॥ আঠারো ॥
বোরো চাষে কার সাধ্যি চাষ করে। সারাদেশ উদোম করে গরু ছেড়ে দেবে সবাই। গরু তাড়াবে না চাষ করবে? একেবারে ন্যাংটা জায়গা। তাই কদমপুরে বোরো চাষে নামার ভরসা হয়নি কুবেরের। কিন্তু ভদ্রেশ্বরের কথায় মেদনমল্লর দ্বীপে হুড়হুড় করে গুচ্ছের টাকা ঢেলে বসলে চাষবাসে। সেখানে গরু সামলানোর ঝক্কি নেই।
‘বড়বিল’আর ‘ডাহুক’-দু’দুটো লঞ্চ বোজাই হয়ে বস্তা সার, বীজধান—কয়েক টিন পাম্প চালানোর পেট্রোল আর পোকা মারার ওষুধ দ্বীপে চলে গেল। মোষের হাল দশটা। মাঠের পর মাঠ জমি ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। চুচকো ঘাস পাম্পের জলে মাটিতে মিশে সুন্দর পচানি হচ্ছে। মাটি দিয়ে গন্ধ উঠলেই কলা করা বীজধান ছড়িয়ে দেওয়া হবে। দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে সারাটা দিন কুবেরের তদারকিতে কেটে গেল। তারপর ‘ডাহুক’-এ চড়ে কুবের সন্ধ্যে সন্ধ্যে কদমপুর পাড়ি দিল। ইদানীং কুসুম তার বড় আকর্ষণ। সৃষ্টিধর ব্যস্ত-সমস্ত কুবেরকে পায় না। বুলুর হাজারো কাজকর্ম। তাকেও কাছে পায় না ছেলেটা। তাই কখনো গোয়ালে-নয়ত পুকুর ধারে একখানা লাঠি হাতে অনাথ হয়ে ঘুরছে সবসময়।
এসবের মাঝখানে কুবেরের তাই ভীষণ ছন্নছাড়া লাগে। লোক নেই, জন নেই। পুঁচকে একটা সংসার ঘাড়ে নিয়ে ভীষণ হালকা মনে হয়। কোন ভার নেই। দুশ্চিন্তা নেই। অথচ এই চাষবাস, জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি, পুকুর -গাছগাছালি, গোয়াল—দোহাল, হাঁস, কুকুর, সৃষ্টিধর, বুলু, কুসুমকে নিয়ে—বাইরে থেকে দেখলে—তাকে ঘোর সংসারী বলে ভুল হবে। আরও, আরও করে আজ তিন-চার বছরে জমি-জিরেত বেড়েছে অনেক। ব্যাংকের নানান ঝকমারিও শিখে ফেলেছে। নিজের টাকা নিজে তুলবে—তাও অষ্টগণ্ডা সই চাই।
চাষের মরসুমের জন্যে ভাড়া করা লঞ্চ। ‘ডাহুক’-এর সারেঙ ঘর থেকে ভদ্রেশ্বর তরতর করে নেমে এল, ‘সাধুখাঁ মশাই আপনি কালে কালে চকদার বনে যাবেন!
কুবের না বুঝতে পেরে তাকিয়ে আছে দেখে ফিরে বললো, ‘কিয়ৎকালের মধ্যে আপনার মত চাষী এই ভূমণ্ডলে আর কেউ থাকবে না।’
ভদ্রেশ্বরের ভাব এলে ভাষা সাধু হয়ে যায়। বুঝিয়ে বললো, অনেক জায়গা নিয়ে চাষ-আবাদ করলে তাকে চকদার বলে। এতখানি জায়গা নিয়ে এই দক্ষিণ দেশে কেউ নাকি চাষবাস করেনি এর আগে। কথাটা শুনে কুবেরের বুক ফুলে ওঠার কথা। কিন্তু তা হল না। রোঁয়া বাকি। সার নিড়েন, জল দিতে হবে। ফসল না ওঠা অবধি কত বিপদ। মজুরদের গুডুলবাঁশে কয়েকটা বনমুরগি মারা পড়েছিল। তার ঝলসানো মাংস খেতে খেতে কুবের দেখল হ্যাজাক বাতির আলোয় ভদ্রেশ্বর প্রায় কষের দাঁত বের করে বুড়ো মুরগিটার পোড়া দাবনা চিবোচ্ছে, চাটছে—বাগে আনতে পারছে না কিছুতেই।
চারদিকে কুয়াশা,লঞ্চের একঘেয়ে আওয়াজ, পেছনে মেদনমল্লর দুর্গ, দ্বীপ—দুই পড়ে থাকল। কুবেরের খুব ইচ্ছে হল, দরজা জানালা আটকে দিয়ে সৃষ্টিধর, কুসুম, বুলুকে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু কাল ভোরের আগে কদমপুর পৌঁছানো যাবে না।
পরদিন খুব ভোরে ‘ডাহুক’ এসে লঞ্চঘাটায় নোঙর ফেলল। কুবের তখনও ঘুমে। ভদ্রেশ্বর ভোরের ট্রেন ধরে কদমপুর যাবে বলে কুবেরকে জাগাবার চেষ্টা করল। সুবিধে হল না। সারেঙকে বলে নেমে গেল।
তার একটু পরেই কাউকে কিছু না বলে লঞ্চে যে -উঠল, তাকে সারেঙ চেনে না। মাল্লারাও না। যে চেনে সে ঘুমোচ্ছিল
ধাক্কা খেয়ে কুবের চোখ খুলল। প্রথম দমকে চিনতে পানেনি। সুরমার টান দেখে এক ঝলকে চেহারাটা ফুটে উঠল। ‘তুমি?’
‘আজ তোমার লঞ্চ ভিড়বে জানতাম। ভোরের ট্রেনেই চলে এসেছি। মোটে তো বিশ মিনিটের পথ—’
‘তাই বলে একা? এই সকালে?’
‘চলে যাব?’
‘তাই বলেছি!’ এর বেশি কিছু বলতে পারল না কুবের। কিছুকাল চাষবাসের নানান ভেজালে দিনগুলো হুহু করে কাবার হয়ে যাচ্ছিল। একটু নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। তার মাঝখানে কুবের শুধু একজনের মুখ দেখতে পেয়েছে, সেই একজন শুধ একটা কথাই বলছে, ‘কি হবে এসব দিয়ে আমাদের? তুমি এবারে থামো।’ সেই একজনের নাম বুলু।
বেলা এগারোটা নাগাদ টাটকা মাছের ঝোল, নতুন চালের ভাত পেটে পড়তেই কুবের গরম হয়ে উঠল। পাটাতনে লেপের মধ্যে বসে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে আভাকে কাছে ডাকল। নদনদে কাদা ভেঙে দূরের চালানী নৌকোয় কুলিরা বরফের চাঙ্ তুলছে। মাছ আসবে বড় নদী থেকে। ক’দিন ধরে সব কিছু ফাঁকা লাগছিল। তার ভেতরে আভা এসে দাঁড়াতেই কি একটা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।
মাল্লাদের একজন বালতি বালতি জল তুলে দিচ্ছিল নদী থেকে। আভা নিজের বাড়ির উঠানের মত করে পাটাতন মুছে দিচ্ছিল। কেবিন বলতে বড় ঘরখানা একদিন ভদ্রশ্বরের দখলে ছিল প্রায়। কুবের ডাকতেই উঠে আসেনি আভা। সেই আভা—প্রথম কদমপুরে এসে যার পায়ে খড়ম দেখেছিল কুবের গলায় ডুমো ডুমো কালো পাথরের মালা।
‘ওদের দিয়ে পান আনিয়েছি। নাও ধরো।’
ভাত খাওয়ার পর পান, এই শীতে সঙ্গে সিগারেট। ফাইন। কুবের সারেঙকে দুপুর দুপুর লঞ্চ ছাড়তে বললো।
‘কোনদিকে যাবেন?’
কুবের ফট করে কিছু বলতে পারল না। কোথায় যাবে, সে নিজেও জানে না। মুখে বললো, ‘ইঞ্জিন গরম হোক তো আগে—’
আভা বললো, ‘এই লঞ্চখানা তোমার?’
‘নাঃ! ভাড়া নিয়েছি। আরও একখানা আছে।’
‘কোথায়?’
‘আমার দ্বীপে-’
‘তোমার দ্বীপে?’
‘ওই হল। মেদনমল্লর দ্বীপ। চর বললে ছোট করা হয়। কয়েক মাইল লম্বা হবে। চওড়া মাইল দুই। কেউ কোনদিন যায়নি সেখানে—মানে ইদানীং বিশ পঞ্চাশ বছরেও তো কেউ যায়নি—’
‘বুলু বলছিল তুমি সেখানে চাষ-আবাদে নেমেছ। জে এল আর ও অফিস থেকে নিজের নামে খাজনা করে নেবে পরে
‘বুলুর সঙ্গে দেখা হল কবে?’
‘বাঃ! ও তো তোমার দাদার রেলেশ্বর শিব দেখতে প্রায়ই যায়।’
কুবের মাসখানেক বাড়ির কোন খবরই রাখে না। রাখতে ইচ্ছে করে না। বাড়ি নাকি ওটা। তার চোখের সামনে হরিরাম সাধুখাঁর ভরভরাটি পরিবারের ছায়া সব কিছুকে ঢেকে আছে। ‘তুমি আর কদমপুরে থাক না?’
‘কবে চলে গেছি! সেখানেই তো ছিলাম।’ থেমে গিয়ে ফিরে আভা বলল, ‘থাকা যায় না—‘
কুবের চুপ করে থাকল। কেন থাকা যায় না? অসুবিধে কি? ব্রজ দত্ত কেমন আছে? তার ঠাকুরতলা বানানোর কদ্দুর? কোন কিছুই জানতে চাইল না কুবের। একদিন তার মাথার মধ্যে শুধু ধানের ঢিবি পাহাড় হয়ে উঠছিল। ধান ফেলা প্ৰায় সারা। চারা হলে তুলে তুলে রুয়ে দেওয়া শুধু। তারপর একদিন পাকবে। আছড়াতে হবে। বস্তা বোঝাই হয়ে চরের ফসল লঞ্চঘাটার বাজারে আসবে শেষে।
আমি কুবের সাধুখাঁ। বয়স চল্লিশের দিকে যাচ্ছে। এই মাঝ বয়সে আমার কেউ নেই।
‘জানো আভা একদিন আমি তিরিশ টাকার একটা চাকরি পেয়ে খবরটা দিতে বাড়ি ফিরলাম। মা ঘুমোচ্ছিল। ঘুম ভেঙে মার কি কান্না! আনন্দাশ্রু! তখন আমি দোরে দোরে ঘুরি কাজের জন্যে! এখন!’
কিন্তু এতটা ঝুঁকি নিলে কেন কুবের। এদিকে ফসল সবাই ঘরে তুলতে পারে না। মুছে নিয়ে যায়।’ আরও অনেক চিন্তার কথা ছিল আভার মনে। কিন্তু কুবেরের মুখ দেখে বলতে পারল না। কথাগুলো হলঃ কুবের, বাজারও তো পড়ে যেতে পারে! ডাকাতি হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এত সব দিয়ে কি হবে তোমার। পুরুষলোকের একটা জিনিস আভা কিছুতেই ধরতে পারে না। ব্রজর ভেতরেও এ—জিনিসটা দেখেছে। যখন আর দরকার নেই—তখনও ছুটছে। স্বস্তি কাকে বলে চেনে না, জানে না। রেলেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠার নামে, ঠাকুরতলা বানানোর জন্যে কি না করে চলেছে। শেষকালে তাকেও প্রায় নীলামে তুলেছিল।
‘আর তো কোন ঝুঁকি নেই আভা। আমি তো জমির ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। এ তো সরল কারবার। খুব সরল। চাষ কর আর ফসল ঘরে তুলে নিয়ে যাও!’
‘কত টাকা লাগিয়েছ চাষবাসে?’
‘আমার সর্বস্ব! হাজার বিঘের ওপর চাষ।’ তারপর কি মনে হতে দূরে বসা আভাকে একরকম হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এল এক ঝটকায়।
অরক্ষিত মেয়েমানুষ সব সময় যে কোন পুরুষেরই প্রিয় জিনিস।
ইঞ্জিন গরম হয়েছে অনেকক্ষণ। ‘ডাহুক’ এখন বটবট করে সামনের খুদে চরটা বাঁয়ে ফেলে বড় নদীর দিকে এগোচ্ছে।
আর কোন আড়াল থাকল না।
আভা কুবেরের গায়ে ঠেসান দিয়ে এক একটা নদী দেখায়-আর কুবের তার নাম বলে। প্রায় খুকিটি সেজে আভা একেবারে কলকল করে কথা বলে গেল অনেকক্ষণ। এতখানি নিশ্চিন্তির স্বাদ কতকাল পায়নি। তখনও এক একবার তার মাথার ভেতরে ড্রিলিংয়ের লোহার চেন কড়-কড়-কড়-কড় আওয়াজ তুলে গভীরে নেমে যাচ্ছিল। আর বিটকেল দেখতে একটা বন্দুক হাতে সাহেব মিত্তির তারই বুক লক্ষ্য করে এক চোখ বুজে টিপ নিচ্ছিল।
‘কি করে এলে এখানে?’
‘পরে বলব’খন। সে অনেক কথা।‘
কুবেরেরও খুব জানার ইচ্ছে ছিল না।
সারেঙ এসে বললো, ‘পূর্ণিমে সাহেব। একটানা চালালে মাঝ রাতেই দ্বীপে পৌছে যাব।’ কুবের মাথা নেড়ে সায় দিতে লোকটা চলে গেল। পয়সা হওয়ায় ভদ্রেশ্বর এদানী তাকে সাধুখাঁ মশাই বলে ডাকে।
‘পূর্ণ চাঁদের মায়ায়’–বামুন কায়েত বাড়ি অনেক মেয়ে হারমোনিয়ম খুলে বসে এসব গান গায়। নদীনালার পথে রাত-বিরেতে পূর্ণিমা যে কি জিনিস, তা একবার দেখলে ওসব গান গাইত না। একবার দ্বীপ থেকে ফেরার পথে কুবের আর ভদ্রেশ্বর পূর্ণিমার মধ্যে পড়েছিল। গা ছমছম করে। চরের গাছপালা তখন ফটফটে জ্যোৎস্নায় ডালপালা মেলে দিয়ে জেগে ওঠে। একটু হাওয়া পেলে তো কথাই নেই। সরসর আওয়াজ লেগেই থাকে।
পূর্ণিমার নাম শুনে আভা অনেকদিন পরে কুমারী হয়ে গেল একেবারে। লঞ্চঘাট থেকে এই মেয়েলোকটি আজ সকালে যখন একটা বোঁচকা হাতে নিঃশব্দে ‘ডাহুক’—উঠে এসেছিল—তখন কে জানত এত জিনিস তার সঙ্গে ছিল।
সূর্য ঢলে পড়তে ‘ডাহুক’ তিন তিনটি নদী কেটে বেরিয়ে গেল। আভা কুবেরের সামনেই মাথার খোঁপা ভেঙে বিনুনি বাঁধতে বসল—একদম পা ছড়িয়ে। কতকাল এমন মেয়েলোক দেখেনি কুবের।
আভা দাঁতে বিনুনি কামড়ে চাপা গলায় বোঁচকা থেকে ব্লাউজ বের করে দিতে বললো।
কুবের বেছে বেছে যেটা বের করে দিল, আভা দেখে নাক কুচকে আপত্তি করল।
‘কেন? পরো না।’
কত পুরনো। ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায় —
‘ওতেই হবে।’
‘বোলছো!’
কুবের মাথা নাড়ল। সে এই জামাটা চেনে। কতকাল আগে—সেই প্রায় সত্যযুগে আভা এই লেজ লাগানো ব্লাউজ গায়ে খালপাড়ে মাছ কিনতে গিয়েছিল চাঁদের আলোয়। এখন সে জায়গার নাম কুবের রোড।
ব্লাউজটার বোতাম পেছনে। কুবের আটকে দিল। থ্যাঁতলানো বেণীটা পিঠে পড়ে আছে। মাথা, ছোট মত চিবুক। কুবের আলগোছে হাত রাখল পিঠে।
চিরুনির মাথা দিয়ে সিথিতে সিঁদুর ঘষে আভা ঘুরে বসল। ‘এইবার বল কেমন দেখাচ্ছে। তোমার বউর চেয়ে ভাল?’
‘ও কথা বললে কেন? বুলু আমার ছেলেমেয়ের মা। তাকে আমি সবসময় ভালবাসি।’
‘বারণ করেছে কে? যত ইচ্ছে ভালবাস।’ একটু থামল আভা, ‘তার কতখানি জান তুমি? তুমি তো জায়গা-জমি, চাষবাস নিয়ে মজে আছ।’
‘তোমারই বা কতটুকু জানি আভা!’
‘যা জেনেছ বেশ জেনেছ। নাও সরে বস—’, আভা বেশ লেপটে তোশকের ওপর বসে পড়ল। খানিক আগেও চাঁদের একখানা ছাপ আবছা হয়ে আকাশে লটকে ছিল। এখন তার ভেতর দিয়ে আলো গলে পড়ছে। সারেঙ জানে পূর্ণিমার রাতে সাধুখাঁ সাহেব লঞ্চের হেডলাইট জ্বালানো পছন্দ করেন না। আভার মনে হল, লঞ্চটা কোনদিকে না তাকিয়ে নদী দিয়ে, খাল দিয়ে শুধু চাঁদের দিকেই ছুটছে।
কুবেরের ন্যাড়া মাথায় ভেলভেটের চেয়েও পুরু হয়ে চুল উঠেছে। তাকে কেমন দেখতে সে নিজে জানে না। অন্তত বছর তিন-চার এসব নিয়ে ভাবার ফুরসৎ হয়নি তার। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে কাত হয়ে বসেছিল! আভা আচমকা ঘুরে বসে শব্দ করে একটা চুমো খেল তার ঠোঁটে
‘এসব কি হচ্ছে?’
‘কথা ছিল না। তাই না?’
কুবের সোজা হয়ে বসে বললো, ‘ওই দেখ—হাত তিরিশেক হবে না এখান থেকে ওই ধবধবে জ্যোৎস্না মাখানো জঙ্গলে বাঘ আসে —‘
‘সত্যি!’
‘লঞ্চ ভিড়াতে বলব? নেমে আলাপ করে আসবে—’
‘দোহাই তোমার। অনেক গুণ আছে তোমার। ওসব আর দেখাতে হবে না।’ কুবের গা ঘেঁষে বসতেই একবার ইচ্ছে করল জাপটে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু কি মনে হতে বুঝল, এসব করে লাভ কি! হয় কি তাতে। শীতকালে জড়াজড়ি মন্দ জিনিস না। কিন্তু তারপর সব তো সেই একই ব্যাপার।
নদীটা ছোট ছিল। দু’ধারের জঙ্গল পরিষ্কার দেখা যায়।
এসব দেখে দেখে কুবেরের চোখ পচে গেছে। আভা কিন্তু গিলছিল। বুলু আর কুবেরের মাঝখানে এখন কয়েকটা নদী, কয়েক মাইল মাঠ, গোটা কয়েক স্টেশন চাঁদের মায়ার মধ্যে পড়ে, লুটোপুটি খাচ্ছে। মা আর তার মধ্যে যে এখন কত যোজন যোজন মাঠ, বিল, নদীনালা পড়ে আছে কে বলতে পারে। এখন সে চকদার কুবের সাধুখাঁ। মুশকিল! এত সব খাবে কে? লোক কোথায়!
তবু আজও কুবেরের ইচ্ছে হচ্ছিল, জগৎ জুড়ে যদি আবাদ করা যেত। এক একটা মাঠ কি বিরাট। কার কতখানি, আগে আগে ভাগ করা আছে। কুবের সব এক করে নিয়ে চষে ফেলতে চায়। তারপর ধান ছড়িয়ে দেবে। চারা বেরোবে। তখন বীজ ভেঙে রুয়ে দেবে শুধু।
টাটকা মাছ যেভাবেই রান্না হোক খুব স্বাদু। কুবের আভাকে কিছুতেই চাঁদের আলোয় খেতে বসতে দিল না।
রাগে রাগে কেবিনে গিয়ে খেতে বসল আভা। কি হয় জ্যোৎস্নায় খেতে বসলে?’ ভূতে ধরে।’
‘তুমি যে বসে আছ দিব্যি। নিজের ছায়ার মধ্যে বসে খাচ্ছ?’
‘আমার ভূত ভবিষ্যৎ কিচ্ছু নেই। আমি আগে ছিলাম লাভ-মেশিন,এখন মানি—মেশিন—আই মিন্ট মানি—‘
জ্যোৎস্নার নিরালায় যেসব হাওয়া উঠে গাছপালা, নদীর জল সবই কিছুটা নেড়ে দিয়ে যায়—তারই খানিকটা উঠল। যথারীতি গাছপালাও হাওয়ায় ঢলে পড়ে সায় দিল। সরসর আওয়াজ। সঙ্গে লঞ্চের একটানা বটবট। আভা কিছুই শুনতে পেল না, ‘কি বলছো?’
‘ও তুমি বুঝবে না—’
‘তোমরা সব পুরুষই ওই এক কথা শিখেছো।’
‘খেয়ে নাও।’
‘নুন কোথায় তোমার?’
কুবের এগিয়ে দিল।
‘আমি কিন্তু খেয়ে-দেয়ে আবার পাটাতনে গিয়ে বসব।’
‘যত ইচ্ছে বোসো। আমি গিয়ে ঘুমোবো।’
কুবের জিভে কামড় খেল। খেতে খেতে কথা বললে এই দশা।
‘বুলু বোধ হয় তোমার কথা বলছে এখন। দূরের মানুষ মনে করলে অমন হয়।’
কুবের খাওয়া থামিয়ে সোজা আভার দিকে তাকাল, ‘আর কি কি জান তুমি?
আভা একটুও অপ্রতিভ হল না। সোজাসুজি বললো, ‘আসলে আমি দেশগাঁয়ের মেয়ে। কিছুকাল শহর ঘেঁষে আছি। তখনই তোমার দাদার সঙ্গে বিয়ে। তেল পড়লে টাকা আসে, পা চুলকোলে ভ্রমণ লেখা আছে কপালে—এসব ছোটবেলা থেকেই শিখেছি কুবের।’ দম নিয়ে বললো, ‘বুলুর কথা বললেই অমন গম্ভীর হয়ে চোখ গোল করো কেন? আমি তোমার বিয়ে করা বউ নই—সে আমি জানি।’
এখন আভা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে পারলে সিনটা কমপ্লিট হত। কিন্তু জ্যোৎস্নার আলোয় বিদেশী জায়গার ভেতর দিয়ে লঞ্চটা যাদের পাটাতনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল—তাদের কেউই আনকোরা নয়। অনেকদিন আগে থেকেই এরা শোলার মালা হয়ে জলে ভাসছে। ভাসানের দিনক্ষণ কারোরই মনে নেই।
কুবের আবার জানতে চাইল, ‘আর কি কি জান তুমি?’
‘তুমি একট পয়লা নম্বরের ভীরু। ষোল আনা ইচ্ছে থাকলেও ক্ষমতা নেই বলে তাই—’
তাই কি আভা—থামলে কেন? বলে যাও।’
‘খেয়ে উঠে বাকিটা বলব।’ খাওয়া আর হল না আভার। তোলা জলে আঁচিয়ে নিয়ে লঞ্চের সরু মাথায় ইস্পাতমোড়া নোঙর বাঁধার জায়গায় গিয়ে আভা ধপ করে বসে পড়ল।
কুবের ঘাঁটালো না। ড্রিম মারচেন্ট সাধুখাঁ সাহেব এখন কুরের চকদার। ভীত লোক স্বপ্না দেখে না। খুব জোর হিস্টিরিয়ায় ভুগতে পারে। ভীতু লোক চাষবাসে নামে না! এত বড় বদনাম দিয়ে দিল আভা।
‘বুলুর কি জান তুমি?’
‘কি জানি না কুবের? আমায় ঘাঁটিয়ো না—’ ধমকে উঠল আভা। এতক্ষণে এই রগচটা ভঙ্গীটা কুবেরকে আকর্ষণ করল। আন্দাজ নিচ্ছিল, ওখান তেকে পঁজাকোলে তুলে কেবিনে পৌঁছতে ক’ সেকেন্ড লাগবে। কিন্তু একটা জিনিস সে কিছুতেই সুবিধে করে উঠতে পারে না কোনকালে। কথায়বলে মেয়েমানুষের মন। সে জানে না, এখন আভা কতখানি মেজাজে আছে। দিব্যি ঠান্ডায় পোজ দিয়ে বসেছে লঞ্চের ডগায়। হালে মেয়েমানুষ নিয়ে নাড়া-চাড়া করা একরকম ভুলে গেছে। ভুলভাবে হয়ে যায়।