॥ ঊনত্রিশ ॥
চিটু দাশ নিজেই তেতলা থেকে নেমে এল। ফটাশ ফটাশ চটির শব্দ তুলে নামার সময় এক এক তলায় এসে সিঁড়িঘরের আলোর সুইচ টিপছে। উল্টো দিকের বাড়িটায় ঘণ্টা পেটানো দেখে ভদ্রেশ্বর বুঝলো, পুলিসের থানা। আর গাদাখানেক কুকুরের একসঙ্গে চীৎকার শুনে বুঝে নিল—এইটেই চিটু দাশের বাড়ি।
স্বয়ং চিটু দাশ দরজা খুলে মোলায়েম করে সব জানতে চাইল। পরে ভদ্রেশ্বরকে ভেতরে নিয়ে বসাল। অত বড় সব কুকুর এর কথা শুনে ওঠবস করে—এমন লোক এত ঠাণ্ডা করে কথা বলে কেন—ভদ্রেশ্বর বুঝতে পারল না। এর ভয় কি? সারা বাড়ি ঘেউঘেউ ডাকে গমগম করছে। চিটুর সঙ্গে তেতলার ছাদে যেতে হল।
সমঝদারির ভঙ্গীতে দাঁড়িয়েও ভদ্রেশ্বরের ভয় যায় না। এগারোটা কুকুর একসঙ্গে জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে যাচ্ছে সব সময়। চিলেকোঠায় কড়া আলো এসে পড়েছে। দু’টো লোক মিলে কুকুরদের পাউডার মাখাচ্ছে—উকুন বাছার চিরুনী বুলোচ্ছে গায়ে। জায়গাটা প্রায় কুকুরপাড়া। বড় বড় আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে চেনে বাঁধা কুকুররা রোখ করে চেঁচিয়ে উঠছে—আয়নার ওপরে ঝাঁপ দিতে চাইছে।
বাড়িতে আর অন্য প্রাণী আছে, কি না বোঝা গেল না। চিটু দাশকে সব বললো ভদ্রেশ্বর। বাঘার বয়স, গলার আওয়াজ, পছন্দ-অপছন্দ সব জানালো। চিটু দাশ বললো, ‘ছাদে দাঁড়িয়ে প্রায়ই ওই বৈকুণ্ঠপুরের দিক থেকে একটা কুকুরের ডাক শুনতে পাই। এমন চেঁচাবে—বোঝাই যায় মনে সুখ নেই। ওখানে একবার খোঁজ করে দেখতে পারেন—’
সারাদিন ঘোরাঘুরি, খাওয়া হয়নি, ভদ্রেশ্বরের শরীর আর চলছিল না। দিনের দিন কাজও হয়নি আলিপুর কোর্টে। সরু পিয়াসলে স্টেশন থেকে বৈকুণ্ঠপুর তা মাইল দুই হবে। স্টেশনে ফিরে এসে কদমপুরের গাড়ি ধরল। আশা ছিল, আজ কোনক্রমে যদি বাঘাকে ফিরে পায়—তবে কুকুরসুদ্ধ সাধুখাঁ মশায়ের বাড়ি যাবে। তাহলে কিছুটা নুনও শোধ হবে আর মিষ্টি খাওয়ার টাকা চাই বলে খয়রাতি চাওয়ার লজ্জা থেকে বেঁচে যাবে।
পরদিন খুব ভোরে বৈকুণ্ঠপুরে গিয়ে হাজির হল। খড়ের গাদার গায়ে লাউমাচার নীচেই বাঘা শুয়ে। গালে সেই তিল। একটা গোঁফ সাদা হয়ে গেছে। নাম ধরে ভদ্রেশ্বর ডাকতেই কুকুরটা উঠে দাঁড়াল। আর কি কান্না।
বাড়ির কর্তা অমৃত ঘোষ বেরিয়ে এল। ভদ্রেশ্বর নমস্কার করে সব বললো। লোকটা গেরস্থ মানুষ। রেশনের দোকান আছে। সাইকেলে বাড়িতে কি একটা মেমো বই নিতে এসেছিল। সব শুনে ঘোষমশাই বললো, ‘থানায় ডাইরি করা আছে—ছেলেদের কাউকে থানায় নিয়ে গিয়ে ডাইরি কেটে দিয়ে কুকুরটা নিয়ে যান।’
কিন্তু ছেলেরা বাদ সাধল। দিন ভাল নয়, ভোরবেলা কুকুর দিলে বাড়ির অকল্যাণ হবে—এইসব বলে তাকে প্রায় ফিরিয়ে দেয়। ভদ্রেশ্বর তখন বললো, ‘আজ্ঞে আমি কুকুর পোষার লোক নই। কুকুরটি কদমপুরের কুবের সাধুখাঁ মশাইর। বাঘাকে ফিরে পেলে সাধুখাঁ মশাই খুশী হবেন।‘
এ তল্লাটে কুবের এখন একটা নাম। ঘোষমশাইর এক ভাইপো কিছু বেগড়বাঁই করছিল। নাম শুনে সিধে হয়ে এল। বাঘা তখন ছাড়া পেয়ে ভদ্রেশ্বরকে একনাগাড়ে আদর করে যাচ্ছে।
সারা বাড়িতে ষাট সত্তরজন লোক। ছেলে মেয়ে বউ অনেক। জানা গেল, এই সরু পিয়াসলেতেই ঘোষেদের সাতখানা দোকান। রেশন, কাটা কাপড়, মুদির দোকান তো আছেই—তাছাড়া স্কুলের বই আর কয়লার দোকানও আছে। আরও জানা গেল, এবাড়িতেও এসে বাঘা ফেন খাওয়া ধরেছে, রাতে দুধের সঙ্গে রুটি খায় ন’খানা।
অমৃত ঘোষের ভাইপোটি অনেক কথা বলে, শেষে বললো, ‘আমায় একটা চাকরি করে দিন—যদি ক্ষমতা থাকে সাধুখাঁ মশাইকে বলে কোন একটা কাজে লাগিয়ে দিন। কুকুর এসেছে স্টেশন থেকে আমাদের পিছু পিছু-অবলা জীব—যত করেছি। তার বদলি কিছু চাইনে। আমি ইয়ং ম্যান—আমাকে খাটিয়ে কিছু পয়সা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলুন।’
ভদ্রেশ্বর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলতে পারল না। কালই কলকাতায় ট্রাম পুড়তে দেখেছে। তার চেনা দুনিয়া অনেকদিনই চেহারা পাল্টাচ্ছে।
ছেলেটা আবার বললো, ‘আমায় যে-কাজ দেবেন—ফাসক্লাস করে দেব, খুঁত পাবেন না। শুধু গোড়ায় গোড়ায় একটু দেখিয়ে দিতে হবে।’
ছেলেটা আগ বাড়িয়ে কুকুর দেবার ব্যবস্থা করল। থানায় নিয়ে গেল ভদ্রেশ্বরকে। সেখানে অমৃত ঘোষের ভাইপো বেশ পরিচিত। দু’চারবার অ্যারেস্টও হয়েছে। এখানকার লোক দারোগার সঙ্গে কেমন হেসে হেসে কথা বলে। দারোগাও হাসে। ডাইরি কেটে রসিদ তৈরি হল।
ভদ্রেশ্বর মুখের ওপর ঘোষ মশাইয়ের ভাইপোকে বলতে পারল না, বাবা এ—বাজারে চাকরি দেবার কথা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সেকথা বললে, ছেলেটা আঘাত পাবে। বড় আশা করে কথাটা পেড়েছে। কাজ যিনি দেবেন সেই কুবেরবাবুও এখানে নেই!
ঠিক হল পূর্ণিমার দিন কি একটা ছুটি আছে। রেশনের দোকান বন্ধ থাকবে। সেদিন বিকেলে সবাই বাড়িও থাকবে। তখন ভদ্রেশ্বর বাঘাকে নিয়ে যাবে। যাবার আগে ভদ্রেশ্বর খানিকক্ষণ হাত বোলালো গায়ে, কিরে ব্যাটা ধৰ্ম্মরাজ্যের সঙ্গী!’
পেটের মধ্যে এত খিদে কোথায় ছিল কুবের বুঝতে পারেনি। লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার পর সাহেব খেতে বসেছে। সারেঙ মাল্লাদের একজনকে তার সিটে বসতে বলে নিজে দু’বার সাধুখাঁ সাহেবের পাতে প্রায় হাঁড়ি উলটে ভাত ঢেলে দিয়েছে। কুবের খেয়েই যাচ্ছিল। সারেঙ থামালো, ‘কাল ভোরে বড় নদীতে পড়েই আপনার জন্যে মাছ কেনাবো—’
কুবের মাথা নীচু করে খাচ্ছিল। ভাত না অমৃত। সারেঙের কথায় মাথা তুলে তাকাল, ‘বড় নদীতে পৌঁছতে পারব আমরা?’
‘না পারলে তো ভাঁটায় পড়ে যাব সাহেব—’
‘ভাঁটায়—’, খাওয়া থামিয়ে কুবের কি ভাবতে বসছিল।
সারেঙ নিজে আঁচানোর জলের বালতি, মগ এনে পাটাতনে রাখল, ‘হাত ধুয়ে ফেলুন।’
এঁটো তোলার নাম করে মাল্লাদেরই একজন অন্যমনস্ক কুবেরের সামনে থেকে কলাই থালা আর গ্লাস সরিয়ে নিল। কুবের পেছনে তাকিয়ে দেখল, কোথায় মেদনমল্লর দুর্গ! সব মিলিয়ে গেছে। সেখানে আকন্দর কাটা শেকড়ের ওপর আভা আছে। হাজার বিঘের ওপর মাঠে বোরো ধান শুয়ে। জ্যোৎস্নায় নদীপথ থানধুতির মত লম্বালম্বি দেখায়। আজই বিকেলে আভা বলছিল, ‘তাঁবুর কাছে কি একটা। আর বলা হয়নি। তখন বিকেল ছিল একটু। কিংবা সন্ধ্যে শুরু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। এখন সেসব, নদীর কয়েক বাঁক পেছনে। সামনে জলের ওপর ফ্যাকাসে ধোঁয়ার লম্বা লম্বা লাইন জ্যোৎস্নার মধ্যে ঝুলে আছে। সেগুলো ছিঁড়ে দিয়ে ‘ডাহুক’ এগোচ্ছে। এমন আলোয় হেডলাইট লাগে না। কারবন পালটে কালপরশু লঞ্চ ফিরে যাওয়ার কথা।
আঁচিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় বসল কুবের। মাথার কাছে বালিশের পাশেই ঝোলাটা। তার ভেতরে হরেক জিনিস। ঝোলার একদিক ট্যাম হয়ে ফুলে উঠেছে I কুবেরের এখনই সব পর পর মনে পড়ে গেল। আজ সকাল থেকে কিসব হয়ে গেল। এখন ভুলে ফেললে সবচেয়ে ভাল। এতবড় একটা দ্বীপ, তাঁবু, দুর্গ এসব দেখার ইচ্ছা না থাকলেও মনে পড়লেই ঠিক চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এত বড় একটা জিনিস—ভাঁজ করে পকেটে রাখারও উপায় নেই। কতদিকে চোখ বুজে থাকবে। লঞ্চের ডগায় আলো পেয়ে নোঙর বাঁধার লোহার খুঁটি, পাত—সবই চিকচিক করে উঠছে। ওখান থেকে ঘুমন্ত আভাকে একদিন এমন রাতে কুবের পাঁজাকোলে তুলে নিয়েছিল। তখন ‘ডাহুক’ দ্বীপে যাচ্ছিল। কুবেরের স্পষ্ট মনে পড়ল আভা বলত, ‘তোমার দ্বীপ’। মেদনমল্ল লোকটাই ফাউ। সেই দ্বীপে তার কত টাকা আটকে গেল। যাকে বলে হার্ড ক্যাশ-করকরে নগদ।
শেষরাতে ঠাণ্ডা হাওয়া দিতেই কুবেরের ঘুম ভেঙে গেল। তখন আর পুরনো কিছু মনে নেই তার। জ্যোৎস্নায় পরিষ্কার সব দেখা যায়। সামনেই মৈসিনির চর। ওখানে খাবার জলের কুয়ো আছে। ওই বাঁকটা পেরোলেই লঞ্চঘাটা আর দু’তিন ঘণ্টা। লঞ্চ জোরে জল কাটছে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে। নাহলে ভাঁটা।
জলের নীচে কত বেওয়ারিশ জায়গা। ভাঁটায় তারা গা তুলে দেখা দেয়। জল নেমে গেলেই কাঁকড়ার ছানার রাজত্ব। কোটি কোটি। ভোররাতে ভাঙা ঘুমের মধ্যে কুবের সাধুখাঁ ফোলা মুখ নিয়ে বসেছিল। সেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। একা একাই হেসে নিল। ভাঁটায় ফাঁকা নদীর বুক পারলে আমি একদিন বায়না করে নিতাম।
তারপরেই কুবের ফট করে শুয়ে পড়ল। বালিশের বদলে ঝোলার খানিকটাও মাথার নীচে পড়েছে। সে-জায়গাটা একেবারে পাথর। ভীষণ শক্ত। মাথা সরিয়ে নিয়ে বালিশেই রাখল। ভাঁটায় পড়ার ভয়ে লঞ্চ তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। একবারও মনে পড়ল না, এবার পৃথিবী কাদা করে কতটা জায়গায় ধান রুয়েছে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, আভা কাল কি একটা কথা বলতে চেয়েছিল। শেষ অব্দি বলতে পারেনি। তাঁবুর ধারে কি একটা—
নিজের নামের রাস্তায় পা দিয়েই কুবের বুঝলো, কদমপুরে তার আজ অনেক বাকি। পাকা রাস্তা হবে বলে দু’ধারে ইটের গাছি, খোয়ার চৌকো সাজানো রয়েছে। অনেককাল পরে এদিকে এসে একেবারে গোড়ার দিককার নতুন নতুন লাগছে। একটু এগিয়েই স্টেডিয়ামের গোল ঢালাইটা চোখে পড়ল। তারই দিকে দাঁত বের করে আছে। এস.কে. বোসের দোতলায় সামিয়ানা খাটানো। লোকজন। বোধহয়, গৃহপ্রবেশ।
বড় মুলতানী গাইটা দূর থেকে কুবেরকে দেখেই চিনলো। কদমতলায় দাঁড়িয়ে মেছলা থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর গলায় ডেকে উঠল। গরুটা কুবেরের কাছে কৃতজ্ঞ। তিন তিনবার পাল ঝেড়ে ফেলার পর বড় ডাক্তার বাড়িতে আনিয়ে গাইটাকে ইনজেকসনে গাভিন করেছে কুবের। খারাপ ষাঁড়ের পাল্লায় পড়ে জরায়ুতে আলসার হয়ে গিয়েছিল। জার্সি বুলের বীজ দেওয়ার আগে সেখানে ডাক্তার আগে পাঁচ সিসি স্ট্রেপটোমাইসিন দিয়ে নিয়েছিল। নইলে যতবারই বীজ দাও—ঘা থেকে পোকা উঠে শুক্র মেরে ফেলবে। এসব করার আগে ডাক্তার গাইটার চারপায়ে প্রণাম করে বলে নিয়েছিল, ‘কোন দোষ নিস নে মা—‘
বাড়ির সামনের সবুজ লনে গার্ডেন পার্টির পেল্লায় এক ছাতা বসানো। তারই ছায়ায় দুই প্রাণী বসে কি করছে। কাঁধের ঝোলাটা সামনে নিয়ে কুবের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো।
দেবেন্দ্রলালের হাত থেকে সকালের কাগজ পড়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা কুবেরের দিকে তাকিয়ে আছে। কুবের কিছু বলতে পারল না। সৃষ্টিধর পেছন ফিরে ছবি আঁকছিল। সেও ঘুরে বসল। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার উলটে দিয়ে ছুটে এল, ‘বাবা।’
কুবের সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে ছেলেটাকে টেনে নিল। তারপর দেবেন্দ্রলালের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাবা? তুমি? এতদিন পরে—
কোন কথা এল না দেবেন্দ্রলালের মুখে। ছেলেকে চেনা যায় না। গায়ের রঙ জ্বলে গেছে—না, সারা গায়ে কালো কালো কিসের ছাপ। তার ছেলেই মনে হয় না। ‘বোসো এখানে।’
সৃষ্টিধর টেনে আনছিল। কুবের ধপ করে বেতের চেয়ারে বসে পড়ল। নিজের ঢাকা দেওয়া দুধের গ্লাস দেবেন্দ্রলাল এগিয়ে দিল। কুবের বললো, ‘আমি দুধ খাইনে—’
‘কেন?’
‘বমি আসে—’
‘তাহলে এতগুলো গরু পুষলে?’
অনেক কষ্টে কুবের বললো, ‘তোমরা সবাই আসবে ভেবেছিলাম।’
সৃষ্টিধর দেবেন্দ্রলালকে বললো, ‘দেখেছ—আমি বলেছিলাম, বাবা আসবে।’
দেবেন্দ্রলাল ধমকে উঠল, ‘গায়ের ওপর উঠছ কেন? বাবাকে জিরোতে দাও।’
এমন সময় কুসুম এসে হাজির। ছাতার নীচে একটা নতুন লোককে বসে থাকতে দেখে পায়ে পায়ে কাছে এল, তারপর খুব আস্তে জানতে চাইল, ‘তুমি বাবা?’
কুবেরের চোখ জলে ডুবে যাচ্ছিল। লঞ্চঘাটায় নেমেই দৌড়ে এসে ট্রেন ধরেছে। কাল এইসময় মাঠে দাঁড়িয়ে আভার ডাকে সাড়া দেয়নি। অনেক কষ্টে বললো, ‘হ্যাঁ।’
মেয়েটার তবু বিশ্বাস হয় না, ‘সত্যি!’ কুবের কোলে তুলে নিল। কোলে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কুসুম একটু একটু করে মিলিয়ে নিতে লাগল। কুবেরের দু’খানা হাত তাকে শক্ত করে ধরে আছে।
একজন এইসব দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিল। সে দেবেন্দ্রলাল। কুবেরকে তার বলার ছিল অনেক। ভাবেইনি ছেলেকে এমন আচমকা দেখতে পাবে।
ঘাসের নরম মখমলে সৃষ্টিধর পা ডুবিয়ে দাঁড়ানো। পেল্লায় ছাতার ছায়া অনেকদূর ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একটা ছাতা নিয়ে একজন লোক পূর্ণিমায় পালিয়ে গিয়েছিল। কুবেরের পরিষ্কার মনে পড়ল, আমি তখন এরকম একটা ছাতা মাথায় দিয়ে ব্রজদার সঙ্গে এসপ্ল্যানেডে হেঁটেছিলাম। বসেও ঘুম পাচ্ছিল। পারলে সেখানেই চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু তিন প্রাণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেবেন্দ্রলাল, সৃষ্টিধর, কুসুম
‘তুমি এখানে?’
‘তোমার বড়দার প্রোমোশন হয়েছে। তাই নারায়ণকে সোনার বেড় পরাতে এসে কিছুদিন এখানে আছি। কেন?’
‘কিছু না। তোমরা তো এদিক মাড়াও না—’
‘কোন খবর নেই, এতদিন তুমি বাইরে ছিলে কি করে? তুমি এ বাড়ির কর্তা। বউ ছেলেমেয়ে হয়েছে। এখনও কি আগের মত ঘোরা যায়—’
কুবের দেবেন্দ্রলালের মুখের ওপর মানানসই একটা জবাব দিতে পারত। আজ চার পাঁচ বছর আমি মুখে রক্ত তুলে টাকা কামালাম। ঘরবাড়ি করলাম। তোমরা এলে না। এই ফাঁকা তল্লাট, গরুবাছুর, ধান বিচুলি, কুকুর-পুকুর—আমরা একা একা আগলাই। আজ নতুন করে কি আর দুশ্চিন্তা দেখাচ্ছ।
কুবেরের সেই ব্যথার জায়গাটা আজকাল খুঁজে পায় না। জায়গা মত ঘা পড়লে তবে মনে পড়ে।
‘বাবা। বাঘা নেই।‘
সৃষ্টিধরের সঙ্গে সঙ্গে কুসুমও বললো, ‘নেই।’
দেবেন্দ্রলাল ছেলেমেয়েকে ধমকে উঠল, ‘আগে তোদের বাপকে জিরোতে দে একটু। এবার পালাচ্ছে না।’ কুসুমকেও নামিয়ে দিল বুড়ো, তারপর নিজেই বললো, ‘তোমাদের মা নেই এখন। আমিও চৌদিক ঘুরে সবাদিকে দেখার সময় পাইনে। তোমরা কে কেমন থাক—’
সুষ্টিধর ঝোলাটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকছিল। কুবের দৌড়ে গিয়ে একরকম কেড়ে নিল, ‘আমিই রেখে দেব।’
দু’বর্ষা আগে বসানো নারকেল চারা, কলমের বাতাবি, আম, জামরুল মাথায় কিছু বেড়েছে। এখনও এদিকে পাখি আসে। গরমকালের পানকৌড়ি ভুস করে জলে পড়ছে আবার ছুঁচলো হয়ে আকাশেও উঠে যাচ্ছে। বাড়ির ভেতরে ঘণ্টা বাজিয়ে ঠাকুর পুজো হচ্ছে। কুবের এসেছে-এ খবর এখনও ভেতরে পৌঁছয়নি।
কালই বিকেলে বোধ হয়—কিংবা তার আগের দিন বিকেলে—দেবেন্দ্রলাল দশ টাকার খুচরো করে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসেছিল। ভিখিরী দেখে ডেকে ডেকে পয়সা দিয়েছে। মনে মনে বলেছে, আমার ছেলেটা যেন ফিরে আসে। কুবেরের কিছু হয়ে থাকলে আমি সারিয়ে ফেলব।
গাভিন গরুর দুধ খুব ঘন বলে খানিক জল মিশিয়ে কড়ায় চাপাতে হয়। নতুন রাঁধুনী ব্যাপারটা জানত না। জল দেয়নি। দুধ ধরে গিয়েছিল। কড়া মাজতে দেওয়ার আগে নোখ দিয়ে চেঁছে চেঁছে পোড়া দুধ খেয়েছিল। বুলুর ধমকে সব স্বীকার করেছে। সে জানত না, গেরস্থবাড়ি এভাবে পোড়া দুধ খেলে গরুর বাঁট ফেটে যায়। দোহালকে কাল থেকে হাত দিতে দিচ্ছে না বাঁটে। কাছে গেলেই পা ছুঁড়ছে। কুবেরের ডাইরি খুলে দেখছিল বুলু। ওষুধটার নাম লেখা আছে। কয়েক পাতা উলটেই পেল বোরোফ্যাক্স।
ওষুধটা আনতে দিতে হবে। অনেক কাজ বুলুর হাতে। সাহেব মিত্তির অনেক দিন তার দেখা পায় না। বুলু বলেছিল, ‘অত অস্থির কেন? শিব প্রতিষ্ঠার দিন শ্বশুর মশাইর সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছি। তখনই তো দেখতে পাবে।’
‘অত ভিড়ে কিছু কথা হয় না।’
সাহেবকে ধমকে থাকিয়ে দিতে পারেনি বুলু, আস্তে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে আমার এমন কি কথা থাকতে পারে সাহেব?’ শেষে নিজেই নিজেকে শুনিয়ে বলেছে, ‘কোন কথা থাকতে পারে না।’
‘সে আমি জানি না। দুপুরে কোথাও বেরোবো না। কোয়ার্টারে তোমার জন্যে বসে থাকব। আসবে কিন্তু।’
সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বুলু বেলা পড়তে না পড়তে গাড়ি নিয়ে বেরোতো। ঘুম থেকে উঠে একটু বসতে পারে না। অনেক কাজ। লবিতে প্রমাণ সাইজের আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠেছিল। কোথাও একটু টাল খায়নি। একেবারে পুরন্ত পাটালি। দোষের মধ্যে হাত দু’খানা ভারি হয়ে গিয়ে বয়সটা ধরিয়ে দেয়। মাথা নীচু করে বুকের ওপর ব্লাউজের ঘের দেখছি। তার জন্ম পৌষ মাসে।
‘কে?’ আয়নায় একটা লোককে দেখে চমকে উঠেছিল বুলু। বাবা থাকলে বাইরের কেউ সোজা ওপরে উঠে আসতে পারে না।
‘চিনতে পারলে!’
বুলুর মাথার মধ্যে সারাটা দোতলা দুলে গেল,’ওমা তুমি—’, আনন্দর মত একটা জিনিস বেশ চেষ্টা করে গিলে ফেলল বুলু। অনেকদিন পরে নীচে দেবেন্দ্রলালের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। শেষে বুলুই বললো, ‘এত দেরি হল ফিরতে? ধান কেমন হল?’
কুবের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল, ঝোলাটা কোলের ওপর, ‘ভালোই।’
‘পোকা লাগেনি?’ চটি এনে কুবেরের পায়ের সামনে রাখল।
‘একদম না।’
‘জল ছিল?’
‘খুব!’
‘কাটবে কবে?’
‘দেরি নেই আর—! এক গ্লাস জল দেবে?’
জল, সঙ্গে এক গ্লাস দুধ নিয়ে ছুটে এল বুলু, ‘জায়গাটা কেমন? খুব ফাঁকা শুনেছি—’
ঢকঢক করে জল, দুধ দুই-ই ফিনিস করে ফেলল কুবের, ‘চমৎকার!
‘তোমার গা একদম জ্বলে গেছে। কি কালো হয়েছ বাবা!’
কুবের আর কোন জবাব দিতে পারল না। বুলু কাছে এসে মাথার আঙুল চালিয়ে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। অনেক পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘স্টেডিয়ামের কাজ বন্ধ। সিমেন্ট আসছে না। আশি লরি ইট এসেছে। চালানগুলো সই করে রেখেছি তোমার দেরাজে—’
‘ওসব পরে শুনবো বুলু।
‘তোমার ঘাড়ে, গলায় এসব কিসের দাগ। আগে তো ছিল না।’ বুলু খানিক পিছিয়ে গেল। তারপর কুবেরের শার্ট উলটে পিঠটা দেখে চমকে উঠল, ‘কি হয়েছে তোমার?’
‘আমি জানতাম বুলু! তুমি একদিন ঠিক জানতে চাইবে—’
‘মানে—’
‘তোমায় আমি বলতে চেয়েছিলাম। ক’বার বলতে চেষ্টা করেছি। হয় তুমি থামিয়ে দিয়েছ বুলু-নয়ত, কেন যেন থেমে গেছি। আমি জানতাম বুলু—’
হঠাৎ দুজনই এক সঙ্গে দেখল একতলার সিঁড়ির মাথায় সৃষ্টিধর আর কুসুম চুপ করে দাঁড়িয়ে। তারা মা বাবাকে এভাবে কোনদিন দেখেনি। কুসুম প্রায় এই প্রথম দেখেছে-বাবা কেমন হয়।
ওদের দিকে তাকিয়েই কুবের বললো, ‘আমি মোটেই ঘুমোইনি কাল। একটু ঘর অন্ধকার করে দাও। শোব।’
সৃষ্টিধর, কুসুম খুব মন দিয়ে বাবা দেখছিল। ঘুমজড়ানো চোখে কুবেরও ওদের দেখছিল। বুলু দক্ষিণের বড় ঘরের জানলায় জানলায় পেলমেটে গোটানো পর্দা নামিয়ে দিচ্ছে। সৃষ্টিধরের মাথাটা কিছু বড়। কুসুমের ব্রহ্মতালু এখনও নিশ্চয়ই নরম। ভেতরটা সব সময় দপদপ করে। হাত রাখলে বুঝতে পারত কুবের। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ওদের দু’জনেরই মাথার ঘিলু এখন নরম—মুদির দোকানে ওই সাইজের মাখনের দলা জল থেকে তুলে ছুরিতে পুচিয়ে কাটে, কাগজে মুড়ে খদ্দেরদের ভাগ করে দেয়। ওখান দিয়ে আমার রক্ত পাস করে।
ঠিক তখন কুবেরের মাথার ভেতরে চেনা ছবিগুলো খুলে খুলে পড়তে লাগল। এইভাবে শখের থিয়েটারে নাটকের পর ডেকরেটারের লোকজন উইংস খুলে নিয়ে যায়। সারা আসর তখন পালক খসানো। চোখের সামনে নিজের ছেলেমেয়ে দাঁড়ানো। কুবের তাদের মনে করতে পারল না। ছোট দুই প্রাণী তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা দেখছে। কুবের তখন নিজের মাথার মধ্যে নেমে লণ্ডভণ্ড-প্রায় ন্যাড়া একটা জায়গার ভেতর দিয়ে জোরে হেঁটে যাচ্ছিল। চেনা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কাকে দেখে মনে রাখবে—তার নিজের নাম কুবের। নাম ভোলার চেয়ে বড় দুঃখ আর নেই। তখন সে কি কষ্ট। যে কোন একটা কিছু উঠে ধরে দাঁড়ানো দরকার।
কখন কুসুম পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এসেছে, পা উঁচু করে কুবেরের কোলের মাঝখানে জায়গা করে নিয়ে বসে পড়েছে—বাবা হয়েও কুবের তার এতটুকুও টের পায়নি। সব কিছু মনে রাখার জন্যে নিজের কোলের মধ্যে নরম মত একটা জিনিস পেয়ে সেটাকে এমন জোরে চেপে ধরেছিল, কুবের নিজেই তার চীৎকারে চমকে উঠল। এ যে কুসুম।
সব কিছু অচেনার মধ্যে প্রথমবারে কিন্তু মনে হয়েছিল, একটা হাঁসকে আচ্ছাসে চটকাতেই সরু পাইপ মার্কা গলা চিরে ফেলে বাতাসের অভাবে প্যাঁক করে উঠল হাঁসটা। আরেকটু চেপে ধরতেই কুসুমের গলার ফাটা আওয়াজ—মেয়ের জলে-ভরা দুই চোখ—এসব দেখে শুনে কুবের খচ করে সব মনে করে ফেলল। আর ভয় নেই।
কুবের খুব সাবধানে খসখসে আঙুল বুলিয়ে কুসমের চোখের জল মুছে দিল। এতখানি ব্যথার পর আদর পেয়ে মেয়েটা সব ভুলে যাচ্ছে। হাসি ঠিকরে পড়ল মুখে। কুবের পরিষ্কার বুঝল, এই ধারার মেয়ের পাকাপাকি কিছু মনে থাকে না, এরা জানে না, কেন এখানে আসে। মাথা তুলে দেখল, বুলু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে—মায়ের হাত ধরে সৃষ্টিধর। সিঁড়ির মাথায় দেবেন্দ্রলাল।
যেমন উঠেছিল, কোল থেকে তেমন নেমে গেল কুসুম।
‘আমি শুয়ে পড়িগে—’
সিঁড়ির মুখ থেকেই দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘চান খাওয়া-দাওয়া কখন করবে?’ বুলুর দিক থেকে কোন সায় না পেয়ে চুপ করে গেল। কুবের উঠে যাচ্ছিল—ফিরে এসে চেয়ারের পায়ার কাছ থেকে ঝোলাটা তুলে নিয়ে গেল।
বুলু একটা কথাও বলেনি। এই সময়টুকু সে তার অনেক দিনের চেনাশোনা বিয়ে করা স্বামীর কেমন অচেনা হাঁটাচলা খুব মন দিয়ে দেখল, কুবের ঘরে ঢুকতেই বাইরে থেকে দু’ইঞ্চি পুরু কাঠের দরজা আস্তে আবজে দিল।
কুবের প্রায় অন্ধকার ঘরে ঢুকে দেখল, বিছানায়, মেঝেতে, জানালার তাকে—সব জায়গায় ধান হয়ে আছে। ভালো করে তাকালে বোঝা যায় দানা শক্ত হয়ে হলদে হতে শুরু করেছে। কোন দিকে মন না দিয়ে কুবের ধপাস করে বিছানায় পড়ল।
বেলায় খেতে বসে দেবেন্দ্রলাল দু’বার জানতে চাইল, ‘কুবের উঠবে না?’ ফ্রিজের মাথায় বসানো সুরেলা ঘড়ির ভেতর থেকে পাখি বেরিয়ে এসে ডাকছে।
সুষ্টিধর চুপ। শুধু কুসুম দু’একটা কথা বলে যাচ্ছে। বুলুর গম্ভীর মুখ দেখে দেবেন্দ্রলালের বিশেষ ভরসা হল না। আজই সকালে অনেক দিন পরে কুবেরকে ফিরে পেয়ে এত আনন্দ হচ্ছিল। সব জোড়া লেগে যাচ্ছিল। শেষে এ কি হয়ে গেল। অল্পক্ষণে এমন হয়ে যায় সব জিনিস। দেবেন্দ্রলাল জানে, আজ ওদের মা থাকলে কুবের এমন হতে পারত না, ‘তুমি বসবে না বউমা?’
বুলু শুধু মাথা নেড়ে পার পেল না, বলতে হল, ‘আমি একটু শিবতলায় যাচ্ছি—’, সাহেবের ওখানে যাওয়ার কথা আছে, শেষবারের মত যাওয়ার জন্যে তাকে দিয়ে দিব্যি গালিয়ে নিয়ে গেছে লোকটা—তা আর ভেঙে বলতে পারল না। তবু একটু অপরাধের খোঁচা লেগে থাকল কোথায়। মাথা নীচু করেই বুলু বললো, ‘আমি ফিরে এসেই ও’র সঙ্গে খেতে বসব—
দেবেন্দ্রলালের মনে হল, হয়ত কোন মানত আছে। তবু বললো, ‘কাল তো সবাই যাচ্ছি। শিব প্রতিষ্ঠা সন্ধ্যে সন্ধ্যে। আজকের কাজ তখন হয় না-’দেবেন্দ্রলালের মন বলছিল, আজ কুবেরের কাছাকাছি থাকা দরকার। কুবেরকে খুব করে ঘিরে রাখা চাই।
‘না ঘুরে আসি।’
বুলুর মন পড়েছিল এখানে। কিন্তু অন্য জায়গায় জটপাকানো একটা সুতো খুলে ফেলে দিয়ে তবে সুস্থির হয়ে বসা যায়। শাড়ি পালটে আজ আর নিজেকে দেখতে পেল না বুলু। ঘরের আয়নাগুলো ফলস্ লাগে তার। সিঁড়ির মুখে লম্বা আয়নায় নিজেকে পেয়ে গেল।
সৃষ্টিধর, কুসুম নীচের বড় ঘরে আজ দেবেন্দ্রলালের সঙ্গে শুয়েছে। ‘গারো’ আর ‘ফ্লোরিকান’ স্টিমারে চানের জল কত মোটা নল দিয়ে পড়ত—সেই গল্পটা দেবেন্দ্রলাল বলছে। বুলুর শ্বশুর বলে জাহাজ। ‘বালুচ’ জাহাজে একবার মেঘনা পার হওয়ার সময় একটা কাক খুব বিপদে পড়েছিল। ডাঙায় থাকতে নোঙর করা জাহাজে কাকটা এসে পাটাতনে বসেছিল। খেয়াল করেনি—জাহাজ কখন বড় নদীতে পড়েছে। চারদিকে ঘোলা জল। দশ মাইলের মধ্যেও তীর দেখা যায় না। কাকটার পাখায় অত জোর থাকবে কোত্থেকে? এতটা পথ না জিরিয়ে একা একা উড়ে পার হওয়া যায় না। ‘গারো’, ‘ফ্লোরিকানের’ পর দেবেন্দ্রলাল ‘বালুচ’ জাহাজের গল্প বলবে। বুলু জানে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সেই কাকটাকে আয়নায় পরিষ্কার দেখতে পেল। কাকটা আজ ভর-দুপুরের সঙ্গে মানিয়ে হালকা রঙের শাড়ি পরেছে—সরু সিঁথিতে অনেকদিন পরে খানিক সিঁদুরও ডলেছে। কতকাল আমি কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নিতে পারিনি। শুধু ফেনা কাটার আওয়াজ—জল ভেঙে যাওয়ার ঘোলা ছবি।
দেবেন্দ্রলাল গল্প থামিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনলো চুপচাপ। সৃষ্টিধর ঘুমিয়ে পড়েছে, কুসুমের চোখ ছোট হয়ে এসেছে। নিজেও ঘুমিয়ে পড়ছিল। অনেক কষ্টে চোখ খোলা রাখল। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তেই পা টিপে টিপে দোতলায় এসে কুবেরের ঘরের দরজা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিল!
হাঁ করে ঘুমচ্ছে। দুই চোখের নীচেই অনেকখানি করে গর্ত। কুবেরের একখানা পা খাটের বাইরে ঝুলে পড়তে পারে। খুব আলগোছে সেখানা জায়গা মত রাখতে গিয়ে দেবেন্দ্রলালের খুব ভারী লাগল। ঘরের অন্ধকার সয়ে এসেছিল চোখে। মুখের কাছে মুখ নিয়ে বহুকাল পরে তার একটা পুরনো ইচ্ছে উঠে এল। কুবেরের মাথার কিছু চুল কপালে এসে পড়েছে। ব্রহ্মতালু কত ফাঁকা। দেবেন্দ্রলাল মুখ নামিয়ে কুবেরের কপালে একটা চুমো রাখতে গেল। পারল না। ওদের মা বলেছিল, ঘুমন্ত শিশুকে চুমো দিতে নেই—বড় রাগী, জেদি হয়। তার ঊনচল্লিশ, চল্লিশে কুবের হয়।
‘কে? কে—’
চোর পড়লে এমন চেঁচায় লোকে। কুবের উঠে বসেছে। দেবেন্দ্রলাল কিছু থতমত খেয়ে গেল, ‘কেউ না। আমি–তোমায় বাবা।’
‘এখানে কেন? এখানে?’
‘তুমি ঘুমের ঘোরে খাট থেকে পড়ে যেতে—ঠিক করে দিয়ে গেলাম।’
‘দাঁড়াও। যেও না। কিছু খাবার আছে? বড় খিদে পেয়েছে বাবা—’
‘পাবেই তো—’, বলে আর দাঁড়াল না দেবেন্দ্রলাল। কাজের লোকজন শুয়ে পড়েছে। ফ্রিজে কিছু রান্না জিনিসপত্র পাওয়া গেল। সেগুলো গরম করে দেওয়া চাই। ও পথে না গিয়ে পাথরবাটিতে তোলা ছানা চিনি মিশিয়ে নিয়ে এল দেবেন্দ্রলাল।
‘বুলুকে বললে পারতে—’
কুবেরের হাতে বাটি তুলে দিয়ে পুবের জানলা খুলে দিল দেবেন্দ্রলাল। খাওয়া হয়ে গেলে ফ্রিজ থেকে ঘাম মাখানো একটা বোতল ছেলের হাতে তুলে দিল। কুবের মাথাটা পেছনে ঢেলে দিয়ে ঢকঢক করে এক বোতল জল খেয়ে ফেলল, ‘বুলু কোথায় বাবা?’
‘ও বুঝি শিবতলায় গেছে। খেয়ে যায়নি। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে খেতে বসবে বলে গেছে।’
কুবের এবার পাথরবাটি, বোতল নিজে উঠে গিয়ে রেখে এল।
‘তুমি এখানে পাকাপাকি থাকলে পার বাবা।’
দেবেন্দ্রলাল মুখ খুলল না। হাসল একটু।
‘এখানে তোমার খারাপ লাগে?’
‘তা কেন? তবে, আমি বলি কি-এটা তোমার সংসার, যা-কিছু ডিসিসন তোমারই। সব সময় থাকা দরকার তোমার।’ কি আর একটা কথা মনে পড়ল দেবেন্দ্রলালের, ‘তোমার তুলনায় কত অল্প টাকায় সংসার করেছি আমরা।’
‘শুধু টাকাটাই দেখলে বাবা! তোমার কাছাকাছি আমরা ছিলাম। আমার কাছাকাছি কেউ নেই—‘
‘বয়স হলে সব লোক আলাদা হয়ে যায়। ছোটবেলায় একরকম থাকে। বিয়ের পর তার নতুন শেকড় বেরোয়—’,
‘তাহলে তুমি ফিরে ফিরে আসো কেন?’
‘বাঃ! আমি তোমাদের বাবা। তোমার এত দুঃখ কিসের কুবের?’ কথাটা শুনেই কুবেরের মাথার ভেতর দিয়ে ফুলস্পীডে একটা ইলেকট্রিক ট্রেন চলে গেল। তার ভেতরে মা, বড় বউদি, বুলু, বাবার সঙ্গে কুবের একটা কামরায় বসে আছে। ভিতপুজোর পর সবাই কদমপুর থেকে ফিরছে। সেদিন দেবেন্দ্রলাল বলেছিল, তোমার কত টাকা কুবের? ট্রেনটা ভীষণ দুলছিল। কুবের শক্ত করে খাটের ছত্রী চেপে ধরল। এই তো সব মনে আছে তার। দেবেন্দ্রলাল ইজিচেয়ারে শুয়ে ছিল এতক্ষণ। এবারে উঠে বসে বললো, ‘তোমাদের গর্ভধারিণী থাকলে তিনি এসেই দেখে যেতেন। না দেখে থাকতে পারতেন না—’
তারপর নিজেই আবার দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘আমার স্ত্রী বলে নয়—ওরকম মহিলা আর দেখনি আমি কুবের। কতই বা মাইনে পেতাম। তোমাদের কতজনের পড়াশুনো ওই টাকায় চলেছে। কিছু বন্ধ থাকেনি। রোজ স্টিমারঘাটায় বসে বসে নোঙর করা জাহাজের বয়লারে স্টোকারদের কয়লা দিতে দেখতাম—’
কুবের দেবেন্দ্রলালকে থামতে দিল না। উৎসাহে চোখ বড় করে তাকাল।
‘তোমাদের মা তার নিজের কাজ ঠিক করে নিয়েছিল। সংসারটা চালু রাখার জন্যে যেনতেন প্রকারে আমাকে খাইয়েদাইয়ে স্টিমারঘাটায় পাঠিয়ে দিত। আমার ইঞ্জিনে কোনদিন কয়লার-জ্বালানির অভাব পড়েনি। সে ধরেই নিয়েছিল—আমি চালু থাকলেই সংসার চালু।’
‘মা না থাকলে আমরা উঠতে পারতাম না বাবা।’
‘কেমন মোক্ষম সময়ে চলে গেছে দ্যাখো!’
‘কিছুই দেখে যেতে পারেনি মা।’
‘ধান কেমন হল?’
কুবের আকাশ থেকে পড়ল, ‘কোথায়?’
‘কেন! তোমার সেই দ্বীপে। মাটি কেমন?’
কুবেরের সব মনে পড়ে গেল। তার এই মাত্র মনে হচ্ছিল, মা ছিল বলেই সে নিজে কঠিন, অসম্ভবের তোয়াক্কা না রেখেই কদমপুরের মাঠে ড্রিম মরচেন্ট হয়ে বসেছিল। এ শুধু মায়ের ছেলে বলেই সম্ভব হয়েছে। মায়ের কাছে আমরা ছিলাম এক একটা ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন। কুবের একদিন নগেনকে বলেছিল, জানিস—মা হল ইটারনাল স্টোকার। আমাদের ইঞ্জিনে ফুয়েল যোগানোই তাঁর কাজ। শুধু সেইটুকু জেনে বসে আছে এ-জীবনে। আজ অনেক দিন পরে দেবেন্দ্রলালের কথায় মায়ের সে-ছবি ভেসে উঠতেই কুবের ভরে যাচ্ছিল।
‘মাটি ভালোই। তবে কিনা—অনেক দিনের পোড়ো জায়গা তো—আগাছা, বিশেষ করে আকন্দ আর কিসব বুনো গাছ মাটির এক হাত নীচেই শেকড়ের জাল ছড়িয়ে রেখেছে—’, কুবের হাঁপাতে লাগল।
‘বলো তাহলে সেসব কেটে আবাদ করতে খুব কষ্ট গেছে!’
‘তা কিছুটা—’
‘ধান হল কেমন?’
‘খুব। গোছে গোছে মাঠ এঁটে গেছে।’
‘এত ধান আনবে কি করে কুবের।‘
‘সেই তো সমস্যা। খরো থাকতে থাকতে লঞ্চ বোঝাই দিতে হবে। তারপর ডাঙায় উঠে লরি—না হলে অগত্যা গোরুর গাড়ি।’
‘কোথায় রাখবে এত ধান। গোলা কোথায়? একটা ভাল স্টোর হাউস আগে চাই। আমি নিজে দাঁড়িয়ে সব দেখাশুনো করব। সালকের বাড়িতে থাকতে তোমরা রেশনের লাইন দিতে! এসব তোমাদের মা দেখল না।’
কুবের অবাক হয়ে দেবেন্দ্রলালকে দেখছিল। ধানের নেশা বড় নেশা। পাকে পাকে জড়ানো। অথচ আমার গেরো খুলে গেল।
‘তোমার সামনে অনেক কাজ কুবের।’
কুবের আরও অবাক হয়ে দেবেন্দ্রলালকে দেখল।
‘স্টেডিয়াম বানাতে হবে। খালের ওপরে ওখানে একটা ব্রিজ চাই।’
‘আমার আর ভাল লাগে না বাবা।’ কুবের গুছিয়ে বলতে পারল না। জমা হতে হতে অনেক জঞ্জাল স্তূপ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে স্টেডিয়ামটা মাথা তুলে দাঁড়ানো। চোখ খুললেই চোখ পড়বে। কিছুতেই তাড়ানো যাবে না।
‘আশ্চর্য! বুলু এখনো ফিরল না।’
‘তাড়া কিসের?’
‘না কুবের। তা ভাল না। অবেলায় খেলে নির্ঘাত অজীর্ণ। অবাক কাণ্ড! তুমি এসেছ—আর আজই এত কাজ পড়ল বউমার?’
‘কাজ হয়ে গেলেই চলে আসবে। এত ব্যস্ত কেন।’
‘আমরা এসব বুঝি না!’
যা কোন দিন করেনি, তাই করল দেবেন্দ্রলাল। পরিষ্কার বললো, ‘আমি সোজাসুজি একটা কথা বলতে চাই তোমাদের—নগেন ওদের বলতে পারিনি—কিন্তু তোমাকে আজ বলছি—তোমরা আরও বড় হতে, অনেক বড় হতে—’
কুবের উঠে বসে দেবেন্দ্রলালের দিকে তাকাল।
‘তোমাদের বউরা যদি অল্প অল্প করেও তোমাদের গর্ভধারিণীর গুণের ছিটেফোঁটা পেত!’
‘তা তুমি কি করে আশা কর বাবা!’
‘লোকে দেখে শেখে, ঠেকে শেখে। বিয়ের পর থেকে আমার ছেলেরা সবাই পায়ে পাথর বেঁধে পড়ে আছে।’
‘তুমি মানুষের কতটুকু জান বাবা? আমি আপত্তি করছিনে। কিন্তু—’
‘তুমি বুলুর কতটুকু জান? নগেন রেখার কতটুকু জান?’
‘কি বললে?’
‘তুমি বুলুর কি জান?’ দেবেন্দ্রলাল আর বলতে পারল না। কুবেরের চোখের কোণে ভীষণ সরু সব রেখায় হঠাৎ রক্ত থানা দিয়ে উঠেছে। হাঁটুমুড়ে আধখানা কুবের বিছানায় ঠেলে উঠল, ‘আবার বল—’,
দেবেন্দ্রলাল কিছু বুঝতে পারছিল না। এমন সময় সৃষ্টিধরের পেছন পেছন কুসুম ঘরে ঢুকল। মেয়েটাই আগে কথা বললো, ‘বাবা আমি একটা নাচ করি?’
থপ করে বিছানায় বসে পড়ল কুবের। দেবেন্দ্রলালের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
সৃষ্টিধর বোনকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘বেড়াতে চল না বাবা—’
দেবেন্দ্রলাল, কুবের একসঙ্গে বাইরে তাকাল। সামান্য বাবলা গাছও হাওয়া পেয়ে খুশীর ভঙ্গীতে দুলছে। সারি সারি বসানো গাছ কিছু ডাগর হয়েছে গত বর্ষার পর। তাদের গা বেয়ে কুবের রোড। বিকেলে কদমপুরের লোকজন এদিকটায় বেড়াতে আসে—হাওয়া খায়। আজ অনেক আগে পরিষ্কার আকাশে চাঁদের জলছাপ পড়েছে। ঘনরাম চাটুয্যের ইটখোলার জোড়া চিমনি দিয়ে রাশি রাশি ধোঁয়া বেরিয়েও ঝুলন্ত সূর্য ঢাকতে পারেনি। দেখতে পাওয়ার এই চেনা সীমানা কুবেরকে সাহস দেয়। খাট থেকে নেমে বললো, ‘বাবা চল না, সবাই মিলে বেড়িয়ে আসি।’
সৃষ্টিধর বললো, ‘চল। খুব মজা হবে।’
দেবেন্দ্রলাল মাথা নাড়ল, ‘তোমাদের বাবা খায়নি। মা ফেরেনি—’
কুসুম খুব গম্ভীর হয়ে বললো, ‘বাবার অত খিদে পায় না তোমার মত—বুঝলে—’