কুবেরের বিষয় আশয় – ২১

॥ একুশ ॥

ব্রজর হাত ভীষণ শক্ত। আঙুলের হাড় সাঁড়াশি হয়ে তার হাতে চেপে বসেছে। আভা ছাড়াতে পারল না। অন্য হাতখানা ধরে সাহেব টানছে। ‘তখনই বলেছিলাম সাহেব আমাকে এসব খাইও না। আমার সহ্য হয় না। মুখ দিয়ে গরম হাওয়া ছোটে—তোমরা যে কী ধাতের মানুষ—’

ব্রজ দাঁতে হাত ঘষছিল। অনেক রকমের গালাগালি এসে তার মুখ বোঝাই হয়ে গেছে। কিন্তু চেঁচাবার উপায় নেই। শিব প্রতিষ্ঠার পর এখানে সে আপনা—আপনি সেবায়েৎ—আপনা-আপনি মোহান্ত। দূর গাঁয়ের লোক আজকাল শিবতলার মোহান্ত বাবাও বলে। তার পক্ষে জ্ঞানহারা হয়ে চেঁচানো বেঠিক কাজ হবে। আশপাশের হাটুরে লোক শুনতে পেলে কি ভাববে।

তাই বলে এই তেলখোড়ার আড্ডার একেবারে গায়ে গায়ে এসব কি বেলেল্লাপনা? একেবারে চোখের সামনে। আর একবার জোরে টান দিল আভাকে। ব্রজর হাতের মধ্যে কয়েকটা কাচের চুড়ি মুটমুট করে ভেঙে গেল শুধু।

আভা সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে কেঁদে উঠলো, ‘ভাঙলে তো শেষে।’ কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, ‘এই সাহেব—তোমার সাধের সাহেব ছাইপাঁশ কি সব গিলিয়েছে—তখনই বারণ করলাম ওগো—কথা কি শোনে তোমার সাধের সাহেব!’ এর পর ডুকরে কেঁদে উঠলো আভা।

এতটা হবে সাহেব ভাবতে পারেনি। তারও কিছু নেশা হয়েছিল। ব্রজর গলা ধরে বলতে যাচ্ছিল, ‘তুমি তো মোদক খাওয়াতে দাদা! আমি এই একটুখানি—’

গলায় হাত পড়তেই ব্রজ এক ঝটকায় সাহেবকে সরিয়ে দিল। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়েই আভার চীৎকার শুনতে পেল। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সাহেব। কিছ বুঝে ওঠার আগেই দেখল, ব্রজ ফকির আভাকে মাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

এই পর্যন্ত আভা অনেক পরে পর পর সাজিয়ে মনে করতে পেরেছিল। তখন সে নেশায় পাথর হয়ে ছিল। তার পরেরটুকু মনে করতে কোন কষ্ট হয়নি। কেননা, ততক্ষণে আভার নেশা ছুটে গিয়েছিল। ব্রজ পরিষ্কার বলেছিল, ‘এই জাগ্রত শিবের সামনে সত্যি কথা বল। মিথ্যে বললে জিভ খসে পড়বে—’

হাত আলগা হতেই আভা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ‘শিব কোনদিন ঘুমোয় না গো! আমি কোন্ দুঃখে শিব সাক্ষী রেখে দিব্যি গালতে যাবো?’ তারপর থেমে বলেছিল, ‘এমন তো আগেও অনেকবার গেছি—কদমপুরে থাকতেই—তখন তো একবারও বারণ করোনি?’

এইবার ব্রজ যা করলো, তার চেয়ে আভাকে ধরে আচ্ছাসে চড় কষালে পারতো। তা না করে দিব্যি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এজন্যে তৈরি ছিল না. আভা। নেশার বাকিটুকুও ফরসা হয়ে গেলো। আভা তখন একেবারে তিরিক্ষি, ‘এতদিন জেগে জেগে ঘুমোচ্ছিলে?’

‘কোন উপায় ছিল না আভা—’ এমন করেও কাঁদতে পারে ব্রজ—তা একদম জানা ছিল না আভার। তখনও খটখটে গলায় বলেছিল, ‘কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে—’, এর চেয়ে সেদিন বলতে পারত—কিন্তু গাড়ি যে চলে গেছে ব্রজ—ফের সেই বিকেলবেলার আগে আর কোন ট্রেন নেই। কিংবা ওরকম ধাঁধা মাখানো আরও অন্য কিছু বলতে পারত আভা। কি করে যে অমন কথা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে।

বেলপাতা, চন্দনমাখানো পাথারখানা তারই দিকে তাকিয়ে ছিল। আভা সেই দিনই অল্পক্ষণের জন্যে তার ভেতরে আবছায়ায় চোখের আভাস পেয়েছিল। তবে ত্রিনেত্র নয়। মানুষেরই মতো দুটো চোখ তাকেই দেখছিল।

আর একবার বমির ভাব আসতেই আভা জোরসে ডাঁশা পেয়ারাটা কামড়ে ধরল। দ্বীপের গাছের ফল। মেদনমল্লর বাথানের গায়ে কালই বিকেলে গাছটাকে পেয়েছে। গা গুলোনো ঝোঁকটা কিছুতেই কাটানো যাচ্ছে না। অথচ এখন বেলা মোটে ন’টা দশটা। এখানে কুবেরের টাইমপিস দেখে কাজকর্ম চলে, সূর্য ওঠে। দিঘির সামনের চত্বরে মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহাচ্ছিল দু’জনে। কুবের পেছন ফিরে অনেকক্ষণ এক মনে কি একটা বই পড়ছিল। আভা যে তারই পাশে বসে আছে—তা একটু ভ্রুক্ষেপও নেই।

আজ হপ্তা দুই পাখিরা চলে গেছে। মাঘ প্রায় শেষ। রোদের তাত বাড়তেই পদ্ম বোঁটাগুলো নেতিয়ে যাচ্ছে। দিঘির জল যে কতকালের! এসব কথা ভাবতে গিয়ে কারখানা গাঁয়ের সেই সন্ধ্যেবেলায় চলে গিয়েছিল আভা। ফিরেও এলো এক লহমায়।

কুবেরের হাতের খোলা বইয়ের সামনেই অনেকগুলো ধানচারা তুলে এনে কামলারা বিছিয়ে রেখে গেছে। কুবের পড়ছে আর মাঝে মাঝে চারাগুলো দেখছে। মুখ তুলে ম্যাগানিফাইং গ্লাসটা জল-চৌকির ওপর থেকে নিতে গিয়ে দেখল, আভা খুব মন দিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।

‘কি ব্যাপার?’

‘তোমাকেই দেখছি!’

কুবের খুব অনেকক্ষণ এমন একজনকে চাইছিল, যাকে সে এখুনি বলতে পারে—আজ হাতের বইখানায় সে কি ভীষণ একটা জিনিস জানতে পেরেছে। ধানগাছ মানুষেরই মতো ব্যবহার করে। বসন্তে আকাশ বাতাস মানুষের মনের মধ্যে কি সব করে দেয়—তেমনি আলো, হাওয়া ধান-চারারও অনেক কিছু করে দেয়।

মাটির রস, আলো, রোদের তাত, হাওয়ার দুলুনি—সব মিলে ধানচারাগুলো রসস্থ হয়ে ওঠে। তিন চার কলি চারা পুঁতে দিয়ে তা থেকে মাসদেড়েকে চল্লিশ পঞ্চাশটা বিয়েন ছাড়ে। একে একে বিয়েনগুলো গোল হয়ে ফুলে ওঠে। দেশী ভাষায় বলে, থোড় এসেছে। তারপর থোড় ফেটে শিষ বেরোয়। সবুজ শিষের গায়ে সাদা ফুলের ঝুরি লেগে থাকে। হাওয়ায় ধানের খোলের মুখ খুলে যায় এক সময়—আর ফুল গিয়ে তার ভেতরে পড়ে।

ফুল পড়ে শিষগুলো ক’দিনেই ফুলে ঢোল হয়ে ওঠে। একেবারে শক্ত হয়ে ওঠার আগে টিপলে দুধ ছিটোয়। যে খোলে ফুল পড়ে না—তার নাম চিটে। আছড়ানো ধান হাওয়ার উল্টোদিকে ধরলে চিটেগুলো ফুরফুর করে উড়ে যায়। নিষ্ফলা।

এসব চাষীও জানে।

‘জানো আভা, সকাল আটটার আগেই এই বিরাট কাণ্ডটা হয়ে যায়। তারপরে যেই তাত বেড়ে যায় রোদের—

‘কোন্ কাণ্ড?’

‘ভোরের দিকে ধানের খোলা—আপনা-আপনি খুলে যায়—হাওয়ায় হাওয়ায় ফুলগুলো ভেতরে ঝরে পড়ে-পড়তেই ধানের খোল বুজে যায়—’

আভা কুবেরের মুখখানা দেখছিল। কপালে, চোখের নীচে, বাঁ কানের লতিতে কালো একটা ছোপ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘কদমপুরে যখন প্রথম এসেছিলে তার চেয়ে কত কালো হয়ে গেছ কুবের।’

‘আমার কথা ছাড়ো। আমি আবার একটা মানুষ নাকি!

‘এতো অভিমান?’

কুবের বুঝতে পারলো, আভা তার কথা একদম বুঝতে পারেনি। এখন আভা তার প্রেমে গড়াগড়ি যাচ্ছে। অথচ কুবের—

অথচ কুবের কোথাও পুরোপুরি মন বসাতে পারছে না। এই ক’মাসে দ্বীপে আন্দাজে আভাকে নিয়ে কেমন একটা সংসার তৈরি হয়ে গেছে। সারা দিনরাতে খানিকক্ষণ তারা দু’জনে প্রায় স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। কখনও লাভমেশিন কুবেরের দিব্যি ষোলোআনা লাভার হয়ে উঠতে হয়।

‘সত্যি তুমি অনেক কালো হয়ে গেছ। কি করে হলে কুবের? নোনা হাওয়ায়?’

কুবের ভেতরে ভেতরে গুড়গুড় করে ডেকে উঠলো। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। প্রায় কাঁপছিলো হাতখানা। বলতে শুরু করতে পারতো, জানো আভা—আমার জীবনে খুব একটা স্যাড ঘটনা—এক্সপিরিয়েন্স বলতে পারো—

কিছুই বলা হলো না। ক’দিনই সতেজ ধানচারাগুলোর ডগা লালচে হয়ে যাচ্ছে। কামলারা বলে, লালি ধরেছে বাবু। সে নাকি একটা রোগের নাম। লোক লাগিয়ে ব্লাইটক্স আর এনড্রিন জলে গুলে ছিটিয়ে দিয়েছে গাছে গাছে। মারাত্মক বিষে পথ ভুলো কিছু সাপ ডাঙায় উঠে ছটফট করে মরেছে। শেষে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন দিতে হলো। অথচ পোকার দেখা নেই। মাজরা পোকা শিষের ভেতরে নেমে গিয়ে থোড় খেয়ে ফেলে কুরে কুরে। তখন শুধু চিটে শিষ বেরোয়। সে পোকারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতো বিষেও তবে কোন্ পোকা টিকে থাকতে পারে?

পাতা উল্টে উল্টে কামলারা এক ধরনের পোকা তুলে নিয়ে এলো মাঠ থেকে। ধানের পাতা লালায় মুড়ে ঘোমটা বানিয়ে তার ভেতরে গুটি পাকিয়ে পড়ে ছিল। বেশ বড়ো—প্রজাপতি হওয়ার আগেকার চেহারা পোকাগুলোর পাতার মোড়ক এমনই যে বাইরের কোন ওষুধ তাদের গায়ে লাগে না।

একটা পোকা কুবের হাতে নিতেই পাক খুলে লম্বা হয়ে গেল। সারা গায়ে পাতার সবুজ ছোপ আলগা করে মাখানো। কুবেরের চোখে জল এসে গেলো। হয়তো এদেরই জন্যে সে পথে বসবে। এতো খরচের চাষ—ঠিক ঠিক ফলন না হলে সে ডুববে। সর্বস্ব ঢেলে বসে আছে এই ঢালাও চাষে।

একটু আগে বইতে এই পোকার ছবি দেখেছে। নীচে লেখা আছে—কেস ওয়ার্ম। ঘোমটা দিয়ে এরা পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে। আসল নাম অবশ্য অন্য।

‘জানো আভা—এ পোকাগুলোর নাম কি?’

‘ফেলে দাও-হাতে নিও না। ঘেন্না করছে—‘

‘নিমপুলা ডিপাংটালিস। এদের তুমি এমনিতে মারতে পারবে না। পাতার ঘোমটার ভেতরে ওষুধ পৌঁছয় না—’

আভা তাকিয়ে আছে দেখে কুবের বললো, ‘মাটি, গাছ খাবারের কায়দায় শুষে নিতে পারে এমন কোন ওষুধ ঢালা ক্ষেতময় ছড়াতে হবে। গাছগুলো সেই ওষুধ টেনে নিয়ে খাবারটুকু রেখে দেবে—আর সন্ধ্যে সন্ধ্যে বিষটুকু নিশ্বাসে নিশ্বাসে ছড়িয়ে দেবে। তখন গাছের ভেতরকার মেদমজ্জা যাই মুখে দেবে—পোকাগুলো পটাপট মরবে—তার আগে ওদের কিছু করা যাবে না।’

আভা শুনতে শুনতে ঘোমটা তুলে দিল মাথায়, আমায় কি তোমার ওই নিমপুল না কি তাই দেখাচ্ছ! আমাকে তুমি কি দিয়ে মারবে? বল না, কোন্ বিষে ওগো! ঘোমটার মধ্যে গোটানো মুখখানা, তার পেছনে দূরে ধুধু জল চড়ায় এসে আছড়ে পড়ছে, একটানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, মাথার ওপরে বেলাবেলির রোদ-কুবেরের বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস শব্দ হতে লাগলো। ইংরাজি র‍্যাপিড রিডার গ্রীক টেলসে পড়া নিমফ্—প্রায় জলপরীর কায়দায় ঘোমটা মোড়া আভার মাথাটুকু জলের ব্যাক গ্রাউন্ডে জেগে আছে শুধু। তখনকার মতো কুবেরের চোখে বাকি সব কিছু মুছে গেল।

এখানে এখন নোনা হাওয়ায় ফাল্গুনের আগাম বাতাস। কুবের খুশি হয়ে উঠতে পারত। মেদনমল্লর দুর্গটা ঢাউস ছায়া ফেলে দাঁড়ানো। তার ভেতরে আভাকে পাশে বসিয়ে মনের সুখে বইয়ের পাতা খুঁটে খুঁটে মাটির স্বভাব, পোকার চরিত্র—রহস্যময় আরেক জগতে ডুবে ছিলো খানিকক্ষণ। কিন্তু গায়ের রঙ কালো হয়ে যাওয়ার কথা শুনেই মনের মধ্যে একদম দমে গেল। জিনিসটা তারও চোখ এড়ায়নি। সেই আদ্দিকালে একদিন কারখানা ফেরত কুবের ট্রেনের জানলায় বসে তারই জাতের একজন লোকের মুখে শুনেছিল, ‘আমাদের মতো লোকের সবচেয়ে বড়ো শত্রু রোদ্দুর।’ চামড়ার ভালো দানাগুলো রোদে ক্ষয়ে যায়।

আভা। আমার অসুখ আরও বড়ো। ইদানীং আমি পরিষ্কার টের পাই—গতকালও আমার শরীরের যে জায়গা সুন্দর ছিলো, আজই সকালে তা কালো হয়ে যাচ্ছে। একদিন শুধু চোখের মণি দাঁত, হাত পায়ের আঙুলের নখ যে যার পুরনো রঙ নিয়ে কোনরকমে টিকে থাকবে। আভা। ইদানীং আমি পরিষ্কার টের পাই—আমার মেরুদণ্ডে হাড়ের চাকতির বলবেয়ারিং মজ্জা শুকিয়ে যাওয়ায় তেল-মবিলের অভাবে খচখচ করে ওঠে। আমাকে আর কিছুতেই চালু রাখতে চায় না। কেননা, একটা স্যাড ঘটনায়—এক্সপিরিয়েন্স বলতে পার–আমার মাথার ভেতরে ঘিলুর পরতে পরতে মনে করে রাখার সিঁড়িগুলো একদিন ঘচাং করে মুছে যেতে পারে। যদি মনেও পড়ে, কথা বলতে পারব না। উপায় থাকবে না কোন। থাকলেও, মনে হবে অন্যের কথা।

‘অমন করে তাকিয়ে আছো কেন?’

‘তোমাকে দেখছি—’

‘ও কি দেখার ছিরি! চোখ নামাও। কুবের—’, আভার গলা চিরে গেলো। তব কুবেরের চোখ নামলো না। মণি গলে গেলে বোধ হয় এমনভাবে তাকায় মানুষ। দারুণ ঘোলাটে। কুবের নিজেকে মূর্তির কায়দায় আভার কাছে তুলে নিয়ে গেল। তারপর খুব আলগোছে আভার গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

‘তোমার কি হয়েছে কুবের?’

দিঘির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জানি না।’ তারপর বললো, ‘খুব কালো হয়ে যাচ্ছি?’

‘কে বললো! নোনা হাওয়ায় এমন হয়ই—’, দু’হাতে আভা কুবেরকে খুব করে ধরে ফেলার চেষ্টা করল। পিঠে হাত বোলাতে গিয়ে আদর ঢেলে দিল, ‘আমার একটা মোটে কুবের!’ তারপর গদ্‌গদ হয়ে গেলো, ‘কে বললে কালো! তুমি হাজার দিকে মাথাটা খাটিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছ। কি দরকার এতো সব? যা দেখতে পারবে না—রাখতে পারবে না—তার পেছনে শুধু শুধু ছুটে কি লাভ।’

কুবেরের চোখের সামনে যতদূর দেখা যায়—বোরো ধানের সবুজ গোছ মাথা ঠেলে উঠেছে। ক’দিনের মধ্যে সারাটা তল্লাট আরো সবুজ হয়ে কালো মেঘ হয়ে উঠবে। তাদের গায়ে গায়ে বোশেখ মাসে আকাশ চলকে এসে পড়বে। এখনই কিছু কিছু বিয়েনকাঠি বেরিয়ে পড়েছে। দু’একটা গোল হতে শুরু করেছে। একটা খুঁত থেকে যাচ্ছে। মাঠময় সবুজের মধ্যে পাতার আলগা শ্রী গায়ে মেখে ঘোমটা পোকাগুলো লুকিয়ে আছে। তাই গাছের ডগায় লালি ধরেছে।

টিনের মধ্যে এনড্রিন কালো জল হয়ে পড়ে থাকে। খুব কড়া বিষ। জলে গুলে দিলে সাদা হয়ে যায়। তাতে গা গুলোনো গন্ধ। পয়েন্ট থ্রি, পেট্রোল ইঞ্জিন বসানো স্প্রেয়ারের ট্যাংকে ওষুধ ভরে নিয়ে কামলারা কাপড়ে নাক মুখ বেঁধে নেয়—তারপর ওষুধ ছিটোয়। ধানক্ষেতের জলে ওষুধ পড়ে। সে জল গর্তে গিয়ে সাপের বাসায় পৌঁছয়। কত সাপ যে এই করে সাবাড় হয়ে গেল।

মাটির শরীর ভালো রাখার জন্যে ভগবান কেঁচো দিয়েছে—হরেক রকমের পোকা দিয়েছে। তারা সময় সুযোগ মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি ওলটপালট করে। নীচের মাটি ওপরে আসে—ওপরের মাটি নীচে যায়। ভগবানের তাবৎ কেঁচো—তাবৎ পোকা এনড্রিনের বিষে ফিনিশ।

কামলাদের রান্নাবান্নার ধুন্দুমার, রোজ রোজ গুড়ুল বাঁশের গুলি খেয়ে পাখিগুলো বোধহয় আগেভাগেই কেটে পড়েছে। এখান থেকে কুবেরকে অন্তত তিরিশ হাজার মন ধান রেল স্টেশনের লঞ্চঘাটায় নিয়ে তুলতে হবে। নইলে এ খরচ পোষানোর কোন পথ নেই। ব্যারেল ব্যারেল পেট্রোল হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। পাম্প থেমে নেই। এরই মধ্যে মাটি ফেটে চৌচির। কত জল যে আরও লাগবে তার ঠিক নেই।

সে এখন কুবের চকদার। কিছুকাল আগেও ছিল ড্রিম মারচেন্ট কুবের সাধুখাঁ। অনেক—অনেক আগে ছিল কুবের দ্যা ভ্যাগাবন্ড। অনেক বছরের তফাতে প্রথম দেখাতেই সনৎ বলেছিল, ‘তোর সেই হ্যাগার্ড লুকিং চেহারাটা কোথায়? খুব রেসপেকটেবল হয়ে গেছিস!’

মা, তুমি পালম বুনতে এক কাঠা জায়গা চেয়েছিলে!

আজ কুবের চাকদারের পায়ের নীচে হাজার হাজার বিঘে জায়গা।

‘কি হয়েছে কুবের? আমার গায়ের ওপর সবটুকু ভর দিলে আমি পারি? হাজার হোক তুমি পুরুষমানুষ তো। তোমাদের কাঠামোই আলাদা’

কুবের তখনও সারা শরীরের ভার আভার বুকের ওপর ছেড়ে দিয়ে একখানা মূর্তি হয়ে কাত হয়ে পড়ে ছিল, ‘আমার কি হয়েছে বলতে পারো?’

‘সে কথাই তো বলছি! অমন করে তাকাচ্ছ কেন? আমায় বলবে না?’

‘তুমি আমার কে যে বলতে হবে! এই যে বলেছিলে-কি বিষ দিয়ে মারবে গো!’

‘নাও ওঠো। পড়ে যাব। তোমার লোকজন মোষ চান করাতে জলে নেমেছে। ওরা উঠে এলো বলে—’

কুবের সরে এল, ‘আমি নিজেই বিষপাথর আভা। কোথাও তিষ্ঠোতে পারি না।’ বাকিটুকু বিড়বিড় করে বললো। ডাঙায় আমার একটা বউ আছে। সৃষ্টিধর আছে। কুসুম আছে। এখানে আবাদে অন্যের বউ ভাগিয়ে নিয়ে পড়ে আছি। আমি কলবাড়ি বানাতে এসে জটের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি। চেয়েছিলাম, মা, বাবা, বড়বৌদি, নগেন, বীরেন ওরা আসবে। সব হাতের কাছে এগিয়ে দেব। ভদ্রেশ্বরও আমাকে ছেড়ে গেলো। আমি আর ডাঙায় যাবো না।

আভা। আমি তোমার শরীরে রোজ বিষ ঢেলে দিচ্ছি। তোমার আর নিস্তার নেই। কোন্‌দিকে তুমি পা ফেলবে? সব জায়গায় আমার শরীরের রক্ত বয়ে যাচ্ছে।

সাক্ষাৎ যমের বাহন-মোষগুলো দল বেঁধে জল থেকে উঠে আসছে। সারি দিয়ে কুবেরদের বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেল। ভিনদেশী কামলাদের চোখে কুবের কখনও বড়বাবু, কখনও ভগবান। তারা ঠিকই করতে পারে না—এ লোকটার কত টাকা আছে। এতগুলো লোকের হপ্তা দেয়। হালের কাজ কবে শেষ। এখন নিড়েন চলছে, জল চলছে, ওষুধ চলছে। সারও ছিটোনো হয় ক’দিন অন্তর।

ধান কাটার আগে দুর্গের ভেতর খানিক জায়গা পরিষ্কার করে নিতে হবে। রোজকার আছড়ানো ধান সেখানে তুলে রাখা হবে। সেদিকটা গোডাউন করে নিতে ত্রিপল চাই বড়ো বড়ো। ‘ডাহুক’ সেসব জিনিস আনতে রেল স্টেশনের লঞ্চঘাটায় যাবে। আরও পেট্রোল আনতে হবে—কেরোসিনও দরকার। ভদ্রেশ্বর কতকাল আসে না।

তাঁবুর ঘরের পেছনে পোড়া ছাইয়ের ডাঁই-সিগারেটের খালি প্যাকেট আর পাখির পালক ছড়ানো। ট্রানজিস্টারের কিছু বাতিল ব্যাটারিও পড়ে আছে। কুবের বুঝল, সবই মানিয়ে যাচ্ছে যতক্ষণ নদীর মাথা ঠাণ্ডা থাকে। জল ক্ষেপে উঠলে কি দশা হবে বলা যায় না। একটা বর্ষা এখানে কাটালে তবে বোঝা যাবে।

‘পেয়ারা পেলে কোত্থেকে?’

‘খোঁজে থাকলেই পাওয়া যায়—’, বলতে বলতে আধখাওয়া পেয়ারাটা আভা আঁচলের নীচে সরিয়ে নিল। কুবের বলতে যাচ্ছিল, পইপই করে বারণ করেছি আভা-এই অজানা জায়গার কোন ফলপাকুড় আন্দাজে মুখে দেবে না। এ জায়গার সবটা এখনও আমারই দেখা হয়নি। খুব কম জানি এই দ্বীপের কথা। কিন্তু ফলটা লুকিয়ে নেওয়া, মাথা নীচু করে আভার হাসি—এসব দেখে ভেতরটা একটা টানা সুর তুলে ঝনাৎ করে থেমে গেল। ভাবলো, তা নিশ্চয় হয়নি।

‘আভা। আমার দিকে তাকাও।’

আভা মুখ তুলল না। কুবের কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘মাথা তোল। আমার একটা কথা আছে। ‘

‘বল না—শুনতে পাচ্ছি।’

‘যা ভাবছি—হয়েছে?’

এবারে মুখ তুলে তাকাল। কুবের কোন মানে করতে পারে না মেয়েমানুষের। যখন পুরনো ব্যথায় ভেতরটা চুলকে ওঠে—তখনও ওরা কিছুই হয়নি ভাব দিয়ে হাসবে। ‘কি ভাবছ আমি জানব কি করে! হাত গুনতে জানি?’

কুবের দুই হাতে আভার কাঁধ জোর দিয়ে ধরল, ‘এখন ইয়ারকির সময় না—হাসি রাখো—’, আভার দুই কাঁধের হাড় কুবেরের হাতের মধ্যে প্রায় মটমট করে উঠল।

হাসি নিবিয়ে আভা খিঁচিয়ে উঠল, ‘আঃ! ছাড়ো বলছি। লাগে না!

কুবের নিজেই বুঝল, তার গলার স্বর করুণ হয়ে উঠেছে, আবেদনের চেয়েও নিরুপায়, ‘লক্ষ্মীটি—নষ্ট করার সময় নেই এখন। সত্যি কথা বল। জানো আভা, আমি জেনে-শুনে আর একজনকেও এই এখানে আনতে চাই না—কিছুতেই না আভা। তুমি একটু কাইন্ড হও—ইচ্ছে করলেই পারো-আমার সবটাই ঘুণ ধরা কাঠ—গুঁড়িতে, শেকড়ে—ডালপালায় সব জায়গায় পোকাগুলো কুরে কুরে খাচ্ছে—’

শুনতে শুনতে আভা অবাক হয়ে তাকালো। সামান্য একটা ব্যাপার। তা নিয়ে এত লেকচার। কি হয়ে যাচ্ছে মানুষটা। আস্তে কুবেরকে ধরল ‘তোমার কি হয়েছে বলতো?’

কুবেরের কথার তোড় বন্ধ হয়ে গেলো। শেষে আস্তে বললো,—তুমি তো সব জানো আভা। বলে দিলেই পারো।’

‘হুঁ। তাতে এতো চিন্তা কিসের?’

জেতা লটারির টিকিট হারিয়ে লোকে এইভাবে বসে পড়ে। কুবের কোন কথা বলতে পারলো না। কামলারা দ্বীপে আসার আগে ডাঙা থেকে অনেক জিনিস সঙ্গে এনেছিল। তার মধ্যে মোটাসোটা একটা কালো বেড়ালও ছিল। ক’দিন খায়-দায় আবার জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে যায়। কি খেয়াল হয় ফিরেও আসে। দিঘির ওপারে যে একটা সজনে গাছ ছিল এতদিন চোখেই পড়েনি। বসন্ত শুরু না হতেই ক’দিনের ভেতর ডালে ডালে ফুল সাজিয়ে গাছটা একটেরে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাটা ফাটা বাকলে ঢাকা গাছের গা বেয়ে বেড়ালটা ওপরে উঠতে চাইছে। এসব দেখে দিঘির এপার থেকেই কুবেরের গা শিরশির করে উঠলো—তারই গায়ে কে থাবা বসিয়ে মাথায় উঠতে চাইছে। কষে কান মোচড়ানো তার যন্ত্রের কায়দায় টাইট হয়ে বসে আছে কুবের—এক বিন্দু ধুলো পড়লেই টঙ করে বেজে উঠবে। নানান্ ধারার মাংস পার হয়ে তার শরীরের মোটা মোটা হাড় গোড়াসুদ্ধ সরু একটা ব্যথায় চুলকোতে শুরু করে দিল।

‘এই কুবের—

পটাং করে উঠে দাঁড়াল মানুষটা। ভোরবেলা থেকেই এমন মানানসই সকালটা আস্তে আস্তে কোনদিকে যে যাচ্ছে—আভা কিছুতেই ধরে উঠতে পারছে না।

‘এ তুমি কি করলে—’

দাঁড়ানো কুবেরের কথায় আভা কিছুই বলতে পারল না। চারিদিকের চেনা চত্বর, দিঘির ধাপ তারই বিরুদ্ধে চুপচাপ নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে আছে। কারও কিছু বলার নেই।

‘সবই তোমার হাতে ছিল আভা। তুমি সব জানতে।’

ক’মাস এমন অসম্ভব সুখের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। এদানীং আভা আরামের মাথায় বিকেলবেলায় মেঘচাপা রোদ্দুরের আলোও দেখতে পেতো। নোঙর করা ‘ডাহুক’ নয়তো ‘বড়বিলের’ ডেকে চাঁদনী রাত দেখে নিজের হাতে বিছানা সাজিয়েছে কতোদিন। সন্ধ্যে হতেই কুবেরের দ্বীপের দুধলি ফুল তুলে বিছানায় ছড়িয়ে দিতো। অমাবস্যার রাতে সাদা সাদা বুনো ফুল মাথায় গুঁজে তাঁবুর বাইরে হ্যাজাক বাতির কড়া আলোয় কারণে অকারণে এটা ওটা আনার নামে বেরিয়ে পড়েছে আভা।

‘সবই তোমার হাতে ছিলো আভা—’

আভা বলতে যাচ্ছিল, কচি খোকা নও তুমি। আজকাল সে সুখের এপিঠ ওপিঠ দেখতে পায়। সুখ তার বেলায় ভীষণ পাতলা।

‘কোথায় চললে—‘

কুবের কোন জবাব দিল না। হনহন করে চত্বর পার হয়ে, দিঘি পেছনে ফেলে মেদনমল্লর দুর্গের ভেতরে চলে গেলো।

আভা তখনও ডাকছিলো, ‘কোথায় গেলে? দেখতে পাচ্ছি না যে—’

এমন সব আরও অনেক কিছু বলছিলো আভা। খানিক দূর শুনতে পেলো কুবের। তারপর চওড়া চওড়া দেওয়াল ফুঁড়ে বাইরের পৃথিবীর কোনো কথাই ভেতরে গেল না। তখনও কুবের এগোচ্ছিলো। দিনের আলো বাইরে পড়ে থাকলো। নেহাত বেগে হেঁটে যাচ্ছিলো—না হলে কুবের এতটা যেতে পারতো না।

এখানে এখন আলো নেই—অন্ধকারও নেই। পরিষ্কার না হলেও কুবের কিছুটা দেখতে পাচ্ছে। আর এগোলে যদি দেওয়ালে ধাক্কা খায়। অনেক উঁচুতে আলোসুদ্ধ আকাশের খানিকটা দেওয়ালের ফ্রেমে ধরা পড়েছে। মেঝে ফুঁড়ে একটা আকন্দ গাছ ডালপালা ছড়িয়ে আছে। বাতাস নেই বলে নিস্তব্ধ। মেটে আলোয় জায়গাটা স্থির হয়ে পড়ে আছে। কুবের আর এগোতে পারল না। এখানকার ধুলো, এখানকার ঘাসে—কতকাল মানুষের পা পড়েনি। অথচ হয়তো এখান থেকেই জলপথে বেরোনোর খুঁটিনাটি ঠিক হতো। খাবার জলের বড় বড় কলসি হয়তো ভরে রাখা থাকতো।

কুবেরের সন্দেহ হলো—আর কোনদিন এই ঘরের পর ঘরের জঙ্গল ফুঁড়ে সে বাইরের আলোতে বেরোতে পারবে না। কেন যে হনহন করে ভেতরে চলে এলো। এখন কোনদিকে যাবে। বাইরে মাঠময় ধানের গোছ। শিষ বেরোলে না-জানি কেমন দেখাবে। এখনও অনেক কাজ বাকি। দ্বীপের উত্তরদিকটা জঙ্গল হাসিল করে একে একে চাষে আনতে হবে। এক বছরে হবে না। অনেক সময় এক জীবনেও হয় না। সামনে তাকালে এখন কুবেরের সামনে শুধুই ভবিষ্যৎ। জমির পর জমি। যত দূর দেখা যায়—মাঠগুলো ঢেউ তুলে পড়ে আছে। শুধু তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাকি। গেলেই দখলে এসে যাবে। পালটা দাঁড়াবার কেউ নেই। এমন কোনদিন আসবে, যখন চাঁদ থাকতে থাকতে বেরিয়েও কুবের নিজের দখলের জায়গা জমি দিনের আলো ফুরোবার আগে হেঁটে কাবার করে উঠতে পারবে না।

অথচ এই সময় মেদনমল্লর চওড়া চওড়া দেওয়ালের গোলকধাঁধা ছাড়িয়ে যদি বাইরে বেরোতে না পারে—তাহলে কি হবে। এ আমি কোথায় পড়ে গেলাম? ‘আভা। আমি এখানে। শুনতে পাচ্ছ—এই যে আমি—’

চেঁচিয়ে দেখল, শুধু নিজের গলাই শোনা যাচ্ছে এখনও অনেক যে বাকি। ‘আভা—আমি এখানে—’, কুবের মরীয়া হয়ে উঠল, ‘সাড়া দিচ্ছ না কেন আভা?’

একবারও খেয়াল হলো না, সে নিজে নিজেই এই অন্ধকারে চলে এসেছে। বাইরে থেকে আর কিছু শোনারও উপায় নেই। ঠিক তখনই আরেকজন খুব সাবধানে ভেতরে আসছিল। কুবেরেরই মতো সেও কোনদিন দুর্গের এতটা ভেতরে আসেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *