ্ছিলো না, ‘নাও এই শাড়িটা পরে নাও।’

আভার বোঁচকায় কি আছে কি নেই—কেউ বলতে পারে না। আদ্যিকালের সেই ব্লাউজটার লেসের ঝালর বসানো একটা হাতা বাইরে ঝুলে আছে। কুবেরের একটা আমলের সাক্ষী এই ব্লাউজ! ড্রিম মারচেন্ট থেকে চকদার—কুবের সাধুখাঁর এই লম্বা রাস্তার অনেকখানিই আভা সঙ্গে সঙ্গে আছে। আজ কিছুকাল এই মেয়েমানুষটি তার সঙ্গিনী।

কলকাতার কোন ফ্ল্যাটের সন্ধ্যেবেলা—এইভাবে, প্রায় কিছুই হয়নি পোজে আভা মাথা ঘষে, শাড়ি পালটে আলোর সামনে চুল বাঁধতে বসলো। বাইরে তখন কুবের একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল, কোন শিষেই দুধ ধরবে না-ফুল সব ঝরে যাবে, এখনই যাচ্ছে কিছুই থাকবে না। হাজার হাজার মনে ধানের হাতছানি দেখতে দেখতে কুবের এতোটা পথ এসেছে। ভদ্রেশ্বর তাকে এই রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সেই যে কবে কেটে পড়েছে। ধানের দর এবার আরও পড়তে পারে। এতোদিনকার ড্রিমসেলার কুবের সাধুখাঁ এবার নিজেই ধানের ঘোরে পড়ে, টাকার স্বপ্নের মায়ায় দুলতে দুলতে কদমপুর থেকে মেদনমল্লর দ্বীপে এসে পড়েছে।

‘পা মুছে শুয়ে পড়ো। সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি! চুল বাঁধা হয়ে গেলেই আলো নিবিয়ে দেবো।’

কুবেরের মুখে কোন কথা এলো না। সারাটা দিন, তারপর এই টানা রাত—সবটাই কুবেরের খারাপ যাচ্ছে। কাপড় পালটে সবে দাঁড়িয়েছে, আভা বললো, ‘পুঁটলিটা দাও না গো—‘

কুবের ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। হাওয়া কমলেও বৃষ্টির ধারা পড়ছে তো পড়ছেই। ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে একদিন এই দ্বীপে নেমেই মনে হয়েছিল, দুনিয়া কি বিরাট। যতো দূর যাও সবটাই তোমার। তবে জোর খাটিয়ে মুঠোয় ধরে রাখা চাই। দাপটে রাখতেই হবে। তখন আলোর মধ্যে সূর্যরশ্মি শিমুল ফলের ধারায় ফেটে গিয়ে পেঁজা আলো গুচ্ছ গুচ্ছ ছড়িয়ে দিত। পৃথিবীতে যে কত আনন্দ ছিল! সেই ঢালাও দ্বীপ ছোট হতে হতে এখন এই তাঁবুর ঘরের মধ্যেই দিব্যি ধরে গেছে। কুবের তার বাইরে যেতে পারছে না কিছুতেই।

‘এইভাবে কেউ জিনিস দেয়?’

কুবের লজ্জা পেলো না। কেন না এই মেয়েমানুষটির সঙ্গে সে আর কোনরকমের যোগাযোগ বোধ করছে না। তাই পুঁটলিটা দিতে গিয়ে কাপড়চোপড় সুদ্ধ একরকম ছিটকে গিয়ে বিছানায় পড়েছে। নীচু হতে গেলে কুবেরের মেরুদণ্ডে লাগে। সেখানকার চাকতিগুলো শুকিয়ে খটখট করছে। কিছুদিন কি হয়েছে, ভোরবেলার কথা দুপুরে ভুলে যায়। কোনটার পর কি করতে হবে-পর পর সাজিয়ে নিয়ে ভাবতে পারে না। কুবের তার সারাজীবনের টাইমপিসটা নিজে নিজেই মেরামত করতে বসে —আগাগোড়া খুলে পরের পর খাপে খাপে বসিয়ে তুলতে পারছে না কিছুতেই। ফলে অনেকগুলো বছরের গাদাখানিক জিনিসপত্তর জট পাকিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।

আভা বাইরে এতোখানি জলকাদা ভেঙে এসে অনেক আশা করে চুল বাঁধতে বসেছিল। কুবের কতোদিন পরে তাঁবুতে। পুঁটুলিটা দেওয়ার কায়দা দেখে তার মাথা আরও নীচু হয়ে গেছে, হাতের আঙুলগুলো বেণী ধরে থেমে আছে—এবারে গুটিয়ে আলগা খোঁপা পাকানো দরকার, আভার মনে নেই—চোখে জল এসে দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমার গায়ের রক্ত খারাপ আভা। তোমার শরীর এতদিনে বিষে ভরে গেছে—’

আভার মন কুবেরের কথা ধরে ধরে সেদিকেই গেল না। শুধু বললো, ‘তুমি তো এমন ছিলে না কুবের—

‘যেদিন থেকে, খারাপ রক্তে আমি ভরে গেলাম—‘

‘খারাপ রক্ত তুমি পাবে কোথায় কুবের? সুস্থ ছেলেমেয়ে হয়েছে তোমার—’

‘তোমার বিশ্বাস হবে না আভা—আমি জানতাম। একটা স্যাভ্ ঘটনায়—খুব অল্প বয়সে—’

‘আবার ভুল বকতে শুরু করেছ!’

‘আমার পিঠে ফি বছর একরকমের বিদঘুটে ব্রণ বেরোয়। আন্দাজে চুলকোতেই গলগল করে পাতলা রক্ত বেরিয়ে পড়ে। দেখেই বোঝা যায় পানসে, ফ্যাকাসে, দোষে ধরেছে—’

‘বুঝেছি। এক কাজ করতো—আমার বালিশের নীচে এই পুঁটুলিটা দিয়ে দাও—আজকাল এক কাতে শুয়েই রাত শেষ হয়ে যায়। নীচু বালিশ বলে মাঝে মাঝে ঘাড়ে ব্যথা হয়—‘

‘আমি সবই প্রায় ভুলে যাচ্ছি আভা। জানি না সেই বিষ শরীর বেয়ে বেয়ে মাথায় গিয়ে জমা হচ্ছে কিনা—‘

‘থামবে। আমি আর জেগে বসে থাকতে পারছিনে কুবের।’

পুঁটুলিটা তুলতে গিয়ে কুবেরের এবারে বেশ ভারি ঠেকলো। টিপে দেখতে গিয়ে শক্ত কি হাতে লাগতেই জামাকাপড়ের বোঁচকাটা বিছানায় নামালো। গিঁট খুলতেই কাপড়, ব্লাউজ, সুরমাদানি, পুঁতির মালার ভেতর থেকে জিনিসটা বেরিয়ে পড়লো।

‘এটা কি আভা?’

‘কিছু না—‘

‘তার মানে। এ যে দেখছি চন্দনে দাগানো।’

এবারে আভা চুপ করে থাকতে পারলো না, ‘তোমার দাদার শিব। রেলেশ্বর শিব। ইনি এসে ইস্তক তোমার ব্রজদার হাল ফিরেছে—’, তার পরেরটুকু এইভাবে বলা উচিত ছিল, সেদিন মাঝরাতে উঠে কেটে পড়ার আগে শিবতলার খ্যাপা মোহান্তকে না জানিয়ে বেলপাতা ঘেঁটে অন্ধকারের মধ্যেই এই পাথরখানা তুলে এনেছি। সে জানে, যাঁর জন্যে স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির গড়ে তুলছিল ব্রজ দত্ত—সেই পাথরখানা তার আগে মজা—পিয়ালির বুকে ওঠার মুখে রেলপুলের গোড়ায় বহুকাল পড়েছিল।

‘এই শিব নিয়ে ব্রজদা ঠাকুরতলা বানাচ্ছিল?’

‘বানাচ্ছিল কি! বানিয়ে বসে আছে।’ তারপর আভা বাইরের জলেভেজা ভাঙাচোরা নিশুতি রাতের একদম পরোয়া না করে খুব খানিক হেসে নিলো, অনেকদিন পরে বসা-চোখের নীচে, তেরিয়া গলার ভাঁজে ভাঁজে সেই হাসির ঝাঁজ এসে প্রায়ান্ধকার এই তাঁবুর ভেতরকার আলো মেয়েমানুষটির সারাটা কাঠামোর সামনে উসকে দিলো, ‘তুমি তো এতো সব কিছুই দেখে আসনি। কতো পুজো, কতো মানত-ভক্তের কামাই নেই। ফকির শেষে শিব-সেবায়েৎ। মোহান্ত! তোমার আভারাণীও শিব-সাধিকা সেজেছিল—’ এখান থেকে কাঁদতে শুরু করে দিল আভা। বাইরে বৃষ্টিতে পেট্রোল মাখানো আগুন হেরে গিয়ে নিবে গেছে।

বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। কামলাদের গলা পাওয়া যাচ্ছে। কুবের বুঝলো, আর ফেরার উপায় নেই কারও। ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। কোথায় কদমপুর, কুবের রোড, হরিরাম সাধুখাঁর ভদ্রাসন। মা নেই। নগেন একবার ছোটবেলায় পুকুরে ডুবতে ডুবতে উঠে আসার পর ওর সারাটা বুক লাল হয়ে উঠেছিল। আমার পিতা শ্রীদেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁ কোনকালেও টাকার মুখ দেখেননি। সেই মুখ খুব বেশি করে দেখতে এসে এ-কোথায় পড়ে গেল কুবের।

‘লোকটার সারাজীবনের সাধ মিটে আসার মুখে মুখে এ তুমি কি করলে আভা?’

‘ঘুমোচ্ছিল পড়ে পড়ে। নইলে লোকটার চোখ উপড়ে নিয়ে আসতাম কুবের—’

‘তাই বলে সাধের শিব—‘

‘শুধু নিজের স্বপ্নটুকুই চেনে তোমার ব্রজদা। আমার সে কি হল কেউ দেখেনি কোনদিন। আমি একটা মানুষ—কতকাল কোণে পড়ে আছি। আমায় যে সাজিয়ে গুজিয়ে সাধিকা বানিয়েছিল খ্যাপা মোহান্ত!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *