কুবেরের বিষয় আশয় – ২

॥ দুই ॥

নয়ানদের বাঁধানো বারান্দার কিনারে বলরাম বসে, নয়ান চেয়ারে। কুবের বারান্দায় উঠতে উঠতেই বললো ‘ডাক্তারটি কেবল আড্ডা মারে দেখলাম—তাও আবার আধখানা বয়সের এক ছোকরার সঙ্গে—ওই তোমাদের বিকাশ বোস ছেলেটা —‘

‘কিছু না, কিছু না—রুগীদের কাছে পয়সাও নেয় শুনেছি। জুটেছে আর ওই এক ফোক্কড়।

‘আমাকে যেতে বলে খানিক বসিয়ে রাখল শুধু—’

‘পাওয়ার দেখালে আর কি! যাওয়াই ঠিক হয়নি আপনার।’

কুবের আজ কিছুকাল কদমপুরে যাতায়াত করে। এখানকার লোকজন, জায়গা—জমি, ধানের ফলন, পঞ্চায়েত ইলেকশন—সব কিছুর খানিক খানিক জেনেছে। অথচ একবারে ঘরবাড়ি করে বসতে না পারায় সব কিছুর সঙ্গে পুরোপুরি জড়াতেও পারছে না নিজেকে। সেই শালকে থেকে এত দূর আসে দু’-তিন ঘণ্টার জন্যে। আবার ছুটে গিয়ে ট্রেন ধরতে হয় তাকে—আবার কলকাতা, ট্রাম-বাস-অফিস —কত কী।

‘বলরামদা আর ভোগা দিও না ভদ্রলোককে। তোমাদের এখানে আসবেন, তোমার খুড়োর দরেই জমিটা ছেড়ে দাও।’

বলরাম খানিক হেসে বললো, ‘আমি কি করবো বলুন, লোকেই তো দর বাড়িয়ে দেয়, আমি তো বাড়াইনি—’

কথাটা সত্যি। যার জমি সে তো হপ্তায় হপ্তায় দর চড়াতে পারে না। লোকজন এসেই চড়ায়। ফি ছুটির দিন কতো লোক এসে, খালপাড় ধরে জায়গা দেখতে দেখতে যায়। দর-দাম শুনলে কার না মনটা দপ্‌দপ্ করে।

‘তবু ভাই কিছুটা লাভ না-হয় ছেড়ে দাও। দু’চারশো টাকা, আমি এখানে এলে অন্য দিক থেকে পুষিয়ে দেব তোমায়।

‘বাজার যা বলে তাই দেবেন—’

এই এক কল। খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু বাজার যে রোজ ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কুবেরের ভারি অস্বস্তি লাগল। রোজই আসে প্রায়—এসেই শুধু জমি কেনার দরদস্তুর, দাগ-নম্বর কিংবা না-দাবি লেখানো—এসব নিয়েই কথা চলে। নয়ানের নিজেরও তো জীবন আছে।

আজ আর কথা বাড়ালো না কুবের। বলরামও উঠি উঠি করছিল। এখন ভর সকালবেলা—জোর বাজার বসেছে।

নয়ান ভেতর থেকে চা-বিস্কুট নিয়ে এলো। বলরাম ট্যাঙট্যাঙ করতে করতে রাস্তায় গিয়ে উঠলো। কুবেরের মাথায় এখন খাল পাড়ের মাঠখানা দুলছে। অন্য কেউ কেনার আগে তাকে সবটা কিনে ফেলতেই হবে। জায়গার নকশা পাওয়া এক ঝকমারি। আপত্তি ওঠায় মৌজা কে মৌজার নকশাই বাতিল। ডি.এল.আর অফিসে একতলায় সিঁড়ির নীচে একজন মুহুরি সেই বাতিল নকশা বেশী টাকায় ঝাড়ে। নকশা পেলেও সাবেক আর হাল দাগ মেলানো বাকি থাকে। সব শেষে চাই খাজনার হাল দাখিলে। খাতন, দাখিলে—কোন জায়গাতেই কুবের সব শরিকের নাম পায়নি। সর্বত্র লেখা বলরাম গং, ভুবন গং, সূর্যোধন গং। অর্থাৎ দিগর। সব জমিই শরিকানি. অতএব দিগর থাকবেই। কিন্তু সেই দিগরের মধ্যে কে কে লুকিয়ে আছে বের করে কার সাধ্য। যে জানে, পয়সা না খসালে সেও মুখ খুলবে না।

ক’মাস আগে নয়ানই তাকে ডাঙায় তুলে এনেছিল। না হলে আজও বোধ হয় কুবের মেদনমল্ল মৌজার দাগ নম্বরে নম্বরে জল খেয়ে বেড়াতো। এতো দিন হাবুডুবু খেয়ে তার ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়ার কথা। সারাটা দেশ এমন দাগ ন’র দিয়ে খুঁটে খুঁটে তোলা যায় ভাবলেই পায়ের নীচে মাটি খুলে যাচ্ছে এমন মনে হয়।

‘আপনারা ক’ঘর বসে গেলে দেখবেন রাস্তা আপনা-আপনি ভাল হয়ে গেছে। আলোও এসে যাবে বছর খানেকের ভেতর।’

‘তা আসবে। কিন্তু, বলরাম আর ক’দিন ভোগাবে বলতে পার?’

‘হয়ে এলো। আপনার ফের কেটে যাওয়ার মুখে।’

‘কাটলেই ভাল–’

‘অতটা মুষড়ে পড়বেন না। জায়গাটা কেমন দেখতে হবে তো। বাবা আপনাকে গোড়াতেই ডিসকারেজ করেছিলেন—এদিকে না আসতেই বলেছিলেন।’

তা ঠিক। প্রথম দিনই নয়ানের বাবা পইপই করে বারণ করেছিলেন—’এদিকে আসবেন না, লোকজন সব মামলাবাজ, তাড়ি খেয়ে গজল্লা বাধাবে রাত—দুপুরে—শেষে তিষ্ঠোতে পারবেন না

তা সে অসুবিধে কোথায় নেই। কান্তবাবু এখন কুবেরকে তুমি বলেন। একসময় হাজার বিঘের লোনা ভেড়ি জমা নেওয়া ছিল। রাখতে পারেননি। বাঁধ কেটে জল বেরিয়ে গিয়ে সেখানে এখন ধান হয়। ফসল তোলার পর কলাই মটর ফেলে দেন সেখানে। মাস গেলে মোটা টাকার সরকারী মাইনে। পুরু চশমা লাগিয়ে মাঝে মাঝে কুবেরের কাগজপত্রও দেখে দেন। সে সময় তাঁর কাছে নানান দরের চাষী আসে। কেউ চায় পুকুর জমা, কেউ সুপুরি-নারকেল গাছ, কেউ আবার ধান তোলার পর সেখানকার মাটি খুবলে ইঁদুরের গর্ত থেকে চোরাই ধান তুলে নেওয়ার আর্জি নিয়ে আসে। কুবের এক দিন কথা বলতে বলতে দেখেছে কান্তবাবুর শার্টের কলারের ভেতর ‘মৃণাল’ ছাপ রয়েছে। এসব শার্ট ধর্মতলায় তিন টাকা সাড়ে তিন টাকায় ফুটপাতে গুচ্ছের বিকোচ্ছে।

‘আজ উঠি নয়ান। ন’টা আটত্রিশের ট্রেনটা ধরতে পারলে সকাল-সকাল পৌছানো যাবে।’

তাড়া কিসের। খাওয়া-দাওয়া করে দুপুরের ট্রেনে যাবেন। নয়তো বাস তো আছেই।’

‘আছে ঠিকই।’ কিন্তু দু’দিকের ধানক্ষেত ঘুরে বাস যখন এগোয় তখন নির্জন পিচেররাস্তায় টায়ার থেকে একটানা বিজবিজ, বিজবিজ শব্দ হতে থাকে। তার হাত থেকে নিস্তার নেই। চলতেই থাকবে। কুবের একদম সহ্য করতে পারে না। এর চেয়ে ট্রেন ভাল। আধঘণ্টা চল্লিশ মিনিটে শেয়ালদা।

নাঃ! উঠি আজ। কাল বোধহয় কয়লাঘাটে ফোন করতে পারি তোমায়। অন্য দাগগুলোর খতেন পেয়ে গেলে শরিকানি বুঝে নেব তোমার কাছ থেকে।’

‘আমি কি পারব! সবাইকে চিনিও না—’ নয়ান হেসে ফেলেছে। হিন্দু আইনের পর ভাইয়ের সঙ্গে বোনেরও সমান অংশ। আট বছরের মেয়ে বিয়ে হয়ে ভিনগাঁয়ে চলে গেছে সেই কবে। বত্রিশ বছরের কালে কোলে বাচ্চা নিয়ে এসে টিপ-ছাপ দিতে এলে কে চিনবে তাকে—কে সনাক্ত করবে—কে বলবে এই সেই আট বছরের বৃহস্পতিদাসী জওজে ভদ্রেশ্বর নস্কর, সাকিন নাটাগাছি। অন্ধিসন্ধির কোথায় কোন্ বড় ফাঁক থেকে গেল, কুবের তা আজকাল বোঝে।

নয়ানের পরের ভাই ভোম্বল বহরিডাঙ্গা রেজিস্ট্রি অফিসে বলরামের খুড়োর অংশ কোবালার দিন কুবেরের সঙ্গে সনাক্ত করতে গিয়েছিল। কুবেরকে ন’ছটাক চৌদ্দ তিন জমি তিন দিয়ে ভাগ করে মুখে মুখে দুই দিয়ে গুণ করতে দেখে ভোম্বল বলেছিল, ‘আপনি পাগল হয়ে যাবেন—এতো হিসেব, দর—এসব দিয়ে হবে কী! কলকাতায় এর চেয়ে ভালো থাকেন না?’

আচমকা এ কথায় কোন উত্তর দিতে পারেননি কুবের। সত্যিই কি একটুখানি ভাল থাকবার জায়গা বানাতে গিয়ে সে আগাগোড়া বিষয়ে ডুবে যাচ্ছে।

‘না-হয় তোমার বাবাকে দেখাব। শনিবার আসছেন তো তিনি—‘

‘বসুন না আপনি। এখনও পনের মিনিট দেরি ট্রেনের। সরু পিয়াসলে থেকে নটার গাড়ি আসবে।

ফিরে বসতে গিয়ে নিজের হাতখানাই আগে চোখে পড়ল কুবেরের। আঙুলের খানিকটা খানিকটা কালো হয়ে আছে। পায়ের গোড়ালিও কালটি মেরে যাচ্ছে। দেখা মাত্র আর বসে থাকতে পারল না। সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘বসুন তো আপনি। ভাল পেঁপে হয়েছে। ভোম্বলকে কাটতে বলি—‘

অথচ এরা যদি কোন দিন শোনে কুবের সাধুখাঁর হাতের কালো কালো দাগগুলো খারাপ অসুখের, তা হলে কী আর বাড়ির কাপে চা দেবে, প্লেটে পেঁপে! কুবের মনে মনে স্থির করল, আমার কোন খারাপ অসুখ হয়নি। হওয়ার কথা নয়। থাকলে তো অনেক আগেই ধরা পড়তো।

এক্ষুণি যদি জানা যেতো, তার ঠিক কী হয়েছে আঙুলে। ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি, ভেজাল তেলের আফটার এফেক্ট কিংবা নিদেন পক্ষে চামড়া খারাপ হয়েছে।—এমন একটা রায় এখনই জানতে পারলে কুবের বেঁচে যেত।
.

এ্যালসেসিয়ান ঘুমোচ্ছে। দূরে পাঁচ রাস্তায় জোঁকার বাস এসে দাঁড়াল। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে কন্ডাক্টর কুমড়ো নামাচ্ছে। সামনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে পুরো একটা সাপুড়ে পরিবার মৈত্রী আবাদের দিকে চলে গেল। কিছুদিন পরেই ধেনো কেউটে ধরার সময়। এর পর সেই যে গর্তে ঢুকবে-ফাল্গুন-চোতের ফুরফুরে হাওয়া দেওয়ার আগে আর বাইরেই আসবে না। বসন্তকালে হাওয়া খেয়ে খেয়ে চন্দ্রবোড়া তো ফুলে ফুলে ওঠে—তখন চলাফেরার গতিকও মন্দ। নয়ানের মুখে শোনা, বাড়ির ঝি যশোদা নাকি গত অঘ্রাণে গরুর খড় কুঁচোতে গিয়ে একটা আস্ত গোখরো বঁটিতে কুঁচিয়ে ফেলেছিল। খড় কোটার বঁটি কালচে রক্তে সড়সড়ে হয়ে গিয়েছিল। যশোদা নাকি তাতে ভ্রূক্ষেপও করেনি, দিব্যি ঘাটতলায় গিয়ে সাবানে হাত ধুয়ে গোয়ালে ধোঁয়া দিয়ে এসেছে।

আজই বিকেল-বিকেল শিবপুরের টি.ডি. মুখার্জীকে আঙুলগুলো একবার দেখাতে হবে। পেঁপে খেয়ে জল খাওয়া গেল না। সিগারেট ধরিয়ে কুবের বেরিয়ে পড়লো। নয়ান বারান্দা থেকেই বললো, ‘এদিককার খবর আপনাকে ফোনে অফিসে জানাব।

‘দশটার পর ফোন করো।’

.

ট্রেনে জানলার ধারে বসল কুবের। আজও একটা সি.এল. গেল। এ বছর সব সুদ্ধ ন’দিন ক্যাজুয়াল লিভ নিতে হয়েছে তার। আজকাল বুলু স্পষ্টই বলে, ‘তোমার কদমপুরের পাট কবে চুকবে বলতে পার?’

কুবের তাড়াতাড়িই মেটাতে চায়। কিন্তু মিটছে না। তার ওপর সাত আটজনের জমি কিনিয়ে ভাগ করে দেওয়ার ভার রয়েছে। কেনাই শেষ হলো না এতদিনে! সরু পিয়াসলে আজ স্পেশাল চেক্। কালো কোট, লাল টাই, চেকারদের হাতে ফাইন করার বই। পকেট থেকে মান্থলি বের করে সইয়ের জায়গায় সই করল কুবের। বয়েস লিখল বত্রিশ। তার এখনও বত্রিশ হয়নি ঠিক—মাস চারেক বাকি। ভাঙা হিসেব লিখতে কার ভাল লাগে।

গোড়ায় কুবের একাই এসেছিল এদিকে। তখন তার সঙ্গে থাকতো বুলু। দুজনের কী সখ। একবার নস্করদের বড় ছেলে জমি দেখাবে বলে দুজনকে মে মাসের ভর-দুপুরে খড়খড়ে শালী জমির ওপর দিয়ে আধ ক্রোশ হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে তার সঙ্গে এখন সাত আটজন একই জায়গায় একলপ্তে জমি কিনেছে। দর শুনে সবার চোখ একেবারে চক্‌চক্ করে। লোভ। কিন্তু পস্টপষ্টি ভাবতে গিয়ে কুবেরের কষ্ট হয়। লোভ কেন? সবাই বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বাস করতে চায়।

রুদ্রনগরে এক মুড়িওয়ালা ওঠে রোজ। লঙ্কা নেই, আদা নেই, তেল নেই—তবু মুড়িওয়ালা। কয়েকটি টিনের কৌটো, নুন আর কালচে খানিকটা আমের আচার। তাই সে দশ পয়সা করে বেচে। লোকটাকে পেলে হতো।

.

চলতি ট্রেনেই হাতল ধরে একটা লোক উঠে এলো, ‘কি রে সকাল যাওয়া হয়েছিল?’ গৌরবে আহ্বান। কুবের বুঝল অভিমানের কথা, ‘মিড্‌ ট্রেনে। আপনি কোত্থেকে?’

‘কদমপুর থেকেই। আমি আবার কোথায় যাব?’

কুবের তাকিয়ে আছে দেখে বললো, ‘ছিলাম পিছন দিকে—মাছের গন্ধে কে বসতে পারে। পাল্টে যেটায় উঠলাম, সেটায় এক বৈরিগি পয়সার জন্যে হরদম গাইছে—

‘পড় য়া আমার জগাই মাধাই
তাহে গৌর আমার হেডমাস্টার—’

মাঝখানে থামিয়ে দিলে কুবের, ‘আপনিও তো বৈরিগির আলখাল্লা ধরেছেন। আপনাকে দেখে কেউ যদি কামরা পালটায়?’

থতমত খেয়ে গেল ব্রজদা, তারপর ঝপাং করে বলে দিলো, ‘তুই যেমন কদমপুরে আমার বাড়ির রাস্তা মাড়াসনে—কেমন তো।’

‘না না, আমি যাই না হাতে সময় থাকে না বলে। নয়ানদের বাড়ি কথাবার্তা বলে প্রায়ই দৌড়ে ট্রেন ধরতে হয়—’

‘বুঝি রে বুঝি সব—’ তারপর নিজেই মাথা দুলিয়ে হাসল, সঙ্গে গুনগুন করে গাইল—শেষে আসন করে বসে ঝোলা থেকে প্রুফ নিয়ে ডট পেন বের করে ব্রজদা তাতে ডুবে গেল.

কুবের অনেক কিছু বলতে পারতো। কোনোটাই জোরালো শোনাবে না বলে চুপ করে গেল। ব্রজ প্রুফ থেকে মাথা না তুলে একবার শুধু বলল, ‘কতদূর এগোলি?’

‘বলুন কতখানি পেছোলাম!

একবার মুখ তুললো ব্রজদা, ‘কেন? বেশ তো এগিয়ে গেছিস। একটু আধটু যা খবর পাই—’

‘রাগ করো না ব্রজদা। তুমি তো জায়গা-জমি ছেড়ে এসেছ তাই এর মর্ম বোঝ না। এক ছটাক কিনতে গেলে ন’মাসের ধাক্কা—কোন জমি পরিষ্কার পাবে না, শতেক শরিকানি—তারপর মর্টগেজ এখন সাফ কোবালা। নতুন ফল হয়েছে এগ্রিমেন্ট। কোথায় যে পেছনের তারিখ দিয়ে চুক্তি করে রাখবে তার ঠিক নেই। কিনেও শান্তি নেই—শেষে মামলার শত হাত জলে—‘

‘থামবি—’, দাবড়ির মত চেঁচালো ব্রজদা, ঠাকুরঝিতে নেমে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে মেশা যায় না—কী হয়ে গেছিস ক’মাসে। কী সব বললি তড়বড় করে এতক্ষণ! নে সর—এক নম্বরে ইন করল আজ—’

গাড়ি থামতেই ব্রজদা লাফিয়ে নামল, ‘তোর বউদিকে না তুই অম্বলের ওষুধ দিয়ে আসবি বলেছিলি?’

‘ও! কালই দিয়ে আসব। আজকাল কেমন আছেন বউদি—হাঁটা চলা?’

‘সারা দিন হাঁটছে। আমি তো বাড়ি পালটেছি—সেখানে না হেঁটে উপায় নেই। বড় বড় ঘর-বিরাট ইঁদারা, এক মাইল নীচে জল-পাতাল থেকে আসে, সত্যি বলছি!’

‘মিথ্যেও বল তাহলে?’

‘কখোন?’

‘মাঝেমাঝে! মানে কখনও কখনও—’

‘কোথায়?’ কবে দেখলি? এই দেখ চুপ করে আছে বাবু। বল না’, শেষে আপনা-আপনিই বললো, ‘আমি তো ফকির-–’

‘ফকির না কচু!’ রাগাবার জন্যই কুবের বললো। কিন্তু কোন ফল হলো না।

‘তাড়াতাড়ি বলে ফেল এইবেলা। ডাউন দিয়েছে—’

‘তুমি বলে আর সভাসমিতি কর না?’

‘কোথায় দেখলে?’

‘দেখিনি, শুনেছি। কদমপুর বাজারের মাঠে আজকাল সন্ধ্যের দিকে সভা করে তুমি গান গাও, গীতা বিক্কিরি কর।—সত্যি কি না?’

‘সে তো সার্ভিস—’

‘বউদিকেও নিয়ে যাও বলে—

‘যায়। যাবে না কেন? সারা দিন বাইরে থাকি—আমার সঙ্গে যেতে পেলে খুব ভালবাসে—একদিন তুই এসে কলকাতা নিয়ে যাবি?’

‘খুব। কোথায় যাবেন?’ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ব্রজদা চেঁচিয়ে বলল, ‘মাথা ভেতরে নে। ইলেকট্রিকের পোস্টে লেগে যাবে—’

মাথা ভেতরে এনে জায়গায় বসে ব্রজ ফকিরকে আর দেখা গেল না। পায়ে নাগরা, ওপরে রাঙানো আলখাল্লা, পরনে লুঙির মত রাঙানো ধুতি, মাথায় বাবরি, কাঁধে ঝোলা—সামনে আড়াল না পড়লে এসব দেখা যেত।

ঝোলায় কি আছে কুবের জানে। গুচ্ছের প্রুফ। রুদ্রনগরে এক ভাঙা প্রেসে শুধ লন্ড্রির বিলই ছেপে বেরোয়। মান্ধাতা আমলের তিন কেস টাইপ আছে। ব্ৰজদা নিজেই বলেছিল। সেখানে ট্রেডল মেশিনে আজ পাঁচ বছর ধরে ছাপা হচ্ছে ব্রজ ফকিরের বাবার আত্মজীবনী। লেখক–ব্রজ ফকির। বিষয় বাবা। ভদ্রলোক বছর দশেক হল গত হয়েছেন। মহাগুরু নিপাতের বছরটি ব্রজদা পুরো বারো মাস ন্যাড়া ছিল। গোড়ার দিককার ছাপা হলদে হয়ে গেছে। আজও পুরো লেখা বই হয়ে বেরুলো না। ব্রজদা শেষ করে উঠতে পারেনি।

.

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়—দেড় দু’ বছর হবে। নারায়ণ পুজো করতে এসে একদিন বিকেলবেলা ঠাকুরমশাই বলল, ‘ভাটিখানার ওদিকে সিরিটি ছাড়িয়ে একখানা একতলা বাড়ি আছে, পাঁচ কাঠা জমির ওপর। নেবেন?’

কোত্থেকে নেবে কুবের। অল্পদিন হল স্যান্ডেল ছেড়ে গ্লেজকিটের পাম্প ধরেছে। চামড়ার বাইরে পায়ের মাংস আরামি লোকের কায়দায় ফুলে থাকে খানিক। কোঁচা পকেটেও রাখে, কোমরেও গোঁজা। খুব বেশি একখানা হারকিউলিস নয়তো হাতটানা রিকশা কিনতে পারে।

ঠাকুরমশাই কুবেরের ভারি গাল দেখে হয়ত মালদার পার্টি ঠাওরেছে তাকে, জলের দরে কুবেরবাবু—জলের দর। আমার সম্বন্ধীর বাড়ি বাদিপোতা—সেখান থেকে খানিকটা ভেতরে—

বুলু দাঁড়িয়েছিল সামনে। বুলুর বড় বাড়ির সখ। সখ মেটানোর মত টাকা কুবেরের নেই। তবু, কিনব বলে বাড়ি দেখতে যাচ্ছি—এই নামে নামে দুজনে আধখানা কলকাতা ঘুরে আসা যাবে। ঢালাই ব্রিজ পেরোবার সময় বুলু হাত তুলে গঙ্গা প্রণামও সারবে। ফাইন—

তিন চারদিনের ভেতর এক বেস্পতিবার ভোরের ডিউটি সেরে বেলাবেলি খেয়ে নিল কুবের। তারপর বুলু বিয়ের জরদ রঙের বেনারসীখানা পরল, কুবের পাম্প সু-র সঙ্গে আটচল্লিশ বহরের ধুতি।

আদি গঙ্গার ওপর কংক্রিটের ঢালাই ব্রিজ পার হয়ে বাঁ হাতে ভাটিখানার পথ। তারপর সিরিটি। খানিক দূর রিকশাসাইকেল এগোনোর পর কুবেররা এমন জায়গায় এসে হাজির হল, যেখানে আর কলকাতা নেই। শুধু খোয়ার রাস্তা। মাঝে মাঝে হোগলা বন—খানিকটা ডাঙা জমি, একটা রঙের কারখানা—তারপর চার পাঁচখানা ইটের স্ট্রাকচার। বাড়ি বলা মুশকিল। একখানা শুধু ইটের পর ইট সাজিয়েই বানানো—ভেতরে কোন মসলা নেই—ঝড় উঠলে পাছে উড়ে যায়, তাই ওপরের করোগেটে আধলা ইট চাপিয়ে ছাদ বানানো হয়েছে। সেই বাড়িখানাই ঠাকুরমশাই দেখাল। পাঁচ কাঠার ভেতর অনেকটা জায়গা মাটি কেটে উঁচু করার জন্যেই লাগানো হয়েছে। আসলে স্ট্রাকচার কোনক্রমে আধ কাঠার কিছু বেশি।

কেনার টাকা নেই, থাকলেও এ জিনিস কুবের কিনত না। বুলুও দেখেশুনে মুষড়ে পড়ল। ঠাকুরমশাই অনেকক্ষণ বাড়িখানার প্রশংসা করছিল। কুবের দাবড়ি দিতে থামল। মাঝখান থেকে গাড়িভাড়ার তিনটে টাকা জলে গেল।

ফেরার পথে ঠাকুরমশাই বলল, ‘আর একটু যদি পেছনে যান তা হলে ছ’শো টাকায় বিঘে পাবেন। হাজরা মোড়ের এক বড়ো ডাক্তার আড়াই শো বিঘে কিনে লেক কাটাচ্ছেন—পরে প্লট করে বাজারে ছাড়বেন।’

সেদিন আর বুলুকে কিছু বলল না কুবের। ছুটির দিন দেখে একাই গেল। ছ’শো টাকা বিঘে কোথায়—শালি জমির বিঘেই দশ বারো হাজার। এক জায়গায় উঁচুমত কাঠা তিনেক জমি পাওয়া গেল—মোট দাম চব্বিশ শো, পাশে দু’চারখানা বাড়িও হয়েছে।

বুলুকে নিয়ে একদিন দেখিয়ে আনল। যার জমি সে উত্তরপাড়ায় থাকে। লোকাল দালালই সব কথা চালালো। বুলুর মন্দ লাগেনি জায়গাটা। কিন্তু কেনার মত টাকা কোথায় পাওয়া যায়। বুলু মোটামুটি একটা আন্দাজও করে ফেলেছে, কী ধাঁচের বাড়ি হবে। কুবের এসব ভাবনায় বাধা দেয়নি। আলোচনাতেই কত সুখ—হলে না জানি আরও কত!

শেষ পর্যন্ত জায়গাটা কেনা হল না। কারণ, টাকা পাওয়া গেল না। বুলুকে সে কথা বলা গেল না, মাকে না, বাবাকেও না। মুখে বলল, ‘আটশো টাকা করে ওই জমির কাঠা কে কিনবে?

.

বুলু একদিন হাসতে হাসতে বলল, ‘জমি না হোক—দেখতে গিয়েও সব মিলিয়ে আঠারো উনিশ টাকা বেরিয়ে গেল। এই টাকায় তোমার একটা রেডিমেড পাঞ্জাবি, হ্যান্ডলুমের ধুতি হয়ে যেত—’

ক্লিন হিসেব। কথা বলার সময় ঘরে কেউ ছিল না। এর পর বুলু কী বলত কুবের জানে। ‘নগেনবাবুর ছেলের বউর মত একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক আনবে?—সাতাশ ইঞ্চি সাইজেরগুলো আঠারো উনিশ টাকা—’

.

এসব কথা অনেকবার বলেছে বুলু। এবারও বলত। চারদিক তাকিয়ে ঠিক ঠোঁটের ওপর বড় একটা চুমু বসিয়ে দিল কুবের। তা সরিয়ে দিয়ে ঠিক যখন ট্রাঙ্কের কথাটা পাড়তে গেল বুলু—তখন কুবের বেশ জাপটে বুলুর কাঁধ কামড়ে ধরলো। ভালবাসার লাইনে কতরকম যে আছে। যা ইচ্ছে একটা করে দিলেই তা লেগে যায়। অন্তত কুবের তাই মনে করে। মাথার তেল, কয়েকটা চুল ভিজে—তবু ছাড়ল না কুবের।

তখন বুলু, ‘ছাড়বে?’ বলে এক ধাক্কায় কুবেরকে সরিয়ে দিল।

বিকেল ছিল। ট্রাম চেঁচাচ্ছে, প্যাসেঞ্জর চেঁচাচ্ছে, ঠেলার আগা রাস্তার জন্যে বাসের পেছনে সামনে খোঁচাচ্ছে-বিকেল বেয়ে ঝুলন্ত ধোঁয়া সমস্ত বাতাসটুকু শুষে নেবার তাল খুঁজছে। ঠিক এখন যদি এক বিঘের ওপর তাদের একটা বাড়ি থাকত (বাবার জন্যে ছোট হামানদিস্তেয় শব্দ করে পান হেঁচছে ঝি),-গ্রিল দেওয়া জানালা (পশ্চিমের জানালাটার চোখ কানা-এক চৌকোয় কোন কাঁচ নেই), চাঁদোয়া টানাবার জন্যে দোতলায় ছাদ (এ বাড়ির ছাদে হনুমানরা এসে নিয়মিত এরিয়াল ছেঁড়ে), হলঘরের মত টানা বারান্দা (কুবের বারান্দায় দাঁড়ালেই ট্রামবাসের সঙ্গে এ বাড়ি কেঁপে ওঠে—খুব আনসেফ লাগে তার)-শীতে, বর্ষায় চিক নামিয়ে ঘর বানিয়ে ফেলা যায়—

সবচেয়ে ভাল হত, বাড়ির সামনে যদি মাঝারি একটা নদী থাকত। খ্যাপা নদীতে লাভ নেই। বুলুর তা হলে শান্তি থাকত না। সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে কুবের বলেছিল, ‘একুশ বছর বয়স অবধি আমার বড় হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল-একা কখনও বেরোতাম না—’

.

বুলুকে কামড়ানোর পর দিন ভোরে ডিউটি ছিল কুবেরের। হাওড়ার কয়েক স্টেশন পরেই ন্যাশনাল মেটালস্। কারখানা গেট থেকে মেল্টিং শপ সবচেয়ে দূরে—চিমনি এক-স্টেশন আগে থেকে দেখা যায়। একতলায় মাটির নীচে ব্রিক চেম্বার-থরে থরে নানান ইট জাফরি করে সাজানো। কোনোখানার দাম দু’টাকা, কোনোখানা পাঁচ টাকা। এসব কোত্রঙের এক নম্বর ইট নয়—হাজার দরেও বিকোয় না—দূর জাপান থেকেও আনতে হয়। ইস্পাত বানানোর চুলোয় অনেক তাপ চাই। ওপেন হাথ ফার্নেসে স্ক্রাপ, পিগ আয়রন, লাইম-স্টোন, ডলোমাইট, ম্যাঙ্গানিজ সব ফুটিয়ে জল করে ফেলতে হয়। তাই কয়লা জ্বালিয়ে—সঙ্গে হাওয়া মিশিয়ে মাটির নীচে এসব ইট-কুঠুরির ভেতর দিয়ে গরমটা দ্বিগুণ চৌগুণ করে দোতলায় ফার্নেস বেডে ছাড়া হয়। কুবের এখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেল্টার।

সেদিন দোতলায় ফার্নেস বেড়ে দাঁড়িয়ে কুবেরকে অনেকখানি ঘোল খেতে হল। গোড়া থেকেই অন্যমনস্ক ছিল। কাল রাতে গোড়ার দিকে বুলুর মাথাধরা ছিল-শেষ রাতে তাকে খালি অ্যাভয়েড করেছে। শুধু ‘উহু না না, বললাম তো—‘

এমন বুলুকে কুবের কোনদিন চিনতো না।

একবার ট্রেনে উঠে গেলে কারখানা পৌঁছানো কঠিন না। অবিশ্যি মুশকিল হয় গেটে এসে। ইলেকট্রিক ফার্নেস, রোলিং মিল, ফাউন্ড্রি, ড্রয়িং অফিস, রিফ্যাক্টরি শপ, সান্টিং ইয়ার্ড—মায় হিন্দিতে লাল বড় বড় হরফে নাম লেখা মারবেল পাথরের সাবান মার্কা মন্দিরটা অব্দি নরম পাড়ায়। রিফ্র্যাক্টরি শপের সামনে তো একটু বাগানও আছে। রোলিং মিলের ফোরম্যান যখন ট্রেনে ফেরে কুবের তার হাতে পেঙ্গুইনের বই দেখেছে। কিন্তু গেটে এসেও কুবেরের ওপেন হার্থ ফার্নেসে যেতে একদম ইচ্ছে করে না।

.

কারখানা বাড়তে বাড়তে এ-পাড়ায় এসে শেষ হয়েছে। মেল্টিং শপের পরেই হোগলা বন, জলা। সবচেয়ে বিশ্রী, একটা বুড়ো গাছে সারাদিন গুচ্ছের ছাতা ঝুলছে। কুবের বাজি রেখে বলতে পারে—সব ক’টা শকুন বুড়ো। ওদিকে তাকালেই দিনটা গন্ডগোল।

রাতের সিফটের লোক ভোরের হাতে ফার্নেস যখন বুঝিয়ে দিয়ে গেল—তখন ভেতরে তিরিশ টন ইস্পাত ফুটছে। মুশকিল ফার্নেসের ছাদ নিয়ে। গরমটা বেশি হয়ে যাওয়ায় ছাদের সিলিকা ইট খানিকটা গলে নীচের ফুটন্ত ইস্পাতে মিশে যেতে লাগল। চার ব্লেডের ঢাউস ফ্যানের হাওয়ায় পোড়া চুন চারদিকে উড়ছে। দোতলায় ফার্নেসের চাতালে দাঁড়িয়ে বারোবার স্যাম্পেল নিয়েছে কুবের। মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে। ফার্নেসের দরজা ওপরে তুলে ভেতরে পনের হাত লম্বা লোহার চামচ ডুবিয়ে বাটি বাটি ফুটন্ত ইস্পাত এনে সুপার কংক্রিটের মেঝেতে ঢেলে দেখেছে। চোখ বাঁচানোর চশমার কাঁচ নীল। ডাঁটি ঘামের ভেতর গরম ভাপ তুলছে। তিরিশ টন মাল নানান কসরত করে ভীমের বিয়ের সাইজের ল্যাডেলে যখন নামিয়ে দিল তখন দু’টো বেজে পাঁচ। ইভিনিং সিটের লোকও হাজির। পৌনে দু’টোর ট্রেন এতক্ষণে হাওড়ায়—পরের গাড়ি সেই তিনটে দশ।

কোথায় যায় তখন। ওয়েলফেয়ার অফিসার ধনরাজ কিছুকাল ভগবানকে খুব ভালবাসছে। বিশ্বকর্মা পুজোয় যেখানটায় রামযাত্রা হয়—তারই উত্তরে ম্যারাপ বেঁধে ধর্মসভা বসিয়েছে। গত হপ্তায় ছিল কংসপালা—এ দু’দিন বিচারসভা চলছে। সিম্পল তর্ক—রাম বড় না নারায়ণ বড়, কৃষ্ণ না রাধা। শোনা যাচ্ছে, বেয়াড়াদের বশে আনার জন্যেই এতো কাণ্ড। ধনরাজের ভাষায় আনরুলি এলিমেন্টদের ওপর সোবারিং এফেক্ট আর কি—

অনেক মাথার ওপর দিয়ে উঁকি মেরে অবাক। কুবের ঠিক চিনতে পেরেছে, গেরুয়াধারী যে নেচে নেচে গাইছে, ছড়া কাটছে ও তো ব্রজ দত্ত। কত রকমই দেখাল ব্রজদা। ধনরাজের পুরো ব্যাপারটাই যে জুয়োচুরি তাতে আর কোন সন্দেহ থাকল না কুবেরের। না হলে ব্রজদা নাচে যেখানে—

কিছুকালই কুবের পথে ঘাটে আধা-সাধুর পোশাকে ব্রজদাকে দেখেছে। আর পাঁচটার মত সাধুগিরিতেও ব্রজদার কিছু দিন কাটবে—কিন্তু এ যে প্রায় মিশনে আসার মত ঘড়ি ধরে নেচে যাচ্ছে।

ট্রেন ছাড়ার খানিক আগে ব্রজদাই লাফিয়ে ভেতরে ঢুকল। ছোট ঢোল, ঘুঙুর চামর, একখানা পকেট আয়নার ফ্রেমে রাধাকৃষ্ণর পট বসানো—সবই ব্রজদার হাতে, ডানে বাঁয়ে দু দুটি শাগরেদ। কুচো ছেলে দু’টো বেঞ্চে বসেই পা তুলে ঘুঙুর খুলতে বসল।

‘এসে গেছিস?’

কোথায় কুবের জানতে চাইবে আগে তা-না ব্রজ দত্তই পয়লা কথা পাড়ল। কুবের থতমত খেয়েছিল, সামলে বলল, ‘আমায় দেখতে পেয়েছ অতদূর থেকে? তুমি তো স্টেজে লাফাচ্ছিলে?’

‘পস্ট দেখলাম তুই। এখানে কাজ করিস সে তো তুইই একদিন বলেছিলি—’

‘তোমার না চশমা ছিল চোখে?‘

‘কবে?’

‘যখন ম্যাজিসিয়ান ছিলে—

‘সে তো ফলস্!’

শাগরেদ দুটি কুবেরের দিকে জোড় মিলিয়ে হাসল। ম্যাজিকের আমলে এদের দেখেনি কুবের। কত বদল হচ্ছে। সেই সিনেমার পিরিয়ডে কুবের নিজেই ছিল ব্রজ দত্তর সাগরেদ! অনেক আগে।

‘আজকাল থাকা হয় কোথায়?’

‘কাউকে বলবি নে? কদমপুর-’

কুবের নামও শোনেনি কোন দিন। মুখে মুখে চিনিয়ে দিল ব্রজদা। শেষে বলল, ‘ফাইন জায়গা। ঘর ভাড়া আট টাকা—সব সেপারেট—মায় একটা পুকুর অব্দি সেপারেট—তোর বউদি আর আমি একসঙ্গে সাঁতার কাটি, নো ডিস্টারব্যান্স!’

‘সরস্বতী বউদি সাঁতার কাটছে আজকাল?’

‘তিনি তো সিঁথিতে থাকেন।’

‘তবে?’

‘তোর আভা বউদি কদমপুরে থাকেন—’

প্রথমজনার নাম তো আভা ছিল না। তিনি তো বেহালায় আছেন, তাই-ই কুবের জানে। কুবের তাকিয়ে আছে দেখে ব্ৰজ দত্ত বললো, ‘একটা বিয়ে করেছি নতুন—গত চোতে আমাদের মাল্যবদল হল-’

কলকাতার কাছাকাছি আট টাকায় এমন সেপারেট কেলির পুকুর পাওয়া যায়—জায়গাটা নিশ্চয় গোপিনীদের বস্ত্রহরণ মার্কা ক্যালেন্ডার থেকে ব্লেড দিয়ে কেটে এনে বাড়িওয়ালা ব্রজদার জন্যে বসিয়ে দেয়নি। সরস্বতী বউদিকে কুবের চেনে। তিনি সাঁতার কাটার লোক নন। বেহালার বউদির কথা, বললে না-হয় বিশ্বাস হতো। নাম মনে আসছে না। অনেক দিন আগে দেখেছে। সে ব্রজদার জন্যে সব পারে। বিধবা হওয়ার পর পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্রজ দত্তর সঙ্গে বিয়ের আগের দিন পিচ রাস্তার ওপর দোতলা বাড়ি ব্রজদাকেই লিখে দিয়েছে।

‘তোর নতুন বউদি বাউল গাইয়ে পিরেলি দাশের বড় মেয়ে—’

প্রথমজনার কথা হিসেবেই আসে না আজকাল। কুবের বলল, ‘সরস্বতী বউদি?’

‘আছে।’

‘একই বাড়িতে?’

‘পাগল নাকি? দু’দুটো পার্সোন্যালিটি একই জায়গায় থাকতে পারে? তিনি ছেলেদের নিয়ে সিঁথিতে থাকেন।

‘তোমারই ছেলে তো?’

‘হ্যাঁ, দুই ছেলে-বড়টা খুব হেলদি।’

‘খরচপাতি?’

‘সেই চালাচ্ছে। এল-আই-সি’র কাজ তো ছাড়েনি—শুনেছি আমাকে ছাড়ার পর আরও প্রমোশন হয়েছে।’

হাওড়ায় ভিড়ের ভেতর মিশে যাওয়ার আগে অনেক কথা বলল ব্রজদা। আট টাকায় দু’খানা ঘর—তবে টালির ছাদ। স্টেশন কাছেই—শেয়ালদা আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট লাগে। হাতে টাকা থাকলে দু’ পাঁচ বিঘে ধরে রাখত ব্রজদা। ইচ্ছে ছিল একটা আশ্রম বানায়।

জমি দেখার গাড়ি ভাড়া উনিশ টাকা গচ্চা যাওয়ার কথাটা চাপা দিতে সদ্য সদ্য আগের দিন বিকেলে কুবের বুলুর মুখে চুমু বসাতে গিয়েছিল। তেমন সুবিধে হয়নি। ব্রজদার মুখে জমির দর শুনে তখনই কদমপুর যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল কুবেরের। ব্রজদা বললো, ‘কাল ভোরে ছ’টা পঁয়তাল্লিশের ট্রেনে আসিস-’

.

পরদিন ভোরে বুলুকে নিয়ে যখন কদমপুরে নামল তখন প্ল্যাটফর্মে কেবল ব্যাপারীদের ভিড়। ডেলি প্যাসেঞ্জারদের আসল ভিড় তখনও শুরু হয়নি। কালো কালো কাঠের পিপে, কাছে যেতে তাড়ির গন্ধ। পরে শুনেছে, কলকাতায় বড় বড় ভাটিখানার এখানে গাছ জমা নেওয়া আছে। তাদেরই তাড়ি রোজ সকালে পিপে বোঝাই হয়ে কলকাতায় যায়। ভেন্ডারের কামরাটা ডিমে ভর্তি।

সারাটা ট্রেন বুলুকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করেছে কুবের। একটা লোক, তার তিনটে বিয়ে। তিনজনই জীবিত। প্রথমজনকে পাঁচ ছেলেমেয়ে সুদ্ধ বিধবা অবস্থায় বিয়ে করে একখানা বাড়ি পাওয়ার পর সেখানে একটি ছেলে হয়। তখন কুবের ব্রজ দত্তর মালটিকলার ফিল্মভেঞ্চারে অ্যাসিস্ট্যান্ট। বাচ্চাটির বছর দুই বয়স ছিল তখন। সেবার কুবেরকে সঙ্গে নিয়ে ব্রজদা তার জন্যে দরদাম করে ফুটপাথ থেকে একজোড়া মোজা কিনেছিল।

তারও বেশ কয়েক বছর পরে চৌরঙ্গীতে দশাসই এক মহিলার সঙ্গে কুবেরের হ্যান্ডসেক করিয়ে দিয়েছিল ব্রজ দত্ত। তিনি সরস্বতী বউদি। আর আজ যাকে দেখবে তিনি থার্ড। তাঁকে কুবের জানেও না। এরপরেও কুবের বুলুকে বোঝায় কী করে ব্রজদা লোকটা খারাপ নয়। হয়তো ভাল নয়, কিন্তু খারাপ বলে কী করে। কুবের ব্রজ দত্তকে যতটুকু জানে তার সবটাই ধাঁধানো চমকে ভর্তি। জানে আর কতটুকু!

ডিরেকসন মত প্ল্যাটফর্ম শেষ করে কাঁচা পথ ধরে শ’দুই গজ যাওয়ার পর ব্রজদার সবকিছু—সেপারেট সেই পুকুর মায় টালির ঘর পাওয়া গেল। ভাড়া—খাটানোর বারোয়ারি বাড়ি—তবে, দিব্যি খোলামেলা বলে বেশ লাগে।

ব্রজদা ঊরু অব্দি লুঙি তুলে বারান্দায় আসন করে সন্ধ্যে করছিল। চানের পর মাংস মাখানো পিঠে-পেটে জলের ফোঁটা লেগে আছে। কুবেরদের ভেতর নিয়ে বসালো ব্রজদারি তিন নম্বর বউ। বেশ লম্বা, চোখে একটা ঢুলুনি, গলায় কালো পুঁতির ডুমো মালা। বুলুর একটু রাগ হল। বউটি তাদেরই বয়সী। এতটা কেয়ারলেস হওয়ার মানে হয়। কালো ব্লাউজ পরেছে-অথচ পাউডার মাখার পর কী হাল হল দেখার সময় পায়নি। পাউডারের সাদা গুঁড়ো কাঁধে বুকে পড়ে আছে।

বুলুর ওপর ব্রজদার বউ তিন চার ইঞ্চি লম্বা। বুলুর কাঁধ ধরে ঘরে এনে বসালো। ঘরে ঢোকার মুখে কুবের দেখল, নতুন বউদির পায়ে খড়ম।

প্রথম আলাপে যেমন হয় তা সবই হল। বুলু কিন্তু অনেকক্ষণ কাঁটা হয়ে বসে থাকল। কুবেরের একটুও খারাপ লাগল না। বরং পস্ট বলতে পারে, সেদিন ব্রজদা আর তার বউর আন্তরিকতায় একটুও খাদ ছিল না।

‘জমি দেখাবার জন্যে ডেকেছো-দেখালে না?’

বউদি বলাই ভাল। কুবেরের চেয়ে বয়সে ছোটোই হবে। গলায় বেশ ঝাঁঝ।

‘উঠছি।’ কুবেরকে বলল, ‘কিন্তু তুই কি এখান থেকে কারখানা যাতায়াত করতে পারবি? তারপর বউমা আমাদের কলকাতার বাইরে—’

বুলু তেড়েফুঁড়ে উঠল, ‘আমি আবার কবে কলকাতার মেয়ে? অবিশ্যি রেশন এনেছি লাইন দিয়ে মির্জাপুর স্ট্রীটে থাকতে-’

বউদি বলল, ‘দেখাবে তো নিয়ে চল—আমিও যাচ্ছি—‘

‘উহুঁ তুমি বোসো না। হাঁটলেই আবার মাথা ঘুরবে। এতটা পথ হয়ত, শেষে পড়ে টড়ে যাবে—’

‘আমার কথা ভাবতে হবে না—তোমরা এগোও তো—আমি আসছি।’

জমি দেখে ফেরার পথে রেলের ছড়ানো ঝিলের ধারে আভা বউদির সঙ্গে দেখা হল। কদমপুরের মতো জায়গায় লেস লাগানো শাড়ি, অথচ পায়ে খড়ম, কপালে লম্বা করে আবিরের টিপ—ঝিলের স্থির জল ব্যাক গ্রাউন্ডে। বেশ দেখাচ্ছিল।

‘দেখানো হয়ে গেল?’ বলে হেসে ফেলল বউদি। যেন কী মিস করল। নিজেই বললো, ‘জায়াগাটা আপনাদের ভাল লাগবে। এসব জায়গা কী সস্তা ছিল! টাকা থাকলে ঠিক কিনে ফেলতাম।’

‘পাগল নাকি? দু’জন মানুষ আমরা-বাড়ি ঘর করে লাভ কি?’

‘তুমি বুঝবে না।’

আগের দিন ব্রজদা যখন বলেছিল দু-চার বিঘে ধরে রাখতাম, তখনই সন্দেহ হয়েছিল। এমন কথা তো ব্রজদার মুখে বসে না। সেদিন কুবের বুঝল, এ-বচন বউদির।

দর শুনে সত্যি ঘাবড়ে যেতে হয়। একদিন নিশ্চয় জমি আরও অনেক সস্তা ছিল। তবে এখন যখন কলকাতার আশে-পাশে জমির দর চড়া তখন কদমপুরে বোধহয় বাইরের হাওয়া ঢোকেনি। সবাই নিটোল আপেলের কায়দায় নির্দোষ এক তল্লাট খুঁজে পেতে চায় বোধহয়। কোথাও একেবারে নখের দাগও পড়েনি এমন জায়গা।

কয়েক বছর আগেও কদমপুর হয়তো তা ছিল—চারদিকে দেখে তখন ওইটুকু বুঝেছে কুবের।

সীতাকুণ্ড—বেগমপুর বাস রুটের ওপর বাঁ হাতে বিঘে দুই জমি দেখিয়েছে ব্রজদা। জমির মালিক চটিরাম বুড়ো মানুষ, জামাইর বাড়ি গেছে মেটিয়ারিতে-ফিরতে সেই সন্ধ্যে। ঠিক হল ব্রজদাই সব জেনে রাখবে।

ফেরার পথে আবার ঘরে গিয়ে বসল। বসতে গিয়ে বুলু টেবিলের ওপরে বসানো একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি তুলে নিল হাতে, কার?’

কুবের দেখেই বুঝতে পেরেছে, ন্যাংটো দুই ছেলেকে তেল মাখাচ্ছে সরস্বতী বউদি। ফটোর আধখানা জুড়ে একখানা হাত। ভাগ্যিস ক্যামেরায় তেলের ছবি ওঠে না।

‘মেজদির’, কথা বলতে বলতে নতুন বউদি কাজুবাদামের জোড় খুলছিল। অনেক দিন ঘরে কোথায় দু’টো-একটার ভেতর সাদা সাদা পোকা হয়েছে। বাদাম বেছে এনামেলের প্লেটে রাখল। পাড়ার এক রাখাল ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে মিষ্টির ভাঁড় বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে তেমনি ছুটে বেরিয়ে গেল—’ট্রেন আসছে, গরুগুলান মাঠে নামিয়ে, এসে পয়সা ফেরত দেব’খন—’, ছেলেটার ডান হাতে একটা পাচন।

‘আপনাদের দেখা হয় না?’

‘আগে তো এক বাড়িতেই থাকতুম। ছেলে দু’টো আমার হাতে জমা দিয়ে সরস্বতীদি অফিস যেত—’

এখানে কুবের ভেবে নিতে পারলো—কি কি হয়ে থাকতে পারে। প্রধান চরিত্র ব্রজ দত্ত। গান জানে, ম্যাজিক পারে, ইংরিজী বলে ফটাফট—স্মার্ট, তাকে যদি পাশের ভাড়াটের আইবুড়ো মেয়ের ভাল লেগে যায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘আমাকে পেলে ছেলে দু’টো হামলে পড়ে আমারও ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়-সৎ মা হওয়ার আগে থেকেই দু’জনার মায়ের কাজ করেছি কত’—এইখানে এসে ভাঙা বাদাম হাতে জানলা দিয়ে ডিসস্ট্যান্ট সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্রজ দত্তর তিন নম্বর বউ।

‘ব্রজদা যায় না?’

‘আমি যাই—মানে আগে যেতাম, সরস্বতীদি অফিস যাওয়ার পর—’, তারপর নতুন বউদি গুনগুন করে বলল, ‘মেজদির সঙ্গে কেউ বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, যা শক্ত—ভীষণ কঠিন, কী করে যে আপনাদের দাদা পাঁচটি বছর একসঙ্গে ছিলেন-’

ব্রজদা মাথা দুলিয়ে হেসে ক্রেডিট নিল, আরও কতজনের সঙ্গে থাকব দেখো! কষ্ট হলেও আমি ঠিক থেকে যাব! হাতে আমার পাঁচ বিয়ে—’

ব্রজদার মেলে ধরা হাতখানার আঙুলগুলো হলদে। কুবের যখন ব্রজদাকে চেনে, তখন থেকে দেখে আসছে-ব্রজ দত্ত সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে ভেতরে গাঁজা পুরে টানে।

‘নানা—দেখবেন, আপনাদের দাদা আর বিয়ে করবে না’

বুলু আভার গলা শুনতে শুনতে তার সিঁথি দেখল—সিঁদুর নেই, চুলগুলো শুকনো, চোখে সুরমা, শাড়ির লেসের সঙ্গে মানিয়ে ব্লাউজের একদিককার হাতায় লেস লাগানো। পায়ের খড়মের দিকে বুলু তাকিয়ে আছে দেখে আভা বউদি অনেকখানি হেসে বললো, আপনাদের দাদার যা সব বিতিকিচ্ছিরি জিনিসে পছন্দ—!’

‘উহুঁ আমি আরও দু’টো বিয়ে করব—হাতে আছে’, হাত মেলে ধরল সবার সামনে। মুখে হাসি মাখানো। লুঙ্গি আবার হাঁটু অব্দি গুটিয়ে এনেছে। বাবরি ঘাড়ের ওপর দুলছে।

‘তা হলে মেজদির কাছেই ফিরে যেও—’ হাসতে হাসতেই বললো নতুন বউদি, ‘কি শক্ত মানুষ মেজদি-সেবার গটগট করে হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন করিয়ে নিজেই রাতের দিকে গাড়ি ডাকিয়ে টলতে টলতে ফিরে এল—’

কুবের বললো, ‘আপনারা খানিকটা জায়গা কিনে এখানে বসে যান—’

‘আমারও তাই ইচ্ছে। বলুন না আপনার দাদাকে—’

ব্রজদা তখন সুটকেস খুলে তিন-চারখানা অ্যালবাম নামিয়েছে। ফটোগুলো কুবেরের চেনা। কুবেরও অনেকগুলো ছবি এর আগে ব্রজদার নানান ডেরায় নানান বছরে দেখেছে। কোনোটায় ভারতখ্যাত ফিল্ম-ডিরেক্টরের সঙ্গে ব্রজদা আউটডোরে টোকা মাথায় দিয়ে রোদের মধ্যে বসে চা খাচ্ছে, কোনোটায় কালো গায়ে ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড হাতে ব্রজদা ঝুঁকে পড়ে বাও করছে, কোনোটায় টি.বি. প্রেশেন্ট ব্ৰজদা। বুলু একটার পর একটা দেখে যাচ্ছিল। নতুন কতকগুলো ছবি পড়ল। ব্রজ ফকির দীক্ষান্তে ন্যাড়া মাথায় বিশ্বনাথের মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো—এরকম আরও অনেক।

কাজুবাদাম, মিষ্টি খেতে অসুবিধে হল না কুবেরের। কিন্তু চায়ের কাপ দেখে ঘাবড়ে গেল। এইমাত্র যেন পুরনো বাসনের দোকান থেকে চেয়ে আনা হয়েছে। হাতলে ছাতকুড়ো। ব্রজদা কতরকম জায়গা ঘুরছে—থেকেছে। নতুন বউদি না হয় সব মিলিয়ে ব্রজদাকে নিয়েছে। কিন্তু এ কাপে চা খেয়ে বুলু আর তার সারা গায়ে যদি কিছু বেরোয়। নতুন বউদি কেমন শুকনো পানপাতা হয়ে গেছে।

সিগারেট, ধুলো, ধোঁয়া আরও কত কি এই শরীরটার ভেতর ভাঁজে ভাঁজে জমে যাচ্ছে। কুবেরের প্রায়ই ইচ্ছে হয় তার সারাটা শরীর যদি কোন সাইকেল সারানোর দোকানে আগাগোড়া খুলে ফেলে ডবল চেনে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিতে পারত—তাহলে জয়েণ্টে জয়েণ্টে তেল ঢেলে ঘষে মেজে নিত। বলা তো যায় না, এত দিনের মেশিন—কোথায় কী হয়ে আছে। বাঁ হাত উল্টে আঙুলের কালো কালো দাগগুলো দেখল।

একবার ছোটবেলায় টাইফয়েডের পর আর ভালো করে ডাক্তার দেখান হয়নি। অবিশ্যি আর কোন ট্রাবেলও হয়নি। কেবল বাঁ হাতের আঙুলের গাঁটে গাঁটে মরচে পড়ে যাচ্ছে।

চা খেল না কুবের। বুলুকেও খেতে দিল না, ‘তুমি আবার চা খাবে কি—ট্রেনেই তো তিন খুরি খেলে?’

ব্রজদা ওদের দু’টো কাপই নিজের গ্লাসে ঢেলে নিল। বুলু এক খুরিও খায়নি ট্রেনে। কুবেরের মুখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *